ছিটকে যাওয়া মেঘগুলো জুটি বাঁধতে বাঁধতে এগিয়ে আসছে এই কালো পাঁচিলটার দিকে। বড়ো দাদাগুলো লাইন করে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের চোখ মেঘেদের ঊর্ধ্বগমন দেখছে। দেখছে, সুদূরের পর্যালোচিত জীবনধারার সঙ্গমে যেন একলা বার্ধক্য আরেকটু গা ঘেঁষে বসে। ও চোখের চাহনিতে অন্তমিল খোঁজে অজস্র ভুল আর প্রাথমিক অভিজ্ঞতার অভিধান। যতদিন এ গঙ্গায় জল জমা শুরু হয়েছে সাময়িক আবরণে ততদিন সাদা কালো ছবি আঁকতে শুরু করেছে কেউ নদীর পাড়ে বসে। তার চুলের স্পন্দন বিস্তীর্ণ গঙ্গাবক্ষে ঢেউ তুলছে বারবার। আন্দোলিত পানার নির্যাস নিয়ে ঘোলাটে ঢেউগুলো কাঁটাতারের দেওয়ালে মিশে যাচ্ছে। সেখানকার কাদামাটিগুলো সহজেই এক একটা পর্যাপ্ত স্মারক নির্মাণ করছে অননুমেয় ইতিহাসের সাক্ষি নিয়ে। তথাকথিত গুরুত্বের আড়ালে বসে থেকে স্থির মনস্তত্ত্ব যেন বিন্দু বিন্দু আকারে সমাহিত হয়ে মেঘেদের নিঝুম অস্বচ্ছতাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। ওপরের ব্যালকনি গুলোয় এইসব দিনে মেঘের পালক এঁকে যায় একদল কচিকাঁচা। তাদের নিজস্বতর হুল্লোড় আর সদ্য ওঠা একগাল দাড়ির সঙ্গমে দাঁড়িয়ে আছে এই আপেক্ষিক জতুগৃহ। কালের নিরন্তর প্রবাহ ছেঁকে নিচ্ছে আগন্তুকের দলকে। বহির্গমনের সুতোটা আরও যেন ঘনীভূত, সুস্থির, এলোকেশী মেঘের দলকে জুড়ে দেয়। ঠিক তখনই একতলার ল্যাবে একটা বিকার ভাঙে। সদ্য মাধ্যমিক দেওয়া হাতটা ঝুলে থাকে ছাই রঙা মেঝের ওপর কিছু কাচের টুকরোর দিকে। তারপর এর ওর দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি, সদ্য গোঁফ ওঠা হাসির মাঝে নতুন ধারার শুরু। হাফপ্যান্ট বেড়ে ফুলপ্যান্টের দায়িত্ব আর কিছু অলিখিত যাত্রার প্রথম ঘণ্টাধ্বনি। এখনও কাচ ভেঙে যায় নিজের খেয়ালে। এখনও লালাদা লাইট অফ করলে এক্‌জস্ট ফ্যানের ব্লেডগুলোর প্রলম্বিত ছায়ারা গুনগুন করে গান করে। দেওয়াল আলমারির ছিটকিনিটার পাশে ওপাশের জানলার সূক্ষ্ম ফাটল দিয়ে অসমান্তরাল আলো এসে পড়ে।

টিফিনের সময়গুলোয় এইসব আলোয় ধুলোর আমদানি আরও বেড়ে যায়। তারপর অজস্র রঙিন প্লাস্টিকের প্যাকেট, সদ্য শুকোতে যাওয়া জলের ফোঁটা, জুতোর চাপে বেঁকে যাওয়া গঙ্গামাটি যেন আজানু হয়ে প্রণাম করে এই প্রহরকে। কলবিতানের স্পন্দন প্রক্রিয়া যেন জ্যান্ত করে এক একটা অঅনুভূত বাড়ির কৌণিক অভিব্যক্তি গুলোকে। যারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাদের চিরাচরিত স্থবির প্রাচীনত্বের কোলে সৃষ্টি করে নতুন যুগের প্রথম কাণ্ডারী। দ-কৃতি সেই দেওয়ালের মধ্যে কান লাগিয়ে শোনা যায় জগতের সূক্ষ্মতর আন্দোলনের কর্মসূচী। এক একটা নবীন জীবনগুলোতে মিশেল ঘটে যায় পূর্ণ আবেগধারার। সে সঞ্চরণ বোধহয় জানে কেবল বেঞ্চের কাটা দাগ, অলস জানলা থেকে দেখা মধ্যাহ্নের অন্তরাগ্নি, কয়েকটা সাধারণ নয়নতারার কুঁড়ি, ব্ল্যাকবোর্ডে গতকালের চকের দাগ, কোনো কোনো ঘরে পড়ে থাকা না জানি কত বছরের আদিম পরিবেশ প্রকল্পের ছেঁড়া পৃষ্ঠাগুলো। প্রতি বছরগুলো যেন সাধ করে স্মৃতির পাঠ দেয়। পড়া ধরতে যাওয়া স্যারের ভয় যেন এক লহমায় দেওয়ালে উড়ন্ত প্লাস্টিক উড়িয়ে দেয়। কেউ আবার লুকিয়ে রাখে একটা খাতার পাতা অনামি ভাঙা আলমারির কাচের ভেতরে। আলো আঁধারের ওই জায়গায় মনের লুকায়িত অনুসন্ধানের ঢল, স্বপ্নে বিভোর হয়ে পাতাটি উলটে দেখে, হাতের লেখার সরল অনুভূতিটুকু বাঁকা মাত্রাহীন ‘ক’-এর মধ্যে অবিকৃত অবস্থায় থেকে যায়। যতদিন না তারই মতো কেউ পালা বদল ঘটায়।

টিফিনের সারাৎসার জুড়ে ছড়িয়ে থাকে দিন প্রতিদিন পলি প্যাক। উড়ে যায় কোনো অখ্যাত ছাত্রের পায়ের ধুলো। কেকের প্যাকেটের গায়ে লেখা নকশা করা অক্ষরে প্রথম কাদা লাগে। ভিড় জমে বেঞ্চের ধারে। তরকারির পেঁয়াজের গন্ধ গোটা দেওয়ালগুলোতে মিশে যায় বারবার। করিডোরে, অ্যাকোয়াগার্ডের জলের ছিটেগুলো কারও চোখের পাতায় লাগে। তখন সময়ের অন্তরাল বড়ো ছোটো, ছুটে যায় ওই ছেলেটা। যার জামার পেছনে লেগে থাকে তরকারির দাগ। অথচ জানতেও পারে না। কে কবে জানতে পেরেছে, ঠিক কতখানি সামঞ্জস্যতায় সাদা জামার বুকে লেগে থাকা জলের দাগ কখন কীভাবে মিলিয়ে গেছে। তীব্র ঘণ্টাধ্বনিতে আলোড়িত এক ঝাঁক নব প্রহর ধেয়ে যায় তাদের শান্ত পরিক্রমার দিকে ধীরে ধীরে। বাড়িটায় আবার মেঘ করে। সুমধুর বিশৃঙ্খলাটুকু সমাহিত হয়ে যায় ভাবের অনুরণন জুড়ে। বোর্ডের নীচে জমে থাকা চকের গুঁড়ো হাতে নিয়ে দেখে কেউ। আঙুলের দাগগুলো বড়ো স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে। দুপুরের পর থেকেই আলো বেঁকে যায় পশ্চিম জানলার কোণে। শীতের বেলায় ঘুম আসে। কোনো কোনো ঘর থেকে ভেসে আসে কাঠের টেবিলে স্কেল ঠোকার শব্দ। আবার কোথাও কোনো স্যারের উচ্চকিত স্বরের বাঁধন। শুয়ে পড়ে, পড়া বোঝা মাথাগুলো কেমন যেন শান্ত অলিন্দের মধ্যে ঢুকে যায়। তারপর, আরও, আরও একটা জীবন বিজ্ঞান বইয়ের পাতায় ঝুল ধরা আলো পড়ে। কেউ কেউ বাইরে তাকিয়ে থাকে হাঁ করে, কৃষ্ণচূড়ার যেন কতগুলো পাপড়ি ফুলের কোল থেকে আলগা হলো! ভ্রাম্যমাণ হাফপ্যান্টটা জলের বোতল রেলিংয়ে ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। যেন নিথর আকাশে ভাসছে। দরজার ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ একনাগাড়ে কোনো ঘর থেকে ভেসে আসছে।

দুপুরের দিকে মেঘ জমল কিছু কিছু। নদীর বুক থেকে উঠে আসা জোলো হাওয়া পাশের বাড়ির প্রাচীন কালো দেওয়ালের গায়ে গজানো অশ্বত্থ পাতার সঙ্গে খেলায় মাতে। কেউ কেউ ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে। লোহার রেলিংয়ের গায়ে পড়ন্ত বৃষ্টির ফোঁটায় আঙুলের গা ছুঁয়ে নিচ্ছে। কারও থুতনিটা ঠেকে আছে রেলিংয়ের গায়ে। ওরা জানে না, এই বৃষ্টি-ফোঁটাগুলো জমিয়ে রাখতে হয়। জানে না এই জলধারা একটা সময় পেরিয়ে তাদের এখানেই আবার দাঁড় করাবে। যে দেওয়ালে জল বেশি লেগেছে, সেই দেওয়ালের প্রতিটি কোণা শুষে নিচ্ছে মেঘ ভাঙা হলদে আলোর তাপ। যেন অন্তরাত্মা এই দীর্ঘ কর্মকাণ্ডের সাবলীলতায়, ছন্দে, ঘটনার বহমানতায় সময়কে ভুলতে বসেছে। অথচ তারা জানে না কত অনুসন্ধান এখনও থেকে গেছে বাকি, কত রহস্যময় স্থান এখনও নিজেকে খুঁজে ফেরে একইভাবে। কত কত গঙ্গার উদাসীনতা কুয়াশার ভোরে নিমজ্জিত শহরের আবেগ সঞ্চার করেছে একটা চোখে। সেই একটা চোখের দৃষ্টি পেরিয়ে গেছে ছুটির পরে বৃষ্টির ধারা। ঊর্ধ্বমুখী সত্তা যেন চোখের জলে ভিজতে চায়। যেন নিঃসীম চরাচরে শান্ত পথিকের মতো, এই পুণ্যভূমির অমলিন অমোঘ ধারাবাহিকতার ব্যাপ্তিতে চেতনা কেবল বিস্মিত হয়। ঘটনাবলীর জীবন্ত সূত্রগুলো বেয়ে বেয়ে কখন যেন এক আকাশ উদাসীনতা চোখের মণিতে এসে জমা হয়। কাল যেন মহাসঙ্গমের প্রাক্কালে উন্মুক্ত জটায় ধারণ করে, শৈশব থেকে কৈশোর পেরিয়ে যৌবনের প্রারম্ভিক ভাবময়তা। মাটির ভেতর মাটি খুঁড়ে যাই। ক্লাসের ভেতর ক্লাস। বেঞ্চের কোণে বসে থাকা জায়গাটার কাছে সময় স্মৃতির উৎসব পালন করছে। কম্পাসের কাঁটা ঘষে ‘পি লাভ আর’ বা ‘আর প্লাস পি’ লেখাটা/গুলো কবে নদীর জলে ভেসে গেছে। অথচ প্রথম প্রেমপত্রের ভাঁজে ভাঁজে কলমের আবেগ মূর্ছনা বারবার স্মৃতির অতলে আরাধ্য হয় ওই ঝুলমাখা টিউবের আলোকরেখায়।

এই সময়গুলোয় ব্যালকনির আলগা হাওয়াগুলো যেন প্রথম কবিতার অক্ষর সাজায়। ফুলপ্যান্টের পিছনে লেগে যাওয়া কাদা, জামায় একগাদা কালির দাগ, প্রেয়ার লাইনের জাতীয় সংগীত যেন অভয় দেয় নবজীবনের দ্বারমুখকে। যেন এই এক একটা ঘর এক একটা ঝুল, জানলার বাইরের দৃশ্য, শহরের যান, গঙ্গার সমাহিত প্রশান্তি, নিত্য স্রোতধারায় শিক্ষার্থীকে দীক্ষা দেয় আবেগের, সুচেতন ও অনুভব তন্ময়তার। অথচ কত কত দিন যেন তাৎপর্যহীন ছিল, শুরুর দিনগুলোয়। তারপর কোনো একদিন প্রথম মন ভাঙা। লুকোনো চোখের জলটুকু মুছিয়ে দেয় পাশে বসে থাকা, টিফিন কেড়ে নেওয়া বন্ধুটা। কত প্রশ্ন, কত উত্তরের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে একটা ভবন। একটা বাড়ি যার এক একটা ইটের ভাবাবেগ অতি সূক্ষ্ম তরঙ্গে কোনো গোপন অলিন্দ দিয়ে বিস্তার লাভ করেছে আপামর বিদ্যালয়ের ছাত্রকুলের হৃদয়তন্ত্রীতে। ব্যালকনিতে মেঘ এসে দাঁড়ায়। যেন জেনে নিতে চায় আর কতদিন দেরি—রবীন্দ্রজয়ন্তীর।

ত্যাবড়ানো জলের বোতলের গায়ে লেগে থাকা কাদামাটিটা শুকিয়ে গিয়েছে কবেই। তাকে নিয়ে দু-দল ভিড়ে যায় না আর। এই বিচ্ছিন্ন দিনগুলোয়, সকলের অগোচরে, ক্লাস সিক্সের বোধিসত্ত্ব কঙ্কনের মায়ের বানানো স্যান্ডুইচটা খুব মিস করে। ক্লাস এইটের প্রদীপ্তর নেওয়া হয় না ফেলুদাটা নীলিমের থেকে। দীপেশের সঙ্গে কার্টুনের বই এক বেঞ্চিতে বসে পড়া হয়নি কতদিন। ইন্টারক্লাস ফুটবল টিমের স্ট্রাইকার দীনেশের কতদিন কচি ঘাসের গন্ধ নেওয়া হলো না। অমৃতের আর বেঞ্চে মাথা রেখে জানলার ওপার দেখা হয় না। এমনই হাজার হাজার সুমন্ত, সৌভিক, অনিরুদ্ধদের টিফিন পিরিয়ডের আড্ডাটা, রোজকার বইখাতার আড়াল থেকে যে টুকরো ভালো লাগা তারা বার করে আনত তা থমকে গেছে অচেনা রোগের কবলে। দূর থেকে ভেসে ওঠা জীবন-বাষ্পের একঘেয়েমি জুড়ে তারা দেখে, তারা কেবলই পরস্পর থেকে আরও দূরে চলে যাচ্ছে। মাঝখানে লাখে লাখে গজিয়ে উঠছে অচেনা বস্তু। যার নামহীন অভিব্যক্তি একলা করে দিয়েছে সেই ভাবনাগুলোকে, যারা তিন তলার ব্যালকনিতে খেলা করত অনায়াসে। ল্যাবে যাওয়ার ছুটন্ত ধুলোর মধ্যে যে হাসির ফোয়ারা। সেভেন-সি এর পেছনে ভাঙা জানালার কাচ দিয়ে আজ আর কেউ আলোর খেলা দেখে না, একটা দৃশ্য থেমে আছে অচেনা মহামারীর অলিন্দে। কাল যেন আকালের উদ্‌ভ্রান্ত মত্ততায় ছোটো ছোটো চোখ গুলোয় ঔৎসুক্যের সৃষ্টি করছে নিরন্তর, সেখানে নির্দেশনামা পড়া হচ্ছে—‘কেউ কারও টিফিন খেতে পারবে না।’

এইসব ফাঁকা দিনগুলোয় হাওয়ারা বন্ধ লোহার গেটের আশেপাশে শিশুমন নিয়ে ঘুরঘুর করে। মাটির গন্ধ পায় না কোনো কচি নাক। কৃষ্ণচূড়ার গোড়ায় কাদামাটিগুলো সেভাবেই মিলিয়ে গেছে। মোজার দাগ হয়নি আর কচি পায়ের চামড়ায়। কিছু চারপেয়ে জীব কিলবিল করছে মাটির প্রথম স্তরে। একটা ছবি পড়ে আছে। বিছানার ওপর। সাদা জামার ওপর খানিক ধুলো লাগা। আয়নার ভেতরে উঁকি দিলে শূন্যতা বড়ো স্পষ্ট রূপে আসে। কাঁটাতারের বেড়ার পাশে মিড-ডে-মিলের স্তূপ গত চার মাস জড়ো হয়নি। তিন দিনের পাখির বাচ্চাটা ওদিকের গাছের ডালের ওপরে কী এখনও বেঁচে আছে? ঝড়ের সময় ওর মা খাবার জোগাড় করল কীভাবে? জানা যায় না তার উত্তর। লক্ষ লক্ষ মানুষের মুখ জুড়ে কেবল আতঙ্ক। কিন্তু চোখ দুটো দৌড়ে ফিরতে চায় পেছনের মন্দির পেরোনো মাঠটায়। প্রার্থনা সংগীতের পর কতদিন কপাল ছোঁয়নি কত দশকের ইতিহাস জড়ানো মূর্তিটার গায়ে। তার ছোঁয়া পেয়ে বোধহয় মূর্তিটাও শিহরিত হয়। নবীন কাল মূঢ় জড়ত্বের অলিন্দে ধারাবাহিক রসবোধ সিঞ্চন করে আসত অনেক দিন। আজ তারা স্তব্ধ সময়ের অলিন্দে প্রতীক্ষার দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। লাইব্রেরি কক্ষের সুকুমার রায় আজ অজানা ভয়ের কাহিনি শুনছে, নিভৃত সকাল সন্ধ্যায়। কৃষ্ণচূড়া ফুল ছড়ানো মাঠটা এখনও নিভৃতে দাঁড়িয়ে দেখে অনন্ত গঙ্গার প্রবাহধারা।

‘এই, একদম কারও কাছাকাছি যাবি না। সাবধান।‘ বা ‘এই হাত ধুবি ভালো করে।‘—বারবার এই সাবধান বাণীর অন্তর্লীন অভিধা দশ বছরের কৈশোরের সম্মুখীন হয়ে সন্দিগ্ধ দৃষ্টির উপস্থাপনা করে, যারা অচেনা কোনো কোরক বেয়ে ঘুরে বেড়ায় আকাশ জুড়ে। কতগুলো দিন স্কুলের পড়ার বদলে টিউশনের বদলে টিভির সিরিয়াল কার্টুন দেখে কেটে গেল। তারপর একটা সময় তার প্রথম স্ক্রিন বিদ্যালয় শুরু হলো। স্ক্রিনে ভাসছে বিদ্যালয়ের আলো। তার ফুসফুস রক্ষা হবে অচেনা রোগের হাত থেকে। ক্লাসের সবাই আছে সে বিদ্যালয়ে, তবু তার কোনো বন্ধু পাশে বসে নেই। স্ক্রিনের গণ্ডির সামনে দাঁড়িয়ে একটা শৈশব তার ক্লাসরুমের প্রিয় জানলাটা খুঁজে বেড়ায়। স্ক্রিনের ওপর জেগে থাকা জানলা তার নতুন বন্ধু। সেই জানলা দিয়ে সে দেখতে পায় স্কুলের মাঠটা অনেক বড়ো হয়ে গিয়ে মিশে গেছে নদীর ধারে।

নিত্যদিনের কর্মযজ্ঞের আহুতি ছড়িয়ে আছে গতানুগতিক ফাঁকা একটা মঞ্চে। যেন প্রতিমা-শূন্য বেদী। অধীর অনন্ত অপেক্ষার প্রহর গুনছে কিলবিলে সূক্ষ্ম জীবের প্রহেলিকা অবসানের। তার মাঝে দাঁড়িয়ে আছে কতগুলো স্থির দৃশ্য। ওই দূর থেকে ঘনিয়ে এসেছে মেঘ। আশপাশ বেয়ে কতগুলো ছোটো ছোটো শরীর চলে যায়। ঝালমুড়িওয়ালা তার ঝুনঝুনি ফেলে রেখে চলে গেছে আজ কতকাল হলো। জংয়ের দাগ বড়ো স্পষ্ট সেখানে। নাক লাগিয়ে গন্ধ মেলে লোহার। সে গন্ধ নিচ্ছে আরেকজন ওই দূরে। ত্যারচা চোখে যে এদিকে তাকিয়ে। ও দেখছে, পাশের বাড়ির ছাদে উড়ন্ত জামাকাপড়। আরও দূরে, পুরোনো বাড়ির ইট। সরু সরু ইলেকট্রিকের তার বেঁধে রেখেছে এই দৃশ্যকে। লোহার ঘণ্টাটা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কুমুদদা। তাকে দেখে যেন হাসছে। ওই দূরে অসিত স্যার বাংলা বইয়ের বহুরূপী নাটক খুলে দাঁড়িয়ে বলছেন,—পড়। আরও, আরও জোরে পড়।

কে যেন অ্যাকোয়াগার্ডের কল খুলে দিয়ে চলে গেছে। অঝোরে জল পড়ছে নল থেকে। সে জল পাশের গঙ্গায় এক সরু নালির মধ্যে দিয়ে মিশছে। ফিজিক্স ল্যাবের জানলায় আলোর লেন্সটা লাগানো। আর কিছু পরেই শুরু হবে রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠান। পার্থ স্যার দু-হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছেন। তাকে দেখে হাসছেন মিটিমিটি। মাইক হাতে সুলেখ স্যার। মুখ্য ফোকাস দিয়ে রঙ্গমঞ্চের মধ্যে যেন প্রলম্বিত আলো সময়ের দ্রাঘিমাকে ছেদ করে গেছে এমন অনন্য প্রহরে। সেখানে সারি সারি প্রাক্তন শিক্ষককুল দাঁড়িয়ে আছেন কেমন থমথমে মুখে। তাঁদের কারও ধুতি উড়ছে, কারও লাঠির কোণে আবেগের ছাপ স্পষ্ট। তাঁরা করুণ চোখে তার দিকে তাকিয়ে। সে ছবি মুছে গেল তীক্ষ্ণ আওয়াজে। কারও মুখ এসে গেল বুঝি মাইকের খুব সামনে। কৃষ্ণচূড়ার পাতায় পাতায় আজ যেন বিচ্ছেদ বেজে চলেছে। আজ দুই পিরিওডে ছুটি নিতে চাইছে না মন। তবু সার বাঁধা ফুলের তোড়া যেন সংবর্ধনা দিচ্ছে এই বিদ্যালয়কে। সে মঞ্চের কোণে দাঁড়ায়। হাজার হাজার নীল সাদা পোশাক স্বপ্নের ছাত্রকুলের বিস্তার ঘটাচ্ছে যেন। সবার মুখে এক অদ্ভুত বিস্ময়। লাইটগুলো জ্বলছে। রেখা জুড়ে জুড়ে রবি ঠাকুরের ছবি আঁকা বোর্ডের গায়ে চকের গুঁড়ো ভরে আছে।