‘কুল’ শব্দটি বুৎপন্ন হইয়াছে কুল ধাতু হইতে, যাহার অন্যতম মূল অর্থ ‘সংহতি’ (কুল= ক +ড), অর্থাৎ বংশ। কুলে জাত ব্যক্তি কুলীন। কুলীন শব্দটি প্রাচীন বৈদিক সাহিত্যে পাওয়া যায়। ছান্দোগ্য উপনিষদে লিখিত আছে, ‘শ্বেতকেতো! বস ব্রহ্মচর্যং ন বৈ সোম্যহস্মৎ কুলীনোহননুচ্য ব্রহ্মবন্ধুরিব ভবতীতি।’ (ছান্দোগ্য, ৬/১/১)—”বৎস শ্বেতকেতু! তুমি অনুরূপ গুরুর নিকট অবস্থান করিয়া ব্রহ্মচর্য পালন করো। আমরা কুলীন হইলেও অধ্যয়ন না করিলে ব্রাহ্মণ হইতে পারি না।” এইখানে ‘কুল’-এর অর্থ হইল উচ্চবংশ, সদ‌্‌বংশ। সৎকুলে জাত ব্যক্তিরা বিদ্যাবিনয়াদি গুণযুক্ত থাকেন। মনুসংহিতায়, মেধাতিথি ভাষ্যেও ইহা স্পষ্টত বলা হইয়াছে, ‘সৎকুলে জাতা বিদ্যাদিগুণযোগিনঃ কুলীনাঃ।’ (মেধাতিথি, ৮/৩২৩) মুনভাষ্যের সদ‌্‌বংশ সদ‌্‌গুণান্বিতাদি গুণই—নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়া নয়টি অর্থাৎ ‘নবধা’ কুল লক্ষণে পরিণত হয়।

বংশের বিশেষ গুণগুলি বংশের সন্তানদিগের মধ্যে প্রত্যাশিত। তা না হইলে, সে বংশের মর্যাদা সে পাইতে পারে না। এই কথাই পূর্বোক্ত ছান্দোগ্য উপনিষদে ব্যক্ত হইয়াছে। কেবল ব্রাহ্মণ বংশে জন্মগ্রহণ করার ফলে-ই এবং যদি ব্রহ্মচর্যাদি ও অধ্যয়নাদি না করে তবে শ্বেতকেতু ব্রাহ্মণ হইবেন না, ব্রহ্মবন্ধু হইবেন না। পরবর্তীকালে যদিও এই অবস্থার পরিবর্তন হইল। বিষয়টি ব্যক্তিগত না হইয়া বংশগত, কুলগত হইল। সেই সৎকুলজাত ব্যক্তি ব্যক্তিগত সংস্কৃতি যোগ্যতায় যাহাই হউক, সে কুলীন ও কুলশ্রেষ্ঠ। কর্মগত বৃত্তি একদা যেমন জম্মগত বৃত্তিতে রপান্তরিত হইয়া ‘গুণকর্মবিভাগযুক্ত’ জাতিভেদ সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য ব্যর্থ করিয়া, জন্মগত জাতিতে পরিণত হইয়াছিল। কুলীনও তেমনিভাবে ব্যক্তিসাধ্য গুণাদির আশ্রয় না হইয়া, কুলে জাত অর্থে গৃহীত হইল। এইভাবেই শুরু হইল সামাজিক দূর্গতির ইতিহাস।

সুশীলকুমার গুপ্তের মতে, ঊনবিংশ শতাব্দীর পূর্বে বাঙ্গালাদেশের সভ্যতা ছিল গ্রামকেন্দ্রিক। গ্রামই ছিল সমাজ জীবনের ভিত্তিভূমি। সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস অর্থের প্রাচুর্যেও পরিবর্তিত হইত না। অর্থের কৌলীন্যের স্থলে ছিল রক্তের কৌলীন্য।


২.

এই কৌলীন্য প্রথা কখন হইতে আমাদের দেশে অর্থাৎ বঙ্গদেশে প্রচলিত হইল? ইহার উদ্ভাবক কে? শ্ৰীযুক্ত অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, দেবীবর ঘটকই বহুবিবাহ প্রথার উদ্ভাবক। তবে এ সম্বন্ধে নাতিদীর্ঘ একটি ইতিহাস আছে। কুলীনশাস্ত্র ও লোকশ্রুতি অনুসারে বাংলাদেশের রাজা আদিশূর ৯৯৯ শকাব্দে আচারবান সদ‌্ ব্রাহ্মণের অভাব দূর করিবার জন্য কান্যকুব্জ হইতে বৈদিক ক্রিয়াকর্মে পারদর্শী পঞ্চ ব্রাহ্মণকে আনাইলেন। রাজার আদেশে তাঁহারা এদেশেই বসবাস করিতে লাগিলেন এবং কালক্রমে এদেশীয় কন্যাকে বিবাহ করিয়া সংসারধর্ম পালন করিতে লাগিলেন। এই সকল ব্রাহ্মণদের মোট ছাপান্ন জন পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করে। রাজা এই ছাপান্ন জনকে এক একটি পৃথক গ্রাম দান করিলেন। সেই গ্রামের নামানুসারে এই ব্রাহ্মণদের ‘ছাপান্ন গাঁই’-এর সৃষ্টি হইল।

কান্যকুব্জ হইতে পঞ্চ ব্রাহ্মণ আসিবার পূর্বেই স্থানীয় ব্রাহ্মণদের সংখ্যা ছিল সাতশত। আচার আচরণে তাঁহাদের খানিকটা স্বাতন্ত্র্য ছিল। সেইজন্য তাঁহারা ‘সপ্তশতী ব্রাহ্মণ’ নামে সমাজে অপেক্ষাকৃত মর্যাদাভ্রষ্ট হইয়া পড়িলেন। ‘সপ্তশতী ব্রাহ্মণ’ সম্প্রদায়ের সহিত বহিরাগত পঞ্চ গোত্রের (শাণ্ডিল্য, কাশ্যপ, ভরদ্বাজ, বাৎস্য, সাবর্ণ) ব্রাহ্মণদের আহারাদি বিবাহ ইত্যাদি সামাজিক ক্রিয়াকলাপ প্রচলিত ছিল না। পঞ্চ ব্রাহ্মণদের নিকট সপ্তশতীগণ ছিলেন সংস্কারবর্জিত ব্রাত্য। ‘ছাপান্ন গাঁই’-এর কোনো ব্রাহ্মণ ‘সপ্তশতী’দের সহিত আলাপ-সম্পর্ক বা সামাজিক অনুষ্ঠানে একত্রে যোগদান করিলে, তাঁহারা সমাজে পতিত হইতেন।

শূর বংশের পর সেন বংশ আসিলেন বাংলার সিংহাসনে। ইতিমধ্যে নানান কারণে পঞ্চ গোত্রের ব্রাহ্মণগণ সমাজে পতিত হইতে লাগিলেন। তখন বল্লালসেন ব্রাহ্মণদের কুলবিশুদ্ধি বজায় রাখিবার জন্যই মনুভাষ্য অনুযায়ী নয়টি গুণ নির্দেশ করিলেন—

আচারো বিনয়ে বিদ্যা প্রতিষ্ঠা তীর্থ দর্শনম‌্।
নিষ্ঠা শান্তি স্তপোদানং নবধা কুললক্ষণম‌্ ॥

আচার, বিনয়, বিদ্যা, প্রতিষ্ঠা, তীর্থ পর্যটন, নিষ্ঠা, আবৃত্তি (অর্থাৎ বৈবাহিক আদানপ্রদান) তপস্যা ও দান—এই নয়টি কুললক্ষণ। যে সকল ব্রাহ্মণ নয়টি গুণ সম্পূর্ণ রূপে অনুশীলন করিবেন, তাঁহারা সমাজে কুলীন ব্রাহ্মণ বলিয়া অভিহিত হইবেন। পূর্বে উল্লিখিত ছাপান্ন গাঁই-এর মধ্যে অষ্টম গাঁই হইলেন: বন্দ্য, চট্ট, মুখুটি, ঘোষাল, পতিতুণ্ডি, গাঙ্গুলি, কাঞ্জিলাল, কুন্দগ্রামী। এঁরা কুলীনের পূর্ণ মর্যাদার ধারক। কারণ ইঁহারা সকল গুণগুলিই অনুশীলন করিতেন। চৌত্রিশ গাঁই মাত্র আটটি গুণের অধিকারী হইলেন, অর্থাৎ একটি গুণ হইতে বঞ্চিত হইলেন এবং কৌলীন্যের মর্যাদা হইতে ভ্রষ্ট হইয়া ‘শ্রোত্রিয়’ নামে পরিচিত হইলেন। অবশিষ্ট চৌদ্দ গাঁই-এর ব্রাহ্মণেরা বিশেষভাবে আচারভ্রষ্ট হইয়াছিলেন বলিয়া ‘গৌণকুলীন’ নামে সমাজে হীনাবস্থা প্রাপ্ত হইলেন।

বল্লালসেন কুলবিশুদ্ধি বজায় রাখিবার জন্য নিয়ম করিলেন যে, কুলীনেরা একমাত্র কুলীনদের সহিত বৈবাহিক আদানপ্রদান করিতে পারিবেন। শ্রোত্ৰিয়ের ঘরে কন্যাদান করিলে, তাঁহারা কুলভ্রষ্ট হইবেন এবং ‘বংশজ’ নামে সমাজে পতিত হইবেন। কুলীনেরা যদি গৌণকুলীনের কন্যা বিবাহ করেন, তবে কুললক্ষণ হইতে সম্পূর্ণ বঞ্চিত হইবেন।

বল্লালসেনের কয়েক শত বৎসর পরে দেবীবর ঘটক নব-বিন্যাস করিয়াছিলেন। বল্লালসেন ব্রাহ্মণদের কুলমর্যাদা জ্ঞাপক যে নয়টি গুণ নির্দেশ করিয়াছিলেন। তাহার মধ্যে বৈবাহিক আদানপ্রদান ব্যতীত কালক্রমে সমস্ত গুণ লুপ্ত হইয়াছিল। বল্লালসেন কুলীন ব্রাহ্মণদের শ্রেণিবিন্যাস করিয়াছিলেন গুণানুসারে। কিন্তু দেবীবর ঘটক দোষানুসারে ব্রাহ্মণদের নুতন শ্রেণিবিন্যাস করিলেন। এই শ্রেণিবিন্যাসের নাম হইল—‘মেল’ বা ‘মেলবন্ধন’। মেলের সংখ্যা হইল ছত্রিশ। ইহার মধ্যে ‘খড়দহ মেল’ ও ‘ফুলিয়া মেল’ সামাজিক প্রাধান্য অনুযায়ী কুলীন বলিয়া অভিহিত হইল।

দেবীবর কুলবিশুদ্ধি বজায় রাখিবার জন্য বিবাহের ব্যবস্থা সংকুচিত করিলেন। বল্লালী কৌলীন্য অনুযায়ী আট গাঁই-এর মধ্যে যথেচ্ছ বিবাহ হইতে পারিত। ইহাকে বলা হইত ‘সর্বদ্বারী বিবাহ’। এই প্রথাতে কুলীনদের মধ্যে বিবাহ ব্যাপারে কোনো বাধা বা নিষেধ ছিল না। ফলে কুলরক্ষার জন্য একজনকে একাধিক বিবাহ করিতে হইত না। কিন্তু দেবীবরের কঠোর মেলবন্ধনের জন্য বিবাহের আদানপ্রদান অত্যন্ত সংকুচিত হইল, স্বাধীনতা নষ্ট হইল এবং ঘটকের মাধ্যমে বিবাহ নির্ধারণ প্রথা হইয়া দাঁড়াইল। বহু পূর্বেই কুলীনদের কুলবিশুদ্ধি ক্ষুণ্ণ হইয়াছিল। তথাপি কাল্পনিক কুলবিধি বজায় রাখিবার জন্য বিশেষ চিহ্নিত কুলের পাত্রে একাধিক কন্যাদান করিতে লাগিলেন কন্যার পিতাগণ। অতএব এ কথা বলায় বিশেষ আপত্তি দেখি না যে, দেবীবরই ‘মেলবন্ধন’ করিয়া বঙ্গসমাজে কুলীনদের বহুবিবাহ প্রথার সৃষ্টি করিলেন।


৩.

রামমোহন রায় কৌলীন্য প্রথার কুফল সম্বন্ধে বিশেষ সচেতন ছিলেন। তাঁহার মতে—

যে সকল স্বামী দুই তিন স্ত্রীকে লইয়া গার্হস্থ্য করে তাহারা দিবারাত্রি মনস্তাপ ও কলহের ভাজন হয়। কখনও স্বামী এক স্ত্রীর পক্ষ হইয়া অন্য স্ত্রীকে সর্বদা তাড়ন করে, আবার কেহ কেহ সামান্য ত্রুটি পাইলে বা বিনা কারণে সন্দেহবশতঃ স্ত্রীকে চোরের তাড়না করে (অর্থাৎ চোরের ন্যায় প্রহার করে) অনেক স্ত্রীই ধর্মভয়ে এ সকলই সহ্য করে, কিন্তু যদি কেহ এইরূপ যন্ত্রণা সহ্য করিতে না পারিয়া পৃথক থাকিবার নিমিত্ত পতির গৃহত্যাগ করে, তবে রাজদ্বারে পুরুষের প্রভাব থাকায় পুনরায় পতির হস্তে আসিতে হয় এবং পতিও পূর্বজাত ক্রোধের নিমিত্ত নানা ছলে স্ত্রীকে ক্লেশ দেয়, কখনো বা ছলে প্রাণবধ করে। [১]

সপত্নী ঈর্ষায় জর্জরিত হইয়া অনেকে উদ্বন্ধন বা বিষপানাদি দ্বারা আত্মহত্যার পথ গ্রহণ করে। কেহ কেহ ব্যভিচার দোষে লিপ্ত হইয়া পাপের পিচ্ছিল পথে গড়াইয়া পড়ে। যিনি মানব প্রকৃতি বিশেষ রূপে আলোচনা করিয়াছেন, তিনিই বিশেষ রূপে অবগত আছেন যে এক পুরুষ দ্বারা বহু স্ত্রীর ধর্মরক্ষা হওয়া কি পর্যন্ত অসম্ভব। যে স্ত্রী হয়তো বিহিত বিধানে পতি প্রাপ্ত হইলে কস্মিনকালেও অসতীত্বরূপ পাপ পঙ্কে লিপ্ত হইত না, পতিব্রতা সতী হইবার জন্য যাহার নিতান্ত যত্ন ছিল, সেও চিরজীবন পতি বিচ্ছেদ হেতু সময়ক্রমে শারীরিক বিকারে অধৈর্য হইয়া সতীত্ব ধর্মে জলাঞ্জলি দিয়া থাকে।[২]

কৌলীন্য প্রথা প্রচলিত থাকায় কুলীন-কন্যাদের যে দুঃখ-দুর্দশার মধ্য দিয়া জীবন অতিবাহিত করিতে হইত—সমকালীন সাহিত্য হইতে তাহারই দুই একটি চিত্র দেওয়া হইল:

নারীর জন্মদুঃখ

 আবার কুলীন ব্রাহ্মণের যত নারী  এদের দুঃখ দেখতে নারি
     যদি বিয়ে হয় পুনঃ বিয়ের পরে।
যে উদ্দেশ নাই কোন দেশ   পতি যেন সন্দেশ
     দৈবে যদি এসেন দয়া করে।।
আবার শ্বশুরের কসুর পেলে   ষোড়শী যুবতী ফেলে
     রাত্রে এসে প্রভাতে যান চলে।
কুলীনের যুবতীগণ   তারা যমের জন্য যৌবন
     ধারণ করেন হৃদয় কমলে।।[৩]

বিদ্যাসাগর মহাশয় কুলীনদিগের বহুবিবাহ নিবারণ হেতু যে আইন বিধিবদ্ধ করাইবার উদ্যোগ করেন, সেই আইন উপলক্ষ্যে লিখিত হয়:

ন মহিলা বিলাপ

বারেক বৃটেনেশ্বরী আয় মা দেখাই
প্রাণের ভিতর দাহ কি বা সে সদাই,—
কাজ নাই দেখায়ে মা, তুমি রাজেশ্বরী,
হৃদয়ে বাজিবে তব ব্যথা ভয়ঙ্করী।
ছিল ভাল বিধি যদি বিধবা করিত,
কাঁদিতে হোত না, পতি থাকিতে জীবিত;
পতি, পিতা, ভ্রাতা, বন্ধু, ঠেলিয়াছে পায়।
ঠেলো না মা, রাজমাতা, দুঃখী অন্যথায়।
আয় আয় সহচরী      ধরি গে বৃটেনেশ্বরী,
করিগে তাঁহার কাছে দুঃখের রোদন,
এ জগতে আমাদের কে আছে আপন?
বিমুখ নিষ্ঠুর ধাতা      বিমুখ জনক ভ্রাতা,
বিমুখ নিষ্ঠুর তিনি পতি নাম যাঁর—
আশ্রয় ভারতেশ্বরী ভিন্ন কেবা আর?

কি জানাব জননী গো, হৃদয়ের ব্যথা,—
দাসীর(ও) এ হেন ভাগ্য না হয় সর্বথা।
কি ষোড়শী বালা, কিবা প্রবীণা রমণী,
প্রতিদিন কাঁদিছে মা দিনদণ্ড গণি—
কেহ কাঁদে অন্নাভাবে আপনার তরে,
কারো চক্ষে বারিধারা শিশু, কোলে ক’রে।
       কত পাপ-স্রোত মাতা প্রবাহিত হয়।
       ভাবিতে রোমাঞ্চ দেহ, বিদরে হৃদয়
       হা নৃশংস অভিমান কৌলিন্য-আশ্রিত!
       হা নৃশংস দেশাচার রাক্ষস-পালিত।
       আমাদের যা হবার হয়েছে, জননী—
       কর রক্ষা এই ভিক্ষা, এ সব নন্দিনী।[৪]

অনাথিনী আমি কুলের রমণী,
কুলীনের মেয়ে, কুলেতে রই।
কাঁদি কাটি খাটি, দিবস রজনী,
কপালের লেখা, যাতনা সই ॥
অনাথিনী আমি কুলের ললনা,
যে যা বলে তাই, শুনিয়ে যাই।
কখনো জানিনা, চাতুরী ছলনা,
কপালের দোষে যাতনা পাই।
পিঞ্জরে আমার চির অবস্থান,
পিঞ্জরে বসিয়ে কাহিনী কই।
পিঞ্জরেতে খান গান করি গান,
পিঞ্জরে শুইয়ে ঘুমায়ে রই।
       ওহে বঙ্গবাসি। নমস্কার করি,
       তোমাদের ঘরে যে রীতি আছে।
       চিরদিন আছি সেই রীতি ধরি,
অপরাধী নই, কাহারো কাছে ।।
বেড়ী খুলে দাও, উড়ে যাই বনে,
তোমাদের মত বাতাস খাই।
স্বপনে একথা ভাবিনিকা মনে।
কোথা উড়ে যাব, যাইতে নাই ৷৷
কেন যাব উড়ে, কুলে থাকা প্রথা,
দেশাচার-দাসী, আচারে গাঁথা।
ধরা বাধা রবো, ধরা বাধা কথা,
হাঁফায়ে মরিলে নাড়ি যে মাথা॥ [৫]

কৌলীন্য প্রথাকে বিদ্রুপ করিয়া কবি ঈশ্বর গুপ্ত লিখিলেন—

দুধে দাঁত ভাঙ্গে নাই শিশু নাম যার।
পিতামহী সম নারী দারা হয় তার।।
নরনারী তুল্য বিনা কিসে মন তোষে।
ব্যভিচার হয় শুদ্ধ এই সব দোষে॥
কুলকল্পে নয় রূপ সুলক্ষণ যাহ।
অবশ্য প্রামাণ্য করি শিরোধার্য তাহা॥
নচেৎ যে কুল তাহা দোষের কারণ।
পাপের গৌরব কেন করহ ধারণ॥
হে বিভু করুণাময় বিনয় আমার।
এ দেশের কুলধর্ম করহ সংহার॥ [৬]

উপরিউক্ত সামাজিক দুর্দশার চিত্ৰ-দর্শন করিয়া বহুবিবাহ প্রথা প্রতিরোধের জন্য ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকেই—ইংরেজি ভাষা শেখা যুবক সম্প্রদায় আন্দোলনের সূচনা করেন। পরবর্তী পর্যায়ে এদেশের সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতবর্গ—বিদ্যাসাগর, গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য ও মদনমোহন তর্কালঙ্কারের নাম উল্লেখযোগ্য।

নারী জাতির কল্যাণ চিন্তা করিয়া রামমোহন রায় বহুবিবাহ প্রথার বিরোধিতা করেন। তিনি শাস্ত্র হইতে বচন উদ্ধার করিয়া দেখাইয়াছিলেন যে, কতকগুলি বিশেষ অবস্থায় ঋষিগণ দারান্তর গ্রহণের ব্যবস্থা দিয়াছেন, অন্যথা নহে। তিনি দেখাইয়াছেন যে, শাস্ত্র অনুসারে পত্নী যদি সুরাসক্তা, স্বামীর প্রতি বিদ্বেষিনী, হিংস্রস্বভাবা, অর্থনাশিনী, রোগগ্রস্ত হয়, তবে স্বামী দারান্তর গ্রহণ করিতে পারে। স্ত্রী বন্ধ্যা হইলে আট বৎসর, মৃতবৎসা হইলে দশ বৎসর পরে এবং যদি কেবল কন্যা সন্তান হইতে থাকে তা হইলে এগারো বৎসর পর্যন্ত দেখিয়া, তবে পুরুষ বিবাহ করিতে পারে। সচ্চরিত্রা হিতকারিণী স্ত্রী রুগ্না হইলে, তার সম্মতি ভিন্ন অন্য পত্নী গ্রহণ চলিবে না। কোনো ব্যক্তি পত্নী বর্তমানে দারান্তর গ্রহণ করিতে চাহিলে, স্ত্রীর শাস্ত্র বর্ণিত কোন দোষ আছে তা ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট প্রমাণ করিতে পারিলে সেই ব্যক্তি পুনরায় বিবাহ করিবার অনুজ্ঞা পাইবে, নতুবা পাইবে না।

এইরূপ একটি আদেশনামা গভর্ণমেন্ট হইতে করিতে পারিলে ভালো হয়, এইরূপ অভিমত রামমোহন রায় প্রকাশ করিয়াছিলেন। তিনি লিখিয়াছিলেন—

Had a magistrate or other public officer been authorised by the rulers of the Empire to receive applications for his sanction to a second marriage during the life of a first wife, and to grant his consent only on such accusation as the foregoing substantiated, the above might have been rendered effectual and the distress of female sex in Bengal and the number of suicides would have been necessarily very much reduced. [৭]

ঊনবিংশ শতাব্দীর বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় বহুবিবাহ প্রথা নিবারণের জন্য মতামত প্রকাশিত হইয়াছিল। সর্বপ্রথম ‘বিদ্যাদর্শন’ পত্রিকাই এইরূপ মতামত প্রকাশ করিয়াছিল।[৮] এই শতকের তৃতীয় দশকে ‘জ্ঞানান্বেষণ’ পত্রিকা কুলীনদের বহুবিবাহের ফলে যে সামাজিক দুরবস্থার সূচনা হয়, তা লিখিয়াছিল এবং কুলীনদের নামের ফর্দ ও তাহাদের বাসস্থান এবং কে কত বিবাহ করিয়াছিলেন তাও প্রকাশ করিয়াছিল।

এ স্থলে কুলীনদের নাম ও তাহারা কে কত বিবাহ করিয়াছিলেন[৯] তা দেওয়া হইল—

ধাম:নাম:বিবাহ:
ময়াপাড়ারামচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ৬২
জয়রামপুরনিমাই মুখোপাধ্যায়৬০
আড়ুয়ারামকান্ত বন্দ্য৬০
মালগ্রামদিগম্বর চট্টোপাধ্যায়৫৩
নগরখুদিরাম মুখ৫৪
বলুটীদর্পনারায়ণ মুখ৫২
বলুটীনয়কড়ি বন্দ্য১৮
সিঙ্গীকৃষ্ণদাস বন্দ্য১৭
ফতেজঙ্গপরশম্ভু চট্টোপাধ্যায়৪০
পাঁচন্দিরামনারায়ণ মুখ৩৭
বিল্লগ্রামরাধাকান্ত বন্দ্য৩০
কৃষ্ণনগরকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়৩৪
কৃষ্ণনগরগোকুল মুখ২৭
হালদামহেশপুররাধাকান্ত চট্টো২৬
হামরাপুর মথুরাযজ্ঞেশ্বর মুখ২৫
সিঙ্গীগঙ্গানন্দ মুখ২২
কাশীপুরভগবান মুখ১৭
কাশীপুরশম্ভু মুখোপাধ্যায়২২
পানিহাটীরামধন মুখোপাধ্যায়১৮
বালীরামকান্ত চট্টোপাধ্যায়১৭
পারহাটতারাচাঁদ মুখ১৫
চন্দ্রহাটরাধাকান্ত চট্ট১৫
কইকলোজগন্নাথ মুখোপাধ্যায়১৪
কুরুম্বাকাশীনাথ বন্দ্য১৩
ওয়াড়ীরামকানাই চট্ট১২
খিরগ্রামত্রিলোচন মুখ১০
পতমপুরগিরিবর বন্দ্যোপাধ্যায়

‘সম্বাদ ভাস্কর’ পত্রিকার মাধ্যমে পণ্ডিত গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য মহাশয়ও বিধবা বিবাহের সহায়তা করিয়াছিলেন। তিনি ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্রের সমাজ সংস্কার কর্মের নির্ভীক প্রচারক। বহুবিবাহ নিবারণ আইন প্রণয়নে সরকার কেন বিলম্ব করিতেছিলেন, তাহার জন্য ‘সম্বাদ ভাস্কর’-এর অসহিষ্ণুতাও লক্ষণীয়।[১০]

‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকাও এই কুরীতি সংশোধনের জন্য বিশেষ আগ্রহী ছিল। উক্ত পত্রিকার মতে, কুলীন কুলোদ্ভব মহাত্মারা বর্তমান না থাকিলে অধিবেদনের পদ্ধতি বহুদিন পূর্বেই লুপ্ত হইয়া যাইত।[১১]

ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে পত্র-পত্রিকায় যেরূপ বহুবিবাহের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হইয়াছিল, সেইরপ সাহিত্যিকগণও সামাজিক কুসংস্কার সম্বন্ধে অবহিত ছিলেন এবং নাটক, উপন্যাসের মধ্যে সেই সংস্কারগুলির রূপদান করিয়া জনমত গঠনের প্রচেষ্টা করিয়াছিলেন। উদাহরণ স্বরূপ রামনারায়ণ তর্করত্নর ‘নবনাটক’, ‘কুলীন কুলসব’ এবং মনোমোহন বসুর ‘প্রণয় পরীক্ষা’ গ্রন্থাদিতে বহুবিবাহের অনিষ্টকারিতা, সপত্নী-বিদ্বেষের পরিণতি ও কৌলীন্য-প্রথার অসঙ্গতি সম্বন্ধে আলোচনা করিয়াছেন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা দুখানি উপন্যাস ‘সীতারাম’ ও ‘দেবীচৌধুরানী’র উল্লেখ করিতে পারা যায়। বিদ্যাসাগর মহাশয় বহুবিবাহ বিষয়ক দুখানি পুস্তক রচনা করিলেন।

‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকা বহুদিনের প্রথা নিবারণের পক্ষে আগ্রহী ছিল কিন্তু এই ধরনের সামাজিক প্রথায় বিদেশী সরকারের হস্তক্ষেপ পছন্দ করেন নাই। ‘সোমপ্রকাশ’ মন্তব্য করেন, বিদ্যাসাগরের বহুবিবাহ বিষয়ক লিখিত প্রস্তাব হইতে জানিতে পারা যায় যে, যেখানে আধুনিক শিক্ষার প্রসার হইয়াছে সেখানেই লোকের মনে সমাজ সংস্কারের উৎসাহ আসিয়াছে। অতএব আপনা হইতে এই প্রথা একদিন বিলুপ্ত হইবে। যাহারা বিনা কারণে একাধিক বিবাহ করিবে তাহাদের প্রত্যেককেই ৫০০ শত টাকা জরিমানা দিতে হইবে। ফলে বিবাহ ব্যবসায় রহিত হইবে। কিন্তু উক্ত মত পোষণের দ্বারা ধর্মীয় ব্যাপারে পরোক্ষ সরকারী হস্তক্ষেপকেই সমর্থন জানানো হইয়াছে।[১২]

১৮৫৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর তারিখে কাশীপুরে কিশোরীচাঁদ মিত্রের ভবনে বঙ্গের সামাজিক উন্নতিবিধায়নী একটি সমিতি স্থাপনের সম্ভাব্যতা আলোচনার জন্য একটি সভা আহূত হয়। ইহার ফলে ‘সমাজোন্নতি বিধায়িনী সুহৃদ সমিতি’ নামক এক সভা জন্মলাভ করে। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ইহার সভাপতি হন। বিদ্যাসাগরের পূর্বেই ১৮৫৫ সালের প্রারম্ভে এই সভা বহুবিবাহ নিবারণের নিমিত্ত ভারতীয় ব্যবস্থাপক সভায় সর্বপ্রথম আবেদন প্রেরণ করে।[১৩]

বিদ্যাসাগরের ‘বহুবিবাহ’ বিষয়ক দ্বিতীয় পুস্তক প্রকাশিত হইলে বাংলাদেশের সর্বত্র এই আন্দোলন বিস্তৃত হয়। এই প্রসঙ্গে পূর্ববঙ্গের রাসবিহারী মুখোপাধ্যায়ের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি ইংরেজিতে অনভিজ্ঞ ও প্রাচীন সম্প্রদায়ের লোক হইলেও বহুবিবাহের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন করিয়াছিলেন। তিনি জনগণকে উদ‌্‌বুদ্ধ করিবার জন্য বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করিয়া বক্তৃতা দিতেন। তিনি অনেকগুলি ছড়াগান রচনা করিয়াছিলেন এবং গ্রন্থ প্রকাশ করিয়াছিলেন। তদানীন্তন বাংলার ছোটলাট ক্যাম্বেল রাষ্ট্রীয় আইন দ্বারা যাহাতে বহুবিবাহ প্রথা রহিত করেন তজ্জন্য মহারানি ভিক্টোরিয়াকে অনুরোধ করিয়া এই লৌকিক গীতটি রচিত হইয়াছিল—

কেম্বলকে মা মহারানী কর রণে নিয়োজন।
(রাজা) বল্লালেরি চেলাদলে করিতে দমন।
কাজ নাই সিক সিফাইগণ—চাইনা গোলা বরিষণ,
(একটু) আইন-অসি খরষাণ করগো অর্পণ—
বিদ্যাসাগর সেনাপতি
মোদের রাসবিহারী হবে রথী
মোরা কুলীন যুবতী সেনা হব যে এখন।[১৪]

১৮৫৫ সালে সুহৃদ সমিতি নামক সভা হইতে ভারতীয় ব্যবস্থাপক সভায় বহুবিবাহ নিবারণকল্পে আবেদনপত্র পেশ করিবার পর, ১৮৫৬-য় বিদ্যাসাগর কর্তৃক বহুবিবাহ বিষয়ক আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। এই সময়ে যে আবেদনপত্র প্রেরিত হয় তাহাতে প্রায় পঁচিশ হাজার লোক স্বাক্ষর করেন।[১৫]

১৮৫৭ সালে ৭ ফেব্রুআরি জে. পি. গ্রান্ট (ভারত সরকারের সদস্য) ও রমাপ্রসাদ রায়ের (রামমোহন রায়ের পুত্র) যুগ্ম প্রচেষ্টায় বহুবিবাহ নিরোধের জন্য একটি বিলের খসড়া প্রস্তুত হইল। কিন্তু সিপাহী বিদ্রোহের জন্য সরকার বহুবিবাহ নিষেধক কোনো আইন প্রণয়নে সচেষ্ট হইলেন না। ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে দুর্গাচরণ নন্দী এবং আরও প্রায় ষোলশো স্বাক্ষরকারী বঙ্গদেশ হইতে ভারত সরকারের নিকট বহুবিবাহ নিবারণের আইন প্রণয়নের জন্য আবেদন করিলেন। তাহাতেও কোনো ফল না হওয়ায় বারানসীর রাজা দেবনারায়ণ সিংহ বড়লাট এলগিনের নিকট এই মর্মে একটি বিল পেশ করিলেন—’To regulate plurality of marriages between Hindoos in British India.’

১৮৬৬-র ১৯ মার্চ, তদানীন্তন লাটসাহেব সিসিল বিডনকে শেষবারের ন্যায় বহু ব্যক্তির স্বাক্ষরযুক্ত আবেদনপত্র প্রেরণ করা হইল।[১৬] লাটসাহেব কিছুদিন পরে স্বাক্ষরকারীদের কয়েকজন প্রধান ব্যক্তির সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছিলেন এবং আশ্বাস দিয়াছিলেন যে তিনি এ বিষয়ে যথাসাধ্য চেষ্টা করিবেন। ৫ এপ্রিল বাংলা সরকার ভারত সরকারের নিকট বহুবিবাহ প্রথা যাহাতে অন্তত বঙ্গদেশ হইতে রহিত হয় তাহার জন্য অনুরোধ জানাইলেন। কিন্তু ভারত সরকার এই বিষয়ে অগ্রসর হইলেন না।

অপরদিকে বহুবিবাহের সমর্থক সনাতনপন্থী দল নিশ্চিন্ত হইয়া বসিয়া ছিলেন। রাজা রাধাকান্ত দেবের নেতৃত্বে তাঁহারা অপর একটি আবেদনপত্র ভারত সরকার সমীপে প্রেরণ করিয়াছিলেন। ইহার জন্য ভারত সরকার হিন্দু সমাজ সংস্কারে শঙ্কিত হইলেন। ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দের অগস্ট মাসে ভারত সরকার বাংলা সরকারকে জানাইলেন যে, বহুবিবাহ নিরোধক আইন প্রণয়ন করিলে, রক্ষণশীল সম্প্রদায়ের মনে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হইতে পারে।

ভারত সরকারের পত্র প্রাপ্তির পর বাংলা সরকার এ বিষয়ে অনুসন্ধানের জন্য একটি তদন্ত কমিটি নিয়োগ করেন। সাতজন সদস্য বিশিষ্ট এই কমিটিতে ছিলেন—হব‌্ হাউস, প্রিন্সেপ, সত্যশরণ ঘোষাল, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রামনাথ ঠাকুর, জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, ও দিগম্বর মিত্র। এই সকল সদস্যের রিপোর্ট হইতে দেখা গেল যে, বিদ্যাসাগর ব্যতীত কেহই আইনের সাহায্যে এই প্রথা নিরোধে ইচ্ছুক ছিলেন না। তাঁহাদের অভিমত ছিল পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের সহিত ধীরে ধীরে এই প্রথা দূরীভূত হইবে। কিন্তু বিদ্যাসাগর এই প্রস্তাবের প্রতিবাদে লিখলেন—

I do not concur in the conclusion come to by the other gentlemen of the committee. I am of opinion that a declaratory Law might be passed without interfering with the liberty which Hindoos now by law possess in the matter of marriage.

তদন্ত কমিটির অন্যান্য সদস্য কৌলীন্য প্রথা ও বহুবিবাহকে সমাজের হানিকর কুসংস্কার জানিয়াও লোকমতের ভয়ে যথাকর্তব্য পালনে অসমর্থ হইয়া ছিলেন। একমাত্র বিদ্যাসাগরই লোকমতকে উপেক্ষা করিয়া লোকাশ্রয়ের প্রতি অনুরাগ দেখাইয়া মানসিক শক্তির পরিচয় দিয়াছিলেন। রাজদ্বারে এ আইন উপেক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও এই কার্যে যথাসাধ্য নিয়োগ করিয়া তিনি অসাধারণ বীর্যবত্তার পরিচয় দিয়াছিলেন।[১৭]

বহুবিবাহ প্রথার বিরুদ্ধে যতগুলি আপত্তি উঠিয়াছিল একের পর এক সবগুলিই যুক্তিতর্কের দ্বারা খণ্ডন করিয়াছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র। প্রথম আপত্তি ছিল—বহুবিবাহ নিবারিত হইলে, শাস্ত্রের অবমাননা হইবে ও ধর্মের লোপ হইবে।

বিদ্যাসাগর বিভিন্ন শাস্ত্র হইতে প্রসঙ্গ ও উদ্ধৃতি উল্লেখ করিয়া দেখাইলেন, বহুবিবাহ শাস্ত্রীয় ব্যাপার নয় এবং এই প্রথার দূরীকরণে শাস্ত্রীয় মর্যাদার হানি হয় না। তাঁহার মতে, ধর্মশাস্ত্র সমূহের মধ্যে মানবধর্ম শাস্ত্রই মাননীয়। তাহাতে আছে ব্রহ্মচর্যাশ্রমের পর গার্হস্থাশ্রমে প্রবেশের জন্য প্রত্যেক ব্যক্তির বিবাহ করা উচিত। প্রথম পত্নীর মৃত্যুতে দ্বিতীয়বার বিবাহ করা যায়, কারণ সস্ত্রীক গার্হস্থাশ্রম নির্বাহ করিতে হয়।

বিদ্যাসাগর, রামমোহনের ন্যায় মনুভাষ্য হইতে উদ্ধৃত করিলেন—”স্ত্রী যদি সুরাপায়িনী, ব্যভিচারিণী, সতত স্বামীর অভিপ্রায়ের বিপরীতকারিণী, চিররোগিণী, অতি ক্রুরস্বভাবা, অর্থনাশিনী হয় তাহা হইলে পুনরায় দার পরিগ্রহ চলিতে পারে। স্ত্রী বন্ধ্যা হইলে অষ্টম বর্ষে, মৃতপুত্রা হইলে দশম বর্ষে ও অপ্রিয়বাদিনী হইলে তদ্দণ্ডে পুনর্বিবাহ চলিতে পারে। ইহা ব্যতীত কাম্যবিবাহ আছে। কিন্তু এই বিবাহের দ্বারা পত্নীকে ধর্মপত্নী আখ্যা দেওয়া হয় না, তাহাকে কামপত্নী বলে।” তা হইলে আমরা দেখিলাম, মনু প্রভৃতি শাস্ত্রকারেরা পুনর্বিবাহের বিশেষ কতকগুলি ক্ষেত্র নির্দেশ করিয়াছেন। ইহার দ্বারা সর্বসাধারণে পুনর্বিবাহ প্রচলিত থাকা বোঝা যায় না।

দ্বিতীয় আপত্তি ছিল—বহুবিবাহ নিবারিত হইলে, কুলীন ব্রাহ্মণদের ধর্মলোপ হইবে।

কৌলীন্যের নিয়মানুসারে ইদানীং ‘কুলীন’ ব্যক্তিই অপ্রাপ্য। অতএব বহুবিবাহ নিবারিত হইলে কুলীনদিগের ধর্মলোপ ঘটিবে, এ আপত্তি স্বীকৃত হইতে পারে না। ইহা ব্যতীত কুলীন শ্রেণি বিধাতার সৃষ্টি নহে, মানব সমাজের সৃষ্টি।

তৃতীয় আপত্তি—বহুবিবাহ প্রথা নিবারিত হইলে, ভঙ্গ কুলীনদের সর্বনাশ হইবে।

ইহার উত্তর হইল, মেলবন্ধনের ফলে তাহাদের পুরাতন কুল নির্মূল হইয়াছিল। তৎপরে ‘বংশজ’ কন্যা পরিণয় দ্বারা পুনরায় নতন কুলের লোপাপত্তি হইয়াছিল। সুতরাং দুইবার যাহাদের কুলোচ্ছেদ হইয়াছে, তাহারা কুলীন বলিয়া গণ্য হইতে পারে না এবং তাহাদের সর্বনাশ হইবারও কোনো কারণ দেখা যায় না।

চতুর্থ আপত্তি—তৎকালীন সমাজে বহুবিবাহের অত্যাচার অনেক হ্রাসপ্রাপ্ত এবং অল্পদিনের মধ্যে সম্পূর্ণ লোপ পাইবে। অতএব এই প্রথারহিত করণে রাজশাসনের প্রয়োজন নাই।

তৎকালীন সমাজেও বহুবিবাহের অত্যাচার প্রচলিত ছিল। বিদ্যাসাগর মহাশয় প্রমাণস্বরূপ হুগলি জেলার ও জনাই গ্রামের কতকগুলি কুলীনের সংখ্যা ও বিবাহের সংখ্যা লিপিবদ্ধ করিয়াছেন। ইহা হইতে প্রমাণিত হয় যে, তৎকালীন সমাজেও বহুবিবাহ প্রচলিত ছিল। নিম্নে সে তালিকা প্রদত্ত হইল—

জনাই গ্রাম:ব্যক্তির সংখ্যা:বিবাহের সংখ্যা:
১০
১৪
৩৮

হুগলি জেলা:ব্যক্তির সংখ্যা:বিবাহের সংখ্যা:
৮০
৭২
৬২
৬২
৫৫
৫২
৫০
৪৪
৪১
৪০
৩৬
৩০
২৮
২৭
২৫
২২
২১
২০
১৯
১৭
১৬
১৩১৫
১৪
১৩
১১১২
১১
১৪১০
১৪
২০

পঞ্চম আপত্তি—বহুবিবাহ প্রথা রহিত হইলে, কায়স্থ জাতির আদ্যরসের ব্যাঘাত হইবে। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মতে, আদ্যরস কায়স্থ জাতির পক্ষে অপরিহার্য ব্যবহার নহে।[১৮] এই ব্যবহার অশেষ প্রকারে অনিষ্টকর, তাহার সন্দেহ নাই। যখন এই ব্যবহার রহিত হইলে কোনো অংশে, কায়স্থ জাতির অহিত, অধর্ম বা অন্যবিধ অসুবিধা ঘটিতেছে না, তখন উহা বহুবিবাহ নিবারণের আপত্তি স্বরপ গৃহীত হইতে পারে না।


৪.

বহুবিবাহ প্রথা নিবারণকল্পে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দান স্মরণীয় ও উল্লেখযোগ্য। প্রথমদিকে ইয়ং বেঙ্গল সম্প্রদায়ও এই প্রথার বিরুদ্ধে মনোভাব পোষণ করিয়াছিলেন। তারানাথ তর্কবাচস্পতি প্রমুখ ব্যক্তিরা প্রথমে বহুবিবাহ নিবারণের পক্ষে থাকিলেও, পরে শাস্ত্রের দোহাই দিয়া বিপক্ষে মত দেন। এই বিষয় লইয়া মতানৈক্যের ফলে তারানাথ তর্কবাচস্পতি ‘সনাতন ধর্মরক্ষিণী সভা’ পরিত্যাগ করেন। ঊনবিংশ শতাব্দীতে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ভারতবাসী তথা বাঙালি উপলব্ধি করিল বহুবিবাহ ব্যক্তিগত জীবন ও সমাজ জীবনের পক্ষে ক্ষতিকর ও মানসিক শান্তির পরিপন্থী। তাঁহাদের এই নুতন উপলব্ধিই বহুবিবাহ নিবারণে সাহায্য করিল।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশে নতুন শ্রেণিবিন্যাস দেখা যায়। সামন্তযুগের রক্তের কৌলীন্য ও আভিজাত্য আর্থিক কৌলীন্যের নিকট পরাস্ত হয়। ইংরেজ আমলে ‘সভ্যতা’র সূত্রপাত হওয়ায় স্থিতিশীল গ্রামীণ অর্থনৈতিক জীবন বিপর্যস্ত হইল। চিয়হায়ী বন্দোবস্তের ফলে ভূমি ব্যবস্থার পরিবর্তনে নতুন জমিদার শ্রেণির সৃষ্টি হইল। নুতন শ্রেণিবিন্যাসে দেখা দিল— ধনিক, মধ্যবিত্ত এবং শ্রমজীবী শ্রেণি। ফলে অনিবার্য পরিণতিরূপে দেখা দিল বিভিন্ন শ্রেণির বিচিত্র দ্বন্দ্ব ও সমন্বয় প্রয়াস। এবং এর ফলে মধ্যযুগের বংশকৌলীন্য তলাইয়া গেল। সাবেক কুলীনকুল ধ্বংস হইলে, বল্লালসেন প্রবর্তিত ‘কুলীনের বহুবিবাহ’ প্রথাও ক্রমে সমাজ থেকে অপসারিত হইল।

বহুবিবাহ নিবারণে সর্বশেষ আপত্তি ছিল—বহুবিবাহের ন্যায় সামাজিক দোষের প্রতিকার কল্পে সরকারকে হস্তক্ষেপ করতে দেওয়া অন্যায়। ভারতবর্ষের সকল প্রদেশে, হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই বহুবিবাহ প্রচলিত আছে। তাহার মধ্যে কেবল বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিরাই বহুবিবাহ প্রথা রহিত কল্পে সরকারের নিকট আবেদনপত্র প্রেরণ করেন। ভারতবর্ষের এক ক্ষুদ্র অংশ বাংলাদেশের মানুষের অনুরোধে ভারতবর্ষীয় যাবতীয় প্রজাকে সরকারের অসন্তুষ্ট করা অনুচিত।

ইহার উত্তর হইল, অবশ্যই অবাঞ্ছিত। কিন্তু সমাজের লোকের দ্বারা যদি দোষ-ত্রুটি দূর করা যাইত তবে সরকারকে হস্তক্ষেপ করার জন্য অনুরোধ করা হইত না। বহুবিবাহ প্রথা প্রচলিত থাকাতে বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে যত দোষ ও যত অনিষ্ট ঘটিতেছে, ভারতবর্ষের অন্য কোনো অংশে তদ্রুপ নহে, এমনকি বাংলাদেশের মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যেও সেরূপ অনিষ্টের খবর পাওয়া যায় না! অতএব মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত থাকিলেও, হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে উহার রহিতকরণ একান্তই প্রয়োজন।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য মধ্য-এশীয় আরব দেশগুলিতে বা অপরাপর মুসলমান সমাজে বহুবিবাহ আইনত নিষিদ্ধ হইলেও, একবিংশ শতাব্দী পার করা মানব সমাজ, এমনকি এদেশের বাঙালি হিন্দু সমাজ থেকেও তার বিলোপ পুরোপুরি হইয়া গিয়াছে এমনটা বলা যায় না। বহুবিবাহের কথা গ্রামদেশে, অশিক্ষিত বা অল্প শিক্ষিত পরিবারে যেমন শোনা যায় অল্পস্বল্প আজও। তেমনি শিক্ষিত সমাজেও। সংবাদে প্রকাশ কোনো কোনো রাজস্থানী সম্প্রদায়ে, প্রথা-পরম্পরায় এক স্ত্রী গর্ভবতী হওয়া মাত্র স্বামী দ্বিতীয় বিবাহ করিয়া থাকেন। সরকার স্বয়ং ঠেকাইতে পারে না এমত লোকাচার! স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশে হিন্দু ও মুসলিম উভয় ধর্ম সম্প্রদায়ের আইনত বহুবিবাহ বৈধ। এমনকি ভারতবর্ষেও মুসলিম পারিবারিক আইন কার্যত বহুবিবাহের পক্ষেই। যদিও সেকালের ন্যায় নারীরা আজ আর লোকলজ্জা বা ধর্মভয়ে অন্দরমহলে গুমরে কাঁদিয়া মরে না। একালে তাহারা তাহাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন।




পাদটীকা:

০১. সহমরণ বিষয়ে প্রবর্তক নিবর্তকের দ্বিতীয় সম্বাদ, রামমোহন রায়, ১৮১৯।

০২. সাময়িক পত্রে বাংলার সমাজচিত্র (২য় খণ্ড), ‘বহুবিবাহ, ১৫২ সংখ্যা, চৈত্র ১৭৭৭ শক’।

০৩. মানভঞ্জন (২), দাশরথি রায়, পৃ. ১৫১।

০৪. কবিতাবলী, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়।

০৫. আমি রমণী, ভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, ১২৮৭।

০৬. কৌলীন্য, ঈশ্বরগুপ্তের কবিতাবলী, পৃ. ১২৭।

০৭. বাংলার নারীজাগরণ, শ্রীপ্রভাতচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়।

০৮. সংবাদপত্রে সেকালের কথা, সম্পা. ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘বিদ্যাদর্শন’, আষাঢ়, শ্রাবণ ও ভাদ্র সংখ্যা, ১৭৫৪ শক (১৮৪২ খ্রি.)।

০৯. সংবাদপত্রে সেকালের কথা, সম্পা. ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘জ্ঞানান্বেষণ পত্রিকা’, ২৩ এপ্রিল ১৮৩৬।

১০.সাময়িক পত্রে বাংলার সমাজচিত্র (৩য় খণ্ড), সম্পা. বিনয় ঘোষ, ‘সম্বাদ ভাস্কর’, সম্পাদকীয়, ৯৫ সংখ্যা, ২৫ নভেম্বর, ১৮৫৬।

১১. সাময়িক পত্রে বাংলার সমাজচিত্র (২য় খণ্ড), সম্পা. বিনয় ঘোষ, ‘বহুবিবাহ, ১৫২ সংখ্যা, চৈত্র, ১৭৭৭ শক’।

১২. সাময়িক পত্রে বাংলার সমাজচিত্র (৪র্থ খণ্ড), সম্পা. বিনয় ঘোষ, সম্পাদকীয়।

১৩. কর্মবীর কিশোরীচাঁদ মিত্র, মন্মথনাথ ঘোষ, পৃ. ১০৭, কলিকাতা, ১৯২৭।

১৪. বিদ্যাসাগর বাংলাগদ্যের সূচনা ও ভারতের নারী প্রগতি, রমেশচন্দ্র মজুমদার।

১৫. ১৯শ শতাব্দীতে বাংলার নবজাগরণ, ডঃ সুশীলকুমার গুপ্ত, ১৯৫৯।

১৬. রাজা সত্যশরণ ঘোষাল, সারদাপ্রসাদ রায়, ঈশ্বরচন্দ্র ঘোষাল, দেবেন্দ্রনাথ মল্লিক, দুর্গাচরণ লাহা, কৃষ্ণকিশোর ঘোষ, জগদানন্দ মুখোপাধ্যায়, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, শ্যামাচরণ সরকার, দ্বারকানাথ মিত্র, প্রফুল্লকুমার সর্বাধিকারী, কৃষ্ণদাসপাল, ভারতচন্দ্র শিরোমণি, বিদ্যাসাগর প্রভৃতি।

১৭. বিদ্যাসাগর রচনাবলী, দেবকুমার বসু কৃত ভূমিকা, সম্পা. ডঃ অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়।

১৮. কায়স্থ জাতি দুই শ্রেণিতে বিভক্ত—কুলীন (ঘোষ, বসু, মিত্র প্রভৃতি পদবী) ও মৌলিক (দে, দত্ত, কর, পালিত প্রভৃতি পদবী)। কুলীন শ্রেণির জ্যেষ্ঠপুত্র প্রথমে কুলীন কন্যা ও পরে মৌলিক শ্রেণির গৃহে যে দ্বিতীয় দার পরিগ্রহ করেন, তাহার নাম আদ্যরস। ওই সকল মৌলিকের ঘরকে আদ্যরসের ঘর বলে।




প্রচ্ছদচিত্র সৌজন্য: www.urbansketchers.org