লকডাউন পর্বে ‘ভার্চুয়াল-দুনিয়া’ সমাজে জাঁকিয়ে বসেছে। রাষ্ট্রনেতাদের ভার্চুয়াল-ভাষণ থেকে অনলাইন ক্লাস—বিচ্ছিন্নতা আমাদের গ্রাস করছে। ভার্চুয়াল ভাষণবাজির ফাঁকিবাজি বুঝতে অসুবিধে হয় না। আমাদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তারা বলে যাবেন। আমরা বাধ্য-প্রজার মতো সে সব শুনে দেশপ্রেমের প্রমাণ দেবো। কিন্তু শিক্ষাজগতে এই ফাঁকিবাজি বৈধতা পেলে? ফাঁকিবাজিটা শিক্ষক আর ছাত্রের নয়। অতিমারীর সুযোগে দেশের নীতি-নির্ধারকেরা শিক্ষাবিজ্ঞান ও সমাজকে ফাঁকি দিচ্ছে।

‘নয়া স্বাভাবিক’ অবস্থা কায়েম করতে রাষ্ট্রনেতাদের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টায় বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা গুরুত্ব হারাচ্ছে। পরীক্ষা গ্রহণ ও তার ফল প্রকাশেই যেন মোক্ষলাভ। সেই ফল প্রকাশে অসঙ্গতি থাকলে পরিস্থিতির দোহাই দিতে অসুবিধে নেই। শিক্ষাদানের পদ্ধতিই যদি যথাযথ না হয়, তবে পরীক্ষা গ্রহণের অর্থ থাকে না। অথচ স্বাভাবিকতার আড়ালে এক অস্বাভাবিক অবস্থাকে বৈধতা দেওয়া হচ্ছে। ভারতের মতো দেশে, অনলাইন পদ্ধতিতে অধিকাংশই যে শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে, তা নীতি-নির্ধারকেরা বিলক্ষণ জানে। দেশের খুব কম মানুষেরই ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। অনেকেরই আবার সবসময় ব্যবহারের সুযোগ নেই। আবার প্রত্যেক বাড়িতে সকলের ব্যবহারের সুযোগ নেই। সেই হিসেব কষলে দেখা যাবে ১০ শতাংশ ছাত্রছাত্রীও এই ব্যবস্থায় শিক্ষাগ্রহণ করতে পাচ্ছে না। বাস্তবে অনেক বিদ্যালয় ও কলেজেই অনলাইন ক্লাস নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। যেখানে হচ্ছে সেখানেও অনেকেই সুযোগ পাচ্ছে না।

রাষ্ট্র তার দায় ঝেড়ে ফেলে সব চাপিয়ে দিয়েছে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে। বলা ভালো ক্রেতার ঘাড়ে। শিক্ষা সামাজিক চরিত্র হারিয়ে ফেলছে। শিক্ষার্থীদের আর্থিক সামর্থ্যই শিক্ষার সুযোগ পাওয়ার প্রধান মাপকাঠি। রাষ্ট্র বা সমাজের কোনো দায়িত্বই নেই। আর্থিক সামর্থ্যের অভাবে অনলাইন ক্লাসের সুযোগ না পেলে দায় যেন অভিভাবক ও শিক্ষার্থীর। বঞ্চনায় রাগে, দুঃখে গর্জে না উঠে তাই শিক্ষার্থী হীনম্মন্যতায় ভোগে। ইতিমধ্যেই অনলাইনে ক্লাস করতে না পারায় দেশে আত্মহত্যার বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা বা লেখাপড়া ছেড়ে দেওয়া এ সময়ে রাষ্ট্রের কাছে নিছকই কোল্যাটারাল ড্যামেজ।

অসাম্যের দুনিয়াকে বিস্তৃত করে বাজার-ব্যবস্থার কাছে সব কিছুকে সঁপে দেওয়া নীতি-নির্ধারকদের মতলব। শিক্ষা-ব্যবসায়ীরা তাই এই অবস্থাতেও মুনাফা লুটতে মরিয়া। স্কুল বন্ধ, ক্লাস না করিয়েও নানাবিধ ফি নেওয়া হচ্ছে দিব্যি এমনকি অনেক বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই এই সময়ে তাদের ফি বাড়িয়েছে। সরকারের নির্দেশ বা অনুরোধ তারা গ্রাহ্যই করে না। ফলে প্রশ্ন ওঠে, সরকারি আদেশ উপদেশ—এসবই কি লোক দেখানো? বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করা যে এদেশে কাঁঠালের আমসত্ত্বের মতোই অবাস্তব কলকাতা হাইকোর্টের রায়ে তা আজ প্রমাণিত। এ কথাও নতুন নয় যে, ব্যবসায়ীদের সামাজিক দায় থাকে না। তারা চলে বাজারের নিয়মে। যে দায়টুকু তারা পালন করে বলে বিভিন্ন সময়ে খবরের শিরোনাম হয়, বলাই বাহুল্য তা-ও তার বাণিজ্য নীতির অন্তর্গত।

সরকারি ও সরকার-পোষিত বিদ্যালয়গুলি কিছু নমুনা প্রশ্নপত্র, বাড়ির কাজের নির্দেশ দিয়েই দায় সেরেছে। বলা যেতে পারে, এভাবে সরকার শিক্ষায় ব্যয় কমাচ্ছে। এটাকেই আগামী দিনে স্বাভাবিক বলে দেগে দিলে খরচ অনেক কমবে। শুধু কি পঠনপাঠনের খরচ? মিড-ডে-মিলের খরচও কমছে। চাল, ডাল, আলু দিয়েই দায় শেষ। রান্নার খরচ নেই, মিড-ডে-মিল কর্মীদেরও টাকা দিতে হচ্ছে না। সোয়াবিন বা ডিম নেই। কোনো বিদ্যালয়ে মাঝে মাঝে যে মাছ বা মাংস জুটত তারও ব্যবস্থা নেই। অথচ এই অতিমারীতে শিশুদের পুষ্টিকর, সুষম খাবার দেওয়ার জন্য বরাদ্দ বাড়ানোর প্রয়োজন ছিল। সরকার কিন্তু বিপরীত পথটাই বেছে নিয়েছে।

শিক্ষা কখনও সমাজ বিচ্ছিন্ন হতে পারে না। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক উপযুক্ত শিক্ষার পরিবেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তেমনই সহপাঠীদের সঙ্গে একাত্মতাও শিক্ষার অন্যতম অঙ্গ। এভাবেই সামাজিক-বোধ গড়ে ওঠে। অনলাইন ক্লাসে এসবের কোনো সুযোগ নেই। ভার্চুয়াল-দুনিয়া হয়তো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যন্ত্র তৈরি করতে পারে। কিন্তু মানুষের চেতনা বিকাশের সম্পর্কটা জৈবিক। সেখানে আর যাই হোক অনলাইনে পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতায় যথাযথ শিক্ষা লাভ হয় না।

বলা যেতেই পারে, হচ্ছেও, অনলাইন ক্লাস তো সাময়িক। স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরলেই আবার সব ঠিকঠাক চলবে। কিন্তু আগেও কি সব ঠিকঠাক চলছিল? সহপাঠীদের পারস্পরিক সহমর্মিতা বা সহযোগিতা-বোধ, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক কোনোকিছুই সন্তোষজনক নেই। ক্রমাগত বোধের অবনমন ঘটেই চলেছে। সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির অধিকাংশই বর্তমানে কেবল নাম-নথিভুক্ত করার স্থান। লেখাপড়ার জন্য প্রাইভেট টিউশন ছাড়া গতি নেই। এভাবেই, সকলের জন্য শিক্ষার কথা বলা হলেও, বেড়ে চলেছে মানের বৈষম্য। যার সঙ্গে আবার আর্থিক সামর্থ্যের সম্পর্ক রয়েছে। শিক্ষায় তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের নামে বৈষম্য বাড়ানোর প্রক্রিয়া অনেক বছর ধরেই চলেছে। যার সূত্রপাত ১৯৮৬ ও ১৯৯২ সালের জাতীয় শিক্ষানীতিতে। পরবর্তীতে বিদ্যালয়গুলিতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। ২০০৫ সালে সাম পিত্রোদার নেতৃত্বে গঠিত হওয়া ন্যাশনাল নলেজ কমিশন এই প্রযুক্তি ব্যবহারের সুপারিশ করে। ২০০৯ সালে গৃহীত হয়, ন্যাশনাল পলিসি অন ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইন স্কুল এডুকেশন।

শুনতে খুব ভালো। কিন্তু দেশ তথা রাজ্যের ক’টি বিদ্যালয়ে এসবের সুযোগ রয়েছে? প্রযুক্তিরও আসলে শ্রেণিচরিত্র রয়েছে। উন্নয়নের মোহে সেই সত্য আমাদের ভুলিয়ে দেওয়া হয়। এই তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির নামে বৈষম্যের পরিসর বিস্তৃত করা হয়। সরকারি বিদ্যালয়গুলির মধ্যে যেমন মানের বৈষম্য বাড়ে, তেমনই সেই ফাঁকে বেসরকারি বিদ্যালয় বাজার বিস্তারের সুযোগ পায়। প্রথা বহির্ভূত শিক্ষার নামে প্রথাগত শিক্ষার গুরুত্ব সরকার কার্যত কমাতে থাকে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে পঠনপাঠন উপযোগী পরিকাঠামোর প্রসঙ্গটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে অবহেলিত হতে থাকে। রকমারি মানের শিক্ষাব্যবস্থা বাজারে হাজির করা হয়। শিক্ষার মানের এই বৈষম্য বেড়েই চলেছে। অনলাইন শিক্ষাদান কিন্তু রাষ্ট্রের সেই শিক্ষানীতি থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। আজকে যেটাকে সাময়িক বলে মনে হচ্ছে সেটাই আগামী দিনে শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম মডেল বলে আমাদের ওপর চাপানোর আশঙ্কা তাই থেকেই যায়।

প্রশ্ন উঠতে পারে, বর্তমান অতিমারীর আবহে এর বিকল্প কী? বিকল্প নেই বলে অধিকাংশকে সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা ন্যায্য হতে পারে না। একজন ছাত্র বা ছাত্রীও যাতে সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হয় তা নিশ্চিত করে তবেই এই ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন ছিল। সরকার সেই দায়িত্ব পালন করল না। গণতন্ত্র এ দেশে নির্দিষ্ট সময় অন্তর ভোট দেওয়ার অধিকারের মধ্যেই সীমায়িত। শিক্ষা যেন অধিকার নয়, ভিক্ষা। সংবাদ-মাধ্যমই জানাচ্ছে, এরই মধ্যে কোনো কোনো গ্রামে, মাঠে খোলামেলা পরিবেশে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে। দূরত্ববিধি মেনেই তা হচ্ছে। অবশ্য এগুলি ব্যতিক্রমী ঘটনা। কারণ শিক্ষকরা বিদ্যালয়ের কাছাকাছি না থাকলে, ছাত্রছাত্রীরা স্থানীয় বাসিন্দা না হলে, সেটা সম্ভব নয়। আর এখানেই কমন স্কুল সিস্টেম ও নেবারহুড স্কুলের কথা এসে যায়। বিগত শতকের ষাটের দশকে কোঠারি কমিশন সেই সুপারিশই করেছিল। সকলে একই শিক্ষাব্যবস্থায় লেখাপড়ার সুযোগ পাবে। কোনো ভেদাভেদ থাকবে না। শিক্ষার্থী নিকটবর্তী বিদ্যালয়ে পড়বে। মানের সমতাই কেবল নয়, এভাবে শিক্ষার্থী জানবে দেশকে, সমাজকে। শিক্ষা সমাজ-বিচ্ছিন্ন যান্ত্রিক হবে না। বলাই বাহুল্য, শিক্ষার দায় রাষ্ট্র গ্রহণ না করলে, সেটা সম্ভবপর নয়।

শিশুশিক্ষার অধিকার আইনে নেবারহুড স্কুলের কথা বলা হলো। কিন্তু বড়ো ফাঁকও রাখা হলো। সেটা করা হলো সচেতনভাবেই। আইনে নানা মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্বীকৃতি পেল। বেসরকারি বিদ্যালয়গুলিকেও স্বীকৃতি দেওয়া হলো। নানা মানের প্রতিষ্ঠান থাকলে আর কমন স্কুল সিস্টেমের অর্থ হয় না। কার্যত শিশুশিক্ষার অধিকার আইন মানের বৈষম্যকেই বৈধ করল। আর্থিকভাবে দুর্বলেরা এখানে কেবলই সংখ্যা। যাদের নির্দিষ্ট শ্রেণি অবধি পাশ করানো হবে। শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়লে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র শিক্ষাবিস্তারের দাবিও করতে পারবে। আর ভালো মানের শিক্ষাগ্রহণ করতে অর্থ খরচ করতে হবে। তাই অনলাইনে ক্লাসের সুযোগ সব শিক্ষার্থী না পেলে রাষ্ট্রের কিস্যু যায় আসে না। পরীক্ষা ও ফল প্রকাশ সময় মতো হলেই সবকিছু ‘স্বাভাবিক’ বলা যায়।

দুর্যোগেই কোনো ব্যবস্থার ত্রুটিবিচ্যুতি যথাযথ রূপে ধরা পড়ে। আজকের অতিমারী এই সমাজ ও শিক্ষাব্যবস্থার আসল চিত্র প্রকাশ্যে এনেছে। জনশিক্ষার ধারণাকে শিকেয় তুলে শিক্ষাকে বাজারে হাজির করার পরিণাম আজ বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না। বিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষক সংখ্যা বাড়ালে, শ্রেণিকক্ষগুলিকে উপযুক্ত করে তুললে, বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেত। শিশুশিক্ষার অধিকার আইনেও ছাত্র-শিক্ষকের যে অনুপাত বলা হয়েছে, তাও মানা হয় না। রাষ্ট্র নিজেই তার বানানো আইন লঙ্ঘন করে চলেছে। একটি এলাকার বিদ্যালয় পরিচালনায় ছাত্র-অভিভাবক-শিক্ষকদের পারস্পরিক মত বিনিময়ের সুযোগ থাকলে শিক্ষার সামাজিক চরিত্র থাকে। রাজধানীর ঠান্ডাঘরে বসে নীতি ঠিক করলে বাস্তবের সঙ্গে তা মেলে না। এ রাজ্যে, এক সময়ে বিদ্যালয়গুলি পরিচালনার জন্য অভিভাবক-প্রতিনিধি নির্বাচনের ব্যবস্থা ছিল। যদিও দলীয় রাজনীতির সংকীর্ণতায় তার আসল উদ্দেশ্যই পূরণ হতো না। বেশ কয়েক বছর সে সবের পাটও উঠে গেছে। আমলাতন্ত্র আরও পাকাপোক্ত হয়েছে। এই অতিমারী অনেক কিছু আমাদের শিখিয়ে চলেছে। কিন্তু রাষ্ট্র সেই শিক্ষা গ্রহণ করবে না। বরং রাষ্ট্রনেতারা এই সুযোগে মানের বৈষম্য বাড়িয়ে, শিক্ষা-বেসরকারিকরণের মতলবেই মশগুল। ভাবতে হবে নাগরিকদের। সম-মানের শিক্ষাব্যবস্থা যে অধিকার, ভিক্ষা নয়, সেই বোধ সবচেয়ে জরুরি। শিক্ষাগ্রহণের দায় ব্যক্তি বিশেষের নয়, শিক্ষাপ্রদানের দায়িত্ব সমাজের। রাষ্ট্র সেই সামাজিক দায়িত্ব পালন না করলে, নাগরিকদেরই নীতি বদলের দাবি তুলতে হবে। ভবিষ্যতেও আজকের মতো বিপর্যয় আসতে পারে। সম-মানের শিক্ষার অধিকার সর্বজনীন না হলে, প্রতিটি বিপর্যয়ে, পুঁজির স্বার্থে অসাম্যের ভিতকে পাকাপোক্ত করা হবে।



প্রচ্ছদ সৌজন্য : nst.com.my