সাহিত্যের পরিমণ্ডলে ছন্দ একটি অতি পরিচিত এবং চর্চিত পরিভাষা। সাহিত্যের পরিমণ্ডলে বললে অবশ্য ছন্দের চলাচলের জায়গাটা অনেক ব্যাপক অর্থে বোঝায়। বরং বলা ভালো সাহিত্যে কাব্যে-কবিতার পরিসরেই ছন্দের সিংহাসনটি পাকাপাকিভাবে বসানো। বহু আলোচনায় অংশ নিয়ে দেখবেন—ছন্দের অবস্থান বলতে মূলত কবিতার কথাই উঠে আসে। এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাহিত্য-বিষয়ক পাঠ্যক্রমে (সে বাংলাই হোক বা ইংরাজি) ছন্দ সংক্রান্ত যে ইউনিট-টি থাকে, সেখানেও ছন্দ-বিশ্লেষণের আধার কবিতাকেই ধরে নেওয়া হয়। ছন্দের মাপ, মাত্রা, প্রস্বর, যতি, পর্ব, পদ—সবকিছুর ব্যাখ্যা চলে কবিতার পঙ্‌ক্তির আঙ্গিকে। বাংলা ছন্দের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখতে পাবেন মধ্যযুগীয় কাব্য থেকে ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত ছন্দবন্ধের যে পরিচয় পাওয়া যায়, তা মূলত মিত্রাক্ষর। মিত্রাক্ষরের সর্বব্যাপী দখলদারিটা একটু ক্ষুণ্ণ হলো যখন ১৮৬০ সালে ‘তিলোত্তমাসম্ভব’ কাব্যে মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রথম অমিত্রাক্ষর পয়ার ব্যবহার করেন। সেই থেকে অন্তমিলের ছন্দবাঁধনের পাশাপাশি প্রবহমানতার পথে ঝুঁকতে শুরু করল কাব্য-কবিতার ধারা।

এই প্রবহমানতার আরেক নামকরণ হলো রবীন্দ্রনাথের হাতে। বেড়াভাঙা পয়ার। যার অপর নাম মুক্তক। ‘বলাকা’ কাব্যে আমরা মুক্তকের নমুনা পাই। অমিত্রাক্ষরের সঙ্গেই পা মিলিয়ে বাংলা কবিতায় স্থান পেল গদ্যছন্দ। ধারাবাহিকতা বজায় রাখা এর মূল বৈশিষ্ট্য। চরণদৈর্ঘ্য অর্থানুযায়ী স্বাধীন। গদ্যছন্দের মাধ্যমে কবিতার আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা ছন্দের মুক্তি ঘটানো হয়। কিন্তু সবটাই কবিতার চেহারাকে কেন্দ্র করে। আধুনিক কালে কবিদের কলমে গদ্যছন্দের আদর বেশি চোখে পড়ে। কিন্তু তবুও সে তো কবিতা-ই। আমার প্রশ্ন কবিতার ছন্দকে ঘিরে নয়। কবিতা তো একটি আয়োজন। ভাবনার পূর্বনির্ধারিত আত্মপ্রকাশ। তা সে ভাবনা পরিপাটিই হোক বা এলোমেলো। আমি চোখ রাখছি মুখের ভাষা, অর্থাৎ স্বতঃস্ফূর্ত কথা বলার জন্য যে ভাষা, সেই ভাষার ছন্দের দিকে। মানুষের সঙ্গে মানুষের যে যোগাযোগ, মানুষের সঙ্গে পার্থিব ঘটনার যে যোগাযোগ, তার প্রকাশের মাধ্যম যদি ভাষা হয়, তবে সেই ভাষার চলনকে নির্ধারণ করার কারিগর অবশ্যই ছন্দ। অথচ সেই ছন্দের কথা আমরা চিরাচরিত ছন্দের আলোচনায় ধর্তব্যের মধ্যেই ধরি না। কিন্তু ভেবে দেখেছেন কী, আপনি আপনার বাচ্চার বোর্ডের অত্যন্ত ভালো রেজাল্টের খবর শুনে যে শব্দ বা শব্দগুচ্ছের ব্যবহার করেন, যে স্বরভঙ্গিমায়, ধরা যাক—‘ওমা! কী বলছো কী! সাংঘাতিক ব্যাপার তো!’—ঠিক একই শব্দগুচ্ছ আপনি ব্যবহার করতেই পারেন, অফিসে বসে আপনার বাচ্চার স্কুলে পড়ে গিয়ে চোট লাগার খবর পেয়ে, কিন্তু দুটো ভাষিক অবয়বের ছান্দিক গঠন কি এক হতে পারে? বা এক হলে আপনি মানসিক ভাবে সুস্থ বলে ধরে নেবে আপনার বাড়ির লোক? আমাদের দৈনিক ভাষার যাপনে ছন্দের কারুকাজ যে কতটা সূক্ষ্ম এবং তাৎপর্যপূর্ণ, সেটা বইয়ের পাতার ছন্দ বিশ্লেষণের অনুচ্ছেদে জায়গা পায়নি ঠিকই, কিন্তু আমরা একটা কথোপকথন চালাতেই পারি মুখের ভাষার ছন্দের গতিপ্রকৃতি নিয়ে, আমাদের ঘরোয়া মেজাজে।

আগে বোঝা দরকার এই ‘আটপৌরে কথোপকথন’টা আসলে ঠিক কী? আটপৌরে কথোপকথনের সংজ্ঞা কী? এক্কেবারে সহজ করে বলা যায় আমি/আপনি প্রতিদিন প্রতিনিয়ত আমার/আপনার ভাষা দিয়ে প্রয়োজনের (প্রয়োজন অর্থে প্রয়োজন-ই বুঝবেন। আপনি যে ভাবছেন প্রয়োজন ছাড়াও তো মানুষ কথা বলে, আমি সেই প্রয়োজনের কথা এখানে বলছি না। আমি বলছি অপ্রয়োজনীয় কথাও মানুষ প্রয়োজনের তাগিদেই বলে) তাগিদে যে অসংখ্য সংলাপ গড়ে তুলি, তাই আসলে আটপৌরে কথোপকথন। আবার ধরে নেওয়া হয়, মানুষের মুখের ভাষা স্বাভাবিক। অর্থাৎ এই আটপৌরে কথোপকথন স্বাভাবিক। ‘স্বাভাবিক’ শব্দটি দু-ভাবে নেওয়া যায়। প্রথমত—জৈবিক ভাবে, ভাষা হলো মানবশরীরের একটি স্বাভাবিক জৈবিক ক্রিয়া। দ্বিতীয়ত—সাংস্কৃতিক ভাবে, ভাষা ব্যবহারের স্বাভাবিক ভঙ্গিমা। ‘সাংস্কৃতিক’ এবং ‘স্বাভাবিক’ দুটি শব্দ তো সহাবস্থান করতে পারে না। কিন্তু আমরা সেটাই করি। সাংস্কৃতিক অভিরুচি প্রয়োগ করেই ভাষার ব্যবহারে ‘স্বাভাবিক’ এবং ‘অস্বাভাবিক’ মাত্রা টেনে দিই। ‘ওর কথাবার্তা আজ ঠিক স্বাভাবিক লাগল না’ বা ‘ওর কথাবার্তার ধরনটা কেমন যেন অস্বাভাবিক ঠেকল’—এই জাতীয় নমুনাগুলো তো আমাদের খুব চেনা। এখানে এই ‘অস্বাভাবিক’ ব্যাপারটা বক্তা এবং বক্তার উদ্দিষ্ট ব্যক্তির কাছে ভাষা-সম্পর্কিত। কিংবা ধরুন পাড়ায় কোথাও গণ্ডগোল বেঁধেছে বা পাশের বাড়ির কোনো গোলযোগ—আপনি প্রথম বুঝতে পারেন উচ্চৈঃস্বরের কোলাহল শুনে। যা কিনা আপনার পরিচিত ভাষিক ব্যবহারের স্বাভাবিক ধরন থেকে বিচ্যুত।


নমুনা-১

পাড়ায় গণ্ডগোলের নমুনা দেওয়াটা খানিক গোলমেলেই হবে। কারণ দূর থেকে ভেসে আসা অগুন্তি উচ্চ কণ্ঠস্বরের বয়ান শুনে অনুমান করা যেতে পারে সেটা কোলাহল কিন্তু সেই বয়ান থেকে শব্দ ছেঁকে বের করা কঠিন।

ক: অতই যখন শখ তো নিজে রেঁধে খেলেই পারো। রোজ রোজ এত খুঁত ধরতে হয় না।

খ: করো তো ওইটুকু রান্না। তাতেও নুন কম। ঝাল বেশি। বাজারের পয়সাগুলোই জলে যায়। ধুত্তোর…যত্তসব।

ক: হ্যাঁ। ওইটুকু রান্না। কোটা-বাটা-ধোয়ায় তো কোনো পরিশ্রম নেই। গা-গতর নাড়িয়ে রান্নাটা তো ছেলেখেলা। এক-আধদিন পান থেকে চুন খসল তো, বাবুর মেজাজের শেষ নেই।

খ: হু্হ। ফালতু কথা ছাড়ো তো। এক-আধ দিন দেখাচ্ছে। বাতিকের ঠেলায় রান্নার লোকও রাখবে না। রোজ রোজ এই অখাদ্যগুলো গিলতে হবে। কপালটাই শালা খারাপ।

কিন্তু এই যে দুজনের ভেতর গণ্ডগোল বাঁধল, সেখানে কিন্তু একটা বিশেষ পরিস্থিতি আছে এবং সেই পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে তো ভাষার এই ব্যবহারটাই স্বাভাবিক। চূড়ান্ত মানসিক অস্থিরতার দ্বান্দ্বিক প্রকাশ তো আর রোমান্সের স্বরে হবে না।

তাহলে কি আমরা ধরে নেব যে দৈনিক কথোপকথনে স্বাভাবিক এবং বিচ্যুত—দুটি ভিন্ন ধরনের ছন্দ কাজ করে। স্বাভাবিক অর্থে যেটা চলনসই—বিশেষভাবে চোখে পড়ার মতো নয়। ধরুন কোনো কলেজের স্টাফরুমে কথাবার্তা চলছে, যেমন চলে। এই যে ‘যেমন চলে’ বললাম, এটাও কিন্তু আমাদের ওই সাংস্কৃতিক অভ্যাসের একটা নমুনা। এই ‘যেমন চলে’-টাই স্বাভাবিক বলে ধরে নিই আমরা। যাই হোক, স্টাফরুমে ফিরে আসি।


নমুনা-২

স্টাফরুমে অনেক টিচার। সবাই দুই-তিন-চার-পাঁচ দলে ভাগ হয়ে হয়ে কথোপকথন চালাচ্ছে নিজেদের মতো। হঠাৎ একজন চেঁচিয়ে উঠল—অনেকদিন, অনেকদিন ধরে দেখছি, ডিপার্টমেন্টের ছেলেমেয়েদের আপনিই উসকাচ্ছেন। ওরা আমার ক্লাস করতেই চায় না। আপনার ক্লাসে তো ঘরভরতি থাকে।—আরেকজন শান্ত গলায় জবাব দিল—সেটা আপনার সমস্যা। আমার নয়। ছেলেমেয়ে উসকাতে আমি ক্লাসে যাই না।—অপর জন আবার চেঁচাল—আলবাত যান। সেটা আমি খুব ভালো করেই জানি।…

বাকি সকলের নজর গিয়ে পড়ল এই সংলাপে। সংলাপের শব্দের প্রতি যতটা কৌতূহল মানুষের, ততটাই নজর দুই-ব্যক্তির স্বরভঙ্গিমার উপর। এবং এই বিশেষ ছান্দিক বৈশিষ্ট্যেই তাঁদের সংলাপ আলাদা হয়ে যায় বাকিদের থেকে। এখানেও দেখবেন ওই যে দুটো ‘অনেকদিন’ শব্দ দু-বার ব্যবহার করা হয়েছে, তাদের উচ্চারণগত প্রভেদ রয়েছে। প্রথমটা ‘অনেকদিন’, পরেরটা ‘অনেএএকদিইইন’ লিখিত অবস্থায় তাদের একরকম দেখতে লাগলেও উচ্চারণের তারতম্য রয়েছে। আর সেই তারতম্যের ভিত্তিতেই বক্তার অভিপ্রায়ের চেহারাটা ধরা পড়ে শ্রোতার কাছে।

মানুষের আবেগ পরিস্থিতি সাপেক্ষ এবং উলটোটাও অর্থাৎ পরিস্থিতিও আবেগ সাপেক্ষ। আবেগ প্রকাশের ধরন অনুযায়ী ভাষার ব্যবহার পালটে যায় এ কথা তো নিশ্চিত। সেই ব্যবহারটা কী শুধুই শব্দবন্ধের ব্যবহার নাকি সেখানে ছন্দের চলনও একটা আবশ্যিক ব্যাপার, সেটা একটু খোলসা করে নেওয়া যাক। আবেগ যখন পরিস্থিতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, সেই পরিসরের একটা নমুনা দেখে নিই—ধরা যাক, দুই বন্ধুর (অবশ্যই খুব কাছের) দেখা হয়েছে বহু বছর বাদে। বিশ্ববিদ্যালয়ের রিইউনিয়ন প্রোগ্রামে। তাদের সম্ভাষণ, তাদের সংলাপ স্বাভাবিকভাবেই তুমুল উৎসাহে সংঘটিত হবে। সেই উৎসাহের ভাষা পরিচালনা করার প্রধান কলাকার ছন্দ।


নমুনা-৩

খবর কী বস্‌! কতদিন পর! উফ্‌ ভাবতেই পারছি না! (সঙ্গে ছাত্রজীবনের টুকটাক চেনা পরিচিত স্মৃতি হাতড়ানো একান্ত নিজস্ব শব্দ ইত্যাদি ইত্যাদি।)

ঠিক এই দুইজন মানুষের দেখা হলো বহুদিন পর, কোনো এক মাস্টারমশাই এর প্রয়াণ সংবাদে। তাদের সম্ভাষণ, তাদের সংলাপের শব্দবন্ধ পালটে তো যাবেই। যদি শব্দবন্ধ একও থাকে কোথাও কোথাও, তার ছন্দের চলন পালটাতে বাধ্য।


নমুনা-৪

কতদিন পর দেখা হোলো বল্! কিন্তু ভাবতেই পারছি না যে এমন দিনে দেখা হবে আমাদের!

‘নমুনা-৩’-এর ক্ষেত্রে যদি ‘কতদিন পর! উফ্‌ ভাবতেই পারছি না!’ শব্দগুচ্ছে কতোওওওদিইইইইন পর! উউউউউফ্‌ ভাআবতেই পারছি না। তবে ‘নমুনা-৪’-এর ক্ষেত্রে ‘কতদিন পর দেখা হলো বল্!’-এর ‘কতদিন’ অত্যন্ত ছোট্ট একটি ঝিমিয়ে পড়া ছন্দে বলা একটি শব্দ যার সঙ্গে জুড়ে থাকে পরিস্থিতির বিমর্ষতা।

এবার দেখি পরিস্থিতি কীভাবে আবেগ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, সর্বোপরি, সেখানে ভাষা এবং ছন্দের ভূমিকাটি ঠিক কেমন। একটা কথা এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, আবেগ অর্থে শুধু রাগ-দু:খ-সুখ-অভিমান ভেবে নেওয়া ঠিক হবে না, আমাদের মানসিক অবস্থার যে বাহ্যিক প্রকাশ তাকেই বলছি আবেগ। সুতরাং সেই প্রকাশ যে-কোনো আঙ্গিকেই ঘটতে পারে।


নমুনা-৫

সেদিন এক আত্মীয়া ফোন করেছিলেন। ওঁর বয়স্কা মা’কে নিয়ে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা বলছিলেন। এখন কোভিড পরিস্থিতি। বুঝতেই পারছেন ডাক্তারদের দম ফেলার সময় নেই। তায় আবার মফস্‌সল। শহর থেকে কোনোরকমে সপ্তাহে এক-আধদিন এসে চেম্বারে বসেন। প্রচুর রোগীর ভিড়। সময়ের মধ্যে এক চেম্বার গুটিয়ে আরেক চেম্বারে যাওয়ার তাড়া। তো সেই আত্মীয়া ফোনে যখন সেই বিবরণ দিলেন, আমি নিমেষে যেন সেই চেম্বারের অবস্থাটা মানসচক্ষে উপলব্ধি করতে পারলাম—“ভাবতে পারবি না তুই, সে যে কীইইই হড়হড় তড়তড় করে প্রেসক্রিপশনটা লিখে দিল। এই ওষুধটা লাগাবেন, এটা খাবেন। দু-বেলা। দেখি, দেখি হাত দেখি। এখানে ব্যথা? মায়ের হাত টেনে ঝট করে—ফসফস করে কী যে দেখল, তারপর বলল হয়ে গেছে। উফফফফ্‌। সে যে কীইইই তাড়া! ওইভাবে পেশেন্ট দেখলে হয়।” আমি সেই আত্মীয়াকে ফোনে বললাম—‘সে তোমার বলা শুনেই বুঝে গেছি।’—অর্থাৎ খেয়াল করে দেখুন, জাগতিক ঘটনাগুলির সঙ্গে মানুষ ভাব প্রকাশের জায়গাটাকে কীভাবে মিলিয়ে নিতে পারে। ছন্দও সেই বেগটা চালনা করে।


নমুনা-৬

ঠিক একইভাবে সকালে বাড়িতে যে মানুষটি খবরের কাগজ দিয়ে যায়, সে যাতায়াত করে সাইকেলে। এমন তাড়ায় থাকে তার সাইকেল, যে তার সঙ্গে যেটুকু কুশল-বিনিময় চলে, তাতেই তার ‘হ্যাঁ দিদি। ভালো। আপনি ভালো তো?’—এই শব্দগুচ্ছের বেগ তড়িদ্‌গতিতে ছোটে। এবং লক্ষ করলে দেখা যায়—শব্দগুলির গায়ে যে সুর লেগে থাকে, তাও কিন্তু আমাদের শান্ত অবস্থার সুরের চেয়ে আলাদা। উচ্চারণের মতো করে যদি লিখি, তাহলে আরও পরিষ্কার হবে ব্যাপারটা। হ্যাঁ দিদিইইই। ভালোওওও। আপনি ভালো তো? (আপনি ভালো তো-র প্রতিটি শব্দ অত্যন্ত দ্রুত বেগে চলে) কিন্তু একই শব্দগুচ্ছ আপনি কোনো বয়স্ক শিক্ষিকাকে বললে তার গতি অনেক ধীর হয়। সেখানেও ছন্দ-ই কিন্তু এই পার্থক্য নির্দেশ করে।

মানুষের মুখের ভাষার এত বিপুল বৈচিত্র্য এবং সেই ভাষার প্রকাশ এতটাই তাৎক্ষণিক যে তাকে মাপজোকের তাগিদে মুঠোবন্দি করা কষ্টসাধ্য কিন্তু অসম্ভব হয়তো নয়। আসলে মানুষ কথা বলে স্বতঃস্ফূর্ত ভঙ্গিতে। শিখিয়ে-পড়িয়ে, গুছিয়ে-সাজিয়ে কথা বলা হয় নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে। ক্লাসে পড়া মুখস্থ বলা, ভেবে-চিন্তে বক্তৃতা দেওয়া, মিটিং-এ প্রেজেন্টেশন দেওয়া, আদালতে সাক্ষি দেওয়া (সেখানেও জেরার মুখে পড়লে স্বতোবৃত্ত কথাই বেরিয়ে আসে), পূর্ব-পরিকল্পিত আলোচনায় অংশ নেওয়া—এইসব এলাকাগুলোয় কথার ছাঁদ তৈরি থাকে। কিন্তু বক্তা মাত্রেই বাচনের একটা স্বতন্ত্র ভঙ্গিমা থাকে। যাকে আইডিওলেক্ট বা নিভাষা বলা হয়। ফলত কথা যেভাবেই বলা হোক না কেন, স্বতঃস্ফূর্ত বা পরিকল্পিত, তার ছন্দ প্রকাশের ধরন নির্দিষ্ট করে দেওয়া যায় না।

প্রথমত ভাষা একটি পরাধীন চলরাশি। পরিস্থিতি যেমন ভাষার ছন্দের চলনের সঙ্গে অব্যবহিতভাবে যুক্ত, তেমনভাবেই আরও কিছু চলরাশি গুরুত্বপূর্ণভাবে ভাষার ছন্দকে নিয়ন্ত্রণ করে। বয়স তার মধ্যে একটা উপাদান। বয়সের কয়েকটা সাধারণ পর্যায় ধরে নিয়ে ছন্দের রূপের তফাতগুলো দেখা যাক।

শৈশবের অনভিজ্ঞতা এবং সারল্য কথার ছন্দের একটি নিয়ন্ত্রক। ওদের কথায় অদ্ভুত একটা গতি থাকে। ছন্দের চাঞ্চল্য থাকে। তুচ্ছাতিতুচ্ছ জিনিস সম্পর্কেই অপার কৌতূহল, বায়না যেন ছন্দের উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে। কিছু নমুনা দেখি।


নমুনা-৭

১. ও মা, মা! আমার কেন পাখির মতো ডানা নেই?

২. গনেশ ঠাকুরের মুখে ওরম শুঁড় কেন মা? ভুড়িটা কত্ত বড়ো! হি হি।

৩. যাই না একটু খেলতে! প্লিজ প্লিজ! একটু যাই।

৪. খাবো না এখন। নাআআআআ। কিছুতেই না।

৫. যা! আড়ি তোর সাথে।

৬. বাবা, ও বাবা! আমায় একটা কুকুর ছানা এনে দেবে? বলো না! দেবে?

কৈশোরে কথার ছন্দ আবার খানিকটা খরখরে। মানসিকতা এ বয়সে যেমন শৈশবের বাঁধন পেরিয়ে খানিকটা শৃঙ্খলযুক্ত, কথাবার্তার আবহেও যুক্তি-তর্কের মেজাজ চোখে পড়ে। সঙ্গে উচ্ছলতাও। ছোটো না-থাকা বড়ো না-হওয়া এই দুইয়ের মাঝখানে কৈশোরকাল যেমন কিছুটা বিভ্রান্ত, ছন্দের গতিপ্রকৃতিও তেমনই খানিকটা বিহ্বল। আবার একইসঙ্গে অভিভাবকের ছত্রছায়ায় থাকা নিশ্চিন্ত জীবনযাপনে ছন্দের সহজিয়া চালও লক্ষণীয়। কোথাও কোথাও কথাও ছন্দ গোপনীয়তা রক্ষার দায় নেয়।


নমুনা-৮

১. স্কুল থেকে তো সবাই যাচ্ছে। আমি গেলে কী হয়? ধুরররর্‌! তোমরা এত বেশি বেশি করো না!

২. বলেছি না আমায় কাঁটামাছ দেবে না! এখন এসব বেছে কে খাবে?

৩. এইই! ফোন রাখছি এখন। মা এসে গেছে মনে হচ্ছে।

৪. এবারের ম্যাগাজিনের কভার পেজটা দেখেছিস! উফফফফফফ্‌! ছবিটা শুধু দ্যাখ।

৫. আমার তো লিটারেচার নিয়ে পড়ার ইচ্ছা! কিন্তু মা-বাবা বলছে সায়েন্স নিতে!

৬. কাল ম্যাচটা শুধু ওভার-কনফিডেন্সের জন্য হারলো! ওইভাবে কেউ রান নেয় লাস্ট উইকেটে? বোগাস! ভাল্লাগে না।

যৌবনকালের ছন্দের গতি সাবলীল। সাবলম্বী। খোলামেলা কথনে ছন্দের গতিপ্রকৃতিও স্বাধীন-মনস্ক। কখনও সে জটিল। কখনও হালকা। কখনও চিন্তিত। কখনও প্রতিবাদী।


নমুনা-৯

১. ডিগ্রি তো বেড়েই চলেছে রে! চাকরি-বাকরির কী হবে এবার!

২. চল্! মার্চের শুরুতে, দোল-টোল পেরিয়ে গেলে এবার পুরুলিয়ার দিকটা ঘুরে আসি। তাঁবু খাটাবো কিন্তু জঙ্গলে!

৩. কর্তৃপক্ষ কি আমাদের মাথা কিনে নিয়েছে নাকি? কী ভেবেছেটা কী? এবার তো একটা হেস্তনেস্ত করতেই হয়!

৪. আমার ফিরতে রাত হবে। এডিটিং-এর কাজ আছে। খেয়ে নিও কিন্তু।

৫. ভাবছি লোনটা নিয়েইনি এবার বুঝলি! বাড়ির কাজটা না করলেই নয় এবার।

প্রৌঢ়ত্বের ভাষায় ছন্দ অনেক বেশি অভিজ্ঞ। খুঁতখুতে। কিছুটা সন্দিগ্ধও বটে।


নমুনা-১০

১. একটু ভেবেচিন্তে টাকাপয়সাগুলো খরচ করতে পারিস তো!

২. কী সব সিনেমা দেখিস আজকাল! সিনেমা ছিল আমাদের সময়ে! বাঘা বাঘা অভিনেতা সব।

৩. কী দিনকাল পড়ছে কে জানে! এক-একটা সাবজেক্টে এক-একটা মাস্টার! কী পড়াশোনা হয় কে জানে?

৪. আর কী! সামনের বছর রিটায়ারমেন্ট! হয়েই এল!

৫. অনেক ঠেলেছি রে এই সংসার! এতগুলো বছর ধরে তো কম করলাম না। সবাইকে চেনা হয়ে গেছে।

৬. বাচ্চা মানুষ করা অতো সহজ নয়। সারাদিন মোবাইল ঘাঁটলে বাচ্চার দিকে নজর থাকে?

বার্ধক্য যে ছন্দে কথা বলে, সে ছন্দের গতি অনেক ধীর। কখনও শান্ত। কখনও এলোমেলো। কখনও স্পষ্ট। খানিক অস্পষ্টও বটে।


নমুনা-১১

১.ভালো থাক। ভালো থাক। তোরা সবাই ভালো থাকলেই আমি ভালো থাকি।

২. চশমাটা কোথায় রাখলাম দ্যাখ দেখি!

৩. কে? কে এল? কার গলা? তোতন নাকি?

৪. দাদুভাই, শরীর আর মন দুটোকেই চাঙ্গা রাখতে হবে।

৫. সব কিছুই তো পালটে গেছে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে… এই বাড়িটাই কি আর আগের মতো আছে? কেমন গমগম করত সব। সব চলে গেল এক এক করে।

তবে খেয়াল রাখা প্রয়োজন যে নমুনাগুলো আমরা দেখলাম, সবগুলোই একটি নির্দিষ্ট মানদণ্ডের বিচারে পর্যবেক্ষিত। সব সময় যে একইরকম ছন্দে ছন্দ চলাফেরা করবে, তা কিন্তু নয়। শৈশবকালীন কথাবার্তায় শব্দ এবং ছন্দের ভাব-গম্ভীরতা লক্ষ করলে আমরা বলে থাকি ‘বাব্বা! পাকা বুড়ির মতো কথা!’ বা ‘এত পাকা পাকা কথা শিখলি কী করে?’ বা ‘কথা বলছে দ্যাখো, যেন আশি বছর বয়স!’—অর্থাৎ কোথাও যেন ছন্দের ছন্দবিচ্যুতি হয়। আবার বার্ধক্য কালীন ছন্দেও ছেলেমানুষির মেজাজ দেখতে পাওয়া বিরল কিছু নয়। যৌবনের ছন্দের সাবলীলতা বা কৈশোর কালের উচ্ছলতাও কারও কারও ক্ষেত্রে লাজুক ছন্দে ঢাকা পড়ে যায়।

প্রতিটি ব্যক্তিবিশেষে, বলা ভালো, প্রতিটি বক্তা বিশেষে, মুখের ভাষার ছন্দ বদলে যায়। একই কথা, একই উদ্দেশ্যে, একই পরিস্থিতিতে ভিন্ন ছন্দের ছাঁচে পড়ে যায়। এর পিছনে মানসিক গঠনটাও একটি ফ্যাক্টর। ধরুন—


নমুনা১২

‘ভালো লাগছে না।’—এই তিনটে শব্দ তথা একটা বাক্য। এই নমুনা নিয়েই বলা যাক। এখনকার বর্তমান পরিস্থিতির সাপেক্ষে এই তিনটি শব্দই বহুল ব্যবহৃত। কথায় কথায় একে অন্যকে বলে ফেলছি চেতনে-অবচেতনে। এই শব্দ তিনটির প্রকাশ ভিন্ন হয়ে যায় একই উদ্দেশ্যে, একই পরিস্থিতিতে। কোনো বন্ধুর প্রশ্নে বলে ফেললেন—ভালো লাগছে না। কখনও সেখানে বিরক্তির ভাব মিশে থাকল। বন্ধুর প্রতি নয়, সামগ্রিক পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রতি। কখনও মিশে থাকল আক্ষেপ। কখনও বা সমতল ধারায় শব্দগুচ্ছ উচ্চারিত হয়ে গেল। অথচ তিন রকম ধারায় শ্রোতার উপলব্ধি হলো ভিন্ন ভিন্ন।

তাহলে মোটামুটি কী দেখলাম? ছন্দ সংক্রান্ত তত্ত্বকথা আলোচনার ভরকেন্দ্র কাব্য-কবিতা হলেও ছন্দের চলন যে মুখের ভাষার আত্মপ্রকাশের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে থাকে, তার নমুনা কিছু দেখলাম। মানুষের উচ্চারণের যে ভিন্ন ভিন্ন ভঙ্গিমা, তার ভিত্তিতে শুধু বক্তার অভিপ্রায়-ই নয়, শ্রোতার উপলব্ধির জায়গাও বিশেষভাবে নির্ধারিত হয়। কোনো হাসপাতালে যদি কোনো বাড়ির মানুষ ভর্তি থাকে, তখন সেই বাড়ির সদস্যদের সংলাপে ধরা পড়ে চাপা উত্তেজনা ও চিন্তার প্রতিফলন। কোনো বাড়িতে কোনো সদস্য সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় পাশ করলে সেই সংলাপে থাকে খুশির মেজাজ। ছন্দ ব্যতিরেকে কোনো কথার আত্মপ্রকাশ সম্ভব নয়। এবং মানুষের সঙ্গে মানুষের বোঝাপড়া তৈরি হওয়ার জন্য ভাষিক উপাদানে ছন্দ শুধুমাত্র সহচর নয়, অত্যন্ত আবশ্যিক অভিযোজন।