সনাতন মণ্ডল মারা গেছে আজ তিনদিন হলো। অপঘাতে মরেছে বলে তে-রাত্তিরের কাজ করার তোড়জোড় চালাচ্ছে ওর স্বজনেরা। সকাল থেকে নাকি সুরে কান্নার রোল কানে আসছে। বদ্দি পুকুরের উত্তর দিকের জংলা বাগানের খানিকটা আগাছা পরিষ্কার করে কামান বসাবে। বড্ড কাদা এদিকে। নাগাড়ে চার-পাঁচ দিন টানা বৃষ্টির কাল থেকে ধরন দিয়েছে।

গদাই বামুন সাইকেলে দুটো বড় ব্যাগ নিয়ে হাজির। ফণী নাপিত খুর দুটো মিহি বালিতে শানিয়ে নিয়েছে। ব্লেড লাগানো মালও আছে, ওতে খরচা বেশি। তাই ব্যাগের মধ্যে, লুকোনো। ছেলেছোকরা কেউ বেঁকে বসলে তবে ওটা বেরোবে। নতুন ব্লেড তার। একটা চামড়ার ছেঁড়া বেল্ট চটকা গাছে ঝুলিয়েছে পেরেক মেরে। ওটাতে ঘষে খুরে ফাইনাল শান দিচ্ছে হেল্পার ফকির। নয় নয় করে জনা তিরিশ–চল্লিশ লোক হবে মোড়ল গুষ্টির। তবে আজকাল নেড়ার সংখ্যা অনেক কমেছে এই যা।

বেলা চড়ছে চড় চড় করে। ফকির নখ চাঁচতে শুরু করেছে। কড়ে আঙুলের নখে নরুন ঠেকিয়েই ছেড়ে দিচ্ছে। ফণী নাপতে এক বয়স্ক লোকের বাটি ছাঁট দিচ্ছিল। দুজন–তিনজন করে লোক জড়ো হচ্ছে কামান স্থলে। গদাই বামন পাট কাঠি–মাটির সরা–চাল–তিল–কলা গোছানোয় ব্যস্ত। ভট ভট করে দু–তিনটে বাইক এসে থামল কামানস্থলে। চার-পাঁচজনই লোকাল নেতা। একজন প্রধান। বাকিরা পঞ্চায়েতের অন্য অন্য পদে আছে। সব্বাই একই গোষ্ঠীর। গোষ্ঠী বিভাজন আর গোষ্ঠী কোঁদল এখন পল্লিগ্রামেও প্রকট।

বিলেশ্বর, সনাতনের বড় ছেলে এগিয়ে আসে; পেছনে মেজো আর ছোট—পঞ্চানন আর ধুলো মণ্ডল।
লম্বা মতন খাতা বার করেন, প্রধানবাবু। নীল-সাদা চেক মলাট।
—তুমাদের ক’বিগা জমি-ই?—প্রধানবাবু নীচু স্বরে শুধোন।
—পাঁচ বিগে।—মুখস্থ বলে বিলে।
—ইবার চাষ ক্যামন?
—আব‌নারা জানেন নে?—বিলেকে সমর্থন করে ধুলোও সামান্য তড়পে ওঠে,—ধারের সব জমি তো আব‌নার। আব‌নাদেরও।
—আরে কিচু কিচু জানি। তবু রুটিনে খাতায় তুলতে হবে না।—প্রধানবাবু গম্ভীর হবার ভান করলেন।
—ধান কত পেলে বলো?—এবার প্রধানবাবুর সঙ্গী এগিয়ে এলেন।
—কুড়ি কুইন্টেল হবার কতা, বাবা পেল মাত্ত ছয়। দুই বার রুইছিল। সব মরে হেজে… দেড় গেল মহাজনবাবুর বাড়ি। কিচু খোরাকির রেকে আড়াই–তিন কুইন্টেল কলে বেচলো… তার চেক-ই তো…!—একটানা কথা বলে থামে পঞ্চা। কোরা ধুতির খুঁট দিয়ে ঘাম মোছে। বাবার সব হিসাব সেই রাখতো। সে গাঁয়ের ইসকুলে আট কেলাস পর্যন্ত পড়েছে।
—মরার আগে মাতার কোনও ব্যামো? মানে গোলমাল কিচু?
—তা খানিক হইছিল! ওই চেক…! হাসান ডাক্তার মেলা বড়ি–সিরাপ দিইছিলো, তা খেলো কই!—রাগের গনগনে আঁচ তিন ছেলেরই চোখে।
—বেত্তান্ত পাঁচ কান কোরো না।—গলার স্বর খানিক নিবু-নিবু করে কাছে এগিয়ে আসেন প্রধানবাবু।—দেকি, ক্ষতিপূরণের কিচু ব্যবস্থা করা যায় কিনা।

প্রধানবাবু উঠে পড়েন। আরও কিছু আলোচনার দরকার ছিল। সামনে বিধানসভা। চাপ খুব। শোনা যায় না। দমে কান্নার শোর ওঠে। সনাতনের বউ মিনুরানির কান্নায় ধুয়ো তোলে তার পোয়াতি মেয়ে জবা।


২.

তিন চার দিনের নাগাড়ে বাদলে গাঁয়ের লোককে বারমুখো হতে দেয়নি। সিমেন্ট গোলা ঘোলাটে মেঘের জলের স্টক অফুরন্ত। হাওয়া অপিস থেকে টিভিতে নাকি বলেছে—পশ্চিমি ঝঞ্ঝা। বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেশি থাকায় এরকমটা চলবে বেশ ক’দিন।

আজ সকাল থেকে সামান্য ধরন দিয়েছে। সূর্যের ঘুম ভেঙেছে, চোখ খোলেনি এখনও। মুখে আলকাতরার মুখোশ। প্লাস্টিক মাথায় করে বেড়িয়ে পড়ে সনাতন। কড়খোয়াই গাঁ লাগোয়া বিঘে চারেক জমি রয়েছে তার। বহুকাল ধরে ভাগায় করে। বড্ড নাবাল। এবার দু-দুবার রুয়েছে। প্রথমবার নিজের বীজতলার। টানা নিম্নচাপের বৃষ্টিতে ধুয়ে হলুদ হয়ে গেল। পরেরবার বীজের জন্য অনেক দূর অবধি দৌড়োতে হয়েছিল। মওকা বুঝে চড়া দাম। চাষের খরচ আজকাল অনেকগুণ বেড়ে গেছে। আজ আবার মাঠে গিয়ে কী দেখবে কে জানে?

ছোট মেয়ের ডাক্তার দেখানোর দিন এবারও পার হয়ে গেল। পর পর দু-বার। বর্ধমানের খোসবাগানে ওর মানসিক চিকিৎসা চলছে প্রায় দু-বছর হলো। ওষুধ চলে দিনে চার-পাঁচরকম। যা দাম! ডাক্তারের ফি-ওষুধ আর যাতায়াত নিয়ে হাজারের ওপর ধাক্কা। এবার নাম লেখাতে হাতে-পায়ে পড়তে হবে।

জবার বিয়ে হয়েছে বছর ঘোরেনি, এখনই পোয়াতি। বিয়ের খরচের দেনা এখনও শুধে উঠতে পারেনি। কাল রাতে আগাম কোনও খবর না দিয়েই বাপের বাড়িতে এসেছে। জামাই আসেনি, দেওর দিয়ে গেছে। মেয়ের পেট এখনও চোখে পড়ার মতো না হলেও সঙ্গের দশমেসে পেট ফোলা ব্যাগটা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই সনাতন স্পষ্ট দেখতে পায়—পোয়াতি মেয়ের ওষুধপত্র-ডাক্তার-হাসপাতাল… ভাবতে ভাবতে আলের কাদায় হাঁটু অবধি গেঁথে যায় দু-পা। কোনওরকমে হামাগুড়ি দিয়ে বের হবার চেষ্টা করে সনাতন। পারে না। কাদায় যেন সাঁড়াশি চাপ।

অন্যমনস্ক হয়ে চিন্তার মাঝে নিজের জমির কাছেই আটকে গিয়েছিল। চিনতেই পারেনি। ভেবেছিল গাঢ় সবুজের নধর চারা হাত-পা ছড়াবে। এক বুক দুধ নিয়ে ধানের শিষ মাথা দুলিয়ে—পনেরোই আগস্টে মাইকে বেজে ওঠা গানের কলি গেয়ে উঠবে—ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা… কিন্তু হলদেটে ছোপ এধার-ওধার। সবুজের ছোঁয়া সামান্যই। ওই গানেরই অন্য লাইন শুনতে পায় সনাতন—এই দেশেতেই মরি…


৩.

ভূতবাগান মাঠে প্রশাসনিক বৈঠক বসেছে দুপুর-দুপুর। লাগোয়া তিন বিধানসভার বিধায়ক সাহেবদের ঝাঁ-চকচকে সাদা স্করপিও ধুলোর ঝড়ে থামল। পেছু পেছু গোটা তিনেক ছোটা হাতি। তাতে বোঝাই তাঁবেদার। মুখে স্লোগান আর খিস্তি। গাড়িতে গোঁজা উড়ন্ত পতাকায় অহংকার আর তার বহিঃপ্রকাশ সাহেবদের ঝলমলে পোশাক—গটমট জুতো আর শরীরী ভাষায়। ছয় পঞ্চায়েতের প্রধান সাহেবরা আসেন বাইকের পিছনে।

সবুজ চেয়ার সাজানো আছে লাইন করে। সানি ডেকরেটার্সের। লাল চেয়ার কেনা বন্ধ করে দিয়েছে। ওই রঙয়ের কোনও প্রতিনিধিই আর অবশিষ্ট নেই। চাষিরা সবাই সবুজ ঘাসে। মাটির কাছে। মাটির মানুষ।

বিডিও স্যার লেট। তিনি যখন এসে কপালের ঘাম মুছছেন, সভার কাজ কিছুদূর এগিয়েছে। ব্লকের প্রশাসনিক বড়কর্তাকে দেখে প্রধান সাহেবরা বিগলিত হন। বিধায়ক সাহেবরা একটু নড়েচড়ে বসেন। শরীরের ভাষায় সামান্য পরিবর্তন আসে। তিনি ধপাস করে চেয়ারে বসে আলোচনায় উঁকিঝুঁকি দিলেন, ঢুকেও পড়লেন। বিস্তারিত আলোচনার ফল বেরুলো। স্থির হলো—প্রত্যেক চাষিকে পঞ্চায়েত থেকে শংসাপত্র নিতে হবে। প্রধানবাবুর কাগজ চিহ্নিত করবে ‘প্রকৃত চাষি’ কে। ওই কাগজ দেখিয়ে মাথা পিছু তিরিশ বস্তা ধানের জন্য টোকেন মিলবে বিডি অফিস থেকে। এই টোকেনই চালকলে ধান বেচার ছাড়পত্র।

বাড়িতে সবদিক সামলে, পঞ্চায়েতের অফিসঘরের মাঠে সনাতন যখন পৌঁছাল, লাইন তখন সাপের মতো বেঁকেছে বার কয়েক। শুনল রাত থাকতেই লাইন পড়েছে—চাষার ছেলের ‘চাষি প্রমাণপত্র’ জোগাড়ের জন্য। আঁকাবাঁকা সাপের মুখের দিকে প্রচুর নতুন লোক লাইনে নেমেছে। তাদের কারোর বাবা-কাকারা মাঠে গেলেও ওদের কখনও কাদায় নামতে দেখেনি সে। রঘুনাথের ছেলেটা এক্কেবারে সামনের দিকে। পরনে শরীর-টাইট জিন্‌স প্যান্ট আর শৌখিন গেঞ্জি। দুই-ই বেশ দামি। হাতে সিগারেটের প্যাকেট আর মিউজিক বাজা লাইটার। মুখে এখন গুটকা। ওরা জাতে আগুরি আর রঙয়ে লাল হলেও জমিজিরেত তেমন নেই এখন। এককালে ছিল। ছেলেটা টাউনে লম্বা লম্বা বাড়ি বানায়। বিল্ডারের বড় ব্যাবসা। সিন্ডিকেট গড়েছে। সেবার হাই ইসকুলের বিল্ডিং বানানোর সময় ও-ই মাল সাপ্লাই করেছিল। পার্টির ওপর তলায় ওঠা বসা আছে। এখন এদের হাওয়ার টানে রং বদলে গিরগিটিও মুখ লুকোচ্ছে। মাঝে মাঝে মিউজিক বাজিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছে বাপের বয়সিদের মুখের ওপর—ছ্যাঃ ছ্যাঃ …

ও যে কেন চাষার লাইনে—মাথায় আসে না সনাতনের। সনাতন যখন সরকারি টেবিলের কাছে এল, রোদ তখন মাথার ওপর সার্চ লাইটের ফোকাস মারছে দমে। নাইলনের থলে থেকে কাগজ বিছিয়ে ধরে টেবিলে। গোল দেখা দেয় সেখানে। সরকারি মাপকাঠিতে মেলে না অনেক কিছুই।
—তোমার কেসটা একটু গোলমেলে। সরকারিবাবু ঝুলে পড়া চশমা ঠেলে চোখে সেট করে।
—ক্যানে বাবু?—জিবটা আটকে যায় মুখের মধ্যে, লালার অভাবে।
—সে তো অনেক ব্যাপার! এ কেসগুলোর দিন পরের সোমবার রাখা হয়েছে। আর সরকারি হিসাব মতো চাষি হতে গেলে, যে পরিমাণ জমি থাকা দরকার তা মনে হয় আপনার নেই।—কথা শেষ করে সামনে রাখা জলের বোতলের সিল কট কট করে খুলে মুখে উপুড় করে, ঢক ঢক আওয়াজে গলগণ্ড ওঠে নামে।
—কত জমি লাগে? আমি তো ভাগেও করি।
—সে-কথাই তো বলছি, ভাগচাষিদের ডেট পরের সোমবার । নেক্সট…

সনাতনকে সবাই দুয়ো কাটে—জমির কাগজ-জাবদা খাতা-সরকারি চেয়ার টেবিল-সিল ভাঙা জলের বোতল—সব্বাই। আঁকাবাঁকা লাইন থেকে অবজ্ঞার বৃষ্টি পড়ে। অঝোরে। ঘষা কাচের মতো দু-চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। ছেলেবেলায় গাঁয়ের ইসকুলের নগেন মাস্টার বলত—’চাষার ছেলের আবার লেখাপড়া!’ ছোট থেকে ‘চাষার ছেলে’ শুনতে-শুনতে কান-সওয়া হয়ে গিয়েছিল। আজই প্রথম বেতাল ঠেকল। কাগজপত্রে কিছুতেই ‘চাষা’ হয়ে উঠতে পারল না সে।


৪.

বেশ দেরি হয়ে গেল। এ চালকলে ধান কেনার কোটা শেষ। এখন চেক দেওয়া চলছে। রঘুনাথ কোনারের ছেলের হাতে দু-তিনটে চেক। চওড়া হাসি। আবার সাত মাইল দূরে অন্য চালকল। আসলে কাগজপত্র ঠিকঠাক করে, প্রকৃত চাষি হবার টোকেন জোগাড় করে সনাতনের চালকলে পৌঁছোতেই লেট হয়ে গেল। সাত মাইল দূরে অন্য কলেও একই অবস্থা। সনাতন আর দাঁড়াতেই পারে না, সোজা পা-দুটো জড়িয়ে ধরে, মা মনসা রাইস মিলের মালিক বিশ্বম্ভরবাবুর। সে আর বিশ্বম্ভর গাঁয়ের ইসকুলে পড়েছিল।
—আরে সনাতন করো কী?—ব্যস্ত হয়ে পা ছাড়াতে চায় বিশ্বম্ভর।
—ধানডা আবনাকে নিতেই হবে। আমি কিচু শুনবোনি।—সনাতন আর একটু চাপ দেয় পা জড়ানোতে।
—আরে পা ছাড়ো। লাগচে। তুমি বোধহয় বড় আমার… দেকচি কী করা যায়!
সনাতন পা জড়ানোতে আলগা দেয়। ধুতি সামলে বিশ্বম্ভরবাবু খাটো গলায় বলেন—ধান নিবো, পেমেন্ট চেকে। সেটাও আজ হবে না। একটাও চেকের পাতা নেই। আর মঙ্গলবারের পরে। রাজী?

এখানেও রঘু কোনারের ছেলে। হাতে চেক। রং আলাদা। নীলচে। সনাতন আর কথা বাড়ায় না। লাদেন গাড়ি খালি করতে লেগে পড়ে ।

পরেরবার নয়। দুই মঙ্গলবার পেরিয়ে গেল। চালকলের চিমনি বেয়ে গলগল করে অনেক ধোঁয়া আকাশে মিলিয়ে গেল। চেক সনাতনের হাতে এল না । চেকবই ব্যাংক থেকে ডাকে পাঠিয়েছে, মালিক এখনও হাতে পায়নি। সনাতন দু-তিন দিন বাদ-বাদ পাক মারে আর নিরাশ হয়। ম্যানেজারবাবু একই রেকর্ড বাজায় প্রতিবার। তিনটে মঙ্গলবার পেরিয়ে পরের বুধবারে চেক হাতে পায়। নীলচে রঙয়ের। চেকটা ফতুয়ার পকেটে রেখে গামছা বেড় দিয়ে বাঁধে। আশায় বুক বাঁধে চাষা।

পরের দিন সক্কালে যখন সনাতন ব্যাংকের গেটে পৌঁছালো, দরজা সবে খুলবে। ব্যাংকের সামনে টেবিল নিয়ে বসা পাড়াতুতো এক ভাইপোকে দিয়ে স্লিপ ভরালো। চেক জমা দিয়ে মোহর মারা রসিদ নিল। আর তারপর বাইরে এসে নিল—এক বুক শ্বাস। ক্যাশিয়ার বলেছিলেন,—’দিন পনেরো বাদে খবর নেবেন।’ ওই পনেরো দিন পনেরো মাসের সমান হয়ে দাঁড়াল, সনাতনের পোড় খাওয়া জীবনে। ছোট মেয়ের ডাক্তার দ্যাখানো হলো না। ওষুধের অভাবে মাথার গোলমাল বাড়ল—বাড়তে থাকল। চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছোলে, হাসপাতালে যখন গেল—সব হাতের বাইরে।

বড় মেয়ে আসা ইস্তক এই সাত মাসে জামাই একবারও খোঁজ নেয়নি। ফোনও করে না। করলে, এ-পাশ থেকে গলা শুনলেই কেটে দেয়। তারপর বন্ধ। হেল্‌থ সেন্টারের দিদিমণি সাতমেসে পেট দেখে বললেন,—বাচ্চা একটুও বাড়েনি। মা’কে ভালো করে খাওয়ান, দুধ-ডিম-সয়াবিন… এখানে কার্ড করিয়ে বাড়ি নিয়ে যাবেন, আয়রন ক্যালসিয়াম।

সনাতন জানে, উপযুক্ত খাবারের অভাবে বাচ্চা বাড়েনি। নড়াচড়া কমেছে। নয়ন ডাক্তার বলেছে, পেটের একটা ছবি করতে। খরচা আছে। কিন্তু চেকটা… চেকের ভাবনায় হেল্‌থ সেন্টারে ওকে নিয়ে যাওয়াও হয়নি।

চেকের টাকা আজ ঢুকবে বলেছে। জন ধন অ্যাকাউন্ট। সনাতন ব্যাংকের লাইনে প্রথম। চোখে মুখে হাজার বাতি জ্বেলে টুকরো কাগজটি তারজালের নীচের ফাঁক দিয়ে এগিয়ে দেয়। চেয়ারে বসা লোকটির চোখ মুখ কুঁচকে ওঠে যন্ত্রের বোতাম টিপে। তারপর এ ফাইল ও ফাইল খোঁজেন কিছু। একটা কাগজের সঙ্গে আলপিন লাগানো নীলচে চেকটা বের করে আনেন। মোটা চশমার পেছন থেকে চোখ গোল গোল করে তাকান সনাতনের দিকে। সনাতনের মুখে জ্বলে থাকা বাতির ফোকাসে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। চোখ কচলে, সইলে বলেন—চেক বাম্প্‌স ডিউ টু ইনসাফিসিয়েন্ট…
সনাতন তার মুখের বাতি নেবায় না, বলে—মানে?
—এ চেকে টাকা পাবেন না।

হাজার বাতির ফিউজ উড়ে গেল বোধহয়। সনাতন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে, এক বর্ণও মাথায় ঢোকে না। ঘষা কাচের ঘোলাটে হয়ে যাওয়া চোখ জোড়া দিয়ে আবছা দ্যাখে, রঘু কোনারের ছেলে থুথু দিয়ে গুনছে গোলাপি গান্ধি নোট। মাথায় কিলবিল করছে কাঁকড়াবিছে। নদীর দু-পাড় ভাঙছে। হল হল করে ঢুকছে জল। সর্বাঙ্গ ভেসে যাচ্ছে। শেওড়ার মগডাল টানছে সজোরে। নীচে সাদা গরুটা ঘাস ছিঁড়ছে আবছা আঁধারে আপন মনে। খোঁটা থেকে খুলে নেয় দড়ি…

দুপুর গড়িয়ে রাত। রাত বুকে হাঁটে ভোরের দিকে। সনাতনের আধ-পাগলি বউ আর থাকতে না পেরে ডুকরে ওঠে। ছেলেরা বেড়িয়ে পড়ে দু-ব্যাটারি লাইট সম্বল করে। সনাতন ফেরে না। বডি আসে দেড় দিন বাদে, সব সরকারি নিয়ম মেনে ময়নাতদন্তের পর।