১.
সেদিন হিঁদুদের দুগ্গা পুজোর মহাষ্টমী। আমার বৈধ বউ নিবিষ্ট মনে বেলুড় মঠের কুমারী পুজোর লাইভ টেলিকাস্ট দেখছিল টিভিতে। কী আর করবে! ওর ইচ্ছে ছিল অঞ্জলি দেবার। কিন্তু, বিগত বত্রিশ বছরে আমি, এক না-ধার্মিক ওর এইসব আচারে বাধা দিয়ে এসেছি। জোর করে কি? না, যুক্তিতক্কো সহকারে বুঝিয়ে এসেছি। এবার করোনার দৌলতে বেরোতে পারেনি, নইলে হয়তো চলে যেত অঞ্জলি দিতে।
আমি আমার পড়ার ঘরে—বসে বসে লিখছিলুম, ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে—না শুধু টাকাপয়সা নিয়ে নয়, বিধ্বস্ত নিসর্গের সঙ্গে জুড়ে ভাবতে হচ্ছিল আমাকে। অর্থনীতি (আমি কই ‘অর্থ-নেতি’[১]) আর নিসর্গনীতি[২] আমাকে ভাবায় খুব—আমি পাগলের মতো ভাবি, লিখি, ‘সাধ্যি’মতো কাজ করি। শিল্পবিপ্লব-উত্তর পরিবেশের সংকট আমাকে ভয়ার্ত করে তুলেছে।
হঠাৎ হো-অ্যাপে মেসেজ আসার টুংটাং শব্দ এল। অনেকক্ষণ কাজ করেছি। তাই হাঁফ নেবার জন্য সেল ফোনটা খুললুম। আমার ‘বৈধ’ বউ-এর কাছ থেকে এসেছে বার্তা। এই হয়—একই বাড়িতে থেকে মেসেজ করে কথা চালাচালি! সাধে কী আর প্রভুরা ‘ফিজিকাল ডিসটেন্সিং’-এর বদলে ‘সোশ্যাল ডিসটেন্সিং’-এর মতো পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট কথাটা এই করোনাকালে ব্যবহার করছে!
একটা সিগারেট ধরিয়ে নিসর্গকে আরও একটু কাহিল করলুম। কেন জানি মনে পড়ল, কালিদাসের একটা হেঁয়ালি: ‘ঘরের মধ্যে ঘর,/ তার মধ্যে থাকে কনে বর।’ ধাঁধার উত্তরটা ‘মশারি’ হলেও, ‘মশারির ক্ষমাহীন বিরুদ্ধতা’ আমার কাছে এক একটা ঘর হয়ে দাঁড়ায়—সত্য বা মিথ্যে ঘর…Malvina Reynolds-এর লেখা, পিট সিগার-এর গাওয়া গানটা[৩] মনে পড়ল: ‘Little boxes on the hillside’…। চালিয়ে দিলুম গানটা। শুনতে শুনতে মনে হল, এইইই এইরকম একই এবং এক একটা লিটল বক্স-এ আমরা বন্দি—কোনো লিটল বক্স আমাদের নির্মিত সত্যির ঘর অথবা মিথ্যের কিংবা কোনো অনির্ণেয় ঘর! জানি না![৪]
এসব ভাবতে ভাবতে আমি মেসেজটাই পড়তে ভুলে গেছিলুম। রামকৃষ্ণ মিশনের (এবার থেকে সং সেজে ক্ষিপ্ত হয়ে কইবো ’রাকৃমি’) কুমারী নারীর এই মাতৃরূপবন্দনায় সে মুগ্ধ, এটাই সে জানিয়েছে। তার খুব ‘মিষ্টি’ লাগছে ওই পুঁটলির ভেতর পুরে দেওয়া জড়ভরতবৎ নাবালিকা মেয়েটাকে—যে কিনা স্বসম্মতিতে নয় (নাবালিকার আবার সম্মতি, হুঁ!), বাপ-মায়ের সম্মতিতে একটা রিচ্যুয়ালে বসেছে।
এই প্রতিক্রিয়া ওর হবারই কথা, কেননা সমাজতত্ত্বে ডিগ্রি থাকা সত্ত্বেও সে তার ‘হিঁদু বামনী’ চিহ্নটা ছাড়তে পারেনি, ছাড়তে পারেনি পুংতান্ত্রিক সিঁদুর। যেমন, ছাড়তে পারেনি তার আপিসী কম্যুনিস্ট পার্টির ছাগু-মামারা—ছেরাদ্দ থেকে পৈতে ইত্যাদি ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ (হাসি পাচ্ছে) আচরণে তারা ওস্তাদ। নরম করে ধর্মীয় আচার-আচরণ যে কোথা থেকে কীভাবে ঢুকে পড়ে ব্যাপ্ত হয়ে যায় সাম্প্রদায়িক রাম-বামে, কে জানে!… আমাকে ব্যথিত করে এদের ব্যাপক হিপোক্রেসি!
নির্দিষ্ট সাইট-লিংকে এই কুমারী পুজোর ভিডিওটা পেয়েও গেলুম। খুব অসহ্য লাগল…আমার সত্যঘরের লিটল বক্স-এ পুং সন্ন্যাসীদের এমন কাজ ‘অশ্লীল’ (?) মনে হলো। কেন মনে হলো পরে কইছি। ঝটিতি প্রত্যুত্তরে আমি লিখলুম ছোট্ট একটা কথা, ‘Obsession’-এর বেশি ব্যাখ্যা দিতে গেলে ওর ট্যান হয়ে যাবে। বইপত্তরের সঙ্গে ওর বিগত বত্রিশ বছর কোনো সম্পক্কো নেই।
সঙ্গে সঙ্গে উত্তর এল, ‘DHFL তোমার Obsession!’
DHFL? আমার Obsession???
DHFL মানে Dewan Housing Finance Limited![৫] Insolvency and Bankruptcy Code-এর ভেতর চলে গিয়ে এমন অবস্থা চলছে যে আমার স্বেচ্ছাবসরের দরুন প্রাপ্ত ৬৭ লাখ টাকা আটকে গেছে ‘স্বাধীন’ ভারতের এই সবচেয়ে বড় স্ক্যামে। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে কেন্দ্রের শাসক দলের তোলাবাজি, তাও আবার আন্ডারগ্রাউন্ড বা ছায়া অর্থনীতির দাউদ আর ইকবাল মিরচি মারফত টাকার লেনাদেনা হয়েছে।[৬] টাকার আবার হিঁদু-মোছলমান নফরত হয় নাকি? এখন চাড্ডি বিচিপি এই DHFL-কে পূর্ব-পরিকল্পিত ভাবে তুলে দিতে চাইছে মুকেশ আম্বানির জামাই আনন্দের বাপ অজয় পিরামলের হাতে, যে কিনা ইনসাইডার ট্রেডিং থেকে শুরু করে মন্ত্রীর (পীযুষ গোয়েল) কোম্পানি জলের দরে পেয়ে গেছে। হ্যাঁ, পেয়ে গেছে! ঠিক যেমন ভাবে তারা পেয়ে গেছে DHFL-এর ৪০-৪৫ কোটি টাকার সম্পত্তি মাত্তর ১ টাকায়।[৭]
এ নিয়ে একটা লড়াই আমি চালাচ্ছি, একটা ওয়েবসাইট মারফত—Digital Non-Violent Civil Disobedience Movement—আজকাল এটা চালু এক পদ্ধতি। এক একটা অনুসন্ধান-ভিত্তিক লেখা লিখতে প্রাণ বেরিয়ে যায়—প্রাণ নিয়ে নেওয়ার ঝুঁকি বইতে হয়, কেননা এখানে শাসক দলের কেচ্ছা আছে অনেক কত বুড়ো মানুষ (DHFL FD-Holders) আমাকে আতঙ্কিত হয়ে ফোন করেন, মেসেজ করেন। আমি তাঁদের আশ্বাস দিই। এক বিধবা মহিলাকে তো একবার আত্মহত্যা থেকে বাঁচিয়েছিলুম। তার ওপর বড় সমস্যা হলো ‘এনারা’ আন্দোলনবিমুখ। প্যানডেমিকের অ-সময়ে ডিজিটাল মুভমেন্টে যেতে চাইলুম, কিন্তু পারলুম না। কেননা, টেক স্যাভি নন। মধ্য-উচ্চবিত্ত এই মানুষগুলো ভীতুও বটে। এই স্বৈরাচারী সময়ে তাঁরা সরকারের মুখের ওপর সত্যি কথা কইতে ভয় পান। ‘এনাদের’ আন্দোলিত করা খুব শক্ত।
আর এটাই কিনা আমার ‘Obsession’? বৈধ বউ-এর এই শব্দবন্ধে আমি খুব কষ্ট পেলুম। এখানে মজার ব্যাপার যেটা হলো, ‘রাকৃমি’ স্বয়ং DHFL-এ আমারই মতন এফডি করে অনেক কোটি টাকা রেখেছে। যেমন রেখেছেন: ভারতীয় এয়ারফোর্সের লোকজন, উত্তর প্রদেশের পাওয়ার করপোরেশন, লেপ্রসি ফাউন্ডেশন এবং অসংখ্য ক্যাথলিক আর জেসুইট সম্প্রদায় তথা প্রতিষ্ঠান। এইসব লোকজন এবং প্রতিষ্ঠান, সব মিলিয়ে সংখ্যায় প্রায় ৭৭ হাজার হবে। ‘এনারা’ দৌড়ঝাঁপ করছেন, মামলা লড়ছেন, কিন্তু, ‘রাকৃমি’র মুখে রা নেই। আর্ত মানুষের পাশে এসে তাঁরা দাঁড়াবেন না? কেন? কেনই বা মূলধারার ‘গোদি’ মিডিয়া এটাকে, এই ভারতের সবচেয়ে বড় ব্যাংকিং স্ক্যামের খবর করছে না? কী করেই বা করবে! ২০১৪ থেকে ২০২০-র মধ্যে বিজেপির সম্পদ বেড়েছে ৬২৭%! ব্যাংক দেউলিয়া করে দিয়ে স্বেচ্ছায় ব্যাংকের ধার না মিটিয়ে বিদেশে কেটে পড়েছে অসংখ্য পুঁজিপতি। তাদের সমাদরে সাগরপার করেছে শাসকদল। মাথায় চেপেছে বিশাল বৈদেশিক ঋণের বোঝা! এগুলো ‘গোদি’ মিডিয়া জানায় না।
‘রাকৃমি’র ব্যাপারে ফিরে আসি। নরেন যখন নির্বিকল্প সমাধির খোঁজে ব্যতিব্যস্ত করছেন রামকৃষ্ণকে এবং কয়েছিলেন,
আমার ইচ্ছা হয় শুকদেবের মতো একেবারে পাঁচ-ছয় দিন সমাধিতে ডুবে থাকি, তারপর শুধু দেহরক্ষার জন্য খানিকটা নিচে নেমে এসে আবার সমাধিতে চলে যাই।
রামকৃষ্ণ প্রত্যুত্তরে কয়েছিলেন,
ছিঃ, ছিঃ, তুই এত বড় আধার—তোর মুখে এই কথা! আমি ভেবেছিলুম, কোথায় তুই একটা বিশাল বটবৃক্ষের মতো হবি—তোর ছায়ায় হাজার হাজার লোক আশ্রয় পাবে—তা না হয়ে কিনা তুই শুধু নিজের মুক্তি চাস?
কোথায় গেল ‘রাকৃমি’র বিবেকানন্দ-অনুসারী, ‘আত্মোমোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ’ বা ‘বহুজনহিতায় বহুজনসুখায়’-র নৈতিকতা? শিব্রামের কথা মোতাবেক, ‘রাকৃমি’র মতন সংঘ কি সবসময় সাংঘাতিকই হয়ে ওঠে?
হায় বটগাছ! ‘রাকৃমি’র কাছে এখন নরেন্দ্রনাথ দত্ত আর নরেন্দ্র দামোদারদাস মোদি একাকার হয়ে গেছে। বাপ-রে, কী বিপুল সংবর্ধনা দিল ‘রাকৃমি’ নরেন মোদিকে! শুধু তাই নয়, ‘রাকৃমি’র তরফে বলা হলো: ‘Narendra Modi One Of The Best Prime Ministers Of Our Country Ever Produced.’[৮] আমি নিজে ‘রাকৃমি’র ছাত্তর। আমি লজ্জা পেলুম প্রথমে, তারপর হাসতে হাসতে কেঁদেই ফেল্লুম। বুঝলুম, নির্ঘাৎ টাকাপয়সার ব্যাপারটা ভেতরে ভেতরে ‘সেটিং’ হয়ে গেছে, তাই ‘রাকৃমি’র আর কোনো মাথাব্যথা নেই।
অথচ আজকের হিঁদু-ধ্বজাধারীদের চামচাবাজ ‘রাকৃমি’ একসময় অ-হিঁদু হবার তাগিদে অনেকদিন (১৯৮১- ১৯৯৫) ধরে কোর্টে মামলা লড়েছে—স্রেফ ‘সংখ্যালঘু’ সুবিধেবাদী তকমা বা স্টেটাস পাওয়ার তাগিদে।[৯]
‘রাকৃমি’ কৃমিতে পরিণত হলো কী করে? নরকের কীট না-হলে এরকম বণিকপোষিত কট্টর ধর্মীয় মৌলবাদী দলকে কেউ সমর্থন করে? আহা, কী দারুন ভাবনাতে তৈরি হয়েছিল বেলুড় মঠের স্থাপত্য! বিজ্ঞানানন্দ মিলিয়ে দিয়েছিলেন একই সঙ্গে ইসলাম, খ্রিস্টীয় আর হিন্দু স্থাপত্য (দ্রষ্টব্য: www.belurmath.org)। সেই সিংক্রেট্রিক ঐতিহ্য কি ভুলে মেরে দিয়েছেন এখনকার নফরতপন্থীদের টাকার লোভে ‘রাকৃমি’র ক্যাডাররা?
SEARCHING FOR SYNCRETISM Part 2[১০]
আমি তীব্র ঘেন্নায় একবার বিজেপি আর ‘রাকৃমি’র তাবড় ‘উচ্চ’ নেতৃত্বকে (এ কথাটা ‘ছাগু’রা খুব ব্যবহার করে—স্তালিনীয় আমলাতান্ত্রিক কাঠামোতে তাই তো হবার কথা!) একটা চিঠি লিখেছিলুম—মক লেটার—বিজেপি সেজে, সারকাজ্ম-এর মোড়োকে ডেভিল্স অ্যাডভোকেসি[১১] করেছিলুম। এটা আমরা স্ট্র্যাটেজি হিসেবে করেই থাকি। নইলে সর্বগ্রাসী সংঘ পরিবার আমাকে বাঁচতে দেবে না।
ভারতে এই ছায়া অর্থনীতির ঠাঁইটা মারাত্মক অশুভ আঁতাতে ( অ্যাডাম স্মিথ যাকে বলেন কলিউশন) চলে। এই অজয় পিরামলের সঙ্গে জুড়ে আছে ইস্কনের রাধানাথ স্বামী, ‘রাকৃমি’ আর মুম্বাই-এর নীচের মহল এবং অবশ্যই রুলিং পার্টি।[১২] পিরামলের স্ত্রী স্বাতী পিরামল আবার (কু-)খ্যাত সদ্গুরুর সঙ্গে যুক্ত।[১৩]
২.
All happy families are alike; each unhappy family is unhappy in its own way.
― Leo Tolstoy, ’Anna Karenina’.
১৩ অক্টোবর, ২০২১ মহাষ্টমীর দিন আমি এই একটা হো-অ্যাপ মেসেজে মুহ্যমান হয়ে পড়ি। পরের দিন নবমীর সন্ধেবেলা আমার বউকে জিজ্ঞেস করি, ‘আমরা একটু আলোচনায় বসি, সংলাপে যাই। বুঝে নিতে চেষ্টা করি না হয় কুমারী পুজোর নৈতিক-অনৈতিক।’
তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল আমার বৈধ বউ ‘না কোনো আলোচনা ফালোচনা নয়। ওসবে যেতে গেলে তুমি তোমার মত জোর করে আমার ওপরে চাপিয়ে দেবে।’
না, না, একদমই না। আমরা হারাজেতাহীন সংলাপে মাতব কেবলমাত্র তত্ত্বজিজ্ঞাসার খাতিরে। নৈয়ায়িকরা যারে কন ‘বাদ’।[১৪] মাথা ফাটাফাটি করে বিতণ্ডা নয়, আমি ‘বাদ’ ভিক্ষে চাইছি।
রাখো তোমার বাদ ফাদ। তোমার মতো লম্পট মাগীবাজের মুখে ওগুলো মানায় না।
বৈধ বউ কথা ঘোরাচ্ছে। বুঝতে পারছি স্ট্রম্যান ফ্যালাসি-র মুখে পড়তে চলেছি। আমি সেই ফাঁদে পা-ও দিয়ে ফেল্লুম, কইলুম, “দেখো, আলোচনার দিক ঘুরে যাবে কিন্তু এবার। আমি তো বিয়ের আগেই বলে নিয়েছিলুম, আমি একগামিতাকে ‘কু’- সংস্কার মনে করি—রাসেল থেকেই ঝেড়ে বলেছি। আমি কি বিয়ের আগের চিঠিগুলো দেখাব? আমি কী স্বয়ং বহুগামী ব্যাসদেবকে কোট করে কয়েছিলুম, ‘ন হি একস্যাং স্ত্রিয়াঃ রক্তঃ অন্যাসু বিরক্তঃ ইতি’। এক স্ত্রীর প্রতি অনুরক্ত থাকার মানে এই নয় যে, অন্য স্ত্রীর প্রতি আমি বিরক্ত! তাছাড়া ওই ছোট বয়েসেই আমি মার্কস-এঙ্গেলস আর রাসেলের উদ্ধৃতি ভরা চিঠি পাঠাতুম তোমাকে—শুধু বিয়ে প্রতিষ্ঠানের ইলেজিটিমেসি বোঝাতে…।”
মুখ ঝামটা দিয়ে আমার বৈধ বউ অর্ণব গোস্বামীয় হাই ডেসিবেলে চেঁচিয়ে উঠে বল্লো, “হবে না কেন? তোর (এবার তুই তোকারি শুরু হল—আমার বেশ লাগছে!) তো গায়ে নীল রক্ত বইছে, জমিদার বংশ তো, তার ওপরে কুলীন। রক্তের দোষ যাবে কোথায়?”
হাই ডেসিবেল শব্দে এমনিতেই আমার মাথা গুলিয়ে যায়, তার ওপর যদি যুক্তি প্রতিষ্ঠা না করে উচ্চৈঃস্বরে কেউ কথা কয়, তাহলে আমার মধ্যে ত্বরিৎ পশুটা জেগে ওঠে। তবে আজকাল দেখছি, অতি ধীরে সেই পৈশাচিক পাশবিকতা জাগে। আমি কি বড় হচ্ছি? বুঝদার হচ্ছি? নাকি ফ্যাসিজ্ম আমার একক মনের মধ্যে গেঁড়ে বসেই আছে?
তাই দাঁতে দাঁত চেপে মেকি হাসি মেরে কইলুম, “নীল রক্ত কবে লাল হয়ে গেছে। কিন্তু, তোমার তো তা’ হয়নি গুরু। তোমার গুজরাটবাসী চাড্ডি দিদি-জামাইবাবু যখন এখানে আটকে পড়েছিলেন, তখন থেকেই তো দেখছি, তুমি নিজেকে ‘হিঁদু বামনী’ হিসেবে পরিচয় দাও। সিঁদুর পরে সেটা জানান দাও। ওটা যে দাসত্বের চিহ্ন, তা সমাজতত্ত্বের ডিগ্রিধারী হয়েও মাথায় ঢোকে না। কিন্তু, আমার পরিচয়টা তো এই, এই দেখো ঘরে পোস্টার লটকানো আছে।”
ও এবার পালটা দিল, “ওসব তোর মুখের বড় বড় কথা। কোনো মানে নেই। লোকে কী আর সাধে তোকে মেগ্যালোম্যানিয়াক বলে! নিজের কথা তুই অন্যের ওপর জোর করে চাপিয়ে দিস। আর তুই তো কিসসু না, কিসসু না, কিসসু না, কেউ পোঁছেও না। নইলে ৬৫ বছরি মেয়াদের কেঃ সঃ চাকরি কেউ ৫২ বছরে ছাড়ে?”
এই বলে সে তার হাওয়াই চপ্পল খুলে আমাকে পেটাতে শুরু করে, তারপর লাথি কষায়। আমি আমার হাত দুটো পেছনে রেখে আমার নিজের মধ্যের ফ্যাসিস্ট বাবাতান্ত্রিক পশুটাকে রোখার চেষ্টা করি।
না, অন্যায় ও করেনি কিছু। এর আগে দুটো ঝামেলায় আমি ওকে মেরেছিলুম। কেন মেরেছিলুম, তা আর মনে নেই। কেননা, সেই দু-বারই আমি চূড়ান্ত অপরাধবোধে একগাদা ঘুমের ওষুধ খেয়ে মরার চেষ্টা করেছিলুম। তারপর বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছে সব। তবে এটুকু মনে আছে ও তীব্র আওয়াজে আমার বিরুদ্ধে কিছু বলছিল। বোধহয় আমার ‘চারিত্রিক দোষ’ নিয়ে…ঠিক মনে পড়ে না আর! হাই ডেসিবেল সাউন্ডে আমার মাথা খারাপ হয়ে যায়। উপরন্তু, এই ঘিঞ্জি বসতিতে আশপাশের লোকজন কী ভাবছে, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি—লজ্জা পাই অর্থাৎ কিনা অপরের চোখ দিয়ে নিজেকে দেখি যাকে কয়, রিফ্লেকশন আর কী! উফফ, কী ‘Nerve racking existence to enshrine our neighbours’—এই কথাটা কোনো এক সাহেব কয়েছিলেন—কে সেই সাহেব, এখন তা’ মনে পড়ছে না।
ঘড়িতে তখন বারোটা বেজে গেছে। মানে আজ পনেরোই অক্টোবর। দশমী তিথি। আমার মায়ের গবভো থেকে আমার ‘পতন’ (falling/casus/ptosis) এই তিথি এবং এই দিনেই। কোন কার্যগতিকে কে জানে অথবা কোনো অনন্ত পুনরাবর্তে আমার মতন falling body (being নয়) আজ সৌর-চান্দ্র হিসেব খাপে খাপ হয়ে পৃথিবী গ্রহের মাটিতে ‘পড়েছে’। আবার এই যে ‘অনন্ত পুনরাবর্ত’ কথাটা আমি কইলুম, ইংরেজিতে যারে কয়, ‘infinite reccurence’—এই কথাটা নীৎসের। আজ নীৎসে আর ফুকোর জন্মদিন। আমারও। এসব সমাপতন নিয়ে আর মাথা ঘামিয়ে কী হবে? এখন ব্যতিহার বহুব্রীহি ক্যালাকেলির বা মিউচুয়াল অ্যাবিউজ-এর শুভক্ষণ।
বউ বলতে থাকে, আমার চরিত্রহীন যাপনের কথা আর অভিশাপ দেয়, ‘মর, মর শালা তুই মর। তোর জন্মদিনেই তোর মরণ আমি দেখতে চাই।’
নির্ঘাৎ আমার ভেতরে বাবাতান্ত্রিক এক ফ্যাসিস্ট লুকিয়ে আছে। অতীতে হয় তো বা ওর ওপর বহুৎ অত্যাচার করেছি। তারই ব্যাকল্যাশে ও বোধহয় হিংস্র প্রতিশোধ নিচ্ছে। কতখানি অত্যাচার করেছি আমি, যে ও আমার মরণকামনা করছে? নাকি ঋতুবন্ধের পর মানে যাকে বলে পোস্টমেনোপজাল সিম্পটম্স দেখা দিয়েছে? ইস্ট্রোজেন হরমোনের গণ্ডগোল? কিসসু মাথায় ঢুকছে না।
কী আশ্চর্য! ও, যে দুজন প্রেমিকার নামে খিস্তি মারছে, তাদের একজন জ্যোতি-ভক্ত ছাগু, আরেকজন সংঘ পরিবারের দুর্গাবাহিনীর সদস্য মানে চাড্ডি। এদের সঙ্গে আমার মেলে না—আমি না-পার্টি আর না-নেশনের সদস্য। আর ইদানীং দেখেছি, ‘জ্ঞানের বিহনে প্রেম নেই।’ ইন্টেলেকচুয়াল লভ্ আমি পাই কোথা? এদের উত্তাপী আকর্ষণে আমার জাগে না—নেতিয়ে পড়ে।
আমি ভদকার (উদক বা ওয়াটার আর কী!) শিশি খুলে আকণ্ঠ পান করতে থাকি। আর চালিয়ে দিই পণ্ডিত যশরাজের গলায় পূর্বী। সন্ধের রাগ এই রাত্তিরে? হ্যাঁ, কাল সকালে যে নিশ্চিত সূর্য উঠবে—তার আভাস দিয়ে যায় এই পূর্বী। আলাপ-জোড় পেরিয়ে ঝালায় এসে যশরাজের গলায় শুনতে পাই তীব্র আর্ত-কান্না। আমি একা ঘরে অপৌরুষেয় আর্তচিৎকারে কাঁদি। বুঝি,
নৃসিংহের আবেদন পরিপাক করে
ভোরের ভিতর থেকে বিকেলের দিকে চলে যায়
রাতকে উপেক্ষা করে পুনরায় ভোরে
ফিরে আসে; তবুও তাদের কোনো বাসস্থান নেই,
যদিও বিশ্বাসে চোখ বুজে ঘর করেছি নির্মাণ
ঢের আগে একদিন;[১৫]
ঘর—ঘরের মধ্যে ঘর! হাঁসফাঁস করা ক্লাস্ট্রোফোবিক সত্যি বা মিথ্যে বা অনির্নেয় ঘর। আমাদের little box(es)! শক্তিকে মনে পড়ে, ‘সবরমতী আশ্রম কোনদিকে? কোথায় ছিল?’
‘নিরস্ত্রের যুদ্ধে’ যেতে গিয়ে তো ‘শস্ত্র হয় মন’!
৩.
আমি কি বাবাতন্ত্রের প্রতিনিধিত্ব করছি তাহলে? জৈবিক নারীর প্রতি অত্যাচার করছি আমি প্রবল পুং? আমার বৈধ বউ-এর প্রেক্ষিতটা বোঝার চেষ্টা করি। ওর চাড্ডি গুজরাট-নিবাসী আত্মীয়রা যখন এখানে, প্ল্যান্ডেমিকের (Pandemic নয় Plandemic কই আমি।[১৬]) সময় আটকে পড়েছিলেন, তখন কথায় কথায় ওর দিদি লুজ টকের মাঝখানে কয়ে ফেলেছিল, ‘সবাই পেট্রিয়ার্ক’। এই ইউনিভার্সাল কোয়ান্টিফায়ার ‘সবাই’ শব্দের অতি-ব্যাপ্তিতে আমার আপত্তি। নির্বাচনে ৩৬% ভোট পেয়ে কোনো দল যেমন বলে ফেলে—আমরাই সব, সেরকম আর কী! হেস্টি জেনারালাইজ়েশন!
আমি চ্যালেঞ্জ করলুম দিদিকে। তাঁর কপালে সিঁদুর-চিহ্নকে প্রশ্ন করলুম, “তুমিই তো পেট্রিয়ার্কি-কে বহন করছ ওই সিঁদুরে। আবার এই শব্দটার সংজ্ঞার্থও কইতে পারছ না। এসো আলোচনা করা যাক।”
দিদিও বোনের মতোই। আলোচনা নয়, লজিক চপিং নয়—আমাদের সংসদ বা বিধানসভার মতন—আলোচনাহীন! কৃষি বিল পাস হয় বিনা আলোচনায়, কৃষি বিল রদ হয় বিনা আলোচনায়। বিশটা বিল্স একদিনে অ্যাক্ট্স হতে আজকাল আর আলোচনা লাগে না। অথচ সংলাপী আনুভূমিক গণতন্ত্র চেয়েছি আমি…আমার চাওয়া-না-চাওয়ায় কার কী যায় আসে! সংলাপ থমকে দাঁড়ায়—Halting Problem Of Dialogue—The End Of Dialogue![১৭]
মনে পড়ল, আমাদের বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানে ঢোকার মুহূর্তটা। স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্টে বিয়ে। তবু হিঁদু আচারাচরণ কীভাবে জানি ঢুকে যায়: মালাবদল, সিঁদুর-পরানো…। আমার বউ-এর দিদির উদ্যোগে ছাগু আপিসী কমি মামাশ্বশুররা ঝাঁপিয়ে পড়ে উদ্যত হয় সিঁদুর পরাতে। প্রচণ্ড চাপ লাগে। তবু সেই চাপে, ‘হাগা পেয়েছে’ বলে, আমি বেরিয়ে যেতে পারিনি। ক’দিন বাদেই এই কমি মামাশ্বশুররা তাঁদের ছেলেমেয়েদের পৈতে দেন।[১৮] হাসব না কাঁদব এইসব হিপোক্রেসিতে?
ঘটনাটা বাবাতন্ত্রের পক্ষে সওয়াল-করা দিদিকে স্মরণ করিয়ে দিই। দিদি শেষ যুক্তি দেন, ‘দেখতে সুন্দর লাগে—তাই পরি’। প্রত্যুত্তরে আমি শুধু কই, ‘তাহলে ছোটবেলা থেকে সিঁদুর পরতে না কেন?’—পরিবার যে প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাষ্ট্রেরই প্রতিরূপ তা মালুম হয় এইবার, ধীরে ধীরে।[১৯]
রাকৃমির এই বাবাতন্ত্রের উৎসমুখ কোথায়? বা আপিসী কমিদের? ধম্মো, জাতপাত কেন এখনও আছে টিকে? কেন আমার বউ ‘হিঁদু বামনী’ পরিচয়ে এখনও থিতু? কেন কমিরা (এবং কংগ্রেস সহ অন্যান্য দলগুলোও…এখন বিজেপির মতোই একই ধম্মো কার্ডেই খেলছে? কেন ভোট পাওয়ার লোভে টেম্পল ফেস্টিভালে অংশগ্রহণ করতে চাইছে—আপিসী কমিরা?[২০]
এইসব ভাবতে ভাবতে রাত ভোর হয়। ঘুম আসে না। বইয়ের তাক থেকে পেড়ে ফেলি রামকৃষ্ণ কথামৃত। আর তার পাশে নিই সুধীর কাকর-এর: ‘The Inner World: A Psychoanalytic Study of Hindu Childhood and Society’, দেখলুম, আগে থাকতেই সাজানো ছিল রামকৃষ্ণের ‘মিসোজেনিস্ট’ বক্তব্যগুলো। আমি কাকর থেকে ঝেড়ে আমার মতো করে শুধু ইংরেজি শিরোনাম দিয়ে দিলুম আর যা ভাবনা এল টুকরো টুকরো, তা নোট্স-এর মতো করে লিখে ফেল্লুম। দাগ দিলুম, নজরটান হিসেবে দুটি একটি শব্দ ও বাক্যে।
কামিনী=কাঞ্চন? (অহো! কী সমীকরণ) জয়তু শ্রীরামকৃষ্ণ!
NURTURING BENEFACTRESS (COSMIC MOTHER)
VERSUS THREATENING SEDUCTRESS? AMBIVALENCE?
MYSOGENIST RAMAKRISHNA? NARCISSISTIC WOUNDS?
Who seeks for better of thee, sauce his palate
With thy most operant poison! What is here?
Gold? Yellow, glittering, precious gold? No, gods, 1690
I am no idle votarist: roots, you clear heavens!
Thus much of this will make black white, foul fair,
Wrong right, base noble, old young, coward valiant.
Ha, you gods! Why this? What this, you gods? Why, this
Will lug your priests and servants from your sides, 1695
Pluck stout men’s pillows from below their heads:
This yellow slave
Will knit and break religions, bless the accursed,
Make the hoar leprosy adored, place thieves
And give them title, knee and approbation 1700
With senators on the bench: this is it
That makes the wappen’d widow wed again;
She, whom the spital-house and ulcerous sores
Would cast the gorge at, this embalms and spices
To the April day again. Come, damned earth, 1705
Thou common whore of mankind, that put’st odds
Among the route of nations, I will make thee
Do thy right nature.
—Shakespeare, ‘Timon of Athens’.
কামিনী-কাঞ্চনই মায়া। সাধুর মেয়েমানুষ থেকে অনেক দূরে থাকতে হয়। ওখানে সকলে ডুবে যায়। ওখানে ব্রহ্মা বিষ্ণু পড়ে খাচ্ছে খাবি।
মেয়েদের সঙ্গে মাখামাখি করিলে সাধুর পতন হইবার সম্ভাবনা। এই উচ্চ আদর্শ না থাকিলে জীবের উদ্ধারই বা কিরূপে হইবে? স্ত্রীলোকটি তো ভক্তিমতী। তবুও ভয়! এখন বুঝিলাম, শ্রীচৈতন্য ছোট হরিদাসের উপর কেন অত কঠিন শাসন করিয়াছিলেন। মহাপ্রভুর বারণ সত্ত্বেও হরিদাস একজন ভক্ত বিধবার সহিত আলাপ করিয়াছিলেন। কিন্তু হরিদাস যে সন্ন্যাসী। তাই মহাপ্রভু তাঁকে ত্যাগ করিলেন। কি শাসন! সন্ন্যাসীর কি কঠিন নিয়ম! আর এ-ভক্তটির উপর ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কি ভালবাসা! পাছে উত্তরকালে তাঁহার কোন বিপদ হয়—তাড়াতাড়ি পূর্ব হইতে সাবধান করিতেছেন। ভক্তেরা অবাক্।
‘সাধু সাবধান’— ভক্তেরা এই মেঘগম্ভীরধ্বনি শুনিতেছেন।
আমি মেয়ে বড় ভয় করি। দেখি যেন বাঘিনী খেতে আসছে! আর অঙ্গ, প্রত্যঙ্গ, ছিদ্র সব খুব বড় বড় দেখি। সব রাক্ষসীর মতো দেখি।
আগে ভারী ভয় ছিল! কারুকে কাছে আসতে দিতাম না। এখন তবু অনেক করে মনকে বুঝিয়ে, মা আনন্দময়ীর এক-একটি রূপ বলে দেখি।
কিন্তু পুরুষের পক্ষে—সাধুর পক্ষে—ভক্তের পক্ষে—ত্যাজ্য ।
হাজার ভক্ত হলেও মেয়েমানুষকে বেশিক্ষণ কাছে বসতে দিই না। একটু পরে, হয় বলি, ঠাকুর দেখো গে যাও; তাতেও যদি না উঠে, তামাক খাবার নাম করে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ি।
যে মন ভগবানকে দিতে হবে, সে মনের বারো আনা মেয়েমানুষ নিয়ে ফেলে। তারপর তার ছেলে হলে প্রায় সব মনটাই খরচ হয়ে যায়। তাহলে ভগবানকে আর কি দেবে?
একজনের বউ—কোথায় রাখে এখন ঠিক পাচ্ছে না। বাড়িতে বড় গোল কয়েছিল। মহা ভাবিত। সে কথা আর কাজ নাই।
আর মেয়েমানুষের সঙ্গে থাকলেই তাদের বশ হয়ে যেতে হয়। সংসারীরা মেয়েদের কথায় উঠতে বললে উঠে, বসতে বললে বসে। সকলেই আপনার পরিবারদের সুখ্যাত করে।
আমি একজায়গায় যেতে চেয়েছিলাম। রামলালের খুড়ীকে জিজ্ঞাসা করাতেবারণ করলে, আর যাওয়া হল না। খানিক পরে ভাবলুম—উঃ, আমি সংসার করি নাই, কামিনী-কাঞ্চনত্যাগী, তাতেই এই!—সংসারীরা না জানি পরিবারদের আছে কিরকম বশ!
মণি—কামিনী-কাঞ্চনের মাঝখানে থাকলেই একটু না একটু গায়ে আঁচ লাগবেই। আপনি বলেছিলেন, জয়নারায়ণ অত পণ্ডিত—বুড়ো হয়েছিল—আপনি যখন গেলেন, বালিস-টালিস শুকুতে দিচ্ছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ—কিন্তু পণ্ডিত বলে অহংকার ছিল না। আর যা বলেছিল, শেষে আইন মাফিক্ কাশীতে গিয়ে বাস হল।
সাধনের অবস্থায় ‘কামিনী’ দাবানল স্বরূপ—কালসাপের স্বরূপ। সিদ্ধ অবস্থায় ভগবান দর্শনের পর—তবে মা আনন্দময়ী! তবে মা’র এক-একটি রূপ বলে দেখবে।
কয়েকদিন হইল, ঠাকুর নারাণকে কামিনী সম্বন্ধে অনেক সতর্ক করেছিলেন। বলেছিলেন —‘মেয়েমানুষের গায়ের হাওয়া লাগাবে না; মোটা কাপড় গায়ে দিয়ে থাকবে, পাছে তাদের হাওয়া গায় লাগে;—আর মা ছাড়া সকলের সঙ্গে আটহাত, নয় দুহাত, নয় অন্ততঃ একহাত সর্বদা তফাত থাকবে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির প্রতি)—তার মা নারাণকে বলেছে, তাঁকে দেখে আমরাই মুগ্ধ হই, তুই তো ছেলেমানুষ! আর সরল না হলে ঈশ্বরকে পাওয়া যায় না। নিরঞ্জন কেমন সরল!
কারু কারু যোগীর লক্ষণ দেখা যায়। কিন্তু তাদেরও সাবধান হওয়া উচিত। কামিনী—কাঞ্চনই যোগের ব্যাঘাত। যোগভ্রষ্ট হয়ে সংসারে এসে পড়ে,—হয়তো ভোগের বাসনা কিছু ছিল। সেইগুলো হয়ে গেলে আবার ঈশ্বরের দিকে যাবে,—আবার সেই যোগের অবস্থা।
কামিনী—কাঞ্চনই যোগের ব্যাঘাত। বস্তু বিচার করবে। মেয়েমানুষের শরীরে কি আছে—রক্ত, মাংস, চর্বি, নাড়ীভুঁড়ি, কৃমি, মুত, বিষ্ঠা এইসব। সেই শরীরের উপর ভালবাসা কেন?
কামিনী-কাঞ্চনের এই সমীকরণে আমার মতো বাবাতন্ত্রীও বিপর্যস্ত হলো। এসব কী কথাবার্তা? শ্রী গদাধর চট্টোপাধ্যায় যাঁকে বঙ্গসমাজ মেনে নিয়েছে নবজাগরণের কাণ্ডারী ও ধর্মগুরু রূপে; ‘প্রজ্ঞাবান’ লোক-শিক্ষক শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস, যিনি মহাজাগতিক ‘নারী’র (মায়ের!) পায়ে নিজেকে সঁপেছেন, তিনি জাগতিক-নারীকে কেন এমন হেয় করছেন? এই উভটান বা ambivalence কেন? কেন পারমার্থিক দেবী ব্যবহারিকে ধর্ষিতা? যারা একই সঙ্গে বোন নিবেদিতাকে তাড়িয়ে দেয়, তারাই আবার বোন নিবেদিতার নামে সভাগৃহ তৈরি করে![২১]
এবার আমি রামকৃষ্ণের মনোপ্রতিন্যাস আরও একটু বুঝতে চাইলুম। কেমন ছিল তাঁর শাসনতান্ত্রিকতার ধারণা? তিনি কী ভাবতেন, চাষাভুসো-মজদুরদের সম্পর্কে? যেটুকু পেলুম খুঁজে, সেটুকুই দিয়ে দিলুম।
আগে হরিনাম না শ্রমজীবীদের শিক্ষা? (শ্রমজীবীদের বিরুদ্ধে রামকৃষ্ণ?)
কালীকৃষ্ণ ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া গাত্রোত্থান করিলেন। ঠাকুর বিস্ময়াবিষ্ট হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কোথায় যাবে?’ ভবনাথ—আজ্ঞা, একটু প্রয়োজন আছে, তাই যাব। শ্রীরামকৃষ্ণ —কি দরকার? ভবনাথ—আজ্ঞা, শ্রমজীবীদের শিক্ষালয়ে (Baranagore Workingmen’s Institute) যাব। (কালীকৃষ্ণের প্রস্থান) শ্রীরামকৃষ্ণ—ওর কপালে নাই। আজ হরিনামে কত আনন্দ হবে দেখত? ওর কপালে নাই!
On Governmentality
দুষ্ট লোকেরও দরকার আছে। একটি তালুকের প্রজারা বড়ই দুর্দান্ত হয়েছিল। তখন গোলক চৌধুরিকে পাঠিয়ে দেওয়া হল। তার নামে প্রজারা কাঁপতে লাগল—এত কঠোর শাসন। সবই দরকার। সীতা বললেন, রাম! অযোধ্যায় সব অট্টালিকা হত তো বেশ হত, অনেক বাড়ি দেখছি ভাঙা, পুরানো। রাম বললেন, সীতা! সব বাড়ি সুন্দর থাকলে মিস্ত্রীরা কি করবে? (সকলের হাস্য) ঈশ্বর সবরকম করেছেন (এই কথায় কেন জানি John Maynard Keynes-এর কথা মনে পড়ল—এই অর্থনীতিবিদের বেরোজগারির দাওয়াই ছিল এরকম: এক জায়গা খুঁড়ে কিছু পোঁতো, তারপর আবার খুঁড়ে সেটাকে তোলো)—ভাল গাছ, বিষ গাছ, আবার আগাছাও করেছেন। জানোয়ারদের ভিতর ভাল-মন্দ সব আছে—বাঘ, সিংহ, সাপ সব আছে।
দেখ না দুষ্ট লোকেরও প্রয়োজন আছে। যে-তালুকের প্রজারা দুর্দান্ত, সে-তালুকে একটা দুষ্ট লোককে পাঠাতে হয়, তবে তালুকের শাসন হয়।
আমার হঠাৎ করেই মনে পড়ে গেল ভলতেয়ার-এর ‘কাঁদিদ’-এর সতেরো নম্বর অধ্যায়ের কথা। কাঁদিদ সেই এলডোরাডোয় পৌঁছে গেছেন, যেখানে হিরে-সোনা কেবল মাত্তর টুকরো টাকরা ইট পাটকেল! টাকা মাটি, মাটি টাকা? স্বয়ং কার্ল মার্কস সাহেব টাকা-চিহ্নের নেতিকরণ[২২] করেছেন, রবি ঠাকুর তো কয়েছেনই টাকা-রূপক।[২৩]
হ্যাঁ, এইরকম দুঃসময়েই মনে পড়ল আমার গুজরাট-নিবাসী শ্বশুরমশাইয়ের কথা। তখনও আমাদের বিয়ে-প্রতিষ্ঠানে ঢোকা হয়নি। হবু শ্বশুর কমল মিত্তিরি ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তা কী করা হয়?’ আমি প্রত্যুত্তরে জানাই আমার কেঃ সঃ নোকরির কথা। শুনে তিনি বেজায় খুশি হয়ে কন, “আমি গুজরাটে থাকতে থাকতে ওদের মতোই হয়ে গেছি। আমাদের বেওসা চালাতে হয়। আমরা সবকিছু নিত্তিতে মানে দাঁড়িপাল্লাতে ওজন করে নিই”।
আরে, এ তো সেই রূপচাঁদ পক্ষীর…সেই উনিশ শতকের বিয়ের গান। বিয়ের বাজারের সঙ্গে জুড়ে আছে একপেশে (এনট্রান্স), দোপেশে (এল. এ.), তেপেশে (বি. এ.), চারপেশে (এম. এ.) বাজারদর! উনিশ শতকেই কী করে টের পেলেন রূপচাঁদ পক্ষী ডিগ্রি-নোকরি আর সাদির সম্বন্ধ?
যুবক-আমি দেখলুম, আমার পায়ের তলার মাটি যেন সরে যাচ্ছে। এখানে ‘বিশুদ্ধ’ (হাঃ হাঃ হাঃ কী পিউরিটান ফ্যাসিস্ট আমি!) বৌদ্ধিক প্রেম কই? আমি বিয়ের বাজারে পণ্য মাত্তর—একটা ওজনদার মাল। পণ্যই যদি হই আমি, তাহলে আমি পণ নেবো না কেন? কিংবা যৌতুক? বাবার কাছ থেকে পাওয়া সম্পত্তি বা স্ত্রী-ধনের বিতরণের জন্যই তো এই (কু-) প্রথার বাড়বাড়ন্ত! এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে দায়ভাগী[২৪] নিয়মকানুন। তবে বরপক্ষের পণ- যৌতুকের জন্য জোরজারিতে আমি নেই। আমার মনের অন্দর থেকে অনপেক্ষ (ধুস, কান্ট যাই বলুন, ‘অনপেক্ষতা’ বলে কিছু হয় নাকি?) আদেশ পেলুম, ‘যা স্বোপার্জিত নয়, তার জন্য লালায়িত হয়ো না!’ আমি কিসসু নিই নি; বরং আমার বৈধ বউ আমার কথাতেই প্রাপ্য স্ত্রী-ধন ওর দাদাকে দিয়ে দিয়েছে।
কিন্তু আজ ও, আজ বত্রিশ বছর পরে, আমার কাছ থেকে যে খোরপোশটা চেয়ে বসল, তাতে আমার বুকে বড় একটা দাগা লাগল! ওর দাবি: একটা ৭৫০ স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাট আর ৫০ লাখ টাকা! পণ-পণ্য আর খোরপোশ—আমার মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে…
প্রৌঢ়ত্বের অন্তিম প্রান্তে এসে, ভার্যার কাছে আক্রান্ত হয়ে, বিষমকামী বৌদ্ধিক প্রেম-বিলাসী এবার আমি খেপে উঠলুম। আমি ওর ফুলওলা বাপ-মায়ের ছবি থুতু ছিটিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিই—চিহ্ন-ধ্বংস বা Semioclasm-এর খেলায় মেতে উঠি। পরে বুঝেছি, এটা শুধুমাত্তর ওর বাপ-মায়ের প্রতি অশিক্ষা-সঞ্চালনের দায়ে শুধু নয়, পৌত্তলিকতার প্রতি প্রবল বিদ্রোহে এসেছে—এই অপ্রেম মহা অ-সমারোহে। আমার এই হঠকারী আচরণে আরও ঝাড় খেতে শুরু করি। কোথায় আমার মা-বাপ? তাঁদের কারোর ছবি রাখিনি তো আমার ঘরে—ওঁরা আছেন আমার মনে।
কেন আমি এই হিংস্রতার আশ্রয় নিলুম? মাতেরাৎসির খিস্তি একাই শোনে জিদান, সবাই কেবল দেখে (প্রতি-)আক্রমণে হিংস্র ঢুঁসো মারছে জিদান, আমরা শুনতে পাই না। Provocation, Abetment, Sledging ইত্যাদি আইনত নিষিদ্ধ হলেও এই জগতের লীলেখেলায় এগুলো গুপচুপ চলে। দশচক্রে ভগবান ভূত হয়ে যায়। জিদানের সৃজনী খেলোয়াড় জীবন শেষ হয় নীরব অথচ সরব খিস্তির প্রত্যুত্তরে ঢুঁসো মেরে লাল কার্ড দেখে। এখানে বুঝতে হবে কে প্রথম আক্রমক? কে শুরু করল যুদ্ধ? চীন না ভারত? ১৯৬২-র আখ্যানে, রাসেলের, ভারতে কার্যত নিষিদ্ধ কিতাব ‘Unarmed Victory’ পড়তে গিয়ে রীতিমতন ঘাবড়ে গেছিলুম। আজকের স্টেট ক্যাপিটালিস্ট আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদী চীনের সঙ্গে তখনকার চীনের তুলনা করা মুশকিল। খাদ্য সংকট আর সে জন্য আন্দোলন থেকে মন ঘোরাতে তখন নেহরুর দরকার ছিল। চৌ এন লাই আর নেহরুকে লেখা রাসেলের চিঠিপত্তর পড়ে মালুম হল, চৌ যদি বা শান্তি চান অস্তর চালনা বন্ধ করে, নেহরু কখনই তা চাননি। আদ্যন্ত কম্যুনিস্ট-বিরোধী রাসেল কিন্তু চীনের পক্ষে কথা কইলেন (যদিচ এখনকার চীন সাম্রাজ্যবাদী State Capitalist বৈ আর কিসসু নয়!)। একেই বলে লজিক! প্রথম আক্রমককে চিনে নিতে হয়।
আমি কি প্রথম আক্রমক? নাকি আমার বৈধ বউ? আমি তো এমন কাণ্ড দেখলেই ঘর থেকে পালিয়ে যাই এখন। কোথায় যাব? আশ্রয় কোথায়? এর পর দশমীর রাতদিন কাটে দুটো মানুষের দুটো বালিশের কুৎসিত লড়াই-এ।[২৫] আর এই লড়াই-এ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে আমাদের ছেলেটা। কী যে করবে, তা যেন আর ভেবে পায় না।
দশমীর রাত্রে বিসর্জনের একাধিক মিছিল চলছে গঙ্গার ঘাটের দিকে। ঢাকঢোল আর ডিজের তীব্র আওয়াজে আমি আরও বিপর্যস্ত হই। তীব্র রাগে মেসেঞ্জারে আমার বৈধ বউ-এর রক্তীয়দের কাছে পাঠাতে শুরু করি বউকে খুন করার পর আলথ্যুজারের সেই বিখ্যাত স্বীকারোক্তি—শুধু বউ-এর নামটা (Hélène Rytmann) বদলে দিই:
I was massaging the front of her neck. I pressed my thumbs into the hollow at the top of her breastbone and then, still pressing, slowly moved them both, one to the left, the other to the right, up towards her ears where the flesh was hard. I continued massaging her in a V-shape. The muscles in my forearms began to feel very tired; I was aware that they always did when I was massaging.
…’s face was calm and motionless; her eyes were open and staring at the ceiling. Suddenly, I was terror-struck. Her eyes stared interminably, and I noticed the tip of her tongue was showing between her teeth and lips, strange and still. I had seen dead bodies before, of course, but never in my life looked into the face of someone who had been strangled. Yet I knew she had been strangled. But how? I stood up and screamed: ‘I’ve strangled…!’
আমি পাগল হয়ে গেছি। আমি এবার রবার্ট ব্রাউনিংয়ের ‘পোরফেরিয়া লাভার্স’-এর কতকটা অংশ হো-অ্যাপেতে পাঠাতে শুরু করলুম:
And I untightened next the tress
About her neck; her cheek once more
Blushed bright beneath my burning kiss:
I propped her head up as before,
Only, this time my shoulder bore
Her head, which droops upon it still:
The smiling rosy little head,
So glad it has its utmost will,
That all it scorned at once is fled,
And I, its love, am gained instead!
Porphyria’s love: she guessed not how
Her darling one wish would be heard.
And thus we sit together now,
And all night long we have not stirred,
And yet God has not said a word!
বুঝলুম, আমার ভেতরে নিদারুণ (অ-)প্রতিশোধপ্রিয় ক্যালিগুলা জাগছে। কাম্যুর নাটক ‘ক্যালিগুলা’! (নাকি শেক্সপীয়ারের ‘ওথেলো’?) আমার শত্রুর হাতেই সব অস্তর তুলে দিয়ে, আমার ভালোবাসার ধনকে খ্যামতাবান আমি… হ্যাঁ; আমিই খুন করে, আমিই আমাকে খতম করে ফেলব। কিন্তু, কোথায় আমার শ্রেয়সী-প্রেয়সী? ভয়ংকর চরম প্যারানোইয়ায় আমি চাদ্দিকে খালি শত্রুদের মুখ দেখতে পাচ্ছি। স্বপ্নের ঘোরে আমি দেখছি, আমার বন্ধুরা প্রবল অট্টহাস্যে আমাকে, আমার দিকে আঙুল তুলে বিদ্রুপের সুরে কইছে, ‘হেই, সব তোরই দোষ, কনফেস কর। আমি আওড়ে যাচ্ছি:
It is the cause, it is the cause, my soul.
Let me not name it to you, you chaste stars.
It is the cause. Yet I’ll not shed her blood,
Nor scar that whiter skin of hers than snow,
And smooth as monumental alabaster.
আমার কি নিজের কথা বলে কিসসু নেই? আমি কী শুধু ঝাড়া কথাই কয়ে যাব? নাকি এটা ধ্রুপদ শিল্পের ভেন্ন উপস্থাপন এবং বিস্তার? নাকি আমার সৃজনে নেমেছে পঙ্গুতা?
পরের দিন একাদশীর সকালে, আমি ছেলের সঙ্গে বসে কথা কইছিলুম। অ্যাকাদেমিওক্রাসিতে চোরচাট্টাদের ঘুষ খেয়ে চাকরি, প্রমোশন ইত্যাদি নিয়ে কথা হচ্ছিল।[২৬] আমি ওকে বোঝাতে চাইছিলুম, কীভাবে ছায়া অর্থনীতিকে সদাগর-পোষিত রাষ্ট্র নিজের মধ্যে পুরে নেয়। সিনেমার টিকিট, রেলের টিকিটে ফ্লেক্সি ফেয়ার আদতে কালো বাজারেরই সদাগরী রাষ্ট্রীয়করণ। তেমনি মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের[২৭] নিজস্ব ইস্কুলও পরিণত হয়েছে টাকা দিয়ে ডিগ্রি বাগানোর জায়গা।
আমার ছেলে ব্যাপারটাকে নিজের কোলে ঝোল হিসেবে হিসেবে টেনে নিল। কেননা, ওর দুটো পরীক্ষা দেওয়া সত্ত্বেও অনুপস্থিত দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে। উপস্থিতির নথিপত্তর বা পাথুরে প্রমাণ দেওয়া সত্ত্বেও The National Institute of Open Schooling (NIOS) সেটা মানতে চাইছে না। আপিসীভাবে টাকা দিলে, তবে তা স্বীকৃতি পাবে। অনেক দৌড়ঝাঁপ করেও শেষ অবধি টাকা দিতে হলো। তাই, ওর পক্ষে এটা ভাবা স্বাভাবিক। ও চেঁচিয়ে বলে উঠল, ‘তার মানে কি তুমি বলতে চাও, আমি টাকা দিয়ে পাস করেছি? আমার কোনো কৃতিত্ব নেই?’
এই বলে ও পাশের ঘরে গিয়ে দড়াম করে দরজা দিয়ে দিল। ওর মা ছুটে এসে বন্ধ দরজাটায় ধাক্কা দিয়ে তীব্রভাবে চেঁচাতে লাগল। বাড়ির আশপাশে লোক জমে গেছে। আমি গিয়ে আমার বৈধ বউ-এর মুখ চেপে ধরলুম। তাতে ওর ওই চিৎকার পরিণত হলো গোঙানিতে। এবার আমার ছেলে বেরিয়ে এসে চরম শিভালরিতে হয়ে উঠল অয়দিপাউস। আমাকে পেটাতে লাগল। আমার জামা ছিঁড়ে দিল।
ওর মা তালি দিয়ে নাচতে নাচতে বলতে লাগল, “বেশ হয়েছে, ঠিক হয়েছে। ওর ইস্কুল ছাড়ানোর সময় আমি বাধা দেওয়াতে যেমন আমাকে মেরেছিলে, তার প্রতিদান আজ তুমি পাচ্ছ”।
হ্যাঁ, ইস্কুলে আমি বীতশ্রদ্ধ। আমি আমার ছেলেকে আনস্কুল্ড /ডিস্কুল্ড /হোমস্কুল্ড করেছিলুম যখন, মিডিয়া ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আমার ঘরে। তখন বীভৎস ক্যালাকেলি হয়েছিল বটে। হ্যাঁ, এবার মনে পড়েছে, অনুষঙ্গ পেয়েছি—ইস্কুলহীনতার[২৮] অসময়ে গৃহযুদ্ধ!
আমার ছেলেকে কোনোদিন আমি মারিনি, বরং বাবরের প্রার্থনায় থিতু থেকে যযাতির মতো সন্তানের যৌবন কেড়ে নিতে চাইনি, হায়![২৯]
৪.
এবার ক্লান্ত, বিষণ্ণ আমি ইউটিউবে ‘রাকৃমি’র কুমারী পুজো ইউটিউব চ্যানেলে দেখতে বসলুম।[৩০]
এখন আমি শুধু এই মনমোহিনী পুজোটা দেখছি। এর সঙ্গে কুমারী আর উর্বর জমির চাষ, নারী কৌমার্যের (ভার্জিনিটি কাল্ট) মহত্ব থাকলেও মেলাতে চাই না এখন আর। ‘সতীচ্ছদ’ কথাটা কী ভয়ংকরভাবে পলিটাকালি ইনকারেক্ট! এসব তো জানা কথা। না, বোধহয় জানা নেই। হাইমেন কি শরীরের ভেতরে না বাইরে? সতীর পেনিস-ট্রেশন-এরপর ডিস-সেমিনেশন-এ শব-দ তার স্থিতলক্ষণ হারিয়ে বহ্বর্থ-এর খোঁজে পাড়ি দেয় অজানায়। আমি বুঝতে পারি না, সতীর যোনি ফুঁড়ে বেরোনো নব্বই ডিগ্রি খাড়া শিবলিঙ্গ আমি মায়ের গবভো থেকে দেখছি—নাকি বাইরে থেকে?[৩১] সমগ্র মহাবিশ্ব আমার গর্ভগৃহ। ভাণ্ডে ব্রহ্ম-অণ্ড? দ্রষ্টা আমি নিজেই যেন এক অণু—ডিম্বাণু।
এখন শুধু মনে পড়ছে শবরীমালা মন্দিরে ঋতুমতী নারীদের প্রবেশ নিষেধ আর কামাখ্যা মন্দিরে অম্বুবাচীতে মা কামাখ্যার ঋতুস্রাবের (আলতা আর তেঁতুলগোলা জল?) কাপড় বিক্রির কথা! হিঁদু ধম্মের ছাতার মধ্যে এত্তো বৈচিত্র্য, এত্তো অসমসত্বতা মেলাবে কী করে সংঘ পরিবার? আচ্ছা, ধরা যাক, তথাকথিত হিঁদু ঐক্যের খাতিরে যদি কামাখ্যা মন্দিরের প্রসাদ যায় তিরুপতি মন্দিরে অথবা উলটোটা? কী ক্যাঁচাল বাঁধবে বলুন দিকিনি?[৩২]
আমি এবার মন দিয়ে ভিডিওটা দেখতে শুরু করি আর নোট্স নিতে থাকি। মন্তরগুলো খেয়াল করে দেখলুম, এক ‘মেখলাবৃতা’ (মন্ত্রে উল্লেখ থাকলেও, এই কুমারীর গায়ে কিন্তু বেনারসী!) ব্রাহ্মণ কুমারীর আপাদমস্তক চান করানো হচ্ছে, অথচ হচ্ছে না—রিচ্যুয়ালে যেমন হয় আর কী! কালের প্রবাহে হারিয়ে যায় ‘মূল’ মানেগুলো! মানে নিউট্রিলাইজ্ড হয়ে যায়। যুদ্ধের শীল্ড খেলার শীল্ড হয়ে যায়; যুদ্ধ জেতার আনন্দে কাপে করে মদ্যপান—খেলা জেতার কাপ হয়ে যায়।
তেমনি এখানেও অনায়াসে ‘সমোস্ক্রিত’ ভাষায় যেসব তথাকথিত প্রাইভেট-অর্গান্স (‘প্রাইভেট পার্টস’-এর ধারণা এক এক কৌমে এক একরকম)-এর উল্লেখ করে চান করানো হয় (‘স্নানীয়’) কুশ দিয়ে যোনিসদৃশ কোষাকুষি (এটা বসাতে হয় জল দিয়ে আঁক কেটে মাত্রাহীন ‘ব’ চিহ্ন দিয়ে! মানে বুঝলেন কি?), তা বুঝে শুনে আমার আরোপিত ভিক্টোরীয় (হায়, মহারাণীর জারজ সন্তান!) নৈতিকতায় ভিরমি খাওয়ার কথা! স্রেফ বাংলায় যদি এইসব মন্তরতন্তরের তর্জমা করা হয়, তাহলে কোথায় লাগে রোদ্দূর রায়ের ‘অপরিশীলিত’ (?!) সত্যভাষণ? সমোস্ক্রিতো ভাষায় কথা কইলেই বুঝি তা শুদ্ধ পবিত্র হয়ে যায়? আমি এখন পবিত্রকে অপবিত্র করার খেলায় মেতেছি।
All that is solid melts into air, all that is holy is profaned, and man (sic) is at last compelled to face with sober senses his(sic) real conditions of life, and his(sic) relations with his (sic)kind. The need of a constantly expanding market for its products chases the bourgeoisie over the entire surface of the globe.
প্রায় এক ঘন্টার এই ভিডিওর এই সময়গুলো একবার খেয়াল করে দেখুন: ১৫.৪০, ১৬.৫০, ৪১ মিনিট। ‘যোনি’, ‘স্তন’, ‘কুলকামিনী’, ‘রতিচাতুরী’ ইত্যাদি শব্দগুলো নানাভাবে ঘুরেফিরে বেড়ায়। এইসব রতিক্রিয়ার কথা আসছে কেন কুমারীর ক্ষেত্রে? ভিডিওর ২৭.৩৪ মিনিট নাগাদ দেখুন: তন্ত্রধারক কইছেন, ‘…এটা (মধুপর্ক) মুখে একটু ঠেকাবে?’ আবার নিজেই বিধিবাক্য লঙ্ঘন করে, ‘না’ কইছেন! এই উভটান (ambivalence) কেন?
আমি আর না পেরে, ভিডিওটার নীচে মন্তব্য করতে শুরু করলুম: IPC Section 294? They are reciting Sanskrit (or otherwise Vedic?) psalms that mention (‘Brahmin’) female’s ‘private’ organs, e.g., breast & vagina etc. Organs are to be bathed by the items called ‘snānīya’ by the male priests! Meanings of mantras & semiotics of items are neutralized, obscured (very few understand those mantras) by the ritualistic performance (though this particular performance does not follow the dictums of the age old mantras) within the ambit of mechanical solidarity of the priests of the missionary order. The mission itself once (1981) pleaded for status of non-Hindu minority organization, though they are performing so-called ‘Hindu’/sanātana dhārmika agnihotrādi karma.
এটা কি Child Abuse নয়? এই রিচ্যুয়াল কি পাকসো (POCSO)-আইনে পড়বে না? IPC-র ২৯৪, ৫০৯ ধারায় মামলা হবে না?
কিসসু হবে না, কারণ ভক্তির তোড়ে এই অনুষ্ঠান ভান-(Simulation)-সর্বস্ব স্পেকট্যাক্ল তৈরি করছে। মেয়েটা জড়ীভূত পণ্য মাত্র!
কে তাহলে obsession-এ ভুগছে? ‘রাকৃমি’র সন্নেসি পুরুত, মুগ্ধ দর্শক না দেউলিয়া পরকীয়া ফ্যাসিস্ট মিসোজেনিস্ট আমি? সর্বার্থে ব্যর্থ আমি?
শেষ অবধি আর দেখতে পারলুম না। কুমারীর মুখে কখনও বা দেখছি ‘দেবী’ (সত্যজিৎ রায়, ১৯৬০) দয়াময়ীর মুখ, কখনও বা ধর্ষিতা বাচ্চা আসিফার মুখ…
আমার মনের অবস্থা শোচনীয়। রাষ্ট্রের কাছে আমার মর্যাদাময় মৃত্যুর অধিকার আবদার করি। রাষ্ট্রপতিকে চিঠি লিখে আবেদন-নিবেদনের থালা নিয়ে হাজির হই।[৩৩] আর এই চিঠি মারফত অধিকারের আবেদন করা মাত্তর, ফুকো সাহেব ঠিকই কয়েছেন, ‘রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব’ আমি স্বীকার করে নিই—রাষ্ট্রের বিলুপ্তি নয়, সদাগর-পোষিত রাষ্ট্র আমার বৈধ বউ-এর মতোই বৈধতা পেয়ে যায়, হায়! আর আমার কাছে বৈধতা আর অবৈধতা যায় গুলিয়ে…
আমি কেন আত্মহত্যা করবো না? বলতে পারেন?[৩৪]
ধ্বংসাত্মক এই আত্মহনন থেকে আমি বেরোতে চাই—thantos থেকে eros-এ পাড়ি দিতে চাই। আমি একটা মৃত প্রায় গাছকে জড়িয়ে ধরে আর্তচিৎকার করে উঠি। এবং সেটা ফেবুতে জানান দিয়েও দিই—আমার নিসর্গপ্রেম (Eco-Sexuality)—বিভূতিভূষণ বাঁড়ুজ্জেকে উৎসর্গ করা। ফেবু তো আমার শরীরের অন্দরে সেঁধিয়ে গিয়ে মনের কথা জানতে চাইছে, ‘What is on your mind?’ আমার শরীর-মন দখলীকৃত আজ! কোথায় পালাব আমি?
আগ্রহীদের জন্য বিস্তৃত পাঠসূত্র:
০৩. পিট সিগারের গান: Little Boxes
০৪. “ছোট বাক্স, ছোট বাক্স: (অ-) সত্য ঘরের (অ-)যুক্তি ‘Little Boxes: (Il)Logic(S) of Truth-Room(S)'”
০৪: ১. “Little Boxes: (Il)logic(s) of Truth-Room(s)””
০৫. Dewan Housing Finance Corporation Ltd.(DHFL)”
০৬: ১. AN RTI ON THE ALLEGED COLLUSION AMONG DAWOOD-MIRCHI-RKW-DHFL-BJP”
০৮. NARENDRA MODI ONE OF THE BEST PRIME MINISTERS OF OUR COUNTRY EVER PRODUCED: RAMAKRISHNA MISSION”
০৯. The Curious Case of the Ramakrishna Mission: The Politics of Minority Identity”
১০. SEARCHING FOR SYNCRETISM Part 2″
১১. Ban the anti-Hindu Ramakrishna-Vivekananda Tradition– We Need Homogenized Pasteurized Hindutva”
১২. RADHANATH SWAMI: AMBANI-PIRAMAL FAMILY’S GURUJI”
১২: ১. RELIGION-BUSINESS-POLITICS-GANGSTERS AND THE OTHER 99%”
১৩. We are in the same boat: DHFL Victims (a letter to the UPPCL)”
১৪. মূল, মৌল, মৌলিক আর মৌলবাদ নিয়ে কিছু ফান্ডা”
১৫. জীবনানন্দ দাশের কবিতা: ভূমিকা
১৬. THE PANDEMIC PANDEMONIUM: THE ONE WITH THE VACCINE
১৮. “তোমাদের পৈতেতে আমার খোলা চিঠি”
১৯. স্বীকারোক্তির সত্যিঘরের লীলেখেলা: “চির জীবন শূন্য খোঁজা”
২০. CPIM NOW: THE DOUBLE STANDARDS OF THE “REDS”
২১. এই মুহূর্তে, যখন এই লেখাটা লিখছি, তখন খবর এসে গেছে যে, গোলপার্কের রামকৃষ্ণ মিশনের শিবানন্দ হলের মঞ্চে মেয়েরা গান-নাটক ইত্যাদি কিছুই করতে পারবে না! আরেক কেরেশ্চান মিশনারি বিশ্ববিদ্যালয়, সন্ত জেভিয়ার্স এক অধ্যাপিকার বিরুদ্ধে ৯৯ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ দাবি করেছেন শুধু নয়, তাঁকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেছেন। (তাঁর অপরাধ (?), তিনি তাঁর ব্যক্তিগত, সোশ্যাল অ্যাকাউেন্টর প্রোফাইলে সুইমিং স্যুট পরে ছবি দিয়েছিলেন!—১২/০৮/২০২২]
২৩. “(অন-)অর্থনীতিবিদ রবীন্দ্রনাথ”
২৪. UNIFORM CIVIL CODE FOR THE HINDUS? REALLY SO?
২৬. পার্থ চাটুজ্জে অ্যান্ড কোং কেসটা তখনও বাজারে আসেনি। তবে আমি জানতুম। ‘অনিলায়ন’ মাথায় ছিলো কিনা!
২৭. এখন ফের নামকরণ হয়েছে ‘শিক্ষামন্ত্রক’!
২৮. Narrative of না-ইস্কুল বা/or Nice School
২৯. “হে প্রণম্য পিতৃদেব, তুমি তো বন্ধু নও/হও”
৩১. মনের দেহ দেহর মন: মায়ের গবভো-র ভিতর বাহির
৩২. “UNIFORM VEGETARIAN FOOD CODE” FOR ALL THE “HINDUS”???
৩৩. Legalizing Active Euthanasia in India
৩৪. আমি কেন আত্মহত্যা করব না? বলতে পারেন?
প্রচ্ছদচিত্র ও অন্য ছবি সৌজন্য: www.thewire.in, Middle-Tone