বার্ধক্য

নতুন দিনের আলোর জন্য এতদিনের প্রতীক্ষা
দিনের শেষে সব ঝাপসা
টিনের চালে বৃষ্টি মধুর শ্রুতি
বুকের মাঝে কান্না চোখ ঝাপসা।
আর কতদিন!
আতঙ্কের ধ্বনি ওঠে—আর কতদিন!

নদীর ধারে বসা হয়নি বহুদিন
কথা বলার ইচ্ছে ছিল
তার বুকেও জমেছে চরা
তবু স্রোতই জীবন—
চলার পথ বাঁক নেয়
ফেলে রাখে স্মৃতি।

তালাবন্ধ সিন্দুকে
জমিয়ে রাখা ইচ্ছে
অবসরে খুলে দেখি
কাটাকুটির জ্যামিতি
জীবন বৃত্তে সবই ক্ষণস্থায়ী।

গাছে আটকে থাকা ঘুড়ির
গুমরে মরে আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন
শরীর মনে পঙ্গুত্ব, বার্ধক্যের বৃত্ত
তবু পাগলা ঘোড়ার দাপাদাপি
অবাধ্য অবোধ
হে সময়! আত্মবিলাপের উত্তাপ দাও।




করোনা

ঘরে থাক। নিরাপদে থাক। থাক কারাগারে
অপেক্ষা, উপেক্ষা ও ত্রাসের আবর্তে
ঘুনপোকা যেন ভিতর ঝাঁঝরা করছে
জীবন এত মহার্ঘ জানা ছিল না আগে
জীবনের প্রতি গভীর আকুতি
তীব্র করে তোলে মৃত্যুভয়।

মৃত্যুর গাঢ় ত্রাসে দেহ জুড়ে শবের শীতলতা
জীবনের উষ্ণতা উত্তাপ সহবাসে সাহচর্যে
প্রকৃতি ও বিজ্ঞানী, দুই ঈশ্বরের লড়াইয়ে
আবদ্ধ আমরা রূপকথার কারাগারে
উঁচু গবাক্ষে অপেক্ষা কাতর তীক্ষ্ণদৃষ্টি কবে
সেই প্রভাত সূর্যের আলো সব অন্ধকার
ধুয়ে করে তুলবে শুচিস্নাত মানুষ হবে
সহজ সরল স্বাভাবিক উচ্ছল উজ্জ্বল।




টেরোরিস্টের অশ্রু

সকাল থেকেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। আকাশে মেঘ থাকলেও তেমন ঘন কালো নয়। ঘোলাটে। আলো ফুটতে পারে।
এক শ্রাদ্ধবাসর। বিষাদঘন পরিবেশ। পুরোহিত ব্যস্ত পারলৌকিক কর্মে। পারিবারিক মানুষের ভিড়। তাদের টুকরো টুকরো কথার অনুষঙ্গে স্মৃতির তরঙ্গ। নীরবতার চাপ থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যই কিনা জানি না, নানা বিচিত্র প্রাসঙ্গিক অপ্রাসঙ্গিক কথার চালাচালি জমায়েত মানুষের মধ্যে।

উঠে আসে সদ্য ঘটে যাওয়া সন্ত্রাসবাদীদের বীভৎস ধ্বংস ও হত্যার কথা। নির্বিচারে কত সাধারণ মানুষকে খুন করা। সন্ত্রাস দমনের ব্যর্থতার কথা। কথা ও কথার পিঠে কথা। পরিবেশ পালটে যায়।

সিগারেট ধরাতে বাইরে যাই। বর্তমানেই থাকতে চায় মানুষ। মৃতেরা থাকে স্মৃতির গভীরে, শোক অন্তরের অন্তঃস্থলে।

পায়চারি করতে করতে চোখে পড়ে খালি জমিটা। পাঁচিল ও তার উপর লোহার রেলিং দিয়ে ঘেরা। যেন কোনো দুর্গের উপরে লাল রঙের বর্শার ফলা উঁচিয়ে থাকা। মন ধাক্কা খায়। সারিবদ্ধ টেরোরিস্ট! বৃষ্টির জলের বিন্দু রেলিংয়ের নীচে জমা।

শ্রাদ্ধবাড়ি থেকে গান ভেসে আসছে—

“আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবুও অনন্ত জাগে।।” …

মেঘের জড়তা কাটিয়ে আকাশে আলো ফোটে। ঘরে ফিরি।

খবরের কাগজে এবং নিউজ চ্যানেলে টেররিজ্‌মের নানা কাহিনি নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। সন্ত্রাসের প্রকোপে সব সন্ত্রস্ত। মানুষ কী মানুষের কথা কি ভাবে না! এ তো মানবজাতির কলঙ্ক।

সব থেকে আলোচিত সদ্য ধৃত কারারুদ্ধ যুবক। অনেক ধ্বংস ও হত্যার নায়ক। কৈশোর উর্ত্তীণ এক সাধারণ যুবক। জেরায় জানা গেছে হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান। সংসার ও মায়ের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য নিজেকে সন্ত্রাসবাদীদের কাছে বিক্রি করেছিল।
খবর পেয়ে মায়ের চোখে কি হাসি আছে? টিভিতে দেখা ছেলেটির শুকনো খটখটে চোখ দুটোর কোণ কীরকম চকচক করছিল। ও-দুটো কী? অশ্রুবিন্দু!

সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস কী সন্ত্রাস নিরসনের
উপযুক্ত পন্থা? যুদ্ধের বিরুদ্ধে যুদ্ধ! উত্তরহীন জলন্ত প্রশ্ন।

শ্রাদ্ধ বাড়িতে শোনা গানটা কানে বাজতে থাকে।

“আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবুও অনন্ত জাগে।।

নাই ক্ষয়, নাই শেষ, নাহি নাহি দৈন্য লেশ—
সেই পূর্ণতার পায়ে মন স্থান মাগে।।”




রাস্তার ছেলে

বড়ো হওয়ার আগেই বড়ো হয়ে গেছি
চাঁদের স্নেহ বৃক্ষের নির্ভরতা বঞ্চিত

জন্মে সন্তানের নিয়ন্ত্রণ নেই
আস্তাকুঁড়ে ফেলে যাওয়া বেজন্মা, বজ্জাত
প্রকৃতির কোলে লালিতপালিত
হতচ্ছাড়া, ডাস্টবিনের কীট।

দিদিমণি বলেন,
‘আজ রাখিপূর্ণিমা। এসো রাখি পরাই।
তোমাদের কথা একটু শুনি।‘
ঝগড়া গালাগালি মারামারি
গলাগলিতে আমাদের সম্পর্ক
কোনো রাখি পরানোর দরকার হয় না।

মনে মনে সব বলি। আমাদের দেখতে পাবে
হাটে মাঠে ঘাটে মন্দির চত্বরে, মানুষের ভিড়ে
সব জায়গায়।

কেউ কেউ বাঁচার তাগিদে শাসনযন্ত্রের চাপে
ছিটকে যায় খারাপ জায়গায়
আক্রোশে হয় ছিনতাইবাজ গুণ্ডা
ক্ষমতার লোভে প্রতিহিংসার আগুনে মস্তান
শাসকের হাতিয়ার।

প্রাত্যহিকতা আমাদের দেয়
পৃথিবীর পাঠশালায় পাঠ
যেতে হয় না মানুষ তৈরির বিদ্যালয়ের খাঁচায়।

সম্পর্ক বিচ্ছিন্নতার কোনো কষ্ট নেই
নেই বিষাদের বিলাসিতা,
টিকে থাকার আগুনে পুড়ে সব ছাই তবুও কিছু ইচ্ছে আছে
চাঁদের আলোয় রোদ্দুর ক্লান্ত ছায়ায়
প্রশান্ত হাওয়ায় আনন্দে ডুব দেওয়ার
টুকরো টুকরো মেঘে ভেসে স্বপ্ন দেখার।



প্রচ্ছদ ও লেখায় ব্যবহৃত ছবি : জয়দেব ভট্টাচার্য।