২৪ মার্চ ২০২০, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কোভিড ভাইরাস সংক্রমণকে রুখতে ২১ দিনের জন্য দেশে ‘লকডাউন’ ঘোষণা করলেন। যা কার্যকর হলো তার পরদিন থেকে। লকডাউন ঘোষণার ফলে দেশের নানা প্রান্ত তথা বিদেশ থেকে ছাত্রছাত্রীদের ঘরে ফেরার প্রয়াস, ভাইরাসে সংক্রামিত হবার সংশয়, চোদ্দ দিনের কোয়ারান্টিন—এসবের মাঝে লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রীর ভবিষ্যৎ হয়ে পড়ল অনিশ্চিত। বাতিল হওয়া পরীক্ষাই বা কীভাবে দেওয়া সম্ভব, কীভাবে সম্ভব সময়ে সিলেবাস শেষ করা—এইসব কারণেই সরকারি নির্দেশে স্কুল কলেজে অনলাইন ক্লাস নেওয়ার কথা বলা হলো। দেশের বহু স্কুল বা কলেজে অনলাইন ক্লাস নেওয়ার ব্যবস্থা থাকলেও বেশিরভাগ জায়গায় শিক্ষক-শিক্ষিকারা পড়লেন সমস্যায়। চিরাচরিত পদ্ধতিতে ক্লাসে পড়ানোর বদলে এই অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থা কতটা কার্যকরী হবে ভারতের আপামর ছাত্রছাত্রীর কাছে তা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হলো। এই বিতর্ক মূলত সেই ব্যবস্থার সাফল্য অসাফল্য নিয়ে। কিন্তু আমরা যারা ছাত্রছাত্রী, এদেশের স্কুল কলেজের, তাদের প্রতিক্রিয়া সেভাবে সামনে এল না এ বিতর্কে।

অনলাইন ক্লাস বা ই-লার্নিং কোনো নতুন জিনিস নয়। পৃথিবীর যে-কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, যেখানে ডিসট্যান্স এডুকেশন কোর্স রয়েছে, সেখানে অনলাইন ক্লাস বহুদিন ধরেই একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মূলত সমস্যাটা সাধারণ স্কুল কলেজের, যেখানে অনলাইন ক্লাস নেওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। এই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে অনেকেই মনে করছেন কিশোর কিশোরী বা তরুণ তরুণীরা তো প্রচণ্ড ‘টেকস্যাভি’ কাজেই তাদের তো কোনো সমস্যা হবার কথা নয়। হাজার হোক বাবা-মায়েদেরই তো সারাক্ষণ ছেলেমেয়েদের বকে যেতে হয়, মোবাইল ফোন খুলে বসে থাকার জন্য। তাহলে মোবাইলে ক্লাস করতে আর অসুবিধে কোথায়? কিন্তু বিষয়টা হচ্ছে ছাত্রছাত্রীরা সাধারণত অনলাইন ক্লাসের ব্যাপারে জানার জন্য তো আর মোবাইল খুলে বসে থাকে না। বেশিরভাগ পড়ুয়ার কাছেই ইন্টারনেটে পড়াশুনো বলতে—গুগুল, উইকিপিডিয়া অথবা ই-বুক। এ কথা সত্যি, নতুন এই শিক্ষা মাধ্যমে মানিয়ে নিতে ব্যক্তিগতভাবে আমার হয়তো অতটা অসুবিধে হচ্ছে না, কিন্তু বহু ছাত্রছাত্রী, বিশেষ করে যাদের কাছে যথাযথ ইন্টারনেট কানেকশন বা ইলেকট্রনিক গ্যাজেটস নেই তারা মহা মুশকিলে পড়েছে। আর শুধু মোবাইল থাকলেই তো হলো না, বহুক্ষেত্রে অনলাইন অ্যাসাইনমেন্ট পাঠাতে হচ্ছে টাইপ করে। ছোটোবেলা থেকে দিস্তা খাতায় নোট বানানোর অভ্যেস পালটানো অত সহজ নয়।

ছোটোবেলা থেকে শুনে এসেছি, মায়েরা আমাদের বলে এসেছে—’এত ফোন মুখে করে বসে থাকিস না, চোখ খারাপ হয়ে যাবে।’ বেশিরভাগ ছেলেমেয়েই কিঞ্চিৎ বিরক্তির সুরে, ‘উফ্‌ মা! যাও না।‘ বলে এড়িয়ে গেছে সেই সতর্কবাণী। কিন্তু এখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা ক্লাস করতে করতে সেই সমস্যাটা বোঝা যাচ্ছে। শারীরিক সমস্যার চেয়েও বড়ো সমস্যা হচ্ছে মনোযোগের। একটা ৪০-৫০ মিনিটের অনলাইন ক্লাস করার পর বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রীরই মনোযোগ বিঘ্নিত হচ্ছে। নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, কলেজে যে সমস্ত প্রফেসরদের লেকচার টানা দু-তিন ঘণ্টা শুনতে পারতাম, অনলাইন ভিডিও কনফারেন্সে একটা সেশনের (সাধারণত ৪০-৫০ মিনিট) শেষে কনসেনট্রেশনের সেই লেভেল আর থাকছে না। বিভিন্ন স্ট্রিমের, ক্লাসের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বুঝলাম তাদেরও অভিজ্ঞতা প্রায় একইরকম। এবং যে বিষয়টা কথার ভেতর থেকে উঠে এল, তা মূলত মেকানিকাল ইন্টারফেয়ারেন্সের সমস্যা। এছাড়া স্লো-ইন্টারনেটের সমস্যা তো আছেই। সেই সঙ্গে বারবার মাইক ও ভিডিও অন-অফ করা এবং আরও নানান রকমের টেকনিকাল কারণেই মনোযোগ ব্যাহত হচ্ছে, একধরনের বিরক্তি আসছে মনে। আমার এক বন্ধু বেশ কিছুদিন ধরে কোনো ক্লাস করছিল না। তাকে ফোন করেছিলাম খবর নেওয়ার জন্য। উলটে সে আমাকে জিজ্ঞাসা করল—এই অনলাইন ক্লাসের এফিসিয়েন্সি কতটা? প্র্যাকটিকাল ক্লাসগুলো তো বন্ধ।

যে মেকানিকাল ইন্টারফেয়ারেন্সের কারণে মাঝেমধ্যেই এই অনলাইন ক্লাস বিরক্তিকর হয়ে উঠছে ছাত্রছাত্রীদের কাছে, সেই বিরক্তির শিকার হচ্ছেন কোনো কোনো শিক্ষক-শিক্ষিকাও। যাঁরা ক্লাসে বসে থাকা ছাত্রছাত্রীদের মুখ-চোখ দেখে বুঝতে অভ্যস্ত, ছাত্রছাত্রীরা পড়ার বিষয়টা বুঝতে পারছে কিনা, তাঁদের কাছে পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন ব্ল্যাকবোর্ডের অভাবকে পূরণ করতে পারছে না। যে অভাব তাঁদের অনলাইনে পড়ানোর গুণগত মানেও প্রভাব ফেলছে।

বহু ছাত্রছাত্রী বিশেষ করে গ্রাম আর মফস্‌সলের দিকে যাদের বাড়ি। তারা দিনের পর দিন হয় বাড়ি ছেড়ে হোস্টেলে, ভাড়ায় নয়তো পিজি হিসাবে কলেজের কাছাকাছি কোথাও থেকেছে বা সহজে আসা যায় এমন দূরত্বে থেকেছে। অনেকেই ট্রেনে বাসে করে যাতায়াত করে থাকে। তারা এই সময়ে ঘরে বসে অনলাইনে ক্লাস করে সুখের নিঃশ্বাস ছাড়ছে। কিন্তু দল বেঁধে বন্ধুদের সঙ্গে কলেজে যাওয়া বা ক্লাস করা, পরীক্ষা দেওয়া, আড্ডা মারা—এসবই যে-কোনো পড়ুয়ার মধ্যে একধরনের মেন্টাল আন্ডারস্ট্যান্ডিং তৈরি করে। পড়াশুনোর প্রতি সিরিয়াসনেসও বজায় থাকে অনেকটাই। নিজের অভিজ্ঞতাতেই জানি, যা শুনে অনেকেই হয়তো ভ্রূ কোঁচকাবেন, কিন্তু বাস্তব হলো, ঘরে বসে অনলাইন ক্লাস করতে গিয়ে সেই আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ে প্রভাব পড়ছে। অনলাইন পরীক্ষায় বড়ো প্রশ্ন দেওয়া হলে তার উত্তর টাইপ করে পাঠাতে যেমন সমস্যার মুখে পড়তে হচ্ছে, তেমনই এমসিকিউ প্রশ্নের মধ্য দিয়ে মেধার প্রকৃত পরিমাপ হচ্ছে না। বলাবাহুল্য, হাতের পাঁচটা আঙুল সমান নয়। রোজকার এই ট্রেনে বাসে যাতায়াতে যে সময় বা এনার্জিটুকু খরচ হয়ে যেত, ঘরে থাকার কারণে তার যথাযথ সদ্‌ব্যবহার করে নিজেদের সিরিয়াসনেসে ও মানে আরও একটু উন্নত করে নিতে পারছে অনেকেই।

শুধুমাত্র পড়াশুনো নয়, আমার অনেক বন্ধুরাই এই সময়ে নতুন নতুন এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটি খুঁজে নিয়েছে। অন্য সময়ে যে ইচ্ছেগুলো চাপা পড়েছিল সময়ের অভাবে, এখন পড়ার বইয়ের নীচ থেকে সেই ইচ্ছেগুলো বেরিয়ে এসেছে। যার নিদর্শন ছড়িয়ে রয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়।

ই-লার্নিং একটি নতুন কনসেপ্টকে সামনে নিয়ে এসেছে। ওয়েবিনার। অনলাইন সেমিনার আগেও হতো। তবে এই সময়ে তা প্রচণ্ড জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। প্রায় প্রত্যেক ছাত্রছাত্রী চেষ্টা করছে যতটা/যতগুলো ওয়েবিনারে সম্ভব অংশ নিতে। লম্বা লম্বা অনলাইন কোর্সের বদলে অনেক পড়ুয়াই এক দুই ঘণ্টার ওয়েবিনারে আগ্রহ দেখাচ্ছে অনেক বেশি। পরিস্থিতি যখন সম্পূর্ণ পালটে আবার সব স্বাভাবিক হবে, কোভিড সংক্রমণের ভয় বা এই সোশ্যাল ডিসটেন্সিংয়ের আর প্রয়োজনীয়তা থাকবে না। নতুন করে আবার পুরোনো অভ্যাসগুলোকে কিছুটা ঝালিয়ে নিতে হবে। সে সময়ে কি অনলাইন ক্লাসের প্রয়োজনও ফুরিয়ে যাবে? হয়তো নয়। বিশেষত বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে যখন জানতে চাইলাম—তারা ফিরতে চায় কিনা? প্রত্যেকেই জানাল—‘না!’ প্রায় প্রত্যেকেরই বক্তব্য এই ওয়েবিনার ব্যাপারটা থেকে গেলে খুবই ভালো হয়। কারণ এখনও অবধি ওয়েবিনারগুলোয় সম্পূর্ণ বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে অংশ নেওয়া যায়। বিদেশে গিয়ে পড়ার মতো অবস্থা নেই যাদের তাদের কাছেও অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ, স্ট্যানফোর্ডের মতো বিশ্বখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আয়োজিত সে সব ওয়েবিনার জ্ঞান আহরণের অন্যতম পন্থা। যদিও শিক্ষার মূল্য এভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। শুধু এভাবে কেন কোনোভাবেই হয়তো সম্ভব নয়। তবু যদি তুলনা করতেই হয়, তাহলে বলতে হয়, অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থায় কস্ট-এফিসিয়েন্সি বেড়েছে অনেকটাই।

রোজকার রুটিন মেনে ক্লাস করতে গিয়ে ছাত্র ও শিক্ষক উভয়কেই এক অদৃশ্য সীমায় বাঁধা পড়ে যেতে হয়। কিন্তু ই-লার্নিং সেই সীমাকে অতিক্রম করতে পেরেছে। অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকারাই বিষয়ের সেই গভীরতায় ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে যেতে পারছেন যা সাধারণভাবে ক্লাসরুমে সম্ভব ছিল না। শুধু তাই নয়, হয়তো কোনো একটি মেডিকাল কলেজের অ্যানাটমির একজন যথেষ্ট ভালো শিক্ষক আছেন। কলেজে তিনি সীমিত সংখ্যক পড়ুয়াকেই পড়াতে পারতেন। কিন্তু এখন এই অনলাইন ক্লাসের সময়, অন্যান্য কলেজের ছাত্রছাত্রীদেরও তিনি ক্লাস নিতে পারছেন। এভাবে বিভিন্ন গেস্ট লেকচারদের কারণে, কলেজের সাধারণ সময়ের তুলনায় অনেক বেশি ক্লাস করে নিতে পারছি আমরা। বিভিন্ন ক্লাস নোট্‌স আদানপ্রদানের ক্ষেত্রেও বড়ো সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে এখন, হোয়াটস্‌অ্যাপ, গুগুল ড্রাইভ বা গুগুল ক্লাসরুমের মাধ্যমে।

সব শেষে যে কথাটা বলতে চাই। একজন পড়ুয়া যদি কিছুটা ওয়াকিবহাল হয়, যা সে নিজের অজান্তেই প্রায় প্রতিদিন ব্যবহার করে চলেছে, তা যদি সামান্য বুঝে করা যায়, তাহলে দেখা যাবে—অনলাইন শিক্ষা পদ্ধতিগত দিক থেকে অনেক বেশি সেল্ফ-ফেস্‌ড। যে-কোনো পড়ুয়া তার নিজের শেখার গতি, তার মেধার উন্নয়নের মানদণ্ড নিজেই ঠিক করে নিতে পারছে সেই পদ্ধতিতে।