আমাকে কে চেনে? কে কে চেনে? এই শাদা দেয়াল, তুমি আমাকে চেনো? তুমি দেয়াল তো? নাকি চৈত্রের রোদ?

এখন পড়ন্ত বিকেল। আমি ঠিক ধরতে পারি। চোখ বন্ধ করারও দরকার হয় না, বলে দিতে পারি, আর কিছু বাদেই কটু, নোনতা ধারালো ঘাম আর ঘামের গন্ধের ভেতর দিয়ে সঙ্গম-না-শেখা আকাট অ্যালসেশিয়ানের দল ফিরবে। মাঠ, প্রতিটি মাঠ থেকে তারা ছড়িয়ে পড়বে রাস্তায় রাস্তায়। তাদের প্রতিটি বাক্যের ভেতরে ‘ফুটবল’ নামে এক ক্রীড়ার অনুষঙ্গ, তরল রক্তের মতো লাল রিবন। ঝকঝকে অন্ধত্ব। তাদের ভয়, লোভ, ক্লান্তিকে চিনতে পারবে না ভীতু, লোভী, ক্লান্ত কিছু লোক। আহারে, কৈশোর কৈশোর করে থুতু ছিটোবে পরস্পরের মুখে।

এই অ্যালসেশিয়ানের দল অ্যালসেস নামে কোনো জায়গার কথা জানে না কিন্ত ওরা মানতেই চাইবে না এই যে চৈত্রের রোদ তার পলেস্তারা খসে পড়ছে। বহু, বহুকাল…আমার জন্মের ঢের আগে থেকে এরকম একটা করে হাঁ-করা দেয়াল উঠে যাচ্ছে প্রতিজনের চোখের সামনে। উঁচুতে নীচুতে কেটে জানলা করার অভ্যেসে দূরের বাড়িগুলো জঙ্গল আকাশ সব মিলিয়ে বাইরেটাও যে কতটা ভারী কতটা নিরেট চৌকোণা এক লহমায় পরিষ্কার হয়ে যায়।

আমি এই বর্গক্ষেত্রাধীন ব্যাপারটাকেই ঘেন্না করি। নিরেট। হাস্যকর। যেন মাপের মাপ দুটো পক্ষই আছে সবসময়ে ধরে নেয়া। আমি ক্রশ, রুবিক কিউব ও হিটলারকে ঘেন্না করি। আমার কেমন যেন মনে হয় হিটলার লোকটি চতুর্ভুজের পুজুরি ছিল।

বনবাদাড়জলাচড়াইউতরাই চার পায়ে নেভাতে নেভাতে এক দঙ্গল অ্যালসেশিয়ান ছুটে যায়। কিন্তু, তারা কোথাওই যায় না আসলে। কোথাওই পৌঁছয় না। তারা তো জানে না, তারা অনেকগুলো ‘এক’ ছাড়া আর কিছুই নয়। বা দেয়ালের কাহিনি।

আচ্ছা অ্যালসেশিয়ানেরা কি তারা খসে পড়া দেখে চলকায় ঝলকায়? বিস্ময় নিয়ে ক্যাঁচকোঁচ করে কথা বলে? আমি ভুলে গেছি, ঠিক কোন জিনিসটাকে আমি একসময়ে বিস্ময় বলতাম। তারা কি পরস্পরের গালে ন্যালনেলে স্তুতি মাখিয়ে দেয়? দেয় বোধহয়, চাটতো খুব। বীরু, পুষ্কর, বাপ্পা, অনন্ত। আরও কয়েকটা একরকমের মুখ। সব কবি এরা। বীরুর বিয়ে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ওরা সেদিন গল্প করছিল। বেশ ক’বছর হয়ে গেছে বোধায়। পুষ্কর বলছিল, বাড়ি ফিরছিলাম, মাঝরাত, পেটে কিছু ছিল না, তেলতেলে শাদা দোতলা বাগানঅলা সাহেব কোয়ার্টার বাঁয়ে, ডাইনে সামনে গঙ্গার ওপর কাগজকলের জেটি, পায়ের নীচে কালো ফিতে। জ্যোৎস্নাতাড়িত হয়ে ফিরছিলাম বুঝলি। হঠাৎ দেখি, রাস্তা ফুঁড়ে চোখের সামনে মাখমের মতো খোলা বুকে এক মাড়োয়ারি মেয়েছেলে, ওর পায়ের কাছটা একটা শাদা বেড়ালে চাটছে। আমি সন্ত্রাসবশত আকাশে তাকিয়ে দেখি, নক্ষত্রের সভা। এবং কী আশ্চর্য তক্ষুনি দক্ষিণে একটা তারা খসে পড়ল! আমার খুব মনে হলো, আমার খুব চেনা একটা বাগানে এক টুকরো পড়ে থাকবে মৃত মাছের মতন। আমার মনে হলো খসে পড়া নক্ষত্র-কুচি থেকে আমি যেদিকে মনোযোগ দিইনি, ওই সামনের দৃশ্যটির, ওই শাদা বেড়াল ও স্তন সমেত মাড়োয়ারি মেয়েছেলেটির জন্ম। আমি ওর স্তন ছুঁয়ে, আমাকেও তোমার অংশীদার করো বলতে চেয়ে এগিয়ে দেখি, সব সুনসান। কেউ নেই। আমার ঘিয়ে-রঙা দরজা, নীল জানলা সেদিন শিশিরে ভেজানো পাউরুটির মতো হয়ে গেছিল, আমি জানি না কীভাবে আমি সেদিন ওখানে পৌঁছেছিলাম। শুনে বাপ্পা বলল, হ্যাঁ এরকমই হয়। এরকম একটা জায়গা থেকেই রক্তমাংসের কবিতা উঠে আসে। একরকমের দেখতেগুলো বলল, বাংলা কবিতা যখন বাঁক নেবে তোমাদের হাতে তখনই তোমরা সরে এলে, তোমার এই ইলিউশানটা নিয়ে নিশ্চয়ই একটা গুচ্ছ আছে, ওটা আমি ছাপব। এইভাবে যখন তুমি কথা বলো, তখন তোমার গালের হনুটা কপালের দাগটাও একটা মানে পেয়ে যায়! অনন্ত অন্য ক্যাম্পের কিছু আশ্চর্য হবার ইতিহাস শোনানোর তালে ছিল। পুষ্কর বাপ্পারা ওকে এগোতে দেয়নি, কয়েকটি নীরব শ্রোতা ছিল। চান্স পেয়ে টুক করে অনন্ত জিগগ্গেস করল, আচ্ছা পুষ্কর, মেয়েছেলেটি মাড়োয়ারি ছিল তুমি কী করে বুঝলে? পুষ্কর বলল, দ্যাট‌্স অ্যানাদার টেল! বলে হাহা করে খুব হাসল, এই হাসিতে সে আরেকটা ঘটনা মনে পড়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছিল। অবিশ্বাসে চোখ সরু করে টেকো অনন্ত বলেছিল, চলো গাঁজা খাবে!

অনেক রাতে বাড়ি ফেরার সময় আমি জিগগ্গেস করলাম, পুষ্কর, তুই মিথ্যে কথা বলছিলি? ও বলল, ওরকম দিতে হয়রে মাঝে মাঝে, নইলে এ শালারা মানে না। আমি বললাম, ও। একটু পরে, ও ছোটখাটো চেহারারই, ও চাঁদের কাছে বামনেরা যেভাবে প্রার্থনা জানাতো সেভাবেই বলল, আসলে আমি মরে গেছি বুঝলি। তুই আমাকে ক্ষমা কর। এইভাবে কথা বলার সময়েই আমি বেঁচে উঠি।

পুষ্কর আর তার বন্ধুদের মুখরেখাগুলো কিছুই আর মনে আসছে না, কতগুলো দেশলাই বাক্সের মতো মুখঅলা জীব, একদলা কুয়াশার মধ্যে ভুরু, নাক চোখ ঠোঁট।

সুন্দর। আশ্চর্য। বিস্ময়। কবিতা। এই শব্দগুলোকে বোঝাতে যারা তবে হরেক আকারের আওয়াজে চারদিক বুমবুম করে তোলে তারা তবে মরে হেজে গেছে। বহুকাল আগে! এই কথাটাই, কথা। পাথরের মতো বেঁচে থাকা। উৎক্ষিপ্ত হলে, গড়িয়ে গেলে, ভাঙলে চুরলে। কিছুই হলো না কিছুতে। সবকিছু, একভাবে রয়ে যায়। আমি অন্ধের মতো ফুটবল খেলে গেছি আঠাশ বছর তক। সঙ্গীরা সব অন্য অন্য অন্ধতায় মাততে চলে গেছে, আমি যাইনি; কিশোর আকাট অ্যালসেশিয়ানদের দলে রয়ে গেছি। তারপর একদিন শুয়ে পড়লাম ঘরে এসে। দুই, তিন, চার বছর মায় কয়েক শতাব্দী হতে পারে; আমি এপাশ ওপাশ করে শুয়ে থাকি। চড়ুই, টিকটিকি আর গরাদের সঙ্গে ভাব জমানো আমার এখন ম্যাটমেটে লাগে। কিছুই হয় না ওতে। আমি পরিষ্কার দেখতে পাই আমাকে—দেশলাই আর কুয়াশার মুখ—অশোকের সময়ে, কাশ্মীরে, ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে আঠাশ বছরে, এইভাবে শুয়ে আছি। কাশ্মীর ইজ দ্যা অ্যাপ‌্ল অফ ডিসকর্ড। আহ্! শীট! দ্যা পোয়েট‌্স অ্যান্ড পলিটিশিয়ান‌্স শুড বি হ্যাংড! ওরা আমাদের স্বজ্ঞা পেতে দেয় না। প্রতিজনেই যদি সাধারণ যন্ত্রণাখানা জেনে পাথরের মতো হয়ে যেত। পৃথিবীর সার্বিক সমাপ্তি তাল-লয়-সমৃদ্ধ নিশ্চিত হত কত?

পরীক্ষামূলক ভাবে সারা গায়ে মল মেখে আমি দেখেছি। কিছুই হয় না। একটা সময়ের পর নাক হয়ে যায় আমাদের ছোটবেলার সহনশীলতার প্রতিমূর্তি মাস্টারমশাই নাকুবাবু। লাল বীজগুড়ি বীজগুড়ি বেরিয়ে ছিল ক’জায়গায়, ক’দিন বাদে মিলিয়ে গেল। আর ওই যো হাঁ-করা শাদা দেয়াল, তুমি বেশ আছ; আমার মলে-মলে অস্তিত্ব সেদিন কাউকে উত্যক্ত করতে পারেনি।


এই ছেলেটা মারা যাবে। আত্মহত্যা করবে। কিছু সময় বাদে। কাল সকালে ঘর ঝাঁট দিতে কাজের লোক শৈল ভেজানো দরজা ঠেলে ঢুকেই দেখবে, দরজার পর্দা পাকিয়ে সিলিং ফ্যানে বেঁধে সে ঝুলে আছে। শৈল ‘ম্ মা গো’ অস্ফুট চিৎকার করে ছুটে বার-বারান্দায় গিয়ে চিলচিৎকার জুড়ে দেবে। কিছুক্ষণের মধ্যে আত্মহত্যকারী পবিত্রর ঠান্ডা শাদাটে ঘর থিকথিকে হয়ে উঠবে ভীড়ে। পাড়ার মার্কসবাদী পার্টি করা ছেলেরা সে-ই ভীড়ের, সে-ই গুঞ্জনাক্রান্ত চাপা অবস্থার দখল নিয়ে নেবে। তারা তিন দলে ভাগ হয়ে যাবে। একদল যাবে থানা ও ডাক্তার ম্যানেজ করতে—যাতে সিধে নিয়ে গিয়ে মড়া পুড়িয়ে দেওয়া যায়, কোনো ঝামেলায় না পড়তে হয় মৃত পবিত্রর মা বিভাবতী দেবীকে। একদল যাবে শ্মশানবাবুকে ম্যানেজ ও পোড়ানোর বন্দোবস্তে। আর একদল যাবে, পবিত্রর নাক মুখ দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে, চেঁচাচ্ছে খুব মাঝে মাঝে—মিথ্যে কথা বলে, তার মা’কে টেলিফোন ভবনের পাশের একটা বড় অফিসবাড়ি থেকে নিয়ে আসতে। বিভাদির বাড়ি চিরকাল মার্কসবাদী পার্টিকে ভোট দেয়। মৃত পবিত্রও দিত, গত দু-বছরে তাকে কেউ বুথে দেখেনি। বিভাদি নিজের ভোটটা দিয়ে যাবার সময় ছেলেদের বলে গেছেন, পারলে ওরটা ফেলিয়ে দিস, নষ্ট করিস না।

সারারাত ডিউটি করার পরও নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে যেতে পারেননি বিভাবতী, রিলিভার অনেক পরে এল। ক্যান্টিনে বসে চা খাচ্ছিলেন, একটু আড্ডাও হচ্ছিল। আজকাল একটু দুর্বলতা লাগে রাত-ডিউটির পর। পুরোনো টেবিলের ওপর তেরছা রোদে নীল ছাপ মারা ফরসা কাপডিশগুলো, ফ্রেস হাসি-ঠাট্টা, চনমনে ওঠা-বসা-ডাকা সবকিছু, ক’হাত দূরে সরে গেছে মনে হয়। টেবিলের ওপর শরীরটা ঝুঁকিয়ে কিছুটা ভার ছেড়ে দেন, কিছুক্ষণ কাপ ডিশ বা চামচের যে দিকটায় আঙুল ছুঁয়ে থাকেন; সেদিকে চোখ পড়ায় একদৃষ্টে ক’মুহূর্ত তাকিয়ে থাকেন; কথা বলতে বলতেই পাশের জনের হাতে বা ঘাড়ে হাত রাখেন। আড্ডা যখন বেশ জমাটি তখন কপালটা টিপটিপ করে, বিভাবতী কাউকে বুঝতে দেন না। এই সময়ে ইদানীংকালে প্রায়ই একবার করে তাঁর মনে হয়, রমণীর গোলাপি আঙুলগুলো খুব সুন্দর।

পাড়ার ছেলেরা কাল এখানে, এই ক্যান্টিনের চেয়ারেই পেয়ে যাবে তাঁকে। অবনী নামে একটা ছেলে তাঁকে বলবে, বিভাদি, পবিত্রর নাক মুখ দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে। চেঁচাচ্ছে খুব মাঝে মাঝে আপনার নাম করে। আমরা সব ব্যবস্থা করে এসেছি। আপনি চলুন শিগগির। কয়েক সেকেন্ডের জন্য সামনের সবকিছু, গোটা দৃশ্যটা, ভারসাম্য ছিঁড়ে সটান চাঁ চাঁ করে ঢুকে যাবে বিভাবতীর অল্প পৃথুল শরীরের ভেতরে। তারপর বেরিয়ে আসবে ফেটেফুটে। বিভাবতী এক ঝটকা মেরে প্রচণ্ড বিরক্তিতে চেচিয়ে উঠবেন, ‘আঃ!’ তারপর থেকে অবশ্য সবটাই খুব বাস্তবসম্মত ব্যবহার। কাল শেষ বিকেলে অবনীরা শ্মশান থেকে ফিরবে। পবিত্র ওদের অনেকের সঙ্গেই বড় হয়েছে। একসঙ্গে তাই, পবিত্র যুবক ছিল তাই, পবিত্র চিরকাল কম কথা বলত তাই, কিছুটা বোধহয় একা-বিভাবতী তাই, নিমপাতা দাঁতে কেটে আগুন পুইয়ে মিষ্টি গালে দেবার সময়ে সবাই খুব চুপচাপ। এই নিষ্প্রদীপ নীরবতা ফাঁসিয়ে দেবার জন্য অবনী চাপা গলায় ফিচলেমো করবে, পবিত্রর চ্যাপ্টার তাহলে ক্লোজ‌্ড কি বল, হরি! বলেই তার চোখ পড়ে যাবে বারান্দার কোণে স্থিরমতি বিভাবতীর চোখে। বিভাবতী চোখ সরিয়ে নিয়েই ধীরে নির্বিকার গলায় বলবেন, অপু, তোর গামছাটা পড়ে গেছে, তুলে নে। বলে, অন্যদিকে সরে যাবেন। সকাল থেকে কয়েকবারই মনে হয়েছে, আরেকবারও মনে হবে অবনীর, এ কেমন শোক-বিষাদ? তার খুব অস্বস্তি হবে। ক্রমে ক্রমে ঝেঁপে সন্ধ্যা নেমে যাবে। দিন যাবে।

জানো রমণী, মাঝে মাঝে আমি আমার ভগবানকে জিগেস করি, ভগবান তুমি এমন ছেলে আমায় দিলে কেন? দিলে যদি, কেন নিয়ে নিলে? অসুস্থ দূরাত্মীয়ের মতো, একটা পাথরের মতো পড়ে থাকত পাশের ঘরে, কোনো সম্পর্ক ছিল না, শাদাটে মেরে গিয়েছিল, মাঝে মাঝেই আমার মনে হত ও বোধায় ভুলে গেছে, আমি ওর মা। তবু, ওর তরিযুৎ করা, অফিস-বাড়ি করা—এতে আমি কামাই দিই নি। আমার অভ্যেস হয়ে গেছিল, আমি সময় পেতাম না। আজকাল আমার খুব ফাঁকা লাগে। মনে হয় দেয়ালায় থাকা বাচ্চার মতো হাত-পা ছুঁড়ছি, চলছি, উঠছি, বসছি, দৌড়োচ্ছি।

—বিভাদি, আপনি ভগবানে বিশ্বাস করেন ?
—এমনিতে আর করি না। অনেক দিনই করি না। তবে, ওই একলা থাকলে যার সঙ্গে আমি ঝগড়া করি তাকে আমি ভগবান বলি।
—আমি কিন্তু করি জানেন, কাউকে বলবেন না। খুব ছোটবেলা থেকেই করি।
—তোমার বয়েস কত?
—হবে ছত্তিরিশ সাঁইতিরিশ।
—আমি ভাবতাম ছাব্বিশ সাতাশ; তুমি বেশ ধরে রেখেছ তো!
—কী?
—না কিছু না। তা তোমার ভগবান কীরকম? আমায় বোঝাতে পারো?
—খেয়েছে, অত আমি বোঝাতে-টোঝাতে পারব না। তবে, কীরকম বললে…এক কথায় বলতে পারি অনেকটা আমার দাদুর মতন। লম্বা-চওড়া, খুব ফরসা, দাড়ি আছে, সব সময়ে চোখে মিটমিটে হাসি। এরকম একটা ছবি ভেঙে ভেঙে মিলিয়ে যায়। সবকিছুতে ভাগ হয়ে যায়। মুর্শিদাবাদে ছোটবেলাটা আমার দাদুর সঙ্গে আগানে-বাগানে ঘুরে ঘুরেই কেটেছে। দাদু ছিলেন এক সময়ের স্বদেশী। খুব নির্ভীক, সত্যবাদী, গ্রামের ইস্কুলের হেডমাস্টার। আমি নিজের চোখে কুড়ি থেকে পট‌্ করে ফুল ফুটতে, পেট থেকে পড়া ছাগল-ছানার হাঁতে ফুঁ মারতেই ছানাটাকে নড়েচড়ে উঠতে বহু দেখেছি। দেখে দেখে শিখেছি, একজন আছে, যে পারে। নইলে ভাবুন, এই এত কর্মকাণ্ড দুনিয়ায়! আপনা থেকে তো আর কিছুই হয় না।

ছেলেটা, একটা ছত্রিশ সাঁইত্রিশ বছরের আজকের দিনের ছেলে শাদা বাংলায় ভগবানের কথা বিশ্বাসের কথা বলে যাচ্ছে! লম্বাটে বড়সড়ো মুখ, টানা টানা পদ্মের মতো চোখ, সিগারেট খায় না, লাল বড় ঠোঁট, চওড়া কপাল, মুখে কোনো রাগভাব নেই ! ডান গালের ওপর বড় কালো আঁচিলটাই যেন ওকে রাগতে দেয় না, একটু আলাদা করে দেয় সবার থেকে। এই ছেলেটার আঙুলগুলো গোলাপি, মোলায়েম। অফিসের পথে এক কম্পার্টমেন্টে আসতে যেতে পরিচয় হয়েছিল। নিউ সেক্রেটারিয়েটে চাকরি করে। একদিন একটু রাত হয়েছিল, চেনা কেউ ছিল না। গাড়িতে, শেয়ালদা থেকে ফেরার পথে, বিভাবতীর অসহ্য মাথা ধরেছিল। টপ টপ করে চোখ দিয়ে জল পড়ছিল। এ ছিল কয়েকটা সিট দূরে। উঠে এসে নির্দ্বিধায় বলল, বিভাদি আপনি মাথাটা নীচু করে বসুন। আমি আপনার কপালটা টিপে দিই। হয়তো উপশম হবে একটু। নেমে, ওষুধবিষুধ কিনে নেবেন। পরিচয়ের পর থেকে ওর ব্যবহারের রমণীয়তাই কোনো ছাপ ফেলে থাকবে, বিভাবতী কী মনে করে ওর হাতে কপাল পেতে দিয়েছিলেন। সোদপুর থেকে নৈহাটির মধ্যেই কী আশ্চর্য আস্তে আস্তে মাথা ধরাটাও নেমে গেল! তারপর পরিচয় আরেকটু গাঢ় হলো। বিভাবতী আশা করেছিলেন, মনের মধ্যে একটা দূর আশা, যে, সভ্য-সুন্দর দেখাতে দেখাতে একটু গাঢ় হবার পর ও একদিন একটা অসভ্য প্রস্তাব দেবে। দিল না। বিভাবতী দেখছিলেন। ওকে একদিন অফিস-ফেরতা, চলো রমণী, আমার বাড়িটা তোমায় চিনিয়ে দি, তোমার অমন বলরামের মতো আঙুল, কবে দরকার হয় আবার। বলে, ধরে নিয়ে এসেছিলেন। রমণী লজ্জা পেয়েছিল, এসেছিল। তারপর থেকে আসে মাঝে মাঝে। পবিত্র মারা যাবার পর, না বলতেই এসে এটা ওটা করে দেয়। জানলার কবজা লাগানো, রেশন তোলা, চোখের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া, ডালে সম্বর দেওয়া—সবই পারে ছেলেটা। এবং কোনো বিরক্তি নেই কোনো সময়ে। খুব যে আসে তাও নয়। এটা ওটা করে দিয়ে চলে যায়। বিভাবতী দেখলেন, ছেলেটা কীভাবে সংসারে ছোট্ট এক টুকরো জায়গা করে নিল। বিভাবতী কারুর ওপর নির্ভর করা পছন্দ করেন না। এ ছেলেটাও কারুর প্রত্যাশী নয়। অথচ দেখলে মনে হয়, বড় বড় চওড়া হাড়ের এই ছেলেটা এক্ষুনি বুঝি একটা কিছু চেয়ে বসবে। কিছুই না চেয়ে চেয়ে ছেলেটা বিভাবতীকে আরও আরও এগিয়ে নিল। তাকে দিয়ে আরও আরও কথা বলিয়ে নিল।

রমণী বলল, যাক আপনি আপনার ছেলের কথা বলুন। সে-ই একদিন আপনি আমাকে আলাপ করাতে ওর ঘরে নিয়ে গেলেন। আমি ওকে বললাম, নমস্কার।—ও পাশ ফিরে আপনাকে বলল, পাশবালিশটা পড়ে গেছে, তুলে দাও; দরজাটা ভেজিয়ে দাও, ঘুমাবো।—তারপর আর তো আলাপই হলো না। আমার খুব আশ্চর্য লেগেছিল জানেন! আপনি তো ওর গল্প করেন না। তুললেন বলেই একটা কথা জিজ্ঞাসা করছি আজ, কিছু মনে করবেন না; আপনি ওর কাছ থেকে কখনো সরাসরি জানতে চাননি, ও সব ছেড়েছুড়ে অমন একটা পাথরের মতো ঘরবন্দি হয়ে পড়ে থাকা বেছে নিল কেন?

বিভাবতী চুপ করে রইলেন। থুতনি হাঁটুর ভরে চিবুক। মেঝেতে চোখ। কিছুই খেলছে না।

মানে…একটা ইয়ং ছেলে স্বেচ্ছামত্যু বেছে নিল! ওই একদিন ওর চোখ দেখেই আমার মনে হয়েছিল, ও এখানে থাকে না। ও অনেক দূরের অধিবাসী হয়ে গেছে। আপনার মতো মা থাকতে…আপনার কথায় ওর কোনো প্রতিক্রিয়া হত না?

বিভাবতী চুপ করে রইলেন। স্বেচ্ছামৃত্যু থেকে শেষ পর্যন্ত থামা থামা কথাগুলো অনায়াসে গড়িয়ে গড়িয়ে শরীরের ভেতরে ঢুকে গেল।

আপনার খুব কষ্ট হলে অবশ্য থাক! আর সত্যিই তো, আমি জেনে আপনার তো কোনো লাভ হবে না।
না, প্রতিক্রিয়া ওর আর হত না। ও আমাকে ভুলে গেছিল।

বিভাবতী আবার চুপ। এক দুই তিন সেকেন্ড…মিনিট। দুজনের মধ্যবর্তী নীরবতা। বর্ষাকালের এক বিকেলের নীরবতা। তাঁকে এসে ধাক্কা মেরে গেল। জলের কাল এসে ঠেলা মারল জলে। করেছিলাম। একদিন করেছিলাম জিগগ্গেস। কেন, কেন তুই আমাকে এভাবে জ্বালাচ্ছিস! দিনের পর দিন ঘরের মধ্যে পাথরের মতো পড়ে থেকে। বলেছিলাম, আমি তোকে খুন করে ফেলব। কে আছে আমার দুনিয়ায়—মা বাপ ভাই স্বামী? তুই আমার পেটের ছেলে, একটা দামড়া ছেলে, জ্যান্ত ভূতের মতো শুয়ে শুয়ে আমার রোজগারে খাস; কাজে অকাজে নেই, সারাদিন শুয়ে শুয়ে কড়িবরগা গুনছিস আর দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়ছিস। তুই কি আমায় রক্তশূন্য করে খেতে চাস? বল কী চাস তুই?—আমার মাথা গরম হয়ে গেছিল। ঘুম আসছিল না। তখন মাঝরাত। আমি উঠে গিয়েছিলাম। আমি ওকে নিয়ে আর ভাবতে পারছিলাম না। ও চুপ করে রইল। আমি কাণ্ডজ্ঞানহীনের মতো ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ওকে মেরেছিলাম। চিৎকার করেছিলাম প্রার্থনা করেছিলাম, দাবি করেছিলাম, বল, তোকে বলতেই হবে আমাকে, কী হয়েছে তোর! আমি দশ মাস দশ দিন পেটে ধরেছি তোকে। এখনও আমার নাড়ি কটকট করে—কেন করবে? তোকে বলতেই হবে!

বহুদিন পর আমি শুনলাম ওর ধাতুর মতো টংটঙে গলা, ফ্যাঁসফেঁসে মেরে গেছে। সে গলায় কোনো বিকার নেই। কোনো ভাবান্তর নেই। বলল, তুমি আমার মা—তাতে কী, আমার মনে থাকে না। সবকিছু এখন বুঝতে পারছি। কিছুতেই আমার কিছু যায় আসে না। আসলে আমি এখন দূর থেকে তোমাদের দেখতে পাই। বেশ লাগছে। আমার কিছু করতে ইচ্ছে হয় না। কী হবে করে? এই যে তুমি কাঁদছ, চিৎকার করছ এর কোনো মানে নেই। তুমি শিখেছ, তোমার মতো হলে এরকম করতে হয়—তাই করছ। তুমি যাও, আমার কথা বলতে ভাল্লাগে না। সব শুধু আওয়াজ। আর নইলে মারবে আমায়—মারো, খুন করো, দেখো কী হয়। কিছুই হবে না, বদলাবে না। ওই পুরোনো দেয়ালটা মোটেই নড়বে না। খাটের ছত্রী, সিলিং ফ্যান, পর্দা—সব কাল সকালেও একভাবে ঝুলবে। দেয়ালে টাঙানো ওই মৃন্ময় মাছ একভাবে তোমাকে দেখে যাবে। মারবে মারো, নইলে চলে যাবে যাও। আওয়াজ কোরো না।—কী নিষ্ঠুরের মতো বলল। তারপর আর কিছুই বলল না। আমার দরকার ছিল কাঁদা খুব, কিন্তু ওর ওই ফ্যাঁসফেঁসে গলা আমার সব জল মেরে নিয়েছিল। আমি টলতে টলতে আমার ঘরে এসে আছড়ে পড়েছিলাম। তারপর আর যেতাম না। আমি বুঝে ফেলেছিলাম যাবার কোনো দরকার নেই। সবকিছু সময় মতো শুধু জোগান দিয়ে যেতাম। সেটাও, শৈল দিয়ে করে আসত।

জানো রমণী, মা হয়ে, আমি মা হয়ে, শৈলকে বলেছি—টাকা দেবো, একটু খুলেখেলে যাবি, সময় নিবি অনেকক্ষণ, তোর দাদার বিছানাটা ঠিকঠাক করে দিবি। কিছু করলে, আরও টাকা দেবো। কিছু করেনি। শৈল এসে বলল, ‘কিছু করল না গো, দেক‌্লে খানিক ফ্যালফ্যাল করে, তারপর চোক সরিয়ে নিল।’ আমি ওকে বললাম, এরপর কিছু না পরে গিয়ে দ্যাখ তো! শৈল বলেছিল, ‘দাদার চোকের দিকে তাকালে আমার ভয় করে মাসি।’ আমি ওকে টাকার লোভ দেখিয়ে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু, কিছু হয়নি। আমার পবিত্র দেখেইনি চেয়ে ভালো করে। ওর সব বৃত্তিগুলো নষ্ট হয়ে গেছিল। শুধু, প্রাণটা বেরোল ক’মাস বাদে। যখন ওর আর একদম ইচ্ছে করল না, তখন প্রাণটা ছেড়ে দিল।

আমার কী মনে হয় জানো, ওর লুকোনো খুব বড় একটা আশা-টাশা ছিল হয়তো। ভেঙে গেছে। আমি নিজে বুঝিনি অবশ্য কোনোদিন। কী করেই বা বুঝব? চিরকাল গুনে গেঁথে কথা বলে। এইটুকুবেলা থেকে ফুটবল, একটা অ্যালসেশিয়ান কুকুর ছিল জিমি, পড়া আর চুপ মেরে থাকা ওর নেশা। ফুটবলের বাইটা পেয়েছিল বাপের থেকে। কিন্তু, বাপ ছিল ওর ঠিক উলটো, খুব হুল্লোড়ে। অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেল দুম করে। তখন ওর পনেরো। ওর বাপের একটা দুঃখই থেকে গেল, ছোট্ট ছেলে, কথা বলে না! পাঁচ বছর থেকে পবিত্র আলাদা শোয়। ওর সব আলাদা ওই বয়েস থেকে। ওর বাপ চেয়েছিল ছেলে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন হবে। উলটোপালটা বই পড়ত খুব। ফরম্যাল এডুকেশনে নজর দিত না বোধায়। সবাই ভাবত দারুণ করবে হায়ার সেকেন্ডারিতে। খুব সাধারণ ফল হলো। বিকমে গেল, পড়তে পড়তে ছেড়ে দিল। খেলত ভালো, খেলার সুবাদেই একটা চাকরি পেয়ে গেল। খেলেও বড় কোথাও গেল না। তবু দেখতাম খেলে যাচ্ছে। এখানকারই মাঠে বাচ্চাদের সঙ্গে। ওর বন্ধুদের কাছে শুনেছি, সবাই ওকে বাইরে যেতে বলত। ও যেত না, চুপ করে থাকত। ভূতগ্রস্তের মতো চামড়ার বলটার মায়ায় ও জড়িয়ে পড়েছিল। বেশ ছিল নির্বিবাদে। কারুর ছায়া না মাড়িয়ে। কোনোদিন কোনো মেয়ের সঙ্গেও ভাবসাব হয়েছে বলে শুনিনি। হয়তো জোর করে বিয়েটিয়ে দিয়ে দিলে বেঁচে যেত। ভাবিনি কোনোদিন। তারপর খেলতে গিয়েই একদিন পা ভেঙে বাড়িতে এল। ন’মাস লাগল ঠিক হতে। পড়ে রইল বিছানায়। পা ভালো হলো। কিন্তু, আর উঠল না। আরও দু-বছর শুয়ে শুয়েই বেঁচে থাকল। তারপর একদিন যেচে মরে গেল।

বিভাবতীর ভেতরে একটা অনিচ্ছে এসে গিয়েছিল কথা বলতে বলতে। নিরুত্তেজ ভাবে শেষ করলেন। তারপর চুপ করে রইলেন। ‘জানো রমণী’ বলে কিছু একটা বলেত গিয়েও, অত্যন্ত অবসাদ থেকেই বললেন না।

আমার নাম কিন্তু রমেন। আপনি ‘রমণী’ বলেন, আমার মজাই লাগে। তাই আর কিছু বলি না। আপনি অমন নিশ্চিন্তে ‘রমণী’ কী করে কোরে ফেল্লেন রমেন-কে!

অন্য সময় হলে বিভাবতী হেসে ফেলতেন। সন্ধে হয়ে গেছে। ঘরে আলো পড়েনি। হালকা এক চির অনেক দূরের জলা হাওয়া এল। মাঝারি গড়ন, ফরসা রং, অল্প পৃথুলা শরীর বিভাবতীর। ছোট কপাল, কটা চোখ, চাপা ঠোঁট, হাসলে এখনও গালে টোল পড়ে। ঘরের আঁধারে শুধু তার অবয়বটুক বোঝা যায়। যে-কোনো একজন রমণীর অবয়ব এরকমই হয়। বিভাবতীর অবয়বের ভেতরে ফুটে উঠল কয়েকটা কোমল গোলাপি আঙুল।




প্রচ্ছদচিত্র সৌজন্য: www.pinterest.com