আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বললাম ওর নাম। তখনই চমকাল বিদ্যুৎ। বুঝলাম ভালোবাসাই আমাদের নিয়তি।

এরপরই সে-ই বিরাশি সিক্কার থাপ্পড়। সঙ্গে বাজখাঁই খিস্তি। সনাতন মনে করতে পারছিল না, বড়বাবু গাঁক করে মুখ খারাপটা আগে করেছিলেন, না ক্যালানির মাঝেই গুঁজে দিচ্ছিলেন, সেঁকো বিষ।

—গাজর ছুলছিলি, নাকি? খেঁচিয়ে ওঠে হারিণ পোদ্দার। এমনিই মনটা দই পেকে আছে সকাল থেকে। তিন মাসের বউটা তিন দিনের নোটিশে ঘর ছাড়ল হক্কাল হক্কাল। বলে কিনা, হাঁসবাড়ির পেছনে হাগতে বসা বেশরমের কাজ।
—ক্যান রে মাগী, ওই রাতমাখা ভোরে কোন ভাতারটা তোর হোগা দ্যাখার লগে টাঁটিয়ে রয়েছে?
—আগে তুমি বেরাথরুম করবে তারপর ডাকবে আমাকে।

হারিণ ভেবেছিল ডাকা মানে ওই আরাম নিতে ডাকা। অবিশ্যি নেয়া বলে না হারিণ। এতো দেয়া নেয়া। যতক্ষণ দেবো ততক্ষণ নিবি। পাঁচ থেকে সাতে পৌঁছোতে গিয়ে গাড়ি থেমেছিল প্রতি কেলাসে দুইবার। সে-ই ডাবল স্টপ দলে কতগুলো সহপাঠিনীও জুটত, যাদের মায়েরা প্রতি দেড় বছর অন্তর আঁতুড়ঘরে থাকতে বাধ্য হওয়ায় তাদের ভাইবোন-খামারে যোগ দিতে হতো, সদ্য মা-ছাড়া দ্বিতীয় কনিষ্ঠতমটির দায় নিয়ে। এরাই ছিলো পাবক এবং সাহসিদের অগ্নিনির্বাপক। তাদের অনেক প্রশিক্ষণ ভীরুদের পরবর্তী জীবনের পাথেয়।

তবুও ভেবলে গেছিল প্রথম রাতে। বলে কিনা, হবে না তিন দিন। সে-ই যে ক্যাঁচাল বাঁধল পরের দিন ভুলুটা ন্যাকড়া নিয়ে টানাটানি করায়, সে-ই সম্পর্ক আজও সহজ হলো না শাশুড়ি বউয়ের। যার কাছে বেলাবেলি বাসি রুটি খেয়ে নাপিত পাড়ার আশনাইতে যায় ফি রোজ, তারই হাতে আচমকা ডাঁশার বাড়ি, বদমাইশ বাচ্চার বিচি টিপ করে ছোঁড়া পাথরের বাড়া। সারাদিন ধরে যতবার কঁকিয়েছে ভুলু, ততবার একটু একটু করে অধিকারচ্যুত হয়েছে মুনিয়া। অপরাধবোধ মুখ ঢাকতে চেয়েছে কাঠিন্যের চাদরে। শেষমেষ দুই ঘরের মাঝখানে চানঘর থেকে গেছে বরাবরের মতো, হারিণের মায়ের, আর তার জন্য বরাদ্দ হয়েছে হাঁসঘরের পেছন।

ঠিক আছে, এখন তো আয়। আদুর কুলোর নীচে মেরুদণ্ড যেখানে ভেতর গোঁজা হয়ে তলিয়ে গেছে, সেখানে কাপড়ের বেড়ি ধরে আদুরে টান দেয় হারিণ। ঘুম ভেঙে উঠে বসে মুনিয়া, তখন ভাবছে আবার সে-ই হাঁসের পালক আর গু মাখা হেগো ডাঙার কথা। তখনই নাভি বরাবর পিছটানে দৌড়ে যাবার প্রয়োজনটা উদগ্র করে দিলে একটা প্রতিহিংসাপরায়ণ মোচড়। এক হ্যাঁচকায় পিছন ফিরে বসে হিংস্র হাতে উদ্দীপনা চটকে দিয়ে বিছানা ছাড়ে মুনিয়া। তীব্র যন্ত্রণার আকস্মিকতায় কুঁকড়ে যাবার সময় গলিত সীসা হয়ে কানে ঢোকে তিনটে শব্দ: খুব রস না?

শব্দের প্রয়োগ অভিজ্ঞতা নির্ভর। মিষ্টির দোকান পাড়া গাঁয়ে বড় একটা মেলে না। দুধকে ছিন্ন না করার আর্য্য পুষ্টিতত্ত্ব, না জাতীয় মাতার অকুণ্ঠ দানকে ভোগ্যপণ্যে রূপান্তরিত করার অর্থাভাব, কোনটি কারণ, বাপ তা জানত না। কিন্তু জমিজিরেতের ঝঞ্ঝাটে সদরে গেলে, কড়া পাকের রাজভোগ আনতো মায়ের জন্য। তার আড়বহর দেখে উজ্জ্বল হয়ে ওঠা মায়ের মুখ শেষ লগ্নে লুকিয়ে লুকিয়ে একটু কুঁচকে গেলে, বউয়ের কাছে লজ্জা না লুকোতে অভ্যস্ত বাপ বলতো,—‘কী রে হারু, রসটা একটু কিরকিরে না?’ হারিণ তখন ভাবছে, মা যেন চাটনি করার জন্য তুলে না রাখে রসটুকু।

মুনিয়ার বাপ তো ভেগেছিল ছোটো শালির অপাঙ্গ দর্শনে। শালাটা তখন যন্ত্রস্থ। তার আগে ওর মা’কে কি কোনওদিন খাওয়ায়নি রসগোল্লা? শুনেছে রসিক নাগর বলে সুনাম ছিল পলাতক শ্বশুরটির। রস চিনতে ভুল করে তার মেয়ে! অবশ্য রগে উঠে যাওয়া পিতৃদত্ত সম্পত্তি জোড়ার বিপত্তিতে তখন অনাগত প্রজন্মের সুতীব্র অস্ত্বিত্ব সংকট। যন্ত্রণার তেলে ফুটতে থাকা ক্রোধ থেকে ছিটকে বেরুলো একটাই শব্দ: বাইনচোত!

শব্দটার জৈবিক সম্ভাবনা নিয়ে প্রভূত বিতর্ক অবশ্যম্ভাবী। হারিয়ে যাওয়া মাসি, পরবর্তীকালে কার্যকারণ সূত্রে মা, যদি কোনও কন্যাসন্তান প্রসব করেও থাকেন, তাও মুনিয়ার পক্ষে শব্দটা সুপ্রযুক্ত নয় বললে, মনঃক্ষুণ্ণ হতেই পারেন কোনও কোনও সংশয়বাদী। কিন্তু কিছু কিছু শারীরিক আঘাতের মানসিক অভিঘাত এতটাই প্রবল যে প্রত্যাঘাতই হয়ে পড়ে প্রধান শুশ্রূষা। এক্ষেত্রে অপ্রধান চিকিৎসা কিছু আছে কিনা তা জানার অপৌরুষেয় আগ্রহ থেকে নিজেকে বিরত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালায় হারিণ পোদ্দার। সিদ্ধান্ত নেয় সর্বরোগহর সময়কে কিছুটা সময় দেওয়ার।

তবুও সে-ই থেকে কনকনিয়ে আছে কুসুমজোড়া। হাত ছোঁয়ালেই তিরতিরিয়ে উঠছে একটা ব্যথা তলপেট থেকে নাভি বরাবর। হারিণ তাই ভালো করে বুঝতে চাইছিল, চড়থাপ্পড় খাওয়ার পর কেতুরাম যখন বলে,—‘যতই মারুন দারোগাবাবু, ভালোবাসা অজেয় অমর!’, তখন সপাট বুটের লাথি তারও ঠিক ওইখানেই পড়েছিল কিনা!
—তুই বানিয়ে বলছিস, সনাতন। অবিশ্বাসের হাওয়া ছেড়ে দেয় হারুন মণ্ডল।
—না গো কাকা। কাল সন্ধ্যা থেকেই তেতে ছিল বড়বাবু।
—কেনো, গাঁজারুগুলো হপ্তা বাকি রেখেছে নাকি?
—তা নয়। ওসব তো ইসমাইল এনে দিয়েছে গত বেস্পতিবারেই। কথা বলতে বলতেই আশশেওড়ার বেড়ার ধারে বসে পড়ে সনাতন। খোদ থানার লোককেই জমিয়ে বসতে দেখে, আরও কাহিনির আশায় মাজারমুখো বসতে থাকে বাকিরা। পোড়ো বিকেলে ফোন করেছিলেন, বড়বাবুর বউ। তিনি তখন সবে এক পাত্তর চড়িয়েছেন। এট্টু এট্টু করে জমাচ্ছেন মৌতাত। ফুলটুসিকে ক’টা পেঁয়াজি আনতেও বললেন বোধহয়। 

নামটা শুনে এনায়ুল একটু উসখুস করে। না বলা ক’টা কথা কুটকুট করতে থাকে মনে। হারুন একবার চোখ মটকে তাকায় তার দিকে। আরোপিত গাম্ভীর্যের সতর্ক মুখোশ পরে নেয় এনায়ুল। চোয়াল শক্ত করে জিজ্ঞেস করে,—তারপর?
—তক্‌খনি তো এলো টকিয়ে দেওয়া ফোনটা। শালির ভাসুরের মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে সামনের ফাল্গুনে। অবস্থা ভালো নয়। গয়নাগাটির দায় নিতে হবে কিছু। এই কথা জেনে বড়বাবু রেগে টং।
—ধুস্! এ একটা কতা হলো?—ফোড়ন কাটে গোপালির বাপ।—ওসব তো দারোগার হাতের নস্যি।

নিজের নিরুপায় আশ্রয়কেন্দ্রের এমন ধারা অনুসর্গ বিসর্জিত হয়ে যাওয়াটা একেবারে পছন্দ হয় না সনাতনের। কোঠা বাড়ির প্রসাদের ভরসায় সে তখন ছক কষছে নিজের কুঁড়ে ঘরে ঈশ্বরীর আবাহনের। মেজাজ বিগড়ে যাওয়া অন্তর থেকে সে স্বভাববিরুদ্ধ ভঙ্গিমায় খিঁচিয়ে ওঠে,—ওপরে কত পাঠাতে হয় জানো? তারপর তো তোমার দলের খাইও কম নয়!

ব্যস! শুরু হয়ে যায় বিকট তর্কাতর্কি। প্রথম দিকে হিং দেওয়া হারুন মণ্ডলই সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে আপ্রাণ।
—আরে দারোগাবাবু বউকে ভালোবাসে খুব। তাই অত টেনশন। বউকে ভালোবাসলে ঝি ঠ্যাঙাতে হয় জানিস না?
—তোর বিদ্যের বহর তো আড়াই হাত!
আসর জমাতে চেষ্টা করে, ঘা খাওয়া এনায়ুল। ছাড়বার পাত্র নয় হারুন মণ্ডলও।
—খুব তো মসজিদে খতিবগিরি করো। তা বলো দেখি, কী লিখছে তোমার কোরান-শরীফে?

খুতবা পাঠ তার জীবন জীবিকা। হঠাৎ সে-কথা ওঠায় ব্যথিত মুখে চুপ করে যায় এনায়ুল হক। তার বিরস বদন দেখে গোপালির বাবা বলে,—ও এখন ডুবে আছে তালাক নিয়ে। কেনো জ্বালাও ওরে?
এনায়ুল সোজা তাকায় তার দিকে—যা জানেন না তা বলবেন না। এইসব কথাবার্তা বিপজ্জনক এখন। কী থেকে কী হয় ভরসা নেই। গোপালির বাবা চুপ করে গেলেও হারিণ উব্‌জে পড়ে।
—বউ তাড়ানোর কথা লেখেনি কোরানে!
—না লেখেনি! ওসব ফেকা হাদিসের ব্যাপার। হাদিস মহম্মদের বাণী। কোরান আল্লার।

হারিণ আবার মিইয়ে যায়। ভাবছিল যদি বউটাকে বিদেয় করার জুতসই ফিকির মেলে। ভাবতে ভাবতেই আবার টনটনিয়ে ওঠে ভোর রাতের আঘাতটা। হারিণ বুঝতে পারে না, এখন কষ্টটা ঠিক কোথায় হচ্ছে। বউকে জিজ্ঞেস করবে একদিন। সব আরাম তো ওইখানেই। ওখানে ওরম করে কেউ!
—হ্যাঁ রে সনা, তুই বললি না তো, কেতুরামকে দারোগাবাবু ঠিক কোথায় কষিয়েছিল লাথিটা?
—সে সব শোনার ধৈর্য্য আছে তোমাদের? তোমরা খালি মাতো বাজে তর্জায়।

সুযোগ বুঝে হেক্কার নেয় সনাতন সরকার। আড়ালে লোকে বলে, হাফ পুলিশ। কেউবা, হাফ সরকার। ধর্ম ও রাজনীতির জটিল প্যাঁচগুলো কৌশলে এড়িয়ে যাওয়াই তার সব সময়ের চেষ্টা।

—মারের কথা ছাড়ো দিকিন। কেতুরামের ভালোবাসার কথা চিন্তা করো।

সকালের ভেজা কাপড় দুপুরে ছাদ থেকে শুকিয়ে নামালে যতটা রোদ্দুর থাকে তার মধ্যে, থানার অভিজ্ঞতার পর সনাতন ততটা স্মৃতিকে লুকিয়ে এনেছিল নিজের ভেতর। কেতুরামের ভালোবাসার স্মৃতি। তার কথার স্মৃতি। সে-ই স্মৃতিচারণার মধ্যে ঢুকে পড়ছিল তার নিজের ভাষা। নিজেরই ভালোবাসার কথা। নারীর প্রেমে পুরুষের পাগল হয়ে যাওয়ার কাহিনি, পাগল পুরুষের সঙ্গে নারীর হারিয়ে যাওয়ার কিসসা, কুয়াশার মতো এরপর ঘিরে ধরবে সেইসব মানুষগুলোকে। কেতুরাম কেন এত মেয়ে থাকতে এমএলএ সাহেবের মেয়েটার যাওয়ার পথেই দাঁড়িয়ে থাকত, মেয়েটি কবে অমন ভূতটাকে দেখে মুখ টিপে হেসেছিল, কীভাবে সে-ই হাসির আবেশ চাড়িয়ে গেছিল স্নায়ুতন্ত্রের কোষগুলোর মধ্যে, কোথা থেকে কেতুরাম জেনেছিল, প্রিয়ার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েই চিৎকার করে বলতে হয় মনের কথা, কোন দূর্দৈব যোগাযোগে তখনই আকাশে ঘনঘটা আর কী কারণে তখনই একটা খুচরো বিদ্যুৎঝলক হয়ে গেল পারম্পর্যহীনভাবে—এইসব অজ্ঞাত অব্যাখ্যেয় ব্যাপারে চুলচেরা বিতণ্ডা চালাতে থাকবে পুড়ে যাওয়া, পুড়তে না পারা, পুড়তে চাওয়া কতগুলি হোমো স্যাপিয়েন্স স্যাপিয়েন্স।

হতে পারে সে-ই সময় ভুলুকে নিয়মমাফিক না পেয়ে, লাজুক অনুসন্ধানী কেউ অদম্য তাড়নায় চলে আসবে, মাজারের কাছাকাছি। যৌবন আউটসোর্সিং হওয়ায় অনেকদিন ধরে বিক্ষুব্ধ দুটো মাদী দাঁত নখ বার করে ঝাঁপিয়ে পড়বে তার ওপর। এই অনুপ্রবেশকে কী চোখে দেখতে হবে, সে-ই সম্বন্ধে কোনও রেডি রেকনারের অভাবে, তাদের সঙ্গীগুলোও উজিয়ে আসবে, আর জড়িয়ে পড়বে একটা জগাখিচুড়ি ঝামেলায়। বিচক্ষণ গোপালির বাবা ওদের বলে দেবে,—না, একটা প্রতিযোগী বাইরে চলে যায় রোজ, এ তো স্বস্তির কথা।

এই কূট বুদ্ধির অভাব থাকলেও, উদ্‌বাস্তুর ঘাড়ে চড়ে বসার সহজ জৈব বুদ্ধির অভাব হবে না ওদের। শুরু হয়ে যাবে অনিবার্য ভ্রাতৃঘাতীদাঙ্গা। মানুষের বাতিল গোয়ালে আশ্রয় নেওয়া সদ্য বাচ্চা বিয়ানো এ পাড়ার মাদিটা, চেতনায় মানবিক সংক্রমণজনিত কারণে আছড়ে পড়বে যুযুধান পুরুষদের মধ্যে, তার প্রতি প্রসন্নতর যে, তার ঘাড়ের ওপর।

এইখান থেকে হারিণ পোদ্দারের মনঃসংযোগ ঘুরে যাবার সমূহ সম্ভাবনা। গভীর আগ্রহ নিয়ে সে দেখতে থাকবে শরীরজোড়া কামড়াকামড়িটা নামতে পারে কতটা নীচে।

শুয়োরের বাচ্চাগুলো দিলে পিরিত চটকে। রেশভাঙা আক্রোশে, শালগ্রাম শিলার মতো একটা পাথর ছুঁড়ে দেবে হারুন মণ্ডল। নাম বিভ্রাটের তুচ্ছতাকে উপেক্ষা করে, একটি সফল শুক্রাণুর লক্ষ্যনির্দিষ্ট ক্ষিপ্রতায়, সেটি ফাটিয়ে দেবে, শরণার্থীর কপাল। আবিশ্ব ভালোবাসার বধির পর্দাকে বিদীর্ণ করে, সে-ই অমানুষিক আর্তনাদের মন কেমন করা অনুরণন, তখন একটা ডানাওলা বাচ্চার ছোঁড়া অসংখ্য অণুতীর হয়ে বিঁধছে, একটি ষোড়শীর বুকে, যে তার বিধান রচয়িতা বাবাকে বলতে পারেনি, সে-ও একদিন চিৎপুকুরে কেতুরামকে খালি গায়ে চান করতে দেখেছিল।