পিক্‌-পিক্‌-পিক্‌…পিক্‌-পিক্‌-পিক্‌…

মোবাইল ফোনে অ্যালার্ম বাজতেই উঠে পড়া৷ ঘড়িতে তখন রাত তিনটে বাজে। পৌনে চারটেয় বেরোতে হবে৷ দমদম জংশন থেকে সাড়ে চারটের গেদে লোকালটা ধরতেই হবে। ট্রেনটা আড়ংঘাটা পৌঁছোবে সাড়ে ছ’টা নাগাদ। তারপর টোটো চেপে (ওখানে বলে টুকটুকি) খিশমা বনাঞ্চল, ভোরে উঠে ক্যামেরা, লেন্স, মনোপড, ব্যাটারি, মেমরি কার্ড সবকিছু নিয়ে বেরোনোর তোড়জোড়। এর সঙ্গে অন্তত দু-লিটার জল লাগবেই। জুন মাসের প্রচণ্ড গরমে খিশমা জঙ্গলে যাওয়া যে কী কষ্টকর অভিজ্ঞতা তা যারা গেছেন তারাই জানেন। বাড়ি থেকে হেঁটে অটোস্ট্যান্ড সাত-আট মিনিট। এই ভোরে একটা দুটো অটোরিক্সা কোনোদিন থাকে, কোনোদিন থাকে না। ভোরবেলা হাট যায় যেসব ম্যাটাডোর তাদেরই ম্যানেজ করে উঠে পড়া, দ্বিতীয় অপশন। ট্রেন ধরে তো যাওয়া গেল, জঙ্গলে ঢোকাও হলো। জুন মাসের চল্লিশ ডিগ্রি গরমে কুলকুল করে ঘাম ঝরে। জঙ্গলের মধ্যে পায়ে চলা পথের তিন মাথা মোড়ে এক বিশাল আমগাছ দেবতার মতো দাঁড়িয়ে। তার তলায় বসে খানিক বিশ্রাম, জল খাওয়া। মশার কামড়ে দু-হাত ডুমো ডুমো হয়ে ফুলে গেছে। সঙ্গী বন্ধু আশেপাশে কোথাও আছে। চোখ জুড়িয়ে আসে ক্লান্তিতে। হঠাৎ বন্ধুর ডাক। তুমি এখানে বসে, ওদিকে পিট্টা ডাকছে, শুনতে পাচ্ছ না। তাই তো! ক্লান্তির ঘোরে খেয়াল করিনি। ক্যামেরা নিয়ে ছুট্‌! ক্লান্তি ছোটে উলটোমুখো, পিট্টা ডাকছে, গলা উঁচু করে সুরেলা ডাক। পিট্টার ডাক শুধু শোনার নয়, দেখারও।

আবার হাঁটা শুরু। এতক্ষণে দু-তিন কিলোমিটার হাঁটা হয়েছে। আরও প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে জঙ্গলের শেষে, গ্রামের কাছে আছে বিরাট এক খাদান। নীচে জল। আর পাড়ের গায়ে অজস্র গর্ত। ব্লু-টেল বী-ইটারদের বাসা। অজস্র, হাজার হাজার পাখির ওড়াওড়ি। উড়তে উড়তে অদ্ভুত কায়দায় প্রজাপতি, ফড়িং ধরে গর্তে ঢুকে যাচ্ছে, বাচ্চাদের খাওয়াতে। সূর্য তখন মাথার উপরে। ঝলসে যাচ্ছে যেন চারদিক।

এমনই এক শীতের ভোরে কুয়াশার মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলা। তখনও ভোরের আলো ফোটেনি৷ সন্দিগ্ধ কুকুর গুমরে ওঠে পায়ের শব্দে। হাট যাওয়া ম্যাটাডোরের কাপড়ের গাঁটরির উপর বসে কোনোক্রমে শিয়ালদা পৌঁছে, প্রায় দৌড়ে গিয়ে কাকদ্বীপ লোকাল ধরতে হয়েছিল। সেখান থেকে ফ্রেজারগঞ্জ। পালাস গাল এসে গেছে যে ওখানে৷ ব্রাউন হেডেড গালদের চেহারা এখনও খোলতাই হয়নি। তাদের মাথায় হালকা বাদামি ছোপ পড়ে, শীতের প্রথম দিকে। সারাদিন বালির চরে পায়ের পাতা ডোবা জলে দাঁড়িয়ে পালাস গালের ছবি তোলা।

কত কথাই মনে পড়ে। এসব এই বছরের মার্চ মাসের আগের ঘটনা। মার্চ মাসের শেষ থেকে তো ঘরেই আটক। লকডাউনের বন্দিবাস। সমস্ত পৃথিবীর মানুষ আতঙ্কে দিশেহারা। এত মৃত্যু, এত অসুখ মানুষ বিগত কয়েক দশকে দেখেনি৷ কিন্তু প্রকৃতি কি একটু স্বস্তি পেয়েছে? খবরে দেখেছি, বনের পশু লোকালয়ে রাস্তায় ঘোরাঘুরি করছে নির্ভয়ে। শহরের আকাশটা যেন একটু বেশিই নীল দেখাচ্ছে। রাজারহাটের ঘাসজমির ঘাসগুলো সোজা দাঁড়িয়ে আছে। জলজঙ্গলের অধিবাসীরা অনেক নিশ্চিন্ত। যারা তাদের দেখার জন্য উদ্‌গ্রীব হয়ে ছুটত, তারা জানালার শিক ধরে অমলের মতো চেয়ে থাকে—নীল আকাশের দিকে, অথবা জানালার অদূরে কদম গাছের পাতার নীচে সবুজ অন্ধকারে।


২.

বিনয়দা, আমার ফ্রেন্ড-ফিলোজফার-গাইড। প্রায়ই বলেন,—বেঁধে রাখ, বুকের মধ্যে বেঁধে রাখ ওই নয়-দশ বছরের ছেলেটাকে। ওই-ই তোকে উষ্ণতা দেবে৷

জলেজঙ্গলে ঘোরা, প্রকৃতির মধ্যে মিশে থাকা ওই মানুষটাকে দেখি আর অবাক হই। মফস্‌সলে বড়ো হয়ে ওঠার সময় থেকেই বিনয়দার ন্যাওটা। সে-ই বুঝিয়েছে প্রকৃতিপ্রেম। সঙ্গে থেকে থেকেই ভালোবেসে ফেলা। মফস্‌সল পাড়ায় তখনও ফাঁকা জমিজমা দেখা যেত, ছেলেরা সকাল বিকেল খেলত। বাগান পুকুর নিয়ে বাড়িগুলো যেন লুকিয়ে থাকত গাছপালার আড়ালে। বিনয়দার বাড়ির পুকুরের ঘাটে বসে গ্রীষ্মের ছুটির দিনগুলোতে নয়-দশ বছরের সেই ছোট্ট ছেলেটা দেখত—ওই যে, আমগাছের ডালটা, পুকুরের জলের সমান্তরালে এসে পুকুরের অনেকটা ভিতর পর্যন্ত ঝুঁকে রয়েছে, সেই ডালের আগার দিকে বুলবুলি পাখির বাসা। আর ওই জামরুল গাছটার ঘন পাতার আড়ালে হলুদ পাখিটার বাসা আছে, সে জানে। এইভাবে পাখিদের ব্যস্ততা দেখে দেখেই গ্রীষ্মের দুপুরগুলো কাটত। বিনয়দা চিনিয়ে দিত পাখি, পোকামাকড়, গাছপালা। প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যাওয়া যেত।

দিনবদলের পালা শুরু হয়ে গেল নয়ের দশক থেকেই। চারিদিক ভরে উঠতে লাগল বাড়িঘরে৷ দূরত্ব বাড়তে লাগল প্রকৃতি-মানুষে, মানুষে-মানুষে। কর্মসূত্রে অন্য জায়গায় থাকার জন্য বিনয়দার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি, তবে চিঠির যোগাযোগ ছিলই। নতুন শতাব্দীর শুরুতে আবার ঘরে ফেরা৷ বিনয়দার সঙ্গে জলেজঙ্গলে ঘোরাফেরা। শনি-রবিবার কিংবা ছুটির দিনে নানা গ্রামে ঘুরে বেড়ানো। এখন হাতে থাকে ভারী ক্যামেরা। শুধু নিজে দেখা নয়, অন্যদেরও দেখানো যায় ছবি তুলে। বিনয়দার কোথায় যেন একটা অস্বস্তি। মাঝেমাঝে খবর পাই কোথায় কোন পাখিকে নতুন দেখা গেছে। কখনও যাই, কখনও যেতে পারি না। এমনই এক মে মাসে খবর পাওয়া গেল, কলকাতার কাছেই একটা গ্রামে বর্ণালি এসে বাসা করেছে। প্রতিদিনই প্রচুর ফোটোগ্রাফারের ভিড় হচ্ছে। যখন আমার যাবার সময় হলো, সেটা জুন মাসের শেষ সপ্তাহ। গিয়ে দেখি ভোঁ-ভাঁ৷ কিছুই নেই। সে চলে গেছে। শুনতে পেলাম, ফোটোগ্রাফারদের ভিড় তার সহ্য হয়নি। তাই চলে গেছে।

রাজারহাটে প্রতি সেপ্টেম্বরেই লাল মুনিয়া ঝাঁক বেঁধে এসে যায়। কাশফুলও ফুটে ওঠে সে সময়৷ কাশফুল ঠোঁটে নিয়ে উড়ে চলে যায় যেখানে বাসা বানাচ্ছে। আবার আসে, ঠোঁটে কাশফুল নিয়ে উড়ে চলে যায়। এই কাশফুল ঠোঁটে ধরা লাল মুনিয়ার ছবি তোলার জন্য ফোটোগ্রাফাররা চঞ্চল। একদিন সেখানে গিয়ে দেখি অনেক চিত্রগ্রাহক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আর ঘাসজমির ঘাস তছনছ। ছবি তোলার জন্য বড়ো বড়ো ঘাস মাড়িয়ে ভিতরে ঢুকতে হয়েছে। রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে আছি। এক-পা দু-পা করে একটু এগোতেই, পিছন থেকে সাবধান বাণী—ওদিকে যাবেন না দাদা, বাসা আছে। ভাবলাম ওই তছনছ হয়ে যাওয়া ঘাসজমিতে বাসা হবে হয়তো মুনিয়ার। পরক্ষণেই দেখি, আর একজন ওই ঘাসজমি মাড়িয়ে ভিতরে সেঁধিয়ে গেল। কই, কোনো সাবধান বাণী তার পিছনে ধাওয়া করল না তো! বুঝলাম আর একটা যুগান্তকারী ছবি পেতে চলেছি আমরা। আমি তো সে-ই অর্থে ফোটােগ্রাফার নই, কারণ ছবি তুলে আমি তো পুরস্কার পাইনি কোনো। তাই আমার যাওয়া বারণ হয়তো।

সেদিন সন্ধ্যাবেলায় বিনয়দার সঙ্গে আলোচনা হচ্ছিল৷ উশখুশ করে বিনয়দা বলল, এই আশঙ্কাটাই ছিল। এই যে এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা গ্রুপ, তার মধ্যে তো দেখি ওয়াইল্ড লাইফ ছবির গ্রুপই বেশি। কয়েকটি তো খুবই নামকরা। এই গ্রুপগুলো প্রায়ই নানা রকমের কম্পিটিশন করবে, আর সেইসব কম্পিটিশনে চমকদার ছবি দেওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা চলবে। তার ফল কী হবে? হবে এই পাখি-পশুদের বাসস্থানের দফারফা। তুমি ভালো ফোটোগ্রাফার প্রমাণের জন্য তোমার তো ওই পুরস্কার পাওয়াটা জরুরি। ওই যে পাখির বাসার কাছে গিয়ে পালক-বাছার ছবি তোলা, অনেকে মিলে এই কাজ করলে তো পাখি পালাবেই৷ এসবের পিছনে তো আছে ওই লোভটাই—পুরস্কারের। কিন্তু এটা নিয়ন্ত্রণ করবে কে? এরা তো প্রকৃতিপ্রেমী! তবেই না প্রকৃতির ছবি তুলতে এসেছে! বিনয়দা বলল,—কিন্তু প্রকৃতিপ্রেমের জন্য তো আলাদা কোনো পুরস্কার নেই, তাই প্রকৃতিপ্রেম বোঝাতে একটা ঢাক হলেই হয়। তবে হ্যাঁ, সবাই এমন নয়। সে তুই দেখলেই চিনতে পারবি। সমস্যাটি তৈরি করে তো ওই লোভীরাই। অনেক মানুষ আছেন যাঁরা আহত পশুপাখিদের উদ্ধার করছেন, তাদের চিকিৎসা করে ভালো করে তুলছেন, সংরক্ষণ করছেন। তারা কিন্তু পুরস্কারের লোভে এই কাজ করছেন না। পুরস্কার আর প্রকৃতিপ্রেম—একসাথে আলোচনা করলে অবশ্যই তর্কের অবকাশ থাকে। অনেকে রাগান্বিতও হতে পারেন। তবে এটা তো ঠিক, যে-কোনো মূল্যেই প্রকৃতির অনিষ্ট হতে দেওয়া যায় না। কিন্তু কে আটকাবে? সত্যিটা হলো এই যে, পশুপাখিদের বিরক্ত করে ছবি তোলা হয়েই থাকে অনেক সময়। শুধু কী এটাই, উন্নয়নের ঢেউয়ে যে কত কিছু তলিয়ে যাচ্ছে। জলাজমিগুলো ভরাট করে যে কত বন্যপ্রাণীর বাসস্থান লুটে নেওয়া হচ্ছে তা তো দেখাই যাচ্ছে। সে বেলা বড়ো শক্তি কাজ করে বলে, তাদের কিছু বলা যাবে না—তাই তো!

তাহলে উপায় কি? বিনয়দা বলল,—উপায়! বুকের মধ্যে সেই নয়-দশ বছরের নাছোড় ছেলেটাকে বেঁধে রাখ, সেই তোকে শক্তি দেবে, উষ্ণতা দেবে।


৩.

শহরে ঘেঁষাঘেঁষি বাড়িগুলোর মাঝে সবুজের দেখা পাওয়াই ভার। বড়ো বড়ো আবাসনের মাঝে বসানো, বানানো গাছে, সকাল থেকে চারটে বুলবুলি ওড়াওড়ি করে। দুটো টুনটুনি তীক্ষ্ণস্বরে জানান দিয়ে কোথায় যে চলে যায়, সারাদিনে আর তাদের দেখা পাওয়া যায় না। দুটো ঘুঘু, একটু বেলা বাড়লেই কদমের ডালে এসে বসে, ঠোঁটে ঠোঁট ঘষে। একদিন হলুদ বেনে বউ এসে কৃষ্ণচূড়ার ডালে বসে কয়েকবার ডেকেছিল। দুপুরের খাঁ-খাঁ রোদে হলুদ পিঠ কাঠঠোকরাটা ডাকতে ডাকতে উড়ে যায় ছাদের উপর দিয়ে। দূরে কোথাও সাদা-বুক মাছরাঙা ডাকে, একটানা৷ পাশের বাড়ির কার্নিশে দুটো ব্লু-রক পিজিয়ন সারাটা দুপুর বক্‌ম বক্‌ম করে কী যে গল্প করে বোঝা যায় না। জানালা দিয়ে এইসবই দেখা-শোনা, মার্চের শেষ থেকে।

এখন তো আর ভোরে ওঠার তোড়জোড় নেই, ট্রেন ধরার তাড়া নেই, এমনভাবেই রোজ সকালে জানালার কাছে বসা অভ্যাস হয়ে গেছে। একদিন সকালে, কী ভাগ্যি, একটা শিকরা এসে বসে কৃষ্ণচূড়ার খালি ডালটায়। লাল চোখ দিয়ে এদিক-ওদিক তাকায়। চোদ্দতলার দানব দুটো ফ্ল্যাট বাড়ির মাঝে দুই সখীর মতো দাঁড়িয়ে আছে কদম ও কৃষ্ণচূড়া। তাতেই এসে বসে শিকরা। ক্যামেরা লেন্স সবই তো গুটিয়ে রাখা। দুদ্দাড় করে সে সব নিয়ে এসে জানালা দিয়েই ছবি তোলা গেল। সোজাসুজি তাকিয়ে দেখল আমার কাণ্ডকারখানা। শেষ মুহূর্তে ওড়ার আগে যেন গম্ভীর ধমক দিয়ে গেল।

খবর পাওয়া যায়, এ সময়ে বড়োসুলে তিতির বটগুলো দৌড়োদৌড়ি করছে৷ খিশমায়, বনগাঁয় দুধরাজ জলে ঝাঁপাচ্ছে। পারমাদানে হুডেড পিট্টার ডাকে বনবাদাড় ধ্বনিত হচ্ছে। শ্যামখোলায় গেলে কলার্ড স্কুপ আউলকে দেখা যাবেই। এসবই কানে আসে৷ দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে বুক খালি করে। কত দিন, কত…কত দিন হয়ে গেল—সেইসব বড়ো বড়ো গাছের নীচে দাঁড়াইনি৷ ঘাসজমির মধ্যে একদৃষ্টে তাকিয়ে মুনিয়াদের চঞ্চলতা দেখিনি। দেখিনি বাবুইয়ের বাসা বানানো, মনার্কের লাফালাফি, জ্যাকানার বাচ্চাদের মায়ের পিছন পিছন হেঁটে চলা। দামার গান শোনা হয়নি কত দিন৷

পৃথিবী আবার সুস্থ হবে। জীবনে গতি আসবে। খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে বুক ভরে শ্বাস নেবে সবাই। তৈরি থাকতে হবে। বসিপোতায় বান্টিং, পূর্বস্থলিতে লালমুড়ি হাঁস, গজলডোবায় উত্তুরে হাঁস, বার হেডেড গুজদের আসার সময় হয়ে এল যে। মনপাখা মেলে ওদের সঙ্গে যেতে হবে তো!


প্রচ্ছদ এবং লেখায় ব্যবহৃত ছবি: সুবীর ভট্টাচার্য।