The real danger is not that computer will begin to think like men, but that men will begin to think like computer.

-Sidney Harris

‘বিজ্ঞান’ শব্দটা সুদূর অতীতকাল থেকে ব্যবহৃত হচ্ছে, আমাদের প্রাচীন সাহিত্যেই তার ভুরি ভুরি প্রমাণ আছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, “ওই দেখো, আমাদের মুনি-ঋষিরাই তো বিজ্ঞানের কথা কত বলেছেন, বিজ্ঞান তো তাঁদের করতলস্থ অমলকের মতো ছিল, তোমরা এখন আর নতুন কী শোনাবে?”—হিন্দুত্বের ধ্বজা উড়িয়ে এই জাতীয় কথা যারা বলছে, তাদের কথাকে মান্য ধরে, তাদের মতো করে আমরা এমন বুজরুকি-উজবুকি গলাধঃকরণ করতে পারব না। কারণ আমরা আধুনিক বিজ্ঞানের, যার শুরু ইতিহাসের স্বীকৃতি অনুসারে মোটামুটি ত্রয়োদশ শতকের প্রান্ত বা চতুর্দশ শতকের অগ্র থেকে; জ্ঞানজগৎ ওলট-পালট করে দেওয়া মহা মহা কীর্তিকাহিনি এখন অনেকটাই জেনে গেছি। আর এও জেনেছি যে, বিজ্ঞানের কাজ সেকালের মতো ‘মেটাফিজিকাল’ ব্যাপার নিয়ে নয় বরং ‘ফিজিকাল’ ব্যাপার নিয়ে। কাজেই শুধু শব্দগতভাবে অর্থটা ধরে নিয়ে, বিজ্ঞান অর্থাৎ বিশেষ জ্ঞান এবং সেটা হলো পরাজ্ঞান বা পরমার্থিক জ্ঞান—এসব ব্যাখ্যা এখন অচল।

তবু, বিজ্ঞান বলতে আমরা সাধারণেরা কী বুঝব তার একটা সহজবোধ্য অথচ নির্ভুল সংজ্ঞা তো দরকার। আর সেই সংজ্ঞাকে খুব সহজে যে দুটি শব্দে ব্যক্ত করা যায় তা হলো—কীভাবে ও কেন? এই জিজ্ঞাসাকে স্বর্গ-নরক কল্পরাজ্যের বা কার্যকারণ-যুক্তির বাইরে ফেলে রেখে নয় বা ধ্যানমগ্ন হয়ে কোনো ‘ঐশী বার্তা’র অপেক্ষায় থেকেও নয়, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুগত ও পার্থিব মহাবিশ্বের চরিত্র ও আচার-আচরণ সম্পৃক্ত সমস্ত জিজ্ঞাসার উত্তর-সন্ধানে যে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি-প্রকরণে অনুসরণ করা হয়—যার মধ্যে থাকে অনুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণ, সর্বাঙ্গীণ পরীক্ষণ আর পরিমাপন—এই পদ্ধতি ও প্রকরণকেই আমরা সাধারণ ভাবে বিজ্ঞান বলে জানি।

এই সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে পর্যবেক্ষণ-পরীক্ষণ-নির্ভর অনুসন্ধানের স্থির লক্ষ্য হলো ওই বিশেষ প্রমিত জাগতিক সদাঘটনের পেছনের অকাট্য নিয়ম বা সূত্র আবিষ্কার। এই ‘ফর্মেশন অব‌্ ল’ হলো বিশুদ্ধ বিজ্ঞানের মূল চরিত্রলক্ষণ আর ওই ‘সিস্টেমেটিক স্টাডি’ হলো বিজ্ঞান কর্মের অপরিহার্য পদ্ধতি-প্রকরণ। এখন মানুষ তার প্রয়োজনীয় যেসব বিদ্যাচর্চায় আধুনিককালে বৈজ্ঞানিকতার তাগিদে ওই ‘সিস্টেমেটিক স্টাডি’-র শর্ত প্রয়োগ করে—সেই সব বিদ্যাবিষয়ের সঙ্গে অনেকক্ষেত্রেই ‘বিজ্ঞান’ কথাটা বসিয়ে নেয়—যেমন, সমাজবিজ্ঞান, ভাষাবিজ্ঞান, আবহাওয়াবিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান ইত্যাদি। শিক্ষা-ও তেমনই একটি বিজ্ঞান।

কিন্তু অধুনা সময়ে, বিশেষত গত শতকের মধ্যভাগ বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কাল থেকে বর্তমানের গোলোকায়িত পুঁজিবাদী অর্থনীতির সর্বব্যাপী আগ্রাসনে ‘সিস্টেমেটিক স্টাডি’-র সহায়করূপে প্রযুক্তি নিয়ে যে ধুন্ধুমার কোলাহল জেগে উঠেছে তা বিশ্বজুড়ে বিপুল বিভ্রান্তি ও বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। বর্তমানে আর কেউ ‘বিজ্ঞানের যুগ’ বলতে চাইছে না, বরং বলা হচ্ছে এটা—‘প্রযুক্তির যুগ’। প্রযুক্তি আচ্ছন্নতা একালে এমনই এক উন্মত্ত অন্ধ দৌড়ের সৃষ্টি করেছে যে, কথাটার অর্থ, প্রকৃত সংজ্ঞা বা তাৎপর্য বোঝাবুঝির বালাই সরিয়ে রেখে আমরা তাকে মানুষের, তার সভ্যতার বিকাশ ও উন্নয়নের নির্বিকল্প উপায়রূপে মেনে নিচ্ছি, প্রযুক্তি মানুষের হাতিয়ার না মানুষ প্রযুক্তির হাতিয়ার তা ঘুলিয়ে ফেলে সভ্যতার সংকট সৃষ্টি করছি এবং প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানকে সমার্থকরূপে গ্রহণ করে মানুষের বোধবুদ্ধিকে বিভ্রান্তির আঁধারে ঠেলে দিচ্ছি। এই বিভ্রান্তি আমাদের এমন জায়গায় নিয়ে গিয়েছে যে, আমরা একজন ‘প্রতিভাবান শ্রদ্ধেয় প্রযুক্তিবিদ’-কেও অনায়াস দ্বিধাহীনতায় ‘বিজ্ঞানী’ হিসাবে আখ্যায়িত করছি।

সভ্যতার ইতিহাসে ‘প্রযুক্তি’ আদতে নতুন কোনো ব্যাপার নয়, শব্দটাই শুধু যা ইদানীং আকছার ব্যবহৃত হচ্ছে। সেই আদিমকাল থেকে প্রযুক্তির সঙ্গে মানুষের সুখবৃদ্ধি ও ক্ষমতাবৃদ্ধি উভয়ই জড়িয়ে। আর সব মানুষ তো ‘দেবদূত’ নয়, ‘শয়তান’-ও আছে অনেক। থাকবেই। প্রযুক্তিজাত ক্ষমতা কার বেশি, প্রযুক্তির ওপর দখলদারি ও প্রযুক্তির দখলকারী শক্তি প্রয়োগের ক্ষমতা কার বেশি—তার ওপর নির্ভর করে, কার আধিপত্য কায়েম থাকবে বিশ্বজুড়ে এবং মানবসভ্যতার ইতিহাস বারংবার দেখিয়ে দেয়—এ ব্যাপারে ‘শয়তান’-ই জয়ী হয়। তাই আইনস্টাইনকেও আক্ষেপ করে বলতে হয়: ‘It has become appallingly obvious that our technology has exceeded our humanity.’

মানুষ জীবনকে সহজ ও সুন্দর করার জন্যে প্রযুক্তিকে করেছিল হাতিয়ার। এখন সেই জীবনকেই সরিয়ে দিয়ে তার আসনে বসতে চলেছে প্রযুক্তি। আধুনিককালে প্রযুক্তির সবচেয়ে বড় বিপ্লবগুলোর অন্যতম—তথ্যপ্রযুক্তি। তারই তথাকথিত বিস্ময়কর অগ্রগতি প্রসঙ্গে বিজ্ঞানী অ্যান্ড্রু ব্রাউন বলেছেন: ‘The Internet is so big, so powerfull and pointless that for some people it is a complete substitute for life.‘ প্রযুক্তির লাগামছাড়া প্রয়োগ কীভাবে মানুষের অন্তঃসত্তাকে বিলুপ্ত করে দিচ্ছে, বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে মানুষকে তার জীবনের মৌল ভিত্তি থেকে তার ধারণা পাওয়া যায় আরেক বিজ্ঞানীর কথায়:

Soon silence will have passed into legend, Man has turned his back on silence. Day after day he invents machines and the devices that increase noise and distract from the essence of life, contemplation and meditation.

প্রযুক্তির এই কোলাহল ও আস্ফালনের সামনে পড়ে দিশাহারা মানুষ তাকে করে তুলতে চাইছে আরও সর্বগ্রাসী। বিশ্বে প্রযুক্তির অন্যতম বৃহৎ ব্যবসায়ী ও গুণগ্রাহী; মার্কিন দেশের এক বিজ্ঞানী ডব্লিউ. ব্রায়ান আর্থার তো প্রযুক্তির দাঁত-নখ সব ছেঁটে ফেলে অতি সংক্ষেপে তার এক সংজ্ঞা দিয়ে বসেছেন: ‘a means to fulfill a human purpose…’ তার মানে শিশুকে মা-এর স্তন্যপান করানোও একটি প্রযুক্তি। যত উন্নত স্বয়ংচালিত যন্ত্রই উদ্ভাবন হোক না কেন, একটা স্তরে মানুষের ভূমিকা থাকবেই। প্রযুক্তি মানুষের প্রয়োজন মেটানোর জন্যে সৃষ্ট। মানুষ প্রযুক্তির প্রয়োজন মেটানোর জন্যে জন্মায়নি—মানুষ না থাকলে প্রযুক্তি অস্তিত্বহীন। প্রযুক্তি না থাকলেও মানুষ থাকবে। হয়তো তার আদিমতম অবস্থায়।

এখানেই মানবসভ্যতাকে এক উভয় সংকটের সম্মুখীন হতে হয়—প্রযুক্তিকে ত্যাগ করলে সভ্যতাই (অবশ্য ‘সভ্যতা’ যে কী—তা নিয়ে বিতর্ক আছে, আমরা সর্বসাধারণ্যে প্রচলিত ধারণাকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছি) যে এগোয় না, আবার প্রযুক্তিকে অমানবিক যথেচ্ছাচারের হাতে ছেড়ে দিলে যে—সেই সভ্যতারই সংকট ঘনায়! এই উভয় সংকটের সুযোগ নিয়ে, প্রযুক্তির বিশ্বব্যাপ্ত (বিশেষত পাশ্চাত্য ও দু-চারটি প্রাচ্য দেশ) ফড়েরা তার প্রায় আলোক-উজানো গতিতে উন্নতি ও অসংখ্য চোখ-মন-ধাঁধানো উদ্ভাবন দেখিয়ে আজ অধিকাংশ মানুষকে প্রায় মেসমারাইজ় করে বিশ্বাস করাতে চাইছে প্রযুক্তিই আমাদের—’জীবনস্বামী’; জীবনধারণের শুধু নয়, জীবনসাধনার সর্বপ্রচেষ্টা প্রযুক্তি-সম্ভব; প্রযুক্তির লম্বা-চওড়া সংজ্ঞা দিয়ে বলা হচ্ছে—যন্ত্রপাতি, হাতিয়ার, ঘরবাড়ি, যানবাহন প্রভৃতির মতো স্পর্শাধিগম্য (tangible) সর্ববস্তু যেমন; তেমনি কনসালটেন্সি, কাউন্সেলিং, প্রশিক্ষণ প্রভৃতির মতো স্পর্শানধিগম্য বিষয়ও প্রযুক্তি।


২.

মানবজীবনের বিকাশ ও সকল প্রয়োজন সাধনের সর্বপদক্ষেপ যদি প্রযুক্তি বলেই বিবেচিত হয়; স্বাস্থ্য বা চিকিৎসা ও খাদ্যপ্রযুক্তি প্রভৃতি অভিধা যদি গৃহীত হয়ে গিয়েই থাকে; সংগীত, নাটক, চিত্রকলা প্রভৃতি যদি নব নব প্রযুক্তির প্রয়োগে নবকলেবর ধারণ করতে উঠে পড়ে লাগতে পারে—তাহলে মানুষের মানুষ হয়ে ওঠার অপরিহার্য ও সর্বজনীন শর্ত শিক্ষাই বা প্রযুক্তির চরিত্র গ্রহণ করবে না কেন? তাই অতি আধুনিককালে, আধুনিকতার গর্ব-ধারায় পরিস্নাত হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় ‘শিক্ষা’র ঊর্ধ্বতন বিকাশ ঘটানো হয়েছে—‘শিক্ষা প্রযুক্তি’ বা ‘এডুকেশন টেকনোলজিতে’-তে। পাশ্চাত্যর উন্নত দেশগুলোতে তো ‘কানু বিনে গীত নেই’-এর মতো শিক্ষা-ব্যাপারে শিক্ষা প্রযুক্তি ছাড়া প্রায় কোনো কথাই নেই; আমাদের দেশেও এই ধারণাটা ঢুকে পড়েছে এবং তা নিয়ে শিক্ষা-বিশেষজ্ঞরা বেশ জোর মাথা ঘামানো শুরু করে দিয়েছেন। করজোরে সব প্রযুক্তিরই পূর্ণগ্রাসের গ্রহণ প্রার্থনা করছি যখন, তখন এটাই বা বাদ যায় কেন?

এখন ব্যাপারটা কী? ‘শিক্ষা’ আবহমানকালের ব্যাপার, ‘প্রযুক্তি’ও তা-ই; দুয়েরই কালের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে বিবর্তন-পরিবর্তন-ঊর্ধ্বতন যতই যা ঘটুক না কেন—দুজনেই ছিল সে-ই লগ্ন থেকে, যখন প্রথম আদি সেই শক্তি জাগিল গগনে গগনে। কিন্তু কবেই বা এরা দুয়ে মিলে একাকার হলো? হেনরি এলিংটন, ফ্রেড পার্সিভাল ও ফিল রেস-এর মতো ‘এডুকেশন টেকনোলজি’র গবেষকরা বলছেন:

Educational Technology first emerged as a discipline in its own right in the 1950s, since when a great number of books and journal articles about it appeared.

মনে করার কোনো কারণ নেই যে, এটাই শিক্ষা প্রযুক্তির জন্মকাল, বরং এটা সে-ই কালবৃত্তকে নির্দেশ করে, যখন শিক্ষাক্ষেত্রে প্রযুক্তি ব্যাপারটা প্রধান হয়ে উঠল।

বিখ্যাত শিক্ষাতাত্ত্বিক লুইস এলট‌ন সেই জন্যে বলছেন, ‘Educational technology has undergone a progressive change of emphasis since the end of the Second World war…’ এই যে সময়ের কথা এঁরা বলেছেন, সেটা অবশ্য পাশ্চাত্য ভূখণ্ডের, বিশেষ করে মার্কিন দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য; সদ্য স্বাধীন আমাদের দেশে তখন শিক্ষা প্রযুক্তি নিয়ে ভাবার প্রশ্নই ছিল না।

যদিও সেই কতকাল আগে রবীন্দ্রনাথই কিছু যন্ত্রপাতি কিনে এনেছিলেন শান্তিনিকেতনে কৃষিকাজ, জল-ব্যবস্থা ইত্যাদি উন্নত করার উদ্দেশ্যে। শিক্ষাক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহারেও কি এই কবি পথিকৃৎ? অবশ্য কারিগরি, চিকিৎসা ও বিজ্ঞান ইত্যাদি শিক্ষাকেন্দ্রে তখন যেটুকু প্রযুক্তির আমদানি হয়েছিল তার কথা আলাদা। যাই হোক, শিক্ষা প্রযুক্তি বা এডুকেশনাল টেকনোলজি—এই শব্দ-যুগলের নিহিতার্থ কী তা নিয়ে বিশেষজ্ঞ মহলেই বিভ্রান্তি আছে এবং তার ফলে এই নামটির বদলে সর্বজনগ্রাহ্য একমেবাদ্বিতীয় কোনো নাম (বা সংজ্ঞা) আজও কেউ ভেবে উঠতে পারেননি। এক পক্ষের মতে, এই বিশেষ প্রযুক্তি একান্তভাবে শিক্ষাকাজে ব্যবহৃত যান্ত্রিক উপকরণ ও মাধ্যম যেমন, টেলিভিশন, প্রোজেক্টর, টেপ-রেকর্ডার, কম্পিউটার ইত্যাদিকেই বোঝায়। আরেক পক্ষের মত—এসব উপকরণ মাত্র, আছে, থাক; কিন্তু শিক্ষা প্রযুক্তি বা এডুকেশনাল টেকনোলজির আসল অর্থ হলো, সমগ্র শিখন/শিক্ষণ পদ্ধতির কার্যকারিতা পূর্ণমাত্রায় উন্নীত করার উদ্দেশ্যে তার নিদানিক (clinical) ও প্রণালীবদ্ধ বিশ্লেষণ, অবশ্যই যন্ত্রের সাহায্যে।

শিক্ষার প্রযুক্তি, প্রযুক্তির শিক্ষা
শিক্ষক যখন যন্ত্র

এই দ্বিতীয় অর্থ নির্ধারণ সম্পর্কেই যত সন্দেহ, বিতর্ক, আপত্তি; এমন অভিযোগও করেছেন অনেকে যে, এই অর্থকে মান্যতা দিয়ে যাঁরা শিক্ষা প্রযুক্তি প্রয়োগ করতে চান তাঁরা শিক্ষার্থীদের বৌদ্ধিক উদ্দীপন ও মানবিক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা অনুসন্ধিৎসু মানুষ বলে ভাবেন না, ব্যক্তিসত্তাহীন ব্যাটারিচালিত না-মানুষ বলে মনে করেন। আমরাও এই অভিযোগের শরিক এবং মনে করি শিক্ষা প্রযুক্তির এটাই হলো ভয়ংকর দিক। এই অভিযোগ অস্বীকার করতে না পেরে, বিব্রত হয়ে পাশ্চাত্য দেশেরই অনেক কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের বিভাগীয় নাম পরিবর্তন করে ‘এডুকেশনাল টেকনোলজি ইউনিট’-এর বদলে ‘এডুকেশনাল ডেভলপমেন্ট ইউনিট’ বা ‘লার্নিং ইউনিট’ জাতীয় নামকরণের দিকে ঝুঁকেছে।

পুঁজির দুনিয়াদারির রিমোট কন্ট্রোল যাদের হাতের মুঠোয় তারা কিন্তু সুকৌশলে লাগাতার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, প্রথম অর্থটাকে গৌণ করে দিয়ে এই দ্বিতীয় অর্থেই শিক্ষা প্রযুক্তির ধারণাটা বিশ্বজুড়ে মানুষের মগজে সেঁধিয়ে দিতে। উদাহরণ: আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ব্লুমিংটনে অবস্থিত বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও পুরোনো গবেষণা-প্রতিষ্ঠান ‘অ্যাসোসিয়েশন ফর এডুকেশনাল কমিউনিকেশন অ্যান্ড টেকনোলজি (এইসিটি)’-কে শিক্ষা প্রযুক্তির এই ধারণার প্রায় জন্মদাতাই বলা যায়। ১৯২৩ সালে জাত এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ১৯৭৩ থেকে এডুকেশনাল টেকনোলজিস্টদের আন্তর্জাতিক সংগঠন এবং শিক্ষা প্রযুক্তি নিয়ে নিরলস গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে।

এই প্রতিষ্ঠান শিক্ষা প্রযুক্তির সর্বশেষ যে সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছে—তা বিশ্বময় ফেরি করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে এবং এমন দাবিও তুলে দেওয়া হয়েছে যে, এই সংজ্ঞা একুশ শতকে মানুষের শিক্ষা চিন্তাকে পরিচালিত করার সর্বশেষ আলোক-সংকেত। সংজ্ঞাটি হলো:

Educational Technology is the study and ethical practice of facilitating learning and improving performance by creating, using and managing appropriate technological processes and resources.

সহজেই বোধগম্য হয় শিক্ষা প্রযুক্তির অর্থ সম্পর্কে পূর্বোক্ত দ্বিতীয় মতটির (অভিযুক্ত!) সঙ্গে এই সংজ্ঞার সাযুজ্য; শুধু গঙ্গাজল ছিটিয়ে সবকিছু পবিত্র করে দেওয়ার মতো ‘এথিকাল’ শব্দটা জুড়ে দেওয়া ছাড়া।

তাহলে, ব্যক্তিসত্তাহীন ব্যাটারিচালিত না-মানুষ তৈরির অভিযোগ এই সংজ্ঞাটির বিরুদ্ধেও প্রযোজ্য এবং তা হতেই হবে। কারণ পুঁজির নিঃশ্বাস-বায়ু বাজারতন্ত্র এবং সাম্রাজ্য কর্পোরেট জগৎ তো হাতে স্বর্গ পায় ওই ব্যক্তিসত্তাহীন ব্যাটারিচালিত না-মানুষের বাড়বাড়ন্ত হলে। লক্ষ করে দেখুন, সংজ্ঞাটিতে বলা হয়েছে লার্নিং-এর সুব্যবস্থা ও সাফল্যবৃদ্ধি ঘটবে টেকনোলজিকাল প্রসেস ও রিসোর্স-এর সৃষ্টি, ব্যবহার ও চালনার মাধ্যমে; এখন, টোকনোলজি তো যন্ত্রেরই (মেশিন, টুল‌্স ইত্যাদি) কাজকারবার, টেকনোলজিকাল প্রসেস ও রিসোর্স যান্ত্রিক বা যন্ত্রনির্ভর পদ্ধতি-প্রকরণ ও যন্ত্রের সমাহার। আলোচ্য সংজ্ঞাটাতে কেমন সুকৌশলে যন্ত্রের কথাটা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, শিক্ষা প্রযুক্তির এইসব সংজ্ঞাদাতারা চান শেখার ব্যাপারটা কীভাবে হবে, তার উন্নতি কোন উপায়ে হবে তা ঠিক করে দেবে যন্ত্র। শিক্ষক যিনি মানুষ, যন্ত্র নন; তারা যাবেন কোথায়? তিনি মেশিন না মেশিনম্যান হবেন?


৩.

শিক্ষা প্রযুক্তি কী—সে সম্পর্কে দুটো অভিমত থেকে দুটো সম্পূর্ণ পৃথক আলোচনাযোগ্য ধারণার উদ্ভব হয়। এক, শিক্ষায় প্রযুক্তি বা টেকনোলজি ইন এডুকেশন। দুই, শিক্ষার প্রযুক্তি বা টেকনোলজি অব‌্ এডুকেশন। এছাড়া আরও একটি ধারণার জন্ম হতে পারে কিনা সে আশঙ্কাও জাগে। সামগ্রিক শিক্ষা বিষয়টাই একটি প্রযুক্তি-রূপে গণ্য হতে পারে কিনা; তবে হলেও তা ভবিষ্যতের গর্ভে, সে নিয়ে আলোচনাও ভবিষ্যতের জন্যে তোলা থাক।

শিক্ষায় প্রযুক্তি বা টেকনোলজি ইন এডুকেশন ধারণাটা অপেক্ষাকৃত সহজবোধ্য এবং তার একটি চিত্র সাধারণের মনে মোটামুটি আঁকা হয়ে গেছে। তথ্য ও জ্ঞান শিক্ষাগ্রহণকারীর কাছে শিক্ষাপ্রদানকারী পৌঁছে দেবেন, এটা শিক্ষাকর্মের অন্যতম প্রধান অঙ্গ, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, কী উপায়ে বা পদ্ধতিতে তা নিয়ে অবশ্য বিতর্ক রয়েছে। সাধারণভাবে শিক্ষায় প্রযুক্তি বলতে আমরা বুঝি সেই সকল উপাদানকে—যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর কাছে ‘তথ্য’ বা ‘জ্ঞান’ উপস্থাপিত করা যায়। এখন আমাদের কাছে খুবই পরিচিত এই ধরনের অনেক জড় বা যান্ত্রিক উপকরণ রয়েছে যা কমবেশি শিক্ষাদানে ব্যবহৃত হয়ে আসছে অনেককাল ধরেই—যেমন, নানাপ্রকার চার্ট ও গ্রাফ বা নকশা, তথ্য তালিকা। পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজে দরকারি টুকিটাকি জিনিসপত্র বা যন্ত্রপাতি, অভিক্ষেপক ইলেকট্রনিক যন্ত্র, রেডিও, টেপ-রেকর্ডার, টেলিভিশন, ফিল‌্ম, ভিডিও, সর্বোপরি কম্পিউটার, ইন্টারনেট ইত্যাদি।

কম্পিউটার ও ইন্টারনেট বা তথ্যপ্রযুক্তি বর্তমানে সব প্রযুক্তির ওপরে ঠাঁই নিয়েছে এবং এমন অকল্পনীয় তার ব্যবহারের বিস্তার যে, সে-ই প্রযুক্তির কথা বললেই মনে আসে—আইটি মানে তথ্যপ্রযুক্তি, আর শিক্ষায় প্রযুক্তির ধারণাটাও সেই সঙ্গে কম্পিউটার-ইন্টারনেটের মধ্যে সঙ্কুচিত হয়ে আসে। সে যাই হোক, এইসব প্রযুক্তি-উপকরণ যে তথ্য ও জ্ঞানের ব্যাপ্তি, প্রসার ও আধুনিকীকরণ ঘটায় সব ব্যবহারকারীর জন্যেই—তা অস্বীকার করা যায় না। সেক্ষেত্রে, শিক্ষায় প্রযুক্তি বা ‘টেকনোলজি ইন এডুকেশন’ ধারণাটিকে গ্রহণযোগ্য বলে ধরা যেতেই পারে। যদি না আমরা লক্ষ্যভ্রষ্ট হই, যদি না ভুলে যাই যে, প্রযুক্তির জন্যে প্রযুক্তি নয়—শিখনের জন্যে প্রযুক্তি; শিখন মুখ্য, প্রযুক্তি তার সহায়ক।

এই সহায়কের ভূমিকা থেকে নির্ধারকের ভূমিকায় প্রযুক্তিকে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার জন্যেই দ্বিতীয় ধারণাটি (টেকনোলজি অব‌্ এডুকেশন)-র উৎপত্তি। কেননা শিক্ষা প্রযুক্তির যাঁরা নিয়ামক ও জোগানদার তাঁরা দেখলেন, শুধু শিক্ষায় প্রযুক্তি বা প্রাথমিক স্তর থেকে উন্নততম স্তর পর্যন্ত যান্ত্রিক উপকরণের ব্যবহার সীমাবদ্ধ রাখলে—তা শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত মানুষেরই নিয়ন্ত্রণে থাকে। মানুষই চিন্তাভাবনা করে শিখন/শিক্ষণের কাজে কতটুকু কীভাবে ব্যবহার করলে কাজটি সার্থকতর ও উন্নততর হতে পারে। কাজেই পুরো এডুকেশন টেকনোলজি বিষয়টারই ভোল পালটানো দরকার—একে শিক্ষার প্রযুক্তি বা টেকনোলজি অব‌্ এডুকেশন-এর রূপ দেওয়া দরকার।

…at this stage in the development of educational technology, many people became aware that there was much in education… which could be improved by thinking more carefully about all aspects of design of teaching/learning situations. Such considerations led to a new, broader interpretation of ‘educational technology’ as the entire technology of education…rather than merely as the use of technology in education, with the latter being regarded as merely a part of the former rather than the whole field as had previously been the case.

—’A Handbook of Educational Technology’, Fred Percival

শিক্ষা প্রযুক্তির এই আধুনিকতম বিভাগ দাবি করছে যে ‘শিক্ষার প্রযুক্তি’ই সমগ্র শিক্ষা প্রযুক্তি এবং যা এতকাল ধরে আমাদের খুব পরিচিত ও ব্যবহৃত সেই ‘শিক্ষায় প্রযুক্তি’ তার নিতান্ত গৌণ অংশ। অর্থাৎ ‘শিক্ষায় প্রযুক্তি’র যেসব উপকরণ ও তার ভূমিকার কথা আগেই বলা হয়েছে—তারা শিক্ষার কার্যকর ও লক্ষ্য অর্জনে আর তেমন কোনো নির্ণায়ক ভূমিকায় থাকবে না। এই ভাবনার উদ্ভাবক যে ‘মেনি পিপল’—তারা কারা—তাও আগেই উল্লেখিত। তারা চাইছেন, শিক্ষণ/শিখনের রূপদানের সমস্ত দিক নিয়ে থিংকিং বা চিন্তাভাবনাও হবে এই প্রযুক্তির দায়িত্বে। অর্থাৎ ‘চিন্তা’রও ক্ষমতা জাহির করছে—শিক্ষার প্রযুক্তি।

আমরা তো জানি, প্রাণীরই একমাত্র চিন্তাশক্তি থাকতে পারে এবং মানুষই সেই প্রাণী যে কেবল অভ্যাসের অধীন নয়, সে চিন্তাশীল। নিপ্রাণ জড়ের চিন্তাশক্তি থাকতে পারে না এবং প্রযুক্তির যে প্রাণ নেই তা কেউ অস্বীকার করবে কীভাবে? শিক্ষাক্ষেত্রে চিন্তায় সক্ষম মানুষ তো প্রথমে অভিভাবক (গৃহে)—তারপর শিক্ষক (বিদ্যালয়ে)—তারও পরে সর্বস্তরের শিক্ষা-পরিচালকবৃন্দ। এখন মানুষ গড়ার লক্ষ্যে শিক্ষাকে কীভাবে পূর্ণ সার্থকতার লক্ষ্যে নিয়ে যাওয়া যায় সে পরিকল্পনার জন্যে চিন্তা করবেন তো এইসব মানুষেরাই, নাকি তাদের সেই চিন্তা সাপ্লাই করবে প্রাণহীন প্রযুক্তি! শিক্ষার প্রযুক্তি কিন্তু উদ্ভাবন করে ফেলেছে শিক্ষণ/শিখন প্রক্রিয়ার কিছু লক্ষণ; যেমন: শিখনের গুণমান বা বিষয়ের ওপর দখলের মান বাড়ানো; কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে শিক্ষার্থীর সময় কমানো; শিখনের গুণমান না কমিয়ে, শিক্ষার্থী সংখ্যা যাই থাকুক, শিক্ষকের দক্ষতা বাড়ানো; গুণমান না কমিয়ে ব্যয় কমানো; শিক্ষার্থীর স্বাধীনতা বাড়ানো ইত্যাদি।


৪.

ভালোমন্দ বিচারে আমরা এই লক্ষণগুলি খারিজ করতে চাইছি না, আর এগুলি এমন কিছু অভিনবও নয়, এগুলি ভাবার জন্যে কোনো প্রযুক্তির দরকার হয় না, দক্ষ ও দায়িত্বশীল শিক্ষক ও শিক্ষা প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত অন্যান্যরা নিজেরাই এসব কথা ভাবেন বা ভাবতে পারেন। এবং শিক্ষার পূর্ণ সার্থকতার আরও অনেক লক্ষণের কথা ও যার যার বিদ্যালয়ের অবস্থান, পরিবেশ, শিক্ষার্থীর অবস্থা, আর্থিক সঙ্গতি ইত্যাদি অনেক দিক বিচার করে নতুন নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবনের কথা তাদের চিন্তা করতে হয়, এবং করাই উচিত। প্রাণবান শিক্ষক নিষ্প্রাণ প্রযুক্তির দেখানো পথে হাঁটবেন তা মোটেও অভিপ্রেত হতে পারে না।

প্রযুক্তির নিষ্প্রাণতা ও সীমাবদ্ধতা বোঝাতে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “মানুষের কাছ হইতে মানুষ যাহা পায় কলের কাছ হইতে তাহা পাইতে পারে না। কল সম্মুখে উপস্থিত করে কিন্তু দান করে না—তাহা তেল দিতে পারে কিন্তু আলো জ্বালাইবার সাধ্য তাহার নাই।” প্রায় এইরকম কথা মার্কিনি লেখক ওয়াল্টার লিপম্যান বলেছিলেন, ’You cannot endow even the best machine with initiative; the jolliest steamroller will not plant flowers.’ প্রযুক্তির যুগে, তথ্য প্রযুক্তির ‘বিধাতাপুরুষ’ বিল গেট‌্স বলেছেন: “Technology is just a tool, in terms of getting them kinds of working together and motivating them, the teacher is the most important.”—এ কথাগুলির সত্যতা যদি স্বীকার করি, তাহলে ‘শিক্ষার প্রযুক্তি’-র কার্যকারিতা কতটা তা কি প্রতীয়মান হয় না?

আরেকটা কথাও বলার, শিক্ষার প্রযুক্তি নিয়ে যাঁরা চিন্তান্বিত, নানাবিধ সওয়াল-জবাব করেন তাঁরা কেবলই শিখন/ শিক্ষণের উন্নতির কথা বলেন—মনে হয় ‘শিক্ষা’ বলতে তাঁরা একেবারে ক্লাসরুম-কেন্দ্রিক ধারণায় শুধু শিক্ষণ/শিখন প্রক্রিয়াকেই বোঝেন। তাঁর শিক্ষা-দর্শন যে বাতিল হবে—তা বুঝে নিয়ে বহুপূর্বে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং লিখে গিয়েছেন, ‘এ-সকল কথা মিস্টিসিজম বা ভাবকুহেলিকা বলিয়া উড়াইয়া দিবেন…’এখনকার দিনের কাজের লোকেরা…।’

একেবারে মূলগতভাবে শিক্ষা ব্যাপারটা মানুষে মানুষের কারবার; মানুষে মানুষে সংযোগ ও আদানপ্রদানের কাজ চলে। শিক্ষক-মানুষ শিক্ষার্থী-মানুষকে শুধু তথ্য ও জ্ঞান প্রদান করবেন আর শিক্ষার্থী শুধু তা গ্রহণ করে মগজটাকে ভর্তি করবে—এই ধারণা আধুনিক শিক্ষা বিজ্ঞান বর্জন করেছে ঠিকই, কিন্তু শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক থেকে শিক্ষককে বর্জন করেনি। এখন শিক্ষা বিজ্ঞান উভয়ের ভূমিকা পালটে দিয়ে বলছে—শিক্ষার্থীকে ‘শেখানো’ শিক্ষকের কাজ নয়; শিক্ষার্থী স্বয়ং শিখবে; সে ‘টট’ হবে না ‘লার্ন’ করবে। শিক্ষক শিক্ষার্থীর ‘শেখার’ প্রয়াস বা কাজকে সহজতর করবেন। সঠিক পথ বলে দেবেন। তিনি হবেন ‘ফেসিলিটেটর অ্যান্ড গাইড’। তো, এই কাজ, দুটি মানুষের দুটি ভূমিকা—মানুষের মধ্যে ভাব ও চিন্তার লেনদেন (ইন্টার-অ্যাকশান) ছাড়া, প্রাণে প্রাণে সংযোগ ছাড়া সম্ভব? এই দুই মানুষের সংযোগ তৈরি হবে প্রাণহীন প্রযুক্তির খবরদারিতে!

প্রকৃতি ও পরিবেশ ধ্বংসের কাজে প্রযুক্তিকে এত ব্যাপকভাবে যেখানে কাজে লাগানো হয়েছে ও হচ্ছে, যে, ত্রাহি ত্রাহি রব উঠেছে! পৃথিবী গ্রহটাকেই হয়তো ধ্বংস করে দেবে অচিরে প্রযুক্তির অতি-প্রয়োগ—নির্বিচার প্রয়োগ। সেই অবস্থায় আমরা কি আশা করতে পারি যে, শিক্ষাকে বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে আত্মীয়তার পথে ‘শিক্ষার প্রযুক্তি’ চালনা করতে পারে?


৫.

শিক্ষার যে গভীরতর ও বিশালতর তাৎপর্য রয়েছে, সেই সামাজিক সাংস্কৃতিক-মানবিক মর্মকেন্দ্রে পৌঁছানোর সাধ্য প্রযুক্তির নেই। এখানেই প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন শতবর্ষীয় পাউলো ফ্রেইরি। বিশ্বের শিক্ষাতাত্ত্বিকদের মধ্যে প্রভাবের ব্যাপকতায় ও প্রেরণার গভীরতায় সম্ভবত সর্বাগ্রগণ্য পাউলো ফ্রেইরি। পাউলো ফ্রেইরির শিক্ষাতত্ত্ব অন্য অনেক বিদ্যাবিষয়কেও প্রভাবিত করেছে, করে চলেছে। শিক্ষা বিষয়ক তাত্ত্বিকতার ক্ষেত্রে তাঁর মতো বিপ্লববাদী রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি আর বিশেষ কারোর মধ্যেই দেখা যায় না এবং এই ক্ষেত্রেও তাঁর অনুগামীর সংখ্যা সারা বিশ্বে বড় কম নয়। ব্রাজিলীয় এই শিক্ষাবিদের দর্শন চিন্তা শিক্ষার সর্বদিকেই আলোকদায়ী এবং সর্বকালেই প্রাসঙ্গিক। লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার দেশে দেশে ফ্রেইরির প্রভাব বিপুল, তথাকথিত উন্নত দেশগুলি, যেমন, আমেরিকা-ইওরোপের প্রগতিশীল অংশের মধ্যেও খুব কম নয়।

সরকারি শিক্ষা-ব্যবস্থার মধ্যে কাজ শুরু করেও বয়স্ক সাক্ষরতার এমন এক কর্মসূচি বা পদ্ধতি তিনি তৈরি করলেন যার লক্ষ্য হলো জনগণের দরিদ্রতম অংশকে তাঁদের নিজেদের আটপৌরে ভাষার মর্যাদা বজায় রেখে পড়তে লিখতে শেখানো। ফ্রেইরি সব সময় জোর দিয়ে বলেছেন যে, শিক্ষার কাজ হলো শিক্ষার্থীর ভাষা, অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার ওপর তার বনেদ গড়ে তোলা, শিক্ষাদাতার সংস্কৃতিকে তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া নয়। তিনি শিক্ষার কার্যক্রম ও মুক্তি সম্পর্কিত নানা চিন্তার সূত্রকে গ্রহণ ও একত্রে গ্রথিত করে প্রগতিশীল শিক্ষাধারার ওপর অনপনেয় ছাপ রেখেছেন। তিনি এমন অনেক তত্ত্বের উদ্ভাবক যা সাধারণভাবে শিক্ষাপদ্ধতির ওপর ও বিশেষভাবে প্রথাবহির্ভূত ও গণশিক্ষার অগ্রগতির ওপর অসীম প্রভাব ফেলেছে।

ফ্রেইরির শিক্ষা দর্শনের প্রথম কথাই হলো দরিদ্র ও নিপীড়িত মানুষের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও নম্রতা, সেইসব মানুষ তাঁদের জগতকে যে দৃষ্টিতে দেখে, তার প্রতি শ্রদ্ধা এবং তাঁদের সেই কাণ্ডজ্ঞানের প্রতি শ্রদ্ধা, যা কোনো অংশেই পেশাদার/আধিপত্যকারী গোষ্ঠী/নিপীড়কদের তথাকথিত বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এই ধরনের দার্শনিক প্রত্যয়ের মধ্য দিয়েই পাউলো ফ্রেইরি হয়ে ওঠেন বিচারমূলক শিক্ষা বিজ্ঞানের একজন প্রধান প্রবক্তা এবং তারই ভিত্তিস্বরূপ তিনি রচনা করেন তাঁর বিশ্বখ্যাত গ্রন্থ—‘নিপীড়িতের শিক্ষা বিজ্ঞান’ (পেডাগগি অব‌্ দ্যা অপ্রেস‌্ড)।

দারিদ্র্য ও ক্ষুধা তাঁর শেখার ক্ষমতাকেই দারুণভাবে ব্যাহত করেছিল। তাঁর দারিদ্র্যলাঞ্ছিত শৈশব প্রসঙ্গে তিনি পরে লিখেছিলেন:

I didn’t understand anything because of my hunger. I wasn’t dumb. It was not lack of interest. My social condition didn’t allow me to have an education. Experience showed me once again the relationship between social class and knowledge.

ফ্রেইরি আইন বিষয়ের ছাত্র হিসেবে ভর্তি হয়েছিলেন, সেই সঙ্গে তিনি দর্শন ও ভাষা-মনোবিজ্ঞানের পাঠও নিয়েছিলেন। রেসিফ বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন নিয়ে পড়লেও তিনি কখনও আইনের পেশায় যোগ দেননি। তিনি বরং একটা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পর্তুগিজ ভাষা শিক্ষার চাকরি নিলেন এবং পরে ১৯৪৬ সালে তিনি ব্রাজিলের পার্নামবুকো রাজ্যের শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিভাগের ডিরেক্টর নিযুক্ত হলেন। এখানে প্রধানত তাঁকে দরিদ্র নিরক্ষর মানুষদের নিয়েই কাজ করতে হয়েছে এবং সম্পূর্ণ গোঁড়ামি থেকে মুক্ত হয়ে তিনি তাঁদের জন্যে মুক্তির ধর্মতত্ত্বকে কাজে লাগালেন। এঁদের দ্রুত সাক্ষর করে তোলায় তিনি বিশেষভাবে সচেষ্ট হলেন এই কারণে যে, তখন ব্রাজিলে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট দিতে হলে সাক্ষর হওয়া আবশ্যিক ছিল।

১৯৬১ সালে ফ্রেইরি রেসিফ বিশ্ববিদ্যালয়ে কালচারাল এক্সটেনশন বিভাগের ডিরেক্টর নিযুক্ত হলেন, আর পরের বছরই তাঁর শিক্ষাতত্ত্বকে বাস্তবে প্রয়োগ করার এক সুবর্ণ সুযোগ পেলেন। শব্দ, শব্দ সম্পর্কিত ধারণা ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীর পারস্পরিক আদানপ্রদান বা সংলাপকে অগ্রাধিকার দিয়ে তিনি তিনশো নিরক্ষর আখ চাষিকে মাত্র পঁয়তাল্লিশ দিনের মধ্যে লিখতে ও পড়তে সক্ষম করে তুললেন। তাঁর এই সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ ব্রাজিল সরকার তাঁর শিক্ষাপদ্ধতি ও কর্মসূচির চাহিদা অনুসারে সারা দেশে হাজার হাজার সাংস্কৃতিকচক্র গড়ে তোলার অনুমতি দিল। কিন্তু ১৯৬৪ সালে বিরাট বিপর্যয় নেমে এল এক সামরিক অভ্যুত্থানের ফলে এবং ফ্রেইরিকে দেশদ্রোহিতার দায়ে সত্তর দিন কারাবন্দি থাকতে হলো।

কিছুদিন বলিভিয়ায় নির্বাসিত থেকে তিনি চিলিতে চলে গেলেন। সেখানে তিনি পাঁচ বছর কাটালেন, একদিকে ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটিক দলের কৃষিসংস্কার আন্দোলনে অংশ নিয়ে, অন্যদিকে রাষ্ট্রপুঞ্জের খাদ্য ও কৃষি সংগঠনে (এফএও) কাজ করে। এই সময়ে তাঁর শিক্ষা বিষয়ক ভাবনার প্রথম বই (‘এডুকেশন অ্যাজ দ্যা প্র্যাকটিস অব‌্ ফ্রিডম’) প্রকাশিত হয়, ১৯৬৭ সালে। এবং ১৯৬৮ সালে (অবশ্যই ব্রাজিলের বাইরে) প্রকাশিত হয় তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত ও ধ্রুপদী গ্রন্থ ‘পেডাগগি অব‌্ দ্যা অপ্রেস‌্ড’। এই বইটি প্রকাশের পর পৃথিবী জুড়ে এতটাই সমাদৃত হলো যে তারই জেরে আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে অতিথি অধ্যাপকরূপে আমন্ত্রণ জানায় ১৯৬৯ সালে। কিন্তু তাঁর নিজের দেশে বইটি ১৯৭৪-এর আগে প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি—ক্রিশ্চিয়ান সোশ্যালিস্ট পাউলো ফ্রেইরির সঙ্গে তৎকালীন ব্রাজিলের সামরিক একনায়কতন্ত্রের রাজনৈতিক বৈরিতার ফলে।

বছর খানেক আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেট‌্সে কাটিয়ে ফ্রেইরি ওয়ার্ল্ড কাউন্সিল অব‌্ চার্জেসের বিশেষ শিক্ষা উপদেষ্টারূপে জেনিভাতে কর্মরত হলেন। এই সময়ে তিনি আফ্রিকার ভূতপূর্ব উপনিবেশগুলিতে, বিশেষ করে গিনিবাসাউ ও মোজাম্বিকে শিক্ষা সংস্কারের উপদেষ্টারূপেও কাজ করেছেন। ১৯৭৯ সালে ফ্রেইরি ব্রাজিলে ফিরে আসতে পারলেন এবং সেখানকার ওয়ার্কার্স পার্টিতে যোগ দিলেন। সাও পাউলো নগরী তাঁর বাকি জীবনের নিবাস হলো। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৬ পর্যন্ত বয়স্ক সাক্ষরতা প্রকল্পের সুপারভাইজার পদে কাজ করলেন এখানে তিনি এবং ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে ওয়ার্কার্স পার্টি জয়ী হয়ে মিউনিসিপ্যালিটির ক্ষমতা দখল করলে, তাঁকে সাও পাউলোর শিক্ষা সচিবের পদে নিযুক্ত করা হয়। এই সময় থেকে জীবনান্ত পর্যন্ত পাউলো ফ্রেইরি তাঁর শিক্ষাদর্শ ও পদ্ধতি প্রয়োগের বিস্তার ঘটিয়েছেন।

আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাঁর শিক্ষাতত্ত্ব নানাভাবে স্বীকৃতি ও সম্মান পেয়েছে, অনেক শিক্ষাবিদ তাঁর শিক্ষাতত্ত্ব আলোচনা ও প্রচার করেছেন। উত্তর-আমেরিকায় হেনরি গিরো, পিটার ম্যাকলারেন, কার্লোস আলবার্তো তোরেস, ইলা শোর, শার্লি স্টেইনবার্গ প্রমুখের মতো শিক্ষাচিন্তকরা তাঁর শিক্ষাদর্শনের প্রবক্তারূপে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। ম্যাকলারেন সম্পাদিত ‘পাউলো ফ্রেইরি: ও ক্রিটিকাল এনকাউন্টার’ গ্রন্থে ক্রিটিকাল এডুকেশন তত্ত্বের বিরাট প্রভাব ও অবদান বিস্তৃতভাবে আলোচিত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘ব়্যাডিকাল ম্যাথ’ আন্দোলন ও অঙ্ক-পাঠক্রম নির্মাণকেও প্রভাবিত করেছে ফ্রেইরির কাজ ও তত্ত্ব।

১৯৯১ সালে সাও পাউলোতে প্রতিষ্ঠিত হয়—পাউলো ফ্রেইরি ইনস্টিটিউট—যার প্রধান লক্ষ্য শিক্ষা সম্পর্কে ফ্রেইরির তত্ত্বকে আরও অগ্রসর ও সম্প্রসারিত করা। এই প্রতিষ্ঠান পাউলো ফ্রেইরি সংগ্রহশালাও গড়ে তুলেছে। ফ্রেইরির ‘পেডাগগি অব‌্ দ্যা অপ্রেস‌্ড’ আমেরিকার শিক্ষক-শিক্ষণ কর্মসূচিতে প্রায় বিগ্রহ-স্বরূপ বিবেচিত হয়। ১৯৯৭ সালের ২ মে, ফ্রেইরির জীবনাবসানের পর থেকে এইসময় পর্যন্ত বিশ্বের নানা দেশে, বিশেষত উন্নয়নশীল দেশগুলির শিক্ষা-পরিকল্পনায় তাঁর শিক্ষাদর্শ কীভাবে অনুসৃত হয়ে এসেছে—তা পৃথক আলোচনার বিষয়।


৬.

পাউলো ফ্রেইরির অতীব গুরুত্বপূর্ণ দুটি বক্তব্যের উল্লেখ করা উচিত—যা যে-কোনো শিক্ষাব্রতীর একটি পরিচিত ও ভাবার বিষয় এবং অনেক শিক্ষাবিদেরই সেকালে ও সাম্প্রতিককালেও মূল ভাবনার বিষয়। প্রথম বিষয়টি ফ্রেইরির পূর্বসূরী অনেক শিক্ষা তাত্ত্বিকের আলোচনাতেই উঠে এসেছে। এবং ফ্রেইরির বিশ্বখ্যাতির অন্যতম কারণও সেই ‘ব্যাংকিং মডেল অ‌ব‌্ এডুকেশন’ তত্ত্ব।

এই মডেলে শিক্ষার্থীকে মনে করা হয় একটি শূন্য ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মতো, যা তথ্য জমা দিয়ে পূরণ করে শিক্ষক। পাউলো ফ্রেইরি তীব্র আক্রমণ করেছেন এই মডেলকে। তিনি বলেছেন, “এতে শিক্ষার্থীকে নিছক গ্রাহক বস্তুতে পরিণত করা হয়। এই মডেলে তার চিন্তা ও কর্মকে নিয়ন্ত্রিত করার ব্যবস্থা করা হয়, সকলকেই তার দুনিয়ার পরিস্থিতির সঙ্গে সমঝোতা করতে শেখানো হয়, তাদের সৃজন শক্তিকে সংকুচিত করা হয়।”

এই ধারণাটা অবশ্যই একেবারে নতুন নয়। লকের ‘ট্যাবুলা রজা’র ধারণাই মূলত ব্যাংকিং মডেলের পূর্বসূরী এবং সে তত্ত্ব আগেই অনেকখানি বর্জিত হয়ে গেছে রুশোর শিক্ষাতত্ত্বে শিশুর চরিত্র-চিত্ৰণ দ্বারা। তাছাড়া জন ডিউই-এর মতো শিক্ষাচিন্তকরাও শিক্ষার লক্ষ্য নিছক শিক্ষার্থীর মগজে তথ্য চালান দেওয়া—এই ধারণার তীব্র সমালোচনা করেছেন। ডিউই প্রায়শ শিক্ষাকে সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়াররূপে বর্ণনা করেছেন। পাউলো ফ্রেইরি তাঁর শিক্ষাদর্শনে আগের এইসব ধারণাগুলিকে পরিমার্জনের দ্বারা আধুনিক বা সময়োচিত করেছেন এবং সম-সময়ের শিক্ষাতত্ত্ব ও কর্মধারার পরিপ্রেক্ষিতে গ্রহণ করে তাঁর শিক্ষা তত্ত্বের সবচেয়ে বড় অবদান যেখানে, সেই ‘ক্রিটিকাল পেডাগগি’-র ভিত শক্ত করেছেন।

ফ্রেইরির দ্বিতীয় বক্তব্যটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, প্রায় বৈপ্লবিক এবং চমকপ্রদ। যার অর্থ বাংলা তরজমায়—নীরবতার সংস্কৃতি। ফ্রেইরির মতে, যে সামাজিক সম্পর্কের মধ্যে আধিপত্যবাদ বর্তমান, সেখানেই গড়ে ওঠে নীরবতার সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতি নিপীড়িত মানুষের মধ্যে একটা নেতিবাচক, নীরব-থাকার ও আত্মসত্তাকে দমিত রাখার মানসিকতা চারিয়ে দেয়। শিক্ষার্থীর মনে এমন বিচারক্ষম সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে যার দ্বারা সে বুঝে নিতে পারবে যে, নিপীড়নের জন্যেই তৈরি এই—’নীরবতার সংস্কৃতি’। এই ‘নীরবতার সংস্কৃতি’ যে আধিপত্যকারী শ্রেণির সংস্কৃতিই তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়। এই সংস্কৃতির চাপে এ সত্য বোঝার ও তার বিরুদ্ধতা করার উপায়টুকুও হারিয়ে ফেলে নিপীড়িত শ্রেণি। সমাজে বিশেষ জাতি ও শ্রেণির আধিপত্যবাদ প্রচলিত শিক্ষার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে এবং তার ফলে ‘নীরবতার সংস্কৃতি’ সেই চিন্তার পথই রুদ্ধ করে দেয়—যা বিচার-বিতর্কের ভাষার জন্ম দেয়। ফ্রেইরি লিখছেন:

No pedagogy which is truly liberating can remain distant from the oppressed by treating them as unfortunates and by presenting for their emulation models from among the oppressors. The oppressed must be their own example in the struggle for their redemption.

এই গ্রন্থেই ফ্রেইরি নিপীড়ক ও নিপীড়িতের পার্থক্য সুস্পষ্ট করলেন; বললেন, একটা ন্যায়নীতিহীন সমাজ ব্যবস্থায় এই দুই অংশের অবস্থানে রয়েছে পার্থক্য, এবং নিপীড়কেরই প্রাধান্যের অবস্থান। দুইয়ের মধ্যে এই পার্থক্য নির্দেশের মতবাদের উৎস সম্পর্কে ফ্রেইরি সরাসরি কিছু না জানালেও, হেগেল-এর দর্শন যে তাঁকে গভীরভাবে প্রণোদিত করেছিল—এ কথা বলা বাহুল্য। পাউলো ফ্রেইরি এই মতাদর্শই ঊর্ধ্বে তুলে ধরলেন যে, শিক্ষাকে নিপীড়িতের মধ্যে এই আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তুলতে হবে যে, সে মানুষ এবং এই আস্থার মধ্যে থাকবে তাদের দুরবস্থাকে অতিক্রম করে যাওয়ার প্রেরণা। তবে শুধু শিক্ষা নয়, যদি এমনটা ঘটাতে হয় তাহলে প্রত্যেক নিপীড়িতকে ব্যক্তিগত স্তরেও তাঁর মুক্তির সংগ্রামে যথাযোগ্য ভূমিকা পালন করতে হবে।

প্রকৃত মুক্তি যদি ঘটাতেই হয় তাহলে নিপীড়ককেও তাঁর জীবনধারা সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে হবে ও নিপীড়নের ক্ষেত্রে তাঁর নিজের ভূমিকা যাচাই করে দেখতে হবে। জনকল্যাণে যাঁরা সত্যি সত্যি আত্মনিয়োগ করেছেন বা করবেন তাঁদের নিজেদেরকেও প্রতিনিয়ত আত্মসমীক্ষার ভেতর দিয়ে যেতে হবে।

ফ্রেইরির শিক্ষাদর্শনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ ‘জ্ঞান’ সম্পর্কে তাঁর গভীর ভাবনা। যার বিশদ আলোচনার অবসর এখানে পাওয়া সম্ভব নয়। তবে জানার সক্ষমতা এবং শিখনের মাধ্যমে নিজেকে ভাঙাগড়ার সুযোগ যে শিক্ষাকে অর্থবহ করে তোলে সে সম্পর্কে ফ্রেইরির বক্তব্যটি উদ্ধৃত করা প্রয়োজন। ফ্রেইরি বলছেন:

…education makes sense because women and men learn that through learning they can make and re-make themselves, because women and men are able to take responsibility for themselves as being capable of knowing-of knowing that they know and knowing that they don’t.

পাউলো ফ্রেইরি তাঁর শিক্ষা দর্শন নির্মাণ করেছেন—তাঁর সংজ্ঞায়িত শিক্ষা সম্পৃক্ত বহুবিধ তত্ত্বের সমাহারে এবং অজস্র প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে। পাউলো ফ্রেইরির শিক্ষার্শনে নিশ্চিতভাবে বৈপ্লবিকতা ও অভিনবত্ব আছে, কিন্তু কোনো গোঁড়ামি নেই। তিনি মুক্ত মনে প্রাচীন ও আধুনিক দার্শনিকদের তত্ত্ব থেকে প্রয়োজন বুঝে তাঁদের সিদ্ধান্ত বা ধারণাগুলি গ্রহণ করেছেন। প্লাতো প্রমুখের মতবাদ থেকে যেমন ধারণা গ্রহণ করেছেন তেমনি আধুনিক কালের মার্কস বা কোনো কোনো ঔপনিবেশিকতা-বিরোধী চিন্তকদের তত্ত্বেরও মূল্য দিয়েছেন এবং তাঁর সমসাময়িক মনোবিজ্ঞানী ফ্রঁৎস ফানঁ লিখিত ‘দ্যা রেচেড অব‌্ দ্যা আর্থ’ গ্রন্থের বক্তব্যকেও বিবেচনায় এনেছেন। ফানঁ ঘোষণা করেছিলেন, যে-কোনো দেশের জনগণকে সেই শিক্ষা দিতে হবে যা একাধারে অভিনব ও আধুনিক (ঐতিহ্যবাদী নয়) এবং যা উপনিবেশ-বিরোধী (ঔপনিবেশিকদের সংস্কৃতির ধারাকে অনুসরণ নয়) এই মতের সম্প্রসারণ আমরা দেখি ফ্রেইরির ‘পেডাগগি অব‌্ দ্যা অপ্রেস‌্ড’ গ্রন্থে।

এইসব তত্ত্বের এত গভীর, বিস্তৃত ও প্রায়শই অগতানুগতিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন শিক্ষাবিদ পাউলো ফ্রেইরি যে তা দু-চার কথায় ব্যাখ্যা অসম্ভব বরং তাঁর তত্ত্বের কয়েকটি দিক উদাহরণ স্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে: শিক্ষার লক্ষ্যসমূহের পরিপ্রেক্ষিতে জ্ঞান ও দক্ষতার মূল্যের তত্ত্ব; জ্ঞান কাকে বলে আর বিশ্বাসের সঙ্গে তার পার্থক্যই বা কী, ভুল ও মিথ্যা কী—এইসব প্রশ্নের উত্তরের ভিত্তিতে গঠিত জ্ঞানতত্ত্ব; মানুষ নামক প্রাণীটি কী, অন্যান্য প্রাণীর সঙ্গে তার পার্থক্যই বা কী এবং মানুষের শক্তি-সম্ভাবনা কতটা—এইসব বিশ্লেষণ করে গঠিত মনুষ্য স্বভাবের তত্ত্ব; শিখন বা লার্নিং কী এবং দক্ষতা ও জ্ঞান কীভাবে অর্জিত হয় তার ব্যাখ্যা করে উদ্ভাবিত শিখনের তত্ত্ব; সমাজ কী ও তার কোন কোন প্রতিষ্ঠান শিক্ষা কর্মধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত, তার বিশ্লেষণে রচিত সমাজ বিষয়ক তত্ত্ব—এমনই আরে বহু বিষয়ক তত্ত্বের মিলিত ফল—পাউলো ফ্রেইরির শিক্ষাদর্শ।

পাউলো ফ্রেইরির একজন অনুগামী শিক্ষাবিদ রিচার্ড শল-এর ক’টি কথা উদ্ধৃত করা যেতে পারে, যা থেকে পাউলো ফ্রেইরির শিক্ষাদর্শনের মর্মকথা আমাদের হৃদয়ঙ্গম হবে—

There is no such thing as a neutral education process. Education either functions as an instrument which is used to facilitate the integration of generations into the logic of the present system and bring about conformity to it, or it becomes the ‘practice of freedom’, the means by which men and women deal critically with reality and discover how to participate in the transformation of their world.

শিক্ষার কার্যক্রম একটি রাজনৈতিক কর্ম এবং তাকে শিক্ষা বিজ্ঞান থেকে কোনোভাবেই বিচ্ছিন্ন করা যায় না। ফ্রেইরি একে বিচারমূলক শিক্ষা বিজ্ঞানের (ক্রিটিকাল পেডাগগি) একটি প্রধান চরিত্রলক্ষণ বলে মনে করেছেন। শিক্ষাকে যে রাজনীতি চারপাশে ঘিরে রাখে তার সম্পর্কে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়কেই সচেতন হতে হবে। শিক্ষার্থীকে যা ও যেভাবে শেখানো হয় তা রাজনৈতিক কোনো কর্মসূচিরই উদ্দেশ্য পূরণ করে। শিক্ষকদেরও নিজস্ব রাজনৈতিক ধ্যানধারণা বা বিশ্বাস থাকে, তা সঙ্গে নিয়েই তো তাঁরা ক্লাসঘরে ঢোকেন।




প্রচ্ছদচিত্র ও অন্য ছবি সৌজন্য:
www.needpix.com, www.blacklamprg.medium.com, www.independent.co.uk