বিকেলের নরম আলোয় চেনা পৃথিবী যখন কিছুটা অচেনা হয়ে যায়, আশ্চর্য এক ভালো লাগার ঘোর সমস্ত ভুবনে ছড়িয়ে যায়, ধীরাজকে দেখা যায় হায়দরি পার্কে। পায়ের নীচে নরম ঘাসের গালিচা, আশেপাশে সারিসারি মৌসুমি ফুলের বাহার, পাতাবাহার আর পাইনের ঝোপঝাড় এবং সর্বক্ষণ ফুরফুরে লাজুক বাতাস—সবকিছুই পেছনের নিঝুম সিভিল হাসপাতালের পটভূমিতে আরও বেশি ভালো লাগার কথা। বিশেষ করে বয়স যার মাত্র তেইশ ছুঁই ছুঁই। অথচ, কেন যে ধীরাজের কচি মুখে বিষণ্ণ ছায়া তিরতির করে সদাসর্বদা। মানুষ-মানুষীর ভিড় থেকে গা-বাঁচিয়ে ঝরনার লাগোয়া বড়সড়ো পাথরে আসনপিঁড়ি হয়ে বসা তার নিত্যনৈমিত্তিক রীতি। কখনো-সখনো সে আলতো পায়ে ছোঁয় ফেনিল স্রোতকে, শিউরে ওঠে। কনকনে ঠান্ডায় কলারটা নিবিড় করে তুলে দিয়ে ফিসফিসে সুরে বলে, ‘আমি জানি, আমি জানি’।

বাড়িতে ধীরাজের একটি ছোট ভাই আপন মনে খেলা করে। খুব ছোট। ওর খেলনা নেড়ে চেড়ে দেখতে চাইলে, তারস্বরে কান্না জুড়ে দেয় সে। হাত-পা ছুঁড়ে তীব্র প্রতিবাদ জানায়। কেউই কারো অধিকার ছাড়তে রাজি না। ধীরাজ তাকে সান্ত্বনা জানাতে চাইলে, ছোট ভাইটি ভুল বুঝে, মা’কে নালিশ জানায়। ধীরাজের বুকে অহরহ কত সজারুর তীক্ষ্ণ কাঁটা বিঁধে থাকে; সে স্থির জানে, রক্তক্ষরণ হচ্ছে অঝোরে। বাইরের দুনিয়া কিন্তু অদ্ভুত নিস্তরঙ্গ থাকে; সেখানে ঠিক আগের নিয়মে রোদ্দুর গনগনে আঁচ ছড়ায়, মানুষ মানুষীরা পারস্পরিক সুখ অসুখের ভাগবাঁটোয়ারার দখলদারি নিয়ে কোঁদল করে।

যখন মিহি মসলিনের চাদরে ঢাকা পড়ে শিলঙের চড়াই উতরাই, ধীরাজ নিঃসঙ্গ হেঁটে বেড়ায় ধীরলয়ে। তার খুব কাছে শ্বাসনিঃশ্বাসের মতন ঘনিষ্ঠ হয়ে জেগে থাকে নানান বিষয়আশয়। সে অজস্র অলৌকিক শব্দ শোনে। অনেক অলৌকিক দৃশ্য দেখে। অথচ মাঝে মাঝে এসবের তাল কেটে যায়। এক দঙ্গল ভোমরা হুল ফোটায়, অশরীরী যন্ত্রণায় উথালপাথাল হয় ধীরাজের বুক, অনিবার্যভাবে হাহা করে ছুটে আসে সর্বগ্রাসী বাতাস, ওতে ধ্বনি ওঠে, দ্রুত নুপুরের ছন্দে, মিত্ রাহ… মি-ই-ত‌্-রা-হ।

ঠিক সেই মুহূর্তে চরাচর কঁপিয়ে প্রলয়ের শব্দ ওঠে, ভয়ংকর গোঁ গোঁ গর্জন তুলে ছোটে মোটরবাইক লরি বাস। হয়তো কয়েক ঘণ্টা পার হয়ে যায় ঘোর-লাগা অবস্থায়। বিনি মদে মাতাল হয়ে ধীরাজ ঘরের দিকে ফেরে যখন, তখন বারবার চুম্বকের অমোঘ আকর্ষণে তাকে প্রেতপুরীর মতন স্তব্ধ হাসপাতাল হাতছানি দেয়।

বারংবার মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে প্রকৃতস্থ হবার চেষ্টা করে ধীরাজ, অজান্তে গুমরানো শব্দ ওঠে ঠোঁট চিরে। তাকে এক অদ্ভুত বিশ্বাস পেয়ে বসে, হয়তো বা কিছু পুরোনো ঘটনার পুনরাভিনয় হচ্ছে, হয়তো এই অনৈসর্গিক বাতাসের ছোঁয়ায় সময়ের কাঁটা উলটোদিকে ঘুরে যাবে, হয়তো বা ওই হাসপাতালে আবারও দেখা যাবে, কিছু ব্যাণ্ডেজ বাঁধা শরীর!

ধীরাজের পৃথিবী ইদানীং কুয়াশা আর মেঘে মাখামাখি। স্মৃতি-বিস্মৃতির ভেলায় চড়ে অথৈ পারাবারে ভাসে সে; সব কিছু থাকে দূরে দূরেই, কারো পুরো চেহারা ধরা-ছোঁয়ার আওতায় আসে না কখনও। তার চোখের প্রান্ত অকারণ জ্বালায় করকর করে। বাবা অনেকদিন শয্যাশায়ী, পঙ্গু। মা প্রায়ই জলভরা চোখে তাকায়। এসব তার ভালো লাগে না। ইচ্ছে করে, পরম যত্নে ঝাড়ন দিয়ে তুলে-রাখা মোটর সাইকেলটাকে সাফসুতোর করে নিয়ে বেরিয়ে পড়বে যে-দিকে খুশি। কেউ কিছু জানবে না, কোথায় যাচ্ছে ধীরাজ। হয়তো কিছুক্ষণের জন্যে তার ঠিকানা হবে বরাপানি অথবা এলিফ্যান্ট ফল‌্স। নাহ‌্! কিছুই লাগে না ভালো। সব ট্র্যাশ।

মা কেঁদে ফেলে কখনও বা। বলে, বিক্রি করে দে না বাবা, কিছু টাকার সাশ্রয় তো অন্তত হবে। নিদারুণ চমকে ওঠে ধীরাজের বুক, কোনো উত্তর দিতে পারে না, বড় কষ্টে উচ্চারণ করে মা, মা’গো। ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। বিপর্যস্ত পদাতিকের মতন। হায়দরি পার্কের সংবেদনশীল পরিবেশে সে আবারও একা একা থাকে। তীব্র যন্ত্রণায় মুঠো মুঠো ঘাস ছিড়ে নেয়, অথচ কম্পিত মুঠো থেকে সমস্তই গলে পড়ে যায়। বাড়ি ফিরে এসে নিশ্চুপ দুঃখী বাইকের গায়ে সান্ত্বনার হাত বুলোয় আপন মনে। অন্য কোনো প্রিয় মুখ তখন আর মনে আসে না।

ধীরাজের পুরোনো ট্রাইসাইকেলটা হাড়গোড় ভাঙা দ হয়ে প্লিনথের নীচে ঘুমিয়ে আছে। কয়েকটা ভাঙা রোঁয়া-ওঠা বাক্স, পুরোনো বেহালা, কড়াই, বাসন, ছেঁড়া বেতের চেয়ার ইত্যাকার জঞ্জালের মধ্যে শৈশবের সঙ্গে সে প্রায়ই খানিকক্ষণ কাটায়। এই নিষ্প্রাণ জিনিসপত্রগুলো যেন নিভৃতে আলাপ জমায় তার সঙ্গে, ধীরাজের দু-চোখ সম্ভবত ভ্যাপসা গন্ধেই জ্বালা করে। ধীরাজের মাথা বুক হাত প্রচণ্ড শীতেও ঘেমে ওঠে। বেহালার ছড়িটা প্রাণপণে নড়তে থাকে, দরবারি কানাড়ার সর্বগ্রাসী গমকে থরথর কাঁপে সদ্য-তেইশ ধীরাজের পৃথিবী। সে চেঁচিয়ে ওঠে, না…নন‌্-আ।

মা রান্নাঘর থেকে ছুটে এসে শুধোয়, ধীরু, কী হলো রে!
মাথাটা ঝাঁকিয়ে প্রকৃতিস্থ হবার চেষ্টা করে মায়ের ধীরু, সদ্যযুবা ধীরাজ।

এভাবেই দিন যায় আজকাল।

ধীরাজের শিরদাঁড়া বেয়ে তিরতির করে নামে সুখ অসুখের ঠান্ডা স্রোত। সুনসান অন্ধকারে বুকের দেউড়িতে ঘণ্টা বাজে। ধীরাজের বন্ধু মানে সঙ্গীরা আজকাল তাকে এড়িয়ে চলে। সে একা একা থাকাই পছন্দ করে। হঠাৎ হঠাৎ কথা বলতে শুরু করে নিজের সঙ্গে। দমকা হাওয়ার মতন এসে, আবার তেমনি আচমকা উঠে পড়ে—এমন ছেলের সঙ্গে আড্ডায় তো সুখ হওয়ার কথা না। কখন কোন কথায় যে রাগ করে বসে, তারও ঠিক নেই কিছু।

ধীরাজকে সন্ধ্যার পরে শ্রান্ত পায়ে কৈলাস কেবিনে ঢুকতে দেখে, অমিত বলে কী রে, ধীরাজ! বেহালা বাজানো এক্কেবারে ভুলে গেলি? জানিস, গত পরশুদিন মাস্টারজি বলছিলেন…
অমিতকে থামিয়ে, প্রচণ্ড জোরে চেঁচিয়ে ওঠে ধীরাজ, প্লিজ স্টপ ইট, নো মোর প্লেয়িং অন ভায়োলিন, নো মোর রাইডিং অন দি বাইক।

উদ্ভ্রান্ত চেহারায় কয়লাটুকরোর মতন ধকধক জ্বলে ধীরাজের চোখ। বসে থাকে হতভম্ব অমিত। উৎসাহী মানুষদের সপ্রশ্ন দৃষ্টি তিরের মতো ধেয়ে আসাতেই হয়তো ঝপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়ে ধীরাজ। সাগর থমথমে পরিবেশকে হালকা করে, ব্যাক আপ, ধীরাজ! ভুলে যা না ভাই সব। খালি ভাবনা চিন্তা করে কী লাভ!

উত্তর দেয় না ধীরাজ। বিধ্বস্ত ভঙ্গিতে করুণ হাসি হাসে, মৃদুস্পর্শ করে অমিতের কাঁধ, বলে, আমার কী যে হয়েছে… আর বলিস না ভাই, ভায়োলিনের কথা। ওসব চুকে গেছে।

অমিত ম্লান হাসে। সাগর রাকেশ অমিতরা ধীরাজকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়। এখন ঘনঘোর শীত আরও জাঁকিয়ে বসেছে। হাড়জরজর হিমে জবুথুবু হয়ে চলতে হয়। অদূরে চড়াইয়ের ঘরদোর দোকানপাট কুয়াশার চাদরে মোড়া। লাজুক ঘোমটাপড়া আলো যেন চরাচরকে আরও মায়াবী করে তুলেছে। ট্যাক্সি বাস সমানে এদিক-ওদিক ছুটে যায়। তীক্ষ্ণ হিমশীতল ঢেউ ভাঙতে ভাঙতে চলে ধীরাজ। বন্ধুরা ধীরে ধীরে অল্প স্বল্প খুচরো আলাপ করছে কিন্তু তার মন নেই তাতে৷ সে দেখে, কোনো নীলাম্বরী ঘাসের সুছাঁদ গালিচায় কনে দেখা গোধূলিতে হেঁটে যাচ্ছে, কাছেই অনবরত কাসর ঘণ্টার বেলোয়ারি আওয়াজ…সেই প্রৌঢ়কিশোরীর সিঁথিতে ক্ষণিকের অকারণ উন্মাদ শিহরনের স্বাক্ষর জ্বলজ্বল করে…। সে শোনে, বেহালার তীব্র সুর আছড়ে পড়ছে চারদিকে। পাইনের নিরীহ পত্রপুটের ফাঁকে বয়ে যাওয়া উদাস বাতাসে সেই সুর খানখান হয়ে ভাঙছে…। এই অপরূপ ঘোর নিবিড় হয়ে আসার ক্ষণে ধীরাজ দেখে, একটা পাগল মোটরসাইকেল গমগমে ধ্বনি নিয়ে দ্রুত ছুটে যায়। বেহালার ওই মরণান্ত সুরকে পর্যন্ত ছাপিয়ে যায় সেই নিরবচ্ছিন্ন দামাল শব্দের ঢেউ…


২.

স্পিডোমিটারের কাঁটা ক্রমশ অনেক বেশি বেপরোয়া। বরাপানির প্রশস্ত পথের দু-ধারে ছিমছাম পাইনের সারি। পাতা ঝরার টুপটাপ মিহি শব্দ ডুবে যায়। ছুটন্ত বাইকের ধ্রুপদী ধ্বনিতে, মিত্রার হাসিতে জলতরঙ্গ বাজে একটানা। ধীরাজের ঝাঁকড়া চুলের রাশি এলোমেলো হয়ে পড়েছে চপল বাতাসে। বারবার সে হর্ন দিতে থাকে, সেই নিহেতুক খরখরে আওয়াজ ফালিফালি করে দেয় শরতের মিঠে রোদ, আমূল নীরবতা কাঁচের মতন ভেঙে খানখান হয়ে যায়। মিত্রা পেছন থেকে আঁকড়ে ধরে ধীরাজের স্টিয়ারিং ধরা উচ্ছল হাত।

অ্যাই রাজা, কী হচ্ছে …ভয় করছে যে!
ধুত, কীসের ভয়, দ্যাখো-ই না…

বলতে না বলতে বাঁক পেরোবার সময় উলটো দিক থেকে আসা ভব্যসব্য জিপটাকে নিপুণভাবে পাশ কাটায় ধীরাজ।

তুমি না পাগলই হয়ে যাবে। এক্কেবারে ঢিলে মাখা তোমার। একটু স্থির হয়ে চলতে পারো না?
ওসব আমার পোষাবে না, বুঝলে!
গাড়ি থেকে নামতে নামতেই মিত্রার কাঁধে বেশ ভারী ওজনের চাপড় কষায় ধীরাজ।
উফ‌্! বাবা রে বাবা, কুঁজো করে দিয়েছ একেবারে…লোফার কোথাকার।
আমি লোফার! ইশ‌্, তুমি কী?
তুমি লোফার নও শুধু, সেন্ট পার্সেন্ট বাস্টার্ড!

এভাবেই ধীরাজ এবং মিত্রার আলাপ জমে। বরাপানির আকাশে একটা সোহাগি হেলিকপ্টার চক্কর দিচ্ছে। মিত্রা, ধীরাজকে অনেক কথা বলে। ধীরাজ সে কথা কখনও শোনে, কখনও শোনে না। হঠাৎ বলে, জানো, কাল মাস্টারজি একটা নতুন গৎ শেখাচ্ছিলেন যখন, আমি ভাবছিলাম ক্যাসিয়াস ক্লে যা-একখানা বেলুন হুক ঝেড়েছে না লিস্টনকে… একদম এইভাবে, দ্যাখো, টিসুম।

মিত্ৰা ককিয়ে ওঠে ব্যথায়, ওরে বাবা, গেলুম গেলুম, কী ডাকাতের পাল্লায় যে পড়েছি। যাও, গুন্ডামি করো গে, বেহালা তোমার জন্যে না।
ওহ‌্! লেগেছে নাকি? দাঁড়াও, ম্যাসেজ করে দিচ্ছি। এক্ষুনি ঠিক হয়ে যাবে।
যাও যাও, মেরে আর আহ্লাদ করতে হবে না।
আহা, দ্যাখো-ই না!
ছেড়ে দাও, উফ‌্, লাগছে যে… ছেড়ে দাও, লোহা দিয়ে গড়া নাকি বাপু তোমার হাত?

ধীরাজের চঞ্চল চোখ ঘুরে বেড়ায় হেলিকপ্টারের পাংশুল উপস্থিতি থেকে ধূসর পাহাড়ে, নিঝুম গাছগাছালির মাথায়। মধুমতী বাতাস বয়ে যাচ্ছে সন্তর্পণে। মিত্রার কথাবার্তা থেকে একটা মিষ্টি সুরের রেশ আলাদা হয়ে বেরিয়ে মিশে যায় সুনীল আকাশের চাঁদোয়ায়। চারদিকে অদৃশ্য মাদলের নীরব ঐকতান শুনতে পায় ধীরাজ। অদূরের স্থির জলের দিকে দীর্ঘ চোখ মেলে তাকায় সে। নতুন ধরনের একটা চনমনে ভাব দূরের ওই পর্বতশীর্ষের মতোই আস্তে আস্তে কুয়াশায় তার মনের দিগন্ত ছেয়ে ফেলে। একটা মৌমাছি যেন গুঞ্জন করে অনরবত, বিনি নেশার আমেজ দু-চোখে বিছিয়ে দেয় পাতলা ঘুমের চাদর। টান হয়ে সে কচি ঘাসের শতরঞ্জে শুয়ে পড়ে।

মিত্রার দুটি কাঁধ ছাপিয়ে পড়েছে একরাশ মেঘের মতো রেশমি চুল। বোধহয় দামি তেল মেখেছে আজ। বুনো গন্ধের সঙ্গে মিশে একধরনের মদির ঘ্রাণ উথালপাথাল করে তোলে ধীরাজের হৃদপিণ্ডকে। সে অনর্গল চেয়ে থাকে মিত্রার স্বপ্নিল অবয়বের দিকে। ওর কথা কিছুই কানে ঢোকে না ধীরাজের, সারা মাথা জুড়ে থাকে শুধু একটা দ্রুত সঞ্চরমান গাড়ির শব্দ। আহ্, এটা কী, কী এটা… নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসে তার।

মিত্রা মুখ ঝামটা দেয়, আচমকা। উত্তর দিচ্ছ না যে, অ্যাই রাজা, শুনতে পাও না…কালা কোথাকার!
অ্যাঁ, কী বললে?
মিত্রার নাক ফুলে ওঠে রাগে।
ধীরাজ কাঁচুমাচু হয়ে বলে, আর একবার বলোই না।
ইশ‌্, ছাই বলব। আমার আর কাজ নেই খেয়েদেয়ে! তুমি কি কখনো শুধরোবে না?

ধীরাজের রক্তে মাদল বাজার তাল ওঠে। হলদে রোদের আঁচ লাগে চোখে। মিত্রার রাগী মুখ অন্যদিকে ফেরানো। আঁচলটা বাতাসে আলুথালু হয়ে খসে পড়েছে। অনিবার্য চুম্বকের আকর্ষণে ধীরাজের চোখ পড়ে সেদিকে। ব্লাউজের একটা বোতাম খোলা বুক জুড়ে দাঁড় বেয়ে ছলাৎচ্ছল শব্দ ওঠে। মৌমাছির গুনগুন এখন হেলিকপ্টারের গর্জন হয়ে গেছে। হালকা বাদামি রঙের কচি স্তনে নীল শিরার আভাস।

মিত্রা তাহলে আর কিশোরী না, রীতিমতো স্তনিষ্ণু এখন। ফিকে নীল জামার শাসন আর মানছে না ওর উদ্ধত শরীর, তীব্র সোঁদা ঘ্রাণ তীক্ষ্ণতর হয়ে পড়ে। বাতাসে ভেসে আসে চাবুক চালানোর প্রচণ্ড সুঁই সুঁই আওয়াজ! ধীরাজের চোখ যেন ধোঁয়ার জ্বালায় করকর করে, গনগনে আগুনের ভাপ লাগে কানে। অজস্র অলৌকিক ধ্বনি তার মাথায় একসঙ্গে বেজে ওঠে। মিত্রার ডান বুকের তিল দেখে নিদারুণ তেষ্টা পায় তার, গভীর পিপাসায় আলজিভ পর্যন্ত শুকিয়ে আসে।

ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ে খবর পেয়েই বোধহয় মিত্রা হঠাৎ সচকিত হয়। ধীরাজ নিথর গাছের মতন দম বন্ধ করে চেয়ে আছে। দ্রুত রং বদলায় ওর মায়াবী মুখমণ্ডলে। ত্রস্ত হাতে আঁচল ঠিক করে নেয় ও; ওদিকে ধীরাজের বুক-ভরা পেয়ালা ছলকে ওঠে৷ মিত্রার পরিচিত মুখও হঠাৎ করে কেমন যেন অপরিচিত হয়ে যায়। রক্তিম ছোপ ওর চোখে, বেহালার সুর যেন জমাট হয়ে রয়েছে ঠোঁটে। ধীরাজের সত্তাকে আমূল কাঁপিয়ে নৈশ মেল ট্রেন গমগম করে পুল পেরিয়ে যায়। যন্ত্রচালিতের মতো মিত্রার কুসুমপেলব হাত সে নিজের হাতে তুলে নেয়। তার গলা থিরথির কঁপে, মন্ত্র উচ্চারণের মতো সে নরম সুরে ডাকে। মিত্রা, মি-ত‌্-রা।
কী!
মিতুয়া—!
উম‌্!

ধীরাজের পৃথিবীতে কোনো রমণীর পায়ের ঘুঙুর দ্রুতলয়ে গভীর ধ্বনির দীর্ঘায়িত তরঙ্গ তোলে। ভুবন জুড়ে অলৌকিক দামামা বাজে দ্রিমি দ্রিমি দ্রিমি—তুলতুলে ঠোঁটের স্বাদ নেয় সে নিটোল আবেশে। থরথর পুলকে দু-চোখ বন্ধ হয়ে আসে। মিত্রার জিহ্বা ধীরাজের সমস্ত উত্তাপ নিথর মমতায় গ্রহণ করতে থাকে। পরম সোহাগে ওর কোমল হাত ঘুরে বেড়ায় ধীরাজের ঝাঁকড়া চুলের মধ্যে। লতানে গোলাপের মতন তার রাজার শরীরে মিশে থাকে মিত্রা।

এমন সময়ে কেবলই ঘুরে ফিরে আসে ঘুঘু ডাকা শৈশবের আফোট স্মৃতি, মনে পড়ে মায়ের মুখ, শৈশবের গল্পবলা বাবার কথা মনে পড়ে যায়। নির্জন বারান্দার কোণে মৃদু স্বরে সেই নিভৃত আলাপন—ধীরু, তুই একটু বড় হলেই তোকে আমি ভিটেবাড়িটা দেখিয়ে আনব। জানিস, আমাদের তিনটে পুকুর ছিল। বড় বড় কত মাছ। তোকে মানুষ হয়ে সব ফিরিয়ে আনতে হবে, বাবা! আম জাম নারকোল…।

ধীরাজের শরীরে শীতকাঁটা ওঠে। চেয়ে দেখে, মায়ের মতন স্নিগ্ধ চোখে মিত্রা তাকিয়ে আছে তার দিকে। মিত্রার নরম গন্ধ-ভুরভুর চুলে আঙুল জড়িয়ে সে আস্তে আস্তে ফের ডাকে, মিত্রা!
উম‌্! কী, বলো?
না, কিছু না।

মিত্রা অবাক চোখে দেখে ধীরাজকে৷ সেই দৃষ্টিতে শান্তি, নির্ভরতা, ভালোবাসা মাখামাখি হয়ে আছে। দু-চোখের কোণে মুক্তাবিন্দু ঝলমল করে, শরমরাঙা মুখে ঠিকরে-পড়া রোদ্দুরের অপরূপ আলপনা। ধীরাজ টের পায়, তার চারদিকে অজস্র অনৈসর্গিক বীণায় আহির ভৈরবের মরমী সুর বেজে চলেছে। বাইরের ময়ূরপঙ্খী বাতাসে ভালোবাসার স্বাক্ষর।

মিত্রার হাতের কাঁচের চুড়ি থেকে মিঠে, শান্ত, জলতরঙ্গের বেলোয়ারি আওয়াজ ওঠে৷ অবিরল সুরেলা গলায় ‘রাজা রাজা’ ডাক মিশে যায় নেশাধরা আকাশ পাহাড় বাতাস জলের সঙ্গে। সমস্ত সত্তাকে আচ্ছন্ন করে নেমে আসে মিহি কুয়াশা। খুব সর্পিল গতিতে হয় তার অগ্রসরণ। কোথায় যেন অদূরে সূর্যোদয় হচ্ছে আবার কোনো এক দিগন্তে পাণ্ডুর অন্ধকার ছড়িয়ে ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে সব আলোর আলো। এই মেঘছায়া-রোদ্দুরের অপরূপ পালা বদলের পালায় ক্রমশ স্পষ্টতর হতে থাকে বিন্দু বিন্দু আলোর ঝলকানি, একরাশ জোনাকি পোকা চারদিকে। পরিচিত সুরের ঠুংরি। পুছো না ক্যায়সে ম্যায়নে রৈন বিতায়ে…।

প্রাণপণ চেষ্টাতেও ধীরাজের মুখে কোনো সাড়া জাগে না। হাত পা শোলার মতো নেতিয়ে যায়। দূর থেকে আরও দূরে হারিয়ে যায় মিত্রা আর ওর মিষ্টি সুর…রাজা…রাজা। তারপর পুরু পর্দা ঝুলতে থাকে শুধু চরাচর জুড়ে। সব ধোঁয়াটে, সব অন্ধকার।


৩.

ধীরাজ অস্ফুট সুরে যন্ত্রণায় ককিয়ে ওঠে। চোখ মেলে তাকাতে বড় অসুবিধে হয়। আস্তে আস্তে তার চোখে আলো সয়ে যায়। ঝাপসা চোখে তাকিয়ে দেখে, কিছু আবছা চেহারা তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ সে নিজের অবস্থা সম্বন্ধে সচেতন হয়। এ কী, সে কোথায়, শুয়ে কেন? মিত্রা কোথায় গেল? মিত্রা! ধড়মড় করে উঠে বসতে চায় সে। কে যেন জোর করে তাকে শুইয়ে দেয় আবার। বলে, উঠিস না, শুয়ে থাক।

—এসব কী?

এই তো মা। এ কী, মা কাদছে কেন! ছোট ভাই বিস্ফারিত অবাক চোখে তাকে লক্ষ করছে। অমিত-সাগর-রাকেশ—এরা আবার এল কোত্থেকে? সব গোলমাল হয়ে যায় ধীরাজের। মিত্রা কোথায়, মিত্রা?

ওহ‌্, মিত্রা আসবে কী করে! সব ভুল, তাহলে সব ভুল। চেরাপুঞ্জির হাসপাতালে সে তো গিয়েছিল। ইমার্জেন্সি ওয়ার্ড। হলদে ফুল সংখ্যাহীন ফুটেছে সেখানে। রংচঙে প্রজাপতি মৃদু শব্দ তুলে উড়ে বেড়াচ্ছে । ধীরাজ আচমকা টের পায়, তার দুই চোখ দিয়ে অবিরল জল গড়াচ্ছে। গলায় কীসের একটা প্রকাণ্ড ঢেলা যেন আটকে আছে—কষ্ট হচ্ছে ঢোঁক গিলতে। কে যেন মুছিয়ে দিল তার চোখের প্রান্ত।

সাগর মৃদুস্বরে বলে, আর চিন্তা নেই মাসিমা।
অমিত বলে, হ্যাঁ, ধীরাজ ঠিক হয়ে যাবে।

অনেক কষ্টে ধীরাজ শব্দ ফুটিয়ে তোলে গোঙানির মতন…কেন, কী হয়েছে আমার?

অমিত করুণ চোখ নিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। বলে, ইশ‌্ আমরা না থাকলে, কী যে হত! হঠাৎ কথা নেই বার্তা নেই, দুম করে পড়ে গেলি রাস্তায়।

সাগর মাঝপথে তাকে থামিয়ে দেয়। চুপ কর, ভাই। ওর সঙ্গে আর কথা বলার দরকার নেই। ধীরাজকে বলে, তুই ঘুমো এখন।

মায়ের বিষণ্ণ মুখ দেখে বড় কষ্ট হয় ধীরাজের। ইচ্ছে হয়, মায়ের চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলে, এই তো মা, লক্ষ্মী মা আমার, কেঁদো না—আমি ভালো আছি। কিন্তু কিছুই করা হয় না। তার হাত পা, পুরো শরীর কাটাগাছের মতন নেতিয়ে পড়েছে। দু-চোখের পাতা আবার বুঁজে আসে।

ধীরাজের সমস্ত মাথা জুড়ে থাকে, চলমান মোটরবাইকের শব্দ। অজস্র জোনাকি পোকা হলদে আলো নিয়ে উড়ে নেভে জ্বলে। অনেক পুরোনো কথা ভিড় করে মাথার ভেতরে। লখনউয়ের ইমামবাড়া ভুলভুলাইয়ার স্মৃতি জেগে ওঠে। সেই বিরাট চত্বরে আশিক, ইকবাল, প্রদীপ, সমীরের সঙ্গে হুটোপুটি আর হুলস্থুল মজা! ওরা সব এখন কেমন আছে?

চারদিকে কথার, স্মৃতির বুদ‌্‌বুদ। চারদিকে মিত্রা। চারদিকে ভুলভুলাইয়া। রক্তবাহী ধমনীতে নিশ্চয় তার এই মুহূর্তে তরল কুয়াশা বয়ে যাচ্ছে। আহ্! ছেলেবেলার মতোই কেউ শোনাচ্ছে, ঘুমপাড়ানি গান। বেহালার ছড় বহুদিন বাদে স্বয়ংক্রিয় হয়ে অতলান্ত সুরের মায়া বিছিয়ে দিচ্ছে। মীড়ে গমকে থরথর কাঁপে ধীরাজ। মিত্রার উচ্ছল হাসি শুনতে শুনতে হারিয়ে যায় সে নিবিড় অন্ধকারে।




প্রচ্ছদচিত্র সৌজন্য: www.pinterest.com