তুমি

সব আবরণ সরিয়ে নিয়েছো। তবু, এই মধ্যরাতে খুব অচেনা মনে হয়
তোমাকে। তোমার দৃষ্টি অতিক্রম করি সে সাহস আমার নেই।
তোমার কথা না শুনি সে জোর আজ নেই। শুধু ভাবি, এই উলঙ্গ
আত্মবর্ণনার চেয়ে মানুষের কঠিন অপমানের কী হতে পারে! তোমার
নিদারুণ কষ্টের বেশি ব্যথা কী হতে পারে?

আকাশে তারাগুলি মিটিমিটি জ্বলছে। রাস্তায় একলা রিকশাঅলা
ঘরফিরতি ভাবছে জীবনের এতখানি পথ পেরিয়েও মুখের হাসি ধরা গেল না।
ছাদের আনাচ-কানাচে বড় বেশি অন্ধকার। পাশের
বাড়ির বাগানে অজস্র জোনাকিরা। আমি অসম্ভব নিরুপায় মনে
একবার তোমার মুখের দিকে, একবার পায়ের পাতার দিকে তাকাই।




তার এলোচুল ও রবীন্দ্রসংগীত

পৃথিবীতে যত দুঃখ আছে, তার অর্ধেক আমাকে দিয়েছো। রাত বারোটায়
ওইভাবে আবার কলহ শুরু হলো। তারপর ভাঙচুর, তারপর চিৎকার, তারপর
কান্নার আওয়াজ। তারপর, গান এরকম:
    ভালোবেসে যদি সুখ নাহি তবে কেন
    তবে কেন মিছে ভালোবাসা…
আমি রোজকার এই কলহ থেকে বেদনাবিমুখ হতে চেয়ে নিজেকে আশ্চর্য
জেনেছি। জেনেছি দম্পতির কলহ আসলে কলহ নয়; বিরাট বিরহ শেষে সে
যে ভালোবাসার বিরাট নিঃশ্বাস।




মাটি-পৃথিবীর টানে

[উৎসর্গ: জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪)]

১৪.
আমি সে-ই অভিভূত চাষা
নিড়ানোর কাজ সেরে
এসেছি তোমার কাছে, কই, বিড়ি দাও।
এই কথা কেউ এসে বলে গেল
প্রত্যাশায় প্রতারিত হৃদয়ের অনর্গল কথা বলে গেল
পৃথিবীর রৌদ্রের আঘাতে বিকীর্ণ জীবনের কথা।
তারপর,
সন্ধ্যার কুয়াশায় মিশে
মানবজন্মের কাছে ঋণী থেকে
সভ্যতার জ্বরে আক্রান্ত, অস্থির ঘুমে,
আশ্বিনের আমনের স্বাদ পেতে
হেমন্তে ঝরে যাবে বলে।

১৫.
আজ ১৪ অক্টোবর। আজ সে-ই দিন
এমন দিনে পৃথিবীর সমস্ত কবির আহত হওয়ার দিন।
সবিতার চুলের অন্ধকারে যে-জোনাকি জ্বলে আর নেভে
সে-ই সময়টুকুর ব্যবধানে
পৃথিবীতে রক্তমাখা ট্রাম ছুটে গেছে।
তবু,
রক্তহীন ধুতির আঁচলে দেখি
একটি দ্রোণফুল দিব্যি ফুটে আছে।

১৬.
এই দেশে জীবনের চেয়েও সত্যি মৃত্যুর সংকট?
রোমাঞ্চে প্রেমে আর অক্লান্ত আগুনে বাংলার প্রাণ আছে?
আমাদের হৃদয়ের শ্মশানপাথরে তুমি রেখেছিলে
এইসব প্রশ্নমালা। তারপর
নক্ষত্রে, নীলিমায়, পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে
কোথায় যে লুকিয়ে রয়েছো!
আমরাও প্রতিদানে জীবনের প্রাত্যহিকতায়,
মিথ্যাচারে, প্রপঞ্চনায় আর লোকনিন্দার অন্তরালে
বধূবিয়োনোর মতো কিছুটা সফলতা
দিয়েছি বাংলা কবিতায়।

১৭.
ভাতের চেয়েও বেশি ভাষার এই ঋণ
আমি একে একে সংগ্রহ করি;
দেখি, মানুষের অসফল মৈথুনের মতো
গ্লানি ও গোঙানি তাকে-ও ঘিরেছে।

এর চেয়ে আকাশের ওই যে নীলিমা
তার তলে বয়ে-যাওয়া অখ্যাত নদীর জল
তার পাড়ে সাদা সাদা কাশে ঘেরা কুটিরের
অনন্ত মেঝেয় তুমি নির্জন শুয়েছ; বারংবার
এ-দেখাই দেখতে চেয়ে মুগ্ধ হতে চেয়েছে
আমাদের মন।

সহসা কী যে হলো,
তোমাকে শেখাবে বলে
হে শতচ্ছিন্ন মহানগর,
নারীর হৃদয়ের মতো ডালপালা কেন মেলে দিলে
পাড়াগাঁর শান্তির আকাশে।

একটি বোমারু বিমান
ভারতের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গিয়েছিল?
এরপর হিজলের শ্যামার দোয়েলের সব কথা শেষ?
এরপর, বোবা কালা পাগল মিনসে এক অপরূপ বেহালা বাজায়।