একটা পোয়েটিক জাস্টিস বোধহয় মানুষমাত্রেই প্রাপ্য। শিল্পী হলে তো কথাই নেই। আজ মনে হয়, তিন দশকের দীর্ঘ শিল্পীজীবনের সায়াহ্নে পৌঁছে, বাংলা রুপোলি পর্দার কাছ থেকে সেই মহত্তম বিচারের কিছুটা অন্তত পেয়েছিলেন স্বরূপ দত্ত। রাজা মিত্র নির্দেশিত ‘নয়নতারা’ (১৯৯৭) ছবিতে মানিক দত্তর ভূমিকায় ক্যামিওর সূত্রে। যদিও ক’জন খেয়াল করেছিলেন সেদিন পর্দায় দত্ত বনাম দত্তর উক্ত রসায়নকে বলা শক্তই। খুচখাচ নামোল্লেখের বাইরে সেই অর্থে পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়নের প্রায় কিছুই হয়নি—বাংলা রুপোলি পর্দার একদা জনপ্রিয় এই দীর্ঘদেহী অভিনেতাকে ঘিরে।

এই না-হওয়ার একটা কারণ সম্ভবত প্রচ্ছন্ন থেকে যায় ১৯৭৬-পরবর্তী তাঁর চলচ্চিত্রপঞ্জিতে এক দীর্ঘ বিরতির বাস্তবতায়। সে বছর তিনটি ছবি মুক্তি পায় তাঁর। তপন সিংহর নির্দেশনায় ‘হারমোনিয়াম’ এবং ইন্দর সেনের নির্দেশনায় ‘অসময়’ ও ‘অর্জুন’। বলা যায় মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে থাকতেই রহস্যজনক ভাবে রুপোলি পর্দা থেকে অন্তর্হিত হয়ে যান স্বরূপ দত্ত। যখন ফিরে এলেন, ততদিনে আমূল বদলে গিয়েছে পরিস্থিতি। মনে রাখা দরকার সময়টা আটের দশক। অনায়াসেই চিহ্নিত করা যায় যাকে বাংলা ছবির অবক্ষয়ের সূচনালগ্ন হিসেবে। এমনকি সত্যজিৎ রায়ের ছবি থেকেও যেদিন বেমালুম লোপাট হয়ে গিয়েছে—সেই সাবেক ইঙ্গিতময়তা, শিল্পিত পরিমিতি। সময়টাই আসলে ছিল নষ্টতার প্রহর; পরিণামে, যে চরিত্রগুলির সুবাদে একদা দর্শকের মুগ্ধতা অর্জন করেছিলেন অভিনেতা, ফিরে এসে আর সুযোগই হয়নি তেমন ‘রোল’ পাওয়ার। এরপর নয়ের দশকের প্রায় শেষ লগ্ন অবধি, যেসব মামুলি ছবিতে ততধিক মামুলি ভূমিকায় কাজ করে যেতে হলো, সে সব আর আলোচনাতেই আসে না। আজ মনে হয় উত্তমকুমার অকালে চলে গিয়ে এবং সুচিত্রা সেনও স্বেচ্ছায় নিজেকে সরিয়ে নিয়ে প্রকারান্তরে বাঁচিয়েই দিয়েছিলেন, বাঙালি দর্শককে, স্মৃতির উপর অত্যাচারের সাক্ষী রয়ে যাওয়া থেকে। স্বরূপ দত্তর মূল্যায়ন না হতে পারার নেপথ্যেই যেন সেই হিসেবে প্রচ্ছন্ন রয়ে যায়, আটের দশক থেকে বাংলা মূলধারার ছবির অধোগামিতার একটা ইঙ্গিত।

তবে যা যা বলা হলো পূর্ববর্তী অনুচ্ছেদে—সেই যাবতীয় যুক্তিতেও ব্যাখ্যা মেলে না, ১৯৬৮-১৯৭৬ পর্বের স্বরূপ দত্ত প্রসঙ্গে সেই অদ্ভুত নীরবতার। ওটুকু মূল্যায়ন অবশ্যই হতে পারত। বলে রাখি, রুপোলি পর্দায় তাঁর শিল্পীজীবনের দীর্ঘতা তিন দশক ছুঁলেও চলচ্চিত্রপঞ্জিকে কিন্তু নাতিদীর্ঘই (পাওয়া যায় মোটে তিরিশটি ছবির নাম) বলতে হবে, সেই অনুপাতে। আট ও নয়ের দশকে আর সেভাবে কাজ না পাওয়ার যুক্তিকে মেনে নেওয়া গেলেও, প্রথম পর্বের সোনালি দিনগুলিতেও মাত্রই চোদ্দোটি ছবির টাইটেল কার্ডে হাজিরা অবশ্যই কোয়ান্টিটির চাইতে কোয়ালিটির প্রতি বেশি বিশ্বস্ত রয়ে যাওয়ারই ইঙ্গিত।

ছবিগুলিতে চোখ রাখলে বেশ মিলেও যায় যে অনুমান। লক্ষণীয়, অরুন্ধতী দেবীর নির্দেশনায় ‘মেঘ ও রৌদ্র’-য় (১৯৭০) যিনি শশীভূষণ; ‘সমাপ্তি’-র কাহিনি অবলম্বনে সুধেন্দু রায়ের পৌরোহিত্যে হিন্দিতে নির্মিত ‘উপহার’-এ (১৯৭১) তিনিই অনুপ। এত অল্প ছবির পরিসরেও গল্পগুচ্ছের দুটি বিশিষ্ট রবীন্দ্র–নির্মিত কেন্দ্রীয় চরিত্রকে রূপায়ণের ঘটনা নজর কাড়ে বই-কি। প্রসঙ্গত এই মানুষটিই আবার পর্দায় শরৎসাহিত্যের নায়ক অতুলও। বলছি, ‘অরক্ষণীয়া’-র কাহিনি অবলম্বনে সুনীল বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় ‘মা ও মেয়ে’-র (১৯৬৯) কথা। পক্ষান্তরে ছয় ও সাতের দশকের সন্ধিক্ষণে সামাজিক ভাবে উত্তাল বাংলার সেই অস্থির যৌবনকে প্রায় ঐতিহাসিক দলিলের চেহারাতেই ফুটিয়ে তুলছিলেন যাঁরা সেলুলয়েডের ফ্রেমে, এই শক্তিশালী অভিনেতার নামটি তাঁদেরও অন্যতম। তপন সিংহর ‘আপনজন’ (১৯৬৮) ও ‘এখনই’ (১৯৭১) বা সুখেন দাসের ‘অচেনা অতিথি’ (১৯৭৩) এই ধারার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সোনালি অধ্যায়ের স্বরূপ দত্ত সেই নিরিখে রুপোলি পর্দায় যুগপৎ ক্লাসিক ও কনটেম্পোরারি।

এই দ্বিতীয় ধারার চরিত্রগুলিই ঘটনাচক্রে দাঁড় করায় তাঁকে সমসাময়িক আর-এক দুরন্ত অভিনেতা সমিত ভঞ্জর সঙ্গে তুলনায়। সাতের দশকের দর্শক বেশ উপভোগ করেছেন, পর্দায় দুজনার ডুয়েল। ‘আপনজন’ থেকেই যার সূত্রপাত। দর্শকের মনে থাকবে, কাহিনির দুই প্রতিস্পর্ধী মাসলম্যান ছেনো ও রবির ভূমিকায় এ ছবিতে দেখা গিয়েছিল যথাক্রমে সমিত ভঞ্জ ও নবাগত স্বরূপ দত্তকে। বহু সচেতন দর্শকের মতেই পেশাদার হুলিগানের ভূমিকায় সমিত ভঞ্জর মারকাটারি অভিনয়ের পাশে বেশ নিষ্প্রভই দেখায় স্বরূপ দত্তকে। ছবিটির জন্য বাংলা চলচ্চিত্র সাংবাদিকমণ্ডলীর বিচারে সমিত ভঞ্জর শ্রেষ্ঠ সহ-অভিনেতার পুরস্কারপ্রাপ্তিও (১৯৬৯) খানিক বৈধতাই দেয় যে মতবাদকে। যদিও এই মতাবলম্বীরা খেয়াল করেন না যে, দুই ভিন্ন সামাজিক পরিসর থেকে উত্থান ছেনো ও রবির। তাদের সাঙ্গোপাঙ্গদের চেহারাছবিতেও যে ফারাককে চোখে আঙুল দিয়েই দেখিয়ে দিয়েছিলেন নির্মাতা। আইন বা ভদ্রসমাজের চোখে হয়তো দু-দলেরই পরিচয় অরাজকতাবাদীর। কিন্তু বাঙালির ইতিহাস সাক্ষী, ভদ্র মধ্যবিত্ত পরিবারের কলেজ-পড়ুয়া সন্তানদেরও সেদিন অবলীলায় গ্রাস করতে লেগেছিল লুম্পেন সংস্কৃতির থাবা। সেই বিশেষ সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে আগত রবির চালচলন তথা বেশভূষায় তাই খানিক দূরত্ব রয়ে যাওয়াই সংগত ছিল ছেনোর চাইতে। সারা ছবি জুড়েই ছেনোর টি-শার্ট ও রবির শার্ট পরে থাকাও যেন সেই ফারাকেরই ইঙ্গিতবাহী।

জানা যায়, দর্শকাসনে পিতা ধীরেন দাসকে উপবিষ্ট দেখে, লক্ষ্মণের চরিত্রে অভিনয় করা তরুণ মঞ্চাভিনেতা অনুপকুমার এক সন্ধ্যায় অতি অভিনয়ে প্রায় নস্যাৎই করে দিয়েছিলেন ঋষি দুর্বাসার ভূমিকায় অবতীর্ণ চরিত্রাভিনেতাকে। বাড়ি ফিরে সেই রাত্রে প্রশস্তির পরিবর্তে বিস্তর উপদেশই হজম করতে হয় যার দরুন অভিনেতা পিতার নিকট। তপস্বীর প্রতি আচরণে কলাবাগানের গুন্ডার সঙ্গে কোথায় ফারাক রাজকুমারের সে বিষয়ে। আশা করি বুঝবেন পাঠক, কেন এই স্থলে উত্থাপিত হলো প্রসঙ্গটা।

একই রসায়ন লক্ষণীয় ‘অর্জুন’-এর বেলাতেও। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাহিনি অবলম্বনে, উদ্‌বাস্তু পল্লির পটভূমিকায় নির্মিত যে ছবিতে, দুই প্রতিস্পর্ধীর চেহারায় পর্দায় আবার দেখা মেলে দুই অভিনেতার। ‘আপনজন’-এর মতোই অতীত সখ্যতা আবারও রূপ ধরে শত্রুতার। কলোনির ঘরে ঘরে শিক্ষিত সুবক্তা অর্জুনের (চরিত্রায়নে স্বরূপ দত্ত) জনপ্রিয়তা ঈর্ষান্বিত করেই তুলেছিল রাহাজানির রাজা দিব্যকে (চরিত্রায়নে সমিত ভঞ্জ)। অনুঘটকের রূপ ধরে ইতিমধ্যে আবির্ভাব ঘটে, ধুরন্ধর কেওল সিং-এর (চরিত্রায়নে অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়)। কলোনির ঘরে আগুন দিয়ে সেই জমিতে কারখানা তোলাকে কেন্দ্র করে শেষ অবধি বেধে যায় ধুন্ধুমার। যে সংঘর্ষে দুই যুযুধান সেনাপতির ভূমিকা এসে পড়ে—দুই প্রতিস্পর্ধীর কাঁধে।

ছবির আখ্যান মোতাবেক যেটা লক্ষণীয়, অর্জুনের অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়ার নেপথ্যে স্বার্থ বলতে যা ছিল তা সমষ্টির। কিন্তু দিব্যর বেলায় সংঘাতের ইন্ধন প্রচ্ছন্ন ছিল ব্যক্তিস্বার্থে। উপরন্তু অর্জুনের শক্তি ছিল তার শিক্ষায় (ছবির সূচনায় যাকে পাঠ করতে দেখা যায়, সুকান্ত ভট্টাচার্যর কবিতা)। যেখানে শক্তি বলতে নেশা ও অপরাধের পথে হাঁটতে থাকা দিব্য বুঝত পেশির সামর্থ্যকে। অর্জুনের মতো মানুষ হাতে অস্ত্র তুলে নেওয়ার আগে আঁকড়ে ধরতে চায় শান্তির পথে সমাধানের শেষ বিকল্পটাও। যে বাধ্যবাধকতা থাকে না দিব্যর মতো মস্তানের। দুই জাতের চরিত্রে অভিনয়ও তাই দুই ভিন্ন ভাষার ব্যাকরণ মেনেই এগোয়। পালটে যায় কর্তা-কর্ম-ক্রিয়ার ক্রমিক বিন্যাস।

তার অর্থ এই নয় যে ডাকাবুকো দুষ্কৃতীর ভূমিকায় অভিনয়ের সামর্থ্য ছিল না অভিনেতা স্বরূপ দত্তর; রুপোলি পর্দায় জীবনের প্রথম নির্দেশকের নির্দেশনায় কাজ করা শেষ ছবি, ‘হারমোনিয়াম’-এ, সেই সামর্থ্যকে সপাটেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন চরিত্রাভিনেতা—দুর্ধর্ষ খুনে ডাকাত হারান ঘোষের ভূমিকায়। পতিতাপল্লিতে যার পা পড়তেই থেমে যায় সব গানবাজনা। মিলিয়ে যায় মেয়েদের মুখের হাসি। শুকিয়ে আমসি হয়ে যায় সেই আমুদে হারমোনিয়ামবাদক রতনের (চরিত্রায়নে সমিত ভঞ্জ) চোখ মুখ। হ্যাঁ, সমিত ভঞ্জ বনাম স্বরূপ দত্তর রসায়ন একেবারে উলটে যায় এ ছবিতে।

এই একটি ছবিই সম্ভবত প্রমাণ করে, নিজেকে লোকপ্রিয় ভাবমূর্তির ঘেরাটোপে আগলে রাখার মানুষই ছিলেন না স্বরূপ দত্ত। অশোকের ভূমিকায় ঝুলনের (চরিত্রায়নে তনুজা) সঙ্গে অনুরাগ পর্বে ঠোঁটের কোণে যে মিষ্টি হাসিতে মজেছিল দর্শক, ‘পিতাপুত্র’-য় (১৯৬৯), হারানের ভূমিকায় একেবারে অপাঙ্‌ক্তেয় হয়ে পড়েছিল সেই ট্রেডমার্ক হাসিটুকুই। তবু নায়কের ভূমিকায় একটানা কাজ করে চলার ফাঁকে ওই দুর্ধর্ষ দুষ্কৃতীর রোলে নেমে পড়াই বুঝিয়ে দেয়, সেই অধুনালুপ্ত যুগটারই সার্থক প্রতিনিধি ছিলেন স্বরূপ দত্ত, যেকালে ম্যানারিজমের চাইতে শিল্পীসত্তার পরিপূর্ণতার মূল্য বহুগুণে অভিপ্রেত ছিল অভিনেতার কাছে। ভাবমূর্তির আপাত নিরাপদ ঘেরাটোপ থেকে এত নির্দ্বিধায় বেরিয়ে আসার দামটাও যদিও চোকাতে হয়েছিল কড়ায় গন্ডায়। রূপকথার রাজপুত্রের মতো রূপে, ভাটা পড়ার পর, আটের দশক থেকে পরপর কাজ করে যেতে হয় তৃতীয় শ্রেণির খলনায়কের ভূমিকাতেই। তবে সে সব কথায় পরে আসব আমরা। আপাতত বলা যায়, কোমরে গুলি খাওয়ার পর হারানের মুখে চোখে ফুটিয়ে তোলা সেই মরণ-মুহূর্তের এক্সপ্রেশনেই, অভিনেতা হিসেবে নিজের জাত চিনিয়ে দিয়েছিলেন স্বরূপ দত্ত। যে দুরন্ত চরিত্রায়নের সঙ্গে অবলীলায় মানিয়ে যায় ‘মাগির দালালি করতে করতে সব মাগি হয়ে গেছে’-র মতো সংলাপ।

একটা কথা যদিও সত্যই। তাঁকে নায়কের চেহারায় দেখতেই বেশি পছন্দ করেছে দর্শক। যার নেপথ্যে অবশ্যই ইন্ধন রয়ে যায় সেদিনের দেবদুর্লভ রূপের (পর্দায় হারান ঘোষ হয়ে উঠতেও যার দরুণ মাখতে হয়েছিল প্রচুর কালিঝুলি)। তরুণ স্বরূপ দত্তকে অনায়াসেই চিহ্নিত করা যাবে—বাংলা রুপোলি পর্দার সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম পাঁচ সুদর্শন অভিনেতার অন্যতম হিসেবে। বিংশ শতকের বাঙালি পুরুষের বহিরঙ্গে খুব সহজলভ্য ছিল না যে রূপ—তারই জোয়ার ছিল সেদিনের স্বরূপের চেহারায়। যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল মর্যাদাপূর্ণ পারিবারিক প্রেক্ষাপট ও শিক্ষাদীক্ষার আভিজাত্য। প্রসঙ্গত জুন ২২, ১৯৪১-এ কলকাতার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করা স্বরূপ দত্ত সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে সম্পূর্ণ করেন অর্থনীতিতে স্নাতকের পাঠ। ছিলেন সাউথ পয়েন্ট হাই স্কুলের ছাত্র। এই পর্বেই ইতিহাস ও ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে পাওয়া খ্যাতনামা নাট্যকার ও অভিনেতা উৎপল দত্তকে। অভিনয়ে আগ্রহ ও পারিবারিক কংগ্রেসিয়ানার বিপ্রতীপে বামপন্থায় অনুরক্তির সেই সূত্রপাত। এই সবটা মিলিয়েই হয়তো আবির্ভাবেই চিহ্নিত হয়ে যাওয়া সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সম্ভাব্য উত্তরসূরির তকমায়।

লক্ষণীয় স্রেফ চেহারার সাদৃশ্যই নয়, যে বুদ্ধিজীবীর ভাবমূর্তি ব্যক্তি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে ঘিরে ছিল আজীবন, প্রথম পর্বের স্বরূপ দত্তর চলচ্চিত্রপঞ্জিতেও যেন রয়ে যায় তার স্পর্শ। সেটা নিছক ক্লাসিক সাহিত্যের পাতা থেকে উঠে আসা চরিত্রগুলির খাতিরেই নয়। বরং যে কনটেম্পোরারি চরিত্রদের ফুটিয়ে তুলেছিলেন পর্দায়, তাদের অন্তরঙ্গেও ছিলই বুদ্ধিবৃত্তির ছোঁয়াচ। মনে করা যাক রমাপদ চৌধুরীর কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত ‘এখনই’-র অরুণকেই। যার বিশিষ্টতাকে চিনতে যথেষ্ট সেই একটা সংলাপই,

…আমরা দিনরাত সবাই শুধু কথা বলছি। অথচ মজা দেখ আমরা কেউ কারুর কথা বুঝতে চাই না। তাহলে কথা বলার দরকার কী? কতগুলো আওয়াজ, কতগুলো অর্থহীন শব্দ, তাই না?

ছাপোষা লোক নয়, এ প্রায় এক বুদ্ধিজীবীর উক্তি। যার তার বয়ানে এই সূক্ষ্মতাকে প্রয়োগের চিন্তাই আসবে না নির্মাতার ভাবনায়। খেয়াল করার, অরুণের জবানিতে ছবির আনাচকানাচেই ছড়িয়ে থাকে এমন সংলাপ। নির্দেশকের তরফে যে প্রয়োগই প্রকারান্তরে বুঝিয়ে দেয় সংশ্লিষ্ট চরিত্রের ওজন। যার চরম আধুনিক মনের সাক্ষ্য মেলে ছবির উপসংহারে। যখন অয়নের (চরিত্রায়নে শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়) ঔরসে সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়া ঊর্মিকে (চরিত্রায়নে অপর্ণা সেন) লোকলজ্জা বা ভ্রূণহত্যার যে-কোনো একটি বিকল্প বেছে নেওয়া থেকে বিরত করতে তার হাত ধরে জনস্রোতে মিশে যায় অরুণ।

তপন সিংহর ছবিতে, স্বরূপ দত্তর আর-একটি বুদ্ধিজীবী ঘেঁষা চরিত্রে অভিনয়, বামপন্থী পার্টিকর্মী অমলের ভূমিকায়। বলছি, রূপদর্শীর কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত ‘সাগিনা মাহাতো’ (১৯৭০) বা হিন্দি সংস্করণে ‘সাগিনা’-র (১৯৭৪) কথা। ছয় ও সাতের দশকের সন্ধিক্ষণে যখন বামপন্থার হাওয়া জোরালো হয়েছে বাংলার সামাজিক জীবনে, তখনই পর্দায় আসা ছবিটির। ধারক কালখণ্ড ১৯৪২-৪৩ হলেও, যার দরুন চরিত্রে ভীষণই সমকালীন ছবিটি। প্রসঙ্গত, অনেকেই সুনজরে দেখেননি সেদিন এ ছবিকে। যেহেতু ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের মুখোশ খুলে দেয় ‘সাগিনা মাহাতো’। চিনিয়ে দেয় অনিরুদ্ধর (চরিত্রায়নে অনিল চট্টোপাধ্যায়) মতো তথাকথিত বামপন্থী নেতার আসল চেহারাকে।

তা বলে দক্ষিণপন্থার হাত ধরতে যে বলে না এ ছবি, মালুম হবে অনিরুদ্ধর পাশাপাশি অমলের অস্তিত্বশীলতায়। এ যেন অনেকটাই ক্ষমতায় কায়েম বামপন্থার সমান্তরালেই বিনয় চৌধুরীর মতো মানুষদেরও থেকে যাওয়া। মনে পড়ে, সাগিনাকে (চরিত্রায়নে দিলীপকুমার) বাস্তিল দুর্গের পতনের কাহিনি শোনাতে শোনাতে অমলের চোখ মুখের সেই আশ্চর্য উদ্ভাস। বিশিষ্ট চলচ্চিত্র সমালোচক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের মতে, এ ছবি ব্যক্তিমানুষের একা হওয়ার। যাকে মান্যতা দিলে, প্রশ্ন উঠবে, কে তবে সেই নিঃসঙ্গতার নায়ক? যার উত্তর থেকে যায় ছবির গর্ভেই। বামপন্থার আদর্শে বিশ্বাস রেখে, ঘর সংসার ছেড়ে দলের অনুগত কর্মী হিসেবে অনেকটা পথ হেঁটে আসার পর, যেদিন আচমকাই টের পায়, সৎ কমরেড, নেতৃত্বের প্রতারণাকে, ভেতরে বাইরে অমলের মতো একা হয়ে পড়তেই কি হয় না তাকে? ছবির অন্তিমে, অনিরুদ্ধর সাজানো জনতার আদালতে দাঁড়িয়ে, গলা ফুলিয়ে ভণ্ড বামপন্থার বিপদ সম্পর্কে তাই সচেতন করে দিতে চেয়েছিল সে, পাহাড়ের নিরক্ষর মানুষগুলোকে। বাস্তবের গবেষণাগারে তত্ত্বের প্রয়োগকে ঘিরে আদর্শবান কমরেডের প্রতিক্ষণের দোলাচল, আস্থাবান হওয়া, সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন ও অজান্তেই শয়তানের দোসর হয়ে ওঠাকে—উপলব্ধির সেই প্রতিটি স্বতন্ত্র অভিব্যক্তিকে খুঁজে পাওয়া যায় এ ছবিতে, স্বরূপ দত্তর ঋদ্ধ অভিনয়ে। ‘সাগিনা মাহাতো’ সেই হিসেবে যতটা সাগিনা মাহাতোর ছবি প্রায় ততটাই অমলেরও।

সাগিনা মাহাতো, ১৯৭০
অন্ধ অতীত, ১৯৭২

প্রসঙ্গত, এই ছবির সূত্রে দিলীপকুমারের সঙ্গে ব্যক্তিগত স্তরে যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে স্বরূপ দত্তর, তা বজায় ছিল আজীবন।

তপন সিংহর নির্দেশনায় ১৯৬৮-১৯৭৬ অধ্যায়ে মোট পাঁচখানি ছবিতে অভিনয় করেন স্বরূপ দত্ত। বাংলার আর কোনো নির্দেশকের সঙ্গেই গড়ে ওঠেনি তাঁর যে স্তরের রসায়ন। কিন্তু রুপোলি পর্দায় স্বরূপ দত্তর জীবনের শ্রেষ্ঠ অভিনয় সম্ভবত ধরা আছে কালকূটের কাহিনি অবলম্বনে পীযূষ বসুর নির্দেশনায় ‘স্বর্ণশিখরপ্রাঙ্গণে’-র (১৯৭০) সেই কর্মপাগল প্রযুক্তিবিদ অমরের ভূমিকায়। যদি আজ মুক্তি পেত—আধুনিক সম্পর্কের জটিলতার আলোছায়ায় নির্মিত ছবিটি, অমরকে স্রেফ একটি শব্দে ব্যাখ্যা করতেন সমালোচকরা। ওয়ার্কঅ্যাহোলিক। নিজের প্রস্তাবিত নকশায়, নতুন প্রযুক্তিতে মেশিন বানানোর স্বপ্ন এক করে দিয়েছিল যার দিবানিশি। নৈশভোজে বসার ঠিক আগের মুহূর্তে কারখানা থেকে ফোন পেয়ে আবার ড্রয়িং-এ মগ্ন হয়ে পড়া হয়ে দাঁড়িয়েছিল সংসারের স্বাভাবিক চিত্রই। ভেসে যাচ্ছিল সামাজিকতা। যেখান থেকে সূত্রপাত সুমির (চরিত্রায়নে মাধবী মুখোপাধ্যায়) সঙ্গে মনোমালিন্যের। মা-বাবার মধ্যে দানা বাঁধতে থাকা যে জটিলতার ছাপ ক্রমে পড়তে শুরু করে ছোট্ট কাকলির (চরিত্রায়নে বেবী রিতু) শিশুমনেও।

খেয়াল করার, অমরের ব্যক্তিত্বের সামনে সুমির অবদমিত হয়ে চলাই ছিল এ ছবির চিত্রনাট্যের দাবি। দাম্পত্য কলহের দৃশ্যগুলিতে পর্দা ভাগ করে নেওয়ার মুহূর্তে, ততদিনে রুপোলি পর্দায় সুপ্রতিষ্ঠিত মাধবী মুখোপাধ্যায়ের বিপরীতে, একবিন্দু আড়ষ্টতাও ধরা পড়ে না স্বরূপ দত্তর দাম্ভিক অভিনয়ে। কথাটা আলাদা করে উল্লেখ্য যেহেতু ‘স্বর্ণশিখরপ্রাঙ্গণে’ মাত্রই চতুর্থ ছবি অভিনেতার চলচ্চিত্রপঞ্জিতে। সুমির কাছে ধরা দিতে, কলকাতা থেকে পাহাড়ে ছুটে এসেও, তার বাক্যবাণে আচমকাই অমরের পৌরুষের ফুঁসে ওঠাকে যে নিমেষের অভিব্যক্তিতে বুঝিয়ে দেন অভিনেতা—তার দরুন কোনো প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। ঠোঁটের কোণে ঝুলে থাকা সেই হালকা হাসির রেশটুকু পলকে অন্তর্হিত হয়ে চিবুকের রেখার দপদপিয়ে ওঠা। যত চকিতে পর্দায় ঘটে যায় এত বৃহৎ ভাবান্তরখানা তা অতি উচ্চাঙ্গের অভিনেতারই চরিত্রলক্ষণ। স্বর্ণযুগের সাদাকালো বাংলা ছবির রুপোলি পর্দায় যে প্রবল প্যাট্রিয়ার্কদের দেখা মিলত, ছবি বিশ্বাস, নীতিশ মুখোপাধ্যায় বা কমল মিত্রদের চেহারায়, তাঁদের ব্যক্তিত্বের বীজ যে সুপ্তই ছিল স্বরূপ দত্তর শিল্পীসত্তার অন্তস্থলে, এই একটি ছবিই তার যথেষ্ট প্রমাণ।

যেটা বিস্তর আক্ষেপের, এমন রূপবান অভিনেতাকে প্রেমিকের চেহারায় খুব বেশি পায়নি বাংলা রুপোলি পর্দা। জীবনের প্রথম ‘রোমান্টিক রোল’-টি পাওয়া যদিও উত্তমকুমারের বদান্যতায়। যেহেতু অশোকের ভূমিকায় ‘পিতাপুত্র’-য় অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের প্রথম পছন্দ ছিল মহানায়ককে। কিন্তু সদ্য ডাক্তারি পাশ করা নায়কের বয়সের কথা ভেবেই নবাগত স্বরূপ দত্তর নামটি নির্দেশকের কাছে প্রস্তাব করেন উত্তমকুমার নিজেই। যার দৌলতেই ঘটতে পেরেছিল বাঙালি রমণীর প্রতি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সেই অমোঘ উচ্চারণে ঠোঁট মেলানোর সুযোগ। ‘রাগ যে তোমার মিষ্টি আরও অনুরাগের চেয়ে’…

যে ক’টি মধুর আলাপ শোনা গিয়েছে বাংলা রুপোলি পর্দায় শ্যামাঙ্গিনি কন্যার প্রতি, তাদেরই একটিও তাঁর ঠোঁটেই। বলছি, ‘মা ও মেয়ে’ ছবিতে কৃষ্ণাঙ্গী জ্ঞানদা-য় (চরিত্রায়নে মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়) মোহিত প্রেমিক অতুলের ভূমিকায় মান্না দে-র সেই আকুতির সংগতে ঠোঁট নাড়ানোর কথা। ‘ও কোকিল-কালো কন্যা তোমার ভ্রমর-কালো আঁখি’…

তবে, রোমান্টিক রোলে স্বরূপ দত্তর জীবনের শ্রেষ্ঠ অভিনয়ের সাক্ষী থেকেছে বম্বে। ‘সমাপ্তি’-র কাহিনি অবলম্বনে হিন্দিতে নির্মিত ‘উপহার’-এ, প্রোটাগনিস্ট অনুপের (মূল গল্পে পাত্রের নাম যদিও ছিল অপূর্ব) ভূমিকায়। খেয়াল করার চিত্রনাট্যমাফিক এ ছবি ডানপিটে বালিকা থেকে মৃন্ময়ীর (চরিত্রায়নে জয়া ভাদুড়ি) গৃহবধূ হয়ে ওঠার। যাকে ঘিরে সব আশা একরকম ছেড়েই দিয়েছিল সবাই, সেই মেয়েটিরই এতখানি রূপান্তর ঘটতে পারে শুধু অনুপের বিহনেই। অনুপের উপস্থিতি যা পারেনি, তাই অবলীলায় ঘটিয়ে দেয় তার অনুপস্থিতি। এত বড় ঘটনাটার ব্যাখ্যা বোধহয় লুকিয়ে থাকে খোদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কলমের ক’টি আঁচড়েই,

অপূর্বর বড়ো কঠিন পণ। দস্যুবৃত্তি করিয়া কাড়িয়া লুটিয়া লওয়া সে আত্মাবমাননা মনে করে। সে দেবতার ন্যায় সগৌরবে থাকিয়া স্বেচ্ছানীত উপহার চায়, নিজের হাতে কিছুই তুলিয়া লইবে না।

এমন গভীর প্রেমময় পুরুষহৃদয়কে সাহচর্য নয়, সচরাচর বিরহেই উপলব্ধি করতে পারে রমণীর মন। নায়িকাপ্রধান হওয়া সত্ত্বেও যে কারণে ছবির ‘নায়ক’ অনুপই। এমন মাহাত্ম্যপূর্ণ একটি রাবীন্দ্রিক চরিত্রের অন্তঃস্থলের প্রতিটি সূক্ষ্ম অভিব্যক্তিকে পর্দায় নয়নাভিরাম হয়ে উঠতে দেখা যায়—স্বরূপ দত্তর গভীর অথচ প্রশান্ত অভিনয়ে। প্রসঙ্গত এই চরিত্রায়নের সুবাদেই সুযোগ হয়েছিল, খোদ ‘ভয়েস অব‌্ গড’ মহম্মদ রফির কণ্ঠে ঠোঁট মেলানোর।

একটু আগেই উঠেছিল শিল্পীজীবনের গোড়ার দিনগুলিতে চেহারা ও ভাবমূর্তিতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে সাদৃশ্যের যে প্রসঙ্গটি, ঘটনাচক্রে ‘উপহার’-ও সংশ্লিষ্ট থাকতেই পারে সেই আলোচনায়। যেহেতু ‘তিন কন্যা’-র (১৯৬১) অন্তর্গত ‘সমাপ্তি’-র নায়ক অমূল্যর (এই দফাতেও পরিবর্তিত হয় পাত্রের নাম) ভূমিকায় সত্যজিৎ রায় নির্বাচিত করেছিলেন নিজের প্রিয় অভিনেতাকে। গল্পগুচ্ছর একটি বিশিষ্ট পুরুষ চরিত্র—সেই নিরিখে যথাক্রমে বাংলা ও হিন্দি রুপোলি পর্দায় অক্ষয় হয়ে আছে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও স্বরূপ দত্তর চেহারায়। যোগাযোগের কী বিচিত্র চিত্রনাট্যই না!

কিন্তু এমন যোগাযোগের পরিণাম কি সুখকর হয় সবখানেই? বোধহয় না। ঘুণাক্ষরেও কি ভেবেছিলেন, অভিনেতা, এমন চিত্রনাট্যই একদিন আরও এক রাবীন্দ্রিক চরিত্রের পরিণতির অবিকল পুনরাবৃত্তি ঘটাবে তাঁর জীবনেই!

একটু প্রসঙ্গান্তরে যেতে হবে আমাদের। আগেই বলা হয়েছে, বামপন্থী মতাদর্শে আস্থা ছিল অভিনেতার। যদিও তেমন বড় কথা নয় সেটা। সেকালের শিল্পীদের সিংহভাগই ছিলেন উক্ত শিবিরে। কিন্তু শৌখিন বামপন্থা এক বস্তু, সক্রিয় রাজনীতির ছোঁয়াচ আর-এক। উপরন্তু সত্যজিৎ রায়ের ছবির সূত্রে আন্তর্জাতিক পরিচিতি পেয়ে যাওয়া সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আর সদ্য খানদশেক ছবিতে কাজ করা স্বরূপ দত্তর সামাজিক মহিমা তো আর সমান ছিল না। সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িত থাকা ও সরকারের অপছন্দের নাটক মঞ্চস্থ করার ফল মেলে হাতেনাতেই। সময়টা সাতের দশকের মাঝামাঝি। নিজের বাড়িতেই নিগৃহীত হতে হয় বালিগঞ্জ এলাকার এক ডাকসাইটে কংগ্রেস যুবনেতার পোষ্য হানাদারবাহিনির হাতে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ব্যতিরেকে রুপোলি জগতের আর একটি প্রাণীকেও সেই দুর্দিনে পাননি পাশে। যা মনে করায়, রাজশক্তির সঙ্গে লড়তে যাওয়া শশীভূষণের পরিণতি। সেই অভিমানেই কি সরে যাওয়া রুপোলি পর্দা থেকে? কারাগারের বাইরের পৃথিবীটাকে যেভাবে একদিন বেইমান মনে হয়েছিল শশীর! নাকি বাকিরাই এড়িয়ে চলতে শুরু করেন তাঁর সংস্পর্শ! যেভাবে পর্দার হরকুমারকে (চরিত্রায়নে প্রসাদ মুখোপাধ্যায়) দেখা যায় শশীর সঙ্গে সম্পর্কের সব সুতো ছিঁড়ে দিতে! যার পরিণামে তার জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া, বালিকা গিরিবালার (চরিত্রায়নে হাসু বন্দ্যোপাধ্যায়)। যেটাই ঘটে থাকুক বাস্তবে, পরিণাম সেই নিয়তির কালো মেঘে ঢাকা পড়া একমুঠো সোনালি রৌদ্রের। জানা যায়, অভিনেতা-পুত্র অধুনা নির্দেশক সারণ দত্তকেও ছাত্রাবস্থায় পিতা প্রসঙ্গে পাঠভবনের সহপাঠীদের পুনঃপুন কৌতূহলী প্রশ্নের মুখে বরাবর অবলম্বন করে চলতে হয়েছে নীরবতা।

যেটা জানার আর উপায় নেই, পরবর্তীকালে জীবনের প্রথম নির্দেশককে আত্মজীবনীতে সেই যুবনেতাটি সম্পর্কে সপ্রশংস হতে দেখা, আহত করেছিল কিনা। যদিও ‘আতঙ্ক’-র (১৯৮৬) সূত্রে, বাম সরকারের চোখে তপন সিংহর নিজেরও কালো তালিকাভুক্ত হয়ে যাওয়াও এক ঐতিহাসিক সত্যই। দুই ভিন্ন ভিন্ন যুগে, যুগপৎ অভিনেতা ও নির্দেশকের পরিণতি চোখে আঙুল দিয়েই দেখিয়ে দেয়, আসলে চিরদিনই চলে আসছে সেই একই ট্র্যাডিশন। তবে ক্ষমতায় আসীন বামশক্তির মনসবদারদেরও যখন দেখেছেন, সেই নেতাটির সঙ্গে সুসম্পর্কই রক্ষা করে চলতে, অভিমান কি উত্তাল হয়ে ওঠেনি? আজ মনে হয়, সাতের দশকের পৃথিবীটা ছিল এক অন্য গ্রহই। যেখানে চাকরির ইন্টারভিউতে কম্যুনিস্ট হিসেবে শনাক্ত হয়ে যাওয়ার ভয় না করে, ভিয়েতনাম যুদ্ধকে চন্দ্রাভিযানের চাইতে সমকালীন মানবেতিহাসের বেশি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে চিহ্নিতকরণের সাহস দেখাতে পারত বাঙালি। নিঃসন্দেহে আজকের আত্মমর্যাদাবোধহীন বাঙালির সেই অধুনালুপ্ত প্রজাতিটারই প্রতিনিধি ছিলেন স্বরূপ দত্ত।

আটের দশকে বাম আমলে যখন ফিরে আসছেন পর্দায়, ততদিনে বদলাতে শুরু করেছে শিল্পরুচি। বম্বের অনুকরণে রংচঙে ব্লকবাস্টারের বাইরে নির্মিত হচ্ছিল যে আপাত সামাজিক ছবিগুলি, শিল্পগুণের নিরিখে অধোগতিই ঘটে গিয়েছিল তাদের। যে গভীর জীবনবোধের সংস্পর্শ ‘স্বর্ণযুগ-এর বাংলা ছবিকে একাধারে উন্নীত করত শৈল্পিক মার্গে আবার পালন করত সুস্থ মনোরঞ্জনী ভূমিকাও, এই দশকে তার জায়গা নিল জীবনবোধের বিচারে ফাঁপা অথচ আপাত মূল্যবোধের একরাশ ছবি। সংশয় নেই, ক্রমবিবর্তিত বাঙালির নিজস্ব সামাজিক বাস্তবতাই সেদিন রুপোলি পর্দায় বিনির্মাণ ঘটাচ্ছিল এই গোত্রের ছবিগুলির। অভিনয়ের সূক্ষ্মতা প্রদর্শনের সুযোগ সচরাচর থাকত না, যেহেতু চরিত্রগুলি হত সাদা নয়তো কালোর স্থূল ছাঁচে ঢালা। ছাঁচে ঢালা মনুষ্যত্বই যেহেতু অভিপ্রেত হয়ে উঠছে সেদিন বাঙালির কাছে। রুপোলি পর্দার নায়কও যে কারণে হয়ে উঠছিল স্কুলের ফার্স্ট বয়ের মাপেই ভাবমূর্তির দাস। তলিয়ে ভাবলে মনে হয়, অধুনা ছোট পর্দার অশিল্পিত ধারাবাহিকগুলির বীজ প্রকৃত প্রস্তাবে সুপ্ত ছিল আটের দশকের উক্ত ছবিগুলির অন্তরঙ্গেই।

প্রসঙ্গত এই প্রশ্নটাও ভাবাবে, মধ্যবিত্ত বাঙালির চেতনায় ফার্স্ট বয়ের অমন ভাবমূর্তিই বা কবে বিনির্মিত হলো? তার সাবেক কিশোরপাঠ্য কাহিনির ‘ফার্স্ট বয়’ যেখানে ফুটবলের মাঠ থেকে পড়শির বিপদে সদাই অগ্রণী, সেখানে, কবে থেকে পছন্দ শুরু করল বাঙালি, শক্তিহীন স্বার্থপর ক্ষুদ্রস্বার্থের উপাসকের চেহারায় তার ‘ভালো ছেলে’-কে দেখতে? ছয়ের দশকে যতই রুপোলি পর্দার নায়িকার লিপে শোনা যাক: ‘যত দুষ্টু ছেলেরাই লক্ষ্মী’; বৃহত্তর ভাবে সামাজিক ব্যাধিটার জাঁকিয়ে বসা উক্ত আটের দশকেই। সম্ভবত নকশাল আমলে হাজার হাজার মেধাবী সন্তানের আত্মবলিদান—পরিণামে সতর্ক স্বার্থান্বেষী করে তুলেছিল, জাতিকে। পরিণতিটা হাতেনাতেই ফলতে লেগেছে আজ। বাঙালির ঘরের উচ্চমেধা অধুনা রাজনীতিবিমুখ, আত্মমর্যাদাবোধহীন, ক্ষমতার সামনে নতজানু। কর্পোরেট ও রাজনীতির তল্পিবহনেই তার মোক্ষ।

ফিরে আসা যাক পুরোনো কথায়। যদিও ভাবমূর্তির তাড়না আটের দশকে চিত্রনাট্যেই ফতে করে দিত নায়কের কেল্লা, তবে ডাকাতি-গুন্ডামির দৌলতেই তাও কিছু রক্তমাংসের ছোঁয়া থেকে যাচ্ছিল খলনায়কের চেহারায়। সেই সূত্রেই থেকে যাচ্ছিল কিছু কিছু অভিনয়ের সুযোগও। হোক চরিত্রগুলি যতই তৃতীয় শ্রেণির। খেয়াল করার সরোজ দে-র নির্দেশনায় ‘কোনি’-র (১৯৮৬) প্রণবেন্দুর মতো এক-আধটা দৃষ্টান্ত বাদ দিলে, ১৯৮৩-১৯৯৮ পর্বের স্বরূপ দত্ত রুপোলি পর্দার এক দুর্ধর্ষ ভিলেনের নাম। ততদিনে ভারী হয়ে যাওয়া শরীরও ইন্ধনই জুগিয়েছিল এই ভূমিকাবদলের নেপথ্যে। অন্যভাবেও বিশ্বাসঘাতকতা শুরু করেছিল সেই সাবেক সৌন্দর্য। শরীরময় ছড়িয়ে পড়ছিল সাদা দাগ। অন্তিমে যে পরিণতি ঘটে খোদ নটী বিনোদিনীর ভাগ্যেও।

স্রেফ অভিনয়ের মুনশিয়ানাতেই নায়ককে ছাপিয়ে কীভাবে নেতিবাচক চরিত্রেও বাক‌্‌রুদ্ধ করে তোলা যায় দর্শককে, বুঝিয়ে দেবেন ‘চোখের আলোয়’ (১৯৮৯) ছবিতে সুরেশের ভূমিকায়। সাতের দশকের মিষ্টি নায়ককে যে ছবির সূত্রে স্রেফ ভুলে যাবে দর্শক—সেই বিস্ফারিত চোখের তারায় ফুটে ওঠা ক্রূর শয়তানির ছবিতে। যদিও প্রশ্ন তোলাই যাবে, অমন আপাদমস্তক শয়তান কেন টেপ করে রাখে নিজের যাবতীয় দুষ্কৃতির প্রমাণ। তবে সে উত্তর দেওয়ার দায় নির্দেশকের। অভিনেতা স্বরূপ দত্তর অবশ্যই নয়।

মনে পড়ে, ‘অন্ধ অতীত’-এর (১৯৭২) শেষ পর্বে, প্রবীরের (চরিত্রায়নে স্বরূপ দত্ত) অনবদ্য সওয়ালে মন্ত্রমুগ্ধ চেম্বার অব‌্ কর্মাসের সভাপতি নির্মলেন্দু রায়ের (চরিত্রায়নে উত্তমকুমার) সেই উক্তিকে: ‘ইউ শ্যাল হ্যাভ ইট’। এখানে লক্ষণীয় ইংরেজি মধ্যম পুরুষে ‘শ্যাল’ শব্দের অসামান্য প্রয়োগ। মোটরগাড়ির স্টিয়ারিং সোজা রেখে পাহাড়ের দু-হাজার ফিট উঁচু সেই সুইসাইড পয়েন্টের ঠিকানায় নিরুদ্দিষ্ট হওয়ার ঠিক পূর্বাহ্নে যে নিশ্চয়তা পুত্রসম সাংবাদিক প্রবীরকে দিয়ে যান জাস্টিস অব‌্ দ্য পিস নির্মলেন্দু রায়। তার আগে, একের বিপরীতে এক পরিস্থিতিতে খোদ মহানায়কের বিপরীতে পর্দায় তাঁকেও ছাপিয়ে উঠতে প্রত্যক্ষ করবে দর্শক স্বরূপ দত্তকে। সারা ছবি জুড়েই যদিও নির্মলেন্দু রায়ের মাপের ব্যক্তিত্বের উপর নীরব চাপ সৃষ্টির দৃশ্যে প্রবীরের ভূমিকায় অতীব সপ্রতিভ উপস্থিতি তাঁর। সে সংলাপ প্রয়োগের ক্ষণে মুখের রেখার জ্যামিতিতেই হোক বা গোড়ালি দিয়ে পাথরে আঘাতের অভিব্যক্তিতেই। বান্ধবী সীমার (চরিত্রায়নে বুলন হাজরা) পিতা নির্মলেন্দু রায়কে নিজের পিতৃপরিচয় দেওয়ার মুহূর্তের সেই স্থির চাহনিকেও সহজে ভুলতে পারবে না দর্শক। কিন্তু যে সুবিচারের কথায় সেদিন অত বড় প্রতিশ্রুতিটা দিয়ে গিয়েছিলেন খোদ মহানায়ক, পর্দায় প্রবীরের ভূমিকা নির্বাহ করা সেই স্বয়ং অভিনেতা স্বরূপ দত্ত কি বাংলা রুপোলি পর্দার কাছ থেকে তা পেয়েছিলেন আজীবনেও? আশা করি মনে আছে পাঠকের, এই প্রসঙ্গটা থেকেই সূত্রপাত বর্তমান নিবন্ধের।

না, বিমল করের কাহিনি অবলম্বনে বিনির্মিত রাজা মিত্রর উক্ত ছবিতে পর্দায় দীর্ঘ উপস্থিতি ছিল না মানিক দত্ত চরিত্রটির। থাকার কথাও ছিল না। নয়ের দশকের শেষ পর্বের (যখন মফস্‌সলের মধ্যবিত্তর ঘরেও জনপ্রিয়তা পেয়েছে ছোট পর্দার ধারাবাহিক) পটভূমিকায় উপস্থাপিত নারীকেন্দ্রিক ছবিটি আদতে বঙ্গ রঙ্গমঞ্চের একদা জনপ্রিয় অভিনেত্রী ‘ছোট তারা’ নয়নতারা দত্তর (চরিত্রায়নে মমতাশংকর) রোগজর্জর বার্ধক্যের শেষ ক’টি দিনের যাপনচিত্র। যার ঘটমান বর্তমানে অনুপস্থিত মানিক দত্তর মাঝেমধ্যে পর্দায় আসা ছেঁড়া ছেঁড়া ফ্ল্যাশব্যাকে। দশ মিনিটের হাজিরাও হবে না সব মিলিয়ে। কুমার (চরিত্রায়নে শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়) বা শৈলবাবুর (চরিত্রায়নে রবি ঘোষ) মতো ছবির অপরাপর পুরুষ চরিত্রদের ভাগেও যার চাইতে অনেকাংশে দীর্ঘতর উপস্থিতিই ধার্য রেখেছিল চিত্রনাট্য।

উপস্থিতির দীর্ঘতায় আসলে ধরা যাবে না অভিনেতার চলচ্চিত্রপঞ্জিতে এ ছবির তাৎপর্যকে। উদীয়মান স্বরূপ দত্তর নিয়তি যদি মনে করায় শশীভূষণকে, অস্তবেলার অভিনেতাকে পর্দায় একাকার হতে দেখা যাবে মানিক দত্তয়। যখন তিনশো রজনী ছোঁয়া ‘দুই পুরুষ’-এর কথায় বেজে ওঠে নেশাতুর মানুষটির সেই হাহাকার— ‘ওই বিডন স্ট্রিট আমি পোস্টারে পোস্টারে ছয়লাপ করে দিয়েছিলাম, মুড়ে দিয়েছিলাম’। সাফল্য সয় না সবার কপালে। সয়নি মানিক দত্তর। যেমন সয়নি খোদ স্বরূপ দত্তরও। শিল্পীজীবনের সায়াহ্নে পৌঁছে চরিত্রটি যেন তাই বাংলা রুপোলি পর্দার তরফে এক আংশিক ট্রিবিউটই বঞ্চিত অভিনেতাকে। ইতিবাচক চরিত্র কিছুতেই বলা যাবে না মানিক দত্তকে। কিন্তু খেয়াল করার, ছবির ঘটমান বর্তমানে গরহাজির হয়েও চরিত্রদের স্মৃতিতে সারাক্ষণই পর্দায় প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকা। ঠিক যেভাবে মাত্রই তিরিশখানি ছবির (যার অর্ধেকই আবার হয় অপাঙ্‌ক্তেয় নয়তো নাতিদীর্ঘ উপস্থিতির) সংক্ষিপ্ত চলচ্চিত্রপঞ্জি সত্ত্বেও বাংলা রুপোলি পর্দার ইতিহাসে এক বিশিষ্ট অবস্থান নির্ধারিত হয়েই থাকে অভিনেতা স্বরূপ দত্তর।

দিনটা ছিল জুলাই ১৭, ২০১৯। শেষ বিদায়েও মানিক দত্তকেই মনে করিয়ে দিয়েছিলেন অভিনেতা। মৃত্যুর খবর শোনার পর, বরাবরের শত্রুভাবাপন্ন যে লোকটিকে কাপুরুষ ভাবতে পারেননি খোদ নববাবুও (চরিত্রায়নে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়)। উপরন্তু মনে পড়বে, স্টেজ অ্যাক্টরের মতো মরতে চাইত মানিক। পতন ও মৃত্যু। যেটা লক্ষণীয়, শেষ বিদায়েও নিজের মেরুদণ্ডের সেই ঋজুতাকে চিনিয়েই দিয়ে গিয়েছিলেন স্বরূপ দত্ত। শিল্পীর জীবনবোধের পরোয়া না করে, তাঁর শেষযাত্রাকে কলুষিত কার্নিভালের রূপ দিয়ে—নিজের রাজনৈতিক মূলধন ঘরে তোলার মানুষগুলি ধারেকাছেও ঘেঁষতে পারেননি সেদিন, অভিনেতার মরদেহের। যদিও ‘দেহপট সনে নট সকলই হারায়’ আপ্তবাক্যকে ভুল প্রমাণ করেই যেন আট বা নয়ের দশকে পৃথিবীর আলো দেখা প্রজন্মেরও অনেকেই সেদিন দূর থেকে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছিল মানুষটিকে। দূরদর্শনের পর্দায় যারা দেখেছিল, তাঁর জীবনের সেই সোনালি দিনগুলির ছবি।

এখানেই শিল্পীর জয়।
সাতের দশকের বাংলা রুপোলি পর্দার লোকপ্রিয় নায়ক স্বরূপ দত্তর জয়।




প্রচ্ছদচিত্র ও অন্য ছবি সৌজন্য: www. gulfnews.com, www.getbengal.com