“ইনি সেই আদ্যা।
সহস্র সহস্র বৎসর আমরা যাঁহার গর্ভে আছি।”—তন্ত্রবিভূতি


লীলাবতী বিউটিপার্লার থেকে সুন্দরকান্তি হয়ে ফিরে এসে বউদিকে বলল—কেমন লাগছে? শোভা ছেলের শার্টে বোতাম সেলাই করছিল। নতমুখ না তুলেই বলল—হুঁ। বাইরে ঝড়ঝাপটা এলে ও এরকমই করে। দুরন্তপনার বয়সে জামাপ্যান্টের বোতাম ছিঁড়ছে ছিঁড়বে। কাজেই শোভার অশান্ত মন জুড়িয়ে নেওয়ার উপকরণের অভাব হয় না। বসে বসে বোতাম সেলাই করে। লীলাবতী বউদির মুখোমুখি বসে পড়ল, বলল—না দেখেই হুঁ বললে? শোভা এবার ওর চোখে চোখে চাইল। বিশ সেকেন্ডের মতো।
—কার জন্য এসব?
—মেয়েরা কার জন্য সাজে?
শোভা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, বাবার ঘরে যাও। তোমার একটা চিঠি আছে। আজ তোমার ফেরার কথা না?
—হুঁ। কাল সকালের ফ্লাইটে ও মুম্বই থেকে এসে যাবে। আমাকে না দেখতে পেলে চায়ের কাপ ভাঙবে কী গিজার চালু রেখে অফিসে চলে যাবে।
—অ্যাতো?
লীলাবতী গরবিনীর মতো গ্রীবাভঙ্গী করে উঠে গেল চিঠিটা দেখতে।

এই সে-ই চিঠি। রেজিস্টার্ড। উকিলেরা যেমন করেন,— মহাশয়া, আমার মক্কেল শ্রী মানব বসু পিং ‌৺রাধানাথ বসু, হাল সাং এ/১৭/৩২ ডানকান পার্ক অফিসার্স কোয়ার্টার্স, আপনার বিরুদ্ধে বিবাহবিচ্ছেদের মামলা রুজু করিয়াছেন। এতদ্বারা আপনাকে তাহার বসবাসের জন্য কোম্পানির প্রদত্ত গৃহের কোনও উপকরণ অপসারণ করা হইতে বিরত থাকিতে বলা হইতেছে এবং তাহার ক্রেডিটে কোনও দ্রব্য ক্রয় করিতে নিষেধ করা যাইতেছে।

পড়া শেষ হলে, কম্পিতস্বরে বাবা জিজ্ঞেস করলেন—এর মানে কী লীলা?
লীলাবতী হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মা বললেন—আসার আগে কি ঝগড়াঝাঁটি করে এসেছিলি?
—না তো। ওইতো গাড়িতে আমাকে পৌঁছিয়ে দিয়ে গেল। অনেকদিন যাও না। ক’দিন থেকে এসো—এইসব মিষ্টি কথা।
দাদা বলল—তা হলে নিশ্চয় সে-ই মিসেস রতিয়া দুবের ব্যাপার। ওদের অফিসের প্রোগ্রাম অ্যাসিস্ট্যান্ট। দুজনকে আমি একসাথে ক্রিসক্রস বার থেকে বেরিয়ে আসতে দেখেছি। আর একদিন নন্দনে…
বাবা বললেন—মিসেস যখন তখন তো বিবাহিত!
দাদা বলল—দ্যাখোগে, ওদিকেও এরকমই উকিলের চিঠি গেছে।
মা বললেন—ছিঃ! এসব কী হচ্ছে আজকাল? হ্যাঁ-রে লীলা, তোর দিক থেকে কী…
—তেমন কিছু হলে জানতেই পারতে।
—এমন একটা কিছু ঘটতে চলেছে আগে থেকে তার আঁচ পাসনি?
—না।

বস্তুত লীলাবতী ওদের দিকে পিছু ফিরে জানালার গ্রিল ধরে মানবের সঙ্গে তার সম্পর্কটা আগাগোড়া ভেবে দেখছিল এসব কথার মধ্যে। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। বাবা স্কুলমাস্টার। মানব উচ্চবিত্ত। কোম্পানির কভেনেটেড অফিসার। চেহারা ভালো থাকায় নজরে পড়ে গিয়েছিল। ব্যাপারটা ওর হাঁসের মতো গলা, মুন স্টোনের মতো চোখ, পলসন বাটারের মতো চামড়ার দাম—দামটা ভালোই পাওয়া গিয়েছিল। গাড়ি, বাড়ি, মাইক্রোওভেন। প্রথম আলাপে বুকের খাঁজ থেকে পেন খুলে হাতে ধরিয়ে দিলে মানব, দেহতপ্ত জিনিসটাকে নাকের কাছে ধরে জিজ্ঞেস করেছিল—কত লিখব?
—আপনার কাছে আমরা ভালো সাহায্য পাবো আশা করে এসেছি। ভিয়েতনামের যুদ্ধে অনাথ শিশুদের জন্য খেলনা কিনে পাঠানো হবে। বুঝতেই পারছেন… মা বাপ হারানো সেইসব বাচ্চাদের কত কষ্ট!
—না পারছি না। তবে চাঁদা দেবো। আপনারা এসেছেন।

লোকটা সত্যি করুণা, প্রেম এসব বুঝতে পারে না। তবে জিনিসের বাজারদর বোঝে। সেদিন ওর হাসতে হাসতে শরীর চেয়ারে হেলিয়ে দেওয়াটা নাকি খুব সেক্স অ্যাপিলিং ছিল। দুম করে ফেলে দেওয়ার ব্যাপারটা তাহলে কি বাজারদর কমে যাওয়া? প্রথমে দুঃখে চোখে জল এল লীলার, তারপর নিদারুণ ক্রোধের তাপে সে-ই জল শুকিয়ে গেল এবং জ্বলন্ত চোখ ফিরিয়ে ও জিজ্ঞেস করল—কী বলতে চাও তোমরা?

দাদা বলল—ভেঙে পড়িস না লীলা, মামলা করতে চায় করুক। আমরা না লড়ে ছেড়ে দেবো না, খোরপোশ তো চাইই।
—না। লীলার খরস্বর ধ্বনিত হলো।

বউদিও উঠে এসেছে। বলল উকিলের চিঠি দিলেই হলো? তোমার নিজের পাসবুক, ব্যাংক-লকারের চাবি, জিনিসপত্র আনতে হবে না? ওঠো, চলো, তুমি আর আমি যাই।
—না, আমি একাই যাবো।

সে-ই ভালো। কোথাও একটা ভুল হয়েছে। তুই চলে যা। নিজেরাই বোঝাপড়া করে নে। মেয়েমানুষকে একটু নত হতে হয়। চিরকাল পুরুষের… কথা ক’টা বলতে বলতে মা থেমে গেলেন।

লীলাবতী ভাবলো যা হচ্ছে হোক। মানবের চেয়ে ধনী কাউকে বিয়ে করে সে দেখিয়ে দেবে, তার মধ্যে এখনও সে-ই পুরোনো যাদু আছে। তবে শেষ হিসেবনিকেশ করার জন্য একবার যাওয়া দরকার।

তো যেতে যেতে… শহর-পথের হলুদ রঙের ট্যাক্সি থেকে মেঠো পথের গরুর গাড়ি, গরুর গাড়ি থেকে গাঙুরের নৌকো হলো সে-ই বাহন।

ঘাটে নেমে হাঁটাপথে দুই ক্রোশ। ইতোমধ্যে লীলাবতীর পরিধেয় পালটে গিয়েছে। মঙ্গলকাব্যের আমলে যেমনটা হতে হয়। পদ্মপেড়ে তাঁতের শাড়ি। ব্লাউজ, শায়া নেই। তবে কাঁচুলী আছে। কপালে বড় করে সিঁদুরের টিপ, চোখে কাজল। আসার আগে রিঠার ফেনায় চুল ধুয়েছে। ডাবের জলে কলাই বেঁটে কাঁচা হলুদ মিশিয়ে অঙ্গ মার্জনা করেছে।

ঘাটে পা দিয়ে লম্বা ঘোমটা টেনে দিল। শ্বশুরের দেশ। সঙ্গে দাদা ও লাঠি হাতে রূপচাঁদ ডোম। খেতে কৃষকের হাল নেমেছে। পক্ষকাল আগে অম্বুবাচীতে পৃথিবী রজস্বলা হয়ে এখন বীজ ধারণের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। লীলাবতীর শ্বশুর ব্রাহ্মণ ভূস্বামী। এইসব জমি, ওই পশু ও মানুষগুলি তাঁরই। সম্পত্তি থাকলে তার উত্তরাধিকারী চাই। না হলে ধারাবাহিকতা থাকে না। মাটি থেকে শস্য জন্মায় এবং নারী থেকে সে-ই শস্যের মালিক জন্মায়। মাটি পুরুষের সম্পত্তি। নারীও তাই। হায়! লীলাবতী এখন পর্যন্ত কোনও সন্তানের জন্ম দিতে পারেনি। অনুর্বর মাটির মতোই অনু্র্বর নারীরও আদর নেই।

ফাল্গুনের আজ শুক্লা দ্বাদশী। শীত কেটে বেশ একটু গরমের ছাট পড়েছে। আকাশ রোদে ঝলমল করছে। যেতে যেতে একটা দীঘিতে ওরা তৃষ্ণা মেটালো। পাড়ে বসে বাড়ি থেকে আনা নাড়ু-মুড়ি দিয়ে জলযোগ করে নিল। তাল আর পিঠুলি গাছের ছায়ায় বড় গভীর দেখাচ্ছে নিস্তরঙ্গ জল। কিনারে ঝাঁক-বাঁধা পদ্ম এ ওর গলা জড়িয়ে, রূপসীরা যেসব গোপন কথা কেবল সইকে বলে সে সব আলাপ করছে মনে হয়। তাদের পাশে লীলাবতীর বিম্ব বড় স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। লীলাবতীর মনে আছে। বিয়ের পর এইখানে ওদের পালকি নেমেছিল। সঙ্গে বর। তখন ছিল একরকম। সামনে সুখের রাত। সৌভাগ্যের দিন। আজ অন্যরকম। স্বামী আর একটা বিয়ে করেছে। বংশরক্ষার জন্য। তাই তো বলে পাঠিয়েছে। লীলাবতী এই উনিশ বছরের যৌবনে যদি গর্ভধারণ নাই করতে পারে তো এই খঞ্জনী চোখ, ফেটে যাওয়া ডালিমের দানার মতো দাঁতের পঙ্‌ক্তি, পানপাতা মুখ আর ঘন পত্রপুঞ্জের আড়ালে ঈষৎ উদ্ভাসিত দুটি কদম্ব-কোরকের মতো স্তন—এসব বৃথা। লীলাবতী ভাবলো তবে মেয়েমানুষের এত রূপ কেন? ও হাত বাড়িয়ে জল ছলবল করে দেওয়া-মাত্র প্রতিবিম্ব ভেঙে গেল।

ওকে হাত বাড়াতে দেখে রূপচাঁদ ব্যগ্র হয়ে জিজ্ঞেস করল—কী গো, পদ্মচাক নেবা নাকি? মুই তুইল্যে দি?লীলীবতীর হ্যাঁ-না জবাবের আগেই কাপড় গুটিয়ে জলে নেমে ওই অস্পৃশ্য যুবক সঙ্গী কয়েকটা পদ্মচাক আর ফুল তুলে ওখান থেকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিল লীলাবতীর দিকে।

শ্বশুরবাড়িতে ঢোকার মুখে, বিগত ধুমধামের চিহ্ন চোখে পড়ল। দুয়ারের দু-পাশে কোমরভাঙা কলাগাছের নীচে মঙ্গল কলস। শামিয়ানা খুলে নেওয়া হয়েছে কিন্তু খুঁটিগুলি আছে। তার গায়ে ছেঁড়া পাতার মালা ল্যাপটানো। আর যা-কিছু সব নিত্যকার মতো। গোয়ালের বাইরে দুধ দোয়ানোর অপেক্ষায় খুঁটোয় বাঁধা গাইগুলি, ঢেঁকিশালে ধানকোটার ধুপধাপ শব্দ, ধোঁয়ায় রান্নাঘরের আচ্ছন্ন চাল। সংসারের সমস্ত কাজ চলছে। লীলাবতী জানে, শুধু ওর জায়গাটা পালটে গিয়েছে। হেঁশেলে এখন ওর সতীন।

বাইরের বাকুলে দাঁড়িয়ে দাদা হাঁক দিল—কই গো, কুটুমবাড়ির কে আছ? তোমাদের পুরোনো বউ এসেছে।

দাসী মানদা সাজোকাচোর কাপড়চোপড় পিঁড়ির ওপর থুপ করে মাথায় নিয়ে ঘাটে যাচ্ছিল, তাদের দেখে সে সব নামিয়ে কাছে এসে বলল—ও মা! চলে এলে যে?
লীলাবতী জিজ্ঞাসু হলো—কেন? আসতে নেই?
—না, তা এলে ভালো। কিন্তু এঁরা যে… তা আমি ভেতরে খবর দি। তোমরা ওই দাওয়ায় বসো।

বেশ কিছুক্ষণ বাদে বগলে একটা গুটানো মাদুর আর হাতে একঘটি জল এনে মানদা বলল,—বড় কর্তামশাই নাই গো। জমি গেছে। তিন পহরে ফিরবে। ততক্ষণ তোমাদের এখেনেই থাকতে হবে।
দাদা বলল—তা নয় থাকছি। কিন্তু তোমাদের বউ ভিতরে নিয়ে যাও।
মানদা গলা নামিয়ে জবাব দিল—সে হবেনি গো। ঠাকরাইন বলল, পুরোনো বউকে নাকি ত্যাগ করেছে। কেন এলো? ভেতর-বাকুলে যেন না ঢোকে।
দাদা উচ্চৈঃস্বরে বলল—ইঃ, বললেই হলো! কেন, সতীন-ঘর হয় না? কী অন্যায় করেছে, আমার বোন?

লীলাবতী তাদের দুজনের কথার মাঝে বলে উঠল—ঠিক আছে মানোদিদি, বাবাঠাকুর আসুন, তখন যা হয় হবে। তা অনেক সাজোকাচো দেখছি? নতুন বউয়ের বুঝি? চলো, আমিও তোমার সঙ্গে ঘাটে যাই।
—থাক্! থাক্! এই এলে, জিরান নেও।—মানদা বলে ওঠে।
—ও মা! তাই হয় নাকি? একটা দিন তো থাকবো-খাবো। মেয়েমানুষ না খেটে খায় নাকি?

স্বামী-পরিত্যাক্তা লীলাবতী পতিগৃহে সারাদিন কাপড় কাচলো, বাসন মাজলো, গোয়াল কাটলো, কামিন্যাদের সঙ্গে ঘুঁটেও দিল। সব বাইরে বাইরে। কাজের ফাঁকে স্বামীকে দেখল দূর থেকে। নতুন বউকে দেখল কাছ থেকে। খেতে গিয়ে। নাকের চেয়ে বড় নোলক, শীর্ণ কচি বয়সি মেয়েটি।

—তুই বুঝি আমার সতীন?

জিজ্ঞেস করতেই ঢিপ করে প্রণাম করে বসলো লীলাবতীকে, সে-ই মেয়ে।—সোয়ামী-পুত্তুর নিয়ে সুখে থাক—বলে, চারপাশে তাকিয়ে দেখল কেউ নেই; তারপর, গলায় হিংস্রতা ঢেলে দিল লীলাবতী—কেমন লাগছে আমার বরকে? সাবধান ছুঁড়ি… আমাকে তাড়াল কেন জানিস? পেটে আসে নাই বলে। তোরও হবে না। ও লোকটার কোনও ক্ষমতাই নাই। যদি টিকতে চাস তো যেভাবে হোক, যাকে দিয়ে হোক এদের বংশরক্ষা করে দে।

ফিরে আসতে আসতে চোখে পড়ল ওর সতীন, যমুনা, বড় ভীত, চোখেমুখে ত্রাস। বাঁশের খুঁটি জাপটে প্রমাণ মাপের শাড়িতে জবুথবু হয়ে ঘামছে। লীলাবতীর করুণা হলো, দুঃখ হলো, ঘেন্নাও হলো।

তোর শ্বশুর তো কিছুই কানে নিতে চাইল না লীলা। বললাম, সতীন নিয়ে কি কেউ ঘর করে না? তার জবাব হলো: ও বাঁজা, ওকে নিয়ে আমাদের লাভ কী?—তো অনুনয় করলাম, বউ না মানুন, কামিন্যা রাখুন। বারবাড়িতে থাকবে, খেটে খাবে। আপনার জমিজমা ধানপান কতো। লোকও তো তেমন চাই। তাইতে বললেন: আমার দুই বিধবা বোন আছে। কাজের লোক অনেক। আর চাই না। একে নিয়ে যাও। পুরোনো বউ থাকলে নতুন বউয়ের দিকে ছেলে ফিরে তাকাবে না। আমার নাতি হবে না।—তা অনেক তো সাধলাম। কিন্তু আমাদের কাল সকালেই ফিরে যেতে হবে। তুই নিজে একবার বরং শ্বশুরকে শুধিয়ে দ্যাখ না!—দাদার বলে যাওয়া কথা সব শুনে লীলাবতী ঈষৎ ঘাড় কাত করে বলল—আচ্ছা।

দীন বেশে নয় কানোরী ছান্দে খোঁপা বেঁধে আঁচলে মা’র দেওয়া বর-বশীকরণের জড়িবুটি গিঁট দিয়ে পানরাঙা ঠোঁটে লীলাবতী শ্বশুরের ঘরে ঢুকল। হাতে, সতীনের কাছ থেকে চেয়ে নেওয়া সিদ্ধির গ্লাস। শ্বশুরের নিত্যকার এই অভ্যাসটার কথা লীলাবতীর জানা। ওকে দেখে চমকে উঠল লোকটি।
—তুমি কেন?
—আগে তো আমিই দিয়ে যেতাম বাবাঠাকুর।
—না, না, ছোট বউকে দাও।
—কাল ভোরেই তো চলে যাব। শেষবারের মতো একটু পা টিপে দিয়ে যাই।
—দাও। কিন্তু সকালে উঠে আর যেন দেখতে না পাই।

লীলাবতী মোহিনীর মতো হাসল। তারপর শ্বশুরের পায়ে ওর চাঁপার কলির মতো আঙুলে নরম চাপ দিল। পাশের ঘরে বাতে পঙ্গু শাশুড়ি, মাঝ-বাকুলের ডান দিকের ঘরে স্বামীর কোলের কাছে এতক্ষণে যমুনা বইছে। দক্ষিণের ঘরে, দুই পিসি শাশুড়ি। সবাই দুয়ার বন্ধ করে দিয়েছে। লীলাবতী যুবতী বয়সের সমস্ত ছলাকলা একে একে প্রয়োগ করল। শেষরাতে শেয়াল ডাকলে, বিছানা থেকে নেমে এসে গায়ে শাড়ি জড়াতে জড়াতে বলল—তাহলে আমি যাই?
—দূর হ।
—পেটে আপনার সন্তান, ছেলে হলে দেখিয়ে যাব কি?
—তুই পাপিষ্ঠা।
—কেন বাবা, তাতে আপনার বংশরক্ষা হবে না?
ভূস্বামী তারাশঙ্কর মুখোপাধ্যায় আর্তনাদ করে উঠলেন—না। হায়! আমার যে নরকেও স্থান হবে না। তুই আমার এতবড় সর্বনাশ করলি!

লীলাবতী বিজয়িনীর মতো হেসে দরজা খুলে একেবারে বাইরের বাকুলে চলে এল। জোছনায় থইথই করছে রাতের শেষ প্রহর। ঢেঁকিশালে গিয়ে ঘুমন্ত রূপচাঁদকে আস্তে করে ডেকে তুলল—এই ওঠো, আমাদের যেতে হবে।
—দাদাবাবু?
—না, কেবল আমরা দুজন। হাঁ করে কী দেখছ? চুপচাপ চলে এসো। পিছন দিকে একটা জংলা পথ আছে।

জংলা পথে যেতে যেতে বন ক্রমশ ঘন হয়ে উঠেছে। গাছগুলি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর। আলো গ্রাস করার জন্য ঠেলাঠেলি করে উপরে উঠছে যেন। নীচে প্রায় অন্ধকার। স্যাঁতস্যাঁতে মাটি। পচা পাতা ও শ্যাওলায় পিছল। হেঁটে যেতে যেতে লীলাবতী পার হয়ে গেল শতাধিক পুরুষের কাল।

এখন অবশ্য ওর গোষ্ঠীতে পুরুষ বিশেষ নেই। আছে, মাত্র পঞ্চাশজন। শিশু ও বালক সহ। পশুদের জগতে যাকে খাও সে-ই খায়। ঝোপঝাড়ে আকাশ জলে মৃত্যু ওঁত পেতে থাকে। এত সহজ যে কেউ শোক করে না। পাহাড়ের খাঁজ বেয়ে লীলাবতী তার গোষ্ঠগুহার কাছে উঠে এল। শিশুদের জন্য বন থেকে কিছু ফল ও নদী থেকে কচ্ছপের খোলায় জল নিয়ে এসেছে সে। তাকে দেখে সন্তানেরা ছুটে এল। তারা তাদের মা’কে চেনে। যে জন্ম দেয়, স্তন্যপান করায়, লালন করে তার প্রতি আজন্ম টান সন্তানদের অনুগত করে রাখে। তা ছাড়া আছে ভয়। মা তাদের যাদু জানে।

নারীটি জল আনতে গিয়ে নদীর বালুতে দল-ছুট বাইসনের উত্তরমুখো পায়ের ছাপ দেখে এসেছে। পুরুষদের সে-ই পশুর হদিস দিয়ে শিকারে যাওয়ার হুকুম দিল। পাথরের হাতিয়ার নিয়ে তারা ভয়ংকর চিৎকার করে ছুটে চলে গেলে, লীলাবতী শিশুদের ফল জল দিয়ে গুহামুখের আগুনে দুটো কাঠ ফেলে দিল। এই আগুন সে দাবানল থেকে কুড়িয়ে এনেছে। আজ বনে গাছের পাতা ঝড়তে দেখেছে, অন্যদিনের চে বেশি। তার মানে শীত আসছে। জ্বালানির জন্য কাঠ আর আচ্ছাদনের জন্য পশুর চামড়া জোগাড় করে রাখা চাই। এসব সে জানে, বোঝে। পুরুষের চোখে সে এক যাদুকর। না তো কী? তার পাতার কটিবাসের নীচে জন্মের উৎসে প্রচণ্ড ঘূর্ণি। চোখে বুকে ভয়ংকর টান।

সূর্য অস্ত যায় যায়। পশ্চিমের আকাশ নানা রঙে বিচিত্র হয়ে উঠেছে। শিকারিরা নিহত বাইসন নিয়ে ফিরে এসেছে। নারী, যাদুকর, বাইসনের সামনের পা-দুটি ছুটে যাওয়ার ভঙ্গিতে ছড়িয়ে দিয়ে একমুঠো দূর্বা ঘাস তার মুখে গুঁজে দিল। সমস্ত শিকারিরা হু-লা-লা-লা করে চিৎকার করে উঠল। এই অভিচারে পশু পুনর্ভবা হবে। আবার ফিরে আসবে। গোষ্ঠের মানুষদের খিদে মেটাবার জন্য। লীলাবতী তীক্ষ্ণ পাথর দিয়ে এবার পশুটির বুক ও পেটের চামড়া ছাড়িয়ে মেটে আর হৃদপিণ্ড খুলে নিয়ে শিশুদের খেতে দিল। এবার বাকি সবাই খিদে মেটাতে পারে। যার যেমন দেহের শক্তি, যার যতটা খিদে সে-ই তার প্রয়োজনের পরিমাপ। যে যার মতো মাংস কেটেছিঁড়ে খেতে থাকল। লীলাবতী নারী তার অংশটুকু নিয়ে একটা পাথরের উপর বসে খেতে খেতে দেখল, দলবদ্ধ জোয়ান পুরুষদের কাঁধের আড়াল দিয়ে সূর্য টুপ করে ডুবে গেল। তাদের ঘামে ভেজা সবল পেশিতে আর রক্তমাখা দাঁতে দপদপ করতে থাকা আভা।

সামনে আগুন আর লীলাবতী নারী। সে তার খাওয়া শেষ করার পর হাড়খণ্ড ছুঁড়ে ফেলে দিল। অন্ধকারে ঝোপের আড়ালে খসখস শব্দ শোনা গেল। বন্য কুকুরেরা মানুষের ফেলে দেওয়া খাবারের লোভে কাছাকাছি উঠে আসে।

আকাশের অমল আলো চরাচর মগ্ন করে দিয়েছে আজ। পুরুষদের একজন সে-ই আলোয় লীলাবতী নারীকে দেখল। পশুমাংসের রস ও ঘ্রাণ থেকে আর একটা তীব্র অনুভূতির জন্ম হচ্ছে। সে উঠে গিয়ে সে-ই নারীকে হাত ধরে কাছে আকর্ষণ করল। আরও একজন পুরুষ চিৎকার করে ছুটে আসা মাত্র নারীটি লাফ দিয়ে আরও উঁচু ধাপে উঠে গেল। সেখান থেকে সে দেখল মহাযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে দুই পুরুষমানুষের ভিতর। তারই জন্য, তার রূপমুগ্ধ দুই পুরুষের ভিতর। দুই প্রতিদ্বন্দ্বী পরস্পরকে ভয়ংকর গর্জন করে আক্রমণ-প্রতিআক্রমণ করছে। পাথর ছিটকে যাচ্ছে। ধুলোর মেঘ। তাতে রক্তছটা। ডালপালা ভাঙার শব্দ। ঘর্ষণজনিত স্ফুলিঙ্গ ছিটকে যাচ্ছে। আর্তনাদ এবং বর্বর উল্লাস। পেটের খিদে মিটতে জেগেছে মিলনেচ্ছা। তারপর জিঘাংসা। তার একদিকে মৃত্যু, আর একদিকে জন্ম। উচ্চধাপে দণ্ডায়মান যে নারীর আগুনের মতো লাল চুল হাওয়ায় উড়ছে তার জোছনায় ধোয়া শরীরের কারণে যা-কিছু ঘটার ঘটে চলেছে নীচে।

বহুদূর বিস্তৃত বন, নদী, ঢেউ খেলানো উপত্যকার এই পৃথিবীতে তার আর অন্য কোনও নাম নেই—সে নারী। নদী বন আকাশ উপত্যকা সব সে-ই নারীর। যে সন্তানরা গোষ্ঠীকে ক্রমশ বড় করেছে তার মধ্যে বহুজাতিক কোম্পানির ম্যানেজার মানব বসু, ভূস্বামী তারাশঙ্কর মুখোপাধ্যায় এবং অন্ত্যজ রূপচাঁদ ডোমের বীজ আছে।