‘সিনেমার ইতিহাসগুলো’ [Histoire(s) du cinéma] সিনেমার শুরু থেকে আপনি যে ফিল‌্মগুলো তৈরি করেছেন, সেগুলো আপনার আগের কাজগুলোর চেয়ে বেশি সংবেদনশীল। প্রত্যেকটাই সিনেমার সঙ্গে সমঝোতা করার চেষ্টা বলে মনে হয় ।

হ্যাঁ । আমিও তাই মনে করি, যদি আমি তা বলতে পারি, তবে এটা পিকাসোর একটি কথার মতন আমাকে একবার চোট দিয়েছিল: ‘চিত্রকর্মটি আমাকে প্রত্যাখ্যান না করা পর্যন্ত আমি আঁকা পছন্দ করি।’ আমি বলব যে, সিনেমা আমাকে আরও কয়েকটা ফিল‌্ম, আরও কয়েক দশক ধরে অস্বীকার করবে না, সুতরাং এটা একটা সমঝোতা। আমি যা চাই তা দিয়ে নয়, কারণ আমি কী চাই তা আমি নিজেই জানি না, তবে আমার যা আছে তা থেকে আমি যা চাই তা তৈরি করতে পারব। আরও কিছু প্রশ্ন তুলতে সক্ষম না হওয়ার জন্য, কিন্তু যা আমি সত্যিই পছন্দ করি তা করার জন্য, আমার যা আছে তাই দিয়ে মোকাবেলা করতে পারি। এটা একটা শান্তিপূর্ণ মনোভাব। আমি যখন কোনো ফিল‌্ম করি, তখন তা ভালো ভাবে করা না হলেও আমি আর ক্রুদ্ধ হই না। রাগ করা উচিত নয়, কেননা যে ছবিটা এইভাবে বা অন্য কোনোভাবে হওয়া উচিত ছিল, তা চিন্তা না করে কেবল নিজের মতো করে চালিয়ে যেতে হবে।


তবুও আপনার ফিল‌্ম নির্মাণের কাজটা সর্বদা একটা বিপরীত চলচ্চিত্রের প্রতিনিধিত্ব করে।

আজকাল এটা ঘটনা, তবে আমি আর তা নিয়ে চিন্তা করি না। আমি যখন একটি বড় ফিল‌্ম তুলি, তখন আমি নিজেকে বলি না, এটা হলিউডের কোন জাতীয় চলচ্চিত্র-প্রথার বিরুদ্ধে, এই ধরনের ফরাসি ছবি—এটা আমি করছি কেবল ফিল‌্মে। আমি জানি যে আমি অবশ্যই বিরোধী পক্ষে, তবে এটা একটা বড় এলাকা।


সমালোচক হিসাবে আপনার কাজ সহ পুরো কেরিয়ার—তাকে দেখা যেতে পারে আলোচনার প্রক্রিয়া হিসেবে, সিনেমার সঙ্গে বোঝাপড়ার পদক্ষেপ হিসেবে।

আমি পরিচালনা এবং সমালোচনার মধ্যে পার্থক্য করি না। আমি যখন প্রথম ফিল‌্ম দেখতে শুরু করি, তা তখনই চলচ্চিত্র নির্মাণের অংশ ছিল। আমি যদি এখন হাল হার্টলির ছবি দেখতে যাই, তাও সিনেমা তৈরির অংশ। তাতে কোনো পার্থক্য নেই। আমি ফিল‌্ম নির্মাণের অংশ আর যা এই এলাকায় ঘটে চলেছে, আমাকে তা অবশ্যই দেখতে হবে। আমেরিকান ছবিগুলোর ব্যাপারে, প্রতি বছর কমবেশি একটা দেখাই যথেষ্ট: সেগুলো কমবেশি সব একইরকম হয়। তবে এটা আমাদের দেখার একটা অংশ কেননা আমরা তো এই জগতে বসবাস করছি।


চলচ্চিত্র নির্মাণ কি এক অর্থে আপনার কাছে একটি ইউটোপিয়ান কার্যকলাপ?

আমার ফিল‌্ম যেভাবে হওয়া উচিত তা ইউটোপিয়া, তবে সিনেমা বানানো, তৈরি করা, ইউটোপিয়া নয়।


‘জার্মানি বছর ৯০ নয় শূন্য’ (Germany Year 90 Nine Zero) এবং ‘সিনেমার ইতিহাসগুলো’ [Histoire(s) du cinéma]-তে আপনি সিনেমাকে একটি পতিত মাধ্যম হিসাবে বিবেচনা করেছেন।

হ্যাঁ, সেটাই আমার মতামত ।


কোন মুহূর্তগুলো সেই পতনকে সংজ্ঞায়িত করেছে?

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে আমেরিকান ফিল‌্মগুলোর ফরাসি ফিল‌্মগুলোকে পরাস্ত করার একটা সুযোগ ছিল, যা সেই সময়ে আরও শক্তিশালী এবং সুপরিচিত ছিল। প্যাথে, গাউমঁ, মেলিস, ম্যাক্স লিন্ডার ছিলেন এক একজন বড় তারকা। যুদ্ধের পরে ফরাসিরা দুর্বল ছিল এবং আমেরিকানদের পক্ষে প্রথমবারের মতো ইউরোপীয় সিনেমাতে ঢুকে পড়ার রাস্তা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। আর তারা জার্মান ফিল‌্মের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। অর্ধেক হলিউড ভরে ফেলেছিল জার্মানরা; ইউনিভার্সাল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কার্ল ল্যামেল।

নরম্যান্ডির সৈকত ছিল দ্বিতীয় আক্রমণ; দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছিল ইউরোপকে নিশ্চিতভাবে দখল করার উপায়। আর এখন, তুমি রাজনীতিতে দেখতে পাও যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার নির্দেশ না দিলে, ইউরোপ স্বেচ্ছায় কিছু করতে অক্ষম। এখন ফিল‌্মগুলোতে আমেরিকা পুরো পৃথিবীর দখল নিয়েছে। সুতরাং যে সমস্ত গণতান্ত্রিক ধারণা ছিল তা লোপাট হয়ে গেল। আমি আমার পরবর্তী ‘সিনেমার ইতিহাসগুলো’ [Histoire(s) du cinéma]-তে এক বিশেষ সময়ের, কনসেনট্রেশান শিবিরের সত্যতা দেখাব, যা এখনও ফিল‌্মে প্রদর্শিত হয়নি । সিনেমায়, এর জবাব দেওয়া হয়নি।


এই প্রসঙ্গে ‘শিন্ডলার্স লিস্ট’ ফিল‌্মটা আপনার কাছে কী বোঝায়?

ফিল‌্মটার কোনোই মানে হয় না। কিছুই দেখানো হয়নি, এমনকি সেই আগ্রহসঞ্চারী জার্মান শিন্ডলার-এর গল্পও নয় ফিল‌্মটা। আসল গল্পটা বলা হয়নি। ওটা একটা মেলানো-মেশানো ককটেল।


আপনি কি মনে করেন যে, ইতালীয় নিওরিয়ালিজ‌্ম এবং ফরাসি নিউ ওয়েভ যুদ্ধের পরের পুনরুদ্ধারের প্রতিনিধিত্ব করেছিল?

না, তারা ছিল সর্বশেষ বিদ্রোহ। আমরা যেটাকে আভাঁ গার্দ বলি তা আসলে ‘আরিয়ের গার্দ’ (রিয়ার গার্ড) ছিল।


আপনি কি বলছেন, যে, ফ্রান্সের ষাটের দশকে আপনাদের সিনেমা আমেরিকান আধিপত্যের অধীন ছিল?

আমরা তা ভাবিনি, কারণ একই সময়ে আমরা বেশিরভাগ নিজেরা তর্ক করেছি কোনো এক ধরনের আমেরিকান সিনেমার পক্ষ নিয়ে। আমরা উইলিয়াম ওয়াইলার বা জর্জ স্টিভেন্সের চেয়ে স্যামুয়েল ফুলার বা বাড বোয়েটিচারকে পছন্দ করেছি। আমাদের ইচ্ছে, অন্তত রিভেতে আর আমার ইচ্ছে ছিল যে, একটা বড় সেটে সংগীতচিত্র তৈরি করতে আমরা সক্ষম হব। সেটা এখনও একটা আশা! আমরা বলেছিলুম যে, হিচকক হলেন একজন দুর্দান্ত চিত্রশিল্পী, দুর্দান্ত ঔপন্যাসিক, কেবল মাত্র খুনের গল্পের পরিচালকই নন, তাই ব্যাপারটা আরও গণতান্ত্রিক ছিল। তবে তা ইউটোপিয়ান ছিল, কারণ সত্যিকার অর্থে কী ঘটে চলছে তা বুঝতে পারার পক্ষে আমরা বয়সে খুব ছোট ছিলাম। আমি আজ এই কথা বলছি, কারণ সম্ভবত আমিই একমাত্র এই জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গি দেখাচ্ছি। আমি ইতিহাস পড়ার জন্য আমার চোখ এবং কান ব্যবহার করছি। শব্দ পড়ার জন্য অন্য লোকেরা তাদের চোখ ব্যবহার করে।

নিজের প্রতিকৃতিতে কোনো ‘আমি’ থাকে না।

কিন্তু আমেরিকান সিনেমার কয়েকটি বিষয়কে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে আপনি কি তাহলে তখন শত্রুদের ডেকে আনছিলেন?

একেবারেই না। আমরা হিচককের পক্ষে ছিলুম, তবে আমরা শর্লি ক্লার্ক বা জন ক্যাসাভেস বা এড‌্ এমশওইলারের পক্ষেও ছিলুম। আমি সম্প্রতি যখন পড়েছিলুম যে, একজন আমেরিকান সমালোচক লিখেছেন যে, ‘হায় আমার জন্য (Hélas pour moi) স্ট্যান ব্রাখাজের ছবির মতো লাগছিল, তখন আমি খুব খুশি হয়েছিলুম। ‘কাইয়ে দ্যু’ সিনেমায় যোগদানের অনেক আগে থেকে, গ্রেগরি মার্কোপৌলোসের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব ছিল। পরে তাঁর ছবিগুলো আমার ভালো লাগেনি, তবে ওঁকে আর অন্যান্য লোকদের যাঁরা অকপট সিনেমার পক্ষে ছিলেন—তাঁদের আমার মনে আছে। তা ছিল গণতন্ত্র। আমরা বুঝতে পারিনি যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র আর রাশিয়ার কমিউনিস্ট সরকারের মধ্যে তফাত নেই।


‘সিনেমার ইতিহাসগুলো’ [Histoire(s) du cinéma]-র দ্বিতীয় কিস্তিতে আপনি বলেছেন, ‘প্রযুক্তি জীবন থেকে প্রাণ এবং পরিচয় পুনরুৎপাদন ও নিকাশ করতে চেয়েছিল।’ তার মানে কী ?

আমাদের এই সত্যটি বিশ্লেষণ করা উচিত যে, যখন ফোটোগ্রাফি আবিষ্কার হয়েছিল, তা প্রথম থেকেই রঙিন হতে পারত, তা সম্ভব ছিল। তবে এটি দীর্ঘকাল ধরে কালো এবং সাদা হওয়ার কারণ, তা আকস্মিকতাজনিত নয়। তাতে নৈতিক দিক থাকতে পারে, কেননা ইউরোপীয় ও পশ্চিমা-বিশ্বের শোকের রং হলো কালো। সুতরাং আমরা প্রকৃতি থেকে তার পরিচয়টি নিচ্ছিলুম এবং একটি নির্দিষ্ট উপায়ে তাকে হত্যা করছিলুম।


সাদা-কালোয় তার ফোটো তুলে?

কেবল ফোটোগ্রাফির মাধ্যমে, ভান করছিলুম যে, পাসপোর্টে থাকা ছবিটা সেই ব্যক্তির পরিচয়—তা কেবল তার ফোটো, পরিচয় নয়। এবং তারপরে এটা পেইন্টিংয়ের ক্ষেত্রে একটা বড় পরিবর্তন আনে: আরও বিশদ করে আঁকা আরম্ভ হয়, তথাকথিত বাস্তবতার আরও বাস্তব চিত্র। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমরা প্রকৃতির পরিচয়কে টেনে বের করে নিচ্ছিলুম, আর যেহেতু সংস্কৃতিতে কিছুটা নৈতিকতা ছিল, তাই সাদা-কালো রঙে করা হয়েছিল, শোকের রঙে। আমি আরও যোগ করতে চাইব যে, প্রথম টেকনিকালার এবং টেকনিকালার আজও, কম-বেশি আসল ফুলের মতন নয়, বরং তা শবযাত্রার ফুল।

১৯৭৯ সালে আপনার সিনেমায় ফিরে আসার পর থেকে সিনেমাটিক সৌন্দর্যের ওপর নতুন করে জোর দিয়েছেন। দেখে মনে হয়, আপনি ব্যাপারটাকে ফিল‌্মে রহস্যের ধারণার সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত করেছেন।

হ্যাঁ, বেশিরভাগ সময় কোনো রহস্য থাকে না, আর কোনো সৌন্দর্য থাকে না—কেবল মেকআপ থাকে। ‘শিন্ডলার্স লিস্ট’ বাস্তবতা গড়ে তোলার একটা ভালো উদাহরণ। তা হলো ম্যাক্স ফ্যাক্টর। তার রঙের স্টক বর্ণনা করা হয়েছে কালো এবং সাদায়, কারণ ল্যাবগুলোর আসল কালো রং এবং সাদা করে তোলার মতন সামর্থ্য আর নেই। স্পিলবার্গ ভেবেছেন, রঙের চেয়ে কালো এবং সাদা বেশি সিরিয়াস দেখায়। আপনি আজও কালো এবং সাদা ফিল‌্ম নিঃসন্দেহে করতে পারেন, কিন্তু তা কঠিন, তাছাড়া কালো এবং সাদা ফিল‌্ম করার খরচ রঙিনের চেয়ে বেশি। সুতরাং তিনি সিস্টেমের প্রতি বিশ্বস্ত—এটা একটা ফালতু চিন্তা। ওঁর কাছে ব্যাপারটা কৌতুকপূর্ণ নয়, আমি মনে করি তিনি নিজের প্রতি সৎ, তবে তিনি খুব বুদ্ধিমান নন, যার দরুন ফল হয়েছে ফালতু। যেন, আমি একটি তথ্যচিত্র দেখছি, যা ভালো নয়, তবে শিন্ডলার লোকটা সম্পর্কে আপনি আসল তথ্য জানতে পারছেন। স্পিলবার্গ সেই মানুষটাকে আর এই গল্পকে এবং সমস্ত ইহুদি ট্র্যাজেডিকে এমনভাবে ব্যবহার করেছেন যেন তা এক বিশাল অর্কেস্ট্রা, এক সহজ গল্প থেকে একটা স্টিরিওফোনিক আওয়াজ তৈরি করেছেন।


মানে, উনি ঐতিহাসিক তথ্য দেননি…

উনি সক্ষম নন। হলিউড সক্ষম নয়। আসলে, ব্যাপার হলো, আমি যে ছবিটি করতে চাই, তা করতে আমি সক্ষম নই। আমি তার জন্য লক্ষ্য নির্ধারণ করতে পারি এবং এর অংশ তৈরি করতে পারি, দুই তৃতীয়াংশ বা কখনও কখনও নয়-দশ অংশ। স্পিলবার্গ একজন নিয়মনিষ্ঠ পরিচালকের মতন ‘শিন্ডলার্স লিস্ট’ করতে সক্ষম নন। প্রতিভাবান নন, বরং যেমন উইলিয়াম ওয়াইলার (William Wyler)-এর মতো পরিচালক, যিনি যুদ্ধের ঠিক পরে, ‘আমাদের জীবনের সেরা বছরগুলি’ (The Best Years of Our Lives) ফিল‌্মটি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আজ আপনি যখন ফিল‌্মটা দেখবেন, আপনি এই বিষয়টি দেখে অবাক হবেন যে, হলিউডে কিছু সৎ লোক এবং ভালো কারিগর কারো-কারো কাছে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছিলেন। ওয়াইলারের ফিল‌্মের চেয়ে সামগ্রিকভাবে সিনেমার সম্ভাবনা অনেক বেশি, তিনি সম্ভাবনার শতভাগ অবদান দিয়েছিলেন। আজ, এটি লোপাট হয়ে গেছে। যদি কোনো একশো গজের দৌড় হয়, উইলিয়াম বারো সেকেন্ডের মধ্যে তা সম্পূর্ণ করবেন; স্পিলবার্গ দৌড়োতে দুই মিনিট সময় নেবেন।


‘হায় আমার জন্য’ (Hélas pour moi)-এর একটি প্রধান বিষয় হলো যে, ন্যারেটিভগুলো সভ্যতার মঙ্গলের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ হলেও, সত্য ও সত্যকে নথিবদ্ধ করা ও যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে এটি অপ্রতুল।

‘হায় আমার জন্য’-তে সেই জিনিসটি মিস করেছি, তবে আমি যেহেতু স্পিলবার্গের চেয়ে কিছুটা ভালো, আমার ছবি আরও ভালো হয়েছে। তবে বাণিজ্যিকভাবে ততটা সফল হয়নি। আমি পয়েন্টটা মিস করে গিয়েছিলুম। ছবিটি শুরু হওয়ার আগে যা ছিল তা থেকে একেবারে আলাদা হয়ে হাজির হলো।


সাক্ষীদের সাক্ষাৎকার দিয়ে ন্যারেটিভের পুনর্গঠন যিনি করছেন তাঁর সঙ্গে তদন্তকারী/ বর্ণনাকারীর ভূমিকা আমাকে ওয়েল‌্স-এর ‘আরকাদিন’-এর (Mr. Arkadin) কথা মনে পড়িয়ে দেয়।

হ্যাঁ, ‘মি. আরকাদিন’ আমার মনে আছে, আর আমি সে-কথা ভেবেছিলুম। তদন্তকারী চরিত্রটা সম্পাদনা অর্ধেক করে ফেলার পরে যোগ করা হয়েছিল, কেননা তা না হলে ফিল‌্মটা একসঙ্গে বেঁধে রাখা যেত না। এটা একটা ভালো চলচ্চিত্র, তবে তা হতে পারত আরও…। ফিল‌্মটার উদ্দেশ্য তা ছিল না। ‘মি. আরকাদিন’ ফিল‌্মে সেই উদ্দেশ্য ছিল। এ কারণেই আমি বলছি, এটা আরও ভালো ছবি একটা, কারণ অরসন ওয়েল‌্স, যদিও তাঁর কাজ করার পদ্ধতি সেই সময়ে ছিল আশি শতাংশ, শেষ পর্যন্ত তা ছিল ফিল‌্মের অংশ।


‘জেএলজি দ্বারা জেএলজি’র কথা বলা যাক।

সঠিক টাইটেল হলো ‘জেএলজি/জেএলজি’। কোনো ‘দ্বারা’ নেই। আমি জানি না কেন গৌমঁ শব্দটাকে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। যদি সেখানে একটি ‘দ্বারা’ থাকে তবে এর অর্থ হবে এটা জেএলজি সম্পর্কে একটা গবেষণা, আমার নিজের সম্পর্কে নিজের দ্বারা যেন একধরনের জীবনী, যাকে ফরাসি ভাষায় বলা হয় ‘বিবেকের পরীক্ষা’ (un examen de conscience); যা ফিল‌্মটা একেবারেই নয়। এজন্য আমি বলি ‘জেএলজি/জেএলজি আত্ম-পোর্ট্রেট’। নিজের প্রতিকৃতিতে কোনো ‘আমি’ থাকে না। তার মর্মার্থ কেবল পেইন্টিংয়ে থাকে, অন্য কোথাও নয়। শুধু পেইন্টিংয়ে নয়, চলচ্চিত্রেও তা থাকতে পারে কিনা তা জানতে আমি আগ্রহী ছিলুম।

ফিল‌্মটি আপনাকে বেশিরভাগ সময় নিঃসঙ্গ হিসাবে তুলে ধরে—এটি কি আপনার জীবনের প্রতিচ্ছবি নাকি স্ব-প্রতিকৃতি ঘরানার ফিল‌্ম?

আমি খুবই নিঃসঙ্গ, এটাই—আমি তা বাতিল করতে পারি না। অন্তরজগতে, আমি প্রচুর মানুষ এবং জিনিসপত্রের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছি, যাঁরা একেবারেই জানেন না যে আমি তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করে চলেছি। তবে বাইরে, হ্যাঁ, এটা আমার চরিত্র এবং এটাই আমার জীবনের সত্য, যা মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে অত্যন্ত একাকী। মাঝে মাঝে আমি সেই মানুষদের বুঝতে পারি, যাঁরা ওয়াল্ডেনের বা থোরোর মতো জীবন কাটিয়েছেন। তবে এটাও হতে পারে যে, আমি যখন ছোট ছিলুম তখন আমি এক বিশাল ধনী পরিবারের সদস্য ছিলুম, অনেক খুড়তুতো ভাই আর কাকারা ছিলেন। আমার যৌবনে অনেক কিছুই ছিল যে কারণে আজকে আমি মনে করি এটা একরকম ন্যায়বিচার যে আজকে আমার কাছে সমস্তকিছু কম।


আপনি কী ‘জেএলজি/জেএলজি’ ফিল‌্মকে মৃত্যুচিন্তা হিসাবে দেখছেন? মৃত্যুর অনেক কথা আছে।

মৃত্যুর? না, একদম না। অন্য যে-কোনো সময়ে হলেও ফিল‌্মটা খুব আলাদা হত না। তোমার যদি একটা ফাঁকা ঘর থাকে, তাহলে আমি এই কথা ভেবে অপরাধবোধ এবং বেদনা উভয়ই অনুভব করতে পারি না, যে দেয়ালগুলো ফাঁকা, আমার পরিবার নেই, কিংবা কোনো পারিবারিক ফোটো দেয়ালে ঝোলানো, কেননা আমার পরিবার নেই, মাত্র একজন বা দুইজন বন্ধু আছে। কিন্তু ফিল‌্মটায় যদি অন্য লোকেদের রাখতুম তাহলে সেটা আত্মজীবনীমূলক হয়ে উঠত আর তারপরে তা অন্যরকম কিছু হয়ে যেত, আর স্ব-প্রতিকৃতি থাকত না। একটা স্ব-প্রতিকৃতি মূলত আয়নাতে বা ক্যামেরায় কেবল একটি মুখ। নয়তো তা হাস্যকর, কারণ তখন তুমি একটা শিশুকে অভিনয়ের জন্য নিতে, তোমার শৈশব দেখাবার জন্য আর…এটা হাস্যকর। অমন করা যায় না।


‘মৃত্যুর পথে জীবন একটি বাধা, এবং এই ফিল‌্মটি আমার অন্তিম বিচার নির্ধারণ করবে’— এটি কি মৃত্যুর স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি নয়?

হ্যাঁ…, না। কারণ যখন আমি আমার এই ছোট ছবিটি (চলচ্চিত্রের উদ‌্‌বোধনী চিত্র) আবিষ্কার করলম, তখন আমি ভাবছিলুম যে, কেন আমি ছয় বছর বয়সেই এত মনমরা দেখাচ্ছি। তা এইজন্য নয় যে আমার মা আমাকে চড় মেরেছিলেন; আমি মনে করি তাতে গভীরতর কিছু ছিল। তাই সেই সময়েই আমি পৃথিবী সম্পর্কে খুশি ছিলুম না!


আপনার বলা চূড়ান্ত কথা হলো: ‘আমি বেঁচে থাকব। আমাকে ভালোবাসার মাধ্যমে আত্মত্যাগ করতে হবে যাতে পৃথিবীতে প্রেম থাকে।’—এগুলো কি আপনার নিজস্ব কথা না উদ্ধৃতি?

আমার মনে হয় ওটা একটা উদ্ধৃতি, তবে এখন আমার কাছে উদ্ধৃতি আর আমার কথা প্রায় একইরকম। আমি জানি না, তা কার কাছ থেকে এসেছে; কখনও কখনও আমি তা না জেনে ব্যবহার করছি।


উদ্ধৃতিটির পুনরাবৃত্তি করে, এক অর্থে আপনি তা নিজেই বলছেন।

এর সঙ্গে নিশ্চয়ই আমার কোনো কিছু করার আছে, তবে তা ঠিক কী বলতে পারব না। ব্যাপারটা রঙের মতন, তবে শব্দ দিয়ে তৈরি।


আমার কাছে, ‘জেএলজি/জেএলজি’ যাত্রা করে শীতকাল, নির্জনতা এবং ঘেরাটোপ থেকে বসন্ত ঋতু, খোলামেলা এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনার পুনর্নবীভূত বোধের দিকে।

হ্যাঁ।


শেষ শটগুলির মধ্যে একটা হলো বসন্তকালের অবিশ্বাস্য সুন্দর ল্যান্ডস্কেপ। এটা জীবনের পূর্ণ প্রতিশ্রুতি বলে মনে হয়।

হ্যাঁ। আমি মনে করি বিশ্বের একখানা রূপক তৈরি করা ভালো ছিল, আর তারপরে ছায়া নেমে আসে। তবে তার মানে দুঃখজনক নয়—তা হলো কেবল দিনশেষের কথা।


ফিল‌্মের শুরুতে আপনি বলেছেন, ‘যে জায়গাগুলোয় দৃশ্য চিত্রায়িত হয়েছে তাতে শৈশবের প্রাকৃতিক-ভূদৃশ্যগুলো কারো অন্তরজগতে নেই।’ প্রতিটি প্রাকৃতিক-ভূদৃশ্যে কি একটি নির্দিষ্ট ব্যক্তিগত অনুরণন আছে?

না, আমি নিজে ওটার শুটিং করিনি; একজন ফোটোগ্রাফার গিয়ে ওগুলো শুট করে এনেছিল, আর আমি সেগুলো থেকে বেছে নিয়েছিলুম। উনি ছিলেন জেনেভার ফোটোগ্রাফার, ইভ‌্স পলিকুয়েন, যিনি প্রাকৃতিক-ভূদৃশ্যের শুটিং করতে ভালোবাসেন। বেশিরভাগ ফোটোগ্রাফার প্রাকৃতিক-ভূদৃশ্যের শুটিং করতে পছন্দ করেন না, তাঁরা আলোর কাছে আত্মসমর্পণ করতে চান না (অর্থাৎ—obéir)। ব্যাপারটা আলোকসজ্জার পক্ষে ভালো নয়, তবে উনি তথ্যচিত্র নির্মাণকারী মানুষ হিসাবে একা যেতে পছন্দ করেন। তিনি কেবল মেঘের ছায়ার ছবি নেওয়ার জন্য তিন ঘণ্টা ব্যয় করতে দ্বিধা করেন না, এবং তার ফলে প্রাকৃতিক দৃশ্যটি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।


তা কি আপনি নিজেই করতে চাইতেন না?

হ্যাঁ, তবে তখন আমি খুব দুর্বল ছিলুম। যাই হোক, আমি সেই জায়গাগুলো খুব ভালো করে জানি, কারণ তা আমার আশপাশের, কারণ এই বিশেষ ফিল‌্মটার জন্য আমি খুব বেশি দ্বিধা বোধ করছিলুম—এটা করব, নাকি ওটা? যেহেতু উনি নতুন ছিলেন এবং অনেকগুলো শট তুলে আনার আদেশ দেওয়া হয়েছিল, সেটা বেশ ভালোভাবে কাজে দিয়েছিল। আমার এমন অনুভূতি ছিল যে, আমি ফিল‌্মটা একা তৈরি করছিলুম না, বেশ কয়েকজন লোক ছিলেন, শুধু আমি একা নই, তথাকথিত প্রতিভাবান বা নৈরাজ্যবাদী।


‘জেএলজি/জেএলজি’-তে একটি ভিজ্যুয়াল মোটিফ হলো স্কুলের এক্সারসাইজ খাতাগুলো: প্রথমে আপনি তাতে শিরোনাম লেখেন, তারপরে বাচ্চাদের নামগুলি লেখেন যাদের খাতার পৃষ্ঠাগুলো ফাঁকা, তারপরে সবশেষে আপনার নিজের বইতে ফিরে যান, যাতে তখনও খালি পৃষ্ঠা ছিল। এই ফাঁকা পৃষ্ঠাগুলো ভবিষ্যতের আরেকখানা ছবির মতন মনে হয়, যে ইতিহাস এখনও লেখা বাকি।

হ্যাঁ।


তার মানে এই ফিল‌্মটা ফেয়ারওয়েল বা এপিটাফ নয়, যা কারো কারো মনে হয়েছে। আপনি কি বলতে চাইছেন যে, আপনার ভবিষ্যৎ একজন শিশুর সম্ভাবনা বা প্রত্যাশার ক্ষেত্রে একইরকম?

আমার তেমন অনুভূতি আছে, হ্যাঁ। হতে পারে যখন তুমি বুড়ো হয়ে যাবে, একরকম ভাবে তুমি নিজেকে আরও কমবয়সি বোধ করবে, অথচ বুড়ো হয়ে গেছ—অল্পবয়স্ক বার্ধক্য, যদি সে-কথা বলা যায়, যা খুবই… সান্ত্বনাময়।


শিশুদের সঙ্গে আইডেন্টিফাই করার জন্য?

হ্যাঁ, তবে তুমি বুড়ো হয়ে যাচ্ছ সেই সত্যকে এড়িয়ে নয়। তোমার কাছে এখনও আবিষ্কারের জন্য সমস্ত কিছু পড়ে রয়েছে। সাধারণত তাঁদের দ্বিতীয় ফিল‌্মের ক্ষেত্রে, চলচ্চিত্র নির্মাতারা বলেন, ‘আমি কী করতে পারি? আমি সবই করে ফেলেছি।’ এখন আমি বলি, ‘আমি কিছুই করিনি, আরও অনেককিছু করতে হবে।’ কিন্তু আমি তা করার সময় পাব কী না তা নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন নই। আমি জানি যে প্রচুর ব্যাপার করার থাকলেও, আমি আগে ভাবিনি যে ফিল‌্মে তা করা সম্ভব হতে পারে—যা-কিছু মোশন পিকচারে ইলেকট্রনিক প্রযুক্তির ফলে ঘটছে—পুরোনো বইয়ের শেলফের একটা শট অনেক কথা বলতে পারে।


শেষ অবধি, আপনি নিজের বাড়ি না ছেড়ে একটা চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে পারেন।

তেমনটাই তো কমবেশি করেছি ।


‘জেএলজি/জেএলজি’-র উদ‌্‌বোধনী শট চলাকালীন, ক্যামেরা যখন আপনার অল্পবয়সি ছবিতে আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন ক্যামেরার আর ক্যামেরাম্যানের ছায়া বেশ স্পষ্ট দেখা যায় ।

কেবল একবারের জন্য, আমি দর্শকদের কথা মনে রেখে করেছিলাম—বেশ সংক্ষিপ্ত, যাতে বুঝতে পারা যায় যে এটি ‘আমি এবং আমি’। চিত্রশিল্পীদের স্ব-প্রতিকৃতিগুলির সঙ্গে যেমন ঘটে, প্যালেট এবং পেইন্টব্রাশ হাতে ছবি আঁকছেন।


ভিডিও ক্যামেরায় পেছন থেকে জানালার বাইরের বেশ কয়েকটি শট নেওয়া হয়েছে। সম্পূর্ণ ইমেজের চেয়ে ক্যামেরার ভিউফাইন্ডারে পাওয়া শটটিতে ফোকাস কেন?

মানে, দর্শকদের ফোকাস করার কথা ভাবানোর জন্য, ফোকাসের ধারণা দেবার খাতিরে। সাহিত্য, চিত্রকলা বা সংগীতে ফোকাস করার কোনো ধারণা নেই; ফিল‌্ম তার বিষয়বস্তুতে ফোকাস করে।


একইভাবে, ‘হায় আমার জন্য’ (Hélas pour moi)-তে, রাশেলের (লরাঁ মাসলিয়াহ) একটি অসাধারণ শট রয়েছে মিডিয়াম লং শটে নেওয়া, বেশ আউট অফ ফোকাস; মেয়েটি ক্যামেরার দিকে এগিয়ে যান এবং ক্লোজ-আপ হলে ফোকাসে আসেন।

হ্যাঁ, আমি অমনটা পছন্দ করি। ‘সিনেমার ইতিহাসগুলো’ [Histoire(s) du cinéma]-র ছবিগুলোতে ‘বিউটি অ্যান্ড দ্য বিস্ট’ (La Belle et la bete)-এর শট আছে, যখন জোসেটি ডে দীর্ঘ করিডোর ধরে হেঁটে আসেন; ককতো কোনো ট্র্যাকিং শট তৈরি করেননি, তিনি তাকে একটি ছোট্ট ট্রলিতে রেখে ক্যামেরার দিকে এগিয়ে নিয়ে যান। বাস্তবে এটি একই ব্যাপার, তবে অর্থ একই নয়। ‘হায় আমার জন্য’ (Hélas pour moi)-এর শটে তুমি মর্মার্থ খুঁজে পাচ্ছ: মেয়েটি ফোকাসে আসছে। ব্যাপারটা এমন, কেউ যেন জলের তলদেশ থেকে ওপরে পৃষ্ঠতলে ভেসে উঠছে, কারণ সর্বোপরি, পর্দা হলো একটা পৃষ্ঠতল। আমাকে দর্শকদের চিন্তা করতে প্ররোচিত করতে হবে। এটি সংগীতের মতো—যা নির্দিষ্ট নয়; এমন বা অমন বোঝানোর ভান করা নয়। আমেরিকান লোকেরা বলতে পছন্দ করে, ‘আপনি ঠিক কী বোঝাতে চাইছেন?’ আমি উত্তর দেবো: আমি বলতে চাইছি বটে তবে ‘ঠিক’ তা নয়।


‘হায় আমার জন্য’ (Hélas pour moi)-তে একটা স্তরে আপনি সিনেমার প্রযুক্তিগত শব্দভাঁড়ার অন্বেষণ করছেন বলে মনে হয়েছিল: ফোকাস, এক্সপোজার, ক্যামেরা মুভমেন্ট, মন্তাজ এমনকি একটা জুম আউট এবং ইন, যা আমি মনে করি আপনি প্রায় কখনও করেন না—।

না। খুবই কম।


প্রথম থেকেই কি তেমন অভিপ্রায় ছিল?

না, শুটিংয়ের সময় সেটা ছিল। কারণ ফিল‌্মটা আমার আয়ত্ত থেকে পালাচ্ছিল, সম্ভবত আমি কিছু কিছু করার চেষ্টা করলুম যেগুলো আমি করতে সক্ষম নই তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যাচ্ছিল। বাক্যটির থেকে ব্যকরণ বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল, বা ব্যাকরণ হয়ে যাচ্ছিল বাক্যগুলোর (Un Souvenir) একটা স্মৃতি। বাক্য তৈরি করা হয়নি, ব্যাকরণ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। এটা গাণিতিক উপপাদ্যের মতো, যা বিজ্ঞানীদের কাছে একেবারেই সাফল্য পায় না, কারণ উপপাদ্যের যোগ, বিয়োগ, সমান চিহ্ন ছাড়া আর কিছুই ছিল না।


কিন্তু মাধ্যমটার ব্যাকরণের শুদ্ধ নিশ্চয়তা দেখার বিষয়ে উত্তেজক কিছু আছে নিশ্চয়ই, তা কেবলমাত্র জ্ঞানীদের কাছে গ্রহণযোগ্য হলেও।

হ্যাঁ, এটাই সিনেমার শুরু। এই ক্ষমতাটাকে আরও একবার সম্মান জানাতে পর্যাপ্ত পরিমিত হয়ে আমরা সময়ে সময়ে তা করতে পারি। তুমি যদি তা গণিতের ক্ষেত্রে করো, তবে এর কোনো অর্থ পাওয়া যাবে না। তুমি এটা সাহিত্যে করতে পারবে না, কারণ বাক্য এবং ব্যাকরণটি এতটা নিবিড়ভাবে সংযুক্ত, তুমি তাদের কেটে আলাদা করতে পারবে না। তবে সিনেমায় তুমি তা পারবে। আর কিছু না করে তুমি যদি কেবল কোনো ট্র্যাকিং শট বা ভূপ্রকৃতির দৃশ্য তোলো…। এই কারণেই আমি কিছু আন্ডারগ্রাউন্ড আমেরিকান ফিল‌্ম পছন্দ করি, উদাহরণস্বরূপ মাইকেল স্নো-র দুর্দান্ত ফিল‌্ম, ‘লা রিজিওন সেন্ত্রালে’ (La Région Centrale), যা কেবল একটি দীর্ঘ প্যান। তা হলো একটা ছবি, একেবারে খাঁটি সিনেমা।


কিন্তু ‘হায় আমার জন্য’ (Hélas pour moi)-তে ব্যকরণগত অনুশীলনগুলো মনে হয় ‘ন্যারেটিভ’-এর সঙ্গে সমন্বিত।

আমি ভেবেছিলুম আমার হাতে একটা ভালো চিত্রনাট্য আছে, কিন্তু তাড়াতাড়ি শুট করা হয়ে গিয়েছিল। প্রথম খসড়াটা আমি প্রায় ১০০-১২০ পাতা লিখেছিলুম, আর আমাদের তিন সপ্তাহ পরে শুটিং করতে হয়েছিল। তাই আমি প্রযোজক এবং তারকাকে বলেছিলুম, “এটা সম্ভব নয়, আমাদের আরও তিন মাস বা সম্ভবত আরও তিন বছর সময় দরকার। তোমরা রাজি আছ?” কেউ রাজি ছিল না, তাই আমি ফিল‌্মটা করলুম, কারণ সর্বোপরি একটা ফিল‌্ম মানে তো একটা ফিল‌্ম, ব্যাপারটা জীবনের মতন। আমরা প্রতিদিন যখন খেতে পারি, তখন খাই। তাছাড়া আমাকে কয়েকটা নির্দিষ্ট ব্যাপার সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হয়, তাই সম্ভবত অবচেতনায় আমি সেই ব্যাকরণগত সিনেমাটিক প্রতিমাগুলোকে আঁকড়ে থাকার চেষ্টা করেছি।


‘সিনেমার ইতিহাসগুলো [Histoire(s) du cinéma] দেখার আগে আমি কখনও ভাবিনি যে ভিডিওর ছবি অত সুন্দর আর প্রলোভনসংকুল হতে পারে। আপনি মনে হয় সম্ভাবনাকে আয়ত্ত করার উপায় আবিষ্কার করে ফেলেছেন।

আমি সোনি কোম্পানির চালু যন্ত্র ব্যবহার করি (হাসি)—আমি ওটা ব্যবহার করছি আর আশা করি নতুন ভ্যাক্যুয়াম ক্লিনারের মতন (comme un aspirateur) জিনিসটা ভালো। আমি দেখতে ভালো আর পরিচ্ছন্ন জিনিস পছন্দ করি; সাইকেল হোক কিংবা মোটরগাড়ি, দেখতে ভালো হওয়া চাই। টেলিভিশন ভালো করে তৈরি হয় না কিন্তু তুমি টেলিভিশনে দারুন সুন্দর প্রতিচ্ছবি তৈরি করতে পারো—জিনিসটা যেমনকার তেমনই, নিজের কাজ যতটা পারে ভালোভাবে করে। কিন্তু আমি মনে করি যে, তা এমন প্রতিচ্ছবি যেন কোনো পেইন্টারের আঁকা স্কেচ, যা অসাধারণ পেইন্টিং-এর মতনই ভালো দেখতে লাগবে।


আপনার আগের ভিডিওর কাজগুলো তত পেইন্টারসুলভ ছিল না। ‘সিনেমার ইতিহাসগুলো’ [Histoire(s) du cinéma] যেন বয়ন-বিন্যাসের ব্যাপারে পেইন্টিং।

সেটা ঠিক। এটা চিত্রাঙ্কনের ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কিত আর এটা খাঁটি চিত্রাঙ্কন, কিন্তু সিনেমাটিক পেইন্টিং—এটা সিনেমার একটা দিক, যা বেশিরভাগ লোক বাতিল করে দিয়েছে। আর শুধু বিজ্ঞাপনই নয়। বিজ্ঞাপনগুলোও পেইন্টিং করে, বা সেই পোলিশ ভিডিও নির্মাতা রাইবজাইন‌্স্কি — সেগুলো কেবল বিজ্ঞাপন, তার কোনো মানে হয় না, স্রেফ সাজসজ্জা। আমি মাঝে মাঝে বিজ্ঞাপনগুলোকে পছন্দ করি, কারণ ওই এক মিনিটের মধ্যে প্রচুর অর্থ ব্যয় করা হয়, আর তারা এমন জিনিস তৈরি করে যা মোশন পিকচারে অসম্ভব, কারণ ব্যাপারটা খুব ব্যয়বহুল হবে। তবে এগুলো বিক্রি করার জন্য তাদের মর্মার্থ এবং সেগুলোর বোধবুদ্ধি এবং তাদের লক্ষ্য, এটা বিক্রি সেটা বিক্রি—তা মোটেও ভালো নয়। ৩০ সেকেন্ডে এক মিলিয়ন ডলার ব্যয় করা ভালো নয়…আমি জানি না, একটি জেনারেল মোটরসের গাড়িও তো মিলিয়ন ডলার দাম নয়।

তবে আমি মানি, এটি চিত্রাঙ্কন এবং উপন্যাস। আমার কাছে সিনেমা কেবল আমার লক্ষ্য, তবে তা সম্ভব নয়, কারণ সিনেমা পেইন্টিং নয়। আমার কাছে সিনেমা হলো: একটি পেইন্টিংয়ের পত্রিকায় ভূদৃশ্যের বেশ কয়েকটি চিত্রের একটি চিত্রকর্মের দিকে নির্দেশ করে, তবে আমি সেই লোকগুলোর সঙ্গে (যাঁদের আঁকা) কথা বলতে ভালোবাসি, আর তারপরে আছে নাটক—তবে সেইরকম পেইন্ট-করা নাটক। কোনো উপন্যাসের মতো নয়। আমি প্রায়শই পেইন্টিংগুলোর দিকে তাকাই আর নিজেকেই বলি, ও কী বলছে? এই লোকগুলো—তারা কী ভাবছে? আমার মনে আছে আমার প্রথম নিবন্ধটা, একটি প্রিমিনজার ছবি এবং ইমপ্রেশনিস্ট পেইন্টিংয়ের মধ্যে তুলনা ছিল। হয়তো তা সম্ভব নয়, তবে আমার কাছে এটা সম্ভব বলে মনে হয়—ফিল‌্মটা তো আমার। সেই জন্যই তা পেইন্টিংয়ের কাছাকাছি এবং আরও কাছাকাছি চলে আসছি।

এখন যদি আমি ফিল‌্মে (আর্ট ম্যাগাজিনের পেইন্টিং) রাখি, তাহলে আগের প্রতিচ্ছবি কী হওয়া উচিত এবং এর পরের প্রতিচ্ছবি কী হওয়া উচিত? চিত্রকলাতে আমি যা পছন্দ করি, তা হলো এটি কিছুটা ফোকাসের বাইরে হয় আর তুমি তার পরোয়া করো না। সিনেমায় তুমি আউট অফ ফোকাস থাকতে পারবে না, তবে তুমি যদি সংলাপ যোগ করো, যদি তুমি ফিল‌্মে তা দেখাও, বাস্তবতার দিকে ওই ভাবে চেয়ে দেখা, তবে তোমার ফোকাস-করা সিনেমাটোগ্রাফিক প্রতিচ্ছবি এবং শব্দের মধ্যে এমন একটা জমি রয়ে যায় যা আউট অফ ফোকাস, আর এই আউট অফ ফোকাস হলো আসল সিনেমা।

‘সিনেমার ইতিহাসগুলোর’ ভিজ্যুয়াল টেক্সচারগুলি প্রায়শই এমনভাবে স্তরান্বয়ন করা হয়েছে যে প্রায়ই কিছু জায়গায় যেন একটি পেইন্টিং ইন্দ্রিয়জ আর ঐশ্বর্য্যময় হয়ে উঠেছে।

হ্যাঁ। ইন্দ্রিয়জ একটি ভালো শব্দ। চিত্রকলার সংবেদনশীলতা, যা উপন্যাসগুলিতে থাকে না, তা ভালো, কারণ প্রতিটি রূপের প্রকাশের নিজস্ব আঙ্গিক থাকা উচিত যা অন্য জনারের হাতে নেই, অন্যথায় প্রকাশের শুধু একইরকম রূপ থাকবে। শুরু থেকেই ফিল‌্মগুলো প্রতিটি পরিবারের অংশ। আমার কাছে ফিল‌্মগুলো হলো শৈল্পিক পরিবারের সবচেয়ে ছোট সদস্য যার জন্ম সব শেষে হয়েছে, মানে ব্ল্যাক শিপ। কিন্তু তা একটা সাদা ভেড়া—কেননা পর্দাগুলো তো সাদা (হাসি)। সংবেদনশীলতা এমন কিছু, যা সিনেমায় পর্যাপ্ত পরিমাণে নেই, যা নীরব যুগে বেশি ছিল এবং স্বাভাবিকভাবে টকিজের সঙ্গে অদৃশ্য হয়ে গেল।


তা সিনেমাকে বন্দি করল না ইমেজকে?

হ্যাঁ, একভাবে দেখতে গেলে তাইই। আমি প্রায়ই প্রযুক্তি ব্যবহার করার চেষ্টা করি, যেমন ডলবির কথা ধরা যাক, আওয়াজকে ছবি থেকে আলাদা করতে, আর হঠাৎ যখন নাট্যদৃশ্যে সেটার প্রয়োজন হয়, তখন তারা আবার দুজনেই একসঙ্গে হয়ে যায়। এটা (স্পষ্ট), বিশেষত আমেরিকান সিনেমায়, তুমি ক্যামেরা নিয়ে বিশেষ কাজ করো না, এই তথ্যে নির্ভর করে যে, তা আরও বেশি করে কৃত্রিম হয়ে যাচ্ছে। আমি সম্প্রতি ‘দি পেলিকান ব্রিফ’ (The Pelican Brief) দেখেছি। ওটা স্রেফ বিজ্ঞাপন। ক্যামেরা চলতে থাকে, অথচ ক্যামেরার চলাচল বা স্থিরতার সঙ্গে বা শট পরিবর্তনের সঙ্গে ভন স্ট্রোহিম বা ভন স্টার্নবার্গের কোনো যোগসূত্র নেই। এর কোনো মর্মার্থ গড়ে ওঠে না, কেবল আমরা ফিল‌্ম করছি এরকম ভান করা ছাড়া আর কিছুই নয়।


আপনি অনুভব করেন না যে এটি যৌনতার অন্য রূপ?

না, ওটা বেশ্যাবৃত্তি ।


‘জেএলজি/জেএলজি’-র আরেকটি উদ্ধৃতি: “একটি ইমেজ গড়ে ওঠে মনের দুটি পৃথক বাস্তবকে একত্রিত করে; বাস্তব যত দূরে যায় আরও নিখুঁত হয়, ইমেজ ততই শক্তিশালী হয়ে ওঠে।”

ওটা একটা পুরোনো উদ্ধৃতি। ‘জেএলজি/জেএলজি’-তে আমার নিজস্ব প্রায় একটি শব্দও নেই, তবে যেহেতু আমি সেগুলি পড়ছিলুম আর তা নোট কর রাখছিলুম, সেগুলো আমার হয়ে গেল।


প্যাশন (Passion) ফিল‌্মের পরিচালক সে-কথা বলেন।

ওটা ‘কিং লিয়ার’-এ রয়েছে। পিয়ের রেভেরদির একটি কবিতা, ডাডার পরাবাস্তববাদীদের প্রথম একজন, ১৯২১ সালে জুরিখে যখন ডাডার সূত্রপাত হয়েছিল তখন থেকে। কবিতাটা আমার মতামত খুব ভালোভাবে প্রকাশ করেছিল, কোনো ইমেজ এই জন্যে শক্তিশালী নয় কারণ আপনি একজন মৃত ব্যক্তিকে দেখছেন…। অনেক সময়ে, বলতে গেলে কম সময়েই, কেবল একজন মৃত ব্যক্তির প্রভাব গড়ে ওঠে। ভিয়েতনাম যুদ্ধ এইজন্যে শেষ হয়ে যায়নি যে আমরা অনেক মৃত মানুষকে দেখেছিলুম, বরং এই কারণে যে, একবার আমেরিকান জনগণ একটি আমেরিকান ছাত্রকে কেন্ট রাজ্যে খুন হতে দেখেছিল—কেবলমাত্র একজন, হাজার নয়—তাই ছিল যথেষ্ট। পরের দিন সকালে তারা আর সক্ষম হয়নি, (তবে) তিন বা চার বছর সময় লেগেছিল আর তারপরে হ্যানয়তে বোমা ফেলা হলো।


কীভাবে আপনি এই আইডিয়াকে ব্যবহার করবেন, সম্পূর্ণ বিপরীতে দিক থেকে একটি নির্দিষ্ট ইমেজ তৈরি করবেন?

কিন্তু একটি ইমেজ তো বিদ্যমান থাকে না। এটা কোনো ইমেজ নয়, এটা একটা ছবি। ইমেজ হলো আমার সঙ্গে সম্পর্কিত আর সেই দিকে তাকিয়ে অন্য কারোর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার স্বপ্ন দেখছি। ইমেজ হলো একটা অনুষঙ্গ।


আপনার সত্যিকারের মন্তাজ সম্পর্কে ধারণাটি এখানেই ঘটে?

হ্যাঁ। সিনেমার আসল লক্ষ্য (La vrai mission) ছিল মন্তাজ কী তা বিশদ করা আর তা প্রয়োগ করা। কিন্তু আমরা সেখানে কখনও পৌঁছোইনি; অনেক পরিচালক বিশ্বাস করেছিলেন যে, তাঁরা সেখানে পৌঁছে গেছেন, কিন্তু তাঁরা করেছিলেন অন্য কাজ। বিশেষত আইজেনস্টাইন। উনি মন্তাজের পথে এগিয়েছিলেন কিন্তু সেখানে পৌঁছোতে পারেননি। উনি তো সম্পাদক ছিলেন না, উনি কোণাকুণি ছবি তুলতেন। আর যেহেতু কোণাকুণি নেওয়ার ক্ষেত্রে উনি বেশ ভালো ছিলেন বলে, সেখানে মন্তাজের আইডিয়া ছিল। তিনটি সিংহ, একই সিংহ কিন্তু তিনটি ভিন্ন কোণ থেকে নেওয়া, তাই সিংহটিকে দেখে মনে হচ্ছে প্রাণীটি চলমান। আসলে বিভিন্ন কোণের অনুষঙ্গের কারণেই মন্তাজ এসেছিল। মন্তাজ অন্য কিছু, কখনও আবিষ্কার হয়নি। টকিজ আসার ফলে তা বন্ধ হয়ে যায়; টকিজগুলো তাকে কেবল থিয়েটারের মতন ব্যবহার করেছিল ।


আপনি যখন এলিজাবেথ টেইলরের ইমেজকে (Place in the Sun)-এ উনুনের ভেতরের দেহগুলোর ওপর ‘ইতিহাসের সিনেমাগুলো’ [Histoire(s) du cinéma]-তে সুপার ইমপোজ করেন—তখন তা মন্তাজ।

ওটা একটা সমালোচনামূলক কাজ (ঐতিহাসিক মন্তাজ!)। এলিজাবেথ টেলরের হাসিখানা কেন এমন (হাসি) তা ব্যাখ্যা করে—।


হলোকস্টের কারণে…

হলোকস্টের কারণে। এবং যেহেতু জর্জ স্টিভেন‌্স হলোকস্টের শুটিং করেছিলেন, অনেক অনেক বছর ধরে সেটা তাঁর সেলারে লুকিয়ে রেখেছিলেন, কিন্তু তিনি যখন ‘এ প্লেস ইন দি সান’ শুটিং করছিলেন তখন তাতে একইসঙ্গে একধরনের হাসি এবং বিপর্যয় দেখা দেয়। এমনকি তা কোনো অসাধারণ চলচ্চিত্র না হলেও, অত্যন্ত তীব্র আর তুমি তা ব্যাখ্যা করতে পারবে না। জর্জ স্টিভেন্স পরে যে ছবিগুলো করলেন, তার কোনোটিই অত ভালো ছিল না। মিলি পার্কিন্সকে নিয়ে ‘দ্য ডায়রি অব‌্ অ্যানা ফ্রাঙ্ক’ যা ‘শিন্ডলার্স লিস্ট’-এর চেয়ে ভালো কিন্তু খুব ভালো ফিল‌্ম নয়; উনি মিলি পার্কিন্সের হাসি সেইভাবে নিতে পারেননি, যেভাবে এলিজাবেথ টেইলর মৃদু হেসেছিলেন।

মৃত্যুর পথে জীবন একটি বাধা।

পুরো ‘ইতিহাসের সিনেমাগুলো’ [Histoire(s) du cinéma] জুড়ে আপনি অসাধারণ সৌন্দর্য্য ও মাহাত্ম্যের ইমেজের বিপরীতে আতঙ্ক ও নৃশংসতার ইমেজগুলো উপস্থাপন করেছেন। মনে হয় আপনি বলতে চাইছেন যে সিনেমা এই দুটির মাঝে তৈরি হয়।

হ্যাঁ, অতিক্রম করার ধারণা তাতে রয়েছে। আমি যখন থামে-বাঁধা চোখবন্ধ বন্দির নিউজ রিল ফুটেজ মেশাচ্ছিলুম—তুমি তো জানো তিন মিনিটের মধ্যেই তাকে গুলি করে মারা হবে—আমি ওটাকে মিশিয়েছিলুম ‘অ্যান আমেরিকান ইন প্যারিস’-এর জিন কেলি এবং লেসিলি ক্যারনের সিন নদীতে নাচের সঙ্গে। এটা অবচেতন কাজ ছিল, কিন্তু পরে আমি নিজেকে বলেছিলুম, যে, হ্যাঁ, আমার তা করার অধিকার আছে কেননা ‘অ্যান আমেরিকান ইন প্যারিস’ সম্ভবত একই সময়ে তোলা হয়েছিল।


‘ইতিহাসের সিনেমাগুলো’র [Histoire(s) du cinéma] প্রথম অংশে আপনি ভিডিও প্রয়োগ করেছেন, যাতে সম্পাদনার প্রভাবগুলোয় লক্ষণীয় বৈচিত্র্য অর্জন করা যায়—দুটি শট দ্রুত পরস্পরকে কাটতে পারে, কোনো ওয়ার্ড প্রসেসরে একটা বাক্য টাইপ করার ছন্দ দিয়ে কাটতে পারা যায়। আপনি ঠিক কী জাগিয়ে তুলতে চেষ্টা করছিলেন?

না কেটেই ইমেজগুলোকে মেশানোর চেষ্টা করা হয়েছিল—খুব দ্রুত আরোপণ, যাতে কেবল একটা ইমেজ থাকে, কিন্তু আমরা বুঝতে পারলুম যে দুটো আছে।


ওটা আমাকে ফিল‌্মে ২৪-ফ্রেম-প্রতি সেকেন্ডের প্রভাব বজায় রাখা সম্পর্কে ভাবতে বাধ্য করেছিল। আমি ভেবেছিলাম আপনি চেষ্টা করছেন…

বিশদে তা বলতে হলে বলব, হ্যাঁ ।


অত্যন্ত ঢিমে তালে চলা ডিজল‌্ভগুলো সম্পর্কে কী বলবেন?

সেই সমস্ত পুরোনো কৌশল মোশান পিকচার ব্যাবসার শুরু থেকেই ছিল, যা আমরা নিউ ওয়েভে ভেঙে ফেলতে সক্রিয় ছিলুম—আর এখন ভিডিও আসার ফলে ওটা ফিরে এসেছে, তবে ভালোভাবে।


কিন্তু ‘সিনেমার ইতিহাসগুলো’ [Histoire(s) du cinéma]-র মধ্যেও সংক্রমণগত প্রভাব রয়েছে, যার কোনো সিনেমাটিক নজির নেই: যেমন ধরা যাক, যখন কোনো ইমেজ ধীরে ধীরে ভেসে ওঠে আর শেষে আগের ইমেজটাকে মুছে ফ্যালে। মোশান পিকচারগুলোতে ওয়াইপ‌্স আর স্পিলিট-স্ক্রিন প্রভাব আছে, কিন্তু এরকম বিস্তারিত কিছু নেই। সেই ব্যাকরণটা অনন্যভাবে ভিডিওর।

হ্যাঁ, তবে এটা তো সিনেমা। আমার কাছে ভিডিও মোশান পিকচারের একটা বিভাগ। যখন তুমি ‘সিনেমার ইতিহাসগুলো’ [Histoire(s) du cinéma] দেখো, তখন তোমার স্বাভাবিক ভিডিওর অনুভূতি হয় না না, তখন তোমার সিনেমার অনুভূতি হয়।


আমি ‘সিনেমার ইতিহাসগুলো’ [Histoire(s) du cinéma] ভিডিওতে দেখেছি আর টিভির টেপেও দেখেছি…

ওটা টিভিতে দেখা ভালো, যদি তোমার টিভি সেটটায় ঠিকমতো সামঞ্জস্য করা থাকে আর মোটামুটি ভালো স্টিরিও সরঞ্জাম থাকে। টিভিতে কোনো প্রোজেকশান নেই। একটা প্রত্যাখ্যান আছে—তুমি তোমার আরামকেদারায় বা বিছানায় প্রত্যাখ্যাত হয়ে আছো। সিনেমায় তুমি প্রোজেকটেড, কিন্তু তা সত্বেও তোমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে কী হয়ে উঠতে চাও। টিভিতে কেবল কোনো কিছুর ট্রান্সমিশন থাকে । সিনেমায় প্রোজেক্ট করার ব্যাপারটা অদ্ভুত, হ্যাঁ!


আবার, ‘সিনেমার ইতিহাসগুলো’ [Histoire(s) du cinéma] থেকে একটা উক্তি: ‘থিয়েটার ব্যাপারটা বেশ পরিচিত; সিনেমা খুবই অচেনা।’

রবার্ট ব্রেসঁ?…


আমি এটিকে আপনার, ‘রাতের গল্প’ (histoire de la nuit) আর ইমেজ সম্পর্কে বর্ণনার সঙ্গে যুক্ত করি এবং এই দুটি বাক্যাংশ থেকে আমি যে আইডিয়া পাই—তা এই যে, সিনেমা একখানা রহস্যের এলাকা। আপনি কেন মনে করেন যে, আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে তৈরি আপনার ফিল‌্মগুলো রহস্য ন্যারেটিভের রূপ সম্পর্কে ক্রমশ জড়িয়ে পড়েছে? ডিটেকটিভ (Detective), হেইল মেরি (Hail Mary), নভেল ভিগ (Nouvelle Vague), হায় আমার জন্য (Hélas pour moi) সব ক’টাই কোনো কেন্দ্রীয়, অদৃশ্য রহস্য বা ধাঁধাকে ঘিরে আবর্তিত হয়।

তুমি যখন বয়স্ক হয়ে যাও, তখন কাঠামোর বিশ্লেষণ উপন্যাসেরই একটা অংশ। এটা হলো জেমস জয়েসের ইউলিসিস এবং এরেল স্ট্যানলি গার্ডনারের মধ্যে পার্থক্য। পেরি ম্যাসনে রহস্যটি বর্ণনা করার রহস্য মাত্র, (যেখানে জয়েসের কাছে) লেখার রহস্য নিজেই উপন্যাসের অংশ। পর্যবেক্ষক এবং মহাবিশ্ব একই মহাবিশ্বের অঙ্গ। এই শতাব্দীর শুরুতে বিজ্ঞান সেটাই আবিষ্কার করেছিল, যখন তারা বলল যে, তুমি পারমাণবিক কণা কোথায় তা বলতে পারবে না। তুমি জানো যে তারা কোথায়, কিন্তু তাদের গতি জানো না; বা তুমি তাদের গতি জানো কিন্তু তাদের অবস্থান জানো না, কারণ তা তোমার ওপর নির্ভর করে। যিনি বর্ণনা করেন, তিনি সেই বর্ণনার অংশ ।


ষাটের দশক ও সত্তরের দশকে আপনি যে রহস্যগুলি সমাধান করার চেষ্টা করছিলেন তা ধর্মনিরপেক্ষ বস্তুবাদ ভিত্তিক ছিল আর আকাঙ্খা, আদর্শ, ভাষা এবং শক্তিক্ষমতার মতো ব্যাপারগুলোর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ছিল। আশির দশকের পর থেকে, যদিও আপনার ফিল‌্মগুলো এই বিতর্কমূলক প্রশ্ন অব্যাহত রেখেছে, এখন ফিল‌্মগুলো দর্শন আর অধিবিদ্যার চিরন্তন রহস্যগুলোর সঙ্গে বেশি সম্পৃক্ত।

আমিও তাই মনে করি, আর তুমি যদি সাধারণ ব্যাপারের মাধ্যমে অধিবিদ্যাটা আনতে পারো তাহলে খুব ভালো হয়। এটা শিল্পীর একটা দায়িত্ব। সেজানের আঁকা একটা সাধারণ আপেল একটা সাধারণ আপেলের চেয়ে বেশি কিছু। বা কেবল একটা সাধারণ আপেল।


নভেল ভিগ (Nouvelle Vague) এবং হায় আমার জন্য (Hélas pour moi) ফিল‌্মে প্রকৃতিকে ব্যবহারের পেছনে কি তাইই আছে?

হ্যাঁ।


এই দুটো ফিল‌্মে আপনার উজ্জ্বল প্রাকৃতিক আলোর ব্যবহার অস্বাভাবিক—ক্যামেরা ভেতরে থাকলেও—বা দিগন্তের জন্য, মনে হয় যেন তা বাইরে শুটিং করা। বৈসাদৃশ্যে কেন এমন জোর দিয়েছেন?

কারণ আমি বৈশাদৃশ্য দেখছি। এটা দুটো ইমেজ রাখার উপায়, একে অপরের থেকে অনেক দূরে, একটা অন্ধকারময় এবং একটা রোদযুক্ত। আমি আলোর মুখোমুখি হতে চাই, আর তুমি যদি আলোর মুখোমুখি হও তবে বৈপরীত্য দেখা যায় এবং তারপরে তুমি রূপগুলো দেখতে সক্ষম হও… যা সর্বদা ইউরোপীয় চিত্রকলার সমস্যা ছিল, তবে রোমান্টিকদের আর দেলাক্রয়ার সময় থেকে আরও সচেতনভাবে। আমি চাই পেছনে আলো থাকবে না, কারণ পেছনের আলো প্রোজেক্টরের অন্তর্গত, ক্যামেরার সামনে আলো থাকা জরুরি, যেমন আমরা নিজেরাই জীবনে তা পাই। আমরা গ্রহণ করি এবং (পরে) তা প্রোজেক্ট করি।


তার মানে ক্যামেরার পেছনদিকে আপনি নকল আলো কখনও রাখেননি?

কখনই নয়।


কিন্তু আপনি তো নকল আলো ব্যবহার করেন?

শুধুমাত্র এই কারণে যে আমার তেমন কোনো ফোটোগ্রাফার নেই, যিনি ৫০ বছর আগের দুর্দান্ত ফোটোগ্রাফারদের মতো ভালো। সুতরাং আমি কৃত্রিম আলো ব্যবহার করতে পছন্দ করি, তবে জিনিসগুলি পরিবর্তন না করে। আমাদের প্রয়োজন হলে ফোকাস করার জন্য শক্তিশালী আলো প্রয়োজন হবে। আমার মতে আর প্রায় ফোটোগ্রাফার বলতে কেউ নেই। তাদের মেরে ফেলা হয়েছে, যেভাবে পুরো সেট জুড়ে তারা টিভির ছবি তোলে আর একই লোকজন দিয়ে ভরাট করে, কোনো ছায়া থাকে না, কিছুই না। আমি সিনেমাটোগ্রাফারদের ব্যবহার করি যারা অতিরিক্ত লাইট ব্যবহার করতে ইচ্ছুক নয় আর প্রধানত ভালো অ্যাপারচার খোলার ক্ষেত্রে কাজ করার চেষ্টা করেন।


‘ডিটেকটিভ’ ফিল‌্মে একটি লাইন আছে: ‘এখানে কখনও কোনো আলো হয় না, কেবল কঠিন আলোর ব্যবস্থা।’

‘ডিটেকটিভ’ বেশ ভালো আলোকিত ছিল, একজন ভালো ফোটোগ্রাফার (ব্রুনো নুয়াইটেন), অজানা অভিনেতাদের তিনি ভালো করে আলোকিত করেছিলেন, কারণ দৃশ্যটায় তাদের দেখা না গেলেও তারা ভয় পেত না। কিন্তু নাথালি বে বা জনি হ্যালিডের মতো তথাকথিত বিখ্যাত তারকারা আসার সঙ্গে সঙ্গে তিনি কৃত্রিম আলো ফেলেছিলেন আর তা মোটেই ভালো হয়নি। তিনি তাদের প্রতি আলোকপাত করেছিলেন কারণ তারা টিভিতে স্পিকার দেখতে চান। স্পিকার দেখার গুরুত্ব কী? আমাদের কেবল দরকার তারা যা বলছে, তা শোনা।


আর আপনি তার সঙ্গে একমত হতে পারেননি ।

ওহ‌্, পুরোপুরি (হাসি)। একটা জবরদস্ত তর্কাতর্কি হয়েছিল। কিন্তু আমি তা এড়াতে পারিনি কারণ চুক্তিতে স্বাক্ষরিত ছিল ব্যাপারটা। একটি সমঝোতা করতে হয়েছিল। একটি ফিল‌্ম সব সময়েই একটা আপস।




আলাপচারিতায়: গ্যাভিন স্মিথ ও জ়াঁ-লুক গোদার। প্রকাশ হয়েছিল ‘ফিল‌্ম কমেন্ট’ পত্রিকার মার্চ-এপ্রিল ১৯৯৬ সংখ্যায়। ইংরেজি থেকে বঙ্গানুসরণ করেছেন মলয় রায়চৌধুরী।




প্রচ্ছদচিত্র ও অন্য ছবি সৌজন্য: www.filmcomment.com, www.letterboxd.com, www.dw.com