গড়পড়তা বাঙালির মেদ কম থাকলে, উচ্চতা ছ’ফুটের দু-ইঞ্চি কম থাকলেও কিছু না, সঙ্গে ফ্রেঞ্চকাট আর বয়স ষাটোর্ধ্ব হলে তো কথাই নেই। এখন তো তাই হওয়ার কথা মানিক পালের বয়েস। পরিচয় ভুলিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। বড়াইল পাহাড়ের যেখানে টিলাজমির চা-বাগান সামনে, স্মৃতির ছড়ায় সকালের রুপোলি রোদের মায়াময় হাতছানি। স্বচ্ছ জলে পাহাড়ি কই আর উপল মাছ দেখা দিয়ে পালাচ্ছে। পাথুরে জলছড়ার পাশে গার্ডেন চেয়ারে একা বসে মুচকি হাসছেন অমিতাভ বচ্চন। চোখে রোদচশমার আদলে উপর-নীচে পাওয়ার গ্লাস। ডাক্তার লোহিয়া বলেছে, রেটিনায় সমস্যা আছে। এজ রিলেটেড। সমাধান নেই, তবে দুটো পরামর্শ দিয়েছে; এক পাকা পেঁপে খেতে বলেছে আর বলেছে সূর্যালোকে না বেরোতে। রোদ জলেই ঘুরতে হয় তাঁকে, তাই চশমার দোকানি বাপ্পার পরামর্শে এই আশ্চর্য কালো করা চশমা, রোদ দেখলেই কালো। তবে বেশ ভালোই চলছে এই সাদা কালোর খেলা, মেঘ আর রোদের মতো।

খেলাই তো!
লালি বলে, কড়া রোদে নাকি তাঁকে দারুণ লাগে। ঢাকা চোখের ইশারায় দারুণটা কী জানতে চেয়ে জবাব পায়নি, শুধু ঠোঁট কামড়েছে, ছড়ার জল ঝাপসা হয়েছে লালির চোখ বেয়ে।

এ লালি কিন্তু সে লালি নয়। অমিতাভ বচ্চনের মতো দেখতে মানিক পালও আর মানিক পাল নেই। সে অনেক বছর আগের কথা। অনুরাধা দত্তর স্টেডি বয়ফ্রেন্ড মানিক পাল, আইন কলেজের জিএস। মানিকের চোখটা একটু কেমন!
অনুরাধা বলে, লক্ষ্মীট্যাড়া।
বিপক্ষের বন্ধুরা বলে, লন্ডন লুকিং শিলচর টকিং।
লালি বলে, থাক না বাবা। একটু খুঁত না থাকলে ছেলেদের মানায় না। কোনো পেত্নির পাল্লায় পড়বে না।


লালি, রূপে অনুরাধার অনেক পিছনে। তবু কালোরঙের মেয়েটিকে খোঁচা না দিলে, যেমন ওর ব্রেকফাস্টের ডিম পাউরুটি হজম হয় না, তেমনি লালিও ছেড়ে কথা কয় না। লালি ঠোঁট কামড়ে ডায়াসে বক্তৃতারত মানিকের দিকে তাকিয়ে, খটাখটির বন্ধু অনুরাধাকে বলে,
—ট্যাড়া চোখ আমার দিকে পড়লে ধরতেও পারবি না কোনোদিন।
অনুরাধা কোমরে শাড়ির আঁচল গোঁজে আর চোখ পাকিয়ে বলে,
—পড়ুক না দেখি। সোজা চোখও ট্যাড়া করে দেবো।
মানিকের দিকে অনেকের চোখ, তবু লালি গায়ে মাখে। বলে,
—সেদিন যে দেবশ্রীকে মেডিকেলে ভর্তি করিয়ে এল সমাজসেবক, কিছু বললি না তো?
—জানি, আমাকে বলেছে দেবশ্রীর কথা। তোর কথাও বলেছে, ও সব বোঝে, তোদের ঝুলাঝুলি।
লালি বলে,
—ওর খুব সিম্পল মেয়ে পছন্দ, না রে? লিপস্টিক লাগানো মেয়েদের একদম লাইক করে না।
—আহারে, আমার সিম্পল কাপাডিয়া! আমি জানি, এসব ওর পাগলামি। তোদের মতো সো-কল‌্ড সিম্পল, দুঃখী, ন্যাকা ন্যাকা মেয়েদের দিকে কেন নজর, সর্বদা ছোঁকছোঁক? আসলে ও খুব উচ্চাকাঙ্ক্ষী। সহজে নাম করতে চায় তাই। ফ্রি-তে ট্যুইশানি করে ঘনিয়ালা বস্তির ছেলেমেয়েদের। পাবলিক ফিগার হওয়ার ট্রেনিং নেয়, সংখ্যালঘু পাড়ায় ফ্রি-কোচিং দিয়ে। কিছুদিন আগে বলছিল, একটা খোঁড়া মেয়েকে বিয়ে করবে। এই দেড় বছরের কলেজ জীবনে যে কত মেয়ের সঙ্গে বিয়ের সম্পর্ক ফাইনাল করেছে তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু বললেই হয় না, জোড়ি তো আর ধরায় ধূলায় তৈরি নয় না। তুই ওসব বুঝবি না, ছাড়।

লালি জানে, আকাশ থেকেও তৈরি হয়ে আসে না সম্পর্ক।

দেবশ্রীর পর, আলো নামের হাই পাওয়ার চশমা পাওয়া যায়—মন্দ না, দুটো চোখেরই ভিশন কম। বলল, এই তো মিলে গেছে। কলেজ ক্যান্টিনে ঘুগনি পাউরুটি খেয়ে সেলিব্রেট করল চারজনে। লালি অনুরাধা মানিক আর আলো। দু-দিন পর রিমঝিমের পরীক্ষার ফিস দিয়ে দিল, বইপত্রও কিনে দিল ইউনিয়ন ফান্ড থেকে। এবারও বলল, বিয়ে করবে। ওরা ভট্টাচার্য সে পাল, কেঁচে গেল।

লালি অনুরাধাকে বলে,
—তুই মেনে নিস, পাগলামি?
অনুরাধা বলে,
—হ্যাঁ, মেনে নিই। কারণ সে মানিক পাল। সে জিএস, সে বস।
—বস না হাতি। তুই টাকা দিয়ে কিনে রেখেছিস।
—তো?
—তো আর কী, তুইও আলো দেবশ্রী রিমঝিমের মতো, ওদের কমটা চোখে পড়ে। তোরটা পড়ে না, তোর বটুয়ার ওজন বেশি বলে।
—আমার বাবার টাকা আছে খরচা করি, দি ওকে। এত যে বড়লোকি দেখায়, যাকে তাকে পরীক্ষার ফিস দিয়ে দেয়, বই কিনে দেয়, চোখের ডাক্তার দেখায়, কার টাকায় জানিস?
—সে তোর টাকায় নয় জানি, ইউনিয়ন ফান্ড দেয়।
—ঘোড়ার ডিম, এবার বলবি ওর এগ‌্জাম ফিও ইউনিয়ন দেয়? সব অনুরাধা দত্তর বাপের টাকা। বুঝলি ?
—নেয় তোর টাকা?
—আলবাত নেয়।
—ফালতু বাত। স্টুডেন্টদের জন্য তোর কাছ থেকে নিতে পারে। নিজের ফিস নেবে না। তোর ভিক্ষে নিজের জন্য নেবে না।
—এত কনফিডেন্ট?
—হ্যাঁ। বিশ্বাসের জন্য আঠার মতো লেগে থাকতে হয় না। প্রেম প্রেম নাটক করতে হয় না। তুই ওকে বিয়ে করবি?
—সে দেখা যাবে।
—মানে?
—করব না কেন?
—বলেছিস?
—তুই কী রে! এত বলাবলির কী আছে? এ তো সবাই জানে। কী সব বোকা বোকা কথা বলিস। প্রেমের কিছু বুঝিস? তিন বছর কলেজে আছিস, এক পিসও তো গেঁথে উঠাতে পারলি না।
—আমাকে কে দেখবে বল? একে তো কালোবরণ, পদবীতে কেরকেট্টা। তার উপর পরিপাক গ্রন্থির বিপাকে ভুগি সারা বছর।
—দাঁড়া দাঁড়া, ঠিক এই জন্য…এই সোজা ব্যাপারটাকে জটিল করার অভ্যাসের জন্যই ছেলেগুলো তোকে ঘাঁটায় না। পরিপাক… ধুস!
—আবার মিথ্যে। চা-বাগানের কালো রঙের মেয়ের প্রেমে পড়ে সামাল দিতে পারবে, তোদের দত্ত দাশ পাল বংশ ?
—ভালো কথা বলেছিস। কিন্তু মানিকের তো এরকম সামাজিক সম্মানের ভয় নেই। তার উপর রোগশোকের মেয়েদের দিকে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়ার একটা বাতিকও আছে। তোর যেন কী রোগ বললি?
—পেটের রোগ। পিত্তকোষে পাথর।
—ও-কে, এবার পিকনিকে মানিকের সঙ্গে ফিটিং করে দেবো। দেখি, পারিস কিনা ধরে রাখতে?
—চ্যালেঞ্জ দিচ্ছিস?
—ইয়েস। পারবি না, মানিক আমার।
—এবারও কী পাতিছড়া চা বাগান? মতলিব স্যারের তত্ত্বাবধানে? আমি যেতে পারব না রে।
—চল না রে মেয়ে। চল চল, পিকনিক পর্যন্ত আমাদের ভাব। স্যার তো বলল, এবার ডলু না হয় হাতিছড়ায় ভেনু। চা-বাগান সংক্রান্ত কেসকামারি করে স্যার। যে বাগানই হোক খুব খাতির হবে। বিআরটিএফ-এর কম্যান্ডেন্ট তার বন্ধু, গাড়ি দেয় ফ্রি-তে।
—বাহ‌্! ফ্রি বাগান ফ্রি গাড়ি আর কী কী পাওয়া যায় মাগনা?
—তোর বিশ্বাস হচ্ছে না? মানিক এলে ভেরিফাই করে নিস।
—মতলিব স্যার কমিউনিস্ট পার্টি করে না?
—এবার তো শিলচর থেকে দাঁড়াবে শুনেছি।
—দাঁড়ালে জিতবে? কীরকম হিরো হিরো দেখতে, না রে? টাকার খেলাও খেলতে জানে। এত কম বয়সে লিডার, পাবলিক ফিগার।


ল কলেজের ভিজিটিং প্রফেসর, আবদুল মতলিব স্যার। শিলচরের নামকরা উকিল। চল্লিশের ভিতর বয়স, বিয়ে থা করেনি। সবজান্তা অনুরাধা এতেও একটা স্টোরি বানিয়েছে। বলেছে,
—কেস আছে। এক হিন্দু মেয়ে ছিল সহপাঠী। স্যার কথা দিয়েছিল, ধর্মান্তরিত হতে হবে না। ধর্ম না মানলেই হলো। মেয়েটিও রাজি হয়েছিল। বলেছিল, ধর্ম নিজের নিজের। ঘর সংসার নিজেদের। শেষ পর্যন্ত একটা খটকার নিরসন করতে না পেরে সরে যায়। সন্তানের ধর্ম কী হবে? স্যার বলেছিল ধর্ম লিখব না আমরা। আর নাম? স্যারের চিন্তা স্বচ্ছ। বলেছিল, বাংলা নাম রাখবে। মেয়েটি বলেছে, ওখানেও পুরুষতান্ত্রিক হয়ে যায় সবাই। জব্বার মুদস‌্সর, নাজিয়া পারভিন, সারা সোহা—এসবই রাখবে শেষ পর্যন্ত। স্যারকে বলেছিল, হিন্দু হয়ে যেতে। স্যার তো রাজি। বলল, হিন্দুধর্ম রাজি হবে না, তোমাদের মজহবে ধর্মান্তরণ নেই। তারপর কাট্টি। রূপা ম্যাডাম কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ের এক সহ-শিক্ষককে বিয়ে করে চলে যায় তিনসুকিয়া।

তবে, অনুরাধার স্থির বিশ্বাস মতলিব স্যার একটু মেয়ে-ঘেঁষা পাবলিক। বলেছিল,
—ওসব বিয়ে না করার বাহানা। প্রতিজ্ঞা টতিজ্ঞা কথার কথা। ওদের ওসব হয় না।
লালি প্রশ্ন করেছিল,
—কী হয় না?
—এই বিয়ে না করা।
—তুই দেখি, সব জানিস?
—জানি তো!
—কী জানিস? ওদের কী হয় না?
—ওরা খুব ইয়ে।
—আর তোর বুঝি ইয়ে নেই? এত মানিক মানিক করিস কীসের জন্য? জানি না তোর মতলব?
—কী মতলব?
—বডিগার্ড চাই নাইট কলেজে। তারপর এলএলবি পাশ করে, ইয়ে দেখে উড়ে যাবি। তখন কোথায় থাকবে বস?
—তবে যাই বলিস, মতলিব স্যার কিন্তু হেভি ইয়ে!
—বিয়ে করে নে।
—করব?
—মানিকের কী হবে রে মুখপুড়ি?
—আমাকে দিয়ে দিবি বললি না।
—যা দিয়ে দিলাম। শুধু বল পিকনিকে যাবি? খুব মজা হবে দোস্ত।


পিকনিকে যাওয়া নিয়ে সমস্যা আছে লালির। প্রথমত, চাঁদা দেওয়ার মতো সামর্থ্য নেই তার। যদিও পঞ্চাশ টাকা চাঁদায় মাত্র ত্রিশ দিতে হবে। বাকিটা স্টুডেন্টস ফান্ড থেকে দেওয়া হয়। সিক্সটি ফরটি। অনুরাধা জানে সব, তবু সাহস করে বলতে পারে না—সে দিয়ে দেবে। লালির ব্যক্তিত্বকে ভয় পায়। অনুরাধা বন্ধুত্বের এই ন্যূনতম শর্তটুকু পালন করে। তবে এবার একটু জোর করার কারণ আছে। লালি দু-দুটো টিউশানি ধরেছে জানিগঞ্জে। লালিরও যেতে ইচ্ছে করে, একদিন একটু ফুর্তি করতে মন চায়। এবার যাবে বলেই, তিন মাস টাকা জমিয়েছে। কিন্তু মা যেতে দেবে না, বাবা তো না-ই। শুনলেই তো হুলুস্থুল বাঁধিয়ে দেবে। যেন তাদের মেয়ে সায়রাবানু। তার উপর ইদানীং চা-বাগানগুলিতে নকশালি উৎপাত হচ্ছে খুব। গোলাগুলি চলে। যার জন্য মেয়েটাকে একা একা পড়তে পাঠাল শহরে। তবু একবার চেষ্টা করবে এবার। বাবাকে পটিয়ে ফেলবে। তাই নিমরাজি হয়ে বন্ধুকে বলে,
—মা যেতে দেবে না।
—মা’কে বলার কী দরকার?
—আমি মা’কে বলি।
—ঠিক আছে আমি বলব মাসিকে, রাজি করাব।
—তুই? তোকে দেখলে তো আরও না।
—আমি এত খারাপ?
—না গো সোনা মা, মা রাজি হয়ে যাবে। বাপু বিগড়ে যাবে। বড়লোকের মেয়ে দেখলে রেগে যায়।
—আমি যে বড়লোকের মেয়ে তোর বাবাকে কে বলবে?
—আমার বাপুকে বলতে হয় না। ইনকিলাব করে, দেখলেই চেনে।
—তাই? আমার কাছে আছে অন্য দাওয়াই।
—তোর আবার দাওয়াই?
—মানিক পাল।
—মানিক পাল কী করবে?
—পটাতে জানে। ধনী কিংবা নির্ধন অভিভাবককে। দেখিস, মাসি মেসো শেষ পর্যন্ত ওকেই গার্জেন করে পাঠিয়ে দেবে, তোকে চড়ুইভাতি খেতে।

পিকনিকে গিয়ে লালি ফেঁসে যায়। লালির নাম জড়িয়ে যায় মতলিব স্যারের সঙ্গে। লালি ছাড়া সবাই জানে, এর পিছনে অনুরাধার বুদ্ধি কাজ করেছে। পুরোটাই চক্রান্ত। নইলে, যে প্রাণের বন্ধুকে পিকনিকে শামিল করার জন্য এত পাঁয়তারা। সেই লালিই উধাও হয়ে গেল, স্পটে পৌঁছতে না পৌঁছতে। একা একা বেরিয়ে গেল, মতলিব স্যারের সঙ্গে গ্রামের ভিতর জঙ্গলে! দুপুরে খাওয়ার সময়ও দেখা নেই। সে এক কাণ্ড! সবাই খুঁজে বেড়াচ্ছে স্যারকে, লালিকে। স্যারের উদ্যোগেই তো মূলত এই বনভোজনের আয়োজন। তাই কেউ খায় না। সবাই মিলে খুঁজতে যাওয়া হবে স্থির হয়। সেই সিদ্ধান্তও পরিত্যক্ত হয়। ঠিক হয়, খেয়েদেয়ে খোঁজা হবে। সহপাঠীরা লালিকে নিয়ে হাসি-মশকরা করে। অনুরাধা চুপ করে থাকে। কিন্তু চোখে মুখে চাতুর্যের দীপ্তি বিরাজ করে।

মতলিব স্যার ফেরেন, সূর্য ডুবে যাওয়ার সন্ধি সময়ে। লালিও টলটলায়মান মাথা নুইয়ে। সীমান্ত পথ বানানোর সেনা কম্যান্ডেন্ট মতলিব স্যারকে সুস্থ শরীরে ফিরতে দেখে কাছে যান হাসিমুখে। কানে কানে কিছু বলেন, নাকি গন্ধ শোঁকেন? লালি মতলিব স্যারের হাত ছেড়ে দিতেই, অনুরাধা এসে দখল নেয় বান্ধবীর।

ইতিমধ্যে কুর্গ দেশের মাথাই স্যার তার বাহিনিকে কাজে লাগিয়ে দিয়েছেন আর এক প্রস্থ রান্নার আয়োজনে। ক্যাম্প ফায়ারে আবার মাছ মাংস ভাজাভুজি। মতলিব স্যার আর মাথাই তখন পূর্ণ উদ্যমে আগুন জ্বালানোর জন্য প্রস্তুত। বিশাল কাঠের গুঁড়ি দুটো আর শুকনো পাতায় আগুন জ্বলে দাউদাউ। যেন কিছুই ঘটেনি।

সবাই যখন মতলিব স্যার আর লালির অনুপস্থিতি নিয়ে ভাবছে—সে সময়ে আরও কয়েকজন ছাত্রও যে গরহাজির—সে চিন্তা শুধু অনুরাধার মনে। সে কিছু বলার আগেই লালি হুল্লোড় বাঁধিয়ে দেয়। ফিরে এসে মানিক পালকে না দেখে, সবার সামনে অনুরাধার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। বলে,
—তুই কেমন লাভার রে মেয়ে? একটা ব্যাটাছেলেকে আটকে রাখতে পারিস না। আমার গার্জেনটা যে কোথায় হারিয়ে গেল!
অনুরাধা মুচকি হাসিতে জবাব দেয়,
—আমি তো ভাবছি মানিক তোর সঙ্গেই আছে, সেদিন কথা হলো না!
—অ্যাই, ঝুট বলবি না অনু, তুই সব জানিস। গাড়ি পিকনিক স্পটে পৌঁছাবার আগেই মানিক চারটে মুরগির গলা ছিঁড়ে জঙ্গলে ছুঁড়ে দেয়। পিকলু শিবু আর চয়নকে নিয়ে ধুপধাপ নেমে পড়ে তোর দিকে ঈশারাও ছুঁড়ে দেয়। অন্য মতলব না থাকলে, তুইও চলে যেতি ওদের সঙ্গে।
—গড প্রমিস। আমি জানি না কিছু। মুরগিগুলো দিয়ে যে আলাদা কিছু একটা করবে জানতাম। বাগানের লোকজন জোগাড় করে অন্য একটা ছোট মোচ্ছব হয় প্রতিবার।
—বেশ! এবার ভাবলি অন্যরকম হোক। মতলিব স্যার মাথাই স্যারের সঙ্গে আলাদা করে পার্টি করবি বড়লোকের বেটি। সে গুড়েও বালি পড়ল।
—বালি কোথায়? আমিই তো মতলিব স্যারকে বললাম তোর কথা। বললাম, লালির সঙ্গে যান, ও বাগানের মেয়ে।
—বাহ‌্! তুই এত জানিস? জানিস না, আমার বাবা এ বাগানের সর্দার?

অনুরাধা, লালিকে ভাবে তার হাতের পুতুল। ও সর্দারনি, যা বলবে তেমনই হবে। লালি পিকনিকে যাবে মানে যাবে। মানিককে দিয়ে তার মা বাবাকে রাজি করাতেই হবে। দত্তর বেটির মানিক ম্যাজিক যে কাজে দেয়নি, সে তো আর জানে না অনুরাধা। মানিক পাল চা-বাগানের সর্দার এর সামনে দাঁড়াতেই, পত্রপাঠ না করে দেয়। বলে, যাবে না তার মেয়ে। লালির খুব হাসি পায়। বেচারা, ব্যর্থ মনোরথ মানিক পালের মুখ দেখে। লালি ওকে বাগান ঘুরে দেখায় সারাদিন। পাহাড়ি নদী জাটিঙ্গার দু-পারে চা-বাগানের সৌন্দর্য দেখে অভিভূত হয়। বলে,
—এই বাগানে করা যায় না পিকনিক?
—আমাদের বাগানে এখন আর পিকনিক পার্টি আসে না।
—কেন? এত সুন্দর! আমার তো ইচ্ছে এখানেই কাটিয়ে দিই সারা জীবন।
—শীতকাল ছাড়া বড় কষ্টের জীবন।
—শহরের মানুষ, কষ্ট করিনি কখনও। না হয় করলাম।
—এখানে নকশাল পার্টির ডেরা। পুলিশের গুলি খেয়ে মরে, মারেও।
—আমিও মরব। থাকব এখানে, থাকতে দেবে?
—বাগান কাউকে ফেরায় না।
—তোমার বাবা যে না করে দিল।

—ও বাবা। আমি পিকনিকে যাব।


মতলিব স্যার হারিয়ে যাওয়ায় একটা উত্তেজনা ছিল। সবাই ভাবছিল, নকশাল ধরে নিয়ে গেছে। মাথাই স্যার ফোর্স আনিয়ে নেওয়ার কথা ভাবছিলেন। আসলে, পিকনিকটাই জমিয়ে দেয় অনুপস্থিত মতলিব স্যার। একা বোকা অনুরাধার প্ল্যান মতো কিছুই হয় না। তাই লালি ফিরে আসতে ওকে জড়িয়ে ধরে খামচাখামচি করে। বলে,
—তুই হাড়িয়া খেয়েছিস?
—হ্যাঁ, খেয়েছি।
—মতলিব উকিল খেয়েছে? টলছিল।
—খেয়েছে। শ্রমিকরা খায়, ওদের সঙ্গে মিশতে হলে খেতে হয়।
—তোরা গেছিস ডিপ ফরেস্ট?
—হ্যাঁ, গভীর জঙ্গল। মতলিব স্যারকে দেখিয়ে আনলাম শ্রমিকের কষ্ট।
—কষ্ট দেখতে মদ খেতে হবে?
—মদ না, হাড়িয়া। আমি খুব খুশি। স্যার এসে থাকবেন বলেছেন।
—হাড়িয়া খেতে?
—খাবেন। ওদের অবস্থা জানতে আসবেন। স্যার তো জননেতা। আমিও চলে আসব।
—থাকবি একসাথে?
—থাকব। তাতে কী হয়েছে? আমাদের সমাজ অন্যরকম।
—আর মানিক পাল?

নিজের নাম শুনে, মানিক পালও এসে শোনায়, শ্রমিকের দুঃখ-দুর্দশার সাতকাহন। অনুরাধাকে বলে, সে বাগানেই থেকে যাবে। বাগানের মেয়েকে বিয়ে করবে। চা-পাতার টুকরি পিঠে নিয়ে, দুটি পাতা একটি কুঁড়ি ছেঁড়া হাতের সুন্দরকে সে দেখবে প্রতিদিন। সিম্পল লাইফ। খুদকুঁড়ো যা হবে, তাই খাবে।

অনুরাধা হাসে। লালি ক্যাম্প ফায়ারের আলোয় দেখে, লাল হতে হতে জমাট রক্তে কালো হচ্ছে অনুরাধার গাল। ফিসফিসিয়ে লালির কাছে বসা মানিককে বলে,
—ঠ্যাং খোঁড়া করে দেবো। সরে আয় কামিনটার কাছ থেকে।

লালি খুব হাসে। হাসতে হাসতে অনুরাধাকে জড়িয়ে ধরে, হয়তো শোঁকে। কিছুই ধরতে পারে না। তাই হাসতে হাসতে বন্ধুকে বলে,
—অনুরে, মেয়ে। দুঃখ করিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে। মানিক পালও দু-পাত্র খেয়েছে। রাগ করিস না। আমিও চড়িয়েছি। তবে এটা ঠিক, মানিক পাল গ্রামের মেয়েকেই বিয়ে করছে। গ্রাম মানে চা-বাগান। চা-বাগান মানে ভজন সর্দার, আমার বাপ। আর সর্দারের বিটি লালি কেরকেট্টার সঙ্গে শাদি হবে মানিক পালের। তুই আসবি কিন্তুক।


মতলিব স্যার পারেনি। চা-বাগানে ফিরে আসেনি। অজুহাত দিয়েছে, কোর্টে অনেক কেস জমে গেছে। মিথ্যা মামলায় অনেক কমরেডকে জেলে ঢুকিয়ে দিয়েছে সরকার। পার্টির নির্দেশে ওদের আইনি সহায়তা দিতে হবে। তবে অনুরাধাকে অবাক করে মানিক পাল কিন্তু চলে যায় চা-বাগানে, শ্রমিকদের সঙ্গে থাকতে। উকিল হওয়া আর হয়নি। ফাইনাল পরীক্ষার ফিসই জমা দেয়নি। স্কুল-মাস্টারনি লালির আয়ে চলেছে সংসার। অনুরাধা যথারীতি ল পাশ করে কালো কোট চড়িয়েছে ক’দিন। তারপর, ভালো ঘরে-বরে গাড়িতে বাড়িতে বিয়ে করে চলে গেছে। বছর দুয়েক পর গভীর জঙ্গলে পুলিশ গুলি করে মারে মানিককে। তখন এসব খবর ছাপার কোনো দৈনিক ছিল না জেলায়। তাই কেউ জানতে পারেনি কিছু।


অনেক অনেক বছর পর অচেনা বিদেশী নম্বর থেকে অনুরাধা ফোন করে লালিকে। বলে,
—অনেক কষ্ট করে তোর নম্বরটা পেয়েছি। দিবি মানিককে?
—কেন? এতদিন পর আবার মানিক কেন?
—কাজ আছে, দে না।
—কেন, দেশে ফিরেছিস? আবার বডিগার্ড রাখবি?
—না রে, আমার বর ইন্ডিয়া গেছে, শিলচরেও যাবে। চা-বাগান দেখেনি তো কোনোদিন। খুব ইন্টারেস্ট। মানিক পালও তো বাগানেই থাকে শুনেছি।
—আমিও থাকি।
—গুড। মানিককে বলে একটা বাংলো-টাংলো ব্যবস্থা করে দিতে পারিস?
—মানিক পাল এখন আর বাগানে থাকে না রে দোস্ত। আসাম সরকারের মন্ত্রী তো দিসপুরে থাকে। ফোন নাম্বার দেবো?


হাতিছড়া কালোমণি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক মনোরঞ্জন পাল কেরকেট্টা তার মায়ের এসব রসিকতায় সায় দেয় না। বাধাও দেয় না। মায়ের হাত থেকে বাবার রোদচশমা নিয়ে পোজ দেয় ছেলে।
মাতা-পুত্রের মলিন হাসিতে থাকে, এক বিষণ্ণ শূন্যতা।




প্রচ্ছদচিত্র সৌজন্য: www.needpix.com