এ হয়তো বাঙালির স্বভাব বা মুদ্রাদোষ; আফগানিস্তানের কথা ভাবতে বসলে, তার অতি-পরিচিত রহমতকেই মনে পড়ে। যে স্রেফ ‘সওদা’ করতে নয়, ভালোবেসে তার মেয়ের বয়সের আরেক মেয়ে, বাঙালিবাবুর মেয়ের জন্য ঝোলায় পুরে নিয়ে আসতো মেওয়া। রবীন্দ্রনাথ এভাবেই এক অসম-বয়সের সম্পর্কের গল্প বলেছেন, দু-দেশের মানুষের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন তাঁর লেখনীর মাধ্যমে। যা মূলত পাঠকের মনকে আর্দ্র করে। ফলে, এই কাবুল দেশ আর তার মানুষ-মাত্রই—সুঠাম দেহ, উন্নত নাসা, গৌরবর্ণ, পরনে ঢোলা পাঞ্জাবি-পায়জামা, হাত-কাটা কোট, মাথায় পাগড়ির ‘কাবুলিওয়ালা’ আমাদের অতি-পরিচিত। মেওয়া আখরোট কিনুক না-কিনুক, বাঙালির ধার-দেনার জীবন সংলগ্ন সুদের কারবারি কাবুলিওয়ালাকে তাই সে কখনোই বিজাতীয় বলে মনে করেনি। যেন কোন অজান্তে ওরা আমাদের আপনজন। সুখদুঃখের সাথী। প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ বা সৈয়দ মুজতবা আলীর মতো ব্যক্তিত্বরা তাঁদের জীবনের অনেকগুলি দিন আফগান মুলুকে কাটিয়েছেন। তদুপরি বাঙালি মেয়ের আফগানি স্বামী-শ্বশুরবাড়ির কাহিনি কিছুদিন আগেও—বাঙালির কাছে আগ্রহের ও চর্চার বিষয় ছিল। তাই কাবুল দেশ আক্রান্ত শুনলে, মনের মণিকোঠায় কেমন যেন দোলাচল শুরু হয়।

দু-দশক আগে, ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্ক শহরে এক ঘটনা ঘটল। পৃথিবীর সর্বোচ্চ দুটি অট্টালিকা মুহূর্তে ধ্বংস হয়ে গেল, যে বাড়ি দুটো জানান দিত আমরাই পৃথিবী-শ্রেষ্ঠ। অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর গভীরে তলিয়ে গেল বহু মানুষ। পেন্টাগনের একাংশ ভেঙে পড়ল—বলা চলে মর্মান্তিক মৃত্যুর বিভীষিকা। কিন্তু তার পরের ঘটনায় কাবুল আক্রান্ত হতে পারে এই শঙ্কায় মন যতটা নাড়া দিল, ঠিক ততটা ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনায় দেয়নি! কেন দেয়নি—তা জানতে মনকে বার বার প্রশ্ন করি। এ কী সাম্রাজ্যবাদের প্রতি তীব্র ঘৃণা নাকি দূর ও আপনজনের মধ্যে যে পার্থক্য তারই বহিঃপ্রকাশ!

সে-ই প্রকাশের বেড়াতেই বোধহয় কোথাও আটকে যায়—ইজরাইল-প্যালেস্তাইনের রক্তক্ষয়ী জীবনযাপন। কিংবা এ সময়ে ধীরে ধীরে যখন আফগানিস্তানে পুনরায় নিজেদের শাসন ফেরাতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে ‘তালিবান.০২’ তখন সে আগ্রাসনও সমর্থন পাচ্ছে বহু মানুষের। খেউড় চলছে ধর্মের আখড়ায়। এসব মামুলি উদাহরণ দিয়েই বোঝা যায়, ইন্টারনেট বিশ্বকে একটি গ্রামে পর্যবসিত করতে পারেনি—মানসিক ব্যবধানকে মেটানোয় সে যে তিমিরে ছিল সে-ই তিমিরেই রয়েছে, বরং বিভ্রান্ত হবার পরিসর বেড়েছে আরও।

প্রশ্ন হলো, দুটি ঘটনায় মন দু-ভাবে সাড়া দিল কেন? এই ‘কেন’-র উত্তর খুঁজতে গেলে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিকায় ফিরে যেতে হয়। ১৯৪৫ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রায় অবসান। হিটলারের বাহিনীর আর অবশেষটুকুও নেই। সোবিয়েত বাহিনীর কাছে সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত। জাপান আত্মসমর্পণ করেছে মিত্র বাহিনীর কাছে। একমাত্র পার্ল-হারবারের ঘটনা ভিন্ন সমস্ত বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকা প্রায় অক্ষত। অথচ যুদ্ধ শেষে হিরোসিমা-নাগাসাকির বুকে আণবিক বোমার বিস্ফোরণ। দেখতে দেখতে পঁচাত্তর বছর পেরিয়ে গেল এই বিধ্বংসী-হত্যালীলা। আজও যার স্মৃতি মনকে নাড়া দেয়। প্রতি বছর বিশ্বের অগণিত মানুষের সঙ্গে আমরাও সে-ই মৃত, আহত, পঙ্গু মানুষগুলিকে স্মরণ করি। মার্কিন-সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণায় আজও গাঁ-গঞ্জে কিছু মানুষ শপথ নেয়, ক্লিশে এক বাক্যে, স্লোগানে—সাম্রাজ্যবাদ দূর হটো।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানে, ব্রিটিশ-সাম্রাজ্যবাদের সূর্য অস্তমিত হলেও, ধীরে ধীরে সাম্রাজ্যবাদ আবার মাথা তুলে দাঁড়াল মার্কিন-প্রভুদের নেতৃত্বে। একদিকে সমাজতন্ত্রের প্রতি বিশ্বের মেহনতি মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন, এশিয়া-আফ্রিকা-ল্যাটিন আমেরিকার দেশে দেশে মুক্তি-যুদ্ধের ঢেউ আর অন্যদিকে মার্কিন প্রভুদের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির সারা পৃথিবীব্যাপী লুণ্ঠনের প্রচেষ্টা। বিশ্বে সমান্তরাল দুই শক্তির আবির্ভাব পৃথিবীর পূর্বতন ভারসাম্যের পরিবর্তন ঘটাল। এসবের পাশাপাশি একটা সরলীকরণ আমরা মনে মনে পোষণ করলাম; সাম্রাজ্যবাদের মৃত্যুঘণ্টা বেজে গেছে, সাম্রাজ্যবাদ কাগুজে বাঘ, বিংশ শতাব্দীতেই সাম্রাজ্যবাদ কবরস্থ হবে। কিন্তু, সাম্রাজ্যবাদ থেমে থাকেনি। তারা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, প্রযুক্তিগতভাবে পরিবর্তিত হয়েছে আত্মরক্ষার তাগিদে এবং অনেকাংশে সফলও হয়েছে। এমনকি সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী ঘৃণাকে অনেকাংশে রূপান্তর ঘটাতে পেরেছে—কমিউনিস্ট বিরোধিতায়— তাদের প্রচার মাধ্যমের সাহায্যে।

আমরা সে-ই সময়টা পেরিয়ে এসেছি, যখন ভিয়েতনাম আমাদের উদ্দীপ্ত করত। ভিয়েতনামের মাটিতে মার্কিন-সাম্রাজ্যবাদ যখনই কোনও বোমাবর্ষণ করেছে, তখনই মনে হয়েছে, তা যেন ঘটেছে আমাদের ঘরবাড়ির উপর। যখন ভাবি, এই সে-ই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ যারা বর্তমানে সারা বিশ্বের গণতন্ত্রের ঠিকাদারি নিয়েছে, তারাই সন্ত্রাসবাদকে প্রশ্রয় দিয়ে ইন্দোনেশিয়ায় লক্ষাধিক কমিউনিস্ট নিধন করেছে। চিলিতে আলেন্দে সরকারকে উচ্ছেদ করেছে—আলেন্দের খুনে রক্তাক্ত এদের হাত। এই সে-ই পেন্টাগন যারা কিউবাকে গলা টিপে হত্যা করার জন্য বার বার ষড়যন্ত্র করেছে, যারা সোবিয়েত দেশ সহ পূর্ব-ইউরোপের দেশগুলিতে সমাজতন্ত্র খতম করার জন্য সিআইএ-কে কাজে লাগিয়েছে। ন্যাটো বাহিনীকে কাজে লাগিয়ে যুগোশ্লাভিয়াকে রক্তাক্ত করেছে। ইরাকের সঙ্গে যুদ্ধে বেছে বেছে হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ঘন জনবসতিতে বোমাবর্ষণ করে নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে। তখন সাম্রাজ্যবাদের প্রতিভূর কণ্ঠে সারা পৃথিবীকে সন্ত্রাস-মুক্ত করার ডাক নিতান্তই প্রহসন মনে হয় না? মার্কস বলেছিলেন, বুর্জোয়ারা ততক্ষণ গণতান্ত্রিক যতক্ষণ সে-ই গণতন্ত্র তাদের স্বার্থ রক্ষা করে। তাই প্রেসিডেন্ট বুশের ডাক—যে দেশ আমাদের ডাকে সারা দেবে না, তারাই সন্ত্রাসবাদী—এই হুমকির পিছনে, গণতান্ত্রিক আমেরিকার আসল স্বৈরতান্ত্রিক চেহারা ফুটে ওঠে। সারা বিশ্বের ঠিকাদারি করার এই স্পর্ধা মেনে নেওয়া যায় না। তদানীন্তন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী, বাজপেয়ীজি ‘দেহি পদ পল্লবমুদার্‌ম’ বলে যতই পাদোদক পান করুন না কেন, দেশের একজন সমাজ-সচেতন নাগরিক তাঁর এই কাজে, সমর্থন জানাতে পারে না।

সন্ত্রাসবাদের এক জঘন্যতম নায়ক হিসাবে ওসামা বিন লাদেন বিশ্বে স্বীকৃত। এক কট্টর মৌলবাদী চরিত্রের এই লাদেনকেই এককালে ব্যবহার করেছে—মার্কিন সরকার—নানান দেশে সন্ত্রাসবাদকে প্রশ্রয় দেবার তাগিদে। তীব্র কমিউনিস্ট বিদ্বেষী লাদেন ব্যবহৃত হয়েছে আফগানিস্তানে নাজিবুল্লার নেতৃত্বে গঠিত গণতান্ত্রিক সরকারের উচ্ছেদের জন্য। তালিবানদের সংগঠিত করে মধ্যযুগীয় অরাজকতার রাজ্য সৃষ্টির কাজে ব্যবহৃত লাদেন সাহায্য পেয়েছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কাছে। কিন্তু লাদেন নামক সে-ই দৈত্য বোতল থেকে বেরিয়ে যখন স্রষ্টার গলা টিপে ধরেছে, তখন ডাক পড়েছে বিশ্বের তাবড়-তাবড় নেতাদের ওয়াশিংটনে ‘সন্ত্রাসমুক্ত’ পৃথিবী গড়ার নিমিত্তে। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদ থাকবে অথচ পৃথিবী সন্ত্রাসমুক্ত হবে এটা সম্ভব? এ যেন সোনার পাথরবাটির মতো শোনায় না?

আফগানিস্তানের অবস্থান মধ্য-এশিয়ার এমন এক স্থানে, যাকে ঘিরে রয়েছে—পূর্বতন সোবিয়েত ইউনিয়ন, চীন, কাশ্মীর, পাকিস্তান ও ইরান। হিন্দুকুশ পর্বতে আবৃত আফগানিস্তান যেন এক বিশালাকৃতি কাছিম। সোবিয়েত ও চীনের সীমান্তে কাছিম যেন উদ্ধত গলা বার করে দুটি দেশের দিকে নজর রাখছে। আফগানিস্তানের ভৌগোলিক অবস্থানের দরুন বারবার তাকে নানান আক্রমণের শিকার হতে হয়েছে। বিশ্বের এক তৃতীয়াংশ জয় করে এসে, শুধু ভারতে প্রবেশ করার জন্য আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটকে আফগানিস্তানের দোরগোড়ায় অপেক্ষা করতে হয়েছিল প্রায় তিন বছর। এমনকি চেঙ্গিশ খাঁকেও ঘুরপথে ভারতে প্রবেশ করতে হয়েছিল, আফগানিস্তানের প্রাকৃতিক আবহাওয়ার, দরুন। শীতকালীন প্রবল শৈত্য আর গ্রীষ্মকালীন প্রবল উত্তাপ আফগানদের গড়া-পেটা করেছে এক ভিন্ন ধাতুতে। ১৯ শতকে সাম্রাজ্যবাদী দুই শক্তি ব্রিটেন ও রাশিয়ার যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে ওঠে আফগানিস্তান। কারণ একটাই, মধ্য-এশিয়া কে শাসন করবে। তিনটি অ্যাংলো-আফগান যুদ্ধ এর পরিসমাপ্তি ঘটাতে পারেনি। তাই ১৮৯৩ সালে ব্রিটেনকে ডুরাণ্ড সীমারেখা টেনে ব্রিটিশ-ভারত থেকে আফগানিস্তানকে পৃথক করতে হয়েছিল এবং ১৯১৯ সালে স্বাধীন আফগানিস্তানের স্বীকৃতি দিতে হয়েছিল। ১৯২৬ সালে আমির আমানুল্লাহকে রাজা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে ব্রিটিশ আর একটি দেশীয় রাজ্য সৃষ্টি করল। ঠান্ডা যুদ্ধের কালে তদানীন্তন রাজা মহঃ জ়াহির শাহ সোবিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তুললে, আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সোবিয়েতের ভূমিকাই প্রধান হয়ে ওঠে। ১৯৭৩ সালে রাজা জ়াহির শাহকে উৎখাত করে তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র ক্ষমতা দখল করে আবার ১৯৭৮ সালে নূর তারাকির দ্বারা তার উচ্ছেদ হয়।

তারাকি ও তার পরবর্তী উত্তরাধিকার বারবাক কামাল সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারায় আফগানিস্তানকে গঠন করার পরিকল্পনায় ব্রতী হয়। আর তখন থেকেই উগ্র-মৌলবাদীরা সংগঠিত হতে শুরু করে, মার্কিন-সাম্রাজ্যবাদের পরোক্ষ সাহায্যে, পাকিস্তানের মাধ্যমে প্রচুর মার্কিনি অস্ত্র সরবরাহ করা হয় মুজাহিনদের। আর এই সময়কালে উগ্র-মৌলবাদীরা ধর্মীয় ছাত্র সংগঠনের নামে ‘তালিবান গোষ্ঠী’ গড়ে তোলে। পাকিস্তানে সামরিক শিক্ষা নিয়ে এই ‘তালিবান গোষ্ঠী’ দেশের অভ্যন্তরে উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হয় এবং ১৯৮৯ সালে সোবিয়েতের আভ্যন্তরীণ বিরোধের সুযোগে ১৯৯২ সালে রাষ্ট্রপতি নাজিবুল্লাহকে উৎখাত করে। আফগানিস্তানের আভ্যন্তরীণ নানান গোষ্ঠী ক্ষমতা দখলের লড়াই-এ নেমে পড়ে। অবশেষে ১৯৯৬ সালে তালিবানদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয় কাবুলে। ইসলামের নামে নেমে আসে এক মধ্যযুগীয় শাসন যেখানে নারীদের কাজের অধিকার, শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয় এবং বোরখা-বিহীন মহিলাদের প্রকাশ্যে চলার অধিকার হরণ করা হয়। মোল্লা মহম্মদ ওমরের নেতৃত্বে তালিবানরা আন্তর্জাতিক স্তরে উগ্র-সাম্প্রদায়িক দল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে এই সময়ে।

সন্ত্রাসবাদী ওসামা বিন লাদেনের আশ্রয়স্থল হিসাবে এর চেয়ে ভালো জায়গা আর কী হতে পারে? নাজিবুল্লার উৎখাত, সোবিয়েত সামরিক বাহিনীর অপসারণ পর্যন্ত মার্কিনি মদত পেয়েছে ওসামা বিন লাদেন ও ধর্মান্ধ তালিবান গোষ্ঠী। কিন্তু সন্ত্রাসবাদ থেমে থাকে না। ওসামা বিন লাদেনকে সন্ত্রাসবাদী হিসাবে আমেরিকা চিহ্নিত করল ১৯৯৮ সালে যখন কেনিয়া ও তানজ়ানিয়ার মার্কিনি দূতাবাসে বোমাবর্ষণ হলো। পরধর্মের প্রতি অসহিষ্ণু তালিবানরা শুরু করল ধ্বংসকাণ্ড—বামিয়ানে দ্বিতীয় ও পঞ্চম শতকের স্থাপত্য বৌদ্ধ মূর্তিগুলি গুঁড়িয়ে দিয়ে। সৌদি আরবের এক ধনী ব্যবসায়ী পরিবারের একচল্লিশ বছর বয়সি পুত্র লাদেন, এই সময়ে, পৃথিবী-ব্যাপী ইসলাম ধর্ম রক্ষার ঠিকা নিয়েছে। আমেরিকা ও ইজরাইলের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য আন্তর্জাতিক ইসলামিক ফ্রন্ট তৈরি যার অন্যতম পদক্ষেপ। পরবর্তীকালে বিশ্বের বিভিন্ন সংগঠিত সন্ত্রাসে বারবার যে-কারণে তার নাম উঠে এসেছে।

আফগানিস্তানে লাদেনের কার্যকলাপ সন্দেহের ঊর্দ্ধে ছিল না। স্বাভাবিকভাবে সরকারের ভাবমূর্তি ঠিক রাখতে পাকিস্তানের তালিবানদের সঙ্গে সম্পর্ককে অস্বীকার করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। বাংলাদেশে খালেদা জ়িয়ার শাসনকালে তালিবানিদের আশ্রয় পাবার ঘটনাও আমাদের অজানা নয়। কিন্তু আমাদের বিস্ময় লাগে, তৎকালীন দিল্লি দরবারের কাণ্ড-কারখানা দেখে। যেন ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের অবস্থান নিউ ইয়র্কে নয়—দিল্লিতে। আমেরিকা কোনও নির্দিষ্ট দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করার পূর্বেই আমাদের সরকার ঘোষণা করল—ভারতের মাটি ব্যবহার করতে দেবে আমেরিকাকে। এমনকি আকাশ পথও। প্রধানমন্ত্রী দূরদর্শনের মাধ্যমে আহ্বান জানালেন—সবরকম ত্যাগ স্বীকারের জন্য আমরা যেন প্রস্তুত থাকি। একে ‘নির্লজ্জ চাটুকারিতা’ ছাড়া আর কীই-বা বলা যায়! এ পদক্ষেপের পেছনে কী দিল্লি সরকারের এমন কোনও ভাবনা ছিল—কাশ্মীরের যে অংশ পাকিস্তানে, তা ভারত অন্তর্ভুক্ত হবে? যারা মনে করেছিলেন এর পর পাকিস্তান দারুণ ফাঁদে পড়বে, তারা ভুল ভেবেছিলেন। এশীয় ভূখণ্ডে, তৃতীয় বিশ্বের উপর খবরদারি করতে গেলে, আমেরিকার যেমন ভারতকে দরকার তেমনি পাকিস্তানকেও। এজন্য যে সমস্যা ছিল ভারতের আভ্যন্তরীণ, সে পাট গুটিয়ে আমেরিকা তাকে আন্তর্জাতিক সমস্যায় পরিগণিত করেছে। তার লক্ষ্য আরও সুদুর প্রসারী। সাম্রাজ্যবাদী খেলায় দাবার ঘুঁটি সে সাজিয়েই চলেছে। এখানে থেকে, সে ঈগল চোখ রেখেছে ও রাখবে মধ্যপ্রাচ্য ও চীনে—যারা আমেরিকার রক্তচক্ষুকে ভয় পায় না। এমনিতেও বিশ্ব-বাজারে চীনের অনুপ্রবেশে, জাঁকিয়ে বসায় মার্কিন রাষ্ট্র শঙ্কিত, শঙ্কিত সমগ্র পশ্চিমি-দুনিয়া। বর্তমানের কোভিড-ভাইরাস আমেরিকার হাতে যেন তুলে দিয়েছে তুরুপের তাস। সে চাইছে, একঘরে করে দিতে চীনকে। ‘আত্মনির্ভর’ রাষ্ট্র ভারত সীমান্তে ছায়াযুদ্ধ খেলছে চীনের সঙ্গে।

ভারতে ‘আফস্পা’র মতো বিতর্কিত আইন এখনও কার্যকর। অথচ ৩৭০ ধারা বিলোপ করে কাশ্মীরকে মাসের পর মাস আইন-ব্যবস্থা জীবনযাপন শোধরানোর নাম করে বাকি বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ-বিচ্ছিন্ন করে রাখার মতো ঘটনা যে ঘটল তাও আমরা দেখলাম। সাম্রাজ্যবাদের বা সন্ত্রাসের কোনও রং-রূপ নেই। হয় না। পরিসরের ভিন্নতায় ঘটনার গুরুত্ব বাড়ে কমে কেবল। এসব কথার বিপরীতে সংবাদমাধ্যম জুড়ে আপাতত জীবন বাঁচানোর তাগিদে কাবুল ছেড়ে পলায়নরত ভীত মানুষের মুখের ছবি। ছবি রক্তাক্ত আফগানিস্তানের। আমরা এ গৃহযুদ্ধের দর্শক মাত্র।

দর্শক যখন, তখন ইতিহাসকে ফিরে দেখাই যাক না হয়! ‘সাপ্তাহিক বাংলাবার্তা’ (শুক্রবার, ১. ৮. ১৯৯৯) পত্রিকার হেডলাইন হলো—”পাকিস্তানের মসজিদে ১৬জন নামাজী গুলিবর্ষণে নিহত। এটি পাকিস্তানের শিয়া ও সুন্নী সম্প্রদায়ের উত্তেজনার পরিণতি। সুন্নীদের পক্ষে সিপাহ-ই-সাহাবা এবং শিয়াদের পক্ষে তেহরিক-ই-জাফরিয়া দু-পক্ষের নেতৃত্বে জ্বেহাদ করছে।” এর ঠিক আগে আগেই, জুলাই মাসে (বৃহস্পতিবার, ১. ৭. ১৯৯৯) আরেকটি খবর দৈনিকের প্রথম পাতায়, ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’ লিখল—’Indonesian Religious Clashes have left 24 people dead 134 people hurt, 10 religious building burned.’ “Barron’s”-এ রিপোর্ট বার হলো—“In Sudan efforts of the government to force Islamic Law to rebels-disrupted planting & harvesting thet caused drought in Sudan. Two million people died from that.” সাম্প্রদায়িক খুনোখুনি তো আর কেবল ‘হিন্দু-মুসলিম’-এ নয়। দুনিয়া জুড়ে শিয়া-সুন্নী বা শিয়া-শিয়া বা সুন্নী-সুন্নীর মধ্যে ধর্মের দোহাই দিয়ে জিহাদের মাধ্যমে হত্যাযজ্ঞ চলছে কমবেশি ১৫০০ বছর ধরে।

বিশ্বে খ্রিস্টানদের পরেই জনসংখ্যায় দ্বিতীয় বৃহত্তম জাতি মুসলিম। অথচ জাতি হিসাবে তারা অনুন্নত। সরকারি পরিসংখ্যানে ‘সাক্ষর’ একজন ভারতীয় বা বাংলাদেশী গ্রামীণ ব্যক্তি যে আসলে ‘স্বাক্ষর’ করা ছাড়া আর কিছু পারেন না—এ অভিজ্ঞতা আমাদের নতুন নয়। পেট্রো-ডলারের ঝনঝনানি তাকে এক্ষেত্রে বিশেষ সাহায্য করেনি। মধ্য-এশীয় কোনও অঞ্চলে শ্রমিক হিসেবে দিনাতিপাত করা ছাড়া। অথচ ইওরোপে বিজ্ঞান চর্চা, বৈজ্ঞানিক চেতনার বিকাশে ইসলামি সংস্কৃতির আবদানকে অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। সে দেশে এক নতুন বিজ্ঞান ভাবনার পথ প্রশস্ত করে ইসলাম নিজে তলিয়ে গেল ভয়াবহ বুদ্ধিবিমুখতার অতলে। কট্টর মৌলবাদী অনুশাসন থেকে আজ অবধি তার মুক্তি হলো না। এমনকি সুফীদের মতো নরমপন্থীরাও ধর্মীয় আচরণ মানার ক্ষেত্রে যথেষ্টই নিয়মনিষ্ঠ। এ বর্তমানে যদিও বাংলাদেশের জিডিপি পড়শি ভারতকে টপকে গিয়েছে বলে খবরে প্রকাশ। কিন্তু সরকারি খতিয়ানের বাইরে বেরিয়ে সামগ্রিক জনজীবন বা ‘স্ট্যান্ডর্ড অব লিভিং’-এর সাপেক্ষে এ বৃদ্ধির কার্যকারিতা কতখানি তার বিচার আরও কিছুদিন পরে হয়তো করা সম্ভব হবে।

বলার বা ভাবার কথা এই যে, জীবনে একটু ভালোভাবে বাঁচার চাহিদা শেষমেষ কেন একজন মানুষের হাতে বন্দুক ধরিয়ে দেয়? ইতিহাসের পাতায় পাতায় আমরা দেখেছি, কীভাবে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এই খেলা খেলে এসেছে বরাবর। ‘বোখারী শরীফ’ নামক ‘হাদিছ’কে ‘মুসলিম এডুকেশনাল ট্রাস্ট’ উল্লিখিত ছয়টি ‘হাদিছ’-এর মধ্যে প্রথম স্থানের বলা হয়েছে। উক্ত গ্রন্থটির প্রথম, তৃতীয় ও সপ্তম খণ্ড মুসলিম এবং অ-মুসলিম সকলেরই পড়া উচিত। নিজের বিবেক-বুদ্ধিকে জাগ্রত রেখে। ‘জ্বেহাদ’ নামের একটি অধ্যায়ে যা লেখা হয়েছে তা পড়ে হৃদয়াঙ্গম করতে পারলে হয়তো বোঝা সম্ভব হবে—সমগ্র বিশ্বে ‘ইসলামিক রেভেলিউশন’-এর নামে যে জ্বেহাদ, হত্যা ও সন্ত্রাস—কী তার সূত্র, কে তার নির্দেশক। জানা সম্ভব হবে—আল কায়দা, তালিবান, হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামি, জামাতে ইসলাম, ইসলামিক দাওয়া কাউন্সিল, ইসলামিক স্টেট বাংলাদেশ, মিনি সালামত পার্টি, আল-ই খয়ূনুন মুসলিমিন সহ আরও ছোট বড় যেসব সংগঠন অতীতে ক্রিয়াশীল ছিল বা বর্তমানে রয়েছে তার নেতৃত্ব ও সমর্থকরা বা আয়াতুল্লাহ খোমেনী, ওসামা বিন লাদেন-এর মতো মানুষেরা দিনের পর দিন ইসলামকে রক্ষা করার নামে মানবতাকে, মানব সভ্যতাকে ধ্বংস করার মানসিকতা পেয়েছে কোথা থেকে। কে তাদেরকে সে-ই গ্যারান্টি দিয়েছে যে, ইসলামের নামে মরলে ও মারলে ‘বেহেস্ত’ তাদের জন্য অবধারিত।

ভাবলে খানিক আশ্চর্যই লাগে যে, রক্তস্নাত এই জাতির শিল্পীরাই উৎকর্ষের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে এঁকেছেন মিনিয়েচার পেইন্টিংগুলি। রচিত হয়েছে মসজিদ ও প্রাসাদের দেওয়ালে ম্যুরাল শিল্পকলা। বাজার-সংস্কৃতির এই পৃথিবীতে প্রায় সবই বিকোয়। ধর্ম আর কেবল মানুষের বিশ্বাস বা আচরণ মাত্র নয়। ব্যাবসা। মর্ত্যভূমের মন্দির-মসজিদ-গীর্জাগুলির দিকে তাকালে তা প্রতীয়মান হয়। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে মোটা অঙ্কের টাকা চাঁদা বা ডোনেশন যে আয়কর ফাঁকি দেওয়ার বা বিদেশী মুদ্রাকে দেশী মুদ্রায় রূপান্তরের ভরসাযোগ্য পন্থা—এ কথা খানিকটা দিনের আলোর মতো। জানলেও বলা মানা। ভ্রমণার্থী হিসাবে, তীর্থ করতে দেশ-দুনিয়ার লোক দেখতে যায় বৃন্দাবনের পঞ্চাশ মণ সোনার তাল গাছ। সোনায় গাঁথা স্বর্ণমন্দির। নিউ ভার্জিনিয়ায় নয়ের দশকের মাঝপর্বে একটি মন্দির নির্মাণ শেষ হয়—প্রভুপাদের এই মন্দিরকে বলা হয় ‘প্যালেস অব গোল্ড’। ১৫০০ টুকরো রঙিন কাচে হাতে গড়া ময়ূরের জানলা, ইটালিয়ান ভার্ডে, গ্রিসের থেকে আনা সবুজ ও লাল মার্বেল পাথর। এই মন্দিরে রয়েছে ৩৫,০০০ ফুট মার্বেল যার ওজন ২৫৪ টন। রয়েছে অ্যান্টিক ঝাড়বাতি এবং প্রভুপাদের মাথায় একটি সোনা-অনিক্স-মণিমুক্তা খচিত মুকুট।—এ কী ধর্মাচরণ না ইনভেস্ট? অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই যে, ধর্ম বহু মানুষের রুজিরোজগার। সারা বিশ্বে হাজার কোটি ডলারের ওপর ব্যাবসা। মক্কার মাটি থেকে ভ্যাটিকেন সিটির সিলিংয়ের ফ্রেসকোর ফ্যাক্সিমিলি। তাগাতাবিজ থেকে গঙ্গার জল, পুজোর ফুল সে-ই ব্যাবসার উপকরণ। ন্যূনতম ৬,০০০ ডলারও যদি খরচ হয় জনপ্রতি, তাহলেও বছরে তিনশো ষাট বিলিয়ন ডলারের ব্যাবসা মার খেতো—যদি কোরানে মক্কা-মদীনার তীর্থযাত্রা বা হজকে ফরজ বা পূণ্যজ হিসাবে বর্ণনা করা না হতো।

ইসলাম দাবি করে যে, আল্লাহ্ নির্দেশিত গ্রন্থ চারটি—’তোরাহ’, ‘যাবুর’, ‘ইঞ্জিল’ এবং ‘কোরান’। ইসলাম এও দাবি করে যে, যুগে যুগে আল্লাহ্ বিভিন্ন নবীর মাধ্যমে এই গ্রন্থগুলি পাঠিয়েছিলেন আকাশ থেকে। কিন্তু নবীদের প্রয়াণের পর বিধর্মীরা সে-ই পবিত্র গ্রন্থগুলি নষ্ট করেছে এবং তাতে তারা নিজেদের মন-মাফিক কথা লিপিবদ্ধ করেছে—অতএব অপবিত্র এ গ্রন্থগুলি ‘মুসলিম ধর্ম’ হলেও বিষবৎ পরিত্যাজ্য কোরান ব্যতিরেকে। যেসব ধর্মের মানুষেরা গ্রন্থগুলির ক্ষতিসাধন করেছে তারা সকলেই কাফের এবং ইসলাম ভিন্ন অন্য কোনও ধর্মই খাঁটি নয়। অতএব বিধর্মীর মুণ্ডুচ্ছেদ করাই যায়, তাতে আর পাপ কীসের!

কিন্তু, কসভো, বসনিয়া, চেচনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, রোয়ান্ডা ও প্যালেস্টাইনে হাজারে হাজারে মারা গিয়েছে যে শিশুগুলি অকালে—তারা তো কেউ বিধর্মী নয়, তারা তো মুসলিম!—’আল্লাহ্‌’ তাদের বাঁচাতে আসেনি। যে নারীকে সহবত শেখাতে প্রকাশ্য রাস্তায় গুলি করে হত্যা করা হয়েছে এবং হচ্ছে তার ধর্ম তবে কী? এ সবই কী তবে অনুল্লিখিত ‘কোলাটরেল ড্যামেজ’!—ক্ষমতা আর ধর্মের পাটিগণিতে, সাম্রাজ্যবাদের নীল নকশায়!         



প্রচ্ছদ ও অন্য ছবি সৌজন্য: www.foreignpolicy.com