তত্ত্বের দিক হইতে শিবশুভ্র জ্ঞানমাত্রতনু, গৌরী প্রকাশাত্মিকা। এই জ্ঞান ও প্রকাশ একই অদ্বয় সত্যের দুই অর্ধ; অর্ধনারীশ্বর পরম অদ্বয়-তত্ত্বেরই বিগ্রহ। কালিদাস এই পার্বতী-পরমেশ্বরকে বাক্য ও অর্থের ন্যায় নিত্য-সম্বন্ধযুক্ত (বাগার্থাবিব সম্পৃক্তৌ) বলিয়াছেন। তন্ত্র-সাধনার দিক হইতে প্রত্যেক জীবদেহই একটি অর্ধনারীশ্বর মূর্তি; দেহের বামার্ধ হইল শক্তিতত্ত্ব বা নারীতত্ত্ব; দক্ষিণার্ধ হইল পুরুষতত্ত্ব; প্রত্যেক পুরুষ তাহার বামার্ধে নারী, দক্ষিণার্ধে পুরুষ; প্রত্যেক নারীও তাহার বামার্ধে নারী ও দক্ষিণার্ধে পুরুষ। নারী কখনও বিশুদ্ধা নারী নয়, নারীতত্ত্ব প্রাধান্যের জন্যই সে নারী; পুরুষ তেমনই বিশুদ্ধ পুরুষ নয়, পুরুষতত্ত্ব প্রাধান্যের দ্বারাই তার পুরুষত্ব। এই নারী পুরুষের যুগলতত্ত্বও হইল বাম-দক্ষিণে মিলিত অর্ধনারীশ্বর-তত্ত্ব।

[শশীভূষণ দাশগুপ্তের লেখা থেকে।]

মানতে না চাইলেও এটাই সত্যি যে, অবচেতনে আমরা কঠোর এবং কোমলকে একসাথে পেতে ভালোবাসি। আমরাও তো আদতে তাইই। কঠোরে কোমলে দুলে দুলে জীবন সাজাই। কঠিন কাঠামোর আড়ালে রাখা কোমল অন্তর বয়ে বয়ে শামুকের মতো বাঁচি। ‘বজ্রাদপি কঠোর আর তৃণাদপি কোমল’ কথাটা মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ মানসিক অবস্থানকেই চিহ্নিত করে আসছে যুগ যুগ ধরে।

বছর পাঁচেক আগে ‘অশ্বমেধ’ পত্রিকায় ‘অর্ধনারীশ্বর—এক পিতৃতান্ত্রিক আরোপ’ শিরোনামে একটা লেখা লিখি। নারীকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক বানিয়ে পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোকে মজবুত করার ‘আবহমান’ যে প্রচেষ্টা ধরা পড়ে পুরাণকারদের লেখায়, তাকেই আতসের নীচে রেখে দেখতে চেয়েছিলাম সে লেখায়, নারীতত্ত্বর বিপ্লবীয়ানায় পুরুষকে অবজ্ঞা নয় বরং বুঝতে চেয়েছি, সমাজে নারী-পুরুষের সমঝোতাকে, সমঝোতার ফাঁকফোকর দিয়ে শিকড় চাড়ানো আধিপত্য আর বিদ্রোহকে। আমার চেতনা-প্রাঙ্গণে পরমব্রহ্ম ঈশ্বরী হয়েছেন। প্রাণের উদ্ভব ও সর্বাঙ্গীণ বিকাশে নারীত্বের অবদান, পেছনে ফেলে রেখেছে পুরুষত্বের মিথ্যে গরিমাকে। শুধু পুরুষ হবার জন্য কোনও গর্ববোধ আমার জাগেনি কোনওদিন। সেটুকুই বলার অভিপ্রায় ছিল সে লেখায়।

‘অর্ধনারীশ্বর—এক পিতৃতান্ত্রিক আরোপ’ শীর্ষক লেখার প্রায় শেষে, শশীভূষণের ‘সংস্কৃত সাহিত্যে হরপার্বতীর প্রেম’ নামক লেখাটির যে অংশবিশেষ প্রয়োজনীয় বলে মনে হয়েছিল, এ লেখা শুরু করলাম ঠিক সে-ই অংশটি দিয়ে; কেননা সে লেখায় বলেছিলাম, গৌরীপট্টে সংযুক্ত শিবলিঙ্গ দেখে আমার মনে প্রশ্ন জাগে—লিঙ্গ যোনিতে প্রবিষ্ট না যোনিমুখ থেকে বাইরে প্রকাশমান?—বলেছিলাম, পরবর্তী সময়ে এ নিয়ে কথা বলা যাবে। আজ সে পরিসর পাওয়া গেছে। এই বিতর্কিত লিঙ্গটা শিবের প্রতিভূ হিসেবে পুজো পেয়েছে, পাচ্ছে ও পাবে। কিন্তু এর উৎপত্তির কাহিনি কী?

স্ত্রী সংসর্গে মত্ত হয়ে মহাদেব আমাকে অবজ্ঞা করছে। অতএব তাদের উভয়ের শরীর লিঙ্গ ও যোনিরূপ হবে। আমি ব্রাহ্মণ, শিব পাপাচ্ছন্ন হয়ে আমাকে জানতে পারল না। অতএব সে অব্রাহ্মণ হয়ে দ্বিজদের অপূজ্য হবে। আর যারা শিবভক্ত হয়ে অস্থিভস্ম, লিঙ্গমূর্তি ধারণ করবে তারা পাষণ্ড হয়ে বৈদিক ধর্ম হতে বহিষ্কৃত হবে।

পদ্মপুরাণে ভৃগু বহু অপেক্ষার পরে দেখা না পেয়ে, সম্ভোগে ব্যস্ত শিবকে অভিশাপ দিলেন। একটা কাহিনি তো খাড়া করা গেল। এমন বহু কাহিনি রকমফের হয়ে ছড়িয়ে আছে পুরাণে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ও যথাযথ একটা রূপ ফুটে ওঠে একটিই গল্পে। সেটাও আবার কয়েকটি পুরাণে ভিন্ন ভাবে আছে। গল্পের ছকটা মিলিয়ে মিশিয়ে এইরকম,—ঋষিদের সাধনায় মন বসছে কিনা দেখবার জন্য রূপ বদল কোরে শিব তাদের আশ্রমে আসেন বিবস্ত্র হয়ে। ঋষিদের হাতে ধরা পড়ার আগেই ধরা পড়ে যান ঋষি-পত্নীদের কাছে। রাস জমে ওঠে। ক্রুদ্ধ ঋষিদের অভিশাপে শিবের পুরুষাঙ্গ খসে পড়ে। রাস তো শেষ হলো, কিন্তু রেশ চলল বহুদিন। সে-ই কর্তিত লিঙ্গটা মালিকের জমা ক্রোধের আগুনে পুড়িয়ে ফেলছে—স্বর্গ-মর্ত-পাতাল। গৌরীর কাছে দেবতাদের অনুনয়—আপনি পারেন। আপনিই গ্রহণ করুন।—গ্রহণ করলেন গৌরী। পৃথিবী শান্ত হলো। গৌরীপট্টে বিদ্ধ শিবলিঙ্গ পূজিত হতে লাগল। মর্ত্যভূমে মন্দিরগুলো পরিচিত হতে লাগল শিবের নামে। অথচ জগতকে বাঁচালেন যিনি, তিনি পড়ে রইলেন নীচে। বলা বাহুল্য পাগল স্বামীটাকে ছেড়ে যাবেন কোথায়? মানুষের সমাজ, প্রতিষ্ঠিত পুরুষের বা নারীর ‘ব্যাকবোন’ হিসাবে এভাবেই তো জেনেছে, দাম্পত্যের অর্ধাঙ্গকে। অন্তরালে বাদ-বিসংবাদ যাই থাক।

মানুষ মেনে নিল, যোনিতে বিদ্ধ লিঙ্গের দেব-অস্তিত্বকে। গৌরীপট্ট সাবেকি রূপে থাকলেও লিঙ্গটা ভাস্করেরা বৈচিত্র্যে ভরিয়ে দিয়েছেন। তারও আগে সিন্ধু সভ্যতার দিনে এমন কিছু পাই। মধ্যভাগে ছিদ্রযুক্ত চ্যাপ্টা পাথরের চাকতি ও খাড়া করা লম্বা পাথরের খণ্ড প্রচুর পাওয়া গেছে। এগুলো সবই যে, আদি পিতা-মাতার যৌনাঙ্গ হিসেবে পূজিত হতো তা পরিষ্কার। ভারতের প্রাচীন সভ্যতা ধ্বংসকারী আর্যরা তাই তাদের শিশ্ন উপাসক বলে পরিহাস করত। তাদের তামসিক কাব্য চেতনা, সৃষ্টিতত্ত্বর এই অমোঘ রূপকে বুঝে উঠতেই পারেনি।

বুঝে উঠতে পারেননি বিবেকানন্দও। তাঁর পথ-প্রদর্শক রামকৃষ্ণ গৌরীপট্টে সংযুক্ত শিবলিঙ্গ নিয়ে বলেছিলেন, “…শিবপূজার ভাব কি জান? শিবলিঙ্গের পূজা, মাতৃস্থানের ও পিতৃস্থানের পূজা। ভক্ত এই ব’লে পূজা করে, ঠাকুর দেখো যেন আর জন্ম না হয়। শোনিত-শুক্রের মধ্য দিয়া মাতৃস্থান দিয়া আর যেন আসতে না হয়।” দেশজ মানুষদের শিশ্ন-পূজক বলে হ্যাটা দেওয়া আর্যদের, অথর্ব বেদের যূপকাষ্ঠের ছবিটাই বিবেকানন্দের মনে ধরল, লিঙ্গের প্রতিভূ হিসাবে।

কোনও ভুলের ময়নাতদন্ত করতে আমি বসিনি। আমার লক্ষ্য গৌরীর যোনিতে প্রবিষ্ট শিবলিঙ্গের অবস্থান নিয়ে। আমার আশ্চর্য লাগে এই ভেবে, যে, তার গঠনতন্ত্র নিয়ে কোনও পুরাণবেত্তা প্রশ্ন করেননি অদ্যাবধি। কারোর মনে প্রশ্ন জাগেনি—লিঙ্গ যোনিতে প্রবিষ্ট না যোনিমুখ থেকে বাইরে প্রকাশমান? কোথাও এমন কোনও ছবি বা বর্ণনা চোখে পড়েনি, যেখানে শিবলিঙ্গের উপরিভাগে গোড়া বোঝা যায়। সব মূর্তি ও ছবিতে উত্থিত লিঙ্গের অবস্থান। আমাদের অবস্থানটা তাহলে কোথায়? গৌরীর গর্ভে না বাইরে?


২.

The sex of an early embryo cannot be determined because the reproductive structures do not differentiate until the seventh week. Prior to this, the child is considered bipotential because it cannot be identified as male or female.

[https://en.wikipedia.org/wiki/Sexual_differentiation_in_humans]

সাত সপ্তাহের আগে ডিম্বাণু আর শুক্রাণুর সংযুক্ত অস্তিত্বের কোনও লিঙ্গ-পরিচয় থাকে না। কোনও এক মহাবিশ্বের দ্বারপ্রান্তে অপেক্ষায় ছিল একটা ডিম্বাণু। আশ্রয়দায়িনী। স্বল্প সময়ের এই প্রতীক্ষা শুধু একটা শুক্রাণুর পথ চেয়ে। যে দীর্ঘ যাত্রাপথের শেষে, বিজয়ী হয়ে এসে তাকে নিষিক্ত করবে। শুরু হবে কোষ বিভাজন। এবার মহাশূন্যে ভাসতে ভাসতে বড় হওয়া। এভাবেই গর্ভাশয়ের দেয়ালে একদিন পিঠ ঠেকবে ওদের। এখনও কি ‘ওরা’ বলা ঠিক?

হ্যাঁ, ঠিক। কারণ একা হতে ওদের লাগবে আরও প্রায় পঞ্চাশ দিন। তখনও কি একা হবে? নাকি সারাজীবন এমনই থাকবে, মনের দেহের সঙ্গে দেহের মনের মিলন ঘটিয়ে। সে সবে পরে আসছি, এদিকে ভ্রূণের পিঠে ঠেকে যাওয়া দেওয়ালে শুরু হয়েছে মায়ের সঙ্গে যোগাযোগের পথ-নির্মাণ। বদলে যাচ্ছে আকার। এক কোমল আবরণের মধ্যে বিভাজিত কোষের দল আরও আরও বিভাজিত হচ্ছে। ভাঁজ আসছে ভ্রূণের কলেবরে। কারণ-সলিলে ভাসছে একটা খোঁটায় বাঁধা মাংসপিণ্ড।

এর পরে শুরু হবে তার লিঙ্গের নির্দিষ্টকরণ প্রক্রিয়া। বিজ্ঞান জানিয়েছে, কোষের ভেতরে দুটো এক্স ক্রোমোজোম থাকলে নারী হবে আর একটা এক্স ও একটা ওয়াই থাকলে হবে পুরুষ। কিন্তু এত সরল তো নয় খেলাটা। জিন আর হরমোনের মেলামেশার জটিল কাহিনি এখানে দীর্ঘস্থায়ী ছাপ রেখে যায়। অণ্ডকোষ আর ডিম্বাশয় গঠিত হয় প্রাথমিক উপাদান থেকেই। তারপরে তাদের প্রয়োজনেই তারা গড়ে নেয় যোনি আর লিঙ্গ। এই নির্মাণযজ্ঞে ঘৃতাহুতির তারতম্যে মনের দেহের সঙ্গে দেহের মনের সংঘাত বাঁধে। সে-ই সংঘাতের রেশ আমৃত্যু বয়ে চলে একজন মানুষ। সমাজ, পুরুষের সমাজ তাকে সহজ ভাবে নিতে পারেনি। ছেলেটা মেয়ে হতে চাইলে বা মেয়েটা ছেলে হতে চাইলে তাকে সামাজিক ভাবে বয়কট করেছে। কিন্তু লোভের চোখ রেখেছে তার গতিবিধির ওপর।

যে অবস্থায় সে নিজেকে পেয়েছে, সে-ই অবস্থাকে কেন সে যত্ন করে পূর্ণ করার অধিকার পাবে না? একজন নারী বা পুরুষের মতো কেন বাঁচতে পারবে না মাথা তুলে? কেন, মানুষ সমলিঙ্গের মানুষকে কামের আলিঙ্গনে বাঁধতে পারবে না? নিষেধের আড়ালে অনেক স্বাধীন হয়েছে মানুষ তার যৌনতায়। প্রান্তিকেরা ছড়িয়ে গেছে সমাজে। কিন্তু কোথাও যেন একটা সীমারেখা কেউ এঁকে গেছে, যা মোছা যাচ্ছে না। দৃষ্টি বদলালে মুছে যাবে সীমারেখা? সাহিত্য-সংস্কৃতি, জীবনযাপন আমাদের জানিয়েছে, শিক্ষার আলোয় অশিক্ষা দূর হয়তো হয় কিন্তু সহজাত সহবত পুথি শিক্ষার অধীন নয়। জীবনবোধ ব্যক্তিবিশেষে ভিন্ন। ধর্মাচরণও। উচ্চশিক্ষিতের তাই ‘নির্বিরোধী’ (বা আগ্রাসী) ধার্মিক হওয়ার পথে অন্তরায় হয় না, স্কুল-কলেজের বিজ্ঞান পাঠ। চেন্নাইবাসী এ. এম. পদ্মনাভন যেমন, পেশায় হস্তরেখাবিদ। তামিলনাড়ু পুলিশ বিভাগে কর্মরত ছিলেন ৩৭ বছর। হস্তরেখা পাঠের বিদ্যায় তিনি মানুষের হাতের রেখায় খুঁজে পেয়েছেন মানুষ পূজিত দেবদেবীকেও (Finger Print The Universal Religion of God, 2008):

সমাজে সীমারেখা, গণ্ডি টেনে দেবার এক অনন্ত ইতিহাস আছে। মানবসভ্যতার শুরু থেকেই চলছে এই সীমারেখা আঁকা আর মোছার খেলা। আজকেও চলছে। গণ্ডি কাটায় ওস্তাদ পুরুষের দল ফুলের হাটের গোলাপ হয়ে রেঙে রয়েছে। ধর্ম-বর্ণ-অর্থ-কর্ম নিরপেক্ষ এ এক স্বৈরাচারী অবস্থান। এরাই চালাচ্ছে পৃথিবী নামের এই জরাজীর্ণ রাতের রেলগাড়িটা। তাদের আত্মপরিচয়ের আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে লোহার চাকায়।

ঈশ্বর পুরুষ, তাই তাঁর অর্ধেক নারী বলে, মূর্তির নাম হয় অর্ধনারীশ্বর। গৌরীপট্টে সংযুক্ত শিব, তবু মন্দির হয় শিবের নামে। তাই কি শিবকে শব বানিয়ে তাঁর হৃদয়ে চরণ ফেলেছেন গৌরী? কালী-রূপে পূজিত হয়েছেন তিনি আমাদের? এখানে শিব শবাকারে কেন? মাঝে আছেন মহাকাল। সময় পেলে সে সব গুহ্যতত্ত্ব নিয়েও না হয় কিছু কথা, ভাবনার, লেখা যাবে। একই সঙ্গে কঠোর কোমলে মেশা ধ্যানমূর্তিতে যে ছবি আঁকা আছে, তার একটা বাল-সংস্করণ আমরা ঘরে-মন্দিরে-প্যান্ডেলে দেখি। যাই হোক, ভয় ভক্তিতে মানুষের মাতৃপূজা ভাবের ঘরেই সীমিত থাকে। স্বভাবের বারান্দায় তার আর আসা হয় না। ঘুনধরা সময়ের পথে মা’কে লাঞ্ছিত হতে হয় আত্মজের হাতে। অসহায়ত্ব মাপার যন্ত্র থাকলে বোঝা যেত, রাতের শেষ ট্রেন না-ধরতে পারা স্টেশনে, একা একজন নারী বা একজন পুরুষের অসহায়ত্বের ফারাকটা।

এই যে দুটো মন দু-ধরনের আশঙ্কায় থাকে, সেটা কী মানসিক গঠন? না কী পরিবেশের ভয়াবহতা? মানসিক বিন্যাসে নারী-পুরুষের মিল অমিল নিয়েই তারা বিকশিত। আনন্দ, বেদনা বা ভয় পাওয়া নিয়ে দুজনেরই প্রায় এক অভিব্যক্তি দেখা যায়। তা হলে গভীর রাতে নির্জন স্টেশনে, কেন একজনকে অনেক বেশি ভয় পেতে হবে আরেকজনের থেকে? বাড়ির মধ্যে, বা পাড়ায়, বা কোনও অনুষ্ঠানে তো এমন মনে হয় না—আপাতদৃষ্টিতে! এখানেই সমাজের কথা আসে। সঙ্গে আসে সমাজপতিরা। ক্ষুদ্র বা বৃহৎ গোষ্ঠীরা সবাই বেনের টাকায় চলে। এদেশে ওদেশে এক খেলা।

পুরোহিতের বাড়ি বলে একঘর ঠাকুর আমি জন্ম থেকেই দেখছি। উপনয়নের পর পুজোর আসনে বসার অধিকার পেলাম। ছুটির দিন গৃহদেবতার কাছে আমার হাজিরার কথা। শালগ্রাম শিলা, গোপাল আর শিবলিঙ্গদের স্নান করাতে হতো। সে সময় গৌরীপট্ট সমেত পাথরের শিবলিঙ্গকে ভালো করে দেখি। দেখি বটে, কিন্তু কিছুই বুঝি না তখন। লিঙ্গ শব্দের তাৎপর্য বুঝতে সময় লাগল। অবাক লাগত ভেবে, অত সৌম্য ধ্যানগম্ভীর মূর্তি থাকতেও এ আকৃতিতে কেন শিবের অবস্থান? তারপর যখন জানলাম গৌরীপট্টের মানে, আরও বেশি অবাক হলাম। বসুমতী সাহিত্য মন্দির প্রকাশিত ‘মহানির্বাণ তন্ত্র’-এর শেষে, শিবের লিঙ্গ খসে পড়া এবং গৌরীর তা যোনিতে ধারণের গল্পটা পাই। ছবিটা পরিষ্কার হয়েও হলো না। মনে ধন্ধটা রয়েই গেল। যদি তা যোনিতে প্রোথিত হয়, তাহলে লিঙ্গমুণ্ড উপরিভাগে কেন? উপরে তো লিঙ্গমূল থাকার কথা!


৩.

দেবগণ সেই মহেশ্বরের লিঙ্গ ব্যতিরেকে আর কাহারও লিঙ্গ পূজা করেন নাই ও করিতেছেন না। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, আপনি ও অন্যান্য দেবগণ আপনারা সকলেই সেই দেবাদিদেবের লিঙ্গ পূজা করিয়া থাকেন, সুতরাং তিনিই সকল দেবতার অগ্রগণ্য। ব্রহ্মার চিহ্ন পদ্ম, বিষ্ণুর চিহ্ন চক্র ও আপনার চিহ্ন বজ্র বিদ্যমান রহিয়াছে। কিন্তু প্রজারা আপনাদিগের কাহারই চিহ্নে চিহ্নিত নহে। তাহারা হরপার্বতীর চিহ্নানুসারে লিঙ্গ ও যোনি চিহ্ন ধারণ করিয়াছে। সুতরাং উহারা যে শিব ও শিবা হইতে উদ্ভূত, তাহার আর সন্দেহ নাই। স্ত্রীজাতি পার্বতীর অংশে সম্ভূত হইয়াছে বলিয়া যোনিচিহ্নে চিহ্নিত আর পুরুষেরা মহাদেবের অংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছে বলিয়া লিঙ্গ চিহ্নিত হইয়াছে; যাহারা উহাদের উভয়ের চিহ্নেই চিহ্নিত তাহারা ক্লীবপদবাচ্য হইয়া জনসমাজ হইতে বহিষ্কৃত হয় এই জীবলোকে পুংলিঙ্গধারীরে শিবের ও স্ত্রীলিঙ্গধারীরে পার্বতীর অংশ বলিয়া অবগত হইবে। এই চরাচর বিশ্ব হরপার্বতী দ্বারাই ব্যাপ্ত রহিয়াছে।

[মহাভারতের অনুশাসন পর্বে শিবলিঙ্গ সম্বন্ধে যা বলা হয়েছে,
https://www.shongshoy.com/archives/9821]

শিবের গুরুত্বের দিকটা চিরকালই আছে। পিতার চরিত্রে তাঁকে বেশ মানায়। ব্রহ্মাকে দাদু আর বিষ্ণুকে দাদা ছাড়া ভাবতে পারি না। সে-ই আদি পিতা আর আদি মাতার মিলনে পৌরাণিক ভাবে কোনও সন্তান আসেনি। এসেছে মানুষের ইচ্ছের খেয়া বেয়ে। লক্ষ্মী-সরস্বতী-কার্তিক-গণেশ কেউ কারো নয়। তবু উৎপাদনের পুজোয় শিব গৌরীর যুগলমূর্তি তাঁরা। সারা দুনিয়ায় লিঙ্গ পূজা ছিল এবং আছে। সেখানে যোনির উপস্থিতি নেই। এখানেই এমন সম্পূর্ণ, সৃষ্টির যন্ত্র প্রতীকেরা। যেহেতু লিঙ্গের উত্থানশক্তি আছে তাই শব শিবের লিঙ্গও ঊর্ধ্বমুখী। মহেন-জো-দারোর সময় থেকে আজ অবধি তা উত্থিত হয়েই আছে। সেদিনের সমাজ জীবনে তা দৃষ্টিকটু ছিল না। আজও নেই।

কিন্তু আমার চোখে আগের মতোই তার অবস্থান এক ধাঁধা। বলা বাহুল্য পণ্ডিতেরা আমার এই প্রশ্নটাকে খারিজ করেছেন বাতুলতা ভেবে। অনেকেই ভেবেছেন, কিন্তু কিছু বলতে পারেননি। বাকিরা বুঝলেন না বা বুঝতে চাইলেন না। কিন্তু আমার পক্ষে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। এড়িয়ে গেলে, এ লেখার বাকিটুকুতে যা বলতে চাইছি, তার কেন্দ্রটিকে বা সুতোর জটের সে-ই প্রান্তটিকে অস্বীকার করতে হয়। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, বিষয়-বিজ্ঞ নবীন প্রবীণ অনেকের কাছেই প্রশ্নটা রেখে যখন হতাশ হতে হলো: তাহলে আমি বুঝিটা কী? এমনটাও তো হতে পারে, নির্মাতা বানাতে চেয়েছিলেন একটা ছিদ্রযুক্ত চ্যাপ্টা গোলাকৃতি পাথর আর একটা লম্বমান প্রস্তরদণ্ড। সিন্ধু সভ্যতায় পাওয়া এই লিঙ্গাকৃতি পাথরের অধিকাংশেরই উপরিভাগ লিঙ্গসদৃশ। পূজার সময় তার অবস্থান কেমন হতো সে তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে তা যে আজকের মতো আছে অনেকদিন ধরে—এটা বোঝা যায়।

দুনিয়াটা টেবিলে আসার পর, আন্তর্জালে কিছু ছবি দেখি। শরীর-বিজ্ঞান অনুযায়ী, যোনির উপরিভাগে মূত্রনালীর কাছাকাছি একটা ছোট গোলাকৃতি অংশ আছে, যাকে ভগাঙ্কুর বলে। তার আকারের তারতম্য হয় ক্ষেত্রবিশেষে। কিছু ক্ষেত্রে তা বেড়ে প্রায় লিঙ্গের আকার নিয়েছে। কোনও ক্ষেত্রে তা যোনিদ্বার ভেদ করে অনেকটা বাইরে বেরিয়ে এসেছে। তার সে-ই রূপ দেখে মনে পড়ে গৌরীপট্টের থেকে বেরিয়ে আসা শিবলিঙ্গকে। কিন্তু প্রত্যঙ্গের এই অস্বাভাবিক গঠন কোনওমতেই স্বাভাবিক মানুষের আদি পিতা-মাতার প্রতীক হতে পারে না। উর্বরতার উৎসকেন্দ্র হিসাবে চিহ্নিত হতে পারে না। তাহলে কি একটা ভুল মূর্তিকে মানুষ এতকাল অর্চনা করে চলেছে?

তাই বা কী করে হয়! সাধারণ মানুষ ছাড়াও অনেক জ্ঞানী মানুষেরা শিবের ভক্ত ছিলেন ও আছেন। তাঁদের চোখে এই ভুলটা ধরা পড়েনি কেন? রহস্যটা এখানেই! শক্তিনাথ ঝা তাঁর ‘অন্য এক রাধা’য় বলছেন—‘জগৎ যারে ধর্ম বলে আমি বলি অধর্ম/ জগৎ যারে সত্য বলে আমি বলি মিথ্যা,/ জগৎ যারে পিতা বলে, আমি বলি মাতা।’

ঈশ্বরের প্রতিকৃতি নির্মাণে ভাবুক সে-ই শিল্পী যতই কল্পনায় মজে থাকুক না কেন, কিছুটা কি তার দেখার বা জানার অভিজ্ঞতাপ্রসূত নয়? পৌরাণিক মিথ-কেন্দ্রিক চর্চায় সত্য সন্ধানে যেভাবে বিদেশীয়দের বিজ্ঞানকে অবলম্বন করে এগোতে দেখা যায়, এখানে সে-ই প্রয়াস ব্যক্তিবিশেষে কেউ কেউ নিয়েছেন। প্রতিষ্ঠানগত চর্চায় পুনেস্থিত ভান্ডারকর ইনস্টিটিউটের কথা আমরা জানি, জেনেছি, মহাভারতের কাহিনির সঙ্গে দেশে বিভিন্ন খননকার্যে প্রাপ্ত বস্তুর সময়ক্রম বা অন্যান্য পুথির সঙ্গে মিলিয়ে ইতিহাসকে দেখার পথ প্রশস্ত করেছেন তারা। কিন্তু পিতৃ-পিতামহ থেকে প্রাপ্ত পরম্পরাগত ধর্মবোধ, আচরণ, বিশ্বাসকে অস্বীকার করা সহজ নয়। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন:

পরশপাথর এবং আলাদিনের প্রদীপের প্রতি প্রকৃতিস্থ মানুষমাত্রেরই একটা নিগূঢ় আকর্ষণ আছে। ছেলেবেলায় কথামালার এক গল্প পড়িয়াছিলাম যে, কোনো কৃষক মরিবার সময় তাহার পুত্রকে বলিয়া গিয়াছিল যে, অমুক ক্ষেত্রে তোমার জন্য আমি গুপ্তধন রাখিয়া গেলাম। সে বেচারা বিস্তর খুঁড়িয়া গুপ্তধন পাইল না, কিন্তু প্রচুর খননের গুণে সে জমিতে এত শস্য জন্মিল যে তাহার আর অভাব রহিল না। বালকপ্রকৃতি বালকমাত্রেরই এ গল্পটি পড়িয়া কষ্ট বোধ হইয়া থাকে। চাষ করিয়া শস্য তো পৃথিবীশুদ্ধ সকল চাষাই পাইতেছে, কিন্তু গুপ্তধনটা গুপ্ত বলিয়াই পায় না; তাহা বিশ্বব্যাপী নিয়মের একটা ব্যভিচার, তাহা আকস্মিক, সেইজন্যই তাহা স্বভাবত মানুষের কাছে এত বেশি প্রার্থনীয়।

বিশ্বাসের রাজনৈতিকীকরণের জটিলতায় যাওয়ার উদ্দেশ্য এ লেখা নয়। রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণে অলৌকিক এমন অনেক কিছু আছে যার কোনও প্রয়োজনীয়তা ছিল না। অথচ সে-ই ঘটনাকে নিয়েই কাহিনি এগিয়েছে। সে সব ফিরিস্তি আগের কিছু লেখায় দিয়েছি। তাই সেদিকে যাওয়ার ইচ্ছে নেই। এ পর্যায়ে, মনের দেহ আর দেহের মনের দাম্পত্যের ধারাবিবরণী দেবার ইচ্ছেয় অলিগলিতে ঘুরছি—সে শুধু রাজপথটাকে চারপাশ সমেত চিনে নিতে।

দুটি ঘটনার উল্লেখ এখানে থাক। পুজোর খবর দিতে যজমান বাড়ি থেকে আসতেন একজন। প্রায় ষাটের কোটায় পা দেওয়া এক মানুষ। গোঁফদাড়ি কামানো। মাথার বড় চুল খোঁপা করে বাঁধা। গলায় তুলসীর মালা। একটা পাটের কাপড় কাছা দিয়ে পরে, সামনের অংশটা একটা পাক দিয়ে ওপরের শরীর ঢেকে রাখতেন। গলার স্বরে ও ভাবভঙ্গিমায় নারীসুলভ আচরণ। মা ঠাকুমার সঙ্গেই তাঁর যত কথা রান্নাঘরে বসে। নিজের এই আচরণের জন্য তাঁকে বিন্দুমাত্র অস্বস্তিতে পড়তে দেখিনি। দেখিনি, রাস্তায় লোকের পরিহাস হজম করে হাঁটার গতি বাড়াতে।

পাড়ায় কোনও বাড়িতে বাচ্চা হলে আসতেন ওঁরা। আমি ভিড়ের মধ্যে গিয়ে দাঁড়াতাম। অবাক হয়ে দেখতাম ওঁদের। বাচ্চাকে কোলে নিয়ে, যশোদার আনন্দ ওঁরা ছড়িয়ে দিতেন সরল ভাষার গানে। লাস্যে ভরা নাচগানের আসর শেষ হতো একসময়। একটু উচ্ছল হলেও স্থান-কাল-পাত্রের জ্ঞান পুরোমাত্রায় ছিল ওঁদের। আমাকে ওঁরা চিনতেন। আমায় দেখে বলতেন,—‘চলো ভাই। এয়েছি যখন মায়ের কাছে দেখা করে আসি।’ মা ওঁদের মিষ্টি দিত। ক’টা গামছাও দিত। পুজোর সময় দিতেন শাড়ি। ওঁদের সে-ই তৃপ্তিভরা মুখেও আমি কোনও কুণ্ঠার ছায়া দেখতে পাইনি। কিন্তু, হাসিঠাট্টার আড়ালে কিছু রাগক্ষোভ যে ছিল তা বোঝা যেত, কোনও কোনও কথায়। পরে বুঝেছি, সে-ই রাগ সমাজ—সমাজকর্তাদের প্রতি, যাঁরা তাঁদেরকে বুঝতে পারেনি। যাঁরা তাঁদের নিজেদের মনের মতো বাড়তে দেয়নি, পরিবারের ভিতর।

“স্ত্রীজাতি পার্বতীর অংশে সম্ভূত হইয়াছে বলিয়া যোনিচিহ্নে চিহ্নিত আর পুরুষেরা মহাদেবের অংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছে বলিয়া লিঙ্গচিহ্নিত হইয়াছে; যাহারা উহাদের উভয়ের চিহ্নেই চিহ্নিত তাহারা ক্লীবপদবাচ্য হইয়া জনসমাজ হইতে বহিষ্কৃত হয়…” মহাভারতের অনুশাসন পর্বে এক ত্রিমুখী লিঙ্গাঞ্চল নির্মাণ করা হয়েছে। স্ত্রীং আর পুং সেখানে উপস্থিত আর ক্লীব বহিষ্কৃত। অথচ শিখণ্ডীকে দরকার হয় জ্যেঠাকে হত্যা করানোর জন্য। অপ্সরা উর্বশীর অভিশাপে বৃহন্নলা হয়ে গিয়েছিল অর্জুন। বনবাস পর্বে কিন্তু পুরুষই ছিল আগাগোড়া। অথচ আত্মগোপন পর্বে অর্জুনকে সাজতে হয় বৃহন্নলা। কেন? ভাবী পুত্রবধূকে নাচগানের তালিম দিতে পুরুষ-শিক্ষক থাকাটা শোভন ছিল না বলে? নাকি এ অর্জুনের মনের দেহের নারী, যে দেহের মনের পুরুষ-কে বিরাট রাজার বাড়িতে আসার আগে, শমীবৃক্ষের উঁচু শাখায় বেঁধে রেখে এসেছে। সন্তান উৎপাদনে অক্ষম পুরুষদের ইতিহাসে যাঁরা নারী-পুরুষের দ্বৈত অবস্থান নিয়ে বাঁচবে তাঁদের প্রান্তিক হতেই হবে। শিক্ষার প্রাথমিক স্তরেই তো আমরা শিখে, জেনে গেছি, মানুষের খেয়েপরে বাঁচার জীবনে অপুষ্পক উদ্ভিদের প্রত্যক্ষ কোনও ভূমিকা নেই। কিন্তু, শিব-পার্বতীর নয়নাভিরাম যে অর্ধনারীশ্বর রূপ আমাদের মুগ্ধ করে, সে-ই হর-গৌরী যখন সংযুক্ত জননাঙ্গের আকারে আসেন, তখন আর মুগ্ধতা থাকে না। থাকে বিশ্বাস। আদি পিতা-মাতার অস্তিত্ব অনুভব করে তাকে স্পর্শ করি। মনের কথা, জাগতিক চাওয়াপাওয়ার কথা জানাই।


৪.

“Indra was pleased with the prostrate monarch and wanted to give him a boon. “Which of your sons should I revive, king – the ones born when you were a woman or those born when you were a man?”
The ascetic woman joined her palms and bowed her head and said to Indra, “Let the ones that were born when I was a woman live, Indra!”
Indra was surprised and pleased and he questioned the woman ascetic again. “Why are you not fond of the sons that were born to you when you were a man? Why are you more fond of those born to you when you were a woman? I am eager to hear the reason for this, you should tell me.”
The woman said, “A woman is capable of more affection than a man. That is why I asked for the sons born to me when I was a woman to be brought back to life, Indra!”
Bhishma said:
When she said that, Indra was pleased and said to her, “You speak the truth, dear lady! All your sons shall be restored to life! Choose another boon, best of kings, man of good vows. Ask for anything you wish! What do you want from me – to be a man or to be a woman?”
“So be it,” he said and went back to heaven.
And so it is, great king, that women experience more pleasure.

[‘The Mahabharata’, Anushasana Parva, translated by Arshia Sattar, ‘The Parrots of Desire: 3,000 Years of Indian Erotica’, edited by Amrita Narayanan]

শরশয্যায় প্রায়োপবেশনে ভীষ্ম নীতিশিক্ষা দিচ্ছেন। যুধিষ্ঠিরের প্রশ্ন ছিল, সঙ্গমে সর্বাপেক্ষা সুখানুভূতি কার হয়? পুরুষের না নারীর? চিরকুমার এক গল্প শুরু করলেন। রাজশ্রেষ্ঠ ভঙ্গাস্বন পুত্র কামনায় অগ্নিষ্ঠুত যজ্ঞ করেছিলেন—দেবরাজ ইন্দ্রকে উপেক্ষা করে। শতপুত্র লাভের পর একদিন মৃগয়ায় গিয়ে ইন্দ্রের চক্রান্তে পথ হারালেন। সরোবরের জলে স্নান করে তিনি নারী হলেন। গৃহে ফিরে সন্তানদের হাতে রাজ্যভার দিয়ে ফিরে গেলেন বনে। এক তপস্বীর আশ্রমে থেকে তার ঔরসে শতপুত্রের মা হলেন ভঙ্গাস্বন। রাজপ্রাসাদে ফিরে, পুরুষ-নারী দুই অবস্থার পুত্রদের মিলেমিশে রাজ্যভার নিতে বললেন। রাজা ভঙ্গাস্বনের পুত্রেরা একসঙ্গে ভালো আছে দেখে, বিভেদের বীজ ছড়িয়ে ইন্দ্র তাদের পৃথক করলেন। তারা নিজেরা মারামারি করে মরল। এই সময়ে দেখা তপস্বিনী, ভঙ্গাস্বনের সঙ্গে ইন্দ্রর। সব কিছু জানাজানি হলো। ক্ষমা চাইলেন ভঙ্গাস্বন। ইন্দ্র বর দিলেন, যে-কোনো একপক্ষের শতপুত্রকে তিনি জীবিত করে দেবেন। তপস্বিনী ভঙ্গাস্বন তার স্ত্রী-অবস্থার পুত্রদের চাইলেন। বিস্মিত ইন্দ্র কারণ জানতে চাইলে, তপস্বিনী বললেন, ‘নিজের গর্ভজাত সন্তানের উপরে স্ত্রীলোকের যে প্রকার স্নেহ হয়, পুরুষের সে প্রকার হয় না। অতএব দেবরাজ! আমার স্ত্রীত্বকালে যাহারা জন্মিয়াছিল, তাহারাই জীবিত হউক।’ এহেন উত্তরে সন্তুষ্ট ইন্দ্র তার দুশো পুত্রকেই বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, রাজা ভঙ্গাস্বন তার ইচ্ছেমতো স্ত্রী বা পুরুষ যা হতে চাইবেন—তাই করে দেবেন তিনি। রাজশ্রেষ্ঠ ভঙ্গাস্বন নারীই থাকতে চেয়েছিলেন। ইন্দ্র কারণ জানতে চাইলে, বলেছিলেন, “দেবরাজ, স্ত্রী ও পুরুষের সঙ্গমের সময়ে সর্বদাই পুরুষ অপেক্ষা স্ত্রীর অত্যন্ত অধিক সুখ হয়। এই কারণেই আমি স্ত্রীত্বই বরণ করিতেছি। দেবশ্রেষ্ঠ! ইহাও সত্য যে, পুরুষ অপেক্ষা স্ত্রী অধিক রমণ করিতে পারে। এই জন্যই আমি পুরুষত্ব অপেক্ষা স্ত্রীত্ব অবস্থায় অধিক সন্তুষ্ট আছি।”

রূপকের মোড়ক খুললে পাই নারীর প্রথম ও প্রধান পরিচয়কে। সে জন্মদাত্রী, সন্তানের সবচেয়ে মজবুত আশ্রয়। পিতার ভূমিকা গৃহ হলেও তা মাতৃভূমির ওপরে নির্মিত। অনুভবের যে পার্থক্য জানা কখনোই সম্ভব নয়, সর্বজ্ঞানী মৃত্যু-পথযাত্রীর কাছে তা জানতে চাওয়ার পৌরাণিক আবদার ও তার উত্তরের মধ্যে কিছু সত্য পেলাম।

পূর্বকালে ঘটা এক লিঙ্গ পরিবর্তনের কাহিনি ভীষ্ম শোনাচ্ছেন যুধিষ্ঠিরকে। প্রশ্নটা যতই হাস্যকর হোক, উত্তরে রূপান্তরকামী এক নারী-মনের দেখা পাই। যার অন্তরের নারীত্বে ছেয়ে আছে দেহের খাঁচা। ইন্দ্র তার উপকারই করেছেন। শরীরেও নারী করেছেন তাকে। গর্ভ দিয়েছেন সন্তান উৎপাদনের জন্য। কিন্তু সংঘবদ্ধ না হলে, পরিবারে যথেষ্ট সংবেদনশীল মানুষেরা না থাকলে, এই আধুনিক সময়েও, একজন পুরুষের দেহ নিয়ে নারী-মনের মানুষ সামান্য সামাজিক পরিচয়টাও পায় না—মহাভারতের দেশে।

সেদিনও কি পেত? ‘যাহারা উহাদের উভয়ের চিহ্নেই চিহ্নিত তাহারা ক্লীবপদবাচ্য হইয়া জনসমাজ হইতে বহিষ্কৃত হয়…’ মহাভারতের অনুশাসন পর্বেই তো এ কথা বলা আছে। সমাজ থেকে নপুংসকদের বহিষ্কারের প্রথা আরও প্রাচীন, তা বোঝা যায়। এদের প্রতি সমাজের এই ঘৃণা কেন? সমাজ বলতে আমি পুরুষের মুঠোয় থাকা ভূখণ্ডকেই বলছি। নারীর এখানে কোনও ভূমিকাই ছিল না। তার মমতা একজন নপুংসক বা রূপান্তরকামী সন্তানকে বাল্যাবধি ঘিরে রাখলেও, বাবার কঠিন অনুশাসন তাকে ত্যাজ্য করেছে।

মনের গুরুত্ব সমাজ কখনোই দেয়নি। সে তার বাবার খেরোখাতায় লেখা আপ্তবাক্য মেনে চলেছে। যে ভাবনাচিন্তা সমাজের পথকে সুগম করেছে, তা ভাবতে হয়েছে প্রান্তিক হয়ে গোপনে, অনেক অপমান সহ্য করে। হয়তো এটাই নিয়ম। সারা রাত হিমে ভিজে একটু একটু করে ফোটার দিকে এগিয়েছে ভোরের কুসুম। আজকে তাকালে অনেক মশাল চোখে পড়ে। যার আগুনে পুড়ছে পুরোনো বস্তাপচা আইন। উপেক্ষার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসছে স্বাধীন মানুষ। মনের দেহের সঙ্গে দেহের মনের মিলন ঘটাতে সাংবিধানিক বাধা কেটে যাচ্ছে। কিন্তু সংবিধান কি সব বিধান দেয়? দেয় না বলেই এঁরা আজও প্রমোদ উপকরণ হয়েই আছেন সমাজে।


৫.

থার্ড সেক্স বা জেন্ডার ডায়ভার্সিটি নিয়ে ইংরাজি ভাষায় লেখা বইয়ের সংখ্যা কম নয়। তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে নয় বরং সহজ স্বাভাবিকতায় যে কথা উঠে আসে—তার দিকে নজর দিলে দেখতে পাই, লেখিকা জঁ মরিসের আত্মজৈবনিক কথামালা। প্রখ্যাত এই ভ্রমণকাহিনি লেখিকা যিনি একদা পুরুষ ছিলেন, পরে নারীতে রূপান্তরিত হন। তিনি পুরুষ ও মহিলার ভিন্ন জগৎ সম্পর্কে আলোকপাত করতে গিয়ে বলছেন:

We are told that the social gap between the sexes is narrowing, but I can only report that having, in the second half of the twentieth century, experienced life in both roles, there seems to me no aspect of existence, no moment of the day, no contact, no arrangement, no response, which is not different for men and for women. The very tone of voice in which I was now addressed, the very posture of the person next in the queue, the very feel in the air when I entered a room or sat at a restaurant table, constantly emphasized my change of status.
And if others’ responses shifted, so did my own. The more I was treated as a woman, the more women I became. I adapted willy-nilly. If I was assumed to be incompetent at reversing cars, or opening bottles, oddly incompetent I found myself becoming. If a case was thought too heavy for me, inexplicably I found it so myself. […]
It is hard for me now to remember what everyday life was like as a man—unequivocally as a man, I mean, before my change began at all. Sometimes, though, by a conscious effort I try to recapture the sensation, and realize the contrast in my condition now. It amuses me to consider, for instance when I am taken out to lunch by one of my more urbane men friends, that not so many years ago that fulsome waiter would have treated me as he is now treating him. Then he would have greeted me with respectful seriousness. Now he unfolds my napkin with a playful flourish, as if to humor me. Then he would have taken my order with grave concern, now he expects me to say something frivolous (and I do).

[‘Conundrum’, Jan Morris]

“আমি যখন মেয়ে থাকি/তখন তারা আসেন এবং/মুচকি মুচকি হাসেন এবং/খুকখুক করে কাশেন এবং/ তোতলাতে তোতলাতে বলেন ভালোবাসি… আমি যখন ছেলে থাকি/তখন তারা আসেন এবং/হাতজোড় করে বসেন এবং/সন্তর্পণে কাশেন এবং/কথা শেষ হবার আগে বলেন এখন আসি…” অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা ও সুরে কেয়া চক্রবর্তী, ‘ভালো মানুষ’ নাটকে গেয়েছিলেন। এপারে ওপারে এক ছবি। কেন এই হ্যাংলামো? সহজলভ্য ভেবে? ক্ষমতার ভাষায় যদিও কোনও নারী-পুরুষ ভেদ থাকে না—কিন্তু রাতের নিঝুম রেলস্টেশনে, পথেঘাটে একজন নারীকে শরীর ও মন উভয় দিক থেকেই বিব্রত বা বিরক্ত করাই যায়। এই ছাড়পত্র দিয়েছে পুরুষ-সমাজ। বোভোয়ার যেমন বলেছেন, “জৈবিক পরিচয়ে স্ত্রীলিঙ্গ হিসাবে গৃহীত হওয়া আর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নারী নির্মিত হওয়ার মধ্যে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ব্যবধান। আজন্ম বৈষম্যের শিকার হতে হতে নারীর মধ্যে জন্ম নিয়েছে এক হীনম্মন্যতা ও এক রকম সতর্কতা। যা তাকে শরীর ও মনে সর্বদা পীড়িত করে।” তাই পাড়ার যে মেয়েটা সম্পূর্ণ ছেলেদের মতো আচরণ করে, ছেলেদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লড়ে, তার অসুবিধে হয় না সমাজে থাকতে। বড়জোর সবাই তাকে ‘গেছো মেয়ে’ বলে ডাকবে।

শ্লীল-অশ্লীলের মাপকাঠিতে গাউন-দস্তানা-মোজায় ঢেকে থাকা যে শরীর, তার থেকে যাপনের ধারা বদলে পোশাকে পরিবর্তন এসেছে অনেক। যদিও সভ্য-মানসিকতায় মেনে নেওয়া যাচ্ছে না সামাজিক অনাচার। দীর্ঘ আলাপের শেষে, ‘ফ্রি নীপল মুভমেন্ট’ ইওরোপের গুটিকয় দেশে সাংবিধানিক স্বীকৃতি পেলেও ইউনাইটেড স্টেট্‌স সুপ্রিম কোর্ট তাই এ আন্দোলনের বিপক্ষেই তার মত দিয়েছে। ফলে এ বিতর্কের রেশ যে গড়াবে আরও অনেকটা পথ তা অনুমেয়। বিদেশের মাটিতে সংগঠিত এ আন্দোলনের সুফল বা কুফল বিচার করা আমার উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু, আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আমরা যেমন বুঝতে পারি, নবজাগরণ বা রেনেসাঁর সুফল পেয়েছিলেন মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ মাত্র। বৃহত্তর জনজীবনের তাতে বিশেষ কোনও সুবিধে হয়নি। নারী-অধিকার সচেতন, উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত শহুরে কোনও মেয়ে এ আন্দোলনের বিষয়ে যত সহজে নিজের মত জাহির করতে পারে, মফস্‌সলের বা অজ গাঁয়ের অল্পশিক্ষিত বা অশিক্ষিত কোনও মেয়ে ততটাই সাবলীল কিনা সে-ই সংশয় থেকেই যায়! কেননা, তার পরিবেশ তাকে বারংবার স্মরণ করিয়েছে—লজ্জা নারীর ভূষণ। তাই বিদেশের মাটিতে বিগত পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে বা এদেশে বিগত দেড়-দু দশক বিভিন্ন কথাবার্তার মাধ্যমে সমাজে বসবাসকারী মানুষের চিন্তাভাবনায় পরিবর্তনের যা কিছু তা সীমিত রয়েছে একাংশেই। বিরাট একটা অংশ রয়েছে—যেখানে সাধারণ মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত ঘরের ছেলেটা, যে মেয়ে হতে চেয়েছে, সমাজ তাকে প্রথমেই বকাবকি করবে। তারপরে বয়স বাড়লে শারীরিক অত্যাচারে বোঝাবে সে ভুল করছে। শেষে হাল ছেড়ে বসে বসে, শুধু তাকে অপমান কোরে যাবে। সবাই তাকে ‘বউদি’ বলে প্রকাশ্যে ডাকবে। তাকে খুঁজে নিতে হবে সম-মনের বন্ধুকে। দল বাড়বে। পূর্বাশ্রম ত্যাগ করতে হলে অর্থের দরকার। সহজ উপার্জনের হাতছানি আর পেটের খিদের লড়াই তাকে টেনে নিয়ে যাবে অন্ধপথে। অপরাধ জগতে। একটু মেয়ে-মেয়ে স্বভাবের কৃতী ছেলেটার অবস্থা কিছুটা ভালো। সে ভালো লেখাপড়া শিখে, ভালো চাকরি করবে বা উপার্জনক্ষম হবে। কিন্তু কথা শুনতে হবে তাকেও। কিছুটা বেশিই কথা। অনেকানেক পরিবেশে থাকবে সে। তাই কথা তাকে শুনতেই হবে। এটাই মর্মান্তিক মনে হয়।

সময়ের মিছিল এদের মেলাচ্ছে। ওদের চোখে এখন জ্বলজ্বল করছে প্রত্যয়ে। সলিল চৌধুরী গান বানিয়েছিলেন, “অধিকার কে কাকে দেয়?/ পৃথিবীর ইতিহাসে কবে কোন অধিকার/ বিনা সংগ্রামে শুধু চেয়ে পাওয়া যায়/ কখনোই নয়, কোনওদিনও নয়/ অধিকার কেড়ে নিতে হয়…”—ওরা কেড়ে নিয়েছে অধিকার, ধরার অনেক মাটিতে। আলোর ছোঁয়া না পাওয়া ভূখণ্ডে পুরুষাধিপত্য এত প্রবল যে, ফণা তোলার আগেই মাটিতে লুটিয়ে দেবে। তবে আলো সেখানে ফুটবেই। দেরি হলেও ফুটবেই।

নিজেদের মনের কথা বলতে নারী ও পুরুষ ছাড়া তৃতীয়পক্ষও আজ আর পিছিয়ে নেই। মারামারি না করলেও প্রতিবাদ করছে তারা। স্বপ্নময় চক্রবর্তীর ‘হলদে গোলাপ’ পড়তে পড়তে এমন একজন সমকামী ‘পরী’র অকপট ‘স্বীকারোক্তি’ পাই। কবিতার আকারে সে তুলে ধরেছে তার মনের কথাগুলো:

বয়স তখন তেরোর শেষে প্রথম বার একা
বাড়ির বাইরে পা বাড়ালেম মামার বাড়ি—জোকা।
গোঁসাইবাবুর অনুশীলন মামাবাড়ির পাশেই
মামার ছেলে, ‘জোকার’ দাদা ব্যায়াম শিখত ওতেই।
জোকার দাদা জোকার দাদা হাসির খুড়োর কল
বিকেল হতেই বললে আমায় আমার সাথে চল।
ছুটি চেয়ে গুরুর কাছে বললে চড়া সুরে
চলছে কেমন অনুশীলন দেখাব ঘুরে ঘুরে।
দেখতে পাবি জিমনাস্টিক কঠিন ভারোত্তোলন
প্যারালাল বার ফ্রি হ্যান্ড আর যোগের প্রশিক্ষণ।
দেখছি আমি নয়নজোড়া সুঠাম সারি সারি
অর্ধনগ্ন পুরুষ দেহ তুলছে ওজন ভারী।
মিষ্টিমুখ আর মাচো দেহের ভাঁজ খাওয়ানো ছাঁচে—
চলছে আসন সময় ধরে ওস্তাদদের কাছে।
দেখছি আমি সম্মুখেতে নগ্ন পেশি যত
উঠছে ফেঁপে উঠছে ফুলে কষছে দেহ যত।
পেশির জোরেই ঊর্ধ্ব টানে পেশির জোরেই মাৎ
বক্ষ পেশির ঘেমো ছাতি দেখেই আমি কাৎ।
পেশির খেলায় জোয়ার-ভাটা পেশির বৃন্দাবন
নগ্নপেশির নগ্নটানে মন যে উচাটন।
দীপ্ত আমার সুপ্ত শিখা হৃদয় গভীর মাঝে
কারাগৃহের ক্ষুব্ধ অসি ঝনঝনিয়ে বাজে।
হচ্ছে কী যে মনের মাঝে বলব কী তা আজ
বলতে গেলেই আসবে তেড়ে পড়বে মাথায় বাজ।
আমার আশা আমার ভাষা জানি শুধু আমি
জানি না তো জানেন কিনা স্বয়ং অন্তর্যামী।
মা বোঝে না, কেউ বোঝে না কোথায় আমার আমি
ব্যঙ্গ করে বলতে পারো তুই তো সমকামী।

আজকের আধুনিক ভাবনায় দীক্ষিত হয়ে, স্কুল সিলেবাসের মাধ্যমে, স্কুলের দিদিমণি আর বাড়িতে মায়ের কাছে যেভাবে ছেলেমেয়েরা শিখে নিচ্ছে—‘গুড টাচ’ ও ‘ব্যাড টাচ’—এর প্রভেদ, আমাদের বেড়ে ওঠার দিনে, মধ্যবিত্ত বাঙালি বাড়ির ছেলে হিসেবে, বলা বাহুল্য, আমরা এসব শিখিনি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই শৈশবে বা কৈশোরে ঘটে যাওয়া কোনও ‘ব্যাড টাচ’-এর মুহূর্তকে এ প্রৌঢ়ত্বে এসে চিহ্নিত করা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু যৌনতা সম্পর্কে সাধারণত যে বয়সে আগ্রহ জাগে, সে-ই বয়সে পুরুষ সমকামিতার প্রতি আমার এক তীব্র বিকর্ষণ জন্মায়—একটি অবাঞ্ছিত ঘটনার সূত্রে। আমার এক বন্ধুর বিরাট পরিবার ছিল। পৃথক হাঁড়ি হলেও ওঠাবসা ছিল একসাথে। বন্ধুটির লক্ষ্য ছিল—যেখানে দেখিবে মেয়ে/ সারা অঙ্গ দেখো চেয়ে/ পাইলে পাইতে পারো অমূল্য সুযোগ।—এই আপ্তবাণী সম্বল করে সে ঘরে বাইরে অনেক সুযোগ পেয়েছে। বন্ধুদের আসরে সে সব বলতে, সে বেশ গর্ববোধ করত। আমরাও তাকে বেশ ‘কৃতী’ বলেই জানতাম। একদিন সে একান্তে আমায় বলল, ‘এক জায়গায় যাবি? অন্যরকম মজা হবে ওখানে।’ জিজ্ঞেস করতে, একজনের বাড়ির কথা বলল। আমি তাঁকে চিনতাম। পাশের পাড়ায় থাকেন। অবিবাহিত এক প্রৌঢ়। আসা যাওয়ার পথে দেখতাম—বেতের চেয়ারে বসে স্টেটস্‌ম্যান পত্রিকা পড়ছেন। অনেক জিজ্ঞাসাতেও অবশ্য মজার কারণটা বন্ধু জানাল না। আমার তখন বেড়ার পর বেড়া ডিঙোনোর বয়স। গৃহকর্তা একাকী পুরুষ হওয়ায় কোনও অন্যরকম চিন্তাও আসেনি মাথায়।

তা সেদিন খেলার পর, হাত পা ধুয়ে গেলাম বন্ধুর সঙ্গে। বাইরের ঘরে যথারীতি কাগজ পড়ছিলেন তিনি। আমরা যেতেই গ্রিলের তালা খুলে আমাদের ভেতরে ঢুকিয়ে আবার তালা লাগিয়ে দিলেন। বন্ধু আমার দিকে দেখিয়ে বলল, ‘একে নিয়ে এলাম।’ তিনি আমার দিকে চেয়ে শুধু একটু হাসলেন। তারপর আমাদের নিয়ে উঠলেন দোতলায়। ঘরে ঢুকে আমাদের বসালেন। নিজে বসলেন একটু দূরে। আমার নাম জানতে চাইলেন। কী পড়ি, কোথায় পড়ি জানতে চাইলেন। সে পর্ব সমাপ্ত হতেই এসে বসলেন আমার পাশে। প্রথমেই প্যান্টের ওপর দিয়ে আমার পুরুষাঙ্গটা ধরে আমার গালে একটা চুমু খেলেন। এতক্ষণে আমি ‘মজার’ তাৎপর্য বুঝলাম। আমি তার হাতটা ধরে সরিয়ে দিতেই তিনি প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়লেন আমার ঠোঁটের ওপর। জোর করে চেপে বসাতে চাইলেন নিজের ঠোঁট দুটোকে। এবার আমার প্রতিরোধের পালা। সামলাতে পারলেন না তিনি। উঠে যেতে বাধ্য হলেন। বন্ধুটি এর মধ্যেই জামাপ্যান্ট ছেড়ে ফেলেছে। সে গিয়ে বসল তাঁর পাশে। উনিও উলঙ্গ হলেন। শুরু হলো ‘অন্যরকম মজা’। এমন দৃশ্য আমি আগে দেখিনি। একজন কিশোর আর একজন প্রৌঢ় এমন আচরণ করতে লাগল যা আমার দেখতে ভালো লাগল না। খুব ঘেন্না করছিল। আমি ঘর থেকে বেরিয়ে নীচে নেমে গেলাম। গ্রিলের দরজা তালা লাগানোয় বাইরে যাবারও উপায় ছিল না। অপেক্ষা করতে লাগলাম। বেশ কিছু পরে নেমে এল ওরা। আমায় দেখিয়েই যেন বন্ধুর হাতে দুটো কয়েন গুঁজে দিলেন তিনি। দরজার তালা খুলে দিতে বাইরে বেরিয়ে এলাম আমরা। পথে একটা কথাও বলিনি বন্ধুর সঙ্গে। পাড়ায় ফিরে ও আমার হাত ধরে খুব বিনীত ভাবে বলল, ‘আজকের কথা কাউকে বলিসনি।’

না বলিনি। আজ তিপান্ন বছর পর, এই লেখাটা স্মৃতির ঝুলির কোন অতল থেকে বার করে আনল কথাগুলো। সেদিন আমি শুধু দেহটাকেই বড় করে দেখেছিলাম। তার আড়ালে প্রৌঢ়ের মনের প্রাঙ্গণটা অনুভব করতে পারিনি। সে-ই ঘটনার পর থেকে পুরুষের সমকামিতা আমার দু-চোখের বিষ হয়েছিল। বুঝতাম না নারী সমকামীদেরও। তবে তা দু’চোখের সুখেই ছিল সীমাবদ্ধ। সে মানসিক প্রাঙ্গণেও প্রবেশ করার বোধ তখনও ছিল অনায়ত্ব।

তার অনেকদিন পর আমার চোখ খুলে দিলেন জার্মান চিত্র পরিচালক ফাসবিন্দার। ম্যাক্সমুলার ভবনে হয়েছিল ফাসবিন্দারের রেট্রোস্পেক্টিভ। সেখানে দেখলাম—‘ফক্স অ্যান্ড হিস ফ্রেইন্ডস’। চিনতে পারলাম পুরুষের মনে পুরুষের প্রতি ভালোবাসার ঝরনা ধারাকে। বুঝতে পারলাম সে-ই অদম্য ভালোবাসাকে কোনও লিঙ্গের বাঁধনে বাঁধাটা কতটা অমানবিক। কৈশোর থেকে বয়ে বেড়ানো ঘৃণা তখন উধাও। জেগে উঠল এক অপরিসীম শ্রদ্ধা।

 

৬.

মহাভারতের উদ্যোগ পর্ব:
শিখণ্ডী বলিল—ভগবন্। সুব্রত। আমি আপনার পুংচিহ্ন ফিরাইয়া দিব। অতএব নিশাচর। আপনি কিছুকালের জন্য আমার এই স্ত্রীচিহ্ন ধারণ করুন। তারপর দশারণাধিপতি রাজা হিরণ্যবর্মা ফিরিয়া গেলে, আমি আবার স্ত্রী হইব এবং আপনিও পুরুষ হইবেন।
ভীষ্ম বলিলেন—রাজা (দুর্যোধনকে)। এই কথা বলিয়াই তাহারা দুইজনই সে বিষয়ে শপথ করিল এবং তৎপরে পরস্পরের অভীষ্ট লিঙ্গ বিনিময় করিল।

[‘মহাভারত’, হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ ভট্টাচার্য কৃত বঙ্গানুবাদ।]

এক রাজার তিন মেয়ে। গল্পটা বড়কে নিয়ে। ভালোবাসত এক রাজাকে। বাবার আয়োজিত স্বয়ংবর সভায় দাঁড়াতে হলো বোনেদের সঙ্গে। সেখান থেকে সবার নাকের ডগা দিয়ে তিন বোনকে রথে তুলে নিলেন, এক মহাবীর। লড়াই কোরে হেরে ভূত হয়ে গেল ছোট বীরেরা। একটা মাত্র ছোট সৎ ভাইয়ের জন্য তিন-তিনটে পাত্রী নিয়ে রাজ্যে ফিরলেন মহাবীর। বড় মেয়ে জানাল তার পাত্র নির্দিষ্ট আছে। তাকে ছেড়ে দেওয়া হোক। ছাড়া পেল সে। গেল কাঙ্ক্ষিত পুরুষের কাছে। রাজা তাকে ফিরিয়ে দিল। সে মেয়ে ফিরল মহাবীরের কাছে। বীর বললেন, তিনি প্রতিজ্ঞা করেছেন বিবাহ করবেন না।

মেয়েটা হারিয়ে গেল। অনেক কষ্টে দেখা পেল, পরশুরামের। মহাবীর আবার তার সেরা ছাত্র। ছাত্রকে বিবাহে রাজী না করাতে পেরে শুরু করলেন গুরুশিষ্যের প্রকাশ্য যুদ্ধ। তবে তা অমীমাংসিতই রয়ে গেল। মেয়েটা এবার শুরু করল কঠোরতম তপস্যা। মহাদেব এসে জানলেন তার সংকল্প। সে বীরের মৃত্যুর কারণ হতে চায়। সে-ই বরই দিলেন তাকে। বললেন, পরের জন্মে সে এক রাজার ঘরে ‘স্ত্রী-পুরুষ’ হয়ে জন্মাবে। প্রথমে মেয়ে থাকলেও পরে ছেলে হয়ে যাবে। দ্রুত পরজন্মের আশায় নিজের বানানো প্রজ্বলিত চিতায় প্রাণ দিল সে মেয়ে।

রাজার ঘরে এল মেয়ে। মা তাকে ছেলে বলে প্রচার করল। সাজাল। বাবা মা, সবাইয়ের চোখে ছেলেকেই রাখল। সে রাজপুত্রের মতো যাবতীয় শিক্ষায় পারদর্শী হলো। বাবা মা বিয়ে দিল তার। এবার আর ঢেকে রাখা গেল না পুরুষের নারী-পরিচয়। তার জন্য দুই রাজায় যুদ্ধ লাগে আর কী। এমন সময় মহাদেবের কথা ফলে গেল। বাবা মায়ের সম্মান ও রাজ্যরক্ষায় অসহায় মেয়েটা গেল বনে। সেখানেই হলো যক্ষের সঙ্গে তার লিঙ্গ বিনিময়। মেয়েটা এখন সর্বাঙ্গে পুরুষ। বন্ধ হলো যুদ্ধের আয়োজন। শ্রী ও শান্তিতে ভরে উঠল রাজ্য। কাশীরাজ কন্যা অম্বা এখন শিখণ্ডী। পুরুষাধিপত্যের আগুনে পুড়ে পুড়ে আজ সে খাঁটি সোনা হয়েছে। এবার সে গিয়ে দাঁড়াবে, পুরুষতন্ত্রের কেন্দ্রে থাকা সে-ই মহাবীরের সামনে।

ধনুক নামিয়ে নেবেন মহাবীর। তিনি গোপন অনুসন্ধানে জেনেছেন, নারী অম্বার জন্মান্তরে পুরুষ শিখণ্ডী হওয়াটা। তিনি এদের সামনে ধনুক তোলেন না। আর সে-ই সুযোগে মহাবীরের ইচ্ছামৃত্যুর পথ প্রশস্ত হবে। তীরের বিছানায় শুতে হবে তাকে। তার মাথার পাশে বসে কৃষ্ণ সমেত পাণ্ডবেরা সামাজিক অনুশাসনের পাঠ নেবে। অবশেষে মরে যেতে হবে ধীরে ধীরে। বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে ছত্রিশটা গুলি বুকে নিয়েও নায়কের কিছু কথা বলা বাকি থাকে সব সময়।

বর্ণ নির্বিশেষে পুরুষের একাধিপত্য থেমে থাকবে না। বরং আরও বাড়বে। যেদিন পুরুষ বুঝেছে, সন্তান উৎপাদনে তার ভূমিকাকে, সেদিন থেকেই সে বেড়া বেঁধেছে হারেম বানাতে। অবজ্ঞার চোখে তাকিয়েছে নারীদের দিকে। নারী পুরুষ ছাড়া তৃতীয় পক্ষকে সে মেনে নিতে পারেনি। তা সত্ত্বেও কিছু বোঝাপড়া নিয়ে চলছিল—নারী পুরুষের সমাজ। পাশাপাশি দীর্ঘদিনের অবস্থান এতো ঘৃণায় ভরে ওঠেনি। সিন্ধু সভ্যতা পর্যন্ত নারীর মমতার ভূমিতে পুরুষ ছাউনি তুলেছে পরিশ্রমের। তারপর…

…এলো ওরা লোহার হাতকড়ি নিয়ে
নখ যাদের তীক্ষ্ণ তোমার নেকড়ের চেয়ে,
এল মানুষ-ধরার দল
গর্বে যারা অন্ধ তোমার সূর্যহারা অরণ্যের চেয়ে।
সভ্যের বর্বর লোভ
নগ্ন করল আপন নির্লজ্জ অমানুষতা […]

[রবীন্দ্রনাথের ‘আফ্রিকা’ কবিতা থেকে।]

এখান থেকে গিয়ে ফিরে আসুক বা বাইরের থেকেই আসুক, ওরা এল। অসভ্য বর্বর আর্যরা এখানের মানুষদের প্রভু হয়ে বসল। শুরু হলো পুরুষাধিপত্যের নির্মম অধ্যায়।

নতুন বাসযোগ্য ভূমির সন্ধানে, দীর্ঘ দুর্গম পথচলায় এগিয়ে আসে কলম্বাসেরা। সাহসী ও সমর্থ যৌবনই তাকে অনুসরণ করে। বৃদ্ধ, নারী ও শিশুরা পড়ে থাকে পুরোনো আস্তানায়। সে-ই ভাবেই এসেছে তারা। অনেক ঘুরে শেষে পেয়েছে—সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা অঞ্চল। পেয়েছে ঋতুর বৈচিত্র্য। এবার অধিকৃত ভূখণ্ড বাড়াতে হবে। স্থানীয় নারীদের গর্ভে বাড়াতে হবে জনসংখ্যা। গুছিয়ে লিখতে হবে দমনপীড়নের সামাজিক নিয়মকানুন। দেবতাদের কাছে দু-হাত বাড়িয়ে শুধু পার্থিব সম্পদ ভিক্ষা করার গান লিখতে হবে। ধ্বংস করতে হবে এখানকার সভ্য মানুষের তৈরি যাবতীয় জনপদ, যাবতীয় উৎকর্ষতাকে।

তা তারা করেছিল, বর্বর ভাবে। তার ইতিহাস লেখা আছে বেদেই। খোলা মনে পড়তে হবে। নারী শুধু শয্যাসঙ্গিনীই থাকবে। তার রমণীয়তা, নমনীয়তা তো পুরুষের উপভোগের জন্যেই। বাকি সময়ে সে দাসী। পুরুষের সমান অধিকার তার নেই। সব কিছু থেকে সে বঞ্চিতা। ব্যতিক্রমের সন্ধানও পাওয়া যায়। তবে তা অনেক কম।

মনু লিখলেন শাসনপ্রণালী। সে-ই রথে মনুকে কোলে নিয়ে বসে থাকবে ব্রাহ্মণ। ঠেলবে ক্ষত্রিয়। রসদ জোগাবে বৈশ্য। আর ক্রমাগত যাত্রাপথ বানিয়ে যাবে শূদ্র। ক্ষমতায়নের কী বিচিত্র বৈজ্ঞানিক উদ্ভব! সৃষ্টিকর্তা পরমেশ্বর তাঁর মুখ হইতে ব্রাহ্মণের, বাহু হইতে ক্ষত্রিয়ের, উরু হতে বৈশ্যের আর পদ হতে শূদ্রের সৃষ্টি করিলেন। নৈবেদ্যর নাড়ুটি হয়ে রথে বসলেন ব্রাহ্মণ। আজও সে-ই রথেই রয়েছেন তাঁরা। মনুর চেয়ে অনেক বেশি তেতো শাসনপ্রণালী, তাঁরা মধুর আস্তরণে ঢেকে গপাগপ গেলাচ্ছেন সবাইকে। সময় বদলেছে। বদলেছে শাসন। শুধু বদলায়নি মহিলাদের দুর্বল ভাবা। স্ত্রী ও পুরুষের নির্ধারিত বৃত্তের বাইরে থাকা প্রাণেদের প্রতি চূড়ান্ত অবহেলা। ‘ইহকালে মনুষ্যদিগকে দূষিত করাই স্ত্রীদিগের স্বভাব’—এমন পরিচয় পাওয়ার পরে নারীর আর কী পাওয়ার থাকে? ‘কোন অবস্থায় স্ত্রীলোক স্বাধীন থাকিবে না’—এ ঘোষণায় কারাগৃহের ছবি আঁকা থাকে।

পৈতৃক ধন বিভাজনের প্রাথমিক পর্যায়ে নারীর জন্য কোনও অংশ রাখেননি মনু। পরে ক্ষেত্র ভাগ করতে গিয়ে, অবিবাহিতা কন্যাকে বিবাহের জন্য কিছু ধন দেবার কথা পাওয়া যায়। আর পাওয়া যায় ধন বণ্টনের আশ্চর্য এক তরিকা: কোনও ব্রাহ্মণের চার পুত্র যদি ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র হয় এবং একটি ব্রাহ্মণী কন্যা থাকে; তবে, পৈতৃক ধনকে চোদ্দভাগ কোরে, চারভাগ ব্রাহ্মণী কন্যাকে দিয়ে, বাকি দশভাগের চারভাগ ব্রাহ্মণ পুত্রকে, তিনভাগ ক্ষত্রিয় পুত্রকে, দু-ভাগ বৈশ্য পুত্রকে আর একভাগ শূদ্র পুত্রকে দিতে হবে। কিন্তু একটি ব্রাহ্মণ পুত্র ও একটি ব্রাহ্মণী কন্যা থাকলে, সব ধন আটভাগ করে একভাগ বোনকে দিয়ে সাত ভাগ থাকবে দাদার। এমন ভাগাভাগির আসরে আরও এক ভাগ আছে—কিন্তু, নারী পুরুষের সমাজ নির্মিত কাঠামোর বাইরে থাকা মানুষদের এই ভাগের খেলায় নেওয়া হয়নি। বলা হয়েছে—ক্লীব কোনও ভাগ পাবে না। যদি তার পুত্র হয়, সে পিতামহের সম্পত্তির ভাগ পাবে।

নারী বা অন্য মানুষদের প্রতি এই অবজ্ঞা নিয়ে যারা পুরুষ হয়েছে। সমাজের মাথা হয়েছে। তাঁদেরই কাহিনি ছড়িয়ে আছে বেদ-পুরাণের পাতায় পাতায়। তাঁদের শাসনপ্রণালী উদ্বুদ্ধ করেছে পরবর্তীদের। সবকিছু মুঠোর মধ্যে রাখার বাসনা যাঁদের, তাঁদের আশেপাশে জড়ো হয়েছে মেজো থেকে ছোট, নানান রকমের পুরুষেরা। নরক গুলজার হয়েছে।

 

৭.

শ্রী স্বরূপ গোস্বামী কড়চায়াম্—
রাধাকৃষ্ণ প্রণয় বিকৃতর হ্লাদিনী শক্তিরম্মা—
দেকাত্মানাবপি ভূবি পুরা দেহভেদং গতৌ তৌ।
চৈতন্যাখং প্রকটমধুনা তদদ্বয়ং চৈক্যমাপ্তং,
রাধাভাব দ্যুতি সুবলিতং নৌমি কৃষ্ণস্বরূপম্।।

শ্রীমতি রাধিকাই কৃষ্ণ প্রেমের বিলাস-রূপিণী হ্লাদিনীশক্তি, সুতরাং রাধাকৃষ্ণ একাত্মা হইয়াও অনাদিকাল হইতে বিলাসবাসনায় জগতীতলে দেহভেদ স্বীকার করিয়াছিলেন। সম্প্রতি তাঁহারা উভয়ে একত্ম প্রাপ্ত হইয়া চৈতন্যরূপে আবির্ভূত হইয়াছেন। এই জন্যই রাধাভাব ও রাধাকান্তিবিশিষ্ট কৃষ্ণস্বরূপ কৃষ্ণচৈতন্যদেবকে নমস্কার করি।

[আদিলীলা, ‘শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’, শ্রীমৎ কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী।]

সে-ই যুগসন্ধিক্ষণে তিনজন বাঙালি পুরুষ এসেছিলেন নদিয়ায়। চৈতন্যদেব, স্মার্ত রঘুনন্দন আর কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। রঘুনন্দন শাস্ত্রীয় ক্রিয়াকলাপকে সময়োপযোগী করলেন। কৃষ্ণানন্দ গভীর কুয়াশা সরিয়ে সামনে আনলেন তন্ত্রকে। আর চৈতন্যদেব ধরলেন উত্তাল সময়ের ঝুঁটি। বুনো ঘোড়াকে আনলেন বশে। যে ঢলোঢলো ছবি বা মূর্তি আমরা দেখি, তাতে কৃষ্ণপ্রেমে পাগল একজনকে পেলেও, সে-ই বীরপুরুষ হারিয়ে গেছেন।

প্রথম, শ্রীক্ষেত্রে গিয়ে যে-ই দেখলেন—মন্দিরের চূড়া, পাগলের মতো ছুটতে লাগলেন। মন্দিরের দ্বারে প্রহরী। বাধা দিতে, বাহুর ধাক্কায় তাকে ফেলে দিলেন মাটিতে। উন্মাদের মতো এগিয়ে গেলেন। চোখ মেলালেন প্রাণবল্লভ কৃষ্ণের চোখে। আমরা দেখিনি, পড়েছি। পড়ে বুঝেছি, সে চোখের ভাষায় ছিল রাধার ব্যাকুলতা। আবার দাক্ষিণাত্য ভ্রমণে এই একই ব্যক্তি, যে মারমুখী হয়ে উঠেছিল, পূজারীদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে। নবদ্বীপে গঙ্গার ঘাটে সঙ্গীদের নিয়ে দুষ্টুমি করা নিমাই, বাংলা ব্যান্ডের জনক খোল-করতাল নিয়ে উচ্চৈঃস্বরে নামসংকীর্তন করতে করতে স্পট জাম্প দেওয়া নিমাই, যে মাথা মুড়িয়ে গৌরাঙ্গ হয়েও নিমাইকে ভুলে যায়নি। তার প্রমাণ বারে বারে দিয়েছেন তিনি। অদ্বৈতবাদের দিশারী, নিজে দ্বৈতসত্তার মধ্যেই জীবন কাটিয়েছেন।

কাটিয়েছেন রামকৃষ্ণ। ধুতিটাকে প্রায় শাড়ির মতন পরতেন সে-ই সময়ে। আবার প্রয়োজনে অনুগতদের কাছে পিতার মতন দাঁড়াতেন। পরমাশ্রয় পিতা আর পরম মমতাময়ী মাতার মতো ঘিরে রেখেছিলেন, আগুনগুলোকে। সেদিন তো তাঁকে কেউ ভুল ভাবেনি? পুরুষের ভাবনা ব্যক্ত করেছেন রমণীয় করে। গ্রামে থাকতে মেয়ে সাজতে হয়েছে তাঁকে আগেও। “দেখ, নরেন্দ্রের জন্য প্রাণের ভিতরটা যেন গামছা-নিংড়াবার মতো জোরে মোচড় দিচ্ছে; তাকে একবার দেখা করে যেতে বলো; সে শুদ্ধ সত্ত্বগুণের আধার, সাক্ষাৎ নারায়ণ; তাকে মাঝে মাঝে না দেখলে থাকতে পারি না।” এখানেও সে-ই বিরহ জ্বালায় কাতর এক রাধাকে পাই আমরা।

বজ্রের মতো কঠোর আর ঘাসের মতো কোমলতার মিশ্রণই হলো আদর্শ চরিত্রের রূপরেখা। সেখানে আমরা পুরুষ আর নারীর এক মিশ্র কাঠামোকেই মেনে নিচ্ছি। মানতে হবেই। প্রকৃতির পুরুষটি হলেন বায়ুমণ্ডল। তারা একে অপরের পরিপূরক হয়ে কতকাল কাটাচ্ছে। খুব সন্তর্পণে এই কথাটি এখানে বলতে হয় যে, যৌন অভিজ্ঞতায় আমরা জেনেছি, পুরুষ বা নারীর যৌন-আকাঙ্ক্ষায় বিপরীত লিঙ্গর প্রতি বা সমলিঙ্গর প্রতি আকর্ষণও একটি স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। চৈতন্য বা রামকৃষ্ণর বিবাহ পরবর্তী জীবন, বিপরীত লিঙ্গর প্রতি আকর্ষণের সাক্ষ্য রেখে দাম্পত্যের কথা বলে না। বরং স্বাভাবিক দাম্পত্যে আরোপিত হয় দেবত্ব। দেবত্বর সে-ই কাহিনি বিশ্বাস ও আস্থায় মেনে নিতে রাজী সমাজ। কেবল পাশের বাড়ির মেয়ে হতে চাওয়া ছেলেটাকে মানবে না সে।

আমরা মানুষ হয়েছি বহুকাল আগে। খাওয়া থাকার প্রয়োজনেই জন্ম হয়েছে গোষ্ঠীর। নারী-পুরুষের কাজ ভাগ হয়েছে যাপনের মৌলিক প্রবণতা মেনে। সে-ই প্রতিকূল অবস্থায় নারী-পুরুষের বাইরে অন্য কোনও অস্তিত্বের নির্লজ্জ চিহ্নিতকরণ শুরু হতে পারে না। সেটা হয়েছে বেশ পরে। তারও পরে শুরু হয়েছে পুরুষ-প্রতাপের দিন। সে প্রতাপের উত্তরাধিকারীরা আজও সগর্বে তা অনুসরণ করে চলেছে।

কৃষ্ণ যোগীর ছদ্মবেশে রাধার সঙ্গে দেখা করতে চান। বৃন্দা যোগীর সাজে সীতাহরণে আসা রাবণের উপমা দিয়ে তাঁকে বাধা দিলে, কৃষ্ণ বলেন:

ধরিয়ে পুরুষ-বেশ, রাই-কুঞ্জে হতে প্রবেশ
অসাধ্য হইল প্রাণসখি!
সাজব আমি নারী-দেহ, নারীর ভূষণ আনি দেহ
সই হে! আর সইতে নারি প্রাণে!
নারীর নিকটে যেতে, অনাসে পারে নারী যেতে,
নারী না হলে, নারি যেতে সেখানে।”

—এই বৃত্তান্ত পাই দাশরথি রায়ের পাঁচালি থেকে। এক নারীর সঙ্গে মিলনের অভিলাষে কৃষ্ণ নারী সাজছেন। বৃন্দা তাঁকে নারীতে রূপান্তরিত করছেন—

তখন পীতাম্বরে পীতাম্বরী, পরাইছে ত্বরা করি,
অলক্ত পরায় দুটি পদে।
নহে খর্ব নহে উচ্চ, বসনে গড়িয়ে কুচ,
বন্ধন করিয়ে দিল হৃদে।।
কিছু গায়—কিছু পায়, কিছু দিলো নাসিকায়,
আনি দূতী স্বরণ-আভরণ।
সাজাইছে শ্যামকায়, শ্রবণ দুটি ঝুমকায়,
চমকায় দেখলে মুনির মন।।

আবার চৈতন্য হতে চাইছেন কৃষ্ণ, বিরহে ব্যাকুল রাধার সমতুল। মনের দেহের সঙ্গে দেহের মনের মিলন ঘটাতে চাইছেন, কৃষ্ণের সঙ্গে মিলনে, রাধার আনন্দ অনুভূতির পরশ পাবার জন্য।

এ তো স্পষ্টতই সমাজের তৈরি নিয়মের বিরুদ্ধাচরণ। অথচ সমাজ এ নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য করেনি কোনওদিন। অর্ধনারীশ্বর, গৌরীপট্টে বসানো শিবলিঙ্গ, নারী বা কালী-রূপী কৃষ্ণকে মেনে নিয়েছে। পুরাণ জুড়ে লেখা রূপান্তরকামীদের কাহিনি নিয়ে তার কোনও হেলদোল নেই। শুধু, শরীরে ‘অন্যরকম’ এক সন্তানের জন্ম দিয়ে, ‘সমাজ’ নামক পাড়া-ঘরে বাবা-মা’কে সারাজীবন অপরাধ বোধে কাটাতে হবে! যে ছেলেটি, পুরুষ-অঙ্গ পেয়েও মেয়েদের মতো আচরণ করে, তাকে উত্যক্ত করে এমন একটা অসহনীয় পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যাতে সে অন্ধকার জগতে চলে যেতে বাধ্য হয়, বা আত্মহত্যা করে নিস্তার পায়। সন্তানদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে অভিভাবকরা আজ একত্রিত হচ্ছেন। গড়ে উঠছে নিজেদের মধ্যে অভিজ্ঞতা আদানপ্রদানের সেতুগুলো। মানসিক প্রতিবন্ধী সন্তান থেকে ভুলোমনা সন্তান অবধি সব বাবা-মায়েরাই দল গড়েছেন। শুধু রূপান্তরকামীদের অভিভাবকেরাই তা পারেননি। পারলে বাস্তবটা বুঝতেন। মানসিক রূপান্তর যে তার শিক্ষায় কোনও প্রভাব ফেলবে না, সেটা জানতে পারতেন।

রাধাকান্তি-বিশিষ্ট চৈতন্যদেবকে দেখলে, যে স্বর্গীয় সুষমার বিচ্ছুরণ চোখে পড়ে, পাড়ার মেয়ে হতে চাওয়া ছেলেটার দিকে তাকালে, তা হয়ে যায় নারকীয় ক্লেদের অনুপ্রবেশ। সৃষ্টির মানসে ঈশ্বর নিজেকে ভাগ করে বিশ্ব-নির্মাণ শুরু করলেন। অদ্বৈত হলেন দ্বৈত। তাহলে ঈশ্বরের আসল পরিচয়টা কী ছিল? পুরুষ না নারী? নাকি সে-ই তৃতীয় অস্তিত্বটাই তাঁর আসল পরিচয়? মনের দেহ বা দেহের মন বলে কিছু পার্থক্য ছিল কি সে-ই একীভূত অবস্থানে? এসব প্রশ্ন যতই উঠুক এবং তার উত্তর যতই বিচিত্র হোক না কেন, ভবি ভুলবার নয়! নাগরিকত্বকে নারী-পুরুষে ভাগ করলেও পুরুষ প্রথম শ্রেণীর নাগরিক হয়েই আছে। নারীকে বড়জোর দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকত্ব দেওয়া যায়। বাদবাকিরা সবাই এলেবেলে।

দ্বৈত ও অদ্বৈততত্ত্ব নিয়ে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের মতো হাড্ডাহাড্ডি খেলা চলছে সে-ই কবে থেকে। দার্শনিকতার আড়ালে তা প্রায় গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে বিদ্যমান। আমি কোনও তর্কে যেতে চাই না। খুব সহজভাবে বুঝতে চাই এক আর দুইয়ের খেলা। কোষ বিভাজনের গবেষণাগারেতেও কিন্তু সে-ই একের দুই হওয়ার খেলা। না হলে দুনিয়া চলবে কীভাবে? খেয়াল রাখতে হবে, এক থেকে দুই। আগে এক পরে দুই। ক্রমশ প্রসারমান মহাবিশ্বের গল্পও তো তাই। এত সরল এই প্রক্রিয়ার বিকাশ, যে তার আঁচটুকু পাই না আমরা।

আমরা জ্ঞানে-অজ্ঞানে সে-ই একের ভজনাই তো করি। যার মাধ্যমেই যা কিছু পাঠাই না কেনো সবই তো সে-ই মহাসময়ের কাছে যায়। সব কিছুর নিয়ন্ত্রা তো তিনি। কিন্তু এ তো চেতনা, যে তিনি সর্বশক্তিমান। এ তো জড়ের বোধোদয়। এবার সে-ই সর্বশক্তিমানকে পাবার আশায় জড় গতিশীল হবে। বিভাজিত হবে। আকাশ আর মাটির মতন, দুজনে মিলে এক বিশ্ব হবে। তার একটা সত্তা থাকবে, সর্বশক্তিমানের প্রতি নিবেদিত। অন্য সত্তা আগের সত্তাটির পার্থিব অস্তিত্ব অটুট রাখবে।  দেহ আর মনের সে-ই খেলাই তো প্রাণকে পূর্ণ করবে।

কৃষ্ণকে পেতে চৈতন্যদেব কৃষ্ণপ্রেমের বিলাসরূপিনী হ্লাদিনীশক্তি রাধার পথে যেতে চেয়েছেন। পুরুষ তো একজনই। এবং তিনি ব্যাকুলতার তীব্রতা পরীক্ষা করে ভক্তকে সঙ্গ দেন। বৈষ্ণবধর্মে এই নারীসুলভ ভক্তির পথ এসেছে চৈতন্যদেবের কর্মধারা বেয়ে। তার বীজ বপন করেছিলেন, অদ্বৈতমতে বীতশ্রদ্ধ হয়ে, দ্বৈতমতে প্রেমধর্মের সাধক মাধবেন্দ্র পুরী। তার শিষ্যেরা সে ক্ষেত্র রক্ষা করে এসেছিল। সেখানে ফুল ফোটালেন চৈতন্যদেব। সে-ই সময়ের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় পরিস্থিতি চৈতন্যদেব খুব ভালো করে বুঝেছিলেন। গভীর বুঝতেন সামাজিক বিধানে অন্ত্যজদের মনের কথা। যা করা উচিত, তাই করেছিলেন।

তাঁর কোন সত্তা নিয়ে কথা বলব? তিনি নারী-পুরুষে মিশে আছেন। যেখানে যেমন প্রয়োজন তেমন হয়েছেন। গীতায় সখা অর্জুনের যুদ্ধরথের সারথি হয়ে, হতোদ্যম তৃতীয় পাণ্ডবকে শোনাচ্ছেন,—‘অহমাত্মা গুড়াকেশ সর্বভূতাশয়স্থিতঃ।/ অহমাদিশ্চ মধ্যঞ্চ ভূতানামন্ত এব চ।।’ হে অর্জুন, সর্বভূতের হৃদয়স্থিত আত্মা আমিই। আমিই সর্বভূতের উৎপত্তি, স্থিতি ও সংহারস্বরূপ।—আবার চৈতন্যচরিতামৃতে ‘ললিতমাধব’-এর একটা অংশ অনুসরণ করে কৃষ্ণদাস কবিরাজ লিখছেন:

…স্বমাধুর্য্য দেখি কৃষ্ণ করেন বিচার।।
অদ্ভুত অনন্ত পূর্ণ মোর মধুরিমা।
ত্রিজগতে ইহার কেহ নাহি পায় সীমা।। […]
আমার মাধুর্য্যের নাহি বাড়িতে অবকাশে।
এ দর্পণের আগে নব নব রূপে ভাসে।।
মন্মাধুর্য্য রাধার দোঁহে হোড় করি।
ক্ষণে ক্ষণে বাড়ে দোঁহে কেহ নাহি হারি।।
আমার মাধুর্য্য নিত্য নব নব হয়।
স্ব স্ব প্রেম অনুরূপ ভক্তে আস্বাদয়।।
দর্পণাদ্যে দেখি যদি আপন মাধুরী।
আস্বাদিতে হয় লোভ আস্বাদিতে নারি।।

ভুলে যেতে হয় কংসারী কৃষ্ণের কথা। কালীয় দমনকারী কৃষ্ণের কথা। মনে পড়ে না রাখালরাজাকে। দেখি, আত্মপ্রেমে মাতোয়ারা এক রমণীয় বহিঃপ্রকাশ। নিজেই যেন বিশ্বরূপ দেখছেন তিনি। কঠোর কোমলে মেশা এক আদর্শ মানব হয়েছেন। যেমন মানব হয়েছিলেন, চৈতন্যদেব। নরনারীর সীমারেখা ভেঙে দিয়ে মানব অস্তিত্বকে সাজাতে চেয়েছিলেন তিনি। প্রকারান্তরে পুরুষের ভেতর সুপ্ত কিছু নারীসুলভ গুণকে জাগাতে চেয়েছেন তিনি। ধৈর্য, মমতা, সহনশীলতা এবং পালনের মতো নারীসুলভ গুণের সঙ্গে তিনি মেশাতে চেয়েছেন পুরুষের বল, সাহসিকতা, কর্মশীলতা আর সুরক্ষণকে।

প্রসঙ্গত হিন্দিভাষী কবি রামধারী সিং দিনকর লিখিত ‘অর্ধনারীশ্বর’ শীর্ষক প্রবন্ধের উল্লেখ করা যায়, যেখানে দিনকর বলছেন, গুণ-লক্ষ্মণে নারী-পুরুষ সমান। একের গুণ অপরের দোষ নয়। কিন্তু সমাজে যাতে পুরুষ স্ত্রৈণ হিসাবে চিহ্নিত না হয়, তাই সে তার ভেতরের নারীর গুণকে অস্বীকার করে। শক্তিনাথ ঝা অবশ্য তাঁর ‘অন্য এক রাধা’য় বলছেন, “রাধার গুণাবলী হরণ করে কৃষ্ণে আরোপ করেছে শাস্ত্রকাররা, পুরুষতন্ত্র। ‘মহামাতৃকা’ রাধাকে পুরুষের অনুগত এক চরিত্রে পরিণত করেছে।” এখন আমাদের আলোচ্য বিষয়ে এ নিয়ে আলাপ জুড়লে পথভ্রষ্ট হতে হবে। তাই এটুকু বলা যাক, আধুনিক এই সময়ে দাঁড়িয়েও চৈতন্যের আধুনিকতাকে আমরা এখনও স্পর্শ করতে পারিনি।

 

৮.

প্র: আমরা যেরকম পরিস্থিতির মধ্যে বর্তমানে রয়েছি সেখানে সর্বস্তরে, সব ক্ষেত্রে পুরুষতন্ত্র, ‘ম্যাসকুলিনিটি’ ইত্যাদির বাড়বাড়ন্তই চোখে পড়ে আর তার থেকে ক্রমাগতই হিংসার ঘটনাও বাড়ছে। পরিচিতিভিত্তিক রাজনীতিতে তাহলে এর মোকাবিলা করার জন্য কী কৌশল নেওয়া প্রয়োজন?
উ: আজ পুরুষতন্ত্রের যে রূপ দেখা যাচ্ছে, তা হাজার বছর ধরে যে বীজ বপন করা হয়েছে আজ তাই এক বিরাট বৃক্ষের চেহারা ধারণ করেছে। আর এখনও আমরা শুধু কিছু ডালপালা কাটারই চেষ্টা করছি, এতে কিছুই হবে না; কয়েক’টা ডালপালা কাটলে পুরুষতন্ত্রের বিরাট বৃক্ষের কোনও ক্ষতিই হবে না। এটি নতুন দিশায়, নতুন জায়গায় বেড়েই উঠবে। আমাদের এর শিকড়ের উপরে কাজ করতে হবে। শৈশব থেকে পুরুষতন্ত্র ভেতরে ভেতরে শিকড় ছড়াতে থাকে। আমরা যখন শিশুদের বড় করি, তখনই পরোক্ষে তাদের পুরুষতন্ত্র শিখিয়ে দিই। যেমন—ছেলেদের কেমন হতে হবে, মেয়েদের কেমন হতে হবে, আর তারপর প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে তারা যখন সঙ্গী নির্বাচন করে, তখনও আমরা আমাদের শ্রেণী, জাতি ও পছন্দের আর যা কিছু তা তাদের উপর চাপিয়ে দিই আর তাদের আরও কট্টর করে তুলি। যা কিছুর ফল ভোগ করছি, তার বীজ আমরাই বপন করেছি। সেইজন্য আমি পুরুষতন্ত্রকে একা দেখি না, পুরুষতন্ত্রের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে জাতপাত, জাতপাতের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে লিঙ্গ পরিচিতি, লিঙ্গবৈষম্যের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে ভাষা, জাতিসত্তা ও আরও নানা বিষয়। যদি আমাদের এর সঙ্গে লড়তে হয়, তাহলে যে নতুন প্রজন্ম রয়েছে যা এখনও যেন একতাল কাঁচা মাটির মতো, তাকে রূপ দিতে হবে। কারণ আমরা এখন যেন পরিবর্তনের ঠিক মাঝপথে রয়েছি। একদিকে যেমন আমরা পুরুষতন্ত্রের কুফল ভোগ করছি, তেমনি প্রযুক্তির কারণে পৃথিবীটা অনেক ছোট হয়ে গেছে আর বহু বিষয়ের জন্য সারা পৃথিবী একজোট হয়ে লড়াই করছে। আর আমরা যদি চাই পরবর্তী প্রজন্ম এই লড়াইয়ের শরিক হোক, তাহলে তাদের শ্রেণী-জাত-লিঙ্গ নিরপেক্ষভাবেই বড় করতে হবে।

[https://www.groundxero.in/2020/03/31/an-interview-of-
disha-pinki-sheikh-a-transgender-poet-human-right-activist-and-politician/]

গতবছর (২০২০) মহারাষ্ট্রের বঞ্চিত বহুজন আঘাদি দলের রাজ্য মুখপাত্র, অধিকার আন্দোলনকর্মী, রূপান্তরকামী কবি দিশা পিঙ্কি শেখ কলকাতায় এসেছিলেন একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। সুদর্শনা চক্রবর্তীর সঙ্গে তাঁর প্রশ্নালাপের একটি অংশ এখানে উল্লেখিত হলো। আলোচনার একদম শেষে, সুদর্শনা চক্রবর্তী জানতে চান—‘মূল স্রোতটা ঠিক কী?’ তার উত্তরে দিশা পিঙ্কি শেখ বলেন,—

সামাজিক ভাষায় হয়তো একেই মূল স্রোত বলবে। তবে আমি মনে করি আমার স্রোতের ধারার সঙ্গে এসে যে আমাকে সঙ্গে নেবে তাই মূল স্রোত। আমার অস্তিত্ব, আমার ভাষা, আমার সংস্কার-সংস্কৃতিকে শেষ না করে এটা হতে হবে। মূল স্রোত যখনই কিছুকে আত্মস্থ করে, তার বৈচিত্র্যকে নষ্ট করে তারপর গ্রহণ করে। আমরা আদিবাসীদের মূল স্রোতে এনে তাদেরও পিতৃতান্ত্রিক করে তুলি। আমরা গ্রামের জীবনকে মূল স্রোতে আনার কথা বললে তাদেরও শহুরে করে তুলি। আমরা আসল বাঙালি, আসল মারাঠি বললে—এই ভাষার তাবৎ উপশাখা-উপভাষাগুলিকে অসভ্য ঠাউরে নিই ও তাদের সভ্য ভাষা শেখাই ও বলি তারা মূল স্রোতে এসে গেছেন। এই মূল স্রোতকে আমি স্বীকার করি না। আমার পৃথক হওয়াটা যে মূল স্রোত মেনে নেবে আমি তাকেই স্বীকার করব।

সবচেয়ে প্রয়োজনীয় কথা হলো এটাই। মানুষের ন্যায্য স্বাধীনতা তাকে দিতেই হবে। দিতে হবে সামাজিক নিরাপত্তা। সুস্থ পরিবেশ। কোনও প্রশাসনিক উদ্যোগ নয়। এ ভার নিতে হবে পড়শিদের। সমাজে বসবাসকারী প্রত্যেকের ওপর এ দায়িত্ব বর্তায়। আর তা না হলে সভ্য মানুষেরা ছিঁড়ে খুবলে নেবে, সমাজে অপাঙ্‌ক্তেয় এই মাঝপথে থাকা মানুষদের। ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে গুরুচণ্ডালী প্রকাশন তাদের ‘বাংলা চটি সিরিজ’-এ ‘আমার যৌনতা’ নামে একটি আত্মকথার সংকলন প্রকাশ করে। সেখানে কয়েকজন রূপান্তরকামীর জীবনযন্ত্রণা তুলে ধরা হয়েছে। দক্ষিণ-ভারতের শচীন নামের একজন রূপান্তরকামীর জীবনযাপনের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার কিছুটা এখানে তুলে ধরছি—শচীনের জবানিতে তার মর্মন্তুদ অভিজ্ঞতা ‘Human Rights Violations against the Transgender Community: PUCL, Karnataka’-এর রিপোর্ট থেকে অনুবাদ করেছেন কৃষ্ণকলি রায়। খোলাখুলি ভাবেই তার ওপর দৈহিক ও মানসিক নির্যাতনের বিবরণ দিয়েছেন শচীন। সে-ই ন্যক্কারজনক কার্যকলাপের উল্লেখ এখানে করতে বাধ্য হচ্ছি শুধু আমাদের ভেতরে লুকিয়ে থাকা মানবশত্রুকে চিনিয়ে দেবার জন্য। ভাষার থেকে অনেক বেশি অশ্লীল এদের মনের গঠন।

যখন সে নিজের কথা বলছে, তখন তার বয়স মাত্র তেইশ। চার দিদির পরে ছোট ভাই সে। মা-বাবা তাকে মেয়ের মতো করেই মানুষ করেছেন। তারও ভালো লাগত মেয়েদের মতো থাকতে। সংসারের কাজ করতে। মা-বাবার কোনও আপত্তি ছিল না। যত আপত্তি শুরু করল আত্মীয়স্বজন ও পড়শিরা। সে-ই লজ্জার হাত থেকে বাঁচতে বাবা-মা তাকে সেখান থেকে চলে যেতে বললে, অভিমানে ইঁদুরমারা বিষ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেও সফল হয় না সে। বাড়ি ছেড়ে পথে নামে। তিরুপতি মন্দিরের বাইরে তাকে ক্রন্দনরত দেখে একজন হিজড়াদের কাছে গিয়ে থাকতে বলে। তখনও সে জানত না, হিজড়ারা কারা। মেয়েদের সাজে তাকে দেখে বিছানায় তুলতে চায় অনেকেই। শুরু হয় টাকা রোজগার। নিজের খরচটা চালাতে তার আর কোনও অসুবিধে থাকে না। মাঝে মাঝে পুলিশের মার জুটলেও সয়ে যাচ্ছিল সে সব। বাবা-মায়ের ভোগবিলাসের সরঞ্জামের ব্যবস্থাও করতে হচ্ছিল তাকে—দেহ বেচে। সে-ই অন্ধকার পথে ওঁত পেতে থাকা শয়তানেরা ইচ্ছেমতো তার দেহটাকে নিয়ে টানাহেঁচড়া করছিল প্রতিদিন।

আরেকবার খুব খারাপ ব্যাপার হয়েছিলো। একজন আমায় গাড়িতে করে রিং রোডে নিয়ে গেছিলো। সেখানে গাড়ি থামিয়ে একটা ঝোপের আড়ালে গেলাম। লোকটি দিব্যি ফূর্তি করে নিলো, নিয়ে বললো যে ও গাড়িতে গিয়ে বসছে। আমি যেন পাঁচ মিনিট পরে আসি, না হলে লোকের সন্দেহ হবে। ওমা! আমি ঝোপ থেকে বেরোবার আগেই সে গাড়ি নিয়ে বেপাত্তা। টাকা তো গেলই, তারচেয়েও খারাপ হলো এই যে আমার শার্ট-প্যান্ট সব ওই গাড়িতেই ছিলো। রোজ শরীর-ব্যবসা শেষ হলে আমি পোশাক পালটে ওই পরে মেসে ফিরি। এখন এই রাত দশটায় রিং রোডের মধ্যিখানে এই মেয়েলি পোশাকে আমি কী করি! তারপর একজন পুলিশ কনস্টেবল কোথা থেকে এসে জুটলো। আমি তো খুব ভয় পেয়েছিলাম এমনিতেই। এ লোকটা আমাকে টেনে এবার ঝোপের পেছনে নিয়ে গেলো। নিয়ে বলে ’সব জামাকাপড় খোল।’ আমি খুলতে না চাইলে কী হবে, লাঠির বাড়ি মেরে মেরে টেনে হিঁচড়ে খুলে ফেললো সব। ও দেখতে চাইছিলো আমার পুরুষাঙ্গ সোজা হতে পারে কিনা। আমি থরথর করে কাঁপছিলাম। আমার কাপড় চোপড় সব তার কাছে। আর মারের চোটে চোখেও অন্ধকার দেখছি। ওর পায়ে ধরে কান্নাকাটি করলাম অনেক। একশো টাকা ঘুষও দিলাম যাতে আমায় ছেড়ে দেয়। কিন্তু তখন ওর শরীর জেগে উঠেছে। ও জোর করে আমার সঙ্গে সেক্স করবেই। আমার কাছে আর একটাও কন্ডোম ছিলো না, তাছাড়া পেছন দিক দিয়ে সেক্স করতে আমি কক্ষনো চাই না। কিন্তু লোকটা এক হাতে আমার মুখ চেপে ধরলো যাতে চিৎকার করতে না পারি, তারপর জোর করে আমার পেছনে ওর পুরুষাঙ্গ ঢুকিয়ে দিলো। খুব বড়, আমার ভীষণ লাগছিলো। লোকটা বলছিলো ‘আরো কাঁদবি? আরো কাঁদবি? তাহলে আরো লাঠির বাড়ি খা।’ মারছিলো আমাকে। তাতেও ওর মন ভরেনি, আমাকে এবার বললো ঝুঁকে দাঁড়াতে, নিয়ে এবার শুরু করলো। ব্যথায় ছিঁড়ে যাচ্ছিলাম। আমার পেছন দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছিলো। শেষে আমার ওপর কাপড়চোপড়গুলো ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে, আমাকে ঝোপের মধ্যেই ফেলে রেখে ও চলে গেলো। তাও রক্ষে যে অন্তত কাপড়গুলো নিয়েই চলে যায়নি।

পুলিশের পোশাক পড়া ধর্ষক জানে, ওরা আগাছার দল। ওদের ইচ্ছেমতো ভোগ করা যায়। ধর্ষক তো সমাজেরই একজন। সংসারে বউ-ছেলেমেয়ে আছে। সাজুগুজু করে বিয়েবাড়ি যায়। ঝোপের আড়ালের সে-ই ধর্ষককে তখন আর চেনাই যায় না। এই আমাদের সংস্কৃতি! যা একশ্রেণির মানুষকে সবকিছু মাগনা পাবার অধিকার দিয়েছে।

শচীনদের মতো মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা বহুতলের খুপরিতেও দেয়াল জুড়ে আঁকা আছে। অর্থের জন্য দেহ দিতে গিয়ে ধর্ষণের রক্ত মেখে ফিরতে হয়। বহুজাতিকের যন্ত্র-কেরানি স্বামীর হাতেও ধর্ষিত হতে হয় স্ত্রীকে। যা চাই তা যে করে হোক আদায় করব—এই বাসনা নিয়েই তো মানুষ  মাটি খুঁড়ে খনিজ তেলের ঘুম ভাঙিয়ে, তাকে বাইরে বার কোরে এনেছে। কেন সে এমন নির্দয়ের মতো একটা দেহকে খুঁড়ে বিষ উগড়ে দিল?

এর উত্তর হয় না। এটাই বিচিত্র মানব মনের কর্মক্ষেত্র। ঘটনা পরম্পরায় গজিয়ে ওঠা সে-ই ভ্রূণটাই একদিন একজন শচীন হবে বা সে-ই ধর্ষক হবে। জন্মের পর এক দীর্ঘপথ পেরিয়ে তাদের রিং রোডের পাশের ঝোপে আসতে হবে। এতটা পথে যা কিছু ঘটেছে, তাই তাকে এখানে পৌঁছে দিয়েছে। এখানে আমাদেরও একটা ভূমিকা আছে। নিজের ছেলেমেয়েদের দিকে নজর দিতে গিয়ে সময় পাইনি, পাড়ার সে-ই ‘অন্যরকম’ ছেলেটার বা মেয়েটার খোঁজ নিতে। ওকে এড়িয়ে গেছি।

সমাজ কি পারত না শচীনকে মেয়ে বলে মেনে নিতে? যৌন-বিকারগ্রস্থ ছেলেটার চিকিৎসা করাতে? পারতো তো বটেই। তাই তো সে সমাজ। কিন্তু করেনি। দুজনের প্রতিই চূড়ান্ত অবহেলা করেছে সে। তাদের পৌঁছে দিয়েছে অপরাধের ঝোপে।

ধর্ষিত শচীনের কাছে সেদিনের অত্যাচার বাড়াবাড়ি মনে হলেও, পুলিশে জানাবার মতো কিছু মনে হয়নি তার। ধর্ষকও শচীনদের ঝোপের আড়ালের ব্যাবসার সবটা জানে। টাকাও তোলে ওদের থেকে। সে যা কিছু করেছে, দাপটেই করেছে। শচীন না বললে তো কেউ জানতই না, রিং রোডের ঝোপের আড়ালের এই মর্মান্তিক অধ্যায়টা। এমন অসংখ্য অপরাধ চিরদিন ঢাকাই পড়ে থাকে।

স্বপ্নময় চক্রবর্তী তাঁর ‘হলদে গোলাপ’-এ বিহারের সাসারামের একটা বেশ বড়সড় ‘মওগা’ বসতির কথা বলেছেন। “সালোয়ার-কামিজ পরা বুক উঁচু করা কিছু মানুষ, কিন্তু চোয়াল কঠিন, গাল দেখে মনে হয় দাড়ি কামানো। লম্বা চুল, নাকে নথ, খাটিয়ায় শুয়ে আছে, অথচ পরনে লুঙ্গি আর গেঞ্জি।” বিভিন্ন উৎসবে এদের নাচের খুব চাহিদা। দেহ দিয়ে অর্থ নিলেও গোষ্ঠীবদ্ধ বলে কিছুটা নিরাপত্তা আছে এদের।

এদেশের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে তৃতীয় লিঙ্গকে ভাঁড়ামো বা উপহাসের উপাদান হিসাবে দেখানোর যে গড় প্রবণতা, তার থেকে সরে এসে, তাঁদের মানুষ হিসাবে দেখার কথা বলেছেন অনেকেই। চলচ্চিত্র পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ ‘চিত্রাঙ্গদা’য় ‘আত্মজৈবনিক’ এক ‘পাঠ’ রেখেছেন। কৌশিক গাঙ্গুলী ‘নগরকীর্তন’-এ বলেছেন, অঙ্গে পুরুষ একজনের মেয়ে হতে চাওয়ার ইচ্ছের কথা। সামাজিক অলিখিত অনুশাসনগুলো যদিও সে-ই মেয়েটাকে বাঁচতে দিল না। সম্পূর্ণ আইন বিরোধী দীর্ঘস্থায়ী একটা মানসিক অত্যাচার কী সাধারণ ভাবে ঘটে চলল মেয়েটার ওপর। এই আমাদের সমাজ!

 

৯.

…তিনি নিজেও তার নাম বললেন, এবং জানালেন, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গান শুনতে ভালবাসতেন।
আমি এই বৃদ্ধ বাউলের নাম প্রকাশ করছি না। পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম, প্রকৃতই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল, এবং শান্তিনিকেতনে গিয়ে তিনি রবীন্দ্রনাথকে গান শুনিয়ে আসতেন। সেই বৃদ্ধ বাউলকে সব সময়েই আমার কেমন ভাবের ঘোরে আচ্ছন্ন মনে হয়েছিল। এক সময়ে কাঁদতে কাঁদতে আমাকে বললেন, “বাবা, আমি হলাম ‘পতিত’ বাউল। প্রকৃত বাউল নই।…”
…বৃদ্ধ হেসে, চোখ ঘুরিয়ে, একতারায় শব্দ তুলে বললেন, “ভাববি, নারী হিজড়া পুরুষ খোজা এই তো লক্ষণ/ সাবধানে কর সবে সাধন ভজন।”
এবার সবাই মিলে জয়ধ্বনি দিল, “জয় গুরু, জয় গুরু।”
আমি যে ধাঁধায়, সেই ধাঁধাতেই রইলাম। নারী হবে নপুংসক, পুরুষ হবে খোজা, অর্থাৎ যার যৌন শক্তি কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এই ভেবে সাধন ভজন করতে হবে। তার মানে কি? আমি যেন তন্ত্রের একটা স্তিমিত প্রতিধ্বনি শুনতে পাচ্ছি। অথচ বাউলদের সেরকম কোনো তত্ত্ব থাকতে পারে, আমি ভাবতেই পারি না।

[‘অন্ধকারে আলোর রেখা’, সমরেশ বসু।]

তন্ত্রের গভীরতায় না গিয়েও বলা যায়, যে, এই ফসলহীন কৃষিকর্মের কথা মনু নির্দেশিত পথের বিপরীতে চলছে। এই সে-ই পথ, যে পথের ধুলোয় ‘মা ফলেষু কদাচনঃ’ লেখা আছে। দ্বৈতের অদ্বৈত হবার লীলাভূমি।

আর যদি গভীরে যাই, হাঁপিয়ে মরতে হবে। নারীর রমণীয়তা নিয়ে পুরুষ বা পুরুষালি-নারী আমরা অনেক দেখি। তারা সন্তানাদি নিয়ে জীবন কাটায়। হিজড়া বলা হয় তাঁদের যাঁরা সামাজিক ফতোয়ায় দেহ-মনের সংঘাতে থাকে। যাঁদের প্রজনন ক্ষমতা থাকে না বা নষ্ট করে দেওয়া হয়। নপুংসকতার অনেক ধারা।

ক্যাথলিক ঐতিহ্যে আরও এক ধরনের নপুংসক রয়েছে: ‘আধ্যাত্মিক নপুংসক, যিনি নিজেকে সম্পূর্ণরূপে প্রভুর সেবায় নিবেদিত করার জন্য ব্রহ্মচর্চা অনুশীলন করেন।’ এমনও এক ধারার সন্ধান পাই। কিন্তু বিষয়টা জটিল হয়ে যাচ্ছে ‘নারী হিজড়া’ কথাটায়। প্রজনন ক্ষমতাহীনা নারী না নারী-পুরুষের প্রজননহীন অদ্বৈত অবস্থান। যদি অদ্বৈত অবস্থাকে ধরি, তাহলে অর্ধনারীশ্বর বা গৌরীপট্ট সংযুক্ত শিবলিঙ্গের কথা চলে আসে। যাঁদের মিলনে কোনও সন্তান উৎপাদন নেই। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, এই মিলিত যুগ্মসত্তার সঙ্গে একজন কর্তিত লিঙ্গ পুরুষের সাধনার স্বরূপ কী? একাধারে সম ও অসমকাম নয় কী? রাধা ও কৃষ্ণ না রাধা ও রাধাভাবের কৃষ্ণের মিলন। যে মিলনে কোনও প্রজনন নেই।

ব্যাপারটা গুলিয়ে যাবার আগে সোজা পথটাই ধরি। ধরে নেওয়া যাক, প্রজনন ক্ষমতাহীনা নারী ও প্রজনন ক্ষমতাহীন একজন পুরুষ সেজে এই সাধনা। যে সাধনার ফল ঝরে মনের ভেতরে। এখানে কোনও বাহ্যিক উৎসরণ নেই। ধারা এখানে ঊর্ধ্বমুখী হয়ে রাধা হয়েছে। চলেছে উৎসের দিকে। এ বড় কঠিন সাধনা। এ সাধনার ফল আত্ম ও মানবকল্যাণে নিয়োজিত হলেই সে প্রকৃত বাউল হয়। এ তন্ত্রের সাধনা। এ তন্ত্রীর সাধনা। কুলকুণ্ডলিনীকে সহস্রারে তোলার সাধনা। নারী-পুরুষের অস্তিত্ব এখানে প্রাথমিক পর্যায়ে দ্বৈত। পরে অদ্বৈত। জগৎসংসারে নারী ও পুরুষ-সত্তার এই দ্বৈত থেকে অদ্বৈতে ঘোরাফেরা অত্যন্ত স্বাভাবিক। এক অথচ ভিন্ন। ভিন্ন অথচ এক। বায়ুমণ্ডল ও প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করছে পরস্পরকে। মনের দেহ আর দেহের মনের সঙ্গে এখানে কোনও বিবাদ নেই। বিকাশের পথে নেই কোনও অন্তরায়।

এমনিতেই বিশ্বের দিকে তাকালে মনে হয়, রক্ষণাবেক্ষণ না করা আস্তরণ চটা একটা বাড়ির মতো কাঠামো। দেয়ালে ফাটল ধরেছে। ছাদ ফুঁড়ে বর্ষা নামছে ঘরে। গাদাগাদি করে তার মধ্যে কোনওরকমে বাঁচছে মানুষ। নিজেদের মধ্যে রোজ ঝগড়া। রোজ মারামারি, খুন জখম। আর স্মার্ট ফোনের দুনিয়ায়: কোনও ফোরাম বা নিউজ চ্যানেল আয়োজিত পেপ-টকের কোনও ভিডিও, সোশ্যাল মিডিয়ার নোটিফিকেশনে এসে ভিড়লে, আমরা দেখি, শুনি, মহারাষ্ট্রের নির্বাচন কমিশনের ‘গুডউইল অ্যাম্বাসাডার’ সে-ই সমাজকর্মী, হিজড়া-মায়ের কাহিনি। আমরা সে-ই ভিডিও, একজন ‘ট্রান্সজেন্ডার’-এর জীবনকে, লাইক ও শেয়ার করি ‘হ্যাপি মাদার্স ডে’ লিখে। তারপর, ফোন থেকে মুখ তুলে ভুলে যাই। বাড়িসুদ্ধ সবাই মিলে দেখি—কোনও এক পণ্যের বিজ্ঞাপন। যেখানে এক মেয়ে বলছে তার মায়ের কথা, বাড়ির অনেকেই সে-ই মা ও মেয়েকে চেনে না, কেউ তাদের চেনাবার চেষ্টাও করে না। তারা বরং মিল খুঁজে পায়, তাদের মাথায় থাকে, রামবাবুর মেয়ে-মেয়ে ছেলেটা, বা যদুবাবুর ছেলে-ছেলে মেয়েটার কথা। যে পরিবার পরিজনের থেকে দূরে সরে গিয়ে, নিজেকে মেয়ে বা ছেলে হিসাবে মেনে নিয়ে বাঁচতে চাইছে নিজের মতো করে। বিজ্ঞাপনের ‘মানবিকতা’ বায়বীয় হয়ে উবে যায় পণ্যের বিপণনে। পাড়া-ঘরের ফিসফিসানিতে মুখটেপা হাসিতে চলতে থাকে সে-ই মা’কে নিয়ে চাররকম খেউড়। এতখানি আধুনিক হওয়ার পরেও, মানুষ হিসেবে এ যদি তার ‘বিনোদন’ হয়—মানুষ হিসাবে কীসে তার অনুশোচনা ও লজ্জাবোধ জাগে? এ প্রশ্নের কোনও উত্তর কি জানা আছে কারও?

 
 

 

লেখায় সহায়ক অন্যান্য গ্রন্থ ও ওয়েবপেজ লিংক:

মনুসংহিতা
পঞ্চোপাসনা, জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
গীতা, জগদীশ চন্দ্র ঘোষ
অন্য এক রাধা, শক্তিনাথ ঝা
রবীন্দ্ররচনাবলী, পঞ্চদশ খণ্ড, পঞ্চভূত, ‘বৈজ্ঞানিক কৌতূহল’, ভাদ্র-কার্তিক, ১৩০২
Conundrum, Jan Morris, Faber, 1974.
https://www.britannica.com/science/embryo-human-and-animal
https://bn.encyclopedia-titanica.com/significado-de-eunuco
https://www.techtunes.co/reports/tune-id/285373