আজ বাজার যাইতে হইয়াছিল বলিয়া কথাটি উঠিতেছে। কেননা আগামীকাল হইতে রাজ্যের অন্যান্য পৌরসভার ন্যায়, এ অঞ্চলের মহামান্য পৌরপিতাও তাঁহার এলাকায় পুনরায় আরেক দফা ‘সম্পূর্ণ’ লকডাউন ঘোষণা করিয়াছেন। ইদানীংকালে লকডাউন শব্দটি প্রয়োগ করিবার সময় প্রতি মুহূর্তে আর তাহার সংজ্ঞা ঘোষণা করিতে হয় না। লকডাউনের অভিধা, লক্ষণা ও ব্যঞ্জনা, আজ সকলেই অল্পবিস্তর বুঝিয়া ফেলিয়াছেন।

বাজারের উদ্দেশ্যে বাটি হইতে বাহির হইবামাত্র অনুভূত হইল, যেন কোনো এক নিকটবর্তী কুরুক্ষেত্র হইতে যুদ্ধগ্রস্ত মানবজীবনের কলরব কর্ণগোচর হইতেছে। প্রাতঃকালের কোমল বাতাসে ভাসিয়া আসিতেছে সেইসব শশব্যস্ত শব্দপদাবলী। তাহাতে আর্তনাদ নাই ঠিকই, কিন্তু তাহাতে কলহ রহিয়াছে, প্রতিযোগিতা রহিয়াছে। ক্রমে অগ্রসর হইয়া মূল পথে গিয়া উঠিয়া ব্যাপারখানা দেখিতে পাইলাম, স্বচক্ষে। পথমধ্যে দেখিলাম, মনুষ্যগণ প্রাণপণে দিগ্‌বিদিক জ্ঞানশূন্য হইয়া ছুটিয়া চলিয়া বেড়াইতেছেন। কেহ ছুটিতেছেন আনাজপাতি সংগ্রহের তাগিদে, কেহ পর্যাপ্ত পরিমাণে আলু-পিঁয়াজ কিনিতেছেন। অপরদিকে চিকেনের ডিমের পসরা লইয়া পথপ্রান্তে বসিয়া পড়িয়াছেন কত মানুষ! একপ্রকার ধন্ধুমার কাণ্ড চলিতেছে রাজপথে। চিকেন-বিপণিগুলিতে সুদীর্ঘ সময়ব্যাপী অপেক্ষমাণ সদাচঞ্চল উদ্‌বিগ্ন তথা ‘ইমিউন’ বাড়াইতে সচেষ্ট মনুষ্যগণের ভাবগুলি এমন যে, কিছু না পাই, মুরগি খাইয়া দিন কাটাইয়া দিবো! কেহ চিৎকার করিয়া অপরকে সতর্ক করিয়া বলিতেছেন—মুসুরির ডাল তো ঘরে রহিয়াছে। চিন্তা কীসের? চালও ঘরে মজুত রাখা আছে যথেষ্ট। যাঁহারা বলিতেছেন, তাঁহারাই আবার ছুটিতেছেন। চঞ্চল হইতেছেন। তাঁহাদের দেখিয়া মনে হইতেছিল, আজকের দিনটি যেন ঘোষিত কোনো মন্বন্তর পর্বের প্রাক্কালে খাদ্য মজুত করিবার অন্তিম দিবস। ইহার পরে কবে যে পুনরায় মধ্যবিত্ত মনুষ্যকুল খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহ করিতে পারিবে—তাহার যেন কোনো সুনিশ্চিৎ মীমাংসা বুঝি নাই। যদিও এই চঞ্চল জনজীবন মন্বন্তরের সহিত তুলনীয় নহে। বরং শ্রীযুক্ত সত্যজিৎ রায় মহাশয় নির্মিত ‘পরশপাথর’ চলচ্চিত্রে, সোনা দুর্মূল্য হইয়া পড়িবার সংবাদ পাইবা-মাত্র যে হুড়াহুড়ি জনতার মধ্যে লক্ষ করা গিয়াছিল, শেয়ার বাজারে ধ্বস নামিয়া পড়ায়, শেয়ার-কারবারিদের চিত্তে যে উন্মার্গগামীতা জাগাইয়া তুলিয়াছিল—সেই চিত্রের সঙ্গে আজকের জনচঞ্চলতার সাদৃশ্য পাওয়া যাইবে।

আর একদল মানুষ, ওই পথপ্রান্তে উপবিষ্ট নবাগত চিকেন-ব্যবসায়ীদিগের মতোই ভাবিতেছেন, এই সুযোগে যদি কিছু উপার্জন করিয়া লওয়া যায়—তাহাতে মন্দ কী! চতুর্দিকের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্বন্ধে তাঁহারাও তো সকলের মতোই আশঙ্কা করিতেছেন, কেহ কেহ সেই সংকটে ভুক্তভোগীও বটে, কিন্তু কেহই বুঝিতে পারিতেছেন না—আসলে কী-ঘটনা ঘটিতে চলিয়াছে তাঁহাদের জীবনে। যাঁহাদের উপার্জন সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হইয়া গেছে—তাঁহারা কেবল অসুখের অপরদিক দেখতে পাইতেছেন মাত্র, তবু যেন ব্যাপারখানা ঠিক বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছেন না। একজন প্রপিতামহী-সম বৃদ্ধা, মলিন বস্ত্রে পথপ্রান্তে উবু হইয়া বসিয়া মানুষের মধ্যে এইরূপ অহেতুক ব্যস্ততা দেখিয়া উদাসীন চিত্তে খিলখিল করিয়া হাসিতেছিলেন। কেহই তাঁহাকে খেয়াল করেন নাই। পচা পিঁয়াজ বলিয়া ক্রেতা যখন সবজি বিক্রেতাকে ধমক দিতেছেন এবং সবজি বিক্রেতা উক্ত সচেতন ক্রেতাকে তাঁহার সততা প্রমাণ করিবার নিমিত্ত পচা পিঁয়াজ ও কাঁচা লঙ্কা ফেলিয়া দিতেছে, তখন সেই বৃদ্ধা পরম আনন্দে তাহা কুড়াইয়া নিজের কোমরের কোঁচড়ে ভরিয়া তুলিতেছেন। তাঁহার মুখে বুলি নাই, তাঁর চোখে চঞ্চলতা নাই। তিনিও বুঝিতে পারিতেছেন না—কী ঘটিতেছে, অথচ তিনি অচঞ্চল!

আজ প্রায় পাঁচ মাস হতে চলল, সাকুল্যে তিন-সেট আটপৌরে পাজামা আর পাঞ্জাবির ভেতরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বসবাস করছি, খাচ্ছি-দাচ্ছি, ঘুমোচ্ছি আর ডব্লিউএফএইচ অর্থাৎ ওয়ার্ক ফ্রম হোম করছি। এর মধ্যে তেমন করে ক্ষোভ প্রকাশ করিনি একবারও। আন্তর্জাতিক ও দেশীয়, সরকারি ও বেসরকারি স্তরে নানান হঠকারিতা, কুচক্রীপনা, শয়তানি খেয়াল করেও রাগ দেখাইনি। কেননা তার একমাত্র বা অন্যতম বড়ো কারণ ছিল এই যে, আমি এসবের মধ্যে, নতুন-পুরোনো নানা বিষয়ে পড়বার, লিখবার ও ভাববার অবকাশ খুঁজে নিতে পেরেছিলাম। আমি ঠিক করে নিয়েছিলাম, এই সুযোগে লেখাপড়ার কাজটা যতটা পারা যায় এগিয়ে নিয়ে যাব। ভুল জায়গায় ভুল চাকরি করে সেই কাজ এগিয়ে নিয়ে যাবার এমন সুযোগ তো সচরাচর মেলে না। আর একটা ভাবনা কাজ করছিল আমার মধ্যে। সেটা হলো, এই যে গোলোকায়নের নতুন অ্যাপ্রোচ, বিভেদের মাঝে মহামিলনের মতো প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয় বিশ্বকে একইরকম সাংস্কৃতিক ভাবনায় অভ্যস্ত করে তুলে, ‘একরকম অসুখ’ দিয়ে প্রায় সমগ্র মানবজাতিকে একইরকমভাবে বিব্রত করে তোলা—এর একটা অন্য দিকও আছে।

মানুষের অপর্যাপ্ত লোভ পৃথিবীকে যেভাবে ক্ষতবিক্ষত করছিল, তার থেকে ক’টা দিনের স্বস্তি পাক এই গ্রহ। এই মানবিক হাহাকারের মধ্যেও পৃথিবী নিজে তো দিব্যি আছে! পাখিরা, গাছগুলো, ওই মাকড়সারা, ওই কাঠবেড়ালির দল বরং একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচুক ক’দিন। মনে মনে মানুষকে বলেছিলাম, দ্যাখো এবার, কেমন লাগে! মানুষের পৃথিবীটা যে ‘আসল পৃথিবী’র শত্তুর সেটা বোঝো এবার! এখনও সময় খানিকটা বাকি আছে, শুধরোবে তো শুধরোও। দ্যাখো, শুধরোতে পারো কিনা! এইসব কথা ভেবেছি ও বলে এসেছি বলে, রাগ ধরেনি তেমন।

কিন্তু আজ ভয়ানক রাগ হচ্ছে। কারণ আজ আমি আমার কথা ভাবতে বসেছি। যে সরকারি, বেসরকারি, সামাজিক অনাচার এবং চেনা-অচেনা ব্যক্তি-মানুষের জীবনের যথেচ্ছাচার তদুপরি অকর্মণ্যতা দেখেও নিশ্চিন্তে পড়াশোনা চালিয়ে যাবার লোভে এতদিন চুপ করে ছিলাম, এখন সেইসব জিনিসগুলোই আমাকে এমন বিরক্ত করে তুলল—যে নিজেকে ঠিক রাখতে পারলাম না। এখানে অসহায় আম-আদমির কথা হচ্ছে না। যে-মানুষ অসহায় সে-মানুষের কি দুঃখ হয় নাকি? তার দুঃখ থাকতে আছে নাকি? যাকে তোমরা দুঃখ বলো! সেই দুঃখ তার নেই। তোমরা ভুল বুঝেছ। যে শিশু পায়ে হেঁটে লম্বা পথের শেষে লুটিয়ে পড়ল, কষ্ট, ব্যথা এসব তার নিজের—কিন্তু সে-কষ্টের উদ্‌যাপন তোমাদের। তোমরা যাকে দুঃখ বলো—তা আমার হয়েছে অনেকবারই। যাকে আদর করে বলো বিষাদ, যাকে বিরহ বলো বা যেসব জিনিসকে—উদ্‌বিগ্নতা, গলা শুকিয়ে আসা বা বুকের রক্ত হিম হয়ে আসা—এইসব বলো, সে-সবও কমবেশি আমার মধ্যে ঘটেছে, এই কঠিন সময়ে। কিন্তু কখনও রাগ হয়নি তেমন! অথচ আজ সমস্ত পাঞ্জাবি জুড়ে বিরক্তি নেমে আসছে শ্রাবণের ধারার মতো। কেন?

এইরকম সমস্ত এবং সর্বব্যাপী অচলাবস্থা আমি আগে কখনও উপলব্ধি করিনি বলে! না-না রেখে ঢেকে বলবার কিছু নেই। আর তাই যা বলতে চাইছি, তা সরাসরিই বলছি, যেমন লোকে ব্যক্তিগত ক্ষোভ উগরে দেয় নানা কারণে, তেমনই! আর এক্ষেত্রে সম্ভাষণ-রীতিতে আপনি-আজ্ঞের শিষ্টাচার এবং তুইতোকারির ঘনিষ্ঠতা পরিপূরক।

আমি রাজনৈতিক নেতাদের বা রাষ্ট্রের পরিচালকগণের কথা এখানে তুলছি না। ওঁদের চিনি ভালোই! বরং তোমাদেরই এখন বেশি অচেনা লাগে! অথবা বলছি না সেই ঐতিহাসিক পুঁজিবাদী শত্রুর কথা, যাঁরা তোমার-আমার সকলের স্মৃতি ও সত্তাকে, তোমার-আমার নিজস্ব মনকে, ইচ্ছেকে তাদের উৎপাদন ব্যবস্থায় ব্যবহার করে নিচ্ছে বিনামূল্যে। তোমাদের কথা বলতে গিয়ে বরং আমার রাগ ধরছে। রাগ ধরছে কারণ যা করতে চাইছি—তার এক আনাও করতে পারছি না। কারণ তোমরা কেউ আমার পাশে নেই। কেউ না। ওই পাঞ্জাবি আর পাজামার অভিশপ্ত নাগপাশ থেকে যেন মুক্তি নেই আমার! তারা আমাকে কয়েদ করে রেখেছে। এরই মধ্যে চারপাশে দেখছি কত লোক অসুস্থ হয়ে পড়ছেন, কত লোক মারা যাচ্ছেন, আবার কত লোক দিব্যি আছেন, ফূর্তি করছেন, মাঝেমধ্যে ফাঁকা আস্ফালন করছেন সরকারি নীতি নিয়ে। যাঁরা সরকারি নীতি নিয়ে আস্ফালন করছেন, তাঁরা যেন নিরীহ, তাঁরা যেন এতদিন গোলোকায়নের নীতিগুলো জানতেনই না। জানতেনই না—তিনি নিজেই সেই ভোগবাদের সবচেয়ে বড়ো শরিক। জীবনের চেহারাটা এই ক’দিনে আরও কতটা বদলে গেছে। হ্যাঁ, বদলে গেছে। তোমাদের ওই ভোগবাদী জীবনের ছন্দ নিজে থেকেই পালটে গেছে, অথবা সেখানে কোনো অলীক কবির মুন্সিয়ানা আছে, সেটা ধরতে পারছ অথবা পারছ না। কিন্তু আঙুল তুলছ, আমজনতার অসহায়তার দিকে। বলছ, আমাদের কারুরই কিছু করার নেই। এই কথাটা শুনলেই এখন আমার রাগ ধরছে। আমি ‘ইস্তেহার’ লিখতে বসলে তোমাদের মুখ হাঁড়ি হয়ে যায়। কারণ, তোমরা চর্চা করবে না, কাজ করবে না; অফিসের কাজ, গৃহস্থালীর কাজ ছাড়া আর কি কোনো কাজ থাকতে পারে না—এই অসময়ে? কবিতা লেখা তো শখের জিনিস! ছবি আঁকাও তাই! এই সময়ে তোমাদের মন ভালো নেই, তোমাদের মনে এত বিষাদ, এমন হাত-পা বাঁধা ভিক্টিম তোমরা, যে তোমাদের কিচ্ছু করার নেই। তোমরা ঈশ্বরে বিশ্বাস করো অথচ তোমরা ঈশ্বরকে মানো না, সংসারের নিয়ম মানো। ইনফ্যাক্ট সেগুলো তোমাদেরই বানিয়ে তোলো নিয়ম। ঈশ্বরের নিয়ম নয়।


২.

বৃদ্ধার বুঝিতে না-পারিবার কারণ আছে নিশ্চয়ই। রাষ্ট্রীয় রণনীতি কেই-বা কবে বুঝিয়াছেন? ‘সামাজিক দূরত্ব’—একটি রাষ্ট্রীয় রণনীতি। ‘লকডাউন’ সেই নীতি প্রয়োগের রাষ্ট্রীয় কৌশল। এই কৌশলে ভয় দেখাইয়া, আতঙ্কগ্রস্ত করিয়া, মানুষের মন ও মননকে সম্পূর্ণ দখল করিয়া রাখাই রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য। মানুষের মনে যতটুকু-বা ফাঁক রহিল তাহা ভরাটের জন্য তো পাকিস্তান, চীন, বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ব্রহ্মদেশ ইত্যাদির মতো দুষ্ট ও কুচক্রী রাষ্ট্রের সহিত পৌরুষ প্রদর্শনমূলক সিদ্ধান্তাবলী রহিয়াছেই। সুতরাং ভারতীয়দিগের ইহার অধিক বুঝিবার অবকাশ নাই। ভারতের মনুষ্যকুল জন্মসূত্রে বিশ্বাস করিয়া থাকেন, ভারতের ন্যায় নিরীহ দেশ ও দেশনায়কদের ভালোমানুষীর সুযোগ লইয়া, খতরনাক পাকিস্তান, কূটনৈতিক চীন, প্রভৃতি দেশ ভারতকে সদাই পিষিয়া মারিবার চেষ্টা চালাইয়া যাইতেছে এবং ‘আত্মনির্ভর ভারত’ সেই-সকল দুষ্টাচারের যোগ্য জবাব দিয়া পুনরায় জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লইবে। সে বিশ্বাস যে ধ্রুবসত্য তাহারও প্রমাণ আছে। ভারতের ইদানীন্তন দেশনায়কবৃন্দ ভারতীয়দিগের দুর্দশার কথা ভাবিয়া আহারনিদ্রামৈথুন ত্যাগ করিয়াছেন। তাঁহারা নিজেরা সামলাইতে পারিতেছেন না বলিয়াই তো দেশের নিজস্ব ব্যবস্থাপনার ভার তুলিয়া দিতে চাহিতেছেন, বাণিজ্য সংস্থার হাতে। আপনারা কেবল সবুর করুন, ইহাই কাম্য। তাহাদিগকে যে আপনারাই নির্বাচিত করিয়া গদিতে বসাইয়াছেন—সে-কথা তাঁহারা কখনও ভুলিতে পারেন না।

যে কথাটি স্মরণে আসিলে সমস্ত দিবস সর্বাঙ্গে রিরি করিতে থাকে, রজনীর সীমান্তে নিদ্রাকারক ঔষধ সেবন করিয়া শরীরের জ্বালার নিবৃত্তি ঘটে এবং নিদ্রামগ্ন হইয়া মন আর দুঃস্বপ্ন দেখিতে পায় না, সেই কথাটি আপনাদিগকে জানাইতে ইচ্ছা প্রকাশ করি। ওই কথা কহিবার সময় কোনোরূপ ব্যঞ্জনার অবতারণা করিলে ধাতে সহিবে না বলিয়া সরাসরি বলিতেছি। পুঁজিবাদী শক্তিই যে বহুকাল ধরিয়া পৃথিবী শাসন করিয়া আসিতেছে—সে-কথা তো আপনাদিগের অনেকেরই জানা। পুঁজিবাদী শক্তির প্রধান লক্ষ্যই হইল সমস্ত বিষয় ও বস্তুকে সহজ দ্বিকল্পনে বিবৃত করা এবং সংজ্ঞায়িত করা, যেমন; সাদা-কালো, শূন্য-এক, ভালো-মন্দ, পুরুষ-মহিলা, বড়োলোক-গরিবলোক, নিম্নবর্গ-উচ্চবর্গ, ইত্যাদি, এবং এই দ্বিকল্পিত ঘরগুলির দুই কক্ষে যাহা আঁটিয়া উঠিবে না—তাহাকে পরিত্যক্ত করা। কিন্তু মানুষের সৃজনীশক্তির কাছে, মানুষের মনের একান্ত গবাক্ষে লুকিয়ে থাকা বিদ্রোহের কাছে পুঁজিবাদকে চিরকাল পরাস্ত হইতে হইয়াছে। তাই বর্তমানে সে অপর কোনোরকম ‘রিস্ক’ লইবার পক্ষপাতী নহে। বাজার, শিল্প, মুদ্রণ সে আগেই অধিকার করিয়াছিল, এখন সে শূন্যতাকেও জয় করিয়াছে। শুধু আজও পারে নাই মানুষের মনের রহস্যকে সম্পূর্ণরূপে জয় করিতে—যাহা একার্থে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ছায়াময় রহস্যের সমতুল। তাই পুঁজিবাদের অধুনান্তিক আয়োজন তথ্যপ্রযুক্তি, যাহার মস্তিষ্কে আবৃত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। আপনাদের কাছে আমার একান্ত অনুরোধ, আপনারা যে-কেহ বিশ্বের সর্বাপেক্ষা ধনী মানুষদিগের তালিকায় চোখ রাখিলেই দেখিতে পাইবেন যে, বিশ্বের প্রথম দশজন ধনী ব্যক্তির মধ্যে পাঁচজন ধনীর ব্যবসার উপাদান তথ্যপ্রযুক্তি, দুইজনার ফ্যাশান, একই কোম্পানির তিনজনার তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর অধুনান্তিক বিপণী।

আমার নিজেরও কেবলই মনে হচ্ছে, আমি যেন কী-একটা, যা-খুশি! আমি যেন যাচ্ছেতাই! কেউ বলবে খাব না, কেউ বলবে বেশি খাব, কেউ বললে যাব না, কেউ বললে অনেক দূরে যাব। কেবল আমিই যেন সেই ব্যক্তি, যে কিচ্ছু খাবে না বা কোত্থাও যাবে না। কেউ বললেন তুমি নেতা, কেউ বললেন তুমি আসামী। অথচ কখনও তো কাউকে খুন করিনি আমি! কেউ বলে দিলে, তুমি আসলে কিচ্ছু না, বিভ্রান্ত অন্তর্যামী। কেউ বলবেন—এখুনি লিখে দাও, কেউ বলবেন—এখুনি কাজটা করো। আমাকেও এখুনি লিখতে হবে, কাজটা করতে হবে। অথচ আমি নিজে থেকে লিখলে—সেটা লেখা হলো না, সেটা পড়ে রইল, না-পড়া, না-দেখা, না-চেনা। আমি নিজে থেকে কাজ করলে, সেটা কোনো কাজ নয়! যিনি যখন যা বলবেন, আমি কি তাই-ই? আমার কেবল বিষাদ থাকতে পারে না, কাতরতা থাকতে পারে না। যদি থাকে, সেগুলো বিলাস! কারণ দুঃখ-বিষাদ তো সকলেরই আছে। আমার চেয়ে ঢের বেশি আছে। সুতরাং সেগুলো আলাদা করে বলবার মতো জিনিস নয়, সেগুলো ব্যক্তি-কেন্দ্রিক, তার জন্য তো ওষুধ রয়েছে। খাচ্ছ তো দিনে তিন বেলা! তা সত্ত্বেও এত রাগই বা হবে কেন?

আমি কারুর বাবা, কারুর প্রেমিক, কারুর স্বামী, কারুর দাদা, কারুর সন্তান, কারুর কর্মচারী, কিন্তু কারুর বন্ধু নই। বাকি সকল আত্মীয়তার মধ্যে রয়েছে কর্তব্যের বিধান। সে বিধান লঙ্ঘন করলে আমি দায়িত্বজ্ঞানহীন স্বার্থপর! সকলের বিষাদে তাদের পাশে দাঁড়ানোটাই আমার কর্তব্য। সেই বিষাদ থেকে কী করে মুক্তি সে পেতে পারে, সে-কথা বলবার জো নেই। কারণ, দুঃখকষ্টে পাশে দাঁড়ানোর মানে হচ্ছে, সেই দুঃখকষ্টের উপর্যুপরি বিবৃতি ও ব্যাখ্যা শোনা এবং আরও কিছু যুক্তি আমদানি করে ওই বিষাদ, ওই দুঃখ যে যথার্থ কারণেরই ফল সে বিষয়ে আরও দু-চারটে বাক্য রচনা করা। হে প্রিয় বন্ধু আমার, বন্ধু বলে কিছু হয় না! মৈত্রী আসলে যেমন একটা কেতাবী শব্দ মাত্র, গণতন্ত্র যেমন, তেমনই আমি হচ্ছি—আমার নিজেরই একটা অন্ধবিশ্বাস মাত্র। আমি কারুর শিষ্য হতে পারি, হতে পারি কারুর ছাত্র—কিন্তু আমি কারুর শিক্ষক হতে পারি না, হতে পারি না কারুর গুরুও। জীবনের উপলব্ধির কথা বললে, বাঁচার কথা বললে, আমার প্রিয়তম হারামি ফ্রেন্ড বলে—গাছ তলায় ল্যাঙট পরে বোস।


৩.

সুতরাং আপনাকে ইহা জানাইয়া রাখা আমার কর্তব্য যে, আগামী দিনে মানুষের সর্বপ্রকার ক্রিয়াকর্মকে কেবলমাত্র তথ্যপ্রযুক্তির হস্তে তুলিয়া দিবার অয়োজন চলিতেছে বিশ্ব জুড়ে। ওই ব্যবসায়ে পুঁজির বিনিয়োগের অন্ত নাই। ভারতবর্ষ সেই বিনিয়োগের কাঙাল। তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তা প্রয়োজন নাই, এমত কোনো ক্রিয়াকর্ম ভবিষ্যতে মানুষ আর করিতে পারিবেন না। কারণ সামাজিক দূরত্বের নিদান বলবৎ থাকিবে। বর্তমানে তাহা আপনাদিগকে অভ্যাস করানো হইতেছে মাত্র। মুদি, মৎস-মাংসাদি-বিক্রেতা, সবজিওয়ালা, চাল-ডাল-গমের কারবারি, এই সমস্তই তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে পরিষেবায় পরিণত হইবে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং অন্যান্য কোথাও কোথাও তাহা ইতিমধ্যেই হইতে শুরু করিয়াছে। অতঃপর ছাত্ররা আর ক্লাস করিবে না। কোনো শিক্ষক ছাত্রের মস্তকে তাঁহার স্নেহার্দ্র হস্তস্পর্শ করিয়া, তাহাকে টেলিস্কোপে চোখ রাখিতে উসকাইয়া, আকাশের অনন্ত নক্ষত্ররাজির মিলনান্তক অভিনয় দেখাইতে পারিবেন না। ছাত্র-শিক্ষক উভয়েই এখন অনলাইনের দড়িতে বাঁধা পড়িয়াছেন, যে-স্থলে প্রাথমিক শর্তই হইল—সামাজিক দূরত্ব। চিকিৎসক রোগীকে স্পর্শ করিয়া দেখা অনেকদিন যাবৎই বন্ধ করিয়া দিয়াছিলেন। এখন নিদেনপক্ষে কবজি ধরিয়া নাড়ির স্পন্দন উপলব্ধি করা বা রোগীকে চোখের দেখা দেখাও আর ঘটিবে না। কারণ বাজারে তো আসিয়া গিয়াছে টেলি-মেডিসিন ব্যবস্থা। চায়ের দোকানে, ফুচকার স্টলে পেটিএম-এর মাধ্যমে অদৃশ্য মুদ্রার লেনদেন তো লাগু হইয়াছিল লকডাউনের বহু পূর্বেই।

বিপথগামী চিন্তা করা মহা পাপ। এই সকল কর্মকাণ্ডকে এক প্রকার সরকারি সদর্থক পদক্ষেপ মাত্র বলিয়াই ভাবুন। এখন ফুচকা ও তেঁতুলের জল আপনার বাটিতে পৌঁছিবে প্যাকেটে ভরিয়া। ইহাতে আপনার শ্রম কতখানি বাঁচিল তাহা একবার হিসেব করিয়া দেখুন। ওই বিহার প্রদেশ হইতে আগত বা নিদেনপক্ষে বাঙালি ফুচকাওয়ালা কোথায় যাইবেন কেহ জানিবে না, ভাবিবেও না। আপনি উত্তম মৃত্তিকার পাত্র বানাইতেন, আপনি লিখিতেন সুকৌশলী হস্তলিপিতে শংসাপত্র, আপনার পঞ্চাশ বছরের শৈলী যাহাকে ইদানীংকালে লোকে ‘স্কিল’ বলিয়া থাকে, তাহার আর প্রয়োজন পড়িবে না। আপনাকে নতুন করিয়া নতুন নতুন ‘স্কিল’ শিখিয়া লইতে হইবে তথ্যপ্রযুক্তির যন্ত্র-যন্ত্রাদি মারফত।

আপনি যদি তথ্যপ্রযুক্তির নব নব প্রয়োগের সহিত, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহিত মানাইয়া চলিতে না-পারিয়া থাকেন, তাহা হইলে আপনি কর্ম হইতে অবসর গ্রহণ করিবেন। আপনাকে সরকার বাহাদুর বিনা-বেতনে মুক্তি দিবেন। কারণ সামগ্রিক উন্নয়ন তথা জনগণের স্বার্থে কিঞ্চিৎ স্বার্থত্যাগ যে করিতেই হয় তাহা তো আপনি ইতিহাসেও পড়িয়াছেন। শুধু ইতিহাস কেন, প্রতিদিন জ্বলজ্যান্ত দেখিতেছেনও। দেশকে রক্ষা করিবার নিমিত্ত কত যুবা সৈনিক অকালে প্রাণ বিসর্জন দিয়া শহীদ হইতেছেন সীমান্তে। সরকার বাহাদুরের কী অপরিসীম মমতা, কী সহৃদয়তা দেখুন, তাঁহারা কেবল আপনাদিগের স্বার্থের কথা চিন্তা করিয়াই তো তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবসাকে এইরকম পর্বতপ্রমাণ করিয়া তুলিতেছেন, আপনাদিগকে স্বনির্ভর করিয়া তুলিতেছেন। আপনাকে এই অসুখের দুঃসময়ে বা অসুখ পরবর্তী অলীক পর্বে কষ্টসাধ্য জীবনযাপন করিতে দেখিলে সরকার বাহাদুর তাঁহার বিষাদাশ্রু নিবারণ করিতে পারিবেন কি? উত্তর—না। হয় আপনি মুক্তি পাইবেন উপার্জনের সাংসারিক মায়ার মিথ্যা জগৎ হইতে, যেমন মুক্তি পাইয়াছেন ওই বৃদ্ধা প্রপিতামহী, অন্যথায় আপনাকে তথ্যপ্রযুক্তির নতুন পৃথিবী সাদরে স্বাগত জানাইবে। আপনি হইয়া উঠিবেন হয় স্বনির্ভর সুখী ক্রেতা নতুবা তথ্যপ্রযুক্তির কর্মী। কর্মীর দুই রকম শ্রেণি হইবে—প্রোমোটার এবং সন্ত্রস্ত খিদমতগার।

সকালের বাতাস এখনও মনটা ঠান্ডা করে দেয়। আমি সস্তা মোটা সুতির কাপড় ও দুটো কাঠের ফ্রেম জুড়ে—আরাম কেদারায় বসে লিখি। তাই আমি ‘অভিজাত’। সকলকে অল্পে ভালোবেসে ফেললে আমি ন্যাকা। আবদার করলে ধান্ধাবাজ। ছবি আঁকলে—ওই তো তোমার রিক্রিয়েশন। কবিতা লিখতে চাইলে প্রেমের কবিতা লেখো। এবং সেই কবিতায়—যদি আমি আর তুমিকে সবার আড়ালে নিয়ে গিয়ে ‘তোমাকে শুধু আমার’ আর ‘আমাকে শুধু তোমার’ করে না-তুলি, তবে সে কবিতাই হয়ে রইল কেবল। আর কিছু হলো না। সেই কবিতার প্রাপ্য ‘বেশ ভালো’ অথবা ‘খুব ভালো’ অথবা ‘তুমি কী করে লেখো এমন?’—এই সকল মন্তব্যসমূহ অথবা নিরুত্তর বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠি!

গোলোকায়নে কতকিছু পালটালো, প্রেমের ভোগী চেহারাটা পালটালো না। এই একবিংশতেও প্রেম মানে কেবল—আমি আর তুমি! সেই বাইনারি দিয়েই বিজ্ঞান, সেই বাইনারিতেই পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্র, সেই একই বাইনারিতে পুঁজির দুনিয়া! শুধু প্রেমের নয়, সব কবিতা, সব লেখাই তেমন। সে-সব লেখা পড়ে কারুর লিখে উঠতে ইচ্ছে করে না। কারুর কারুর পড়তেই ইচ্ছে করে না। শক্ত লেখা, অ্যাবস্ট্রাক্ট, মাথার ওপর দিয়ে গেল! কই তুমি তো রবীন্দ্রনাথের মতো সহজ করে লিখলে না? কিংবা জীবনানন্দের মতো! ‘সেই চাহনি ভেসে আসে’—কত সহজ কথা ভাবো একবার,—বা আরও সহজ, ‘উটের গ্রীবার মতো নিঃস্তব্ধতা’। আমি ছবি আঁকতে ভালোবাসি—কিন্তু ছবি আঁকার সময় নেই। আমি এখন লিখতেও পারি না। কেননা আমি-যে সরকারি বেতন পাই বেসরকারি মেজাজের এবং ডব্লিউএফএইচ করি। সরকার মানে তো এখন পুঁজিপতি কোম্পানি। কাজের সময় ২৪ গুণিতক ৭। কাজ করার মানে গতকাল কাজ করা। আজ আর সময় নেই। তারই মাঝখানে আমি এক অসংগঠিত শ্রমিক। তবু আমি তো ভালো আছি, অনেকের থেকে ভালো—যুক্তি তো এই-ই! একদিক থেকে লেখাপড়ার চর্চা না-করাই ভালো! কারণ আমাদের তো কিচ্ছু করার নেই!

আমি লিখলাম তুমি বুঝলে না—সে আমার দোষ। তুমি বললে আমি বুঝলাম না, সে-ও আমারই দোষ। শ্রমের বিনিময়ে হকের মূল্য চাইলে সে আমার অন্যায়। রবীন্দ্রনাথ পড়োনি এখনও?—এই প্রশ্ন তুললে আমার অপরাধ, পাঁচুগোপাল ভাদুড়ী তো অনেক দূরের কথা! ছোটোবেলায় আমায় বড়োরা বলতেন, পড়াশোনা করো। স্বদেশে পূজ্যতে রাজা, বিদ্বান সর্বত্র পূজ্যতে! এখন বড়োরা বলেন, পোড়ো না, বরং পোড় খাও, পোড়ো অন্তরে অন্তরে। আমার ভেরি ক্লোজ স্বজন, অনেকেই আমায় মনে করিয়ে দেন, পারতপক্ষে আমাকে যে বাজার করতে হয় না, স্বজনের অসুখে হাসপাতালে দৌড়োতে হয় না—সেটা আমার সৌভাগ্য। আমাকে সংসারে কারুর কথা ভাবতে হয় না—এর মতো সুখের আর কী আছে? আমি যে বিদ্যার চর্চা করি, শিল্পের চর্চা করি, সেগুলো বাহুল্য মাত্র। সে সব আমাকে যাঁরা ভালোবাসেন, তাঁদেরই দেওয়া সুযোগ মাত্র। তাঁরা নিজেদের সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছেন—আমারই কথা ভেবে। তাঁদের কিচ্ছু করার নেই!

সকলের আক্ষেপ, সকলের বিষাদ, সকলের অকালে ডুবে যাওয়া—আমার ওপর দবাব্‌। আমি জলে ঝাঁপ দিয়ে কাউকে বাঁচাতে গেছি, আমি সাঁতার জানি, অথচ নিজে কেউ বাঁচতে চাইছে না—বরং আমাকেই ডুবিয়ে দিচ্ছে। সকলেই বলছেন—তাঁরা ঠিক। সকলেই বলছেন—কিচ্ছু করার নেই। আমার কথা ও কাজ আসলে ফাঁকা—‘অ্যাকাডেমিক প্র্যাকটিস’ নতুবা পাতি ‘সংস্কৃতিচর্চা’। অথচ জ্বলজ্যান্ত খুন হতে দেখছি একে একে সব স্বপ্নগুলোকে। স্বপ্নটপ্ন থাক, বরং বলা যাক—কাজ করার ইচ্ছেগুলোকে। আমি যাঁদের বেতনভুক তাঁদের পরিকল্পনা আপাদমস্তক ভুলে ভরা। কিন্তু বদলাতে হবে আমাকেই আমার দৃষ্টি একশো ভাগ শতকরা। আমি যখন কাজ করি, তখন সেটা সরকারি পয়সা নষ্ট। তাঁরা যখন হুকুম দেন, অর্থাৎ আমার অবস্থান যখন ‘অ্যাজ ডাইরেক্টেড’ তখন সেটা কাজ। কোনো গোল হবে না, বলে দিয়েছেন,—আমার টিমের ম্যানেজারেরা। তবু ফুটবল খেলার ৯০ মিনিট দৌড়ে যেতে হবে, আমার মতো আরও অনেককেই। কখনো-কখনো ভালো খেলছি তার ভানও করতে হবে। দর্শক কখনও হাততালি দেবেন। তাঁদেরও খুশি তো করতে হবে। তাঁরা-যে পয়সা দিয়ে টিকিট কেটেছেন। তাঁদের মধ্যে কোনো কোনো দর্শক ব্যাপারটা ধরতে পেরে যদি বলেন, এ ম্যাচ ফিক্স্‌ড। তখন তাঁরা সমালোচক। রাজদ্রোহী!


৪.

আমাদের কালটা কেমন যেন দেখতে দেখতে উদাসী বাউলের মতো হয়ে উঠল চোখের সামনে বুকের ওপর দিয়ে। কোনো বিশ্বাস বা তর্কের ওপর ভর দিয়ে কোনো চর্চা দানা বাঁধল না নতুন করে। মনের ঘরের জানলা দরজাগুলো কে যেন বন্ধ করে দিয়ে গেল। আর আমরাও সব মেনে নিলাম। শুধু একটা উইনডো খোলা রেখে গেল। সেই জানলা দিয়ে আসতে থাকল কেবল তথ্য। এ লেখা, আপনারা এ অবধি স্রেফ পড়ার আগ্রহে কেউ পড়ে ফেললে, আশা করি বুঝতে পারবেন আর পাঁচটি নিবন্ধের মতো করে এটি লেখা নয়। এটি কেবল একপ্রকার অ্যাপিল মাত্র। সংক্ষিপ্ত দাবিসনদ। আপনাদিগের প্রতি।

অ্যাপিলের কথাটা আরও বেশি করে উঠল, এই সময়ে; যখন করোনা সংক্রমণের উপর্যুপরি খবর আমার-আপনার হাড়মাস জ্বালিয়ে খাচ্ছে, যখন অসুখ-সাপেক্ষ ঘটনাবলীতে, কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারি কর্মসূচীতে, মিডিয়ার ভূমিকায় মন বলছে, ‘মনে কি দ্বিধা রেখে গেলে’, তখন! কথাটা উঠল, বিশেষ করে কেন্দ্রীয় সরকারের আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলির প্রতি আচরণ, নিজ দেশের মানুষের জীবনযাপনে স্বাস্থ্যে তাঁদের অভূতপূর্ব দায়দায়িত্ব, বাণিজ্যের বসতে তাঁদের ভূমিকায়, ‘ইস্কুল’ এবং ইস্কুল-পরবর্তী শিক্ষা বিষয়ক আচরণ ও নির্মিতি, ইত্যাদির পরিপ্রক্ষিতে। বর্তমানে করোনা সম্বন্ধে কথা বললে লোকে খাচ্ছে বেশি। সুতরাং করোনা-বিষয়ক সূত্র উপস্থাপন করলে আপনার নজর আকৃষ্ট হবে, এমনটা অনুমান করা সহজ।

দুয়েকদিন আগেই, জার্মানির কনস্ট্যান্‌জ় নগরের বাসিন্দা, আমার দুই অসমবয়সি বন্ধুর সঙ্গে বার্তা আদানপ্রদান হচ্ছিল হোয়াট্‌সঅ্যাপে। বিশ্ব জুড়ে লকডাউনের ‘ধারণা’ লাগু হবার পরপরও কথা হতো। তাঁদের কথা শুনে আমার কখনও মনে হয়নি—এই ব্যামো নিয়ে তাঁরা আদৌ ন্যূনতম ভ্রূ-কুঞ্চিত চিন্তনে অংশগ্রহণ করছেন। সেদিনও আমার বয়স্ক-বন্ধুটি জানালেন, এরই মধ্যে তিনি অস্ট্রিয়ায় বাইক (সাইকেল) ট্যুর করেছেন বেশ কয়েক দিন। তাহলে তাঁরা কি ব্যাপারটাকে পাত্তা দিচ্ছেন না? ইতালিবাসী মারিয়ানার কাছ থেকেও জানতে পারি যে, তাঁরা স্বাভাবিক জীবনযাপনে মোটামুটি ফিরে এসেছেন। আমাদের দেশের কথা শুনে, আমার বান্ধবী, জার্মানবাসী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীটির মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য: ‘ইয়েস আই নো উই হ্যাভ বিন সো লাকি হিয়ার সো ফার, বাট অফ কোর্স, ইট ইজ নট ওভার।’ এই মনোভাব,—অসুখ নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তিত না হওয়ার পেছনে কী এমন জিনিস কাজ করছে যা আমাদের মধ্যে নেই? কেন আমরা নেতা মন্ত্রীদের অবান্তর কথাবার্তা এমনকি নিজেদের আচার-আচরণকেও মশকরার বিষয় করে তুলছি সোশ্যাল মিডিয়ায় ঠিক যে সময়ে, সেই সময়েই ভয়ে দুশ্চিন্তায় কেঁপে উঠছি আক্রান্তের সংখ্যায় ‘রেকর্ড’ দেখে? সেই দুশ্চিন্তাও কি আসলে ‘মশকরা’?

সাংঘাতিক এক ভবিষ্যতের পরিকল্পনা আছে এই স্কিল স্কিল করে লাফানোর মধ্যে বা এই করোনা ভাইরাস নিয়ে সরকারি জন-দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করার মধ্যে। কিন্তু সেই পরিকল্পনাটা যে ঠিক কী, সেটা খুব ভালো বিবৃত করতে পারছি না। কেন পারছি না জানেন? কারণ, আমিও ব্যস্ত স্কিল বাড়িয়ে তুলতে। আমার নিজের যা স্কিল, পেশাগত—তা ধরুন গত দু-দশক ধরে ধীরে ধীরে শেখা, বিষয়টির প্রতি সম্যক যে ধারণা আমার গড়ে উঠেছে, যা আমার অর্জন—যা সরকারি মতে অপচেষ্টা এবং তা আপাতত পরিত্যক্ত। অকেজো। অপ্রাসঙ্গিক।

এই মুহূর্তে আমাদের দেশের চিত্রটা বেশ খানিকটা পরিষ্কার। যিনি লোকাল ট্রেনে বাদাম বিক্রি করতেন তাঁকে এখন স্যানিটাইজ়ার বানানোর স্কিল শিখে নিতে হবে, নচেৎ—তিনি রাজার খেলায় বাদ পড়বেন। ইতোমধ্যে ঘরে ঘরে সস্তার মাস্ক, হেড শিল্ড বানানোর ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠেছে, আরও হবে আগামী দিনে। সবাই কাজ পাবে। যদি জিজ্ঞেস করেন—চাকরি দেবেন? আপনার সেই স্কিল নেই, যে স্কিল এখনকার ইন্ডাস্ট্রির দরকার—তার উত্তর হবে। ঠিক এরপরের প্রশ্নটাই যা হবে—স্কিল শিখে নিলে বা বাড়িয়ে নিলে চাকরি পাকাপাকি ভাবে হবে? তবে তখন হয়তো আপনার আর চাকরির প্রয়োজনই হবে না। হয় আপনার বয়স বেড়ে যাবে নতুবা আপনার মতো অজস্র বর্ধিত স্কিল-ওয়ালা লোক সংখ্যায় অনেক হয়ে যাওয়ায় স্কোপ কমে যাবে। আর তেমনটা হলে দেশের গরিব সরকার আর কী-ই বা করতে পারেন বলুন। আপনার নতুন ও বর্ধিত সেইসব স্কিল যে কাজে লাগবে সেরকম কোম্পানি কোথায়? শুধুমাত্র প্রোডাক্ট বিক্রি করা ছাড়া—বড়ো বড়ো ইন্ডাস্ট্রি তো আর কিছু আশাই করে না এই দেশ থেকে।

কিন্তু সরকারের এই সমস্ত দাওয়াই যে আসলে মিথ্যাই তার প্রমাণ রয়েছে ঘরে-ঘরে। মানুষ মানসিক অবসাদের শিকার হচ্ছেন—আর ওইখানেই পুঁজিবাদের দালাল সরকারের লাভ। এখন দেখবেন, আইটির ব্যবসায় প্রোডাক্ট কতটা উন্নত সেটা বোঝানোর জন্য জি বা জেনারেশন কথাটা ব্যবহার করা হয়। ওই জি-স্কেলের সিঁড়ি বেয়ে আপনি যত তাড়াতাড়ি ওপরে উঠবেন, উঠতে চাইবেন, তত তাড়াতাড়ি সরকারের এক্সক্লুসিভ খেলাটা খেলতে সুবিধা হবে। ৫-জি মানে কিন্তু শুধু—জি। ২-জি, ৩-জি, ৪-জি, সমস্ত বাদ হয়ে গেল। পুরোনো মোবাইল ফোন বা সেই সেলেরন প্রসেসরে চলা ২৫৬ এমবি র‍্যামের কম্পিউটারটা এখনও ছাদে ওঠার সিঁড়ির নীচে বা চিলেকোঠার ঘরে ডাঁই করা ই-আবর্জনার মধ্যে কি দেখতে পান না? যান্ত্রিক কখনও কি অযান্ত্রিক হতে পারে? সেটা যদি না বোঝেন, তাহলে সেটা আপনার প্রবলেম, বাণিজ্যের নয় কিংবা সরকারেরও নয়। সরকারের কাজ হলো কেবল—উন্নয়ন, এবং পলে পলে সেই উন্নয়নের সংজ্ঞা ঠিক করা।


৫.

খেয়াল করে দেখবেন, জার্মানির খবর বিশ্বের করোনা-আপডেটে ‘হেডলাইন’ হয়নি একবারও। যেমন কখনও দেখবেন না, ভারতের ভোটের সময় অথবা চীন বা পাকিস্তানের প্রতি ভারতের রাষ্ট্রনৈতিক অবস্থানের খবরের হেডলাইনে জার্মান রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী বা কোনো আমলা মাথা গলাচ্ছেন। গোটা জার্মানিতে করোনার মোট ‘কেস’ ২০,৩০০০। তার মধ্যে সেরে উঠেছেন ১৮,৭০০০ জন। মারা গেছেন ৯১৬৩ জন মানুষ। ২৮ মার্চ ২০২০ সর্বোচ্চ সংক্রমণ ঘটেছিল সেখানে ৬২৯৪ জন। ১৯ জুলাই ২০২ জনের নতুন করে সংক্রমিত হবার খবর পাওয়া যাচ্ছে। অন্যদিকে ঠিক ওইদিনই ভারতে নতুন করে সংক্রমিত হয়েছেন ৩৮,৯০২ জন মানুষ। সর্বমোট ১০ লাখ যে কবে ছাড়িয়ে গেছে! মৃত্যু হয়েছে প্রায় ২৭,০০০ মানুষের। কী করে পারলেন—জার্মান, ইতালিয়রা? আমরা কেন পারছি না? যে ইতালিকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি চিন্তা হচ্ছিল মাস কয়েক আগেও, তাঁদের অবস্থা কীরকম এখন? জুলাইয়ের ১৯ তারিখে ইতালিতে সংক্রমিত হয়েছেন ২১৮ জন। সেখানেও তো একটা সময় অবধি সব মিলিয়ে মারা গেছেন ৩৫,০০০-এর বেশি মানুষ।

জার্মানির অর্থনৈতিক পরিকাঠামো আর ভারতের পরিকাঠামো এক হলো? এই বলে আমাকে থামাতে চাইবেন কেউ কেউ। আমি উত্তরে জিজ্ঞেস করব, তাহলে আমেরিকা? তাঁদের অর্থনৈতিক অবস্থা কি খারাপ? বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দশজন মানুষের আটজনই আমেরিকার বাসিন্দা। তাঁরা পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছেন না কেন তবে? যাঁদের নিজেদের অবস্থা এমন খারাপ, তাঁরা আমাদের দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি নিয়ে এত মাথা ঘামান কীভাবে? তখন আপনি হয়তো বলবেন, না-না ভারতের জনসংখ্যাটা ভাবুন! আমিও তখন বলব চীন! আপনি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠবেন—ওদের কথা ছাড়ুন। ওরা তথ্য গোপন করে, মিথ্যা প্রতিবেদন দেয়, খুব খারাপ দেশ। আমি চুপ করে গিয়ে ভিয়েতনামের কথায় চলে যাব তাহলে এক লাফে। ভিয়েতনামে প্রতি বর্গ-কিলোমিটারে জনসংখ্যার ঘনত্ব ২৯৪ জন। ভারতে ৪২০ জন। এটা গড় হিসেব। শহরাঞ্চলে যেখানে রোগ ছড়াচ্ছে বেশি—সেখানে ভারত-ভিয়েতনামে তফাত অতি নগণ্য। ভিয়েতনামে এখনও অবধি করোনায় একজনও মারা যাননি। সব মিলিয়ে তাঁদের দেশে করোনা সংক্রমণের সংখ্যা ৩৮২। ১৯ জুলাই কারুর সংক্রমণ সেখানে ঘটেনি নতুন করে। আমেরিকায় সেই দিন সংখ্যাটা ৬৫,৩৮৯ জন।

আসলে সমস্যাটা অন্য জায়গায়। অর্থনীতিতে, পরিকাঠামোয়, উন্নয়নে—সমস্যা আছে ঠিকই, সবটা মেনে নিয়েও বলতে বাধ্য হচ্ছি—মূল সমস্যাটা কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গির। আপনি রাতদিন করোনার আতঙ্ক নিয়ে থাকতে ভালোবাসছেন। আপনার দিক থেকেই বলছি কথাগুলো। জানবেন ওতে ভারতের সরকার বাহাদুরের লাভ আছে নিশ্চয়ই। লাভ আছে আমেরিকারও। আমি বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসের বা বর্তমান আঁতাতের পটভূমিকার কথা বলছি না। চুলোয় যাক সে সব। আমি কেবল খেয়াল করে দেখতে বলছি—খবরে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্থ দেশ বলে আমেরিকা এবং সংক্রমণের আগ্নেয়গিরি ইত্যাদিতে বসে থাকা ভারতের কথাই সবচেয়ে বেশি কেন নিরন্তর উঠে আসছে খবরের শিরোনামে! আপনাকে করোনার বিপদ, চীন বা পাকিস্তানের নষ্টামির গল্প শুনিয়ে সরকারের কোথায় লাভ—সেটা খেয়াল করে দেখতে বলছি। আপনাদের কাছে সবিনয়ে অ্যাপিল করছি। দিনের পর দিন আতঙ্ক, হা-হুতাশ করা, আর অপ্রাসঙ্গিক কাগুজে বা ‘ভার্চুয়াল’ রাজনৈতিক তরজা বা মশকরায় অংশ নেওয়া এবার বন্ধ করুন। বরং নিজের কথা বলুন স্পষ্ট উচ্চারণে। বলুন নিজের জন্যই, কেননা নিজেকে নিয়ে ভাবার সময় আপনার হাতে আর বেশিদিন নেই।

যাপনের চেহারাটা এবার আরেকবার পালটান। এভাবে চললে, আপনার কিছু যায় আসে না হয়তো—কারণ আপনার বয়স ৪০, ৫০, ৬০ পার হয়ে গেছে। কিন্তু আপনার দেশের শিশু, কিশোর, তরুণ প্রজন্মের কথাটাও ভাবুন একটু। কেন সরকার বলছেন, পাঠক্রমে স্কিলের ওপর জোর দিতে। কেন নির্দিষ্ট অধ্যায়গুলো, নির্দিষ্ট কবিতা বাদ দিচ্ছেন তাঁরা? স্কিল বলতে তাঁরা ঠিক কী বোঝাতে চাইছেন? আমলাতন্ত্র কোথায় গিয়ে পৌঁছালো, আপনার কোন কোন নিজস্ব অভ্যাসে, চর্চায় তাঁরা ভাগ বসাচ্ছেন? কেন আপনার কথা বলবার, লিখবার, পড়বার, সর্বোপরি ভাববার সময় কমিয়ে আনা হচ্ছে! আপনাকে ব্যস্ত রাখা হচ্ছে লক্ষ্যশূন্য, অন্তঃসারশূন্য, কাজকর্মে। সর্বত্র। সর্বদা।

এই আকালেও যাঁরা এই ভোগবাদের চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারেন, আমার অ্যাপিল তাঁদের কাছে নয়। আমার অ্যাপিল তাঁদের সাহসী অক্ষরগুলো যাঁরা চিনেও চিনতে পারেন না তাঁদের কাছে। ‘কী কঠিন ব্যাপার!’ (যেমন কঠিন গান্ধী? রবীন্দ্রনাথ? না-না রবিঠাকুর তো আপনার মনের মানুষ। তাই না?)—এই বলে মুচকি হেসে যাঁরা পাশ কাটাচ্ছেন, যাঁদের দাবিটা এইরকম যে, আপনি সহজ করে কথা বলুন শুনব। ভাবতে হলে আমি বা আমরা নেই। যাঁরা হাসাহাসিতে অংশগ্রহণ করছেন তাঁরা সবাই হয়তো আম-আদমি নন। তাঁরা কেউ কেউ বিশেষ বিশেষ বিদ্যাপেশার কর্মী। তাঁদের কাছে জয়েস, কাফকা, কিয়ের্কগার্দ সহজ। কান্ট, হাইদেগার, হব্‌স বা কার্ল মার্কসও ততধিক সহজ। বিদ্যাপেশায় নিযুক্ত লোকজনও বোধহয় মনে করছেন, ফেসবুকে তো কেবল কচি বয়সের ছবি, আর কোনো ডিফাইন্ড সম্পর্কের বা সম্ভোগ-সম্ভ্রমণ মুহূর্তের ছবি টাঙিয়ে দিলেই ব্যাপারটা মিটে যায়। আপনি যে সোশ্যাল—সে সবই তো তার প্রমাণ। ঠোঁট-কাটা ফেমিনিস্টের ভূমিকায় নারীর শ্লীলতাহানি থেকে শুরু করে সামাজিক নানাবিধ ব্যাপারে আপনি সরব হচ্ছেন, কারণ সেখানে সরব হলে র‍্যাডিকাল ভূমিকায় নিজেকে দেখানো যায়, তাতে সহানুভূতি ও উদ্‌যাপনের পরিষ্কার আঁতাত আছে। কিন্তু ইউজিসি-কে বয়কট করতে পারছেন কি? বলা বাহুল্য—না। গাছ-কাটা নিয়ে, সবুজায়ন নিয়ে সকলেই তো আপনারা সদর্থক, তাই না? অথচ দুটো লোক এত বড়ো একটা দেশ চালাতে গিয়ে কখনও গাছেদের, কখনও শিশুদের, কখনও কৃষকদের হাঁড়িকাঠে চড়াচ্ছেন—এটা চলতে পারে কেমন করে? কী ভাবছেন, সই তো করেছেন এক-আধটা অনলাইন পিটিশনে। সই করুন, বারণ করছি না তো! এটুকুও জেনে রাখুন দায়দায়িত্ব সেখানেই শেষ হয়ে যায় না।

আমার অ্যাপিলটা একবার সহৃদয়তার সঙ্গে বিবেচনা করবেন আশা করি। আসুন না আমরা সবাই বিশ্বের প্রথম দশটা পুঁজিবাদী শক্তির একজনের তৈরি করা দেওয়ালেই লিখি না হয়, যা মন চায়। অর্থাৎ ফেসবুকে! প্রেমিক-প্রেমিকা-স্বামী-স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে যে ছবি তুলেছিলেন সেটাও দিন। বারণ করছি না। কেবল বলছি,—তামাশা দেখে, তামাশার শরিক হয়ে সময় কাটাবেন না প্লিজ। সম্ভব হলে রাষ্ট্রীয় নোংরামির বিরুদ্ধে লিখুন, খোলাখুলি লিখুন। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, বাংলা অভিধানে শব্দ-সংযোজন নিয়মিত নয়, নয়তো ‘বুদ্ধিজীবী’ শব্দটি যে সময়ে জন-গণ-মনে একটি খিস্তি মাত্র, সে সময়ে দাঁড়িয়েও, এ পৃথিবীতে তেমন কেউ কেউ মাত্র লিখছেন। যাবতীয় দাঁত-নখের বিপরীতে একক অবস্থান নিয়ে, রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির ঘেঁটোর বাইরে, মানুষ হিসাবে, মানব কল্যাণকামী এক সংবেদনশীল মন নিয়ে। দেখুন, ব্যবসাটা তো শেষমেশ মেনে নিয়েছি, নিতে বাধ্য হয়েছি। আমরাও তো ভোগ করছি আইটি গ্যাজেট্‌স। ঝাঁ-চকচকে। তা সত্ত্বেও প্রতি দু-বছর অন্তর কেন মোবাইল ফোন পালটাতে হবে বলতে পারেন, কেন ল্যাপটপ কিনতে হবে বারেবারে? এ-কেমন ব্যবসাকে প্রশ্রয় দিয়ে মাথায় তুলছি আমরা? পুরোনো ল্যাপটপ, মোবাইল, চার্জার, ব্যাটারি, আরও শতশত ইলেকট্রনিক জঞ্জাল ফেলব কোথায়? দেড় দুশো টাকায় বেচে দেবো কাবাড়িওয়ালাকে। সে আগুনে গলিয়ে বার করবে সোনা রূপা। আর সেই ধোঁয়া আমাদেরই মতো, গাছেদের, পাখিদের, সকলের জীবন বিপন্ন করে তুলবে, তুলছে। কেন জঞ্জাল এমন ধ্রুবক হবে?

কেন সরকারি শিক্ষানীতি স্বাস্থ্যনীতি যা বলবে সঙ্গে সঙ্গে সেই কথা আপনাদের শুনতে হবে। জীবনে তো অনেক সম্মান পেয়েছেন, বিদেশী বা সমতুল দিশি বড়ো বড়ো প্রতিষ্ঠান থেকে পড়াশোনা করে এসেছেন, এখন ভাবছেন সুখে শান্তিতে বাকি জীবনটা ছিমছাম কাটাবেন? দয়া করে ভাববেন না। বরং দর্শন পড়তে আসা ছাত্রের সরাসরি যে প্রশ্ন,—এসব জেনে কী হবে?—তার উত্তর দিন। সাহিত্যের ছাত্রকে বোঝান পড়তে পারতে শেখাটা কেন জরুরি! সরকারি দালালিপনার বিরুদ্ধে সরাসরি খোলা গলায় কথা বলুন। পারলে ইউজিসিকে বলুন। যাঁরা নেট পরীক্ষার ব্যবস্থা করেন, তাঁদের বলুন—আমার-আপনার তৈরি করা প্রশ্নপত্রে মিনিমাম কাটঅফ মার্কস শতকরা ২০ নম্বর পেয়ে তাঁরা পাশ করে দেখান। প্রশ্নগুলো যাঁদের করতে দেওয়া হবে আমি-আপনি সবাই মিলে না হয় তাঁদের প্যানেল ঠিক করে দেবো। দয়া করে হ্যাঁ-হ্যাঁ বলা সঙদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবেন না। রিফিউজ করুন ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া এই ব্যবস্থাকে। তার বদলে বেশি বেশি করে ছাত্রদের চীন ও পাকিস্তানের লিটারেচার পড়ান। পড়ান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গল্প। কেউ নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করাকে কূটনীতি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে এলে কিংবা জাতীয়তাবাদ বলতে এলে তাঁর কান মুলে দিন। কোনোরকম রাষ্ট্রীয় ওরফে সরকারি বাঁদরামিকে দয়া করে প্রশ্রয় দেবেন না।


ক্ষতিকারক যেহেতু, এ দাবিসনদ পাঠের একটি বিধিসম্মত সতর্কীকরণ: দয়া করিয়া কাল গুনিয়া পকেটস্থ করুন এবং যাহা ফেরত পাইলেন, তাহা হিসেব করিয়া লইলেন কি? তাহা কাল হইল, জাল নহে তো?