‘এছকলুছিপ ঝি’ হওয়ার সুযোগ সকলের হয় না। কানন পুরোটাই কাজে লাগিয়েছে। বাপের দেওয়া নামটারও মহিমা থাকতে পারে, সিনেমার নায়িকার নাম। পুরোনো কথা মনে এলে কানন আড়ালে হাসল। অষ্টমী পুজোর দিন পুরোনো গন্ধ! বছর তিনেক হলো প্রায়। এ বাড়িতে কাজের খবরটা দিয়েছিল হেমা। এখন সে হাত কামড়াচ্ছে। আড়াইজনের সংসার। দাদাবাবু বউদিমণি দুজনেই চাকরে, ন’টার আগে বেরোয়, রিন্তুটা তখন কত আর, তবু স্কুলে যায়। সকালে আর সন্ধে ছুঁলে ওদের জন্য রান্না, ঘর ফাঁকা হয়ে গেলে ঝাড়মোছ, ব্যস, বাকি সময় টিভি খুলে বসে থাকো। রান্নাতেও প্রায়ই ফাঁক, ওরা হোটেলে খেয়ে আসে, কখনও দোকানের খাবার কিনে এনে বাড়িতে খায়। বছরে দু-বার বিশ পনেরো দিনের লম্বা ট্যুর হবেই। তখন ডিউটি থাকে না। এতসব মওকার পরও ফি হপ্তাতে রোববার ছুটি। কপাল চওড়া না হলে এমন গুণের বাড়ি মেলে! প্রথম দিনেই কথাবার্তা বলতে গিয়ে বউদিমণি বলেছিল,—শোনো, আমার বাড়িতে এক্সক্লুসিভলি থাকবে। অন্য কোনও বাড়িতে কাজ করবে না।

প্রস্তাবটা ভালো, সমস্যাটা নয়। এখানে ঝি-দের বাজারদর চারশো টাকায় ওঠানামা করে। দু-বেলা কাজে গেলে একশো টাকা কোথাও বাড়তি মেলে, তবে হাঙ্গাম অনেক। আগে কথা বলতে গেলেই জিভটা ভারী হয়ে আওতে আওতে যেত, এখন অভিজ্ঞতার পূঁজিতে কানন পাকাপোক্ত। তাই উত্তর সাজাল উকিলি ঢংয়ে,—বউদি, পাসসাত বাড়িতে কাজ না কোরলে আমাদের চলবেনি। চাট্টে পেটের গোঁ মিটুতে লাগে।

সওয়ালে একটু গলদ ছিল। চালাকি করে একটা পেট বাড়িয়ে দিয়েছে। বরের সঙ্গে ও থাকে না, সেটা আরেকটা ধুমসো মাগিকে নিয়ে ভেগেছে। কাননের চোপায় বিধবা শাশুড়ি মাসে পঁচিশ দিন পাড়াতেই বড় ছেলের সংসারে, নইলে মেয়ের কাছে পড়ে থাকে। সে ননদ আবার কাননকে দু-চোখে দেখতে পারে না। দেখা যাচ্ছে ঠিক মাপের পেট বলতে দুটো—নিজে আর তখন পাঁচ ছোঁয়া বিজু।

—কত পাও, সব মিলিয়ে?
—আজ্ঞে, বউদিমণি, তিন বাড়িতে সাতশো করে দেয়, এক বাড়িতে পাঁচশো, মোট…।—কীভাবে যে মিথ্যেগুলো পরপর জিভ আর মুখ দিয়ে খসলো, কানন হিসাব রাখতে পারছে না। বউদিমণি চোখ বুজে কীসব ভাবছিল, চোখ খুলে বলে,—শোনো, আমি তোমায় তিন দেবো। হাজার। না করবে না। আমার কাজের লোকের প্রয়োজন নেই, ঘরের লোকের দরকার। আসছে সোমবার থেকেই কাজে লাগো। মাস পয়লাও পড়ে যাবে।
—ঠিক আছে, বউদি। চিন্তা একটাই, ওই বাড়িগুলো ছাড়ার সময় আবার ঝামেলা না করে।

মামলাটা মসৃণভাবে কাননের পক্ষে চলে গেছে।


২.

কানন অর্থনীতি পড়েনি, তাই ওর আসল আয়ের অঙ্কটা হিসেব করে নিখুঁত জানাতে অক্ষম। নইলে ও বলতে পারতো যে রোজগারটা অঙ্কের কত গুণক। মাইনের চেয়ে পার্কস প্রচুর। বড় বড় কোম্পানিতে যেমন হয়। এগুলো মালিকপক্ষ ওকে দেয়নি, ও নিজেই আদায় করেছে নানান ফন্দিফিকিরে।

বউদিমণির সংসারে শখের জিনিস সবই ‘ইমপোট’ মাল। কানন সেগুলো নিজের বাড়ি নিয়ে আসে। তা বলে ও কিন্তু চোর নয়। যেমন টয়েলেট সাবান। বাথরুমের মার্বেল র‍্যাকে কেসের মধ্যে ঝলমলে বেশে থাকে। কী সুন্দর গন্ধ! গায়ে মাখলে দিনভর ভুরভুর করছে। টিভিতে দেখায়, মেয়েটার কাছে মদ্দাটা কিছুতেই ভিড়ছে না, তখন সে মেয়ে মাখলো, অমনি চারদিক থেকে ভোমরা ঝাঁকে ঝাঁকে ভনভন আওয়াজে উড়ে এল। মদ্দাটাতো ছুটবেই। বউদিমণি গায়ে মেখে, শাড়ি পরে, যখন অফিসে বেরুতে যাবে, তখন ঘর জুড়ে ভ্রমরগুঞ্জন শুনতে পায় কানন। দাদাবাবুর চোখমুখটাও টিভির মদ্দার মতো লোভী লোভী বর্ণ ধরে। এই সময়টায় দৈবাৎ বউদিমণির দিকে চোখ পড়লে কাননেরই ভেতরে শরম ধাক্কা দেয়, গন্ধটা ফ্যানের বাতাসে কেটে কেটে ওকেও ছুঁয়ে গেছে। দাদাবাবুর দিকে চোখ গেলে আরও লজ্জা, গা-টা কেমন যেন করে।

সাবানটা ব্যবহারে ক্ষয়ে গেলে চ্যাপটা ব্রোঞ্জের পাতের মতো খাপটায় পড়ে থাকে। ওরা কেউ আর ধরে না, নতুন একটা মোড়ক খুলে উপরে বসিয়ে দেয়। কানন দু-চার দিন পাতটাকে চোখে চোখে রাখে, একদিন টুক করে সরিয়ে নেয়, দুপুরের ফাঁকা বারান্দার রোদে শুকিয়ে কাগজে জড়িয়ে রাখে। সন্ধের পর ফেরার পথে কোমরে গুঁজে নেয়। এ বাড়িতে শাওয়ার খুলে চান করার অধিকার আছে ওর, তবু সাধ জাগলেও সাবানটা মাখে না। ধরা পড়লে কী জানি কী হবে।

যেমন ট্যালকম, ফেস পাউডার, স্নো, ক্রিম, বডি অয়েল, ‘বেসডালেপার’, শ্যাম্পু, মাথার তেল, আরও আরও। সবই একটু একটু করে কাননের গাছকোমর ভর করে ‘এসপোট’ হয়ে যায়।

শনিবার রাতে ঘরে ফিরে কানন রাস্তার ধারের ট্যাপকল থেকে বালতি ভরে জল বয়ে আনে ওর ছোট বাথরুমে। দরজা বন্ধ করে অনেক সময় বেহিসাবী খরচ করে শ্যাম্পু মাখে, সাবান বোলায়, টিভিতে যেমন দেখা যায় তেমনি। ফুরফুরে ফেনার পালকে ভাসন্ত নিজেরই শরীরটাকে দেখতে ওর ভালো লাগে, ছুঁতে আবেশ বোধ হয়। বাইরের ময়লার গাদ বসা ড্রেন দিয়ে সুরভি জল বয়ে যায়, যেন ড্রেনটাই পাপ ধুয়ে শুদ্ধ হচ্ছে। ওপাশের বাড়ি থেকে হেমার চিৎকার ভেসে আসে,—কানন রে, কী সাবান মাখছিস?
—লাবেন্ডু। বউদিমণি দিয়েছে।

শুতে যাওয়ার আগে বাকি প্রসাধনগুলো একে একে হাতে মুখে লাগায়, কেবল ‘বেসডালেপার’টা লাগানোর সাহস এখনও করে উঠতে পারেনি। স্নিগ্ধ হয়ে যায় শরীর। তবু ঘুম আসে না। গা-টা গোলাতে থাকে। মশারি ভরা সুবাস আগুন জ্বালায়, ভাবে—একবার যদি মিনসেটা মাগিটাকে লাথি মেরে চলে আসতো! পাশে শোয়া বিজুকে বুকে চেপে গুঙিয়ে ওঠে।

চটকায় ঘুম ভেঙে ভয় পায় বিজু, বলে,—ও, মা! মা! কাঁদছো কেন?
—কিছু না, বাবা। পিঠটা এটু চুলকে দে।


৩.

রিন্তুকে স্কুলের পিকআপ ভ্যান বিকেল তিনটের পর ফিরিয়ে দিতে আসে। ফ্ল্যাটের নীচেই দাঁড়ায় গাড়িটা, তবু কাননকে সিঁড়ি ভাঙতে হয়। গার্জেনকে না পেলে গাড়িটা ফিরিয়ে নিয়ে যাবে স্কুলে, তখন থানা পুলিশের হ্যাপা হবে, ভীষণ ভয়ের ব্যাপার।

বউদিমণিদের কেউ না ফেরা পর্যন্ত মেয়েটা কাননের কাছে থাকে, সময়টা একরকম কেটে যায়। মাঝে মাঝে মেজাজ খিঁচড়ে ওঠে, বিশেষ করে বিজুর ভাবনা ভেসে উঠলে। ছেলেটা একা একা মাঠ-রাস্তায় খেলে বেড়ায়। ঠাকুমা বাড়িতে না থাকলে যারা ওর চোখের বিষ, মানে বিজুর জ্যাঠা জেঠি বা পিসি, তাদের কাছে খায়দায়। একবার ভেবেছিল কোনও ছুটির দিনে ওকে এখানে নিয়ে আসবে। সাহসে কুলিয়ে উঠতে পারেনি। ওরা কিছু, যদি, মনে করে! চাকরিটা চলে যেতে পারে! কাজ জুটবেই, কিন্তু এমন সুখ!

রাতের জন্য এ বাড়ি থেকে টিফিন কৌটো ভরে নিয়ে যায় কানন। সুস্বাদু খাবারের মৌজে ছেলেটা শুয়ে ওকে জড়িয়ে জিগ্যেস করে,—মা, তোমার কাজের বাড়িটা খুব বড়, তাই না?
—হুঁ।
—চৌকিটা বড়?
—পালং। অনেক বড়।
—বিছানায় গদি আছে?
—হুঁ। নরম গদি।—দীর্ঘশ্বাস পড়ল কাননের,—ঘুমো, বাবা। চোখ ভেঙে আসছে আমার।
বিজু ঘুমিয়ে যায়, কিছুতেই কাননের চোখের পাতা পড়ল না।

এরকম একনাগাড়ে কথা বলে রিন্তুও। বেশিরভাগটাই স্কুলের গল্প। কোন মিস কেমন কড়া, কোন স্যারের হাঁচিটা চিঁহুই আওয়াজ তোলে, এসব সবিস্তারে বলে সে, অভিনয় করে দেখায়,—বলে, জানো, কানন আন্টি, আমাদের বাইস্যাক মিস! ওল্ড ফুল, ইউ নো! শালোয়ার কামিজ পরে আসে! সিলি ম্যাম! আমরা সবাই হাসি। হি-হি-হি। মিস রেগে কাঁই। আর কথা বলে একেবারে পাপ্পি পাপ্পি!—হাসতে হাসতে কাননের কোলে লুটিয়ে পড়ল।

কাননের সংকোচ হয়, ভয়ও জাগে। মালিকের মেয়ে এতটা কাছে থাকবে, সেটা ওর বাপ মায়ের না-পসন্দ হতে পারে। ঠেলে তাকে উঠিয়ে বসিয়ে দিল।
—তুমি একটা ভালো কাপড় পরো না কেন, আন্টি?
হাসলো কানন,—কিনবো যে, পয়সা কোথায়?
—হোয়াই! মান্মির যে কত শাড়ি। একটা নাও।
—তালে এবার আমায় তাড়িয়ে দেবে।
রিন্তু ফুঁসে ওঠে,—ন্যাভার! কানন আন্টি, ন্যাভার। ইউ ডোন্ট নো, ড্যাড বলেছে—ইউ আর গুড, কোনওদিন ছাড়াবে না।

বাতাসের ছোট্ট ধাক্কা লাগল, কেঁপে উঠল কানন। মেয়েটা ওর হাত ধরে আছে, কাননের আঙুল বাচ্চাটার কনুইয়ে—সূক্ষ্ম রোমের উপর আলতো ছোঁয়ায় পিয়ানো বাজাচ্ছে। মেয়েটা বকবক করেই যাচ্ছিল, কানন কিছুই শুনতে পায় না।


৪.

বউদিমণি যখন পোশাক পরে বাইরে পা বাড়ায়, সত্যিই চেয়ে দেখবার মতো। কাননও দেখে। ওর নিজের শরীরটা ভাঙাচোরা। বয়সে বউদিমণি ওরই সমান হবে প্রায়। অথচ, তার শরীরটাকে এমন উন্নত রাখার ম্যাজিক মন্তরটা যে কী, অনেক ভেবেও তল পায়নি কানন।

ওদের দুজনেরই অফিস কী এক পরবে ছুটি ছিল। মালকিনের বাই উঠেছিল ঘর পরিষ্কার করবে। তকতকে নিকোনো ঘরের খোলনলচে আরেকবার ঝাড়াঝুড়োর মানে হয় না, তবু মালিকের ইচ্ছায় কর্ম।

ঘর বাছতেই সম্পদের ভাণ্ডার আবিষ্কার করেছিল কানন। একটা পিচবোর্ডের মুখ খোলা কার্টনে ওগুলো গুঁজে রাখা। রয়েছে দেয়াল আলমারির নীচের র‍্যাকের কোণে, যেখানে পাল্লায় কাচ নেই, স্টিলের পাতে ঢাকা।—ও বউদিমণি, এদিকে এসো।—ও ঘরে আওয়াজ পৌঁছবে বলে কানন জোরে ডাকল।
—কেন, কী হলো আবার!
—এসো না!—ও ঘরে দাদাবাবু শুনবে বলে কানন খোলসা করতে পারছে না।
বউদিমণিকে দেখাতেই তার মুখটা লাল হয়ে ওঠে,—বলে, কী করি বলো তো?
—এগুলো ফেলে দিলেই তো চুকে যায়।
—যাঃ। কোথায় ফেলবো? লজ্জার ব্যাপার।

একবার সে মহিলা ভেবেছিল, কাঁচি কিংবা ব্লেডে কুচিয়ে কেটে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেবে। ধোঁয়া আর পলিমার পোড়া কটু গন্ধের ভয়ে সেটা হয়নি। প্লাস্টিকের ক্যারি ব্যাগে ভরে ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়ার কথাও ভেবেছিল। পারেনি। কেউ যদি তাকে দেখে ফেলে। ছিঃ! রাস্তার কুকুর সঙ্গে সঙ্গে প্যাকেট ফাটিয়ে বাইরে টেনে আনবে। তখন! আগে গঙ্গার ওপারে অফিস ছিল, ঝামেলা হয়নি একরত্তি। খবরের কাগজে মুড়ে লঞ্চের জানালা গলিয়ে ঝুপ করে ফেলে দিলেই হলো। কত লোক তুলসি গাছ ফেলে।
—তুমি আমার এই উপকারটা করবে?
—কী?
—এগুলো নিয়ে যাও। তোমাদের ওদিকে, কোণে খাঁজে জঙ্গলে টঙ্গলে ফেলে দিও।
শুনতেই সাদা চোখে বউদিমণিকে আপাদমস্তক চাখে কানন। আশ্চর্য, সে-ও তো তারই মতো শিথিল। বলল,—বেশ, খবরের কাগজে ভালো করে মুড়ে চটের ব্যাগে পুরে দিও। লোকজন দেখে ফেললেই বিচ্ছিরি কাণ্ড।

অনেকগুলো সম্পদ জুটল কাননের। ঘরের কাজ সেরে, বিজু ঘুমিয়ে গেলে, জিরো ওয়াটের বালবের মরা আলোয় সুঁচসুতোয় গেঁথে সব ক’টা মেরামত করে নিয়েছে।


৫.

এত সব কায়দাকিসিমে ম্যানেজ করলেও কানন শাড়ি কখনও বাগায়নি। বছরে বরাদ্দ দুটো, পয়লা বোশেখে একটা, সেটা আটপৌরে, বাকিটা পুজোয়। ওর ছেলেটার জন্যও একটা জামা পায়, সেটা বোনাস। পুজোর শাড়িটাকে জমিয়ে রাখে কানন, কোনও বাড়িতে নেমন্তন্নে গেলে পরে। একটু দামি হলেও শাড়িটাতে ঝি ঝি গন্ধ থাকে বলে হেমা বা অন্যদের চোখ টাটায় না। এ বাড়িতে কাজে লেগে কানন একটা শিক্ষা পেয়েছে, মালিকের কাছে কিছু চাইতে নেই, ওতে ‘গুডিল’ বাড়ে। বাইরে ওরা বলে বেড়ায়,—আমাদের কাজের বউয়ের খাই নেই।—এভাবে বলে, অন্যদের হারিয়ে, নিজেরা জেতে।

এবারে রিন্তুরা যাবে সাউথের দিকে, পঁচিশ দিনের লম্বা ট্যুর। ফিরবে পুজোর মুখে। রিন্তুর মা কাননকে ডাকে,—তোমার দাদাবাবু বলছিল, তুমি যাবে নাকি আমাদের সঙ্গে? যাও তো বলো। তুমি গেলে আমাদেরই সুরাহা হয় অবশ্য।

কাননের লোভ জাগছিল। নিজের বেড়ার ঘর আর ভাজের প্রাসাদের মাঝখানের রাস্তাটুকু ছাড়া আর কোথাও রোদ কিংবা সন্ধ্যার আঁধারের অন্য কোনও রং ও দেখেনি। যে পশুটার সঙ্গে ও গাঁটছড়া বেঁধেছিল, সেটা দেড় দু-বছর ধরে ওকে শুধু চটকেছে, তারপর আরেকটা ‘ডাইনি’র শরীরে ডুব মেরেছে। এখন চোখের সামনে নিজেকেই ডানা মেলা পরি হয়ে উড়ে যেতে দেখছে কানন, তারপর হঠাৎ মনে হলো, পরিটার দুই ডানা খুলে উড়ে যাচ্ছে হাওয়ায়, আর ও ধপাস করে মাটিতে থুবড়ে পড়ল। চমকে কাঁপলো কানন, তড়িঘড়ি বলে,—আমার ছেলেটাকে কার কাছে রেখে যাব, বউদিমণি?

ব্যাপারটা আগে ভাবা উচিত ছিল মহিলার, এখন টাল সামলাতে সময় নেয়, বলল,—তুমি বাচ্চার টিকিটের দামটা দিও। নগদে না, তোমার মাইনে থেকেই মাসে মাসে কেটে নেবো। আর কিছু লাগবে না।
—না, না, বউদিমণি, তোমরা যাও।
—এবার সাউথ থেকেই পুজোর বাজারটা সেরে আসবো। বলো, কী শাড়ি আনবো তোমার জন্য।
ঝাঁপি থেকে ছুরির মতো হাসিটা বের করল কানন,—আমি কী বলবো, বউদিমণি, তোমার যা ভালো লাগে তাই দিও।

কানন যখন যাবেই না, ওরা ফ্লাইটে যাবে।


৬.

লম্বা ছুটিটা রসিয়ে রসিয়ে জর্দাপানের মৌজে চিবুচ্ছিল কানন। কত বছর বাদে বাপের ঘরে হপ্তা কাটিয়ে ফিরল। হেমারা কাজ সেরে ফিরলে ওদের ঘরে গিয়ে গপ্পো জমাতো। ওদের ঘরের কাজ শিকেয় তুলে মজা পেলো। একদিন নিজের ঘরের বারান্দায় বসে শাশুড়ির সঙ্গে এমন জমে গেল যে, ভাবা যায় না, দুজনের সম্পর্ক সাপে নেউলে।
শাশুড়ি বলে,—হ্যাঁ রে, তুই তো অনেক পাস। আমায় একটা ভালো কাপড় দে-না।
কানন চোখ টিপে মজা করে,—কেন, তোমার আঁচলের ধন বড় বউ দিচ্ছে না?—একটু পরেই আশ্বস্ত করে,—কত আর পাই! তবে আসচে পুজোয় তোমায় ভালো থান দেবোখন। দেকো, তেনাকে আবার লাগিও নাকো।

ঝামেলাটা হলো দাদা-বউদিদের ফেরার মুখে, কোথ্‌থেকে এক ধূম জ্বর ঘাড়ে চাপলো। থাম্মোটারের পারার জল সাড়ে চার ছাড়িয়ে পাঁচ ছুঁই ছুঁই। প্রথমদিকে ফার্মেসি থেকে ট্যাবলেট কিনে সামাল দিতে চেয়েছিল, শেষে হাল ছেড়েছে। হেমাই নিয়ে গেছে হাসপাতালে। ডাক্তারবাবুর নিদানটি দীর্ঘ—বারবার মাথায় জল ঢালা, গায়ে জল ঢেলে স্নান, আর দিনে তিনটে করে ক্যাপসুল। একটা কিনতে তিরিশ টাকা খরচ হচ্ছে। জলের মতো বেরিয়ে যাচ্ছে, কত বুদ্ধিতে জমানো টাকা। ওষুধ খেলে কী হবে। গতরে জোর পাচ্ছে না, উঠতে মাথা টলে। ভয় লাগছে। কাননের, কাজটা হয়তো চলে যাবে। তার গন্ধল ফুটানি মারার দিন শেষ।

বালিশের পাশে শোয়ানো মোবাইলে বউদিমণির নম্বর বেজে ওঠে,—কী, কানন! কাজে আসছো না কেন? তুমি তো জানতে, আমরা কবে ফিরবো। ঘরটা ড্যাম ধরে আছে। ধুলোয় নোংরা। তুমি এরকম করবে…।
—বউদিমণি!—কানন আর বলতে পারেনি। ওর কান্নাটি ওপারের মুঠোযন্ত্রে বেজে উঠেছে নিশ্চিত। কেননা, অনেকক্ষণ ওপার থেকে কোনও শব্দ ভেসে আসে না।
—কাঁদছো কেন? কী হয়েছে তোমার?
—জ্বর বউদি, মরার জ্বর। পাঁচ ছয়ে উঠছে। নড়বো চড়বো, শক্তি নেই গো, বউদি।
আবার কথা আসে না, তবে সেটটা খোলা আছে বোঝা যায়, একটা অস্পষ্ট পুরুষের গলা পাওয়া যায়, ‘ওর ঘরটা কোথায়, জিগ্যেস করো।’
—ডাক্তার দেখেছে? বউদিমণিই বলে।
—হাসপাতালে গেছিলাম, বলেছে ‘কলকাতা জ্বর’। বাপের জন্মে অসুখের এমনপারা নাম শুনিনি গো।
—ঠিক আছে। এখন রাখো।

কানন ভাবতে পারেনি বউদিমণি সন্ধেতেই হাতে ছোট বড় দুটি ক্যারিব্যাগ ঝুলিয়ে আবির্ভূত হবে। আগে বুঝলে শুয়ে কঁকিয়ে রোগটাকে বাড়তি দেখাতে পারতো। ক্যালকাটা ফিভারে রোগী প্রচণ্ড দুর্বল হয়ে পড়ে, শুনেছে মহিলা। তাড়াতাড়ি কাননকে সুস্থ না করতে পারলে তার বাড়ি বেহাল। ফলের ব্যাগটা তুলে বলল,—কেমন আছো, এখন?
—বিকেল থেকে জ্বরটা, মনে হয়, এট্টু নেমেচে।—অক্ষরগুলো কোনওক্রমে জিভ দিয়ে ঠেলে দিল।
—কালপরশুই ছেড়ে যাবে, ভেবো না।
চৌকিতেই বসেছে বউদিমণি। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঘরটাকে তদন্ত করছে। কেমন আঁশটে আঁশটে গন্ধ লাগে, ভিতরে ভিতরে নাক কুঁচকায়। বাইরে পড়শিরা এসে উঁকি মেরে যাচ্ছে, যতসব ছোটলোকি কাণ্ড!
—শোনো, এখন যাওয়ার দরকার নেই। রেস্ট নাও। পুজোর দিনগুলোতে মায়ের কাছে থাকব, রিন্তু ভীষণ ডিম্যান্ড করছে। একেবারে লক্ষ্মী পুজো সেরে ফিরব। তোমার দাদাবাবু অবশ্য মাঝে মাঝে ঘরটা দেখে যাবে। বিজয়ার পরে তোমায় ফোন করব, তুমি গিয়ে ঘরটা পরিস্কার করে এসো। দাদাবাবুও থাকবে।
ঘাম দিয়েই যেন জ্বরটা নেমে গেল, কাজটা থাকবে। কানন এক কুনকে হেসে বলল,—বউদিমণি, ঘুরলে কেমন?
—ভালো। তোমায় তো যেতে বললাম!—অন্য ব্যাগটাও চৌকিতে তোলে, তোমার জন্য একটা শাড়ি এনেছি। পিওর কাঞ্চীপুরম। এখানে একুশ-শোর নীচে মিলত না। দেখো, তোমার ভালো লাগে কিনা। যতই না করলাম, রিন্তুর বাবা গোঁ ধরে—এটাই কিনবে। বাইরে গিয়ে সিন ক্রিয়েট ভালো লাগে! রাবিশ!
শাড়িটার আঁচল খোলা পড়ে। দুর্বল হাতটা রাখলো কানন, বোলালো। বাসন্তীর সঙ্গে ক ফোঁটা গোলাপি ঢেলে রং করেছে। জমিনে খসখসে রুক্ষতা, মনে হয় লোম। সোনালি রোলেক্সে চৌখুপি, হাতে নখের আঁচড়ের মতো লাগল।
—পোরো কিন্তু।—বউদিমণি বলল।


৭.

ভোর থেকেই প্যাণ্ডেলে ঢাক বাজছিল, ভলান্টিয়ারের হুজুগে দল মাইকে ফুঁকে চলেছিল। কাননের উপোস ছিল। এক প্যাকেট সন্দেশ কিনে বিজুর হাত ধরে কাছের বারোয়ারি তলায় পুজো দিয়ে এসেছে। আজ মনটা বড় আর হালকা। দুপুরে মাংস রেঁধেছিল, হেমাকে পাঠিয়েছে এক বাটি, খেয়ে দেখুক বউদির বাড়িতে শেখা রান্নার সোয়াদ কেমন। বিজুটাকে কিছুতেই ঘরে রাখা যাচ্ছে না, বন্ধুদের সঙ্গে প্যান্ডেলে পড়ে থাকছে সারাদিন। সন্ধের আগে ওকে পাকড়ে প্রতিমা দেখতে বেড়িয়েছিল কানন, ফিরতে ফিরতে বেশ রাত। পা-টা চাবাচ্ছিল, সঙ্গে ক্লান্তি।

রোগের ধাক্কায় কাননকে বেশ একহারা লাগছে, তিন বছরের জমা চামড়ার উপরের তেলটা গলেছে, দাহনে রংটাও যেন একটু খোলতাই। বচ্ছরকার দিনের এই টুকরো সুখটা ওর ভালো লাগছে, ইচ্ছে করছে আনন্দটাকে আচারের মতো জিভ রেখে তাড়িয়ে তাড়িয়ে চাটে। এজন্যই দুম করে ভাসুর জা আর ওদের মেয়েটাকে দুপুরে খেতে বলেছিল। কেমন যেন বদলে গেছে ও, কিন্তু কেন ও নিজেই বুঝতে পারে না। যদি কেউ বলে টাকার জন্য। তবে বেশি টাকা যে ও তিন বছর ধরেই কামাচ্ছে। আজ সারাদিনে একবারও শয়তান মিনসেটার কথা মনে আসেনি।

বিজু এখন ঘুমিয়ে ন্যাতা। কানন উঠে বসল। আস্তে চৌকি থেকে নামল। বাইরে চটে ঢাকা বারান্দায় শাশুড়ি ঘুমোচ্ছে। জিরো ওয়াটের বালবটা জ্বালিয়ে চকিতে পরখ করে নেয় বিজু তাকিয়েছে কি-না। নিঃশব্দে টিনের বাক্সটা খোলে, বের করে আনে সুতোর মেরামতিতে টাটকা সম্পদের একটা। মোটা স্পঞ্জে ভারী, সিনথেটিক কাপড়, ইলাসটিক ফিতে আঁট। সমস্ত শরীরটা খাপে খাপে বসে যাবে, এতটা ভাবেনি ও। আশ্চর্য! দেহটা উন্নত হয়ে যায় ম্যাজিকে। নিজেই হাতে অঙ্গ বুলালো দু-বার। নতুন ব্লাউজটি পরে। সকালে মাখা লাবেন্ডুর গন্ধ সারা গায়ে। বসে রইল কিছুক্ষণ, প্রসাধনের কৌটো শিশির মুখ একে একে খুলে নিল, ছোট আয়নায় মুখ রেখে সিঁদুরের টিপখানা ঘষে ছড়িয়ে দিল। ঠিক করল, এবার থেকে ‘বেসডালেপার’টাও মাখবে। আর বাকি মাত্র একটা…।


৮.

উপরে কাঁচা শিশিরে ভেজা টালি, নীচে ঘরের বাতাস ঠান্ডা। কর্কশ শাড়িটা কেবলই সরে যাচ্ছে গা থেকে। কেমন অদ্ভুত গন্ধ, আনখা সুতোর ওম। ঘর ভরা অন্ধকার। শুয়ে আছে কানন। জেগে আছে। ঘামছে।