[ভাদ্রের বিকেল শুধু একটি সময়-খণ্ড মাত্র নয়, সে যেমন বাহ্যত রোদ-মেঘ-ছায়ায় ভরাট, তেমনি তার ভেতরের নিঃস্বতাও অপরিসীম। শহরতলির ধোপা কুঞ্জবিহারী পুকুরঘাটে সারাদিন কাপড় কেচে ও শুকিয়ে, কাপড়ের বোঝা তার গাধা চাপানের পিঠে তুলে এমনই এক ভাদ্র-বিকেলে ঘরের দিকে ফিরছিল। অকস্মাৎ এক যমদূতের মতো বিশালাকায় লরি তাদের দুজনকেই চাপা দেয়। কুঞ্জবিহারী ও চাপানের মৃত্যু হয়। মৃত্যুর মিনিট পনেরো পর তারা নিজেদেরকে আবিষ্কার করে হাইওয়ের ধারে একটি বিশাল অশ্বত্থ গাছের হেলে পড়া একটি ডালের ওপর। বসার জন্য যদিও তাদের কোনো বৃক্ষশাখা প্রয়োজন ছিল না কারণ তারা তখন ভারহীন, তবু ওই শাখাই তাদের ওই মুহূর্তের অবস্থানকে সূচিত করছিল। নিজেদেরকে পরস্পরের থেকে হারিয়ে না ফেলার জন্য তাদের একটি সাধারণ স্থানাঙ্কের প্রয়োজন হচ্ছিল প্রতি মুহূর্তে। কারণ দুটি অদৃশ্য জীব পরস্পরকে একবার হারিয়ে ফেললে আর একে অপরকে খুঁজে পাবে না, সে সব কথা যদিও তাদের ঠিক ভাবে জানা ছিল না। মৃত্যুর পর থেকে পরস্পর বিচ্ছিন্ন হওয়ার মধ্যবর্তী যে সময়টুকু তারা একসাথে ছিল সেই সময়ের মধ্যে তাদের সংলাপ নিয়েই এই কাব্য(নাটিকা)]



চরিত্র : কুঞ্জবিহারী, এক ধোপা। চাপান, কুঞ্জবিহারীর গাধা। মেঘরথ, কাক।



চাপান :
স্বপ্ন যে এইভাবে সত্যি হতে পারে জানতাম না, প্রভু—
এই তো ক’দিন আগে ভোররাতে দেখি আমি আর তুমি
দুটি পাখি হয়ে উড়ে গেছি, অনেক উঁচুতে বসে আছি এক অশ্বত্থের ডালে
অশ্বত্থের ডালটিও যেন বা জীবিত হয়ে কথা বলতে চাইছে আমাদের সাথে
নীচে হাইওয়ের পাশে ধাবা, লাইন হোটেল, পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে পথচারী
দ্রুতগামী বাস, লরি, ছুটে যাচ্ছে মোটরবাইক যেন এক অস্থির শূন্যতার দিকে
ধাবার পাশেই জমে আছে নোংরা জল, পড়ে আছে অকেজো টায়ার
দূরে দূরে ঘরবাড়ি, ধানখেত, পুকুরের জলে ভাদ্র-বিকেলের রোদ
মেঘেদের পাশ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে বকসারি, চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে প্রাণ
এমনি বহুক্ষণ আমরা দুজন পাশপাশি বসে কাটিয়ে দিলাম যেন
আমরা পরস্পরের ভাষা বুঝতে পারছি সেদিন সহসা, আমি তো অবাক
এর আগে কোনোদিন তুমি তো আমার ভাষা বোঝোনি এভাবে
যেন সেদিন আর আমি গাধা নই তুমিও নও ধোপা, অতঃপর
তোমারই ডাকে ঘুম ভেঙে গেল খুব ভোরবেলা
আরামের স্বপ্নটাও ভেঙে গেল, কিন্তু জানি তুমি আজ বুঝছো না
আমার কথা, আজ শুনবে কি? বুঝবে না জেনেও
মাঝে মাঝে উত্তেজনার বসে বলে ফেলি ভুল করে
কুঞ্জবিহারী :
গাধারাও স্বপ্ন দ্যাখে তবে, জানতাম না, আজ জানলাম
কত কিছুই না অজানা রয়ে গেল এ মানুষ জীবনের শেষে
গাধাদের ঠিক ভাবে বুঝতে গেলে একবার গাধা জন্ম নিতে হবে, দেখি—
চাপান :
সে কী প্রভু, কী আশ্চর্য!
আজ তবে গোটা স্বপ্নটাই সত্যি হয়ে গেল মনে হচ্ছে
কুঞ্জবিহারী :
স্বপ্ন নয়, স্বপ্ন নয়—কঠোর বাস্তব—
আসলে আমরা দুজন পথ হাঁটতে হাঁটতে ওই লরিটার নীচে
চাপা পড়ে মারা গেছি মিনিট পনেরো আগে, ওই নীচে চেয়ে দ্যাখ
হাইওয়ের একপাশে ভিড় জমে আছে, রক্তে ভেসে যাচ্ছে রাস্তা
আমাদের ছিন্নভিন্ন দেহ দুটি নিথর ছড়িয়ে পড়ে আছে
শুরু হয়ে গেছে রাস্তা অবরোধ—চলছে স্লোগান
চাপান :
সে কী প্রভু, আমরা কি একেবারে মারা গেছি নাকি?
আর ওইসব অবরোধ-টবরোধ কারা করছে? মানুষেরা?
জানি গাধারা এসব কিছুই করবে না কোনোদিন, কোনো প্রতিবাদ
হয়তো সব পুকুরঘাটের ধারে কিংবা মাঠে ঘাস খাচ্ছে
নিশ্চিন্ত আরামে, কে কোথায় মরে পড়ে আছে কে খবর রাখে?
কিন্তু, আমাদের মৃত্যুর প্রতিবাদেও এত কিছু হতে পারে, প্রভু?
কুঞ্জবিহারী :
কেনই বা হবে না বল, মৃত্যু তো মৃত্যুই
মৃত্যুর থেকে তো আর কেউ ফিরে আসে না কখনও
চাপান :
তাও বটে, আমি তো আসলে গাধা, এসব বুঝি না
যাকগে সে সব কথা, যা হবার হয়ে গেছে
চলো, ঘটনাটা আরেকটু কাছ থেকে দেখার চেষ্টা করি আগে
আজ যেন কেমন হালকা লাগছে নিজেকে, মনে হচ্ছে
খিদে তেষ্টা কিছু নেই, চিন্তাভাবনা শেষ হয়ে গেছে সব
পিঠের বোঝাটিও নেই আজ, কেবলই আরাম চারদিকে—
কুঞ্জবিহারী :
চ, দেখি—কী হচ্ছে সেখানে
আচ্ছা তোর বুকের ভেতর কোনো বেদনার রাশি
ভারী হয়ে উঠছে না এইসব জীবনের সবকিছু ফেলে যেতে?
চাপান :
আমার বুকের ভেতর আর কী হবে এখন—
ওই দ্যাখো বুক ধড় মাথা চারখানি পা লেজ সবকিছু
কেমন ছড়িয়ে পড়ে আছে, রক্তে রাঙা হয়ে আছে চারদিক
তবে অন্তরের কথা যদি বলো, সে-কথা আলাদা
আর আমার কেইবা আছে তুমি ছাড়া কোনোদিন
আমি তো এখনও তোমার সাথেই আছি রোজকার মতো
প্রিয়জন থেকে তাই বিচ্ছিন্ন হওয়ার ব্যথা বলে কিছু নেই
তবে তোমার বেদনার কথা বুঝতে পারছি আমি—
শৈশব থেকে দশটা বছর কাটালাম তোমার সংসারে
ওদের ছেড়ে যেতে তোমার যে কী বেদনা হতে পারে
আমি সেটুকু বুঝতে পারি, যদিও বা গাধা আমি
বোধবুদ্ধি কম, তবু হৃদয়ে বেদনা-বোধ আছে
দ্যাখো, আরও বহু কিছু ঘটে যাবে, কিন্তু আমাদের হাতে
শুধু দেখে চলা ছাড়া আর কী-ই বা করার আছে এখন‌
মৃত্যুর গভীর শান্তির ভেতর কী এক তীব্র অসহায়তা আছে
কী বলবো তোমাকে।
প্রভু, এই গাধার জীবনে এতসব কিছুই বুঝিনি আগে
আজ হঠাৎ মনে হচ্ছে যেন এক মৃত্যুত্তীর্ণ বোধের জানালা
খুলে গেছে আমার চোখের সামনে, বহু কিছু দেখতে পাচ্ছি
বহু কিছু বুঝতে পারছি, যেন আমি সব জানি
যেন আমি কবেকার ফড়িং ও প্রজাপতি, ছাগল, কুকুর
যেন আমি বাঘ, টিকটিকি, বাঁদর, মানুষ, গাধা
হতভাগ্য কেন্নো, পেঁপে গাছ, তাল ও সজনে গাছ সব
বহুদিন আগে থেকে বহুদিন ধরে বেঁচে আছি
ওই দ্যাখো, তোমার কুকুর ভোলা, নাবালক বড়ো
আমাদের মৃতদেহ ঘিরে থাকা ভিড়ের চারদিকে
ইতঃস্তত ছোটাছুটি করছে কেমন, কষ্ট পেয়েছে খুব
বড়ো উদ্ভ্রান্ত হয়ে পড়েছে বেচারি, কী ভাবছে কী জানি
যদিও আমার অনেক ইচ্ছায় ও প্রেমে বাধা দিত রোজ
তবু ওর জন্য মন খারাপ হচ্ছে আমার যেন আজ খুব
অন্তত বছর চারেক তো একসাথে থাকলাম
আর সেই কিশোরী গাধাটির কথাও মনে পড়ছে আজ
যার সাথে মাঝে মাঝে দেখা হতো কখনও বা কাছাকাছি
কখনও বা দুইজন রাস্তার দু-পাশে, কেবল চোখের দেখা
আমি তো মিলিত হয়েছি তার সাথে তোমাদের সামনেই
আজ যেন সে-কথা বলতেও কিছুটা লজ্জাই হচ্ছে আমার
লজ্জা কথাটা এতদিন মানুষের মুখে শুনেছি অনেকবার
আজ এইসব কথা বলতে গিয়ে প্রথম বুঝলাম
থাক সে বিরহ বেদনার কথা, তুমি কিছু তো বলো প্রভু
মরে গিয়ে একেবারে থম মেরে গেলে
আমি তো কুকুর নই না হলে তোমাকে অবশ্যই
বৈকুণ্ঠের পথ দেখাতাম, কিন্তু আমি গাধা, আমি অপারগ
কুঞ্জবিহারী :
আর গাধা গাধা করিস না তো, ভালো লাগছে না
তুই আর গাধা নোস, তুই এক জীবন্মুক্ত আত্মা আজ
দ্যাখ, আমিও আর মানুষ কিংবা ধোপা নই
বিচ্ছেদ বেদনার চেয়েও বড়ো বেদনার কথা তোকে বলি
অনেক সাধনার ফলে পেয়েছি মানব জনম একবার
তবু নিকৃষ্ট ধোপা হয়ে কাটালাম এ জীবন সব কিছু ভুলে
বহুদিনের সব চেষ্টা বৃথা গেল, মানব জনম আর তো পাবো না
আজ বুঝলাম শাস্ত্রে কেন বলে—ধোপা গাধারও অধম
চাপান :
বুঝতে পারছি প্রভু তুমি কেন ভেঙে পড়ছ এত
মৃত্যুর পর আজ যে কথা তোমার মনে পড়ল হঠাৎ
জীবনে কেন তা ভুলে ছিলে তুমি
কেন এ অমূল্য মানবজীবন বৃথা যেতে দিলে
আমি হয়তো তোমাকে পেতাম না কাছে এইভাবে
তবু তুমি তো উতরে যেতে, আমার যা হবার তা হতো
কুঞ্জবিহারী :
তবে শোন, আসলে আমি ধোপা নই
কিংবা তুইও গাধা নোস, ছিলামও না চিরকাল
শুধু একটি জীবনের জন্য হয়েছি এসব আমরা
প্রাণী যতদিন জীবিত থাকে ততদিন তার সমস্ত চেতনা
সীমাবদ্ধ থাকে মস্তিষ্কের রসায়নে
তাই তার জীবনের অভিজ্ঞতা বলতে শুধু একটি জীবন
কিন্তু মৃত্যুর পর মস্তিষ্ক থাকে না বলে
জন্মজন্মান্তরের স্মৃতি চেতনার সাথে জুড়ে যায়
তার অভিজ্ঞতাও তখন সমুদ্রের মতো মনে হয়
এই ভাসমানতাকে সামলানো দায় হয়ে পড়ে
সীমাবদ্ধ জীবনের অভ্যাস মোছেনি তখনও
নিজেকে যেমন তোর অত কিছু মনে হচ্ছে
ছাগল, পায়রা, বাঘ, টিকটিকি, পেঁপে গাছ
এইসব তোর জন্মজন্মান্তরের সুদীর্ঘ পরিক্রমার স্মৃতি
পুনর্জন্ম হলে আমরা আবার সব কিছু ভুলে যাবো
ভুলে গিয়ে মস্তিষ্কের দাস হয়ে জীবন কাটাতে হবে ফের
চাপান :
কিছুটা বুঝেছি প্রভু, তবে জানতাম না তুমি এত কিছু জানো
কোনোদিন শুনিনি তো এসব তোমার মুখে তাই
মনে হচ্ছে তুমি কোনো জন্মে মুনিঋষি ছিলে কিংবা অধ্যাপক
কী সহজে বোঝালে সবকিছু আমার মতন এক নির্বোধ…
কুঞ্জবিহারী :
তুই থাম দেখি, বৃক্ষের থেকে ফল তুলে আনলেও
যেভাবে ফলের গায়ে বৃক্ষের পাতার দাগ থেকে যায়
তোর চেতনার ওপর সেইভাবে মস্তিষ্কের ছাপ রয়ে গেছে
তাই তুই বুঝতে পারছিস না এখনও নিজের প্রকত স্বরূপ
এসব অবশ্য আস্তে আস্তে কেটে যাবে, এসব বলার জন্য
কোনো মুনিঋষি কিংবা অধ্যাপক প্রয়োজন নেই
মফস্‌সলের কোনো মুখুটি পাড়ার এঁদো কবি বলে দেবে সবকিছু
আর ওই প্রভু প্রভু ছাড়, ওসব সম্বোধন কবেই তামাদি হয়ে গেছে
দাদা কিংবা ভাই বলে ডাক দেখি আজ, তোর দাদা ডাক শুনে
এই মৃত্যু আর শোকগাথার ভেতরেও কিছুটা জীবনমুখী হওয়া যাক
চাপান :
কী বলছো প্রভু, সরি দাদা, জীবনমুখী ভূত আমরা তাহলে
তোমার কথা শুনে হাসিও পাচ্ছে দাদা, কিছু মনে কোরো না যেন
কুঞ্জবিহারী :
ভূত নয়—আত্মা, আত্মা
আমরা জীবন্মুক্ত আত্মা বলতে পারিস, অন্য কোটির জীব
আবার কখন যে নতুন শরীরের ভেতর প্রবেশ করবো
কেউ বলতে পারবে না, এমনকি আমরাও না
তবে ওই ওরা বলবে ভূত—আমরা বলবো আত্মা নিজেদের
এই আবহমান দ্বন্দ্ব আছে ও থাকবে চিরকাল
ওরা হাসে, যেভাবে মূর্খ গোবর হাসে ঘুঁটে পুড়ে গেলে
চাপান :
সে যাই বলো তুমি দাদা, আত্মা ফাত্মা
আমরা তো ভূত ছাড়া কিছু নই এই মুহূর্তে
যখন শরীরে ঢুকবো তখনকার কথা আলাদা অবশ্য
তবু তর্ক থাক, চলো ওই নিমগাছটার নীচু ডালে গিয়ে বসি
ওইখান থেকে ঘটনাটা খুব ভালো করে দেখা যাবে
দ্যাখো, চারদিক পুলিশে ছয়লাপ, এসডিপিওর গাড়ি
কিছু দূরে কথা হচ্ছে, অবরোধ উঠে যাবে
উঠে যাক, আমরাও তাই চাই, ভিড় সরে যাক
মৃতদেহগুলি চলে যাক যথাস্থানে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হোক
ওই দ্যাখো রক্ত ধারা মিশে গেছে তোমার আমার
কুঞ্জবিহারী :
আঃ, তুই তো জানিস, রক্ত দেখলে
মাথা ঘোরে, মূর্ছা যাই আমি, ওসব দেখতে পারি না
অবশ্য এখন আর সে সব হবে না বলেই মনে হচ্ছে
তবু সাবধান হওয়াই ভালো আগে থেকে
এত রক্ত আমি আর দেখতে পারছি না—
দ্যাখ, ডেডবডি তুলে নিল পৌরসভার গাড়ি
এরপর মর্গে নিয়ে যাবে, সেখানে পোস্টমর্টেম
বাড়িতে খবর পেয়ে বউ ছেলেমেয়ে সব এসে পৌঁছেছে
দ্যাখ, তোর বডি নিয়ে যাচ্ছে ভাগাড়ের দিকে—
তারপর হয়তো কাল সকাল সকাল আমার বডিও
হাসপাতাল থেকে শ্মশানের দিকে নিয়ে যাবে
সাথে যাবে শ্মশানযাত্রীরা, গেয়ে উঠবে হরিনাম
তারপর মুখাগ্নি টুখাগ্নি শেষ হলে মুছে যাবে
শেষ চিহ্নটুকু চিতার আগুনে, তুই পাশে থাক আজ
তুইই হয়তো এ জীবনে মরণে আমার প্রকৃত বন্ধু ছিলি
আয় তোকে শেষবার বুকে ধরে রাখি কিছুক্ষণ
কী হলো আবার তোর, ভেঙে পড়লি কেন অকস্মাৎ?
চাপান :
কী আর বলবো দাদা, তোমরা ভাগ্যবান
আমাকে তো যেতে হবে অন্ধকারে একা পথ চিনে
বৈতরণী পার হতে হবে নীরবে একাকী, বন্ধুহীন
কোনো হরিধ্বনি নেই, ভাগাড়-যাত্রীও নেই সাথে
বিদায় জানাবার জন্য আমার দেহের পাশে
নিশি জেগে আছে কতিপয় পচা মাংস-লোভী শিয়াল শকুন
শবগন্ধে পথচারী নাকে রুমাল চাপা দিয়ে
হেঁটে যাবে দ্রুত পায়ে, ভেঙে পড়বো না বলো?
কুঞ্জবিহারী :
কষ্ট পাস না তুই, জানিস তো
শ্মশান ও ভাগাড় পাশাপাশি চিরকাল আছে
যেভাবে ধোপার পাশে গাধা থাকে অনায়াসে
আমরা তো একসাথে যাবো, ভাগাড় থেকেও হরিধ্বনি
শোনা যাবে দেখে নিস, সংজ্ঞাহীন অসাড় শরীরে
তোর মনে হবে চারদিকে ঘিরে আছে ভাগাড়-যাত্রীরা
তীব্র হতাশার চেয়ে এই ভ্রমটুকুওতো ভালো
ভয় নেই, আমি তোর পাশেই থাকবো চিরকাল


[এমন সময় ওই অশ্বত্থ গাছেরই একটি উঁচু ডালে কা-কা শব্দে মহাকাক মেঘরথ ডেকে ওঠে। তার ডাক এতই স্পষ্ট ছিল যে, তাদের মনে হয় তাদের কানের পাশে কাকটা ডেকে উঠল, তাদের চমকে দিয়ে। মেঘরথ অযাচিত ভাবে তাদের কথাবার্তার মধ্যেও প্রবেশ করে।]


মেঘরথ :
ও তোমরাই তাহলে দুই নবাগত, বেশ বেশ
কুঞ্জবিহারী :
আমাদেরকে তো কেউ দেখতে পাচ্ছে না
আমাদের কথাও শুনতে পাচ্ছে না
পাবার কথাও নয় সম্ভবত, তাহলে তুমি…?
মেঘরথ :
হ্যাঁ আমি, ভূশণ্ডি বংশোদ্ভুত মেঘরথ নাম
মেঘবর্ণ পালকে ঢাকা শরীর আমার
মেঘের ভেতর দিয়ে যাই আসি নিজের ইচ্ছায়
একমাত্র আমিই আত্মাদের দেখা পাই, কথাও শুনতে পাই
সকল পিণ্ডের ভাত আমার নামেই বরাদ্দ হয়ে থাকে
কুঞ্জবিহারী :
তোমাকে দেখলেই তো বুক কেঁপে ওঠে
তোমার ওই সুতীক্ষ্ণ চঞ্চু দেখে বড়ো ভয় হয়, প্রভু
তাছাড়া তোমার ওই ধাতব কণ্ঠস্বর, কী কঠিন
চাপান :
আমার তো পিণ্ড বলে কিছু নাই কে আর পিণ্ড দেবে
তবে তুমি তুষ্ট হবে কীসে, বলো প্রভু যদি কিছু করা যায় দেখি
বলো, কেন যে বুকের ভেতরে এমন শূন্য মনে হলো
তোমাকে দেখেই কেন অন্ধ মনে হলো নিজেকে আমার
মেঘরথ :
পিণ্ড নেই তো কী হয়েছে, হৃৎপিণ্ড তো আছে
পাঁজরার ভেতর সযত্নে রাখা, আর অক্ষিকোটরে দুটি চোখ
স্তব্ধ হয়ে গেছে বহুক্ষণ, এতক্ষণে পচন ধরেছে
যত বেশি পচে উঠবে ততই সুস্বাদু হবে জেনো
ভয় নয় ভয় নয় আসলে বৈরাগ্যের দৃপ্ত রূপ আমি
আমার ভয়াল রূপ দেখে জীবকূল মোহমুক্ত হয়
দ্যাখো তোমরাও ভুলে গেছো সবকিছু যা কিছু অতীত
এতক্ষণ একসাথে আছো বলে তোমাদের মনে হচ্ছে
কিন্তু আসলে ওই সবকিছু তোমাদের ভ্রম
সে মোহও তোমাদের কেটে যাবে আর দু-দণ্ড যেতে না যেতে
তোমরাও একসাথে থাকবে না আর বেশিক্ষণ
দ্যাখো নেমে আসছে কালসন্ধ্যা পশ্চিম আকাশে
চাপান :
দাদা, তুমি কোথায়, কোনদিকে গেলে ?
তোমার কথা তো আর শুনতে পাচ্ছি না
তুমি কি শুনছো এখনও আমার কথা ?
কুঞ্জবিহারী :
চাপান, তুই কোথায় রয়েছিস এখন
তোকে কি আমি মৃত্যুর পর কাছে পেয়েছিলাম কখনও
তোর কথা কি আমি কখনও শুনতে পেয়েছি
মনে হচ্ছে সব মিথ্যা সব মিথ্যা
শুধু মৃত্যু ভয় কাটানোর জন্য তোকে সঙ্গী ভেবেছি
আসলে তুই নেই, ছিলিও না এতক্ষণ সাথে
তোর ভাষা বুঝিনি কখনও, আমি একা, একাই রয়েছি, হায়
মেঘরথ :
কা-কা-কা—

[মেঘরথ উড়ে যায়, ভাদ্র-গোধূলির গাঢ় অন্ধকারের ভেতর।]