‘সময় কাটানা’ নিয়ে আমার কোনোকালেই বিশেষ চিন্তা বা মাথাব্যথা ছিল না। স্বভাবের বিচারে হয়তো খানিকটা শম্বুকবর্গীয়, তাই টোকা খেলেই অনায়াসে মন-খোলসে নিজেকে গুটিয়ে নিতে সামান্য অসুবিধে হয় না। যতদিন কর্মজীবন, মানে পেশাগতভাবে সচল ছিলাম, ততদিন রুটিন বাঁধা সময়ের রাশ সামলাতেই সময় কেটেছে। সময়ই যেন টেনে নিয়ে গেল আমাকে এতকাল। কর্মজীবনের পাট চুকতেই, হঠাৎ মালুম হলো আমার অলখে সময়ের সঞ্চয় অনেক বেড়েছে। কর্মস্থলে যাবার তাড়া নেই, সাত-সকালে শয্যা ত্যাগ করে প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ড সেরে ফেলার তাগিদ নেই, কর্মস্থলের সম্ভাব্য কর্মকাণ্ডের জন্য নিজেকে শারীরিক বা মানসিকভাবে প্রস্তুত করে নেবার তীব্র ইন্ধন নেই—সে এক পরম নিরাসক্তি। অবসর গ্রহণের পরে, দিন কয়েক ফোন-পথে নানারকম পরামর্শের কথা শুনতে পেতাম—“কেমন আছেন? কেমন কাটছে সময়? শরীরটাকে সচল রাখবেন, ঘরে বসে থাকবেন না, একটু ফ্রি-হ্যান্ড এক্সারসাইজ করবেন, রাস্তাঘাটে সাবধানে হাঁটাচলা করবেন।”এমনই সব সদুপদেশের বন্যায় যখন প্রায় ভেসে যাবার জোগাড়, তখনই আস্তে আস্তে পরামর্শের পরিমাণ কমে আসতে থাকল দ্রুতলয়ে। মনে মনে ভাবলাম—একরকম নিরুৎসাহ হয়েই বোধহয় সবাই ক্ষান্ত হলো। কিন্তু নতুন রুটিনের খোলসে নিজেকে নতুন করে মুড়ে ফেলাটা যে জরুরি তা উপলব্ধি করতেই বেশ নাকাল হতে হলো। কেননা আমার পছন্দের কাজকর্মের বেশিরভাগটাই যে কেজো মানুষদের পরিমাপে অকাজের, অনর্থনৈতিক। খুরপি বাগিয়ে গাছেদের গোড়া খুঁচিয়ে দেওয়া, নিড়েন দিয়ে গাছের চারপাশে ভিড় জমানো আগাছাদের নির্মূল করা—এই তো আমার কাজ মূলত, লোকে যাকে বলে বাগান করা। সে কাজের ফাঁকে বুড়ো আঙুল আর তর্জনীর মাঝে লেখনিকে আগলে ধরে সাদা কাগজে হিজিবিজি মন-কথা লেখা—এগুলোকে কাজ বলে স্বীকার করে নেবার ঔদার্য ও মুগ্ধতা কার আছে? অথচ এমনই সব কাজে নিজেকে অভ্যস্ত করে তুলেছি দীর্ঘদিন ধরে, একটু একটু করে।

প্রতিদিনের রুটিন বাঁধা কর্মজীবনের ফাঁক গলে যে সময় টুকরো টুকরো ফ্রেমে বন্দি হয়ে সামনে এসেছে তাকেই বড়ো আপন করে আঁকড়ে ধরে পথ বেয়েছি এতদিন। নানান সজীব চরিত্রের সতত প্রাণবান আনাগোনায় ভরে উঠেছে আমার একান্ত অবসর যাপনের মুহূর্তগুলো। এককালে হাতে ধরা লাটাই থেকে সুতো ছেড়ে ছেড়ে যে ময়ূরপঙ্খী ঘুড়িগুলোকে দূরদূরান্তে দিয়েছি উড়িয়ে, তারাই যখন স্মৃতির অনন্ত আকাশ হাতড়ে হাতড়ে আবার মন-দুয়ারে এসে কড়া নাড়ে তখন অন্য এক পাওয়ার আনন্দে, অন্য এক গরিমার অনুভবে হৃদয় মন সব টইটম্বুর হয়ে ওঠে। অনর্গল ঋত, অমল বাচনে ভেঙে যায় সময়ের সীমানা! অনায়াস মন-চারণায় বড়ো কাছাকাছি চলে আসি পরস্পর। অবসর যাপনের এমন খণ্ড মুহূর্তগুলোকে জীবনের পরম পাওয়া বলে মনে হয়। প্রাত্যহিকতার একঘেয়েমি ভেঙে খানখান হয়ে যায় এক লহমায়। নিজেকে নিয়েই একরাশ প্রশ্ন জাগে মনে। মাঝে মাঝে মনে হয় আরও আরও নিবিড় করে কেন সময়ের সঙ্গে সহবাস করলাম না! করলে জীবনপাত্র আরও উছলে উঠত, পরিপূর্ণ প্রাণের আসবে।

এমনি করেই বেশ চলছিল আমার অবসরকালীন দিনযাপনের অনাবিল খণ্ড মুহূর্তগুলো। হিসেবি চলন বুঝি টালমাটাল হলো একেবারে হাল আমলে অতিমারী আর মারণ-ঝড়ের পরবর্তী সময়ে। প্রথমে ঝড়ের কথাতেই আসি। গতবছর পড়শি রাজ্য ওডিশায় প্রবল দাপটে আছড়ে পড়েছিল ফণী, এক ভয়ানক মারণ ঘূর্ণিঝড়। ঘটনাচক্রে আমি সপরিবারে তখন একেবারে ঝড়ের উৎসস্থল —খোরদাতে। প্রবল রভসে মহা হুহুঙ্কার রবে সকলকে সন্ত্রস্ত করে ফণী এসে আছড়ে পড়ল। ঝড়ের তাণ্ডবে চারপাশ লণ্ডভণ্ড। ধোঁয়াটে পাহাড় ঘেরা জাটনি জনপদের নয়নাভিরাম হরিয়ালি বিলকুল লোপাট করে, অজস্র ক্ষতচিহ্নের স্মারক রেখে ফণী চলে গেল তার বায়বীয় পরিমণ্ডলের রহস্যময় ঘেরাটোপে। ওডিশায় ঝড়ের পরে বিধ্বস্ত মানুষের মধ্যে এক আশ্চর্য নির্লিপ্ততা লক্ষ করেছিলাম। বিদ্যুৎ নেই, পানীয় জলের পর্যাপ্ত সরবরাহে ঘাটতি, ঘরবাড়ি, দোকানপাট সব ধ্বংসস্তুপে পরিণত। অথচ সাধারণ মানুষজনের মধ্যে হাহুতাশ নেই, প্রতিবাদের নামে অযথা প্রশাসনের মুণ্ডুপাত করা নেই, অসহযোগিতার ফন্দিফিকির নেই, গাছের ডাল পড়ে ঘর ক্ষতিগ্রস্ত বলে পড়শিকে দোষারোপ করা নেই। যেন খুব স্বাভাবিক একটা ঘটনা ঘটে গিয়েছে। তাদের এমন সংযত, অনুত্তাপ, অভিযোগহীন অভিব্যক্তি আমাদের বিস্মিত করেছিল। চমক লেগেছিল, এক বরিষ্ঠ মানুষের কথায় —‘সব কালিয়া প্রভূর ইচ্ছা!’ দারুভূত ঈশ্বরের প্রতি এমন আত্মনিবেদন, মানুষটিকে নিমেষে শ্রদ্ধেয় করে তুলেছিল আমার কাছে। ভুবনেশ্বর শহরেও দেখেছি, মানুষজন ঝড় পরবর্তী বিপর্যয় নিয়ে আশ্চর্যরকমের নিস্পৃহ, নিরুত্তেজ, নিরুদ্‌বিগ্ন। ভাবখানা এমন যে—যা গেছে যাক। এবার নতুন করে গড়ে নেবার পালা। এত সব কথা বলছি তার কারণ ওই ঘটনা আত্মসংযমের এক পরম শিক্ষা দিয়ে গেছে আমাদের; পরম বিপদের ক্ষণেও স্থির থাকার শিক্ষা পেয়েছি এক অবসর যাপন কালেই।

সাম্প্রতিক উম্পুন ঝড়ের পর রাজ্যের শহরবাসী মানুষজনের মধ্যে যে ক্ষোভের বাত্যা প্রত্যক্ষ করলাম, তা প্রকৃত ঝড়ের গতিবেগকেও বুঝি হার মানাল। সময় কি আমাদের ক্রমশই অসহিষ্ণু করে তুলেছে? বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে পাঞ্জা কষে যুঝবার ইচ্ছে বা সামর্থ্য—দুই কি হারিয়ে ফেলেছি আমরা? নাকি সে-ই সামর্থ্যটুকু অ-সামর্থ্যে পরিণত হলো ধীরে ধীরে সংবাদমাধ্যমের অকুস্থল থেকে ‘খবর’ পরিবেশনের কারণে? কিংবা কিছু সময়ের বিরতির পর, সোশ্যাল মিডিয়ার সার্ভে স্টেটাসে—‘আমি সুরক্ষিত আছি’ জানান দেওয়া এবং ‘তিনদিন হয়ে গেল…চারদিন হতে চলল এখনও’…জাতীয় চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকা মন্তব্যে? মাঝে মাঝে মনে হয়, এই আপাত আধুনিকতা বা ব্যক্তিস্বাধীনতার পক্ষে কথা বলতে বলতে ক্রমশই কি আমরা যূথবদ্ধ সামাজিক যাপনের গরিমা থেকে নিজেদের বিচ্যুত করে ফেলছি বা ফেলতে বাধ্য হচ্ছি নিজেদেরই অজান্তে? অথচ এই পথেই তো এল কত কত বিজ্ঞপ্তি, পরিকল্পনা, উদাহরণ মানুষের পাশে থাকার। মানুষের প্রয়োজনে তো মানুষই বাড়াল সাহায্যের হাত। জানি সব প্রশ্নের বা সংশয়ের উত্তর পাওয়া খুব সহজ নয়, তবু প্রশ্নগুলো নিয়তই মনের মধ্যে পাক খেতে থাকে নিছকই এক ঘূর্ণিঝড়ের মতো। মাঝে মাঝেই মনে হয় মানবসভ্যতা হয়তো এক বড়ো বাঁকের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। স্রোতের গতিপ্রকৃতি সঠিকভাবে ঠাওর করতে না পারলে যেমন মাঝির পক্ষে নৌকো বাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে, একইভাবে; দৈনন্দিনতায়, এই ইতিউতি উঁকি মারা লক্ষণচিহ্নগুলোর সম্পর্কে উদাসীন থাকলে হয়তো আগামীর দিনযাপন কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠবে আমাদের কাছে। আসলে প্রতিটি ঘটনাই আমাদের কিছু শিক্ষা দেয়। সেই শিক্ষাকে গ্রহণ করতে করতেই জীবনপথের পথিক হয়ে মানুষের এগিয়ে চলা। এই সত্য থেকে বিচ্যুত হলে বা বিস্মৃত হলে যে আমাদেরই তার জন্য গুণাগার দিতে হবে!

একটু না হয় পিছন ফিরে তাকাই। ১৯৬২ সাল। আমার তখন নেহাতই বালচাপল্যের বয়স। চতুর্দিকে গুজগুজ, ফুশফুশ—“আমরা আক্রান্ত! সেই বয়সেই কতগুলো কঠিন শব্দবন্ধের সঙ্গে পরিচয় ঘটল—আগ্রাসন, আক্রমণ, দখলদারি, সাঁজোয়া, বোমারু, প্রতিরোধ—এমনই সব কঠিন কঠিন শব্দ। এসব সেই বয়সের পাঠ্য কেতাবে লেখা থাকত এমনটাতো নয়, ঘটমান সময়ের পাতা থেকে এসব শব্দকে আমাদের শিখে নিতে হয়। ১৯৬৫ সালে এসে এই শব্দভাণ্ডারের শ্রীবৃদ্ধি ঘটল অনেকটাই। আর আজ এই ২০২০ সালে এসে আরও অনেক অনেক নতুন শব্দবন্ধ কানের ভিতর দিয়ে একেবারে আমাদের মরমে গেঁথে গেল। শেখার পর্বটি শিশিক্ষু মানুষের কাছে অতিদীর্ঘ এক সড়কের মতো—যত হাঁটবে তত শিখবে, যত শিখবে ততই পথ বাইতে চাইবে মন। না হলে, সুদূর উহান শহর থেকে উড়ে এল, অজানা এক ভাইরাস। নিয়মকানুন মানে না কিছুই, বিশ্বজুড়ে ছড়ায় ত্রাস। ভাইরাসের ভয়াল ভূ-প্রদক্ষিণের ভোজবাজির দাপটে কম্পমান বিশ্ববাসী কত কত নতুন শব্দের সঙ্গে সই পাতালো। আট থেকে আশি বছরের সকল মানুষের জীবনাভিধানে ঠাঁই পেল কত নতুন শব্দ। অথবা শব্দগুলো হয়তো ছিলই অন্য রূপে, অন্য অর্থে, পালটে গেল কেবল তার প্রয়োগ। ভিন্ন অর্থে। আমরা দেখলাম, মার্কস সাহেব আর মাস্‌ক সাহেব একাসনে এলেন এভাবেই —সাম্যের প্রতীক হয়ে। সমস্ত সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থানের গৌরবী ভেদচিহ্ন লোপাট করে। এ অবস্থায় পরিচিত ঢঙে কেবল দক্ষিণহস্ত মুষ্টিবদ্ধ করে কাঁধের ওপর তুলে একটা কথাই হয়তো বলার, অনেক হয়েছে; — হে মাস্ক মহোদয়, প্রিয়সাথী! এবার বিদায় নাও।

কিন্তু বিদায় নাও বললেই তো আর তিনি চুপিসাড়ে বিদায় নেবেন না। এ কথা তো এখন বালক-বালিকাও জানে। সমাজবদ্ধতার কারণেই মানুষের অগ্রগতি। পাশাপাশি থাকার, সহযোগী, সহমর্মী মনোভাবের কারণেই মানুষের এমন স্বাতন্ত্র্য তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। এ কথা তো মানতেই হবে, ইতিহাস সাক্ষ্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক নানা টানাপোড়েনে বাঙালির যৌথ সংসারেও বালকবি বৈরাগী কথিত, আমরা দুই ও আমাদের দুইয়ের ছবিটি এতদিনে ধীরে ধীরে সুখী গৃহকোণের প্রতীক হয়ে গিয়েছে। তবু লোকলৌকিকতা বা সামাজিকতা বিচ্ছিন্ন সে ‘নিউক্লিয়ার’ যাপন তো নয়। ছিল না এতদিন। সামাজিক দূরত্ববিধির ঘেরাটোপে আটকে এবারে কি তবে সেই যাপনেরও ভাঙন ত্বরান্বিত হলো? যা হয়তো ছিলই আড়ালে আবডালে, তাই বুঝি এবার এল প্রকাশ্যে? একরত্তি ‘ভাইরাস’ যে মানসিকতার নিমিত্তমাত্র। এ প্রশ্নের উত্তর এখনই মিলবে না। তবে যেসব বিক্ষিপ্ত ঘটনার কথা রাজ্যের তথা দেশের নানা প্রান্তের জানা যাচ্ছে, সংবাদমাধ্যমের সৌজন্যে, তাতে করে মনে হয় ‘দূরত্ববিধি’ বজায় রাখতে গিয়ে আমরা হয়তো সত্যিই আরও সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ব আগামী দিনে। এবং কোনো সমাজবিজ্ঞানী হয়তো মেতে উঠবেন তার গবেষণায় এ নিয়ে। আমরা পাঠকেরা আরও বিস্তারিতভাবে জানতে পারব এ ভাঙনের নানান পরিমাপ-মানদণ্ড। কোন অ্যাড্‌হেসিভ বা আসঞ্জকের প্রভাবে আবার আমরা আমাদের মধ্যকার অসুখোচিত দূরত্বকে দূর করতে পারব ভবিষ্যতই তার উত্তর দেবে।

এ সময়ে যে শব্দবন্ধটি আসমুদ্র হিমাচলের এদেশকে সবচেয়ে বেশি, প্রবলভাবে আলোড়িত করেছে তা হলো—‘পরিযায়ী শ্রমিক’। পরিযান একটি স্বতঃস্ফূর্ত জৈবনিক প্রক্রিয়া। যারা একটু চোখ-কান খোলা রেখে চলেন, তারা জানেন আর্কটিক টার্ন-মনার্ক বাটারফ্লাই-ঈল মাছেদের মতো না-মানুষী প্রাণীরা দীর্ঘ পরিযানে অভ্যস্ত। বাঙালির অতি প্রিয় ইলিশ মাছ একটি দক্ষ পরিযায়ী মৎস। রুটি-রুজির টানে, উন্নত বেতন তথা জীবনের আশায় আকৃষ্ট হয়ে মানুষ নিজের চেনা মহলের চৌহদ্দি ছেড়ে দূরদূরান্তে পাড়ি জমায়। অথচ মন পড়ে রয় বাড়িতে, নীড়ে; অন্য কোথাও নয়। সেই মানুষগুলোই যখন এই অভাবিত আপৎকালে নিজেদের ঘরে ফিরতে চাইল তখন তাদের সঙ্গে এমন অমানবোচিত আচরণ কেন? এত রূঢ় এক শব্দবন্ধে তাদের দেগে দেওয়া কেন? প্রাণী সমাজে যা একটি স্বাভাবিক ঘটনা, উন্নত শ্রেণির প্রাণী মানুষের সমাজে তা এত ‘অশ্লীল’ নিকৃষ্ট অর্থে প্রযুক্ত হবে কেন? প্রয়োজনে যাদের পরিষেবা নেওয়া যায় অপ্রয়োজনে তাদের অসম্মানও করা যায় এই ধারণা কীভাবে গড়ে উঠল—প্রগতিশীল সমাজে? নাকি ছিলই, ঢাকা পড়েছিল কেবল, ভারতবর্ষের মতো বিরাট দেশে টুকরো টুকরো বিচ্ছিন্ন গুরুত্বহীন সব খবর, ঘটনা হয়ে। ঘটে চলেছিল আমারই চারপাশে, অথচ সেই দেখাটুকু নিয়ে আমি কখনও সেভাবে ভাবিনি। যেভাবে ভাবে না, আর পাঁচজন। এতটাই সহজ স্বাভাবিক সে সব। বোধহীন, দীনতার এমন প্রকাশ হয়তো আমাদের পক্ষেই করা সম্ভব।

সব ক্ষতির ক্ষতিপূরণ হয়? মানুষে মানুষে সম্পর্কের ভিত রচনা করে বিশ্বাস, পারস্পরিক শ্রদ্ধা। পুরোনো প্রবাদ বলে, সুখের সময়ে পাশে থাকা নয়, দুঃখের দাহকালে যে বা যারা পাশে থাকে তারাই প্রকৃত বন্ধু—এই অতিমারী বহুদিনের চেনাজানা এ কথার ওপর এখন এক আস্ত প্রশ্নচিহ্ন! সাধারণ দৃষ্টিতে ধরা পড়ে না যে, এমন এক অণুজীব, সে পালটে দিচ্ছে মানুষের যাবতীয় অভিজ্ঞতার নির্মাণকে। দুঃখের দিনেও আর কারও পাশে থাকতে দিচ্ছে না সে। সংশয় দু-তরফেই। তার চেয়ে ঘরবন্দি থাকা ভালো। আর তাই হয়তো বন্ধু হয়ে উঠতে পারলাম না আমরা অনেকেই শেষমেশ ঘরে ফিরতে চাওয়া সেই পরিযায়ীদের। আগামীতেও কি পারব? আরও অনেক প্রশ্নের মতো এ প্রশ্নের উত্তরও জানা নেই।

এই বদ্ধ-অবসর জীবনের সবটাই যে এমন শব্দজটের ভাবনায় কেটেছে তেমন নয়। ডাকঘরের অমলের মতো বারান্দায় বসে বসে বহু মানুষের সঙ্গে সখ্যতার বাঁধনে বাধা পড়েছি। ‘লকডাউন’—এক ক্ষণিক ঘোষণাতেই এতদিনের চেনা ছন্দ হারিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেল আপামর মানুষের জীবন। এক অতি সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক দিনযাপনের পরিসরেও তো থাকে অনেক সাধন, যাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার লড়াই, টিকে থাকার লড়াই লড়তে হয়। লকডাউনের ফলে সহসা কর্মহীন হয়ে পড়া অসংখ্য মানুষ বাধ্য হয়েই সামিল হয় নতুন মিছিলে। পদাতিক এইসব মানুষেরা পশরার ডালি সাজিয়ে পায়ে পায়ে নেমে আসে পথেই। তাদের পদশব্দে, পণ্যের জন্য হাঁকাহাঁকিতে সরব হয়ে ওঠে আমার পাড়ার নির্জন, একান্ত গলিপথও। এক নতুন দর্শনের অবকাশ মেলে। যেদিন থেকে বাড়ির সামনের রাস্তা জুড়ে পশরার ডালি সাজিয়ে নতুন নতুন মানুষদের আনাগোনা বাড়ল সেদিন থেকেই বাড়ল আমার নতুন বন্ধুত্বের পুঁজি। সিমেন্টের বাঁধানো রাস্তা তার চেনা রূপ, চেনা ছন্দ বদলে হয়ে উঠল এক আশ্চর্য চলমান বিপণি। সেইসব বিপণিতে মেলে না এমন জিনিসই নেই। মনের সেতু বাঁধতে দেরি হয় না। আর তাই;—আলম, সুকুর, আমিরুল, শফিক, শাজাহান, ইমজামুলের সঙ্গে সঙ্গে কানাইদা, পরিতোষ, হরষিত, মিলন, সুজয়, জয়ন্ত—আরও আরও অনেকে আমার আত্মজনের মতো হয়ে ওঠে। ওদের কাছ থেকেই পাই জীবনের শিক্ষা, বেঁচে থাকার লড়াইয়ের শিক্ষা। বহমান জীবনের এক প্রান্তসীমায় এই শিক্ষার স্বাদ পাওয়ার সৌভাগ্য ক’জনেরই বা হয়! আমি যে পঞ্চপ্রদীপ জ্বালিয়ে এদের জন্যই পথ চেয়ে আছি।