শাশু বজ্যৈ-এর বগলে মোরগ!
অবাক হয়ে দেবী জিজ্ঞাসা করে ফেলল, কোথায় পেলেন!
পেয়েছি, ঈশ্বর দিলে না পাওয়ার কী আছে!
এভাবে বগলে চেপে আনতে হয় নাকি! সারা কাপড় রক্তে ভিজে গেছে।

বৃদ্ধা কাছে থাকা নাতিটাকে দূরে তাড়িয়ে, দরজা বন্ধ করে পুত্রবধূর কানে কানে বললেন, এই, বেশি হল্লা করিস না। আশপাশের লোকেরা টের পেয়ে যাবে। কতজনেই তো পাঁঠা খাসি এমনকি বুড়ি ছাগল কেটে হাপিস করে ফেলে। আমরা তো তা টেরই পাই না!

দেবী কোনো কথা না বলে, নীরবে রান্নাঘরে গিয়ে এক কড়াই জল গরম করতে লাগল। টগবগ করে ফুটে ওঠা জলে মোরগটাকে চুবিয়ে এনে তার রোম ছাড়াতে লাগল। তারপর আগুনে সেঁকে, মোরগটাকে কেটে রান্নার জন্য তৈরি করার পর মনে পড়ল, ঘরে চাল তো নেই। কাল দুপুরে খাওয়ার লোক দুজন কম থাকায় টেনেটুনে পুষিয়ে গিয়েছিল। মশলা-টশলা আদা পেঁয়াজ রসুন—তেলও তো নেই—তেল না হলে মাংস কীভাবে খাওয়া যাবে?

সেদিন বাপের বাড়ি যাওয়ায়, তার মা লুকিয়ে একটা পাঁচ টাকার নোট তার হাতে দিয়েছিলেন, তা দিয়ে চরালির রামভরোসের দোকান থেকে মশলা-টশলা আদা রসুন পেঁয়াজ তেল আনা যেতে পারে, কিন্তু চাল?

এবার চালের সমস্যার সমাধানের কথা ভেবে, পটুকা (কোমরবন্ধ)-র মতো করে বাঁধা শাড়ির আঁচলটা খুলে, নিজের শরীর ঢেকে, মোরগটার পা-দুটি ছেলেরা আগুনে পুড়িয়ে খাবে বলে, অস্পষ্ট উচ্চারণ করতে করতে সেগুলি এনামেলের কড়াই দিয়ে ঢেকে রেখে ‌ঘর থেকে বেরুলো দেবী।

মাংস খাওয়ার খুশিতে বুঁদ হয়ে বুড়ি মিষ্টি স্বরে ছেলের বউকে বলতে লাগলেন, এই দেবী, একটু ভালো মশলা-টশলা দিয়ে খুব ভালোভাবে বানাবি। অনেক দিন পর একটু স্বাদ বদল করে আরামে খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। মরিচটা একটু ভালোভাবে দিবি, হ্যাঁ—।

মাংস খাওয়ার কল্পনায় বৃদ্ধার রসনা ভিজে জবজব করতে লাগল। পল্টনে থাকাকালীন মাংস খেতে খেতে বিরক্ত হয়ে দিন দুয়েক শাক-সুক্তোর ঝোল দিয়ে ভাত খাওয়া হত। আহা কেমন ছিল সেই দিনগুলি!—বলে (বলবাহাদুর)-র বাবা গোঁফে তা দিতে দিতে তেরছা চোখে তার দিকে চেয়ে বলতেন, এই সাঁহিলি (জন্মক্রমে তৃতীয় কন্যা বা বোনকে যে নামে ডাকা হয়), আজ ভুটুওয়া (ভাজার মতো শুকনো করে রান্না করা মাংস) খেতে হবে। নে নে বুড়ি (স্ত্রী), আরে খা-খা। দু-গেলাসেই মাংসের বদলে শাক খেয়েছিস, হাহা।

তারপর আর কী, তিনি মাদলে সুর তুলতে আরম্ভ করতেন, ‘সাঁহিলি ধাই রহনে বনমা রসলে ভুল্যায়য়া…’ (বোন চলার বনপথ রসে ভুলিয়েছে) সারা লাইনটাকেই (সারিবদ্ধ কোয়র্টার) মাতোয়ারা করে দিতেন।

বজ্যৈ তাঁর স্মৃতির মধ্যে বুঁদ হয়ে আছেন; ঠোঁটে যৌবনের মুচকি হাসি। দিন বলতে সেই দিনগুলোই ছিল। আহা—! কত ভালো ছিল সেই দিনগুলি। অজান্তে বুকের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।

খেতে আসুন। দেবী ডাক দেয়। বৃদ্ধার স্মৃতি-মহল ভেঙে চুরমার হয়। তাড়াহুড়ো করে খেতে বসে পড়েন বজ্যৈ। সেই তখন—পল্টনে থাকাকালীন কেনা কত কাঁসার থালাবাটি; এখন শুধু এই একটি কাঁসার বাটিকে তিনি তাঁর স্মৃতির ভিত হিসাবে প্রাণপণে বুকে জড়িয়ে ধরে আগলে রেখেছেন। কেউ এটাকে ছিনিয়ে নিতে পারেনি এখনও। আগে একসময়—সাঁহিলি বজ্যৈয়ের রান্নাঘর কাঁসার থালাবাসনে ঝলমল করত। আত্মীয়স্বজনেরা বজ্যৈয়ের প্রশংসা করে বলতেন, ’আহা কত লক্ষ্মী বউ এই ঘরের’। এখন শুধু একটা বাটিকে আশ্রয় করেই লক্ষ্মী বাঁধা পড়ে আছেন এই ঘরে।

বৃদ্ধা বেড়ে দেওয়া ভাতে কাঁসার বাটি থেকে একটু মাংসের ঝোল তুলে মেখে এক গ্রাস মুখে দেন। আহা—! চিকন চালের ভাত দেখছি, কোথা থেকে এনেছিস?

বউ মিষ্টি স্বরে বলে, আপনি খান না।

গপাগপ গ্রাসের পর গ্রাস মুখে তুলতে লাগলেন বজ্যৈ। হঠাৎ থেমে গিয়ে বাটির দিকে চেয়ে ভাবতে আরম্ভ করলেন—অত বড় মোরগ—আর আমার ভাগে এইটুকুন!

নাতিরা ঠাকুরমার ভাগের দিকে চেয়ে ভাবতে লাগল, মা শুধু ঠাকুরমার ভাগে বেশি করে দিয়েছে। তবু, ‘আরও দেবো নাকি?’ বলে জিজ্ঞাসা করছে, আর তাদের ভাগে শুধু একবার মাত্র দিয়েছে, কিন্তু ‘আরও দেবো নাকি?’ বলে জিজ্ঞাসাও করছে না।

খেতে বসে ছোটটা ঝিমিয়ে ঢুলছে। ভাতের গ্রাস নাকের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। নিজের ভাগের একটুকরো মাংস ভাতের সঙ্গে ডলে মিশিয়ে দেবী তাকে খাইয়ে দিতে লাগল। শাশুড়িকে ‘আরও দেবো নাকি?’ জিজ্ঞাসা করার সঙ্গে সঙ্গে এবার তার বড় ছেলেটা বলে ওঠে, আমাকে ভাত দাও, মাংসও।

নে, এটা খেয়ে নে—বলে, বলবাহাদুর তার এনামেলের বাটিতে থাকা মাংস থেকে দুই টুকরো তার ভাগে দিয়ে বাকি মাংস স্ত্রীর দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলে, নেও—এটাতে নিয়েই খেয়ে ফেলো।

থাক, লাগবে না। আমার জন্য রেখেছি, আপনি খান।

সাঁহিলি বজ্যৈ-এর পেট ভরলেও, মন এখনও ভরেনি। শাড়ির আঁচল দিয়ে নাক মুছতে মুছতে বললেন—কই, আর একটুক দে তো—খুব ভালো রান্না হয়েছে—এক গ্রাস বেশি খেতেও ইচ্ছে হচ্ছে। হঠাৎ খুবই জরুরি কথা ভাবার মতো করে জিজ্ঞাসা করলেন—কালকের জন্য রেখেছিস তো। বাগানে মুলো আছে। কাল মুলো মিশিয়ে বানাবি—হ্যাঁ।

দেবী যে কথাটির জন্য মনে মনে ভয় পাচ্ছিল, সেটাই হতে চলল। শাশুড়ির ভাতের দানা হাতে দিয়ে হাতড়াতে থাকা দেখেই, মনে সন্দেহ হয়ে গিয়েছিল। ভাবল সত্যি কথা বলে দেওয়াই উচিত হবে। কারণ এমনিতেই কাল টের পেয়ে যাবেন। শাশুড়ির থালায় এক টুকরা কলজের মাংস দিতে দিতে বলল—কী করে রাখব বজ্যৈ! কাটতে কাটতেই তো অর্ধেক হয়ে গিয়েছিল। তা থেকে একটুখানি মাংস কাটুলির মা’কে দিয়ে চাল নিয়ে এলাম। আগুনে মাংস সেঁকার সময় বাচ্চারা কাটুলির মা’কে মাংস খাব মাংস খাব বলে হয়রান করছিল। এক উঠোনের ঘর—না দিলে…।

সেদিন তো দুজনে চুল ছেঁড়াছেঁড়ি করছিলি—আজ আবার আত্মীয়তা পাতাতে গেলি তোর সতীনের সঙ্গে! মরতে পারলি না। —বৃদ্ধা হঠাৎ রেগে ওঠেন। সমস্ত রাগ জমা হলো নাকের শিকনিতে। রাগে কাঁপতে কাঁপতে নাকের শিকনি ফেলে, শাড়ির আঁচল দিয়ে নাক মুছতে লাগলেন।

দেবী নীরব। বাসনকোশন গুছিয়ে এঁটো মুছতে আরম্ভ করল। ওর মন যদিও ককিয়ে উঠেছে। ভাবে, এত যে বকছেন, মাংস না হলে, এখন কোথা থেকে ওঁর পেটে ভাত সেঁধাত?

বজ্যৈ অনবরত বকবক করে চলেছেন, আমি অতদূর থেকে প্রাণপণ করে বয়ে আনলাম। আর উনি খুব দান মারাচ্ছে…।


২.

সমস্ত স্বাদটাই বুঝি নষ্ট হয়ে গেছে তাঁর। কম করেও দুই বেলা স্বাদ বদল করে করে খাওয়ার ইচ্ছা ছিল মনে। ভাগ্যে না থাকলে, কী আর করা যায়! ছোট উখলিতে কুটা তাম্বুল পান মুখে দিয়ে ধীরে ধীরে চিবোতে থাকেন। গতকাল থেকে জমে থাকা ক্লান্তি এখন তাঁকে কাবু করতে আরম্ভ করেছে।

চোখের সামনে গতকাল থেকে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলি ভেসে উঠছে।

মহাজনের বাড়িতে নেমন্তন্ন। আজ ভোরেই যাওয়ার কথা ছিল বজ্যৈর। কিন্তু দিন দেখে আষাঢ় মাসের পনেরো তারিখের মতো মনে হচ্ছে। সময়ে বেরুতে চাইলেও, বেরুতে পারছেন না। সেই তখনকার ভালো দিনের কাঠের বাক্সের ডালাটা হাঁ-করে খুলে ব্যস্ততার সঙ্গে এক একটা পুঁটুলি খুলে খুলে দেখা হচ্ছে। দেখতে দেখতে ক্লান্ত।

—কই কোথায় রেখেছি?

আমার বোধহয় মরার সময় এসে গেছে! এখানেই রেখে ছিলাম, পল্টনের মোজা, হাত পাঞ্জা, হাতল খুলে যাওয়া খুকরি। বলে-র বাবার কাঁধ ফেসে যাওয়া কামিজ, বিয়েতে আনা লাল শাড়ি, কয়েকটা বোতাম। মেয়ের দিকের নাতিনের বিয়েতে দেবো বলে, রাখা এক জোড়া ‘রৈয়া’ (রুপোর বালা)।—কই কোথায় গেল? নেই! সমস্ত কিছু ভালোভাবে খুলে ঝেড়ে ঝেড়ে দেখে ফেললাম—কই? নেই, কোথাও নেই!

এই আমার রুমাল কে নিয়েছে—হাঁ? সেটায় আমি দু-টাকা বেঁধে রেখেছিলাম। সব সময় এরা কার মাথা খুঁজতে থাকে কী জানি! পেটের ভেতর লুকিয়ে রাখলেও স্বস্তি নেই। পারলে পেট চিরেও বের করে ছাড়বে। এই দিয়ে দে, কে নিয়েছিস—তা না হলে…।

দেবী মাড় ফেলে ভাত ঝরঝরে হওয়ার জন্য চুলোর উপর রেখে, শাশুড়ির সামনে আসে—কী হল বজ্যৈ, কেন চেঁচাচ্ছেন?

মিছেমিছি এমনিতেই চেঁচাচ্ছি নাকি? একটা রুমাল এখানেই রেখেছিলাম, কোথায় গেছে কী জানি! কেউ না নিয়ে গেলে, পালিয়ে যাওয়ার জন্য রুমালের ঠ্যাং নিশ্চয়ই নেই।

দেবী এগিয়ে এসে কাঠের বাক্সটা খুলে, একটা পুঁটুলি হাতে নেওয়া মাত্র, বৃদ্ধা ছোঁ মেরে পুঁটুলিটা কেড়ে নিয়ে বাক্সে রাখতে রাখতে বললেন, আমি সবটাই দেখে ফেলেছি—ওখানে নেই।

দেবীও ছাড়বার পাত্র নয়। নাহ‌্, বজ্যৈ-এর রোজ রোজ একটা না একটা জিনিস হারিয়ে যাচ্ছে। ছেলেরা যদি নিয়ে থাকে, তবে তা ভালো হচ্ছে না—অভ্যাস শোধরাতে হবে, তা না হলে দুনিয়ার মার খেয়ে মরতে হবে।

ওরা নেয়নি। কেন মিছেমিছি ওদের দোষ দিচ্ছিস। নিজের কাজ কর-গে যা।

দাঁড়ান, আপনার ছেলেকে জিজ্ঞেস করে দেখি, বাগানে কাজ করছেন—বিড়ি-খইনি খাওয়ার জন্য নিয়ে গেছেন কিনা। আমারটাই তো নিয়ে নেন, আর আপনারটা নিতে কত দেরি। পয়সাটা নিয়ে রুমালটা বোধহয় কোথাও ফেলে দিয়েছেন।

সে কখনও আমার পয়সা নেয় না। আর আমার বাক্সটা তো সে ছোঁয়ই না, বৃদ্ধার গলার স্বর ক্রমশ নীচু হয়ে আসে।

দেবী ক্ষুব্ধ স্বরে বলল, তাহলে চোর হলাম আমিই—সব সময় বাড়িতে তো আমিই থাকি। আমি না নিলে কে নিয়েছে?

কেন মিছেমিছি ঝামেলা বাঁধাচ্ছিস—আমি সে রকম কথা বলেছি নাকি। ঘরে কত লোক আসে যায়। চোখে না দেখে, কাকে দোষ দেওয়া যায়?

দেবী একটা লাঠি নিয়ে বিছানার তলায় নাড়াচাড়া করতে লাগল। একটা উই পোকায় ধরা পুঁটুলি লাঠি দিয়ে টেনে আনল। কতগুলি ইঁদুরের ছানা ছুটে দৌড়ে পালাল।

আমার বুদ্ধি নষ্ট হয়ে গেছে—ওখানেই রেখেছিলাম, খুলিস না।

দেবী না শোনার মতো করে বলতে লাগল, বিছানার নীচে জিনিসগুলি এভাবে রাখতে হয় না কি? দেখুন তো, বিছানার নীচের দিকের অবস্থাটা!

থাক। এখন থাক। পরে পরিষ্কার করব। এখন তোর কাছে থেকে থাকলে, পুরোনো হলেও একটা রুমাল দে-তো। সেটা নিয়েই চলে যাই।

পুরোনো শাড়ির একটা কোণা ছিঁড়ে রুমাল বানিয়ে দিয়ে, দেবী রান্নাঘরের দিকে দৌড় দিল—ভাতটা বোধহয় তলানিতে লেগে গেছে। তাড়াতাড়ি ভাত নামিয়ে কড়াই বসাল এবং তাতে শুকনো ধেনো মরিচের ফোড়ন দিয়ে তাতে কুন্দ্রুক (শুকানো শাক), টমেটো, হলুদ, লবণ দিয়ে নেড়েচেড়ে তাতে এক বাটি জল দিল—ভক‌্ ভক্ করে কুন্দ্রুকের ঝোলটা উথলানোর পর জিজ্ঞাসা করল, বজ্যৈ আপনি সকালে শুধু এক বাটি লাল চা মাত্র খেয়েছেন, এক গ্রাস ভাত খেয়ে যাবেন নাকি?

বৃদ্ধা তাঁর কোমরবন্ধটা শক্ত করে বেঁধে রওয়ানা হচ্ছিলেন। ছেলের বউয়ের ডাক শুনে একটু থেমে গিয়ে বললেন, পেট-ভর ভাত ঠুসে নেমন্তন্ন খেতে যেতে হয় নাকি? বেশি খেয়ে ফেললে—ওখানে গিয়ে কী করে খাওয়া? ভোজ-নেমন্তনে গিয়ে—ঘরের একবেলার খাওয়া না বেঁচে গেলে—কী লাভ! থাক, খাব না। খেয়ে হাঁটতে বড় কুঁড়েমি লাগে।

—এখনও এল না! ঠুলে-টা মাস্টারকে বলে, তাড়াতাড়ি আসবে বলেছিল—ভুলে গেছে নাকি? আমার সঙ্গে যাবে বলে তো হত্যে দিচ্ছিল—সে না আসা পর্যন্ত যাব কীভাবে? ওদিকে মহাজন‌্নী (মহাজনের স্ত্রী) ভোরেই চলে আসার কথা বলেছিলেন। বৃদ্ধা ফের গজরগজর করতে লাগলেন।

দেবী বলে, থাক, তাকে আর নিতে হবে না। আপনার দেরি হয়ে যাবে। সে-ও বুঝতে শিখুক একটু।—মুখে বললেও, দেবী মনে মনে ভাবল—নিয়ে গেলেই ভালো হত—এক বেলা হলেও, ভালো ভাবে খেত!

তাহলে আমি হাঁটি। পথে পেলে নিয়ে যাব। কিন্তু গায়ে কিছু পরেছে? একটা যা-কিছু পরলেও, শরীরটা ঢাকলেই হল।

হাতে লাঠি নিয়ে বৃদ্ধা হাঁটতে আরম্ভ করলেন—স্কুলটা তো পথেই, মাস্টারকে বলে সঙ্গে নিয়ে যাবে।

হাঁচ্চো—।

রাস্তায় একজনের হেঁচে ওঠার শব্দ শুনতে পেয়ে বৃদ্ধা চড় মারার মতো করে হাত তুলে বললেন, থুঃ, অলক্ষুনে মরা—অলক্ষণ দেখাচ্ছিস! কতদিন হলো মাংস কী বস্তু তা দেখতে পাইনি—আশপাশে মাংস রান্নার গন্ধে মন ভরে যায়, কিন্তু কী করা; মুখে গ্রাস ভরে ভাতই জোটে না; আর মাংস কোথা থেকে?—জন্তেবাখ্রায় (বরযাত্রীরা বর বউকে নিয়ে বাড়ি ফেরার পর মাংস-ভাত খাওয়ার প্রথা) খেতে পাওয়া যাবে ভাবা মাত্র এই মরাটা অলক্ষ্মী দেখিয়ে দিল; থুঃ—।

দূরে বড় বটগাছের তলায় ছেলেমেয়েরা চিৎকার করে কানামাছি খেলছিল—চোখ বেঁধে সঙ্গীদেরকে ধরার জন্য দৌড়াবার সময় বৃদ্ধার সঙ্গে ধাক্কা লাগা মাত্র বৃদ্ধার একদিকে লাঠি একদিকে ঝুলি—বৃদ্ধা চিত। আর হাহাহিহি করতে করতে ছেলেমেয়েরা দৌড়ে পালাল। ঠুলে ওদের সঙ্গেই খেলছিল। ঠাকুরমাকে তোলার জন্য দৌড়ে এল। বৃদ্ধা কোনোমতে উঠে বটগাছের নীচে গিয়ে বসলেন।

নাতি ও লাঠির উপর ভর করে কোনোক্রমে মহাজনের ঘর পর্যন্ত পৌঁছানোর পর বৃদ্ধা দেখতে পেলেন, দুপুরের খাওয়াদাওয়া শেষ হয়ে গেছে। বৃদ্ধার মন মরে যেতে লাগল। সেই কখন সকালবেলা ফিকে চা—এখানেও দেখছি খেতে পাওয়া যাবে না।

এই যে সাঁহিলি—এসে পৌঁছলেন তাহলে। আমি তাড়াতাড়ি আসবার জন্য খবর পাঠিয়ে ছিলাম। উনি দেখছি, দেরি করে আসবার কথা শুনতে পেয়েছেন। মহাজন্নী বললেন, খাও এবার শুকনো পুরি।

হবে, তা হলেও চলবে। বৃদ্ধা নিশ্চিন্ত হয়ে নাতিকে নিয়ে খেতে বসলেন।

এখন এগুলিই খাও, বিকেলে বরযাত্রীরা রওয়ানা হওয়ার পর রাত্রে ভালো ভাবে খাবে। মহাজন্নী চার-পাঁচটা পুরি ও তরকারি দিতে দিতে বললেন।

বৃদ্ধা ও তাঁর নাতি দুজনেই তাড়াহুড়ো করতে করতে পুরি ও তরকারিগুলিকে নিজেদের পেটে পুরতে লাগল—মহাজন্নীর কথা কানে পৌঁছলেও, মুখভরা পুরি-তরকারি থাকায় ‘আজ্ঞে’ বলার ইশারায় শুধু মাথাটা নড়ল।


৩.

মহাজন্নী আরও—আরও—কেবল দিয়েই যাচ্ছেন আর বৃদ্ধা ও নাতিটি কেবল খাচ্ছে—এ প্রক্রিয়া দীর্ঘ সময় ধরে চলতেই থাকত—এমন সময় নরসিংহা ও কর্নাল ধোঁ-ধুঁ-ধুঁ-তু-রী-ধোঁ-ধোঁ করে প্রচণ্ড শব্দে বেজে উঠে বিয়ে বাড়িকে মাথায় তুলে ফেলল। সাঁহিলি বজ্যৈ ও তার নাতিকে ছেড়ে মহাজন্নী লাফ দিয়ে উঠে পড়েন। তাঁর বড় নাতির বিয়ে।

এই, বরযাত্রীদেরকে সগুন দাও, সগুন দাও (বিয়ের আচার পালনে ‘সগুন’ হিসাবে চালের গুঁড়ি, গোলমরিচ, এলাচ ও গুড় দিয়ে বানানো মাঙ্গলিক নাড়ু দেওয়ার নিয়ম) বলে চিৎকার শুরু করলেন। কে শুনবে! বিয়ে বাড়ির হই হুল্লোড়ে কারো কোনো হুঁস নেই! সবাই এদিক-ওদিক হাঁটাহাঁটি করছে। যারা বরযাত্রী হয়ে যাবে তারাও একটু রমরমে হয়ে পড়েছে—তারপর আর কী—তারা এখানেই ধুলো উড়িয়ে নাচতে আরম্ভ করে দিয়েছে সবাই।

বরকে নিয়ে বরযাত্রীরা রওয়ানা হওয়ার পরই স্বাভাবিক ভাবে বিয়ে বাড়িটা শান্ত হয়ে এল। সাঁহিলি বজ্যৈও অন্যদিকে যাওয়ার জন্য উঠে পড়ছে দেখে, মহাজন্নী জোরে বলে ওঠেন,—না সাঁহিলি, সবাই চলে গেলে দীপ ও কলসের পাহারা কে দেবে? না, গেলে চলবে না। বসে থাকো। এখনই গ্রামের স্ত্রী লাোকেরা এসে জড়ো হবে।

স্ত্রী লোকদের জমাট খুব ভালোই হয়েছিল। বৃদ্ধা, প্রৌঢ়া, সদ্য যুবতী, কোলের বাচ্চা টাচ্চা নিয়ে নববিবাহিতা সহ গ্রামের সবাই উপস্থিত।

জিউতি (বর বউ যে কামরায় প্রথম রাত্রিবাস করে, সে ঘরের দেওয়ালে প্রজাপতি ও হর পার্বতীর ছবি আঁকা হয় এবং তার নীচে কলস রাখা হয়। সেখানে সারারাত দুটি প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখা হয়) আঁকায় সাঁহিলি বজ্যৈ-এর মতো ওস্তাদ এ অঞ্চলে কেউ নেই। কাল সকালে নতুন বর বউ এসে যে কামরায় বসবে সেই কামরার দেয়ালে জিউতি লিখতে (আঁকতে) আরম্ভ করলেন বজ্যৈ। প্রবীণ স্ত্রীলোকেরা মহাল (মাঙ্গলিক গান) গাইতে আরম্ভ করলেন—’ভলায়ে ময়ুনায়ে আকাশকি মেরি দিদেই পত্তালকী বইনি…।’

শুভ কামনাময় আকাশের দিদি আমার পাতালের বোন।
কবে হবে তোমার আমার দেখা।
বাবার দরবারের শুভ কার্যেই বোধহয় দেখা হবে আমাদের।
আকাশের বোনের জন্য সোনার সিঁড়ি লাগিয়ে দেবো
পাতালের বোনের জন্য সোনার শেকল লাগিয়ে টানব।
বাবার দরবারে শুভকার্য, এখানেই হলো আমাদের দেখা।
এসো এসো লক্ষ্মী তুমি চিরদিন এখানেই থেকে যাও…।

এ সাঁহিলি মাসি তুমি আরও এক বছর নিশ্চয়ই বেঁচে থাকবে।—এক মুখরা স্ত্রীলোক বলে ওঠে।
আর একজন রসিকতা করে বলে, না-হে—তুই দেখছি মাসিকে এক বছরের মধ্যেই মেরে ফেলতে চাস।

সাঁহিলি বজ্যৈও কারো চেয়ে কম নন—তিনি বলে ওঠেন, বেঁচে না থাকলে চলবে নাকি। আমার লিখে দেওয়া (আঁকা) জিউতিটাকে এক বছর পর আমাকেই তো মুছতে হবে। তা না হলে মহাজন্নীর পন‌্তি (প্রপৌত্র) গর্ভতেই থেকে যাবে যে—।

রান্নাঘরে খাবার রান্না করতে থাকা স্ত্রীলোকেরা একে-অপরকে ঠেলা ধাক্কা হাসিঠাট্টা মশকরা ফুর্তি করছিল। কলকল করে হাসতে থাকার রোল ভেসে আসছিল। এ সময়, বর ও বরযাত্রীরা কনে আনতে চলে যাওয়ার পর, রাত্রে এই ঘরে কোনো পুরুষের প্রবেশ নিষেধ। কেউ দুষ্টুমি করে লুকিয়ে চলে আসলে ধরা পড়ার পর তার দুর্গতির সীমা থাকে না। হঠাৎ মেয়েরা হই হুল্লোড় চেঁচামেচি করতে করতে ঘরের কোণায় কোণায় ঢুকে পড়েছেন। কে যেন পুরুষের বেশে উপস্থিত হয়েছে—প্যান্ট কামিজ টুপি পরা। গামছায় মুখ ঢাকা, চোখে কালো চশমা। এতক্ষণ সব ঠিকই ছিল। কিন্তু সে তার কোমরের সামনের দিকে খড় দিয়ে বানানো লুড়োটা নাড়াতে আরম্ভ করলে, নববিবাহিত আর অবিবাহিত তরুণীদের মধ্যে একটা কপট আতঙ্কের ভাব দেখা গেল!

মহাল শেষ হওয়ার আগেই যোগি (মহিলা সং)-কে এনে কে উপস্থিত করেছে—প্রবীণারা চেঁচাতে আরম্ভ করলেন।

যুবতীরা বোধহয় একেবারে পাগল হয়ে যাচ্ছে। তারা যোগিকে নিয়ে গান গাওয়া আরম্ভ করে দিয়েছে।

সব কিছুরই এটাই তো জোড়া লাগায়
এটাই তো সকল কিছু করে।
—এটার জন্যই সকল সুন্দরী।
এই বংশ বাড়ায়—আত্মীয়তা করায়
বংশ কুল—সমাজের এটাই মূল
এটাই তো দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দর।

ছোট‌্টি (যোগির সঙ্গিনী) ও যোগি পা-তুলে তুলে নেচে চলেছে। প্রৌঢ়া ও বৃদ্ধারা হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে হেসে চলেছেন—মৌমাছিদের মতো অনবরত গান গাওয়া হচ্ছে—নব যুবতীরাও একে অপরকে চোখের ইশারা করে মুখ টিপে হাসছে। ছোট বাচ্চারা কেউ মাটিতে কেউ সতরঞ্জিতে পড়ে ঘুমোচ্ছে। কেউ তাদের মায়েদের চর্চিত কলাগুলি বুঝতে না পেরে টুকটুক করে দেখছে।

অনেক সময় ধরে নাচ ও গান চলতে থাকল—স্ত্রীলোকেরা তাদের মনের স্বাদ তৃপ্তিসহ মেটালেন। ছোট‌্টি বোধহয় ক্লান্ত হয়ে গেছে; সে স্ত্রীলোকদের পাশে বসে পড়েছে; শুধু যোগি ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। স্ত্রীলোকেরা গাইতে আরম্ভ করলেন—

বরের মা’কে খুঁজে যোগি
—ধরে নিয়ে যা।
ভালোভাবে খুঁজে যোগি ধরে নিয়ে যা।

যোগি নড়েচড়ে উঠল। বরের মা’কে খুঁজতে ঘরের বাইরে ভিতরে এক চক্কর লাগাল—তারপর তাকে পেয়ে আগলে ধরে নিয়ে এলে, তখন তার না নেচে কী উপায় আছে!

বজ্যৈকেও যোগি ধরে নিয়ে যা—

বলার সঙ্গে সঙ্গে মহাজন্নী নিজেই নাচতে আরম্ভ করলেন। বললেন, এ-সাঁহিলি তুমিও চলে এসো, একটু ফুর্তি করি। মরার পর সঙ্গে নেওয়ার কী আর আছে!

বৃদ্ধা দুইজনে পারুক না পারুক অনেক সময় ধরে নিজেদের সাধ মিটিয়ে নাচলেন।

দিদি, বোনেরা—আসুন সময় হয়ে গেছে, এবার খেতে হবে, বলে, মহাজন্নীর পুত্রবধূ সবাইকে ডাকার পর সাঁহিলি বজ্যৈ-এর তাঁর নাতির কথা মনে পড়ল। নাতিটা জিউতি লেখা ঘরের একটা কোণায় ঘুমিয়ে পড়েছিল।

এ ঠুলে—জলদি উঠ—খাওয়ার সময় হয়ে গেছে—বলতে বলতে তাকে খুব জোরে নাড়াতে থাকেন।
কই কোথায়—? বলে, ঠুলে, চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে বসল।

বজ্যৈ নাতিকে ধরে হিড়হিড় করে টেনে এনে খাওয়ার জায়গায় বসালেন। কসার (চালের গুঁড়োর নাড়ু), চিড়া, সেল রোটি, পুরি তরকারি—অনেক কিছুর আয়োজন হয়েছে। নাতির ভাগের কসার ও চিড়ার দুনা (পাতার বাটি) পুঁটুলি বেঁধে বৃদ্ধা কোমরে ঢোকালেন।

নাতি রেগে গোঁ গোঁ করে উঠল।

কাল রাস্তায় খাওয়া যাবে। বৃদ্ধা নাতিকে বোঝালেন। কাল সকালে জন্তেবাখ্রায় মাংস ভাত খেতে পাওয়ার কথা ভাবতে ভাবতে—আহা, সেল রোটি কত ভালো হয়েছে, তিল ও মটরের চাটনিটাও কত ভালো—! জিহ্বায় শব্দ করে করে বৃদ্ধা খেতে আরম্ভ করলেন।

নববিবাহিতারা সেখান থেকে সরে পড়ার জন্য ছটফট করছে দেখে, সাঁহিলি বজ্যৈ-এরও পুরোনো দিনের কথা মনে পড়ল। সদ্য বিয়ে হয়েছিল তাঁর—এরকমই রতৌলির রাতে শাশু বজ্যৈ তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলেন। সে রাত খুবই আনন্দের ও মজার হয়েছিল; কিন্তু তাঁর মন ছটফট করছিল—খাওয়ার সময় সবার চোখ থেকে লুকিয়ে, নিজের অংশটার পুঁটুলি বানিয়ে নীরবে বেরিয়ে গিয়েছিলেন; কোনোমতে হাঁসফাঁস করতে করতে ঘরে পৌঁছে দেখেন, সামনে শশুরা-বা (শ্বশুর) দাঁড়িয়ে।

শাশুড়ি কোথায়? একা একা কেন চলে এলি?—শ্বশুর গর্জে ওঠেন।
বজ্যৈ আমাকে যেতে বললেন, তাই আমি ওই ঘরের বউয়ের সঙ্গে চলে এলাম।

কোনোমতে নিজের কামরায় ঢোকার পর—এ দেখছি ঘুমিয়ে পড়েছেন!—খাওয়ার টপরি (পাতার থালা বাটি) মাটিতে রেখে, কাপড় বদল না করেই শুয়ে পড়েছিলেন।
তারপর…!
বৃদ্ধা সাঁহিলি বজ্যৈ-এর ওষ্ঠে একটু মিষ্টি হাসি খেলে গেল। আহা কত সুখের দিন ছিল—ভাবতেই মনটা আলোয় ভরে গেল।


৪.

ধোঁ-তু-রী…ধোঁ-তু-রী…ধোঁ-তু-রী—নরসিংঘা ও কর্নাল বাজাতে বাজাতে বর ও কনেসহ বরযাত্রীরা এসে গেল। বিয়ে বাড়িতে ফের হই চই শুরু হওয়ার পর সাঁহিলি বজ্যৈর চোখ খুলল। ভোরের দিকে একটু জায়গা পেয়ে কাত হয়ে আরাম করতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। অনিদ্রায় চোখ ঢুলু ঢুলু হলেও দমাইরা (বাদ্যকরেরা) অনবরত নৌমতি (নয় প্রকারের বাজনা) বাজিয়ে চলেছেন, জন্তেবাখ্রা খেতে পাওয়ার উৎসাহে। ঘরের ভেতর কনেকে নিয়ে নানারকম আচার চলছে—কিন্তু সাঁহিলি বজ্যৈ-এর সেদিকে কোনো খেয়ালই নেই। সমস্ত রকম রস তো পেছনের উঠোনে—চার পাঁচজন লোক খাসির মাংস কাটছে। দু-দুটো খুব উঁচুমানের বড় খাসির ব্যবস্থা করেছেন মহাজন। প্রথম নাতির বিয়ে। হর্ষবড়াই (আনন্দ, আভিজাত্য প্রদর্শন) কেনই বা করবেন না!

সাঁহিলি বজ্যৈকে ভিত্রাঁস-এর ভুটুওয়ার (খাসির ফুসফুস ও পাকস্থলি ভাজা) সুগন্ধ দারুণ ভাবে নেশাচ্ছন্ন করে ফেলেছে। কিন্তু ভুটুওয়া তো রান্না হতে হতেই কমে অর্ধেক হতে চলেছে। যুবকেরা নীরবে দুনা নিয়ে নিয়ে বাঁশঝাড়ের পেছনদিকে নীরবে সরে পড়ছে। সাঁহিলি বজ্যৈ-এর চোখ থেকে লুকানো এত সহজ নয়—আহ‌্! একটু খাক-না! বরং এই বদমায়েশরা তাঁর জন্যেও একটু এনে দিলে ভালোই হত!

বকের মতো গলা বাড়িয়ে দেখেও, খাওয়ার সময় ভুটুওয়ার স্বাদ সাঁহিলি বজ্যৈ-এর ভাগ্যে জুটল না। ভোজ খাওয়ার সময় শুধু দুই টুকরো মাংস ও পাতে ঢেলে দেওয়া একহাতা ঝোল দিয়েই বজ্যৈ ও তাঁর বড় নাতিকে মন সন্তুষ্ট করতে হল। মন না ভরলেও জিহ্বার স্বাদটা তো একটু পালটানো গেল।

মহাজন্নী-র কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বজ্যৈ ও তাঁর নাতি নিজের ঘরের দিকে রওয়ানা হলেন। পেট পুরোপুরি ভরা—পকেট ভরা পাথর; এবার আর ঠুলেকে কে পায়!—পাথর ছুঁড়তে ছুঁড়তে আগে আগে দৌড়াতে থাকল। বজ্যৈ-এর ঝুলিটাও একটু ভারী হয়ে আছে। নাতিটার সঙ্গে হেঁটে কী আর পারা যায়!

ওহো, ঘলে মহাজনের বাগানে চরতে থাকা একদল মুরগি নিয়ে নাতিটা মেতে রয়েছে! অনেক সময় পরে হাঁসফাঁস করতে করতে বড় নাতির কাছে এসে ধপ‌্ করে মাটিতে বসে বিশ্রাম নিতে আরম্ভ করেন বৃদ্ধা। চরতে থাকা মুরগির দলটি বজ্যৈ-এর চোখেও পড়ে। আহা—কত ভালো জাতের ভালো ভালো মুরগি! বৃদ্ধার জিহ্বায় জল এসে যায়। বলে-র বাবা থাকার সময় শেষবারের মতো মুরগির ঝোলের সঙ্গে ঢিঁড়ো (মকাইয়ের হালুয়া) খাওয়ার কথা মনে পড়ে তাঁর। তারপর বলে-র বাবা চলে গেলেন! একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে বুকের ভেতর থেকে; বেদনায় মাথাটা নড়ে ওঠে—আহা-রে!

সেদিনের মোরগের মাংসের স্বাদ এখনও বৃদ্ধার জিহ্বায় লেগে আছে। সেদিন পিন্সিন (পেনশন) নিয়ে সোজা হাটে গিয়ে সবচেয়ে তেজি ও বড় মোরগটি কিনে এনেছিল বলে-র বাবা। আজকাল তো পিন্সিনের টাকায় দু-বেলা খাবার জোটাতেও টান পড়ে। ঘরের পোষা মুরগিরাও ব্যারামে মরে সাফ হয়ে গেছে।

কঁক‌্ কঁক‌্ কঁক‌্ কঁ-ক‌া-ক‌্ কঁক‌্। একসাথে মোরগগুলি ডেকে ওঠে; বৃদ্ধার স্মৃতি-স্বপ্নজাল সে আওয়াজে ছিন্ন হয়—কী-কী হয়েছে রে ঠুলে?
ওই যে—দেখছ না! কুকুরটা ওদের তাড়া করছে। পকেটে রাখা পাথর ছুঁড়তে ছুঁড়তে নাতি জবাব দেয়।
আহা! কুকুরটা গর্ভবতী মনে হচ্ছে, মারিস না। বৃদ্ধা ঝুলিটা হাতড়াতে হাতড়াতে বলেন—একটা হলেও কসারের নাড়ু দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। বেচারির পেটের বাচ্চারা তাকে হয়তো খুব চুষছে। পেটে বাচ্চা আসার সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গী কুকুর ছেড়ে চলে যায়—হারামির জাত। মানুষকেই কী বিশ্বাস করা যায়!

কুকুরটা একটু বড় রকমের ভারী মোরগকে খপ‌্ করে কামড়ে ধরে ফেলে। আহা—! মেরে ফেলেছে, মেরে ফেলেছে—বলতে বলতে পাথর ছুঁড়তে ছুঁড়তে নাতিটা দৌড়াল, পেছনে পেছনে বৃদ্ধা। পেছনে মানুষকে দেখে, মোরগ মুখে কুকুরটা আরও জোরে দৌড়াতে লাগল। রাস্তার মোড়ে গিয়ে একটা বাঁশঝাড়ের দিকে ছুটল। পেছনে পাথর ছুঁড়তে খুঁড়তে ঠুলেকে আসতে দেখে, মোরগটাকে ছেড়ে ফেলে দিয়ে কুকুরটা পালাল।

রাস্তায় তিন-চারজন আড্ডা মারতে থাকা যুবকদেরকে জিজ্ঞাসা করলে, তারা বলে, ওই বাঁশঝাড়ের দিকে গেছে। হল্লা-চিৎকার শুনে ঘলে মহাজনও এসে পড়লেন। তিনি মগঅরি মিশ্রিত নেপলিতে বললেন, ‘কোটায় নিয়ে গ্যাছে?’

ঠুলে বাঁশঝাড়ের ভেতর থেকে কুকুরের কামড়ে মরে যাওয়া মোরগটি নিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধাও এসে পড়েন।
এ হে, মাইরাই ফালাইছে! থুঃ—! ফালাইডে, বাঁশঝাড়ের ডিকেই ফালাইডে।—মহাজন আপশোস করতে থাকেন।
না না, ফেলব কেন! আমরা নিয়ে যাব।— তাড়াহুড়ো করতে করতে বৃদ্ধা বলে ওঠেন।
না না, মইরা যাওয়া মোরগটা ডিয়া কী করবা বজ্যৈ? ওই রকমের নাকি খেটে নেই। পাগল হইয়ে যাওয়া কুকুরও টো হইটে পারে!
কিচ্ছু হবে না—আমরা খাব।
না না, পরে যডি কিইছু হয়।—ঘলে মহাজন অন্যমনস্ক হয়ে পড়েন।
কিচ্ছু হবে না—বাগানে চার-পাঁচটা মুলো আছে—মিশিয়ে খেলে কিছু হবে না। দিয়ে দাও মহাজন—না বোলো না। কাতর স্বরে বলে ওঠেন বৃদ্ধা।
টাই বইলে কুকুরের মারা মোরগটা খাইবায় নাকি?
কী আর হবে! স্বয়ং মহাদেবই তো বিষ পান করেছিলেন; আমরাও তো তাঁরই সৃজন করা প্রাণী; তাই নয় কী?
ঘলে মহাজন চুপ।
বৃদ্ধা মজেত্রো (নেপালি স্কার্ফ) দিয়ে মোরগটিকে জড়িয়ে নিজের বগলে চেপে ধরলেন।

থাক, তুমি পারবে না বোধহয়। দাও, আমি বইব।—নাতি এগিয়ে আসে।
কেন, পারব না কেন?

বৃদ্ধার হাঁটায় যৌবনের ফুর্তি দেখা যেতে লাগল। ঠিকই তো! কুকুরের বিষ দুঃখী-দরিদ্রদের পেটে হজম হতে কত সময়ই বা লাগে!




শান্তি থাপা, জন্ম ৯ জানুয়ারি ১৯৬১। একাধিক গল্পগ্রন্থ তাঁর প্রকাশিত হয়েছে। ‘হাম্রো ধ্বনি’ শীর্ষক মাসিক নেপালি পত্রিকা প্রকাশ হত তাঁর সম্পাদনায়। যুক্ত ছিলেন নেপালি সাহিত্য পরিষদ ও আসাম-নেপালি সাহিত্য সভা-র সঙ্গে। তাঁর একাধিক গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। পুরস্কৃত হয়েছেন: সঞ্জয় নারায়ণ স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯৯), ‘নামঘরে’ উপন্যাসের জন্য সাহিত্য অকাদেমি অনুবাদ পুরস্কার (২০০২) গুঞ্জন সাহিত্য পুরস্কার (২০০৮) টংকপ্রসাদ উপাধ্যায় পুরস্কার (২০০৯), দিয়ালো পুরস্কার (২০১২) প্রভৃতি। গল্পকার শান্তি থাপা প্রয়াত হন ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে।

মূল নেপালি ভাষা থেকে বঙ্গানুসরণ করেছেন, ভক্ত সিং।




প্রচ্ছদচিত্র সৌজন্য: www.pinterest.com