ওভারব্রিজের মুখে রিকশা এসে দাঁড়ায়। উষসী, ভাড়া মিটিয়ে ব্রিজের উপর ধীর পায়ে হেঁটে চলে। নীচে দিয়ে, আপাত-নিঝুম প্ল্যাটফর্মকে জাগিয়ে, ব্রিজ কাঁপিয়ে, বাংলা থেকে ঝাড়খণ্ড রাজ্যের দিকে চলে গেল এক্সপ্রেস। তার শেষ কামরার আলো অন্ধকারের মধ্যেও কত উজ্জ্বল। উষসী ব্রিজের সিঁড়ি বেয়ে রাস্তায় নেমে আসে। কয়েক পল দাঁড়িয়ে, স্টেশন মোড়ের চায়ের দোকানে, ঝাঁপ বন্ধ হবার আগে ভিড় করা মুখগুলো দেখার চেষ্টা করে। এই রেল কলোনিতে দাদা-বউদির সংসারে অনাহূত চন্দন এখানে বসে আড্ডা দেয় এ সময়, আর পরের পয়সায় চা খেতে খেতে সব বিষয়ে তার পাণ্ডিত্য প্রকাশ করে। কেবল, উষসীকে দেখলেই কেমন যেন শামুকের মতো গুটিয়ে যায়। মাঝে মাঝে চন্দনকে মানুষ বলেই মনে হয় না। চায়ের দোকানে চন্দনকে দেখে, উষসী গলায় কাশি ওঠানোর চেষ্টা করতেই, চন্দন ঘাড় ঘুরিয়ে উষসীকে দেখে। প্রতি রাতের মতোই উষসী কয়েক পা এগোলেই, চন্দন আড্ডা ছেড়ে, ‘না। অনেক রাত হলো, যাই!’ বলে দোকান থেকে বেরিয়ে আসে।

রাস্তার ধারের কালী মন্দিরে প্রণাম করে রাস্তায় উঠতেই উষসী দেখে, চন্দন দাঁড়িয়ে, ল্যাম্পপোস্টে ঝোলানো আলোর ক্ষীণ রোশনাইয়ের নীচে। দুটো ল্যাম্পপোস্টের ব্যবধান আলোর দূরত্ব কমাতে পারে না। কয়েক পা এগোলেই অন্ধকার। সে-ই অন্ধকারে, রেল কলোনির এবড়োখেবড়ো রাস্তা ধরে উষসী এগিয়ে যায়। পাশে চন্দন, ছায়ার মতো। এ রাস্তা কবে শেষ সংস্কার হয়েছিল কলোনিবাসীর মনে পড়ে না। রাস্তার দু-পাশের সাটার টানা দোকানগুলো নিঃস্তব্ধতাকে আরও নিবিড় করেছে।

—এত রাত করেন কেন?
—ভয় কী! আপনি তো থাকেন।
—সে-ই সকাল থেকে কেবল ছুটেই বেড়ান। সকালে মাড়োয়ারি বাড়ির বিলাসীবালাদের শিক্ষাদান করে, দশটায় ঘরে ফিরে এগারোটায় আসানসোল ছোটেন। সারাদিন পর এত রাতে বাড়ি ফিরলে মা, দাদা-বউদিরা কিছু বলে না?এত পরিশ্রম করেন কেন?
—কী করব? ঘর, সমাজ, সরকার—কেউ তো আমার দায়িত্ব নেয়নি। নেবেও না। ফলে, নিজের দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হয়!—উষসী দীর্ঘশ্বাস ফেলে, তার রাগ হয়। লোকটা সব জানে তবু…!

রেল কলোনির শেষ প্রান্তে পরিত্যক্ত রেল কোয়ার্টাস দখল করে উষসীদের বাসা। বর্ষাকাল ছাড়া বিশেষ অসুবিধা হয় না। দুটো ঘর দখল করেছে দুই দাদা, তাদের বউ ছেলেমেয়ের সুখের জন্য। উষসী আর মা’কে রান্নাঘরে ঠেলে দিয়েছে। এক চিলতে উঠানে অপেক্ষা করার সময় বা ইচ্ছা নেই কারও। দুশ্চিন্তাও। উষসীর ঘরে ফেরার উপর কারও জীবনযাত্রা নির্ভর করে না। সংসারের এই গুরুত্বহীন চরিত্র সম্পর্কে চন্দন জানে। এ সব জানা সত্ত্বেও প্রতিদিন একই প্রশ্ন করায় উষসী বিরক্তই হয়।

তার বলায় যে ক্ষোভের আঁচ তাতে পুড়ে চন্দন বলে,—কাল থেকে আর কোনওদিন এই প্রশ্ন করব না। তারপর মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে, জানেন, আজ এক ভদ্র-ফেরিওয়ালার চাকরি পেয়েছি। স্যুট-বুট পরে কারখানায় ঘুরে ঘুরে কেমিক্যাল বিক্রির কাজ। বেতন প্লাস কমিশন। বছরে একবার ইনক্রিমেন্ট। সঙ্গে পারফরমেন্স বোনাস, প্রমোশন…এ রোব্বার, রাতে, কলকাতা চলে যাব।

উষসী পথ চলতে চলতে ভেতরে ভেতরে উত্তেজিত হয়ে পড়ে। না-চাইলেও ভাবে, সুখী-স্থিত ভবিষ্যতের কথা। মুখে বলল,—দারুণ খবর! কাজটা মন দিয়ে করবেন, দেখবেন একদিন…
—আবার কবে দেখা হবে, জানি না!
যখন আসবেন, রাতে ওই চায়ের দোকানে অপেক্ষা করবেন। দেখা হয়ে যাবে। আপনি এবার যান। এটুকু আমি একাই চলে যেতে পারবো। আপনি কলকাতায় গিয়ে সাবধানে থাকবেন, কেমন!

টিউশনি করে ঘরে ফিরে উষসী চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে রান্নাঘরের জানালা দিয়ে মা’কে দেখে। আপন মনে রান্না করে চলেছে। যেন দিনগত পাপক্ষয়! উষসীর ভীষণ কষ্ট হয়… উষসী চা শেষ করে কাপ হাতে উঠানে এসে দাঁড়ায়। তারপর ঝাঁঝিয়ে ওঠে—প্রতিদিন এই সময় আমি স্নান করি সবাই জানে। আমাকে দেখেই তোমার বড় ছেলের বউ বাথরুমে ঢুকে গেল। তুমি কিছু বলো না কেন? অসহায় মা করুণ দৃষ্টিতে উষসীকে দেখে বলে ওঠেন—বালতিতে জল আছে। গায়ে ঢেলে ঘরে চলে যাও। প্রতিদিন এই নাটক ভালো লাগে না। যতদিন বাঁচবো এই অত্যাচার সহ্য করতে হবে। ভগবান কবে যে মুক্তি দেবে—কে জানে?

উষসী বালতির জল মাথায় ঢালতে ঢালতেই বড় বউ উঠানে এসে দাঁড়ায়। চাইলেই কি মুক্তি পাওয়া যায়? মুক্তি পেতে হলে টাকা লাগে। টাকা না থাকলে কোন ভগবান মুক্তি দেবে? যমেরও অরুচি সব… উষসী জানে, সহ্যের চৌহদ্দি বড় না করলে সারাদিনটাই নষ্ট। ভেজা কাপড়ে ঘরে ঢুকে পড়ে। এবং বড় বউদির একটানা বাক্যবাণেও সে নিরুত্তাপে তার নিজের কাজ সারে, পারদ চটা আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায়। ভেজা চুলে আলতো খোঁপা… পরনে হালকা গোলাপি সিফন শাড়ি, একরঙা ব্লাউজ। মুখে সামান্য প্রসাধন সেরে শেষবারের মতো নিজের প্রতিবিম্ব দেখে, হাত-ব্যাগ কাঁধে উঠানে এসে দাঁড়ায়।


২.

বুধবার। উষসীর ছুটির দিন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও চৈত্রের চড়া রোদে, উষসীকে বাইরে যেতে হয়। সপ্তাহের একটা ছুটির দিনেও ঘরে বসে থাকার উপায় নেই। সকালে যখন বের হয় আর রাত্রে যখন বাড়ি ফেরে তার চাহিদা পূরণের জন্য কোনও দোকান খোলা থাকে না, ফলে, বাজারের ব্যাগ হাতে বের হতেই হয়। সপ্তাহের বাজার, মায়ের ওষুধ, এ ছাড়াও নিজের প্রয়োজনের যা-কিছু সব এই একদিনের ছুটিতে সেরে ফেলা ছাড়া উপায় কী!

বেগুনিয়া মোড় থেকে রিকশায় স্টেশনে এসে, উষসী ব্রিজের সামনে চন্দনকে দেখে অবাক হয়!—আপনি?
—কাল রাতে এসেছি। প্রায় দু-ঘণ্টা হলো অপেক্ষা করছি।
—বাজারে চলে যেতেন! এক সঙ্গে ফিরতাম। দু-ঘণ্টা এখানে অপেক্ষা করতে হতো না। তা এখানে দাঁড়িয়েই বা আছেন কেন, এই ভর দুপুরে?
—এই সাধারণ কথাটাই মাথায় আসেনি। সত্যিই, বোকার মতো দাঁড়িয়ে না থেকে চলে গেলেই হতো।—চন্দনের ঠোঁটের কোণে আলতো হাসি, মাথায় আঙুল দিয়ে বিলি কাটে… যদি রেগে না যান তো, যেটা বলার জন্য দাঁড়িয়ে, সেটাই বলি। মাইনে পাওয়ার পর আপনাকে কোনও ভালো জায়গায় নিয়ে গিয়ে কিছু খাওয়ানোর ইচ্ছা ছিল। যাবেন আজ?
—আপনি তো একাই সব ঠিক করে ফেলেছেন দেখছি। আমার মতামতের কি কোনও মূল্য নেই? বেশ। আমি এগুলো বাড়িতে রেখে আসছি। কিন্তু, সন্ধ্যার আগেই ফিরতে হবে—এখনই বলে রাখলাম।

মালঞ্চ সিনেমা হলের গা-ঘেঁষা সদ্যোজাত রেস্তোরাঁয় খাওয়া সেরে চন্দন উষসীর সঙ্গে রাস্তায় এসে দাঁড়ায়। উষসী রিকশা ডেকে বাড়ির পথে পা বাড়াতেই, চন্দন উষসীর হাত চেপে ধরে, বলে,—এখনও সন্ধ্যা হতে অনেক দেরি। দিপাবলীর রাতের আকাশে যেভাবে আতশবাজির রঙিন আলো ছড়িয়ে যায়, সেভাবেই মুখ-টেপা হাসিতে, ছড়িয়ে পড়ে উষসী। যদিও কথায় কপট রাগ ফুটিয়ে বলে,—চাকরি পাওয়ার পর আপনার সাহস তো দেখছি—জিটি রোডের মতো লম্বা হচ্ছে!

অপ্রস্তুত হয়ে উষসীর হাত ছেড়ে দিয়ে চন্দন বলে,—না, মানে, নদীর ধারে শ্মশানে এক কালীমন্দির আছে শুনেছি। খুব জাগ্রত। যে যা চায়, সে সবই নাকি পায়। একবার মন দিয়ে চেয়ে দেখুন না, যদি পেয়ে যান।
—আমি আবার কী চাইব?
—কেন? মুক্তি!
উষসী প্রায় অস্ফুটে বলে,—মুক্তি! কার থেকে, কীসের থেকে!

তার ছ বছর বয়সে বাবা মারা যাওয়ার পর চারপাশে যে দেওয়াল উঠেছিল, সেটাকে কিছুটা হলেও ভেঙে বেড়োতে তার বহুদিন লেগেছে। পুরোপুরি ভেঙে বেড়িয়ে যেতে পারেনি, কেবল মা’য়ের কথা ভেবে। সরকারি দফতরে নিম্নবর্গীয় কেরানির চাকরি পেয়ে, বড়দা বিয়ে করল। কিছুদিন পরে ছোড়দাও। মাসের শেষের হাতটান থেকে নিস্তার পেতে শেষ উপায় ছিল তার বিয়ে… নাকি বিক্রি! কিন্তু, দেখতে সুশ্রী হলেই যে পাত্র জুটে যাবে এমনটাও নয়। তাই এক-আধটা বিয়ের সম্বন্ধ তার দাদারা নিয়ে এলেও, সে সব চা-পর্বের বেশি এগোয়নি। ধীরে ধীরে তার দাদারা প্রায় ভুলেই গিয়েছে তাকে। তারপরেও, তার স্বাধীন চলাফেরা তাদের অসহ্য হওয়ায় প্রায় প্রতিদিনই বউদিদের শাপশাপান্তের পালা চলতে থাকে। প্রথম প্রথম তীব্র মানসিক এই অত্যাচারে চোখ বেয়ে জল নামতো। এখন আর তেমন অসুবিধে হয় না উষসীর। সে বুঝে গিয়েছে, তার জীবনটাও রেল কলোনির রাস্তার মতোই।

—কী হলো? হ্যাঁ-না কিছু বললেন না যে, যাবেন?
—আমার তেমন কোনও চাহিদা নেই। তবু যাবো, আপনার ইচ্ছাপূরণ করার জন্য।

প্রায় জলশূন্য দামোদর নদের বালির উপর সূর্যের আলো পড়ে রুপোর মতো ঝলকাচ্ছে। বয়োবৃদ্ধ বটগাছের ছায়ায় ঘেরা মন্দিরের নিকটে শ্মশানবন্ধুদের উপস্থিতি জানা যাচ্ছে তাদের কলরোলে। হাওয়ায় ভাসছে গাঁজা-পোড়া গন্ধ। মন্দিরে পুজো দিয়ে উষসী চন্দনের সঙ্গে মন্দিরের সিঁড়িতে এসে বসে। উষসী একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে দামোদরের বুকের দিকে। তারপর বলে ওঠে—মুক্তি পাবো কিনা জানি না, তবে শান্তি পেলাম!
—ধন্যবাদ! এতটা সময় আমার সঙ্গে থাকার জন্য।—স্মিতহাস্যে বলে ওঠে চন্দন।


৩.

সাঁতুড়ি বাসস্টপের সামনে, থানার পাশে দুর্গা মন্দির। দুর্গা মন্দিরের গা-ঘেঁষে শ্যামল গোস্বামীর পৈতৃক ভিটে। বাড়ির সামনে তিনখানা দোকান ঘরের একটি মুদি দোকান, একটি মিষ্টির দোকান। পাশেরটি বন্ধ। সাইন বোর্ডের লেখাও অস্পষ্ট। সাটারের তালা খুলতে খুলতে শ্যামলবাবু বলেন, ওই দুটো আমার দুই ভাইয়ের দোকোন। দিব্যি চলছে। আমিই চালাতে পারলাম না। প্রচুর টাকা ঋণ হয়ে গেল। সিমেন্ট কারখানাটা যতদিন চালু ছিল, ওর সব কাজ আমি করতাম। একদিন মালিক বিনা নোটিশে তালা ঝুলিয়ে পালাল। আমার কয়েক লাখ টাকা গচ্চা গেল। বউয়ের গয়না বিক্রি করে পাওনাদারদের টাকা শোধ করার পর থেকে প্রতিদিন বউ-মেয়ে গঞ্জনা দেয়। নতুন কোনও কাজ নেবার সাহস হলো না আর। তখন থেকে এ ঘরটা বন্ধই পড়ে আছে। তুমি যদি চালাতে পারো—আমি মৃত্যু যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবো!

শ্যামল গোস্বামীর অবস্থা দেখে, কথা শুনতে শুনতে উষসী দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মনে মনে বলে, আমরা দুজনেই মুক্তি পাবো! সাটার খুলে ওপরে তুলতেই, ঘরের ভেতর থেকে ছিটকে বেরিয়ে এল ঝাঁঝালো দুর্গন্ধ। তারচেও বেশি অস্বস্তিকর হয়ে পড়ে উষসীর কাছে পথ-চলতি ও পড়শিদের কৌতূহল। যদিও দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা ছাপাখানার সামনে উৎসুক গ্রামবাসীর ভিড় দেখে শ্যামল গোস্বামীর মুখে বিশ্বজয়ের হাসি। সবাইকে শুনিয়ে বলে ওঠেন,—ছাপাখানা আবার খুলবে। এবার চলবেও। ইনি সব কাজ জানেন! শ্যামল গোস্বামী হাসিমুখে বলেন—এরা সব তোমাকে দেখে অবাক হচ্ছে। ওদের ধারণাই নেই, এই যুগের মেয়েরা কী করতে পারে!

এঁদের এখন এখান থেকে যেতে বলুন। এভাবে হাঁ করে তাকিয়ে থাকলে কাজ করব কী করে?—উষসীর কথা শুনে সামান্য অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেও, বাস্তবকে গুরুত্ব দিয়ে ভিড় হালকা করতে উদ্যোগী হন শ্যামলবাবু।
—ঘরটা পরিষ্কার করাতে হবে। আপনার পরিচিত মেশিনম্যান আছে?
শ্যামলবাবু বলেন,—সে সব চিন্তা নেই। সব ঠিক করে দেবো। আমি খবর পাঠিয়েছি। দু-চারদিনের ভেতর সব ঠিক হয়ে যাবে। হাফ-ডিমাই মেশিন। ব্রিটিশ কোম্পানির। দারুণ ইম্প্রেশন… অভ্যস্ত পদচারণায় ঘরের ভিতরে ঢুকে একটা কাঠের বাক্স বের করে আনেন তিনি। বাংলা আর ইংরাজি ছত্রিশ পয়েন্ট হেডিং টাইপ কিনেছিলাম। ব্যবহার হয়নি। দশ আর বারো পয়েন্ট বাংলা রানিং টাইপ আছে। এগুলো ডিস্ট্রিবিউট করে তুমি কাজ শুরু করতে পারবে। আশা করি এতে তোমার অসুবিধা হবে না। আরেকটা কথা, ছাপাখানার একটা ভালো নাম দিও। সবই যখন নতুন করে হচ্ছে নামটা আর কেন পুরোনো থাকে! এসো, তোমায়, তোমার ঘরটা দেখাই।

অতি সাধারণ ভুলকে কেন্দ্র করে প্রুফ রিডার অতনু সান্যালের সঙ্গে তর্কযুদ্ধকে উষসী এত বড় ঘটনায় পরিণত করবে, অফিসের কেউ চিন্তা করতে পারেনি। উষসী তার কাজ শেষ করে নিজের সিদ্ধান্ত জানাতেই সবাই হতবাক। অফিসের পরিবেশ বদলে যায়। তাদের ক্ষোভের মুখে পড়ে দিশাহারা অতনু ক্ষমা চেয়ে ব্যর্থ হওয়ার পরও আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালায় উষসীর সিদ্ধান্ত বদলের জন্য। চিফ নিউজ এডিটর প্রফুল্ল ঘোষ চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে উষসীর সামনে দাঁড়ান,—রাগের মাথায় কোনও সিদ্ধান্ত নিও না। তুমি নিজেও জানো তোমার ওপর আমরা কতটা ভরসা করি। আর কাজ করতে গেলে ছোটোখাটো ভুল হবেই। অতনুর কথায় রাগ করে আমাদের ত্যাগ করবে, তা হয় নাকি!

উষসীর গলায় ক্ষোভ ঝড়ে পড়ল। আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে আমি কোথাও কাজ করি না প্রফুল্লদা, তা আপনি জানেন। ভাত ছড়ালে কাকের অভাব হয় না। কাউকে না কাউকে তো আপনারা ঠিকই পাবেন। বিভূতিবাবু সে ক’টা দিন নিশ্চয়ই ম্যানেজ করে নেবেন।

ক্যাশিয়ার সমর দাস পরিবেশটা হালকা করতে হেসে ওঠে। তারপর বলে,—উষসী, কাককে কখনও পোষ মানানো যায় না। কাক কখনও দায়িত্বও নিতে পারে না। সে-ই যোগ্যতাও নেই। ভালোমন্দের তফাতও বোঝে না।

আমার বুঝে কাজ নেই। আপনি পেমেন্টটা দেবেন? এরপর আমি বাস পাবো না। সারারাত থাকব কোথায়? রাস্তায়?—উষসীর কথায় সমরবাবু অসহায় বোধ করেন। এখন কীভাবে দেবো? কাল তো তুমি আসছোই!

উষসী আর কথা না বাড়িয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে এসে রাস্তায় দাঁড়ায়। বছর ছয়েক আগে এই অফিসে, মেশিনম্যান রতন দাস বরাকরের এক ছাপাখানায় তাকে কাজ করতে দেখে নিয়ে এসেছিল। তারপর… সপ্তাহের ছ’দিন করে ডিউটি দিতে দিতে এতগুলো দিন পেরিয়ে গেল। কাজটা যদিও এক, তবু, সাধারণ ছাপাখানা আর খবরের কাগজের অফিসের মধ্যে ফারাক আছে। কাজের স্থায়িত্ব আছে। বেতনটাও ভালো। সমাজ সম্মান আর সমীহ দুটোই করে। পথ চলতে চলতে উষসীর মেশিনম্যান রতনদার মুখটা মনে পড়ে যায়। বছর দুই হলো মারা যাওয়ার পর দৈনিক পত্রিকার অফিসে রতন দাসের শূন্যতা দূর করা যায়নি… হাতে ধরে তাকে কাজ শিখিয়েছিল। অল্পবিস্তর তার যা জানা ছিল সে সবই রতনদার ভালোবেসে বলা ধমক দিয়ে বলায় আরও পরিশীলিত হয়েছে। প্রতিদিন সাত ঘণ্টায় আশি লাইন করে তিন গেলি। আট লাইনে এক স্টিক। সন্ধ্যাবেলায় এসে গুনে নিত। এরপর ছাপা হলে, প্রুফ দেখিয়ে, ম্যাটার কারেকশন করে তার ছুটি। আজ সকালে ঘর থেকে বেরিয়ে ভেবেছিল, দিন কয়েক ছুটি নিয়ে সাঁতুড়ি যাবে। যদি দেখে সেখানে কিছু হবার নয়—কাউকে সে বিষয়ে কিছু জানানোর দরকার পড়তো না। বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে উষসী সিদ্ধান্ত নেয় আর যাই হোক, এ পথে আর কোনওদিন ফিরবে না।

সকাল থেকেই সাঁতুড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি চলছিল উষসীর। স্নান খাওয়া সেরে ব্যাগ হাতে উঠানে দাঁড়াতেই, ছোড়দা উষসীর সামনে দাঁড়ায়।
—কোথায় যাওয়া হচ্ছে?
—সাঁতুড়ি। সেখানে একটা ছাপাখানা চালানোর দায়িত্ব পেয়েছি। ওখানে সব ব্যবস্থা করে, মা’কে নিয়ে যাবো।
—জাহান্নামে যেতে হয় তুমি যাও। মা যাবে না। মা’য়ের জন্য তোমাকে ভাবতে হবে না। সে জন্য আমরা আছি। তোমার পাপের বোঝা মা বইতে যাবে কেন? উষসী মা’য়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। বলে,—তোমরা আরও আগে এই দায়িত্ব নিলে, আমাকে এত পরিশ্রম করতে হত না। বেশ তো, উপযুক্ত সন্তানরা বৃদ্ধা মায়ের দায়িত্ব নিলে আমায় আর কী প্রয়োজন? আমি তবে আসি মা। ভালো থেকো।

ঘর ছেড়ে রাস্তায় এসে দাঁড়িয়ে উষসী শুনতে পায়, ছোড়দা চেঁচিয়ে বলছে,—যত সব নাটক! মেয়েমানুষে ব্যাবসা করবে! দেখে নিও তোমরা, দু-দিন পরেই ফিরে আসবে কাঁদতে কাঁদতে। এ বাড়িতে কিন্তু রাস্তার মেয়েছেলের ঠাঁই হবে না—এই আমি বলে রাখলাম!


৪.

মা’য়ের নামে প্রেসের নতুন বোর্ড হয়। বাঁকুড়া-পুরুলিয়া রোডের ধারে সাঁতুড়িতে উষসীর ছাপাখানা ‘ভবতারিণী’ সচল হওয়ার পর ধীরে ধীরে তার চাহিদা বাড়ে। বিবাহ, উপনয়ন, অন্নপ্রাশন, শ্রাদ্ধের নিমন্ত্রণপত্র ছাপানোর পাশাপাশি পাইকারি বড় দোকানের ক্যাশমেমো, স্কুলের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র, রুল-বুক, পঞ্চায়েত অফিসের প্রচারপত্র, কারখানার ঠিকাদারের চালান, এমনকি মাঝেমধ্যে থানার বড়বাবুর কথামতো অফিসের কাগজপত্র ছাপানোর দায়িত্ব অবধি পালন করতে হয় উষসীকে।

উষসী আই-কার্ডের ম্যাটার কম্পোজ করে মেশিনম্যান সুভাষবাবুর টেবিলে ফর্মা রেখে, কেরোসিন তেল দিয়ে হাতের কালি মুছতে মুছতে ম্যাটার বাঁধা দেখে। সুভাষবাবু ম্যাটার মেশিনে চাপিয়ে প্রথম ইম্প্রেশন দেখায়। উষসী স্পেস, লাইন অ্যালাইনমেন্ট কারেকশন করে ফাইনাল প্রুফ দেখে সম্মতি জানায়। ঠিক আছে। চালান। সুভাষবাবু মেশিনের গতি বাড়াতে উষসী সাবানে হাত ধুয়ে কাউন্টারে বসে ঘড়ি দেখে চমকে ওঠে। আধঘণ্টা পরেই কারখানার ঠিকাদার সুরেশবাবু আসবেন। এতদিন ধরে ছাপাখানার পুরোনো মালিক শ্যামল গোস্বামীর সময়কার প্রায় কোনও কাজ না-জানা কম্পোজিটর কাম বাইন্ডার আর মেশিনম্যান নিয়ে ছাপাখানা চালাতে গিয়ে সময়ে কাজ শেষ করতে উষসীকে নানান দুর্ভোগের মুখে পড়তে হয়। তারওপর আছে পাওয়ার-কাটের সমস্যা। তখন জেনারেটর চালাতে হয়। আশপাশের দুয়েকটা কারখানার জন্য এদিকে সাঁওতালডিহি থেকে ইলেকট্রিক সাপ্লাই এলেও, বিস্তৃত অংশে কেরোসিনের লন্ঠন বা হ্যাজাক ভরসা। আর সে চাইলেই যে কাজ জানা ভালো লোক পাবে এমন নয়। পুরুলিয়া বা আসানসোল থেকে তেমন কাউকে নিয়ে আসার সাধ থাকলেও সাধ্য নেই উসষীর।

কাউন্টারে বসে এ কথা সে-কথা ভাবতে ভাবতেই উষসীর মনে পড়ে যায়, দামোদর পাড় থেকে ফেরার পথে সেদিন বিকেলে চন্দনের বলা কথাগুলো। ওভারব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে চন্দন বলেছিল—আপনাকে একটা দায়িত্ব নিতে হবে, বা বলতে পারেন একজনের উপকার করতে হবে। তার জন্য অবশ্য বরাকর যেমন ছাড়তে হবে, আসানসোলের কাজও ছাড়তে হবে। এই ঝুঁকিটা কি আপনি নেবেন?
উষসী অবাক হয়। মানে!
—আমার মামার একটা ছাপাখানা ছিল। কয়েক বছর ধরে বন্ধ আছে। ওই প্রেসের দায়িত্ব আপনি নেবেন? যদি চালাতে পারেন ঠিকমতো—কাজের কিন্তু অভাব নেই।
—বুঝলাম না! যদি কাজের অভাব নাই থাকে, তো আপনার মামা বন্ধ করলেন কেন?
—সবার দ্বারা ব্যাবসা হয় না জানেন তো! আপনি রাজি থাকলে ধরে নিতে পারেন, আপনিই হবেন প্রেসের মালিক। লাভের অর্ধেক মামাকে ততদিন দেবেন, যতদিন না প্রেসটা আপনার নামে করে দেবার মতো লগ্নির হিসেবের টাকা ফেরত পাচ্ছেন তিনি। অবশ্য প্রথম কিছুদিন হয়তো কর্মী হিসেবেই থাকতে হবে। সে-ই কারণে হাজার টাকা মাইনে পাবেন। যতদিন না সবাই আপনাকে চিনে যায়। ওখানে থাকার এমনিতে কোনও অসুবিধে নেই। তবে আপনার প্রয়োজনের সব জিনিস হয়তো পাবেন না। সালতোড় থেকে রঘুনাথপুর পর্যন্ত কোনও ছাপাখানা নেই। ধৈর্য ধরতে পারলে নিশ্চয়ই তার ফল আপনি পাবেন। আমার বিশ্বাস, আপনি পারবেন।
—আমার প্রতি এই বিশ্বাস থাকার কারণ?
—কী যে বলেন! মালিকের উন্নতির জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করতে পারে যে, সে নিজের উন্নতির জন্য পরিশ্রম করবে না, হয় নাকি!
—আর যদি না পারি!
—আচ্ছা, আপনি কখনও ভাবতে পেরেছেন, আমার মতো একজন ঢিলেঢোলা এমন একটা চাকরিতে টিকে যাবে! একান্তই যদি না পারেন আসানসোলের অফিসের দরজা তো খোলা রইল। ফের সেখানে ঢুকে পড়বেন। সে অর্থে আপনার লোকসান নেই কোনও। নিজের চোখে গিয়ে একবার দেখেই আসুন না। আপনার কথা মামাকে বলেছিলাম। মামা প্রথমে বিশ্বাসই করেনি যে, মেয়েরা কম্পোজের কাজ করে। আপনাকে দেখে…
—আপনার মামা আমাকে দেখেছে? কোথায়?
—আপনার কর্মক্ষেত্রে, কর্মরত অবস্থায়। দিন পনেরো আগে। মামা আপনাকে তার হেরে যাওয়া যুদ্ধের সেনাপতি রূপে দেখছেন। আপনার রূপ একেক জনের কাছে একেক রকম। কেউ দেখে সেনাপতি রূপে, কেউ দেখে…
উষসী চন্দনের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে চোখ ফেরায়!
—আপনি এই ঠিকানাটা সঙ্গে রাখুন। আগামী সপ্তাহে সম্ভব হলে একবার যান। আমার উচিত ছিল আপনাকে নিয়ে যাওয়া, কিন্তু…
—কিন্তু, ছুটি পাবেন না এই তো! তা, পথে ঘাটে মানুষজন চলাফেরা করে তো নাকি? আপনাকে অত ভাবতে হবে না। আপনি ঠিকানাটা দিন।

উষসীর ভাবনা-জাল ছিঁড়ল পঞ্চায়েত-সদস্য কার্তিক মণ্ডলের হাঁকডাকে। কালীপুজোর রসিদ বইয়ের অর্ডার দিতে এসে দরাদরি করতেই, উষসী নিজের অক্ষমতার কথা বলে।
—স্যার, ওয়ান টেন লং এক হাজার বইয়ের কাগজের দাম, ছাপানো আর বাইন্ডিং সব মিলিয়ে আপনার দেওয়া রেটে আমার তো কিছুই থাকবে না। আপনারা না দেখলে এই ছাপাখানা চলবে কী করে? গত বছর তো পুরুলিয়া থেকে ছাপিয়েছিলেন। সে-ই রেটও যদি না পাই।
কার্তিক মণ্ডল বলে ওঠে—প্রতি বছর আমাদের এক ওয়েলউইসার রসিদ বই ছাপিয়ে দেয়। এ বছর আর যোগাযোগ করা গেল না।
—স্যার, আমিও তো আপনাদের একজন শুভাকাঙ্ক্ষী। অনুমতি দিলে সে-ই দায়িত্বটা আমি নিতে পারি। আমার আপত্তি নেই। আমারও তো ছাপাখানার প্রচারের প্রয়োজন।
—ঠিক আছে। তবে, আপনাকে সবটা দিতে হবে না। আমি কাগজের দাম দেবো। বাকিটা আপনার! পরশু সকালে দুটো বই নেবো, মনে থাকে যেন।
উষসী স্নিগ্ধ হাসে। সকালে নয়, সন্ধ্যাবেলায় আপনার কাছে পৌঁছে দেবো। আপনাকে আসতে হবে না।

কার্তিক মণ্ডল বিদায় নিতে না নিতেই ঠিকাদার সুরেশ মাহাতোর সাদা স্কুটার এসে ছাপাখানার সামনে দাঁড়ায়। উষসী তার প্রেসের কর্মী বুধনকে পাশের দোকান থেকে চা আর মিষ্টি আনতে বলে।
—আসুন সুরেশবাবু, বসুন। আপনি আবার কষ্ট করে এলেন কেন? নিন, আগে চা খান। তারপর কথা হবে।
—তার মানে, আজও হয়নি! আপনি আমার ব্যাবসা গুটিয়ে ছাড়বেন দেখছি!
—কী যে বলেন! আপনার ব্যাবসা না টিকলে আমারও তো… একদম ভাববেন না। চালান, গেট-পাস, আই কার্ড সব রেডি আছে। সব আলাদা করে সাজিয়ে কাল সকালে আপনার অফিসে পৌঁছে দেবো।
—আপনি যে কী করেন! আপনার উপর এত রাগ হয়…
উষসী হাসে। বলে,—চা খেয়ে নিশ্চিন্তে বাড়ি যান। কাল বিকালে আপনাকে রাগ দেখানোর জন্য ডেকে পাঠাবো।

ঠিকাদার সুরেশ মাহাতো বিদায় নেওয়ার পর উষসী হাঁফ ছাড়ে। বুধনকে বলে,—শুনলি তো! কাল সকালে এসে মালগুলো পৌঁছে দিবি। বুধন অনুগত কর্মচারীর মতো ঘাড় নেড়ে নিজের কাজ করে চলে। মেশিনম্যান সুভাষবাবু উষসীর সামনে এসে দাঁড়ায়। আমি যাব? উষসী ঘড়িতে সময় দেখে সাড়ে ছ’টা বাজে। এখুনি চলে যাবেন? আর এক ঘণ্টা মেশিন চালালে কার্ডগুলো ছাপা হয়ে যেত। ঠিক আছে। সকালে এসে কার্ডগুলো ছেপে দেবেন। কাল সকাল দশটার মধ্যে সব পৌঁছে দিতে হবে। এরপর আর চা খাইয়ে খুশি করা যাবে না। কাস্টমার স্যাটিসফেকশন বলেও তো একটা কথা আছে নাকি!
সুভাষ দাস হাসেন। আপনি এসব ভালো সামলাতে পারেন। শ্যামলদা হলে হতো না।
একজন ভালো কম্পোজিটর পান কিনা দেখুন না। দশ টাকা ঘণ্টা দেবো। আমি আর এভাবে সবদিক সামলাতে পারছি না।
উষসীর কথা শুনে মেশিনম্যান সুভাষবাবু যাবার পথে কেবল বলেন,—আচ্ছা দেখবো!

হরির লুটের বাতাসার মতো মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা কাগজ গুছিয়ে রাখে বুধন, উষসী আয়-ব্যয়ের হিসাব করে, পাশের দোকানের কর্মচারী পঞ্চাননকে ডেকে, সারাদিনের চায়ের দাম মিটিয়ে, ছাপাখানা বন্ধ করার জন্য প্রস্তুতি নিতে গিয়ে চমকে ওঠে!
—আপনি! কখন এলেন?
—জাস্ট নাও! সারপ্রাইজ ভিজিট! আমি পরে আসছি, আপনি ফ্রেস হয়ে নিন।

প্রেস আর ঘরের কমন দেওয়ালে একটা দরজা লাগিয়ে নিয়েছে উষসী। বাইরে দিয়ে আর ঘুরতে হয় না। দশ ফুট বাই পনেরো ফুটের একটা ঘর। পাশে এক ফালি বারান্দা পেরিয়ে বাথরুম। বারান্দায় তোলা উনুন। হাঁড়ি কড়াই। সে এখানে এসে পাকাপাকি ভাবে থাকার পর ওটুকু করা। ঘরের চারদিকে চোখ ফেললে আড়ম্বরহীন একাকী যাপনের চিহ্ন চোখে পড়ে—এক কোণে টেবিলে জলের জগ, গ্লাস। রেডিও। পুবে ঠাকুরের সিংহাসন। চৌকি। আলমারি। দেওয়ালে ঝোলানো আয়না।

সাবান দিয়ে সারাদিনের তেল কালি শরীর থেকে ধুয়েমুছে উষসী ঘরে আসার কিছু পরেই চন্দন আসে।
—গ্রেট চেঞ্জ ইন ফাইভ ইয়ার্স!
—কোনও পরিবর্তন হয়নি। যা ছিলাম তাই আছি। শুধু বয়স আর শরীরের ওজন বেড়েছে। মানসিক শান্তি পেলে সব সুখই সহ্য হয়!
—তার সঙ্গে সাহসও বেড়েছে বলুন!
—একা থাকতে গেলে সেটুকু তো… তবে, কোনও ভীতু লোককে সাহস দেখাতে সবারই ভালো লাগে। আশপাশে সবাই জানে শ্যামলবাবু আমার দাদা হন। তাই তেমন কোনও ঝামেলার মুখে পড়তে হয়নি। আপনি বসুন একটু, আপনার জন্য চা করে নিয়ে আসি।

—আমি জানতাম আপনি ঠিক পারবেন। কতবার যে এখানে আসার কথা ভেবেছি। কিন্তু…
—কিন্তু, সময় পাননি এই তো!
—চন্দন সিগারেট ধরিয়ে একমুখ ধোঁয়া ছাড়ে। সত্যিই তাই! বরাকর থেকে ফেরার প্রায় পরপরই অফিস থেকে দিল্লি পাঠাল। স্পেশাল ট্রেনিংয়ে। তারপর কেবল ক্লায়েন্ট মিটিং আর অফিস মিটিং… মাঝে একটা প্রোমোশনও হলো। হাঁপিয়ে গিয়েছি রোজ একভাবে দিন কাটাতে কাটাতে। দিন দশেক ছুটি নিয়েছি, তাই এখানে চলে এলাম।
—বরাকর যাননি?
—নাহ্! দেখি, ঠিক করিনি কিছু। আপনি গিয়েছেন এর মধ্যে?
উষসী নীরবে ঘাড় নাড়ে।
—যদি কিছু মনে না করেন তো, একটা প্রশ্ন করতাম।
উষসী চন্দনের চোখে চোখ রাখে।
চন্দন কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে যায়…