এমন সময় কিছু বাতাস খেলে গেল কানের ওপর। ফিস্ ফিস্ হেশ হেশ শব্দ উঠে আসছে মাটির নীচ থেকে, যেন উষ্ণ নিশ্বাস বাষ্প—অভিশপ্ত হৃদয়ধ্বনি! কান খাড়া কিস্তার যে কোনও একটা সপ্রাণ সারমেয়ের মতো, চোখেও সঙ্গে সঙ্গে এসে গেল অসম্ভব ধার! সে দেখল, সাপের ফণার জিবে—বিদ্যুতের ঝলকে চমকে পাক খাচ্ছে হাজার অত্যাচারী তরবারি—একটার পর একটা মুণ্ডু খসে পড়ছে ধড় থেকে। হিসেব করতে বসলে ধরে নাও সাতশো! হিসেবটা এই রকম থাকলেও, পরে আর রইল না। কিস্তা জানে পৃথিবীটা ঘুরছে। ঘুরছে বলেই একদিকে আলো আর অন্যদিকে অন্ধকার। ওটা যদি হয় মহাপাত্ররাজ নরহরের আলোর দিন তবে তার পিছনে ছিল ভয়ের বিভীষিকার অন্ধকার। কেন এত ভয়? কাকেই বা এত ভয় নরহরের? তার উত্তর কিস্তা জানে। উত্তর জানে না কিস্তা কেন তার এই ব্যাকুলতা আজ! উত্তর মেলে না। তবুও খনন করে চলে। প্রশ্নাভিসারী এ প্রৌঢ় নায়ক এখন তার নায়িকাজিজ্ঞাসার মুখোমুখি। আচ্ছা বল তো তোমরা, ব্যক্তির প্রাতিস্বিক এই যে জিজ্ঞাসা, তার সঙ্গে তার সক্রিয়তাকে গুলিয়ে ফেলা সম্ভব? জিজ্ঞাসার সূত্র ধরে ব্যক্তির উত্তরণ বা অবতরণের বিচার সম্ভব? সম্ভব কী না জানে না কিস্তা। তবে নরহরের ভয়ের কারণ সে অনুসন্ধান করতে পারে। কিস্তার চৈতন্যে শুরু হলো এক পুত্তিকা-গুঞ্জন…

ইহার পরও যারা কৃষক ঘড়াই
সংঘবদ্ধ হইল জেদে যার পর নাই
সেটা হইল সন সতেরোশো তিয়াত্তর
ঘটিয়া গিয়াছে এক মহা মন্বন্তর

বঞ্চনার সে স্বরূপ শুনিতে কি চাও
শুনিতে হইলে সবে কানে চাপা দাও

কিস্তা দেখল সবাই কানে হাত চাপা দিয়েছে। কলকেটি সাজিয়ে নিয়ে ডুমুর গাছের তলায় বসল সে। এমনিতে গরমের দিনে সাপখোপের ভয় থাকে। আজ বুদ্ধপূর্ণিমা। জ্যোৎস্না হাসছে। ছোটখাটো একটা হস্তীর মতো বড়সড় একটা গোসাপের সঙ্গে বন্ধুত্ব থাকায় কিস্তা এখন নিশ্চিন্ত। যাবতীয় অধ্যাস কাটিয়ে উঠতে সে সক্ষম। প্রথমটায় দুজন দুজনকে চিনতে পারেনি। তারপর আলাপে আলাপে কথায় কথায় ভাব হলো, পরিচয় পেলো। তখন আকাশ বাতাস এমনকি উলটো পিঠের সূর্যকে কাঁপিয়ে তারা হাসল। কিস্তার মনে পড়ল এই গোধারাজ প্রথম দিন তাকে দেখতে পেয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। পরের দিন থেকে চুপিচুপি এসে গাছের এক ধারের ডুমুর খেয়ে পালিয়ে যেত। এই রকম বারবার যাতায়াতেই আলাপ হলে বুঝতে পারল তাদের একে অন্যকে ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই। আগের জন্ম থেকেই বন্ধুত্ব। এক দিন গোসাপটি জিজ্ঞেস করে, তুমি কেন এখানে এসে বসে থাক বল তো?

কিস্তা বলল সব বৃত্তান্ত। সব অসুখের কথা। পারিবারিক অসুখ, সামাজিক রাজনৈতিক অসুখ, মনের ভেতরের অসুখের কথা। …