কয়েক বছর আগের কথা। ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়নের এশিয়া পেসিফিক মিটিং দক্ষিণ কোরিয়ার দেজং শহরে অনুষ্ঠিত হবে। আমায় খবরটা দিলেন, অধ্যাপক অমলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বললেন, একটা পেপার পাঠিয়ে দাও। একসাথে যাব। অগত্যা। টিকিটটা একসাথেই কাটতে হয়। আমি ইতস্তত করছি, তখনও আমার ট্র্যাভেল গ্রান্ট মঞ্জুর হয়নি। বললাম, স্যর, আপনি টিকিট কেটে নিন। আমার একটু দেরি হবে। যাই হোক, অবশেষে পৌঁছলাম। এয়ারপোর্ট থেকে বাসে করে হোটেলে গিয়ে ঢুকতে রাত হলো অনেকটাই। সঙ্গে যা ছিল খেয়ে শুয়ে পড়েছি। ভোরে ঘুম ভাঙল, হোটেল লা মিয়া-র ন’তলা থেকে দেজং শহরকে দেখলাম। আকাশে মেঘ। সকালের জলখাবারের জন্য নীচে নামলাম যখন, দেখলাম, স্যর রিসেপশনে ঘরের চাবি জমা দিচ্ছেন। পরনে হলুদ রঙের একটি জামা। নিতান্ত কাকতালীয় একটি সংযোগ যে, একই হোটেলের এগারো তলায় তিনি এবং ন’তলায় আমি। পরবর্তী সাতটি দিন আর কাছছাড়া হইনি তাঁর। ২০২০-র মিটিংটা অস্ট্রেলিয়ায় হবার কথা ছিল। প্রায় এক বছর আগে থেকে উনি বলে আসছিলেন, যাবার কথা। তারপর অতিমারীর প্রভাবে সব বাতিল হয়। গৃহবন্দি দশাটা তাঁর একেবারেই ভালো লাগছিল না—ফোনে সেই উতলা ভাব টের পেয়েছি। কিন্তু কখনোই মনে হয়নি এভাবে উনি চলে যাবেন।

অমলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় হাওড়া জেলার মানুষ। গ্রামের নাম মুগকল্যাণ। গ্রামের স্কুলে পড়াশোনা শেষ করে বেনারস পাড়ি। সেখানে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফলিত গণিতে এমএসসি। বিশেষ পাঠ্য বিষয়—জ্যোতির্বিজ্ঞান। এই তাঁর জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার শুরু। বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নটিক্যাল অ্যালম্যানাক ইউনিট। এই প্রতিষ্ঠানে ১৯৫৬ সালে যোগ দিলেন অধ্যাপক বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর গবেষণার বিষয় পজিশনাল অ্যাস্ট্রোনমি বা অবস্থানিক জ্যোতির্বিজ্ঞান। ’৬৮ সালে পুরো ইউনিটের দায়িত্বভার তাঁর কাঁধে ন্যস্ত হয়। দীর্ঘ বারো বছর তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে সংস্থাটি এক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। ’৮০ সালে সংস্থার নতুন নাম হয়—পজিশনাল অ্যাস্ট্রোনমি সেন্টার। এই আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের তিনিই প্রথম অধিকর্তা বা ডিরেক্টর। এই সময়ে তিনি লক্ষ করেন, অনেকেই এই প্রাচীনতম বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে উৎসাহী কিন্তু অনভিজ্ঞ। ১৯৮৮ সালে অবসর গ্রহণের সময় তিনি স্থির করেন সাধারণের মধ্যে জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেবেন।

পজিশনাল অ্যাস্ট্রোনমি সেন্টার থেকে অবসর নেবার পর তিনি যোগ দেন এম. পি. বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়ামের গবেষণা বিভাগে। সেই সঙ্গে চলতে থাকে গ্রামেগঞ্জে জ্যোতির্বিজ্ঞানকে জনপ্রিয়করণের কাজ। ব্যাগে ভরা থাকত স্লাইড-প্রোজেক্টর। কখনও কখনও পর্দাও নিয়ে যেতে হতো সঙ্গে। প্রযুক্তির পরিবর্তনে, সঙ্গী হলো পেনড্রাইভ আর পিপিটি ফাইল। আগ্রহ নিয়ে যে-কোনো সংস্থা ডাকলেই হলো, ট্রেন বা গাড়ি করে পৌঁছে যেতেন। আর এসবের পাশাপাশি ছিল জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ে প্রবন্ধ ও গবেষণাপত্র লেখা। বাংলা ও ইংরাজি ভাষা মিলিয়ে আড়াই হাজারের মতো প্রবন্ধ রয়েছে তাঁর। প্রকাশিত গবেষণাপত্রের সংখ্যা ২২৫টি। দেজংয়ে যে পেপারটি তিনি পড়েছিলেন, তার নাম—‘The zero-point of the Zodiac of the Hindu astronomers in ancient India’ I

আজীবন জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ে চর্চার সুবাদে অধ্যাপক অমলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় দেশীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃতি পেয়েছেন অনেক। ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়নের সদস্যপদ, রয়াল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির ফেলোশিপ, ব্রিটিশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির সদস্যপদ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে জগত্তারিণী স্বর্ণপদক, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে ডি. এসসি উপাধি এবং ১৯৯৫ সালে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার।

রেডিও, টেলিভিশনে তাঁর অনুষ্ঠান বড়ই জনপ্রিয় ছিল। প্রাঞ্জল ভাষায় জ্যোতির্বিজ্ঞানের জটিল বিষয়গুলো যখন ব্যাখ্যা করে দিতেন, মনে হতো কত সহজ। ব্যক্তিগত স্তরে তিনি ছিলেন পরিচিত সকলের আপনজন। আমার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হ্যালির ধূমকেতু দেখা পাবার পরপরই। আমাদের গ্রামে উনি এসেছিলেন বক্তৃতা দিতে, সেই আলাপ। তারপর আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে পড়া। পরিবারের একজন হয়ে ওঠা। এরপর বহুবার তিনি এসেছেন, হাওড়া-কাটোয়া লোকাল ট্রেনে। আমরা কয়েকজন ওঁর অপেক্ষায় থাকতাম স্টেশনে, আমাদের কাছে তিনি ধূমকেতুর মতোই উজ্জ্বল এক জ্যোতিষ্ক। তিনি নানা বিষয়ে কথা বলতেন। আমরা প্রোজেক্টর-স্লাইডের ব্যাগ নিয়ে মেঠো-পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে সে সব শুনতাম। রাতে, খেলার মাঠের গোলপোস্টে টাঙানো হতো পর্দা। ধূমকেতু কী?—অসাধারণ সব ছবি দিয়ে ব্যাখ্যা করেছিলেন অধ্যাপক বন্দ্যোপাধ্যায়। আমার ওপর দায়িত্ব ছিল স্লাইড বদলানোর। কোনও কোনও স্লাইড দেখতে গিয়ে বিস্ময়ে চোখ-হাত সরত না। মনেই থাকত না স্লাইড বদলাবার কথা। ঘোর ভাঙলে শুনতে পেতাম, অধ্যাপক বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন—নেক্সট স্লাইড প্লিজ!


২.

ধীরস্থির নিয়মানুবর্তী জীবনে, পরিচিত পাড়া প্রতিবেশীর মাঝে হঠাৎ ‘উৎপাত’ বা অচেনা অতিথির মতো আকাশে যে জ্যোতিষ্কের আবির্ভাব, দৃষ্টিসীমায় কিছুদিন থেকে বিদায় নেওয়া যার স্বভাব, তাকে, ধূমকেতু বলা হয়। প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রে ধূমকেতুর সঙ্গে আরও দু-প্রকার কেতুর উল্লেখ আছে, শব্দকল্পদ্রুমে—‘কেতবো হ্যত্র দৃশ্যন্তে বারুণাস্ত্রয় এব তে।/ ঊর্ম্মিকেতুঃ শ্বেতকেতুঃ ধূর্মকেতুঃ স্তৃতীয়ক।।’

১৪৫৬ সাল। আকাশে অনেকটা সময় ধরে ধূমকেতু বিরাজমান। তুর্কিদের আক্রমণে বাইজ়েনটাইনের পতন আসন্ন। রোমে পোপ তৃতীয় ক্যালিকস্টাস প্রার্থনা সভা আহ্বান করলেন। সেই সভায় তুর্কিদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার যেমন আকুতি ছিল, তেমনই ছিল ধূমকেতুর হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রার্থনা। ধূমকেতুটি আপন গতিতে এসে চলেও গেল। গ্রিসে যুক্তিশালী জ্ঞানী মানুষের মনে তখনও ধূমকেতু একটা জ্যোতিষ্ক মাত্র। তবে কেন মাঝে মাঝে তার দেখা পাওয়া যায় সে সম্পর্কে কোনও ব্যাখ্যা তখন ছিল না।

এই ব্যাখ্যার জন্য অপেক্ষা করতে হলো নিউটন, এডমন্ড হ্যালির সময় পর্যন্ত। হ্যালির ছিল আকাশ দেখার শখ। সেইভাবেই তিনি দেখলেন, এক রাতে ধূমকেতু। ঝাঁটার মতো লেজ। উজ্জ্বল একটি জ্যোতিষ্ক। খুব ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলেন। পর্যবেক্ষণ লব্ধ ফল খাতায় পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে লিখে রাখলেন। সন্দেহ ছিল, নিউটনের গতিসূত্র দিয়ে কি ধূমকেতুর গতির ব্যাখ্যা করা সম্ভব হবে? হ্যালি নিউটনের গতিসূত্র প্রয়োগ করেই অঙ্ক কষে বললেন, ধূমকেতুটি ফিরে আসবে ৭৬ বছর পর। তাই এসেছিল। ততদিন অবশ্য হ্যালি ছিলেন না। কিন্তু তিনি একটি নতুন যুগের সূচনা করে দিয়ে গেলেন, ধূমকেতুর গতির গণনা পদ্ধতির। হ্যালির সময় থেকেই ধূমকেতুর বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা শুরু হয়।

ধূমকেতুর উৎপত্তি নিয়ে বিভিন্ন বিজ্ঞানী নানা মত পোষণ করতেন। সে-ই মতগুলিকে সাধারণীকরণ করে যে তত্ত্বটি এখন প্রচলিত সেটি হলো ধূমকেতুর উৎপত্তি হয়েছে সৌরজগৎ সৃষ্টির সময়েই। সৃষ্টি-পদ্ধতিও ছিল একরকম। সৌরজগৎ সৃষ্টির সময়ে শুধু যে গ্রহগুলি তৈরি হয়েছিল তাই নয়, ছোট বড় অনেক বস্তুপিণ্ড সৌরজগতের বাইরের দিকে তৈরি হয়েছিল। তাদের দেহে বরফের ভাগই ছিল বেশি। এই বস্তুপিণ্ডগুলিকেই ধূমকেতুর প্রাথমিক-রূপ ধরা হয়। ধূমকেতুগুলির ভর খুব বেশি না হওয়ার কারণে হাইড্রোজেন, হিলিয়ামের মতো গ্যাস যেগুলি জমে গ্রহদের আবহমণ্ডলে রয়ে গিয়েছিল, ধূমকেতুগুলির তেমন কোনও আবহমণ্ডল তৈরি হয়নি। গ্যাস, ধূলিকণায় গ্রহগুলি যখন নিজেদের ভর বৃদ্ধি করল, তাদের মাধ্যাকর্ষণ বল যখন অনেক বেড়ে গেল, তখন এই গ্রহগুলিই ধূমকেতুর গতিপথকে প্রভাবিত করতে লাগল। তৈরি হলো ধূমকেতুদের দু-ধরনের কক্ষপথ। গ্রহদের কক্ষপথ উপবৃত্তাকার। কেপলার অনেক আগে সে-কথা প্রমাণ করেছেন। এই উপবৃত্তে দুটি বিন্দু পরাক্ষের ওপর অবস্থান করে, সেগুলিকে নাভি বলে। পৃথিবী এবং অন্যান্য গ্রহের আবর্তনের ক্ষেত্রে সূর্য থাকে গ্রহের উপবৃত্তাকার কক্ষপথের একটি নাভিতে। উপবৃত্তটি কতটা চ্যাপটা সেটি নির্ণীত হয় একটি রাশি দিয়ে, যার নাম উৎকেন্দ্রতা। উৎকেন্দ্রতা মাপা হয় নাভি দুটির ভিতরের দূরত্ব এবং পরাক্ষের দূরত্বের অনুপাত দিয়ে। উপবৃত্তের উৎকেন্দ্রতার মান 0.0016 এবং ধূমকেতুর ক্ষেত্রে 0.2 গড় মান। কোনও কোনও ধূমকেতুর উৎকেন্দ্রতার মান অনেকটাই বেশি হয়। যেমন, 0.967 হলো হ্যালির ধূমকেতুর কক্ষপথের উৎকেন্দ্রতা।

ধূমকেতুর কক্ষপথ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উপবৃত্তাকার যার একটি নাভিতে সূর্যের অবস্থান। প্রদক্ষিণ করার সময় যখন সে সূর্যের কাছে চলে আসে যাকে অনুভূ অবস্থান বলে, তখনই সে দৃশ্যমান হয়। যখন অন্য প্রান্তে চলে যায়, তখন আর তার দেখা মেলে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ধূমকেতুর কক্ষপথ উপবৃত্তাকার হলেও অনেকক্ষেত্র এটি অধিবৃত্তাকার অথবা পরাবৃত্তাকার হয়। অধিবৃত্তের ক্ষেত্রে উৎকেন্দ্রকেতার মান (=1) এবং পরাবৃত্তের ক্ষেত্রে (>1)। আর এই কক্ষপথের ভিত্তিতে ধূমকেতুরা দু-ভাগে বিভক্ত—হ্রস্ব-পর্যায়ের ধূমকেতু (যেমন, হ্যালির ধূমকেতু) ও দীর্ঘ-পর্যায়ের ধূমকেতু (যেমন, নিও-ওয়াইজ)। যাকে গত বছর (২০২০) উত্তর-পশ্চিম আকাশে দেখা গিয়েছিল। হ্রস্ব-পর্যায়ের ধূমকেতুর পর্যায়কাল দুশো বছরের কম। এদের ঘোরাফেরা সৌরজগতের গ্রহদের ভিতর। স্বভাবতই গ্রহরা এগুলোর ওপর বেশি প্রভাব খাটাতে চায়। এই ধরনের ধূমকেতুর কক্ষতল এবং পৃথিবীর কক্ষতলের মধ্যে কৌণিক পার্থক্য খুব জোর এগারো ডিগ্রি। এই ধূমকেতুদের ঘোরার পথ উপবৃত্তাকার। উপবৃত্তাকার পথে ঘোরা ধূমকেতুগুলোর মেয়াদ দীর্ঘও হতে পারে। হ্রস্ব-পর্যায়ের ধূমকেতুদের মধ্যে এঙ্কের ধূমকেতু (Enck’s) মাত্র ৩.৩ বছরে একবার সূর্যকে পরিক্রমণ করে। নিও-ওয়াইজ একটি দীর্ঘ-পর্যায়ের ধূমকেতু। হেল-বপ যাকে ১৯৯৭ সালে অনেকেই দেখেছেন। এটিও একটি দীর্ঘ-পর্যায়ের ধূমকেতু। এই ধরনের ধূমকেতুর কক্ষপথের উৎকেন্দ্রতা খুব বেশি। এদের অনুভূ দূরত্ব মানে সূর্যের কাছাকাছি অবস্থানের দূরত্ব এক অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিটের মতো আর অপভূ অবস্থান মানে সূর্য থেকে দূরতম অবস্থান 10,000 A.U. বা তার বেশি। বর্তমান তত্ত্ব অনুযায়ী 10,500 A.U. থেকে 50,000 A.U. দূরত্বে সৌরমণ্ডলকে ঘিরে অনেক ধূমকেতু রয়েছে। ওই অঞ্চলকে বলা হয়—‘উর্ট মেঘ’ (Oort Cloud)। ১৯৫০ সালে আয়ান উর্টের তত্ত্বানুসারে এমন নাম। এই অঞ্চলটি সূর্য থেকে অনেক দূরে থাকায় সূর্যের মাধ্যাকর্ষণের প্রভাব এতদূর পৌঁছোয় না। তবে সূর্যের মাধ্যাকর্ষণ ছেড়ে বেরিয়েও যায় না। এদের নিজস্ব গতি, সূর্যের আকর্ষণ এবং গ্রহের আকর্ষণের সামান্য প্রভাবে এগুলিকে আপাত স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে সাহায্য করে। মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সিতে সব তারাদের এক আপেক্ষিক গতি আছে। যখন এই আপেক্ষিক গতির প্রভাবে কোনও তারা সূর্যের সাপেক্ষে যদি কম দূরত্বে অবস্থান করে, তবে তার মাধ্যাকর্ষণের প্রভাবে উর্ট মেঘ আলোড়িত হয়। ধূমকেতুদের মধ্যে বিক্ষিপ্ত ছুটোছুটি শুরু হয় এবং তার ফলে কয়েকটি ধূমকেতু সৌরজগতের দিকে ধাবিত হয়। কোনও কোনও গ্রহের মাধ্যাকর্ষণের প্রভাবে সে-ই গ্রহের ধূমকেতু হিসাবে সেটি ঘুরে বেড়ায়। কোনওটি আবার একবার ঘুরে ফের নিজের জায়গায় ফিরে যায়।

গ্রিক কমিটিজ শব্দের অর্থ-কেশময়। ধূমকেতুর লেজ কেশগুচ্ছের মতো বলে তাঁরা নাম দিলেন কমিটিজ। ইংরাজিতে কমেট। ধূমকেতুর দুটি অংশ—মাথা আর লেজ। মাথার কেন্দ্রে থাকে কেন্দ্রক। কেন্দ্রককে ঘিরে থাকে গ্যাস ও বাষ্পের আবরণ, যাকে বলা হয়—কোমা। ধূমকেতুর লেজ নানারকম হয়। গঠন অনুসারে কোনওটা প্লাজমা, কোনওটা ধূলি। আকার অনুসারে বিপরীত, নিও-ওয়াইজের লেজ যেমন দ্বিধাবিভক্ত। ধূমকেতু আকাশে তখনই দেখা যায় যখন সেটি একটি নূন্যতম ঔজ্জ্বল্য পায়। কিন্তু এই ঔজ্জ্বল্য পাওয়ার আগেই কেন্দ্রকটি ঢেকে যায় ধুলোয়। হ্যালির ধূমকেতু পৃথিবীর কাছাকাছি ১৯৮৬ সালে এসেছিল। তখন বিজ্ঞানীরা আমাদের জানিয়েছিলেন, ধূমকেতুটির কেন্দ্রকের ভর 1017g ও গড় ঘনত্ব 1.1gm/cc এবং গড় ব্যাস পাঁচ কিলোমিটার। ধূমকেতুটি যখন সূর্যের 5 A.U. দূরত্বের মধ্যে আসে তখন কঠিন বরফ বাষ্পীভূত হওয়ার ফলে কেন্দ্রককে ঘিরে গড়ে ওঠে গ্যাসের গোলক। এই গোলকের ব্যাস এক লক্ষ কিলোমিটার পর্যন্ত হয়। কোমা-র ভেতরে পাওয়া যায় জলীয় বাষ্প, অ্যামোনিয়া, মিথেন। সূর্যের তীব্র প্রভাবে এই যৌগগুলি ভেঙে কোমা-র চারিদিকে তৈরি হয় হাইড্রোজেনের আবরণ। এই আবরণের ব্যাস কয়েক লক্ষ কিলোমিটার পর্যন্ত হয়।

সূর্য থেকে সবসময় তীব্রগতির বস্তুকণা নির্গত হয়। একে বলে সৌরবায়ু। সঙ্গে আসে আলো অতিবেগুণী রশ্মি যা কোনও বস্তুর ওপর পড়ে চাপ সৃষ্টি করে। সৌরবায়ু ও বিকিরণের চাপে ধূমকেতুর গ্যাস ও ধূলিকণার আবরণ বিপরীত লেজের সৃষ্টি করে। ধূমকেতু সূর্যের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় লেজটি ও তার অবস্থান অনুযায়ী ঘুরে ঘুরে যায়। আয়ন লেজ সচরাচর দেখা যায় না। কার্বন মনো-অক্সাইড আয়ন এবং আয়নিত জলীয় বাষ্প দিয়ে তৈরি হয় প্লাজমা লেজ বা আয়ন লেজ। এইভাবে গঠিত লেজ ধূমকেতুর মধ্যে আর মিশে যায় না। তার প্রত্যেক প্রদক্ষিণের সময় ধূমকেতুর ভর কিছুটা করে হ্রাস পায়। যেমন, যে ধূমকেতু হ্যালি দেখেছিলেন; আর আমরা ১৯৮৬ সালে যে ধূমকেতু দেখলাম, সেটির ভর হ্রাস পেয়ে তার ঔজ্জ্বল্য অনেকটাই খুইয়েছে।

নিও-ওয়াইজ মিশনের কাজ হলো স্পেস টেলেস্কোপ ব্যবহার করে গ্রহাণু ও ধূমকেতু পর্যবেক্ষণের কাজে নিয়োজিত থাকা। Wide-field Infrared Survey Explorer (WISE) নাসার একটি ইনফ্রারেড স্পেস টেলেস্কোপ। এটিকে ২০০৯ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে কার্যকরী করা হয়। প্রথমে ঠিক করা হয়েছিল এটিকে ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত কার্যক্ষম রাখা হবে। কিন্তু ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এটিকে ফের নতুন করে কার্যকরী করে তোলা হয়। তবে সে জন্য ‘নিও’ শব্দটি প্রয়োগ করা হয়নি। এটির নতুন কাজ হলো পৃথিবীর কাছাকাছি থাকা বস্তুদের খুঁজতে থাকা—Near Earth Objects থেকে ‘নিও’ কথাটি এসেছে। নিও-ওয়াইজ এখনও পর্যন্ত (মার্চ ২০২০) ৩৪,০০০ নতুন গ্রহাণু দেখেছে, যার মধ্যে ১৩৫টি পৃথিবীর কাছাকাছি। ১৫৫টি ধূমকেতু দেখেছে, যেগুলির মধ্যে ২১টি নতুন। নিও-ওয়াইজ ধূমকেতু হিসাবে আমরা যার ছবি দেখছি, নিজেদের ছোট টেলিস্কোপ বা বাইনোকুলার দিয়ে দেখার চেষ্টা করেছি, তার টেকনিক্যাল নাম হলো—সি/২০২০ এফ থ্রি। ধূমকেতুটিকে নিও-ওয়াইজ প্রথম দেখে—২৭ মার্চ, ২০২০ তারিখে। এর ব্যাস পাঁচ কিলোমিটার। বেগ প্রায় দু লক্ষ একত্রিশ হাজার কিলোমিটার (প্রতি ঘণ্টা)। তবে এই বেগ সূর্য থেকে যত দূরে সরবে, কমতে থাকবে। প্রতিসুর অবস্থানে হবে সর্বনিম্ন। তবে আমরা আর কোনওদিনই এই ধ্রুবতারাকে দেখতে পাবো না, কারণ আবার প্রায় ১৮০০ বছর পর এই ধূমকেতু দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা।


৩.

বৈদিক শাস্ত্র ভারতের প্রাচীনতম লিখিত প্রমাণ। ভারতের অতীত জ্ঞান সম্পর্কে ধারণার জন্য গবেষকরা প্রথম আশ্রয় নেন বেদ গ্রন্থে। তবে এ কথা সত্যি বৈদিক সময়ে জ্ঞানের সম্প্রসারণ হতো মৌখিক উপায়ে। পরে লিপি, লেখার মাধ্যম এলে স্থায়ী হতে শুরু করে জ্ঞান। ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাস চর্চায় শুরু থেকে পাঁচটি গ্রহ এবং তাদের গতি, দিন-রাত্রি-যুগের হিসাব, গ্রহণ ইত্যাদি আলোচিত হয়েছে।

বৈদিক শাস্ত্রর পাশাপাশি রামায়ণ, মহাভারতেও ধূমকেতুর উল্লেখ পাওয়া যায়। বৈদিক আমল থেকে সনাতনী সময় পর্যন্ত ধূমকেতুকে আগুন হিসাবেই চিহ্নিত করা হতো, কোথাও আবার বলা আছে ধূমকেতু আগুন উদ্‌গীরণ করছে। ঋগ্‌বেদে উল্লেখ রয়েছে—’হরয়ো ধূমকেতবো বাতজুতা উপদ্যবি। যতন্তে পৃথগগ্নয়ে।’ (৮. ৪৩. ৪)। অর্থাৎ বিচিত্র বর্ণের ধূমকেতু নানা পথে আগুন ছড়িয়ে আকাশে বিচরণ করে।

তবে আমাদের প্রাচীন শাস্ত্রকারেরা যেমন যে-কোনো বিষয়ের ব্যাখ্যা সরাসরি করতেন না, এক্ষেত্রেও তেমনই পরিচয় পাওয়া যায়। যেমন, ঋগ্‌বেদ (৭.৩৩) উল্লেখ পাওয়া যায় ধূমকেতুর উৎপত্তি প্রসঙ্গে, এখানে ধূমকেতুকে বশিষ্ঠ-পুত্র হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। লেখা হয়েছে, বহুবর্ণ ধূমকেতু আকাশে ভ্রমণ করছে এবং আগুন ছড়াচ্ছে (১.৫.৪)। কিংবা, ’প্রতিকেতবঃ প্রথমা অদৃশ্যন্।/ প্রকেতুনা বৃহতা পাত্যগ্নি।।’—অর্থাৎ, ধূমকেতুকে প্রথম দেখা যায়। পরে আগুনকে দেখা যায় ধূমকেতুর সঙ্গে। অথর্ববেদে এরকমই একটি শ্লোক পাওয়া যায়। ধূমকেতুর রং সেখানে ব্যাখ্যা করার পাশাপাশি, নাম দেওয়া হয়েছে—’অরুণ কেতবঃ’। সে সময়ের পর্যবেক্ষণ থেকে এও জানা যায়, সূর্য আলো দেয় এবং ধূমকেতু ছড়ায় তাপ। সৌর পুরাণে ধূমকেতুর উদয় দাবানলের মতো ধরা হয়েছে—’কেতবশ্বোদিতাঃ সর্বেজৃম্ভন্তইব পাবকা।’

রামায়ণে ধূমকেতুর বর্ণনা স্পষ্ট দেওয়া আছে। আখ্যান অনুযায়ী রাম-রাবণের যুদ্ধের (যুদ্ধকাণ্ড, ৬.৪.৬) সময় মূলা নক্ষত্রমণ্ডলীতে ধূমকেতুকে দেখা গিয়েছিল। রোহিণী একটি ধূমকেতুর দ্বারা অদৃশ্য হয়েছিল। এই ধূমকেতুটিকে দেখাচ্ছিল যেন একটি গ্রহ—‘ধূপ্যমানাং গ্রহণেব রোহিণী ধূমকেতুনা।’ (৫.১৭.৮)। একইরকমভাবে মহাভারতের আখ্যানে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময়েও ধূমকেতুর আবির্ভাব হয়েছিল। পুষ্যা নক্ষত্রমণ্ডলীতে এই ধূমকেতু দেখা গিয়েছিল—‘ধূমকেতুঃ মহাঘোরঃ পুষ্যাংচাক্রম্য তিষ্ঠতি।’ (ভীষ্মপর্ব, ৬.৩.১২)। আবার আদিপর্বে ধূমকেতুকে অগ্নি হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে—’ধূমকেতুর্হুতাশনঃ’ (১.২১৬.১)।

সংস্কৃত সাহিত্য থেকে কয়েকটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হতে পারে। যেমন, হরিবংশ-তে বলা হচ্ছে—‘কেতুনা ধূমকেতোস্তু নক্ষত্রাণি ত্রয়োদশ।/ ভরণ্যাদিনি ভিন্নানি নানুয়ানি নিশাকরম।।’ আবার অদ্ভুতসাগর-এ লেখা হচ্ছে—ধূমকেতোর্ন দিঙনিয়মঃ কেবলং সংবর্ত কেতোরুদয়মাহ্।’ অদ্ভুতসাগর-এ ধ্রুবকেতুর উল্লেখ আছে, যেটি এক প্রকারের ধূমকেতুই—’ধ্রুবকেতুরনগয়তগতি প্রমাণবণা কৃতির্ভবতি বিঙ্বক্।/দিব্যান্তরিক্ষভৗমৌ ভবত্যয়ং স্নিগ্ধ ইষ্টফলম্।।’

ধূমকেতুর সঙ্গে অশুভ ঘটনার যোগসূত্রের কথা প্রাচীন মানুষেরা যে বিশ্বাস করতেন, এর কারণ আমাদের শাস্ত্রকারেরা। রচয়িতারা যখন ধূমকেতুর অস্তিত্ব টের পাচ্ছেন, তখন তাঁরা যে অঞ্চলে বসবাস করেন বা তাঁদের বসবাসের আশপাশের অঞ্চলে হয় যুদ্ধ হচ্ছে, না হয় মহামারী। এই উল্লেখ থেকে সহজেই অনুমেয় কেন ধূমকেতুকে ধ্বংসের কারণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। ‘নারদসংহিতা’য় যেমন দেখতে পাওয়া যায়—‘কৃত্তিকাসু সমুভ্দুতো ধূমকেতুঃ প্রজান্তকৃং।’—অর্থাৎ, কৃত্তিকা নক্ষত্রমণ্ডলীতে ধূমকেতু দেখা দিলে সেটি জনজীবন ধ্বংসের কারণ হয়। ধারণায় নিশ্চয়ই তা আধুনিক ব্যাখ্যা থেকে পৃথক। কিন্তু পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী সে-ই সময়ে যে ধূমকেতুর অস্তিত্ব, গতিপথ ধরা পড়েছিল—তাকে অস্বীকার করার উপায় নেই।

আধুনিক বিজ্ঞানের তত্ত্ব অনুযায়ী ধূমকেতু বাষ্পীভূত হাইড্রোকার্বন দ্বারা গঠিত। ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে স্যর উইলিয়াম হুগিন্‌স স্পেকট্রোস্কপি বা স্পেকট্রাম বিশ্লেষণ করে জানতে পারেন এই হাইড্রোকার্বনের কথা। তিনি রেখার মধ্যে ক্ষার ও লৌহের বাষ্প কণিকারও সন্ধান পেলেন। অনেক বিজ্ঞানীদের মতে ওই বাষ্প থেকে সিয়ানোজোন নামের একটি বিষাক্ত বাষ্প নিঃসৃত হতে থাকে। ওই বাষ্পে সূর্যালোক প্রতিফলিত হলে ধূমকেতুকে স্পষ্ট বোঝা যাবে। সুতরাং আধুনিক বিজ্ঞানে এটি প্রমাণিত যে ধূমকেতুর নিজের কোনও কিছু ধ্বংস করার ক্ষমতা রাখে না।


তথ্য-সহায়ক গ্রন্থ:
Ancient Indian Knowledge about Comets, V. D. Wagh, TIFR, 1989
ধূমকেতু, রাধাগোবিন্দ চন্দ, পুথিপত্র, কলকাতা, ১৯৯৫
ধূমকেতু, ব্রেক থ্রু সায়েন্স সোসাইটি, কলকাতা, ১৯৯৭



ছবি সৌজন্য: www.newsweek.com   www.jpl.nasa.gov  www.universetoday.com