মধুমিতা,

এমন কিছু ছবি থাকে যা প্রতীক হয়ে যায়—এমন কিছু ছবি থাকে, যা একটা সময়ের সম্পূর্ণ ভার বহন করে চলে। গত বছর এই সময়টায় অভূতপূর্বভাবে নেমে এসেছিল ন্যাশনাল লকডাউন… ১৪ দিন ২১ দিন পেরোতে পেরোতে সে-ই লকডাউন স্থায়ী হয়েছিল প্রায় মাস ছয়েক। আর সব মিলিয়ে সব কিছু স্বাভাবিক হতে লেগে গেছে প্রায় একটা গোটা বছর। অবিশ্যি সব কিছু নর্মাল হয়েছে কি? গালভরা এক নতুন শব্দবন্ধ এসেছে বাজারে—নিউ নর্মাল। বায়ো বাবল, সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং সহ নানাবিধ নতুন শব্দবন্ধ আমাদের রোজকার জীবনে ঢুকে পড়েছে এই ক’দিনে। জীবনকালে এমন কিছুই আমরা আগে দেখিনি, দেখবো এমন সামান্যতম আভাসও কখনও পেয়েছি বলে মনে হয় না—সবকিছু বন্ধ, সব! দোকানপাট, বাজার, স্কুল, কলেজ, ব্যাংক, বাস, ট্রেন—যা কিছু মনে হতো না কখনোই বন্ধ হওয়া সম্ভব বলে, সে-ই সবকিছুই বন্ধ হয়ে গেছিল, এক মহানাটকীয় ভাষণের অব্যবহিত পরেই। কোলাহলময় সদা ছুটতে থাকা একটা পৃথিবী যেন ঝুপ করে নিভে গিয়েছিল চোখের সামনে। ভয়-আতঙ্ক-ত্রাস–ত্রস্ত মানুষের ভিড়—ভিড়… নাকি আমরা, মধ্যবিত্তেরা, সেঁধিয়ে ছিলাম যে যার নিজস্ব কোটরে!

উচ্চবিত্তের ছাড়ছিড়েন নিয়মনীতি কিঞ্চিৎ আলাদা—তারা কখন বেরোন কখন ঢোকেন সচরাচর সে-ই খবর আমরা পাই না। না, মানে পাই যতটুকু তারা পাওয়াতে চান, আমরা পাই; কিন্তু এর বাইরের যে দেশ, এর বাইরের যে জমি—তারা কোথায়? তাদের কী হলো? এই অস্থিরতা পেরিয়ে বাইরে যে আসবো, এমন একটা স্থবির সময়ে সে সব কিছুই ঘটেনি। এর মধ্যেই সে-ই খবর—ছবি! মানুষ কী না পারে? মানুষের না পেরে কী উপায়ই বা আছে? দল দল মানুষ কেউ পায়ে হেঁটে কেউ সাইকেলে পাড়ি দিয়েছে ‘দেশে’ ফিরবে বলে। দিল্লি ফেরত কারুর দেশ মালদার কোনও প্রান্তিক গ্রাম, পুনে ফেরত কারুর দেশ বিহারের কোনও ঘুপচি-পল্লি, মফস্‌সল। সে এক আশ্চর্য সময়! মধুমিতা! মানুষ মানুষকে দেখলে ভয় পায়, এড়িয়ে চলে। বাড়ি ফিরলে বাড়ির লোক খোঁজ করে—কাউকে কোনওভাবে ছুঁয়ে ফেলোনি তো? হাত স্যানিটাইজ় করেছ তো? কিন্তু রাজপথে নেমে পড়া এই যে অন্য একটা দেশ—একটা কেন, লক্ষ লক্ষ দেশ—তাদের সে সবের বালাই নেই। সদ্য কৈশোর পেরোনো মা কোলে সন্তান নিয়ে পায়ে হেঁটে পাড়ি দিয়েছে ন’শো–হাজার কিলোমিটার।

যে শহর তাকে এতদিন লালন করেছে, যে শহরকে সে লালন করেছে হাত পা বুক রক্ত ঘাম দিয়ে, সে-ই শহরে যদি কোনওরকমে থেকেও যায়, না খেয়ে মরতে হবে। ওষুধ দূরঅস্ত—খাবার নেই! মানুষ খাবার চায়। এদিকে বাজারে বেরোতে পারছে না বলে, একদল মানুষ ক্ষোভ উগরে দিচ্ছে। রাস্তায় কেউ বের হলে তেড়ে আসছে মানুষ। রেশন ডিলার গাল পাড়ছে সরকারকে—সব মানুষকে বিনা পয়সায় চাল গম দেবে বলে দিয়ে সরকার খালাস। এদিকে মাল এসে পৌঁছায়নি গুদামে। এমন এক পাকিয়ে যাওয়া অবস্থায় কীভাবে রিঅ্যাক্ট করতে হয় আমরা কেউই বোধহয় জানতাম না! যে যেমন পারল চেষ্টা করল—করলও না কেউ কেউ! নিঃসাড়ে ঘরবন্দি হয়ে গেল কোটি কোটি মানুষ। রাষ্ট্রনায়কেরা ঘোষণা আর ঘনঘন মিটিংয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তাদের তাই হবার কথা ছিল—কমিউনিকেশন বুম্যের এই আধুনিক সময়ে, নাটক মেলোড্রামায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন এগ্‌জিবিশনিস্ট পলিটিশিয়ানরা। অমুক তুষুক নিষেধের ভিড়েও কেউ, কারা এগিয়ে এসে দাঁড়াতে চাইলেন মানুষের পাশে—খাবার ওষুধ টাকাপয়সা জোগাড় করে যেমন করে হোক দাঁড়িয়ে যাই মানুষের পাশে—এমনটাই তারা ভেবেছিলেন কি? কে জানে!

কত কত কাজে যায় মানুষ শহরে, পেটের ভাত জোগানোর তাগিদে। সমাজ-অজ্ঞ এই আমি ভাবতাম, শুধুই বোধহয় সোনা রুপোর কাজ করতে যায় মানুষ—মুম্বই, দিল্লি, চেন্নাই। কেউ কাঠের কাজেও যায়, কেউ রং করতে যায়, ঝি খাটতে যায় কেউ, কেউ গাড়ি চালায়, কেউ চা বিক্রি করে শহরে গিয়ে, এমনকি চপ পেঁয়াজি বেচে বেঁচে থাকে অন্ধ্রের কোনও নাম না-জানা মফস্‌সলে এমন মানুষও আছে। এই যে এই মানুষেরা—এদের দেশ কি আমার দেশ? আমি কি জানতাম বলো, এরাও থাকে এই দেশে! সাতপাঁচ এটা-ওটা ভাবতাম; অফিসফেরত ট্রেনে এক ফেরিওলার কাছে মাঝেমাঝে চিঁড়েভাজা খেতাম, তার কী হলো? কী হলো সে-ই টোটো চালকদের—যারা প্রতিদিন টানাটানি করতেন, দাদা আমার গাড়িতে আসুন… দাদা আমার গাড়িতে আসুন। চালের পাঁপড় বিক্রি করত এক ছেলে, একটা পা একটু টেনে চলে—তার কী হলো? অস্থির লাগত খুব! অথচ দারিদ্র্য দেখিনি এমন না—সেদ্ধ খুদ খেয়ে দিন কেটেছে কত। বাবার মুখে গল্প শুনেছি, তালের শাঁস ফুটিয়ে খেয়েও নাকি কেটেছে আমাদের দিন। কিন্তু আমাদের দেশ তো সে-ই গ্রাম, যেখানে মানুষ মাঠে কাজ করে—চাষ করে। খেতেখামারে গতর খাটালে পেট কোনওভাবে চলেই যায়। আর কেউ কেউ, একটা ভালো সংখ্যারই মানুষ—মূলত পুরুষ, বাইরে কাজে যায়। মেয়েরা পাচার হয়। পুরুষেরা বছর সাত আট পর ফিরে এসে, কেউ গ্রামে দোকান দেয়—কসমেটিকসের, বাসনপত্রের, মুদিখানার। কেউ ফেরেই না আজীবন। বিয়ে-থা করে থেকে যায়। এক কাজ যায় আরেক কাজ পায়। ভিনদেশী কোনও অভিজাত আবাসনে বাসন মাজে, কাপড় কাচে, বাচ্চার পায়খানা পরিষ্কার করে—এই দেশেরই কোনও এক বধূ, কোনও এক মেয়ে। সে করুক-গে যাক! কিন্তু ‘লকডাউন’ হতেই সে আর খেতে পাবে না? সে আর থাকতে পারবে না?

মধুমিতা! এক অদ্ভুত পৃথিবীতে আশ্চর্য সময়ে বেঁচে ছিলাম, আছি, আমরা! এ দেশের প্রধানমন্ত্রী ভাবেননি দেশের মানুষের কথা, সরকার ভাবেনি আমাদের কথা বলে যারা শোরগোল জুড়েছিল রাস্তায়, তুমি তাদের কেউ নও। প্রতিবাদ বিক্ষোভে যারা ভরিয়ে তুলছিল স্পেস-ভার্চুয়াল—তুমি তাদেরও কেউ না। দিল্লির শিহরন জাগানো নগর থেকে মালদার প্রত্যন্ত আহিল নামের গ্রাম—তুমি কি জানতে দূরত্ব? তুমি কি জানতে—তেরোশো কিলোমিটার পথ হেঁটে যেতে—কত দিন কত রাত কত জীবন সময় লাগে মানুষের? গর্তে ঢুকে পড়া একটা দেশের মানুষের চোখের সামনে গটগট করে বেরিয়ে এল লক্ষ লক্ষ মানুষ—কেউ কিছু বলল না, কেউ কিছু করল না। কেউ হেঁটে-কেউ ট্রাকে-তেলের ট্যাংকারে লুকিয়ে তারা সত্যিই ফিরে চলল—দেশে। সে-ই লক্ষ লক্ষ দেশের কোন দেশে যে কার বাড়ি কে জানে? রুজিরোজগারহীন মানুষের মিছিল দখল নিল রাজপথের—জানো, মরেও গেল কেউ কেউ। কত মানুষ মরে গেল ভোররাতে, ট্রাকের ধাক্কায়—ট্রেনের লাইনে। হঠাৎ, পথে দম বন্ধ হয়ে। মানুষ মরছিল—দেশের মানুষ। ধোঁয়ার ভেতর সাঁতার কেটে যাচ্ছে কেবল এক নতুন শব্দবন্ধ—‘পরিযায়ী শ্রমিক’। আমরা শুয়োরের বাচ্চাদের দেখেছি, অভিজাত আবাসনে লুকিয়ে জবুথবু মেরে বসে যেতে। আমরা দেখেছি, সমাজবিচ্ছিন্ন ভেড়ার দল থালা বাজাচ্ছে রাস্তায়—বাজি পোড়াচ্ছে সলিডারিটি দেখাতে। কীসের সলিডারিটি রে—শুয়োরের বাচ্চারা? কোন সলিডারিটি? যাক-গে, মাথা গরম এক মস্ত অসুখ!

একশো মিলিয়ন—দশ কোটি মানুষ শহরে গঞ্জে নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে পড়ে থাকে কাজের জন্য। জানি না এই হিসেবের বাইরে রয়ে গেছে কত কত মানুষ। দেশভাগের পরে এত ম্যাসিভ স্কেলের এক্সোডাস নাকি দেখেনি কেউ কোনওদিন! কেউ তবু মানুষগুলোকে আটকে দেয় না, কেউ বলে না—আর ক’টা দিন থেকে যা—যা হয় ভাগাভাগি করে খেয়ে নেবো ক’টা দিন।

তবুও সকাল হয়, আস্তে আস্তে দেশ ‘আনলক’ হতে শুরু করে। ব্র্যান্ডিং-এর এই জমানায় বিপর্যয়েরও ব্র্যান্ডিং তার উদ্ধারেরও ব্র্যান্ডিং! বুড়ো হয়ে যাচ্ছি মিতা—দ্রুত বুড়ো হয়ে যাচ্ছি! ভিক্ষের চাল করুণার একশো দিনের কাজ পেল যারা, তারা আর কাজের শহরে ফিরে যাবে, না যাবে না? গিয়ে করবেটা কী? এসব আলাপ প্রতি-আলাপ পড়ছিলাম, দেখছিলাম। জানাচ্ছিল মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়া। বাজার ফেরত আমি দেখলাম, পুলের ধারে সবজির ঝুড়ি হাতে বসে আছে গ্রামেরই এক ছেলে, হাঁড়ালা পাড়ায় বাড়ি, নামটা মনে করতে পারছি না! বাইরে থাকত। আগে ফিরে এলে, চুলে রং করে হাতে মোটা চেন পরে কিছুদিন ঘুরে বেড়াত গ্রামে। তারপর আবার ফিরে যেত কাজের শহরে। আজ ম্লানমুখে বসে আছে ঝুড়ি নিয়ে। হয়তো শিখে যাবে সবজি বিক্রির কায়দাকানুন দু-একদিনের ভিতরেই। গনেশ মাইতি বলছিল—বাঁচতে তো হবে রে বাবা! পেটে ভাত তো দিতে হবে একটু!—কেন? কেন তোমাদের বেঁচে থাকতে হবে গনেশ মাইতি? কী হবে তোমরা মরে গেলে? স্পাইডারনেটের মতো সিস্টেমেটিক শৃঙ্খলাবদ্ধ এই ব্যবস্থাটার কিছু যাবে আসবে কি, তোমরা মরে গেলে? কেউ কেউ বলে যাবে—ওরা সব কনজিউমার। ওরা একেবারে মরে যাক এটা নাকি কেউই চায় না। ওরা মরে গেলে সস্তার শ্রম মিলবে কোথায়? কোথায়ই বা পাওয়া যাবে দৈহিক শ্রম দেবার এত এত মানুষ? ওষুধ, মোটা চাল, চা-বিস্কুট, বেবিফুড—এসব তো কিনতেই হবে! এত ক্রেতা মরে যাক কেউ কি চায় সেটা? কী জানি!

আচ্ছা, তোমাকে কী ওরা দাহ করেছিল… নাকি গোর দিয়েছিল? তুমি কি হেঁটেছিলে এই দীর্ঘ দীর্ঘ পথের কিছুটা দূর… গরম পিচে পুড়ে গেছিল কি তোমার পা, ঘামের নোনতা স্বাদে জিভ কি ভিজিয়েছিলে তুমি? মনে হয় আমাদের কখনও দেখা হয়নি, কোনও স্কুলেও আমরা পড়িনি একসাথে। তবু এই দাবদাহ… তবু এই হেঁটে যাওয়া, তবু ব্যবস্থার বুকে স্রেফ পা দিয়ে তুমি, তোমরা তো বেরিয়ে পড়েছিলে দেড় হাজার কিলোমিটারের রাস্তা। দেড় হাজার! কত দূর… কত দূর গেলে যে দেড় হাজার কিলোমিটার হয় তা কি আমরা জানতাম মিতা? এক এক করে দিন পেরিয়েছে, রৌদ্র-ছায়ার মতো লুকোচুরি খেলছে, লক-আনলকের দেশ! তবে, এবারের রোদ কিছু আলাদা; এবারের রোদে মানুষের—কান্নার-জেদের-ফিরে আসার গল্প লেখা নেই। এবারের রোদে না খেতে পেয়ে একদল ছেলের হাপুস নয়নে কান্নার ভিজুয়াল নেই। এবারের রোদে ফিরে আসা শ্রমিকের গায়ে ব্লিচিং স্প্রে করার দৃশ্য নেই। কত মানুষ আবার ‘নিজের দেশ’ ছেড়ে চলে গেছে, সে-ই শহরেই, শুয়োরের বাচ্চা মালিকের গাড়ি ধুতে বা দোকানে কাজ করতে বা ফ্যাক্টরিতে লেবার দিতে। যে শহর, যে মালিকের কাছে লকডাউনের দিনে পাওয়া যায়নি খবার। গিয়েছিল কি? মনে নেই! লকডাউনের পক্ষে বিপক্ষে গলা-ফাটানো মানুষেরা অন্য কাজে ব্যস্ত এখন। একঘেয়েমি কাটিয়ে প্রায়োরিটি চেঞ্জ হয়েছে আমাদের প্রত্যেকের। সে-ই ফাঁকে সরকার আরও আরও গভীরে নিয়ে গেছে তার সার্ভিলেন্স। আবার সে-ই লক্ষ লক্ষ দেশ মুছে হুংকার ছাড়তে শুরু করেছে ‘অখণ্ড’ ভারত। এটা করা যাবে না সেটা বলা যাবে না ওটা দেখা যাবে না—এমনকি পথে-ঘাটে-স্টেশনে ভিড় জমানোও যাবে না। সব কুছ ইয়াদা রাখ্‌খা যায়েগা বলে—তুমি মরে গেলে মধু! সারসার মৃতদেহ, তোমার আমার মতো সব অচেনা, অপরিচিত মানুষের। সে-ই লাশের ভিড়ে আমিও কি আর বেঁচে আছি? রানিগঞ্জের যে বেআইনি কোল মাইনের আমি খাতা সারি, তার মালিক দু-দিন আগে গ্রেপ্তার হয়েছে। কয়লা আর আগুনের এই পৃথিবী থেকে তোমার কাছে চলে যেতে ইচ্ছে হয়… ইচ্ছে হয় দিল্লির রাস্তায় খালি গায়ে চিৎকার করে বলি—কই রে শুয়োরের বাচ্চারা, বেঁচে আছিস নাকি কেউ? রাতে মাঝে মাঝে তারা পড়ে—সে-ই একটাই তারা পড়ে—আবার উঠে যায় আকাশে কখনও! যদি দুজনে জেগে থাকতাম… যদি দুজনে দেখতে পেতাম, তারা খসার সে-ই আশাবাদী সময়টাকে!

—তোমার প্রদীপ।



প্রচ্ছদ ছবি সৌজন্য: www.thewire.in