তিনজনের নামের মধ্যে একটা রহস্য আছে।
নলিনীকান্ত বলে,
—রহস্যটহস্য কিছু না, বাংলাদেশে এরকম নাম প্রচুর। ঢাকার বিখ্যাত প্রকাশক পাঠক সমাবেশের মালিকের নাম শহিদুল ইসলাম বিজু বা এস. আই. বিজু, সবাই ডাকে শুধু বিজু। তার মুখেই শুনেছি ১৯৯২র ৬ ডিসেম্বর দাঙ্গার সময় শিয়ালদা থেকে বনগাঁ লোকালে উঠেছিলেন হরিদাসপুর দিয়ে বেনাপোল হয়ে দেশে ফিরবেন বলে। রাস্তাঘাটে ট্রেনের কামরায় তখন দাঙ্গার তাণ্ডব, তবে তার নাম বিজু শুনে বিভ্রান্ত দাঙ্গাবাজরা ছেড়ে দেয়। এরকম নামে বাঙালির হিন্দু-মুসলমান বোঝা যায় না। সিলেটের নামি বইদোকান বইপত্রর মালিক সাহিত্যিক শুভেন্দু ইমামের আসল নাম আবদুল হান্নান। আমাদের পদ্মপলাশও তেমন বাংলা নামের বাঙালি আর ওর মুসলমানি নাম শরিফউদ্দিন, দুয়ে মিলে পদ্মপলাশ শরিফউদ্দিন।
পদ্মপলাশ জানে নামের মধ্যে আত্মপরিচয় লুকিয়ে থাকে। যদিও নলিনের দেওয়া তার নামের ভাষ্য সে এড়িয়ে যায়, বলে,
—একটা ট্র্যাজিক রহস্য আছে অভির নামে, তার উপর হিন্দু-বাঙালিদের মধ্যে অভিমুন্য কর্ণ কিংবা সীতা নাম তো কেউ রাখে না, এদিক দিয়ে অভি ব্যতিক্রমী নিঃসন্দেহে, এরা সব ছাড়াছাড়ির বিয়োগান্তক নায়ক নায়িকা তবে অভিমুন্য নামটা খুব রোমান্টিক।
অভির আবার নাম নিয়ে কোনো আদিখ্যেতা নেই। বলে,
—শুধু এই তিনটে নামই ট্র্যাজিক? আর রামচন্দ্র যে সবথেকে বড়ো ট্র্যাজিক হিরো। তার নাম, তার কথা তো কেউ বলে না। যে লোকটা সারাজীবন সুখের মুখই দেখল না সেই রামের নামে নাম রাখলে পুণ্যি হয় এদেশে। সারা ভারতে ষাট শতাংশ হিন্দুর নাম জড়ানো তাঁর নামে। তবে রহস্যের কথাই যদি বলতে হয়, রহস্যময় নামটা হলো নলিনীর। এখন আমাদের নামে যখন ভিকি বিক্রম, সিড সিদ্ধার্থ, রিক ঋত্বিক আর সৌরভ নিয়ে লোফালুফি তখন কাছাড় স্কুলের ইতিহাসের স্যার কেন নিজের ছেলের নাম রাখলেন নলিনীকান্ত কে জানে? আছে জবাব কারও কাছে, জানে কেউ?
নলিন মুচকি মুচকি হাসে। বলে,
—আমরা তোদের মতো সিলেটি কাছাড়ি নই, ঢাকাইয়াদের মধ্যে এত স্টাইলের নাম রাখার রেওয়াজ নেই। তাই।

নলিনীকান্ত সবচেয়ে বেশি কথা বলে, সে আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাচীন কাছাড়ের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা মানে পিএইচ.ডি করছে। মাসে আট হাজার করে বৃত্তিও পায়। নলিন কাগজে কলমে ওদের দলের নেতা কারণ তিনজনের মধ্যে সে-ই একমাত্র রোজগেরে এবং দরাজহস্ত। তবে নলিন সব সোজাকথা একটু ঘুরিয়ে বলে। রহস্য কিছু না কিছু থাকে কথায়, যেমন সিলেটি কাছাড়ি বলে অভিমুন্য আর পদ্মপলাশকে আলাদা করে দিল চাতুর্যে। অভিমন্যুরা দেশভাগের পর সিলেট থেকে আসা শরণার্থী আর পদ্মপলাশ শরিফউদ্দিন কাছাড়ের স্থায়ী বাসিন্দা। তবে তার মুখে সব সময় একটা ভুবনমোহন মুচকি হাসি থাকে যার জন্য তার কোনো কথাকেই খোঁচা মনে হয় না। যেমন এর পরই সে অভিমন্যুকে উদ্দেশ্য করে বলে,
—শুধু ছেলেদের নামবৈচিত্র্যই দেখলি, ভালো। মেয়েদের নামও এ শহরে আছে বিচিত্র। এক পরিবারে আছে তিন কন্যা—গিরিবালা মহামায়া আর কুড়ানি।
পদ্মপলাশ শরিফউদ্দিনও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। বলে,
—আজ্ঞে না, মোটেই কুড়ানি নয়, তোর নামেই নাম ঠাকুরবাড়ির ছোটো মেয়েরও। সে-ও নলিনী, শুধু নলিনী। শোন নলিনী খোল গো আঁখি।

পদ্মপলাশকে তাতিয়ে দিতেই নলিন নামরহস্যটা একটু ছড়িয়ে দেয়। কারণ সে জানে, গিরিবালা নামটা শহরের মানুষ যত চেনে, শরিফ চেনে আরও বেশি। তবে নলিন যতই চেপে যাওয়ার চেষ্টা করুক শরিফ আর অভি কিন্তু জানে তার নামের গুহ্যসূত্র। তারা জানে ঢাকার বিখ্যাত ইতিহাসবিদ নলিনীকান্ত ভট্টশালীর নামেই নাম রেখেছেন, ইতিহাস শিক্ষক পিতা। নাম নিয়ে এসব কথার কাটাকুটি হলো টাইমপাস, গুলতানিতে সময় বইয়ে দেওয়া। বিষয় একটা থাকে ঠিকই কিন্তু নির্মল আড্ডাটাই হয় প্রধান।

তিন বন্ধুর একটা পার্টটাইম গাড়িও আছে। গাড়ির মালিক ছিলেন পদ্মপলাশের ঠাকুরদা মুর্তজা ডাক্তার। পারিবারিক গাড়ির বিকেলবেলার মালিকানা শরিফের। আশি সালের মারুতি আটশো। লজ্‌ঝড়ে গাড়িটারও একটা নাম আছে মৌখিক, পদ্মপলাশের নানা ডাকত—সাইয়ারা। উর্দুতে নাকি সাইয়ারার অর্থ তারা। ইতিহাস নলিন এর মধ্যেও প্রশ্ন করে পদ্মপলাশকে,
—আর আরবিতে?
—আছে হয়তো কিছু একটা, নানা জানত।

পদ্মপলাশের নানা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মেসোপটেমিয়ায় ছিলেন কিছুদিন, মিলিটারি হাসপাতালে ডিউটি করতে করতে কম্পাউন্ডারিটাও রপ্ত করে ফেলেন। শিলচরের বড়ো বড়ো ডিগ্রিধারী ডাক্তারদের মধ্যেও তখন আলফ্রেড মুর্তজা ডাক্তারের ছিল বেজায় পসার, এখন বেঁচে না থাকলেও মানুষ চেনে এক ডাকে।

বন্ধু তিনজনের ভেতর দুজনই কম কথার মানুষ কিন্তু ওদের কথায় কথায় জড়িয়ে রাখে নলিন, নলিনের ধ্যানজ্ঞান তার শহর আর শহরের মানুষজন নিয়ে। বিকেলবেলা ওরা তিন বন্ধু মিলে যায় লালবাগানের কোচিং সেন্টারে, দু-ঘণ্টায় কুড়িজন করে ছাত্র পড়ায় তিন ঘরে। অঙ্ক বাংলা আর ইতিহাস। অভি একেবারে ল্যাবাগোবা, সাইকেলও চালাতে পারে না, গাড়ি তো দূরের কথা। নলিন ফেরার সময় চালায়, যদিও ওসব ঠিক থাকে না সব সময়, পদ্মপলাশও আসা যাওয়া দু-পথেই চালিয়ে নেয়। বরাক ব্রিজের পাঁচ নম্বর খুঁটির কাছে এলেই নলিন ডান হাত মাথায় ঠেকায়, বাকিদের ওসব বালাই নেই। বরং সেতুর উপর উঠেই ওরা গুনতে শুরু করে এক দুই তিন চার, পাঁচে এসে হাঁক দেয়—নলিন, মাথা ঠোক। নলিন রাগে না মুচকি হাসিতে জানায়,
—এই পাঁচের খুঁটি হলো সুইসাইড পয়েন্ট। জানিস তোরা, কত মেয়ে আত্মহত্যা করেছে এখানে?
—চেষ্টা করেছে, কেউ মরেনি।
—শম্পা পাল মরেনি? প্রদীপদা মরেনি? প্রদীপ সেন? গোপাল কাহারের লাভার মধুবালা?
—ধুর, মধুবালা ওর আসল নাম ছিল না।
—কী বিউটিফুল ছিল, মরে গেল। ধুস!

এই এক খেলা। ফেরার সময়ও গুনবে এক দুই তিন চার নলিন। আসলে মোট ন’টা খুঁটির হিসেব যে কে করেছে, কে জানে! খুঁটি তো নয় ল্যাম্পপোস্ট অগুন্তি। কিন্তু ওরা কাল্পনিক একটা পঞ্চম ধরেছে। তবে তাদের গাড়ি যে রোজ এক পথেই যাওয়া আসা করে তাও নয়। ছুটির দিনে ওরা এদিক-ওদিকেও যায়, চা বাগানে, বিল হাওড়ে, পাহাড়ে। খুব দূরে যাওয়ার পরিকল্পনা থাকে না প্রায় চল্লিশের তারাকে নিয়ে থুড়ি নক্ষত্রকে নিয়ে, কারণ নলিন বলেছে তাদের দখলে যতক্ষণ থাকবে গাড়ি তখন আর একটিমাত্র তারা হয়ে থাকবে না, তখন হবে তারামণ্ডল, নক্ষত্র। সেই নক্ষত্রপুঞ্জের তিন তারা নিয়ে সাইয়ারা রংপুর ছাড়িয়েও ছোটে কুম্ভীরগ্রামে ভোরেরবেলা যাত্রী আনতে। গিরিবালাকে পিতৃগৃহে ফিরিয়ে আনতে।

সাইয়ারা কিন্তু জনতা-পরিবহন নয়, বিমানবন্দর রেলস্টেশন কিংবা বাসস্ট্যান্ড কাউকে আনা নেওয়ার কাজে ব্যবহৃত হয় না। পদ্মপলাশের ঠাকুরদার মৃত্যুর পর লাল ক্রস চিহ্নটা উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে কারণ বাবা কাকা ভাইবোনের কেউ আর ডাক্তার-কম্পাউন্ডারির লাইনে যায়নি। চামড়াগোদাম আর মধুরবন্দে দু-দুটি শুঁটকি মাছের আড়ত আছে, এই একটিমাত্র ব্যবসার আয়ে তাদের পরিবারের মোটামুটি চলে যায়। চাচার পরিবার আর তাদের দু-ভাই এক বোনের সংসার ইটখোলা রোডের বাড়িতে। পদ্মপলাশ মুর্তজা ডাক্তারের নাতি হিসেবে একটা পরিচয়ের সঙ্গে নিজেও কিছু তৈরি করেছে। কলেজে পড়ার সময় ছাত্র রাজনীতি করেছে, গলায় হারমোনিয়াম লাগিয়ে গণসংগীত গেয়েছে। সদ্য ছাত্র থেকে যুব রাজনীতিতে পা দিয়েছে। আসাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যায় এমএ পাশ করে ব্যবসার ধান্দায় ঘুরছে। এখন ধরেছে অভিমন্যুকে পার্টনার করে একটা ছাপাখানা খুলবে শিলচরে। চাকরি বাকরি করবে না।

অভিমন্যুও খুব সচেতন এবং আত্মাভিমানী আবার নলিনীকান্তর মতো পুরোনো কালেও পড়ে নেই। সে ঐতিহ্য সচেতন, কিন্তু পদ্মপলাশের মতো মাকু-সেকুও নয়, নলিনের মতো হিন্দুত্ববাদীও নয়৷ শরিফের সঙ্গে ব্যবসা করতে তার আপত্তি নেই।

নলিনীকান্ত ঢাকাই ব্রাহ্মণ কিন্তু পঞ্চখণ্ড ঢাকা দক্ষিণের ঐতিহ্য নিয়ে চিন্তিত, রঘুনাথ শিরোমণি আর জগন্নাথ মিশ্রর বংশাবলী এমনকি বর্তমান প্রজন্ম পর্যন্ত তার নখদর্পনে। এখন পর্যন্ত রাজনীতি করার কোনো ঝোঁক নেই তার। না থাকলে কী হবে, হিন্দুত্ববাদীদের কর্মকাণ্ড সে অপছন্দও করে না, মুচকি হাসি দিয়ে পদ্মপলাশকেই বলে,
—দেশভাগ হয়েছে, মুসলমানরা নিজের দেশ পেয়েছে, একটা ভেঙে দুটো হয়েছে, এখন হিন্দুদের শান্তিতে থাকতে দেবে না কেন নিজ দেশে?
পদ্মপলাশকে চুপ করিয়ে রেখে অভিমন্যু বলেছে,
—দেশভাগ ধর্মের নামে হলেও, কোথাও বলা হয়নি অন্য ধর্মের স্থায়ী বাসিন্দা থাকতে পারবে না।
এরপরই নলিন দুম করে চলে যায় ইতিহাসে। বলে,
—আসলে ওই ঘাউড়ি লোকটাই যত কণ্ডলের ঘটি।
—ঘাউড়ি আবার কী করল হে, স্যার যদুনাথ? লোকটা তো মোটামুটি ক্রিকেট খেলত, দেখতে সুপুরুষ ছিল।
—আরে না রে, কার্সন ঘাউড়ি না, মহম্মদ ঘাউড়ি।
—ও মহম্মদ ঘোরি, ঘাউড়ি না বলে বাংলায় ঘোরি বললেই তো হয়, এত প্যাঁচাস কেন?
—ওই লোকটাই তো পৃথ্বীরাজ চৌহানের হিন্দুসাম্রাজ্য দখল করল ছলে। এরপর থেকেই না হিন্দুদের দুঃখকষ্টের শুরু।
ধীরস্থির পদ্মপলাশ এসব আলোচনায় মধ্যস্থতা করে না বরং নলিনকে আরও তাতিয়ে দেয়। বলে,
—আমাদের মধ্যে একজন জামাতি থাকলে ভালো হয়, সমান সমান হয়, ভট্টাচার্য বামুনের ভুল ইতিহাস শুধরে দেওয়া যায়, শঠে শাঠ্যং, ফাইভ সিটার গাড়িতে আরও একজন তো অ্যাড করা যায় অনায়সে, কুতুবকে ডাকি?

কুতুব তাদের সহপাঠী হলেও কট্টর মুসলমান, চোগা চাপকান টুপি পরে একজন ধর্মপ্রচারক এখন।

কাছাড় জেলার জনসংখ্যার অনুপাতে মুসলমানরা হিন্দুর কাঁধের উপর নিঃশ্বাস নিচ্ছে, চল্লিশ ষাট। প্রায়ই উত্তেজনা ঘটে, দুই ধর্মের জিগির ওঠে, আবার পদ্মপলাশদের মতো যুবশক্তি আর তাদের অভিভাবকদের শুভ বুদ্ধিতে শান্তি বজায় থাকে। ক্ষীণদেহী অভিমন্যুও তখন দুঃসাহসী হয়ে ওঠে, সাম্প্রদায়িক প্ররোচনার আভাস দেখলেই লাঠিসোটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে নিজের ধর্ম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে। কতবার যে মার খেয়ে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। তার ইয়ত্তা নেই। উত্তেজনার সময় কি কেউ ভাই-বন্ধু-ভালো ছেলে মানে।

দাঙ্গা পরিস্থিতিতে শহর উত্তেজিত রাখার চক্রান্ত বজায় রাখে দু-পক্ষ। প্রশাসন ধর্মীয় মিছিলের পথ বেঁধে দেয়, অন্য ধর্মগৃহের সামনে দিয়ে যাওয়া চলবে না, চললেও নীরবে পেরিয়ে যেতে হবে ইত্যাদি অনেকরকম আইনকানুন। কিন্তু কে শোনে কার কথা, এখন শহরে বারোমাস তিনশো ছেষট্টি পুজো। যে পুজোটি এতদিন ছিল গৃহস্থের একান্ত আপন, বিষহরি পুজোর জৌলুস এখন দুর্গা পুজোকেও হার মানায়, মত্ত নৃত্যে মনসার মূর্তি নিয়ে নগর পরিক্রমার কোনো ঐতিহ্য ছিল না শহরে, এখন হয়েছে, ট্রাফিক থামিয়ে উল্লু কা পাট্‌ঠা গানের তালে হয় উদ্দাম পথ নৃত্য। এতদিন পয়লা বৈশাখে দোকানের হালখাতায় ছোটো ছয় ইঞ্চি মাপের গণেশের পূজা হতো। এখন মহারাষ্ট্রের অনুকরণে গণেশ চতুর্থী হয় দশ ফুট মূর্তির। ইদের উৎসবেও বর্ণাঢ্য জলসা হয়। স্কুল কলেজে মিলাদ উৎসব হয় বাড়তি উৎসাহে, শবেবরাতেও হয় রাতভর মস্তি। আর এই বাড়াবাড়িতেই রাগ হয়, হয় গরু শুয়োরের মাংস দিয়ে ধর্মস্থান অপবিত্র করার রাজনীতি। ইদানীং তো গরুর মাংস খাওয়ার এবং বহন করার মিথ্যা আরোপেও মানুষ মারা হয়, লিঞ্চ হয়। আখলাক নামের এক নিরীহ মানুষকে পবিত্র ইদের রাতে গরু চুরি গো-হত্যা ও বাড়ির ফ্রিজে গোমাংস রাখার মিথ্যে অজুহাতে পিটিয়ে মারা হয় উত্তরপ্রদেশে। শুভ বুদ্ধির প্রতিবাদী মানুষ গর্জে ওঠে ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে। সন্দেহের বশে অকারণ ভিন্নধর্মী বলে মানুষ মারার প্রতিবাদে কলকাতায় হয় সভাসমিতি ছাত্রসমাবেশ।

তেমনি এক সভায় সামিল হয় শিলচরের মেয়ে গিরিবালা। ছোটো খবর বেরিয়েছিল কলকাতার কাগজে, এমন নতুন কথাও কিছু বলেনি গিরি, সে বলেছিল বেদের কালে পুরাণের কালে মহাভারতের কালেও গরু বিক্রি করা হতো না, ব্রাহ্মণকে দান করত ক্ষত্রিয় রাজা। তাহলে প্রশ্ন ওঠে রাজাই বা এত গরু কোথায় রাখত, কী করত? উত্তর-ভারতের অনুর্বর জনপদে গান্ধার সিন্ধু পঞ্জাবে তবে গোমাংসই কি ছিল একমাত্র পুষ্টিবর্ধক আহার্য? গিরিবালা বলেছিল, নিশ্চিতই ছিল, গরু মোষ ঘোড়ার মাংস বলদায়ী ছিল যোদ্ধাজাতির। রাহুল সাংকৃত্যায়ন পর্যন্ত লিখে গেছেন সেই কবে, চম্বল নদীর নাম ছিল চমতী, গরুর চামড়া ধোয়া হতো বলে। এসব তো সবাই বলে, আর্য জাতির ইতিহাস ঘাঁটলেই জানা যায়। খবর পড়ে ধর্মীয় দলবল একটু বিরক্ত হয়। দুদিন পর ছবিটা বেরোতেই ছড়িয়ে পড়ে ফেসবুকে, ভাইরাল হয়। সামুহিক গোমাংস ভক্ষকের দলেও দেখা যায় গিরিবালা ঠাকুরকে। ব্যস, ভস্মে ঘি পড়তেই আগুন বেরোয় দাউদাউ, কলকাতায় কিছুই হয় না, কিন্তু শিলচরে ভাঙচুর হয় গিরিবালার বাবার বাড়ি, দুই ছোটো বোন মহামায়া আর নলিনীকে ধর্ষণের আগাম হুঁশিয়ারি জানিয়ে যায় মাথায় ফেট্টি বাঁধা গোরক্ষকের দল।

গিরির বাবা, বিনয় ঠাকুর দমবার পাত্র নয়, তারও আছে দলবল। রাজনৈতিক দল না হলেও মানুষের প্রিয়ভাজন তিনি, বছরকার বন্যায় তার ডাকে এপাড়া ওপাড়ার ছেলেছোকরারা জড়ো হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে বন্যাত্রাণে, জলমগ্নদের উদ্ধার করে ত্রাণ শিবিরে পৌঁছে দেওয়া, বাড়ি বাড়ি ঘুরে কাপড়চোপড়ের ব্যবস্থা করা, ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাল ডাল জোগাড় করা, যতক্ষণ না সরকারি ত্রাণ ব্যবস্থা কার্যকরী হয়। বিটিদার দলে দু-একজন ছাড়া প্রতি বছর নতুন নতুন ছেলেরা এসে ত্রাণ শেখে, দুর্গত মানুষের পাশে থাকার পাঠ নেয়। তাদের মা বাবাও বলে, যা যা কয়েকদিন ভালো কাজ করে আয়। তবে ইদানীং বিটিদার কাজ করতে আইনকানুন মানতে হচ্ছিল, আগে এমন ছিল না, এখন ত্রাণেও সরকারি অনুমাোদন চাই। বিটিদার বাড়িতে যখন ভাঙচুর হয় তখন কিন্তু তার দলের ছেলেদের দেখা যায়নি, দু-চারটে মিনমিনে ছোকরা পাশে ছিল, অবস্থা ভালো নয় দেখে ওরাও সরে যায়। বিনয় ঠাকুর এসব অনেক দেখেছে, সবাই মুখ ফিরিয়ে নিলেও বুকের পাঁজর আগলে কী করে এগিয়ে যেতে হয় সে জানে, ধর্মবাদী মানুষের বিরুদ্ধে একা রুখে দাঁড়াতে অসুবিধা হয় না। সশস্ত্র জনতার মুখমুখি হয় নির্ভয়ে। বলে,
—আয়, দেখি কার কত ক্ষমতা।
বলে,
—আমাকে একা ভাবিস না, আমার সঙ্গেও মানুষ আছে।

শুধু নলিনীকান্ত আর অভিমন্যুকে পাশে দেখে ওরা হেসেছিল।

সেদিন ক্ষুদিরামের মূর্তির নীচে দাঁড়িয়ে বিনয় ঠাকুরের দুর্নীতির জবাব চাইল জনতা। কত কথা বলে গেল কুৎসাকারী বক্তার দল। বিনয় ঠাকুর নাকি ত্রাণের কাপড় বেচে খেয়েছে, ব্যবসায়ীদের টাকাও খেয়েছে, নইলে কেন এত উৎসাহ ত্রাণ ভাণ্ডারে। এক এক পয়সার হিসাব চাই। সভায় তাকে আর কেউ বিটিদা বলেও সম্বোধন করল না। বিটিদা মানে বিনয় ঠাকুর যেমন হয় আবার বন্যাত্রাণ দাদাও হয়৷ বিনয় ঠাকুরের রাগটা একটু বেশি, থামাটাও দ্রুত। আবার যখন তার বাড়ির সামনে এসে তাকে খুন করার আর মেয়েদের ধর্ষণ করার হুমকি দিতে এল, তখনও সে বেরিয়ে এসে রুখে দাঁড়িয়েছিল, বলেছিল আবার,
—দেখে নেবো।
বলেছিল,

—আমিও ঠাকুরবাড়ির ছেলে।
আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল রাগের কথা কিন্তু সহসা পিছন থেকে এক মহিলার হাত তার মুখ চাপা দেয়, ওর স্ত্রী। ওরা চলে যায়।

ছেলেছোকরারা ওকে ছেড়ে গেলেও, পদ্মপলাশ অভিমন্যু আর নলিন তাকে ছাড়েনি, যদিও মনে মনে নলিন মারমুখী ধর্মধ্বজাধারীদের সমর্থন করে। তবু সে বন্ধুদের সঙ্গে থাকে। ওরা সময় মতো পৌঁছে যায়। শরিফউদ্দিন ইদগার মোড়ে থেমে যায়। বলে,
—তোরা যা, বাঙাল দেখলে আবার ওরা জ্বলে উঠবে। বেতাড়া কিছু দেখলে আমাকে ফোন করিস।

বিটিদা একা হলেও একশো জনের কম নয়। সেদিনও রুখে দাঁড়িয়েছিল। বলেছিল,

—তোরা কে রে? গুন্ডামি করতে এসেছিস, তোদের বাপ কাকাকে তো চিনি, সব মান্যগণ্য মানুষ শহরের। তোরা আমাকে মারতে এসেছিস? বিনয় ঠাকুরকে? আমাকে চিনিস না? আমিও ঠাকুরবাড়ির…!

এবারও কথা সম্পূর্ণ করতে পারেনি, পাথরের টুকরো এসে লাগে নলিনের গালে। সঙ্গে সঙ্গে পালটে যায় বিনয় ঠাকুর বিটিদায়। গিরিবালার বাবা তখন ভুলে যায় তার ব্যক্তিগত সমস্যার কথা, সেবাব্রতী বিনয় ঠাকুর তখন নলিনকে টেনে নিয়ে ভিড়ের ভিতর দিয়ে উঠে যায় মেন রোডে, জটলার ভিতর একটি ছেলেকে ডাকে, বলে,

—চল, তোর তো গাড়ি আছে, নিয়ে চল হাসপাতালে।

ছেলেটি তাঁর পরিচিত, বিনয় ঠাকুরের প্রত্যয়ী আদেশে প্রথমে থমকায় তারপর অবজ্ঞা করে। বিটিদাও এসব কেয়ার করার মানুষ নয়, সে নলিনকে নিয়ে ইদগা পর্যন্ত যায়। কোনো যানবাহন নেই, রিকশাওলারাও কেউ যেতে চায় না। তখন পদ্মপলাশ এসে বলে,
—আপনি যান কাকু, মাথা ঠান্ডা রাখবেন। আমরা আছি, নলিনের কিছু হবে না। ডাক্তার দেখিয়ে ওকে বাড়ি পৌঁছে দেবো।
ইতস্তত করেও বিনয় ঠাকুর ছেলেটির কথায় সম্মত হয়। নলিনের মাথায় হাত বুলিয়ে ফিরে আসে, আপাতত তিন কন্যার দুইজন আর স্ত্রী এই তিন অবলার রক্ষাকর্তা হয়ে।
কলকাতায় আছে গিরিবালা, সে থাকলে বিনয় ঠাকুরকে সাবধান করে বলত,
—অবলা বলবে না বাবা।
বিনয় ঠাকুরও মেয়েকে বলতেন,
—আমি তো বাড়িটার নামই রাখবো ভাবছি—অবলা বাড়ি।
—কেন ঠাকুরবাড়িতে কী দোষ হলো? এরকম শান্তিনিকেতন শিলচর শহরে দুটো আছে?

তা ঠিক, ঠাকুরবাড়ির মতো এত সুন্দর বাড়ি এ তল্লাটে দুটো নেই। শহরের আদি বাড়িগুলি এখনও টিকরবস্তির পাহাড়ে বেঁচে আছে। হয়তো টিকবে না বেশিদিন, টিলার উপর বহুতল বাড়ির প্রযুক্তি এসে পৌঁছালো বলে, মানুষের লোভ আলজিভ পর্যন্ত চকাশ চকাশ করছে এখন। তাদের বাড়িটা দোতলা না হলেও টিলা কেটে দোতলার মতো হয়ে গেছে, দুটো প্রবেশ দ্বার। কলেজের দিক দিয়ে নামলে একটা ফুলের বাগান স্বাগত জানাবে। এখন সব তছনছ, ঘাটা ভেঙে গাছগুলি পর্যন্ত উপড়ে দিয়ে চলে গেছে। একতলার বাগানটা এখনও অক্ষত। ওদিকটায়ই প্রধান রাজপথ, পথের ওপারে অশোক মহাপাত্রর বাড়ি, পুলিশের এসআই। যে-কোনো সুখে দুঃখে পাশে থাকে, পাশের বাড়িতেই কলেজিয়েটের ফিজিক্যাল ইন্সট্রাক্টর গৌতম শী, ডাকাবুকো ছেলে।

কিন্তু এ কেমন অন্ধকার সময় এসে গেল, কেউ বেরিয়ে এল না। বাড়ির গৃহিণী পর্যন্ত গিরিবালা আর তার বাপের শিক্ষাকে দোষারোপ করেছে। বলছে,
—ঠাকুর দেবতার মান্যিগণ্যি নেই, পূজাপাঠের বালাই নেই, এরকম হওয়ারই কথা ছিল একদিন। ঠাকুর ঠাকুর!
বিনয় ঠাকুরের রসজ্ঞানও কম নয়। স্ত্রীর ঠাকুর ডাকের জবাব দেয় গাম্ভীর্যে, বলে,

—উঁ, বলো।
এসব হয় মাঝে মাঝে, ঠাকুর পদবীর মজা। এ শহরে অনেক ঠাকুর পদবীধারীর বাস। যেমন বিশ্বাস পুরকায়স্থ সরকার অধিকারীর পদবী দেখে বর্ণ বোঝার উপায় নেই। ব্রাহ্মণ হয় কায়স্থ হয় নাথ যোগী তপশীলীভুক্ত নিম্নবর্গেরও হয়। বিনয় ঠাকুরের সমাজ সেবক পরিচয়ের বাইরে একটা পেশাও আছে গ্রাসাচ্ছাদনের প্রয়োজনে। সে এক ছোটো ব্যবসায়ী, রঙের ঠিকাদার। সরকারি অফিস কিংবা গৃহস্থ বাড়ি রং করার একচেটিয়া কারবার তার। তিন মেয়ের বড়োটি গিরিবালা পাড়ায় মিষ্টি স্বভাবের মেয়ে বলে পরিচিত, ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়ার কথা বলেছিল বাবাকে, বাবা বলল,
—তুলনামূলক সাহিত্য নিয়ে পড়বি যাদবপুরে?
মেয়ের পছন্দ হয়। জিসি কলেজে এসএফআই করত, তখন থেকেই হিন্দু মুসলমান দুই দলেরই টার্গেট ছিল। কলকাতা গিয়ে অন্য সংগঠন, আরও কড়া আরও লাল। বিনয় ঠাকুরকে সব জানায় মেয়ে, সে-ও যেন মেয়ে নয়, বন্ধু। মেয়ে যা বলে সব তাতেই বাপের হ্যাঁ। নলিনকে পদ্মপলাশের হেফাজতে দিয়ে ফিরতে ফিরতে মেয়েকে নাটকের সব দৃশ্য পুঙ্খানুপুঙ্খ জানিয়ে দেয় মোবাইলে, মেয়ে বলে,
—কে কে ছিল তোমার পক্ষে?
—কেউ না!
—অভি?
—রোগা পটকা!
—পটকা হলে কী হবে, তেজ আছে। তবে নলিন আসবে না জানি, সে তো ও দলের।
—ভুল, ওদের পাথরেই তো মাথা ফাটল নলিনের।
—আরে সাবাশ! আর পলাশ?
—শরিফ ছিল দূরে, নলিনকে নিয়ে গেল ইদগা থেকে।

হুমকি টুমকিতে প্রাথমিক পর্যায় শেষ হয়। কিন্তু শহরে এক নতুন মুখরোচক আলোচনার শুরু হয়ে যায় বিনয়েন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে। ঠাকুরবাড়ির ছেলে—এই মন্তব্যটি সাংবাদিকরা খুব চাতুর্যে ব্যবহার করে সংবাদপত্রে টিভিতে। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে সম্পর্কের ইশারা দিয়ে। আর ওই সংবাদসূত্র ধরে এক মুখরোচক আলাপের সূচনাও হয়ে যায় ছোটো শহরে। কোন ঠাকুরবাড়ির উত্তরপুরুষ তাহলে বিটিদা! আর ঠাকুরবাড়ি বলতে তো একটিমাত্র বাড়ি আছে সারা বাংলায়। দ্বারকা ঠাকুর দেবেন ঠাকুর রবি ঠাকুর। শিলচরের মানুষ তো জানে, বরাক উপত্যকার দূরদূরান্ত পর্যন্ত ঠাকুরবাড়ির কোনো সম্পর্ক নেই। রবীন্দ্রনাথও শিলচরে আসেননি। তৎকালীন সিলেটের বদরপুর জংশনে ছিলেন কয়েক ঘণ্টা। ব্যস, এই তো যোগাযোগ তাঁর এ উপত্যকায়। কামিনীকুমার চন্দ আর তাঁর ছেলেদের সঙ্গে যা, তা তো চিঠিপত্র জোড়াসাঁকো আর শান্তিনিকেতনে। তাহলে বিনয় ঠাকুর বারবার কেন ঠাকুরবাড়ির ছেলে বলে জোরগলায় ঘোষণা করে, কীসের জোরে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রাজনৈতিক নেতা নামজাদা উকিলদের আলোচনা থামতেই চায় না সংবাদপত্র টিভি ফেসবুক টুইটারে। কেউ কেউ বলে, ওরা কী তবে ব্রাহ্ম! টিভির বুম নিয়ে রাহুল দেব ঠাকুরবাড়িতেও পৌঁছে যায়। বিনয় ঠাকুর বলে,
—হ্যাঁ, ব্রাহ্ম মন্দিরে উপাসনা করেছেন ঠাকুরদা। উল্লাসকর দত্তও যেতেন।

এসব শুনে, টিভিতে দেখে পদ্মপলাশের সন্দেহ হয়, কলকাতায় গিরিবালাকে ফোন করে। গিরিও বলে,
—তথ্যপাতি কিছু নেই, তবে বাবা তার ঠাকুরদার রেফারেন্স দিয়ে থাকেন। বরং তফশিলি জাতিভুক্তদের সঙ্গে আত্মীয়তা আছে আমাদের, যদিও কোনো শংসাপত্র নেই। তাতে কী হয়েছে, আত্মীয়তা থাকতে পারে, শুনেছি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্বপুরুষরাও মুসলমান হয়েছিলেন, আবার ফিরেও এসেছিলেন নিম্নশ্রেণির ব্রাহ্মণ পরিচয়ে।
—তাহলে কেন কাকু এমন আলটপকা মন্তব্য করলেন?
—আলটপকা হবে কেন? আমার বাবা দুম করে কথা বলে না। অভিদার মতো ঠান্ডা মাথার মানুষকে যখন তোমরা খ্যাপাও, তখন তাকেও তো বলতে শুনি, আমি অভিমন্যু সাধ্য, সাধ্য বাড়ির ছেলে। এ তো সিম্পল বাগভঙ্গি এক একজনের। এর জন্য কেন এত হইচই, বাবার এতদিনের সুকর্মকে নস্যাৎ করার পরিকল্পনা? আমার বাবা ওসব কেয়ার করে না।

পদ্মপলাশও জানে, বিনয় ঠাকুর কেয়ার করার মানুষ না। নাকি বিটি কাকুর মনের কোণের কোনো দুঃখ ক্ষোভ থেকে…! সুশিক্ষিত মানুষ বিনয় ঠাকুর এমএ পাশ করেও কোনো চাকরি পাননি। গিরিবালা শরিফকে বলেছে, তাঁর বাবা কাস্ট সার্টিফিকেট নেয়নি। বলেছে বিশেষ সুবিধার তার দরকার নেই। তাই কি তবে রঙের ঠিকাদার হওয়ার বিড়ম্বনা ঢাকতে উত্তরাধিকারের খোঁজ! কী জানি, কী আছে বাপ-বেটির মনে।


গ্রীষ্মের ছুটি পড়তে পদ্মপলাশ গিরিবালাকে বারণ করে শিলচর আসতে। রাজ্যে নির্বাচনের দিনক্ষণ ঠিক হয়ে আছে, কখন কোথায় কী হয় কিছুই বলা যায় না, তার উপর গিরিবালা ঠাকুর ইস্যু তো তখনও থিতু হয়নি। গিরি রাজি নয়। বলে,
—আমি আসব।

একবার যখন বলে দিয়েছে, তখন সে আসবে জানে পদ্মপলাশ। তাই তার পার্টটাইম গাড়ি সাইয়ারাকে সোমবারের জন্য ফুলটাইম করিয়ে নিয়ে ছোটে রংপুর পেরিয়ে উধারবন্দ খাসপুর কুম্ভীরগ্রামের দিকে। সকাল ছ’টায় বিমানবন্দরের পথে গেরুয়া ফেট্টিবাধা মাথায় মাথায় ছয়লাপ হয়। গোরক্ষকের দল কিছুতেই এয়ারপোর্টের বাইরে বেরোতে দেবে না গিরিবালা ঠাকুরকে। বেরিয়ে আসতে চাইলে গিরির উপর শারীরিক অত্যাচারও হয়, বিনয় ঠাকুরকে ঘিরে ধরে আন্দোলনকারীর দল। বিটিদা ওদের কী বলে কে জানে, কিছুক্ষণ দেশজননীর স্লোগান দিয়ে পতাকা উড়িয়ে বিজয়ীর মতো চলে যায়।

কিন্তু বাড়ি ফিরেও স্বস্তি নেই, টিনের চালে ঢিল পড়ে রাতে। এবার আর সশরীরে নয়, চিঠিতে হুমকির ফরমান আসে। খুন ধর্ষণের ফতোয়ায় দুই ছোটো বোন মহামায়া আর নলিনী কোথাও বেরোতে পারে না, ওদের পড়াশুনাও বন্ধ। ঘরের ভিতর মায়ের গঞ্জনা, বাবা বিনয় ঠাকুরও চুপচাপ। দুদিন পর মহামায়া আর নলিনী কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফেরার পর বিনয় ঠাকুর বড়ো মেয়েকে বলে,
—কলকাতা চলে যা মা।
গিরি বলে,
—না বাবা, যাবো না। আমার ছুটি ফুরোয়নি এখনও। ঠিক আছে, তুমি যখন বলছো তখন থাকব না আর এ বাড়িতে।
বলেই বেরিয়ে যায় দুম করে।

শহরে রটে যায় আর এক গুজব, গিরিবালা বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছে। ধর্মবিপ্লবী শহরবাসী ভাবে মেয়েটা ভীরু, ভয়ে পালাল। বেশ তো শহর তেতে উঠছিল, হিঁদুয়ানি প্রকট হচ্ছিল।

গিরিবালা কোথাও পালায়নি, শহরেরই অন্য প্রান্তে ঘনিয়ালায় তার বন্ধু রোশনারার বাড়িতে গিয়ে থেকেছে। বাবা মা আর বোন দুটোর মুখ চেয়ে। রোশনারা বন্ধু হলেও তার দাদা পদার্থবিজ্ঞানী শরিফের সঙ্গে যে গিরির ভাব-ভালোবাসার সম্পর্ক আছে সে-কথাও জানে রোশনারা। গিরিবালা শরিফের বাবা মধুরবন্দের ব্যবসায়ী লুৎফর রহমানকে বলে, সে বিয়ে করতে চায় পদ্মপলাশকে। লুৎফর রহমান বলেন,
—পদ্মপলাশ তো হিন্দু নয় মা।
মেয়ে বলে,
—তাতে কী? বিয়েই তো করব দুজন!

শরিফের বাবা মত দেন। কিন্তু পদ্মপলাশ বেঁকে বসে। বলে, বিয়ে করে ওরা ভারতের কোথাও বাস করতে পারবে না, তার নিজের শহর শিলচরেই দাঙ্গা লেগে যাবে। এবং লেগেও যায়। কালীবাড়ির গলিতে লুৎফর রহমানের শুঁটকির আড়ত লুট হয়। রিকশায় অটোয় আগুন লাগে জানিগঞ্জে, শরিফের খোঁজে দল বেঁধে দাঙ্গাবাজেরা রহমান বাড়িতে যায়, ওখানে পাওয়া যায় গিরিবালাকে। শহরে আবার ছড়ায় গুজব, গিরিবালা জাহানারা বেগম হয়ে বিয়ে করেছে শরিফউদ্দিনকে।

বিনয় ঠাকুরও এবার পালটে যায়। মেয়ের কথায় আর হ্যাঁ করে না, মেয়েকে ঘরের ভিতর বন্দি করে রাখে।

সাংবাদিকরা এলে দরজা খুলে দেয়। মেয়েকে পাখি-পড়া করে বলে, বিয়ের খবর মিথ্যে বলতে। সত্যি কথাই বলে গিরিবালা, বলে সে শরিফকেই বিয়ে করবে। এবার ক্যামেরার সামনে মা বাবার হাতে কিল চড় খাওয়ার ভিডিও ফুটেজ ভাইরাল হয়ে যায় সোশ্যাল মিডিয়ায়।

পদ্মপলাশকে নিয়েও শহর তোলপাড় হয়, ওরা তিন বন্ধুও উদ্‌বেগে থাকে, কখন কী হয়! নলিনীকান্ত সবচে ভীতু, বলে,
—কী হবে রে?
অভিমন্যু বলে,
—বিয়ে করবে।
শরিফ বলে,
—করবে না।
—করবে না মানে? আলবত করবে, ভীতু নাকি? পদ্মপলাশ বলে,

—ভীতু আর সাহসীর কথা নয়। বিয়ে যে করব, কেন করব? সুখ হবে? আর একটা মুসলমান বাড়িয়ে কী লাভ বল, যখন কেউই সুখে থাকবে না। বিয়ে একটা সামাজিক অনুষ্ঠান। পারিবারিক বিষয়।
—তোমার গিরিবালা বুঝবে তো?
—বুঝাতে হবে।
—কী বুঝাবি, কে বোঝাবে! ওর বাবা মা পর্যন্ত গায়ে হাত দিল। মেয়েটার মন ভেঙে গেছে, এখন যদি তুইও সরে দাঁড়াস, কিছু একটা করে ফেলতে কতক্ষণ?
—গিরি এত নরম মনের মানুষ নয়।

আজ ওদের খুব তাড়া। কোচিংয়ের টাকা পেয়েছে তিনজন। রিয়া প্যালেসে খাওয়াদাওয়া হবে তাই পদ্মপলাশ রয়েছে স্টিয়ারিংয়ে, এক-এর খুঁটি পেরিয়ে যায় কিছু বলে না কেউ। শহর অন্ধকার হয়ে আছে যেমন থাকে লোডশেডিং হলে, তার উপর অমাবস্যার রাত। অভি নলিনের কাছ থেকে সিগারেট চেয়ে নিয়ে ধরাতে যায় আর তখনই ওরা খুঁটি গোনায় মন দেয়, দুই তিন চার, চারের খুঁটি পেরিয়ে পাঁচে পৌঁছোনোর আগেই দেশলাইয়ের আগুনে সিগারেটের ধোঁয়ার ভিতর শরিফ দেখে, পাঁচের খুঁটি, আলোকস্তম্ভ বেয়ে উঠছে গিরিবালা আর সেতুর রেলিং পেরিয়েই দেয় ঝপাং লাফ, শরিফও উত্তেজনায় চিঁহিহি করে ব্রেক চাপে, হ্যান্ড ব্রেকও উঠিয়ে দেয় মাঝ সেতুতে। নেমে যায় গাড়ি থেকে আর খুঁটি বেয়ে উঠে রেলিং পেরিয়ে সে-ও দেয় অন্ধকারে লাফ—ঝপাংঝাঁপ।

বাঁচল দুজনই। পদ্মপলাশ ঝাঁপ না দিলে বাঁচত না গিরিবালা। অন্ধকার রাতে ওরা তিনজন ছাড়া কেউ দেখেনি—গিরিবালাকে, পদ্মপলাশকেও কেউ দেখেনি ওরা দুজন ছাড়া।

দুটি খাঁটি মানুষ সমাজের কাছে হার মানতে মানতে কোণঠাসা হয়ে যা করেছিল এছাড়া আর উপায় ছিল না বুঝতে পারে অভিমন্যু। কাউকে কিছু না বলে অভিমন্যু যায় টিকরবস্তির ঠাকুরবাড়িতে, উপর থেকে নীচে নামে, সন্ধ্যার আকাশ ছেয়ে আছে মেঘে মেঘে, অপরূপ সুন্দর মেঘের ভিতর দেখে এক উজ্জ্বল রমণী মূর্তি বসে আছে দোতলার ছাদে। অভিমন্যু গালিবের কবিতাকে নিজের মতো সাজায়, চুল এলিয়ে যখন ভাঙা মেঘের উপর কেউ বসে থাকে সন্ধ্যাবেলা, তখন মনে হয় জীবন কত সুন্দর। অভিমন্যু গিরিবালাকেই ছাদের উপর বসে থাকতে দেখে, মেঘের উপমায় এক ঢাল চুল এলিয়ে। এর আগের দিন গিরিবালাকে দেখে ওর ভালো লাগেনি, ইদানীং বাড়ির মানুষগুলো পর্যন্ত ওর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে না। মানুষ বলেও গণ্য করে না, ছোটো বোনদুটোও সর্বক্ষণ খোঁটা দেয়, এখনও যেমনকে তেমন, শুধু বিনয় ঠাকুর, বিটিদা, গিরিবালার বাবা ওকে সাহস জুগিয়ে যাচ্ছে, বলছে মেয়ে যা করেছে ঠিক করেছে। অনুশোচনায় অভিমন্যুকে বলে,
—ভুল করেছি। বাপের দায়িত্ব পালন করিনি, ছোটো মেয়েদুটোর কথা ভেবে।
অভিমন্যুকে একান্তে ডেকে কি কেঁদেছিল বিটিদা, অনেকক্ষণ ওর হাত দুটো ধরে বসেছিল। বলেছিল,
—আমি মান-অসম্মানের কথা ভাবি না রে বাবা। তাই তো কুম্ভীরগ্রামে মুচলেকা দিয়ে মেয়েকে বাঁচাই। মধ্যবিত্তের গিল্টি করা গয়না মানসম্মান, ওসব দিয়ে কিছু হয় না, আমি তখনকার মতো সপরিবারে বাঁচতে চেয়েছিলাম।
অভিমন্যু বলে,
—তাহলে শরিফউদ্দিনের সঙ্গে বিয়েতে রাজি হলেন না কেন? মুসলমান বলে?
—শরিফকে আমার মেয়ের জামাই করতে চেয়েছি মনে-প্রাণে, কিন্তু শরিফ রাজি হয়নি যে।
—কেন রাজি হয়নি?
—বিক্রম বেতালের গল্প পড়েছো? রাজপুত্রের কাহিনি? বিয়ের সব ঠিকঠাক, রাজকন্যাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছিল রাজপুত্র। এরপরই সে বিয়ে করতে অসম্মত হয়। কেন বলো তো?
—ও হ্যাঁ পড়েছি, মেয়েটির তো পুনর্জন্ম হলো রাজপুত্রের হাতে, আর জন্ম দেওয়া মানে পিতা-পুত্রী। সেকেলে গল্প।
—গল্পটা তাই, আমিও ভেবেছিলাম সেকেলে কিচ্ছাকথা। পদ্মপলাশ যেদিন আমার গিরিকে জল থেকে তুলে এনে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যায় সেদিন তাই ভেবেছিলাম। সেদিনও আক্রান্ত হতে পারতো শরিফ, রাতের অন্ধকারে পৌঁছে দিয়েই চলে যায়, যেন কিছুই হয়নি। কাউকে কিছু না বলতে বলে যায়, আসল ঘটনা গিরির দুই বোনও জানে না ওর মা’ও জানে না।
—মাসিমা তো শরিফকে অপছন্দ করেন।
—ঠিক, গিরিবালার মা পদ্মপলাশকে একেবারে পছন্দ করে না। কিছু করার নেই, আজন্ম লালিত বিশ্বাস যে, মুসলমান মানেই বিধর্মী অচ্ছুত অস্পৃশ্য। প্রীতির সম্পর্ক থাকতেই পারে না।
—বুঝলাম। রূপকথার গল্পের উপদেশ যখন গ্রাহ্য নয় তখন বিয়ে হতে বাধা কোথায়?
—শরিফ ঠিক কথাই বলেছে, বিয়েটা এখন ওদের কাছে বোঝা হয়ে যাবে। গিরিবালার সঙ্গে সমান অধিকারে বাঁচতে পারবে না। কৃতজ্ঞতার শর্ত ওকে স্বাভাবিক হতে দেবে না।

অভিমন্যু এরপর বারবার গেছে ঠাকুরবাড়ি। প্রতিদিনই গিরিবালা দূর থেকে দেখা দিয়ে হারিয়ে গেছে। দোতলার ছাদের উপর এলোচুলের রূপসীকে বসে থাকতে দেখেছে মুগ্ধচোখে। অভিমন্যু একদিন সুযোগ বুঝে বিনয় ঠাকুরকে প্রশ্ন করে,
—কাকু, আপনি কেন নিজেকে ঠাকুরবাড়ির বংশধর বলেন?
বিনয় ঠাকুর হো হো করে হেসেছিল। হাসি থামিয়ে দিয়েছিল সঙ্গে সঙ্গে। ওদের বাড়িতে যে এখন হাসিটাও মানা। বলেছিল,
—আমার যে কোনো পরিচয় নেই, বজ্জাতের দলের সঙ্গে লড়তে গেলে একটা পরিচয় চাই। পরিচয় থাকলে বল হয়, তাই। ভুল করেছি মনে হচ্ছে তোমার? ভুলশুদ্ধের কোনো ব্যাপারই নেই কোথাও। আমি যে একজন জলদাস পাটনি, এ পরিচয় সবাই জানে। তাই এত শোরগোল।
—কিন্তু কাকু হঠাৎ করে রবি ঠাকুর কেন? অনেকে তো মুখার্জি চ্যাটার্জিও লিখছে।
—আমি কোথাও বলেছি রবি ঠাকুরের কথা? আসলে এসব নিভে যাওয়া চিতা থেকে মৃতদেহ উদ্ধারের গল্প। আমার বাবা ব্যারি হোয়াইট মেডিকেল স্কুলের এলএমপি ডাক্তার ছিলেন শিলচরে, পসারও ছিল ভালো পাটনি ডাক্তারের। বাবার তো ওঠা বসা বিখ্যাত মানুষদের সঙ্গে। মহীতোষকাকু দেবব্রতকাকু কালীকাকুদের আড্ডা ছিল সেন্ট্রাল রোডে, বাবাও সময় পেলে গিয়ে বসতেন। বাবার মনে হয়েছিল পাটনি ডাকটা তাচ্ছিল্য। একদিন ইতিহাসের স্যার দেবব্রতকাকু বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের এক ভাইপোর শিলকুড়ি বাসের কথা। সহকারী ম্যানেজার ছিলেন দ্বিজু ঠাকুরের ছেলে। ব্যস, আর কোনো কথা নয় পরদিনই কোর্টে গিয়ে এফিডেফিট করে পদবী বদল হয়ে গেল আমাদের, এই তো গল্প।
এবার অভি মোক্ষম প্রশ্নটি করে,
—আচ্ছা কাকু এবার কেন আপনি চুপচাপ? বন্যার জল ঢুকে মালুগ্রাম ন্যাশনাল হাইওয়ে জলের তলায়, তবু অসহায় মানুষের বিটিদা এখনও কেন চুপ? আপনার নামটাও তো বন্যাত্রাণ মানে বিটি দাদা। আপনি কি অভিমান করেছেন?
—তাই? তোমার মনে হচ্ছে? দ্যাখো অভিমন্যুবাবু, যে একবার অন্যের মেঘে রামধনু হতে শিখেছে সে কী করে বলো তার রঙের খেলা বন্ধ করে? তোমাদের বন্ধু গিরিবালা এখন আমার শিক্ষক, সে কখনও ভুল শিক্ষা দিতে পারে না, তোমার কি মনে হয়? কলকাতা গিয়ে গিরি অনেক সাহিত্য ঘেঁষা কথা শিখেছে, বলেছে, যে আমার মতো নয় তার জন্যও আমার জীবন, আমার ঈশ্বরকে যে আমার ঈশ্বরের নামে ডাকে না কিংবা যার কোনো ঈশ্বরই নেই তার জন্যও আমার জীবন। সে আমার মতো বাঁচতে না পারলেও, আমার ভাষায় কথা বলতে না পারলেও তার জন্য আমার জীবন। এই যে শহরময় গিরিবালার নামে এত কথা, এতদিন থেকে যে সে বাড়িতে নেই, কেউ তো রটাচ্ছে না গুজব এখন, তুমি জানো কোথায় আছে গিরিবালা?
—কোথায় যাবে, ছাদে আছে। এই তো দেখে এলাম।
—ভুল দেখেছো, জলের সঙ্গে লড়াই করছে চার দিন ধরে, যারা সেদিন পাথর ছুঁড়ে মেরেছিল ওকে, ওরাই এখন ওর সঙ্গী।
—আর আপনি! আপনি কি রিটায়ারমেন্টে?
—এ কাজের কোনো অবসর নেই বাবা। যাবে তো চলো।

বিটিদার সঙ্গে বেরিয়ে যেতে যেতে আবার ছাদের দিকে তাকায় অভিমন্যু। তাহলে সে কাকে দেখল এলোচুলে!