এই সেদিন ট্রেনে কথা হচ্ছিল, সদ্য তথ্যপ্রযুক্তিতে কাজ পাওয়া এক তরুণের সঙ্গে। সরকারি ক্ষেত্রের চাকরি। অথচ অফিস চৌহদ্দিতে হিন্দি বা ইংরেজি ছাড়া অন্য ভাষায় কথোপকথন নট অ্যালাউড। এমনকি দুজন বাঙালি কিংবা দুজন পাঞ্জাবি হলেও; নো বাংলা, নো গুরুমুখী। কেন এমনটা? উত্তরটা ছেলেটির কাছেই পেয়ে গেলাম। ওঁদের (অর্থাৎ উপরওয়ালাদের) আতঙ্ক, প্রাদেশিকতার চর্চার ফাঁকে যদি দুজনে কোনো গোপন বার্তা-বিনিময় করে। কর্তৃপক্ষকে অন্ধকারে রেখে, নিজেরা কোনো চিন্তাভাবনার লেনদেন করে নেয়। অতএব, দে গরুর গা ধুইয়ে!

ব্যাপারটা কিন্তু বিন্দুতে সিন্ধু-দর্শন। বিশ্বজুড়ে শাসকের সংকট যত বেড়েছে, ততই সে দড়িতে সাপ দেখেছে। আর হবুচন্দ্র রাজার বুদ্ধি নিয়ে বেবাক মানুষের মুখের ভাষা চাপা দিয়ে আপন ভাষা চাপিয়েছে তার মুখে। কিন্তু মাটি থেকে শেকড়বাকড় সুদ্ধ তুলতে না পারলে, গাছের ডালপালা কেটে তাকে আর কাঁহাতক আটকানো যায়। কোন ফাঁকে সে ঠিক ফুল ফুটিয়ে ফেলে, ফল পাকিয়ে তোলে, পাখির গানে ভরে ওঠে বাতাস—প্রকৃতির এমনই ষড়যন্ত্র। সে যাই হোক, মানুষকে এখন মাটি থেকে ওপড়ানোর ‘শুভকর্মে’ হাত দিয়েছে শাসক। ভাষা ভুলিয়ে দিলেই সে কাজটা সবচেয়ে নিশ্চিতভাবে হতে পারে। হাজার বছর ধরে বলতে বলতে বুলি হয়ে উঠে ভাষার গায়ে লেগে থাকে তার ইতিহাস, ধর্মাচরণ, দর্শন ও সামাজিক অভ্যাসের কাদামাটি। তাই মানুষের মুখের ভাষা পালটালে মানুষটাকে যতটা পালটে দেওয়া যায়, ততটা আর কিছুতেই নয়।

মজাটা এই যে, ব্যাপারটা ঠিক মেয়েদের ক্ষেত্রে নিজেকে বাপের বাড়ি ছেড়ে শ্বশুরবাড়ির ধাতে নিয়ে আসার মতো নয়। শ্বশুরবাড়ি এসে মেয়েটি কিন্তু আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভোগে না, সামাজিক স্বীকৃতির সংকট তাকে বইতে হয় না। সমস্যাটি হয় খাপ খাওয়ানোর, যদিও তার গুরুত্ব বা সংকটও যথেষ্ট। এক্ষেত্রে যারা তাদের ভাষা অন্যদের ওপর চাপাচ্ছে, তাদের কিপলিংয়ের ‘ইস্ট-ইজ-ইস্ট’ মার্কা মানসিকতাই আসল অন্তরায়। ‘আজকের সভ্যতা’ প্রবন্ধে সি. এম. জোড (Cyril Edwin Mitchinson Joad) বর্তমান সভ্যতার শুভাশুভ খুঁজতে চেয়ে, এক জায়গায় এর গুণপনা বলতে গিয়ে দেখিয়েছেন যে, এটি আগেকার নগরকেন্দ্রিক ঐতিহাসিক সভ্যতাগুলির মতো ছোট গণ্ডিতে কিছুমাত্র মানুষের মধ্যে আটকে নেই। সমগ্র ইউরোপে তার বিস্তার ঘটেছে। ক্রমে তা এশিয়া, আফ্রিকা ইত্যাদিকেও আলোকিত করে তুলে, আপন আঙিনা-ভুক্ত করছে। অতএব সভ্যতাটি টিকে যাবে।

ক্রান্তদর্শী হতে গিয়ে ভ্রান্তদর্শন ঘটে গেল। আসলে যন্ত্রনির্ভর উৎপাদন-ভিত্তিক এই সভ্যতার সম্প্রসারণ কিন্তু বাজার দখল আর কাঁচামাল লুটের দায় থেকে। যার জঘন্যতম প্রকাশ আফ্রিকার মানুষদের জাহাজ বোঝাই করে ইউরোপ, আমেরিকায় চালান করা। তাই মার্কিনি মন্ত্রীসভার প্রতিনিধি হয়ে সে কলিন পওয়েল বা কন্ডোলিজা রাইস কিংবা কমলা হ্যারিস যেই হোন না কেন, আফ্রিকান বা অ্যাফ্রো-আমেরিকান—অনুন্নত তৃতীয় বিশ্বে এসে তাঁদের হুঁশিয়ারি, হুমকি অথবা টোমাহক মিশাইল রদ্দা প্রয়োগ করতেই হয় মার্কিনি প্রভুদের স্বার্থে। নিজেদের শেকড়বাকড় উপড়ে ফেলে ফরম্যালিনে ডুবিয়ে নিতে না পারলে, বলা বাহুল্য পওয়েল-রাইস-হ্যারিসদের ভাত কাপড় প্রভুরা জোটাবে না। নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়া, ৪৪তম প্রেসিডেন্ট ‘ব্ল্যাক মেন’ বারাক ওবামা ক্ষমতার মসনদে থেকে বিদায় নেওয়ার পরপরই অবাঞ্ছিত এক ঘটনার সূত্রে, সমসময়ের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ ‘ব্ল্যাক লাইভ‌্স ম্যাটার’ আন্দোলন সে দেশে সংগঠিত হয়।

কথা হচ্ছিল ভাষা নিয়ে। দু-চারজন রেজা খাঁ-মীরজাফর-কন্ডোলিজাদের এরা চিরকালই অন্তর্ভুক্ত করে বাকি জাতটাকে তাঁবে রাখবার জন্য। কিন্তু প্রায় সাত-আটশো কোটি বিশ্ববাসীর মধ্যে, নিপীড়িত পাঁচশো কোটির জন্য বরাদ্দ চোখের জল আর মুখের ভাষা—যেটা দুঃখ, বেদনা, রাগ, অভিমান, আশা, আকাঙ্ক্ষা, উৎসাহকে মানুষের মাঝে সশব্দ করে তুলতে পারে। তাই তাদের কাছ থেকে ভাষাটা কেড়ে নেওয়া বড় সহজ নয়। মাও-সে-তুঙ বলেছিলেন—দেশ চায় স্বাধীনতা, জাতি চায় মুক্তি, জনগণ চায় বিপ্লব। পৃথিবীর কোণে কোণে চলমান জাতিসত্তার আন্দোলনগুলির ইতিহাস; ভারত, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, লাটভিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকার অবদমিত জাতিগুলির মুক্তি আকাঙ্ক্ষা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে, রাষ্ট্র বধির শাসক মাত্র অথবা সে যা বলে তাই পালনীয় কর্তব্য। আফ্রিকান কবি মায়ের মুখের ভাষায় ডাক দিয়েছিলেন, আপন ভাইকে, ‘নিককোশি সিকলে আফ্রিকা’ (জাগো মাতৃভূমি, জাগো আফ্রিকা)।


ভাষা স্মারক স্তম্ভ, দক্ষিণ-আফ্রিকা
ভাষা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে, দক্ষিণ-ভারত

বঙ্গভঙ্গের ঘৃণ্য চক্রান্তের দিকে তাকালেই বুঝতে পারব, জাতিসত্তার উন্মেষের বিপদ ইংরেজ কী গভীর আতঙ্কে চিনেছিল এবং যে-কোনো প্রকারে বাঙালি জাতিসত্তার জাগরণকে তাই ধর্মের আফিম খাইয়ে ঘুম পাড়াতে উঠে-পড়ে লাগল তারা ও তাদের সঙ্গী দোসররা। আসলে, মার খেতে খেতে জাগতে চাওয়া মানুষকে ভাষার কাছে আসতেই হবে আপন প্রাণের দায়ে। যে জাতি যত আক্রান্ত হবে, জাগ্রত হবে, হাত-পা মেলতে চাইবে তার ভাষা তত সাবালক হয়ে উঠবে—এটাই সত্য। আজ থেকে হাজার বছর আগে ‘ব্রাহ্মণ্যবাদী’ আগ্রাসনের দিনে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য তান্ত্রিকদের আপন ধর্মাচরণের পদ্ধতি গোপন কোডে টিকিয়ে রাখার তাগিদ নিয়ে তৈরি হলো—সান্ধ্যভাষার চর্যাপদগীতিকা। বিগত শতকে গেষ্টাপোদের মৃত্যু উপত্যকায় দাঁড়িয়েও ফরাসি লেখক-শিল্পী সংগীতকাররা ফ্যাসিস্তদের বিরুদ্ধে লিখেছেন, বই ছেপেছেন, এঁকেছেন, প্রদর্শনী করেছেন, গান গেয়েছেন, গোপন রেকর্ড করেছেন। গড়ে উঠেছে, ফরাসি প্রতিরোধ সাহিত্য। বিশ্বযুদ্ধের দানবিক দংষ্ট্রার বিরুদ্ধে জন্ম হয়েছে ওয়ার পোয়েটদের। এ যেন ঘুমন্ত সিংহকে খোঁচা মেরে জাগিয়ে দেওয়া। ভাষার জড়ত্ব ঘুচিয়ে নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ ঘটানো।

শিল্পীর যে দায় ‘জীবনের বাস্তবতা’ আর ‘জীবনের চাপকে রূপদানের’—ষাঁড়ের দুটো শিং-কে বাগে আনা বলে, বিষ্ণু দে উল্লেখ করেছেন, সে কাজটা অনেকটাই সহজ হয়ে ওঠে। সময়ই আপন তীব্রতায় কবি সাহিত্যিকের অনুপম ভাষা, নাটক উপস্থাপনার নবতম মাধ্যম গড়ে নেয়। যেমন, চারের দশক থেকে একের পর এক আছড়ে পড়া কৃষক বিদ্রোহ, নৌ-বিদ্রোহ, শ্রমিক ধর্মঘট, তেভাগা-তেলেঙ্গানা, মন্বন্তর, দাঙ্গার পরিপ্রেক্ষিতে—আমরা পেয়েছিলাম গণনাট্য সংঘ, ফ্যাসিবিরোধী লেখক শিল্পী সংঘ, প্রগতি লেখক সংঘ ইত্যাদি। পেলাম বিষ্ণু দে থেকে ঋত্বিক ঘটকদের মতো এক ঝাঁক ‘দায়বদ্ধ’ শিল্পী ও স্রষ্টাকে। পালটে গেল শিল্পের ভাষা, শর্ত, মূল্যবোধের সংজ্ঞা। শব্দ পেল নতুন মানস ও চৈতন্য পলি-সমৃদ্ধ আশ্রয়ভূমি।

কিছুকাল আগেরই বুলি—স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায়; মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই; দশহাজার প্রাণ আমি যদি পাইতাম—মানুষের মনের অধিকার কালের দাবিতেই ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো নতুনকে। আমরা বলে উঠলাম—হেই সামাল হো ধান হো; পরান মাঝি হাঁক দিয়েছে; পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন; শতাব্দী যে শেষ হয়ে এল/একটু পা চালিয়ে ভাই; কারা যেন আজও ভাত রাঁধে/ভাত বাড়ে ভাত খায়; পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি ইত্যাদি হাজারো শুদ্ধ সময়নিষ্ঠ শব্দবন্ধ। পরিপ্রেক্ষিত হারিয়ে আগেকার জ্যোতিহীন শব্দপ্রতিমা নিঃশব্দে বিসর্জনে গেছে। খেদ হয়নি আমাদের। আতঙ্কিত হইনি কখনও এই ভেবে যে, ভাষা টিকবে কিনা, আগ্রাসনে হারাবে কিনা, হারবে কিনা। কারণ তখন আমরা পেয়ে গেছি অজস্র ‘হিম্মত’ দেখানো পঙ‌্ক্তি ও বাক্য।

আজ কিন্তু ভাষা আগ্রাসনের প্রশ্নটা উঠেছে। এবং আশ্চর্য, অল্প কিছকাল আগের সেই সময়জ দুটি ধারা অর্থাৎ একদিকে সামাজিকভাবে দায়বদ্ধ বামপন্থায় বিশ্বাসী, অন্যদিকে বোদলেয়র, সার্জ, গিন‌্‌সবার্গ প্রভাবিত হাংরি শ্রুতি অ্যাংরি ইত্যাদি আভাঁগার্দ—উভয়েই সংকটের সামনে, খাদের কিনারায়। সন্দেহ নেই—সমষ্টির কাছে দায়বদ্ধদের কলম থেকে বাদ পড়ে যাওয়া ব্যক্তির বিপন্নতা ও বিচ্ছিন্নতার দিকটা বুদ্ধদেবের নেতৃত্বে ও ধারাবহনে তুলে ধরতে আভাগাঁর্দরা ছিলেন তীব্র, সংরাগময় ও আন্তরিক। ভাষার পতাকা নিয়ে উদ‌্‌বিগ্ন হওয়ার এবং দু-কথা বলার হক তাঁদেরও তো থাকবেই। ব্যক্তিগত ইন্দ্রিয়ানুভূতি, ইচ্ছা, আবেগ, সাধ-আহ্লাদ, সুখ, অভিমান, ক্ষোভ, বিষাদ ও কারুণ্যের বাহারি রঙে তারাও সত্যকেই ধরতে চেয়েছেন তাঁদের মতো করে বিশ্বাস, অবলোকন ও খননের নিষ্ঠা নিয়ে। দুই ধারাতেই সত্য খুঁজেছেন এমন ব্যক্তি তো স্বয়ং জীবনানন্দ।

আজকের প্রেক্ষায় দু-শিবিরের কাছেই এই ভাষার আতঙ্কটা তাহলে কী? উত্তরটা বর্তমান পৃথিবীর বিদ্যমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চিত্র থেকেই বুঝে নেওয়া সহজ হবে। শাসকের বা ব্যবসায়ীর কাছে পৃথিবীটা দু-ভাগে ভাগ হয়ে আছে: ‘দরকারের পৃথিবী’ আর ‘অদরকারের পৃথিবী’। যেমন ধরুন এয়ারপোর্ট থেকে মার্সিডিজ বেন‌্জ চড়ে ভিআইপি ধরে পাঁচতারা হোটেল, টেকনো পার্ক, আইটি সেজ়, শপিংমল, নাইটক্লাব, ডিস্কোথেক, ব়্যাম্পে ক্যাট ওয়াকিংয়ে চোস্ত মডেল—এইসব হলো প্রভুদের দরকারের পৃথিবী। এ জীবনের বাইরের যা কিছু তা সবই তাদের দিক থেকে অদরকারের। এবং কখনও বা এই অদরকারি বিষয়গুলিও ব্যাবসার নিয়মে হয়ে পড়ে ‘কুল থিং’ ফ্যাশানের ইন ও আউট; হয়ে পড়ে কখনো-সখনো বিপজ্জনক প্রতিপক্ষও।

এ অনেকটা সেই মসলিন উপাখ্যান। তবে তাতির আঙুল কাটার থেকে পদ্ধতিটা ভিন্ন আর ছদ্মবেশী, তফাত এইটুকু। এখানে এসেই জোড সাহবের সভ্যতার সম্প্রসারণটা আসলে সভ্যতার আধিপত্যবাদ হয়ে যায়। সেটা যে সবসময় কামান, বন্দুক নিয়েই করতে হবে তার মানে নেই। চকোলেট ছড়িয়েও হতে পারে। বন‌্ধ-কালচারে অভ্যস্ত বাঙালিকেও ‘লকডাউন’ বুঝিয়ে দিল, ‘চাক্কা জ্যাম’ আর ‘লকডাউন’ চরিত্রে কতটা আলাদা। নয়ের দশকের বিশ্বায়ন পেরিয়ে, হাল আমলে বিলুপ্ত এক ফোন নেটওয়ার্ক কোম্পানির তরফে খবরের কাগজের পাতা-জোড়া বিজ্ঞাপনে লেখা হয়েছিল: একটানা বৃষ্টিতে আপনি যখন ঘরবন্দি…! লকডাউন ঘরবন্দি মানুষকে জানান দিল, গুগল-অভ্যস্ত না হলে পরে, নাগরিক হিসাবে দ্বিতীয়-তৃতীয় তো অনেক দূর, জীবন-জীবিকার দশম শ্রেণিতেও ঠাঁই নেই তার।

ভাষা বিষয়ে তাহলে দুটো দিক থেকে প্রেক্ষিতটা গুরুত্ব পাচ্ছে। ভাষা একই সঙ্গে পণ্যের মাধ্যম এবং নিজেও একটা পণ্য। বিশ্বজুড়ে প্রচারিত হাজার হাজার কোটি ডলারের ব্যাবসা করা টিভি চ্যানেলগুলোকে তো ভাষা সাম্রাজ্যের উপর ভর করেই বেঁচে থাকতে হচ্ছে। ছোট ছোট ভাষা উপভাষাও মুখ থেকে কেড়ে নিতে পারলে—ভাষা বিপণনের পাশাপাশি আচরণগত ভাবেও মানুষকে বড় ভাষার ছাঁচে ফেলার সুবিধা হয়। আমরা যেমন যেমন ভাবে শিখেছি, তেমন তেমন ভাবে বলেছি: হ্যালো, হাই, স্যার, ম্যাম, ও কে, আই সি, স্যালুট, গুড মর্নিং, গুড নাইট। শুভ ধনতেরাস। মম্মা, পপ্পা। আমরা বলতে শিখেছি: ব্রো, ইতনা শ্র্যাগ…!

আমরা শিখেছি ও বলেছি: বিজয়া গ্রীটিংস, হ্যাপি পয়লা বৈশাখ বা দেওয়ালি। এফএম রেডিও-র হাজার ফ্যান ফলোয়ার সমৃদ্ধ আরজে-রা এবং টেলিভিশন চ্যানেলগুলি নিরন্তর ভাষা ও উচ্চারণের এই নোংরামি করেই চলেছে, মনোরঞ্জনের দোহাই দিয়ে, হয়তো বা পেশাজীবী হিসাবে কিছুটা বাধ্য হয়ে। করা হচ্ছে একটাই উদ্দেশ্য নিয়ে, সেটা হলো বিপরীত দিকে থাকা ভাষা-ব্যবহারকারীর উচ্চারণ, শব্দ ব্যবহার, আচরণ পালটে ফেলে মাটি থেকে উঠে আসা ভাষাবাহিত ভাবনা-স্রোতটার উৎসমুখকে শুকিয়ে দেওয়া। যতটা সম্ভব।

এই শেখা আমাদের শহর এমনকি গ্রামীণ আচরণকেও পালটে ফেলেছে। কমফর্টেবল হিসাবে বারমুডা, টি-শার্ট কিংবা জিনসের প্যান্ট সে জানা-বোঝার সাক্ষী তো অনেকদিন থেকেই। শহরের আর পাঁচটা সান্ধ্য বা রাত্রিকালীন জমায়েতের মতো, মফস‌্‌সল পেরিয়ে গাঁয়েও, হাত-ফোনে বা হাজার ওয়াটের সাউন্ড বক্সে আজকাল বেজে উঠছে ভায়া ইন্টারনেট ডাউনলোড করা ডান্স নাম্বার, ডিজে মিক্স বা হিন্দি সিনেমা-বাহিত বাজারচলতি মিকা সিং কিংবা টুনির মা ও কাশী হিলে পাটনা হিলে। আবার এই মুখগুলিই ভিড় জমায় লোকনাথ বাবার পুজোয় হওয়া বাউল গানের আসরে। কাঁধে বাঁক নিয়ে ছোটে শিবের মাথায় জল ঢালতে।

এইভাবে ভাষার বিষয়টি জাতি গোষ্ঠীগুলোর মুখ থেকে, আবেগের বহিঃপ্রকাশের সঙ্গদানের কাজ থেকে সরতে সরতে ক্রমশ পুঁজির সঙ্গে সম্পর্কিত হয়েছে। পুঁজি যেহেতু স্থানীয় ও জাতীয় সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক বা বহুজাতিক কিংবা একটু আক্রমণাত্মক ভাবে বললে, সাম্রাজ্যবাদী হয়ে উঠেছে, তার সহযোগী হিসাবে ভাষাও তাই। ইতিপূর্বে স্থানীয় ও জাতীয় পুঁজির বিকাশের স্তরেও তা বহুসংখ্যাক গোষ্ঠী ও উপগোষ্ঠীর হাজারো ভাষার বিলোপ ঘটিয়েছে। ইউরোপে তো বটেই, এ-দেশেও তার উদাহরণ বহু রয়েছে। আবার ছোট-ছোট ভাষাগুলোর বেঁচেবর্তে থাকা কিংবা পুনরুজ্জীবনের বিষয়টিও ভাষাগত জাতিসত্তার বাঁচামরা-লড়াই-আন্দোলন-বিকাশগত বিষয়গুলির সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে। পুঁজির বিনিয়োগ যেহেতু মুনাফার বিষয়ে সাবধানী ও নিশ্চিত হতে চায় সেহেতু ভাষায় বিনিয়োগেও তার স্পষ্ট ও প্রত্যক্ষ দর্শন থাকে। হলিউডি চলচ্চিত্রের সঙ্গে টালিগঞ্জী চলচ্চিত্রের পুঁজিগত পার্থক্যই শেষ পর্যন্ত মেধা, কারিগরি ও উপস্থাপনাগত পার্থক্য গড়ে দেয়।

আবার পুঁজির সেবাদাস হতে চাওয়াদের শিক্ষায় তাই সেই অনুযায়ী মানবসম্পদ গড়ে পিটে নেওয়ার ব্যবস্থা থাকে, যা পুঁজির এই আগ্রাসী চরিত্রের সঙ্গে মানানসই হয়। পুঁজি যদিও মুখে বিশ্বায়ন, বহুত্ববাদ ইত্যাদি বলে থাকে—আসলে সে চায়, বিশ্বব্যাপী একটাই রেফারেন্স ফ্রেম এবং কালচারাল কোড। বিবিধের মাঝে মিলবার এবং মেলাবার যে বিশ্ববীক্ষা রবীন্দ্রনাথ বারংবার প্রচার করেছেন, ইউরোপের দুয়ারে দুয়ারে, তার দায় তো পুঁজির নেই। বরং তাকে ধ্বংস করাটাই তার কাজ। বহু শ্রেষ্ঠত্বের অনুপম সমন্বয় নয় বরং এক ‘শ্রেষ্ঠীগত’ অত্যাচারেই তার কেরামতি।

এই পরিপ্রেক্ষিতের সঙ্গে সুকৌশলে তাল মেলায় দেশে দেশে টিকে থাকা স্থানীয় শাসক। ফলে শিক্ষাব্যবস্থায় বৈষম্যটা থেকেই যায়। বড়র স্বার্থ দেখাটাই যেখানে কাজ, সেখানে শিক্ষাব্যবস্থায় বড়র প্রতি সন্ত্রম জাগানো একটা ব্যাপার থেকেই যায়। সরাসরি ঔপনিবেশিকতার আমলে প্রভুদের প্রতি স্বাভাবিক ঘৃণায় যে কাজ থেকে জনগণ দূরে থেকেছে, হালআমলের এই ছদ্ম-ঔপনিবেশিকতার সময়ে, প্রভুদের মতো চলাফেরা, কথাবার্তা, আচার-আচরণে কেতাদুরস্ত হয়ে ওঠায় আমাদের ভেতর কোথাও আর হীনম্মন্যতা কাজ করে না। স্বাভাবিক ভাবেই দেশের শ্রেষ্ঠ ছাত্রছাত্রীরা দেশীয় ভাষার ব্যবহার কম করে। সংসদ ভবন ও আদালতের মতো জায়গাগুলোতে আঞ্চলিক ভাষাকে মান্যতা দেওয়ার ব্যবস্থা থাকলেও, বাস্তবে দাপুটেদের ভাষাই দাপিয়ে বেড়ায় বড় জায়গাগুলোতে।

সুতরাং ছোট ভাষাগুলো রোজই হেরে যাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে। ভৌগোলিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় বিষয়ের স্থানীয় বৈশিষ্ট্যসমূহ গোষ্ঠী, সম্প্রদায়, জাতি-উপজাতিগুলি স্থানীয় ও ছোট ছোট ভাষাগুলোর মাধ্যমে ভাব-প্রকাশের যে পথ করে নেয় তা রুদ্ধ হয়ে আসছে। প্রভুর ভাষায় থাকে প্রভুর শর্ত, উদ‌্‌বেগ, চাহিদা, আশা, আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ। তামাম দুনিয়ার আক্রান্তদের অনন্য প্রকাশ তাই ছোট ও পরাজিতের ভাষাতেই বিধৃত হয়। বিজেতার ভাষায় অবরুদ্ধ মানবের এবং সর্বোপরি পৃথিবীর জনসংখ্যার অধিকাংশের প্রতিফলন নেই বলেই সে ভাষায় যান্ত্রিকতা বেড়ে গিয়ে মানুষের অন্তরে গৃহীত হবার সুযোগ থেকে সে বঞ্চিত হতে থাকে।

মুখের ভাষা বন্ধ করে মানুষের উপর চেপে বসেছে দাপটের ভাষা। অপরদিকে বর্তমানের বহুমাত্রিক জটিলতাকে বুঝতে না পারায় হতভাগ্য ও পশ্চাৎপদ ভাষায় নতুন শব্দের আগমন ও বর্ণচ্ছটা অনুপস্থিত থেকে যায়। ফলে আধুনিকতার অভাবে সে ভাষা কাজের অযোগ্য হতে থাকে। সেক্ষেত্রে ভাষাগুলির মধ্যে অনুবাদকর্ম বাড়িয়ে, বাইরের হাওয়া ঢোকার ব্যবস্থা করে নতুন করে প্রাণ সঞ্চারের কাজটা করার উপর রবীন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ বসুর মতো মানুষ যে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছেন তা সম্ভবত এই তাগিদ থেকেই। ঔপনিবেশিক আমলে বাঙালি যত বেশি বেশি করে শাসকের সান্নিধ্য পেয়েছিল, ততই নিজের ভাষাকে সমৃদ্ধ করে তোলার আখেরটাও সে গুছিয়েছে পাশাপাশি। কিন্তু মনে রাখতে হবে, লাখ লাখ মানুষ তখন স্বাধীনতার স্পৃহায় উশখুশ বারুদ, অবরুদ্ধতার যন্ত্রণাকে সে ভাষা দিতে চায় প্রাণের আবেগ দিয়ে। সময়টা কিন্তু সংকটের নয়, সংগ্রামের, অতএব বিকাশের। সুতরাং; মানুষ বলে ওঠে: বিনা স্বদেশী ভাষা মেটে কি আশা, মোদের গরব মোদের আশা আ’মরি বাংলা ভাষা। জন্ম হয় রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দের মতো ভাষা-পুরুষের।

আজকের দূর নিয়ন্ত্রিত ও ছদ্ম-ঔপনিবেশিকতার আমলে সেই ঘৃণাটা আর নেই। বরং শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের মধ্যে শুরু হয়েছে আত্মবিস্মৃতি ও আত্মপরিচয় বিসর্জনের বিনির্মাণ। মাতৃভাষায় বিদ্যাচর্চা যেন দুয়োরানি শিক্ষাব্যবস্থা, প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের জন্য দায়সারা গোছের বন্দোবস্ত। বাংলার বাজার কম এই আশঙ্কায়, বৃহতের মাঝে যাওয়ার নিমিত্তে বিদগ্ধজনেরা লিখেছেন, লিখছেন ইংরেজিতে। সন্ধানীরা জানেন, কোন ‘পার্সোনাল ব্লগ’ বা ‘কমার্শিয়াল ওয়েবসাইট’-এ পাওয়া যাচ্ছে নিয়মিত তাঁদের লেখা। মাতৃভাষা বাংলার জন্য ভাবছে কে? ঘরে ঘরে জন্ম নিচ্ছে মাটির পরিচয়হীন, টানহীন, পণ্যপ্রিয় উচ্চাকাঙ্খা। হায়, এই রঙ্গ রোধিবে কে? নিজেকে খুঁজে পাওয়ার জন্য শিকড়ের এবং শিকড়ের জন্য মাটির প্রয়োজন। নিজেকে হারিয়ে ফেলতে হলে, পরগাছা মানসিকতাই তো সুবিধাজনক। এই হলো পুঁজির দরকারের পৃথিবীর ছবি। এর বাইরেরও ছবি আছে—যেখানে ক্ষুধা, নৈরাশ্য, আশ্রয় ও নিরাপত্তাহীনতা, বিনা চিকিৎসাই নিত্যসঙ্গী। আমাদের কমবেশি জানা কথাগুলি বিস্তারে জানিয়েছেন, ড. কাফিল খান তাঁর লেখায়।

ন্যূনতমের চেয়েও ন্যূনতম উপাদানে তারা টিকে থাকে, বধ্যভূমির সমস্ত আয়োজন উপেক্ষা করে। সাইবার-সিলিকন ভ্যালিতে তারা সকলেই গ্রাহক। তারা টিকে আছে যতক্ষণ এ ভাষার শ্বাসও ততক্ষণ। কারণ, আবেগ ও অনুভূতির প্রকৃত বাহক সেখানে হতেই হয় ভাষাকে। ছলনা, চাতুরি, ভণ্ডামির সুযোগ বিশেষ নেই বলেই ভাষাতেও তার অনুপ্রবেশ কম বা নেই। জীবনের সমস্ত তীব্রতা ও সারল্য নিয়ে সেখানে ভাষা প্রাণবান। হয়তো যথেষ্ট শিক্ষিত ও মার্জিত নয় কিন্তু সংগ্রামী—বেঁচে থাকার অনিবার্য শর্তে। আশার কথা এই যে, পুঁজির দরকারের পৃথিবীটা মানুষের সংখ্যার বিচারে ক্রমশ এতটাই ছোট হয়ে আসছে যে, গতকালের প্রয়োজনের মানুষও হয়তো আজ থেকে অদরকারের। যেমনটা আমরা পড়েছি, আর. কে. নারায়ণের গল্পে। দেখি, ব্যাবসা পড়ে যাওয়ায় খরচ সামলাতে না পেরে নামকরা বেসরকারি স্কুল থেকে ছাড়িয়ে ছেলেমেয়েদের সরকারি স্কুলে ভর্তি করতে হয়। সুতরাং কর্পোরেট-কালচারের অনিশ্চয়তায় ‘অভাবের ভাষা’র দিকে ক্রমশই ভিড় বাড়লে, হঠাৎ করে এই মানহারা মানবদের মানিয়ে নিতে বেশ অসুবিধেই হবে। কিন্তু তাকে সেই ভিড়ের মাঝে পৌঁছে দেওয়ার কারণ ও রাস্তাগুলো সবই এখন পুঁজির হাতে।

দেশী বিদেশী ‘মরমী’ ‘সদ‌্ বুদ্ধিসঞ্জাত’ গুড মর্নিং-গুড নাইট বার্তা যে সময়ে ভেসে উঠছে অ্যান্ড্রয়েড স্ক্রিনে, সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখা হচ্ছে রোজনামচা—ভাষা সংরক্ষণ ও গ্রাহকের সুবিধা আর উন্নততর পরিসেবার আড়াল দিয়ে সে সময়ে চলছে অন্য এক ভাষা সন্ত্রাস! সন্দেহজনক নজর রাখছে আর্টিফিশিয়াল মগজ। তার নজরে ‘নির্দোষ মজা’ আর ‘প্ররোচনামূলক’ দুয়েররই মাপকাঠি এক—দেশীয় সরকারও অশিষ্ট অসংসদীয় শব্দসমূহের তালিকা প্রকাশ করেছে যখন—এ অবস্থায় চকিত-চাহনির ন্যায় একটি পুরোনো ‘খবর’-এর দিকে, গুজবই হবে হয়তো, নজর দেওয়া যাক। এমনটা জানা গিয়েছিল, বুশ সাহেব নাকি আল জাজ়িরা টেলিভিশন কেন্দ্র নাশকতার মাধ্যমে উড়িয়ে দেবার চক্রান্ত করেছিলেন। অতএব বোঝা যাচ্ছে, লড়াইয়ের ভাষা আর তার মাধ্যমকে কত ভয় প্রভুদের। আর ওদের ভয়টাই যেন আমাদের কাছে বরাভয়।




প্রচ্ছদচিত্র ও অন্য ছবি সৌজন্য: www.theringer.com, www.dreamstime.com, www.tbsnews.net