আলজিভের ওপিঠ

আজও জানে না মানুষ কীভাবে এ পৃথিবী-গ্রহ জন্মাল। কিছুটা আন্দাজ করেছে কেবল। কীভাবে মানুষ জন্মাচ্ছে, এটা সে মোটামুটি জানতে পেরেছে। কিন্তু এখনও জানে না, ওই জরায়ু-যোনি-অণ্ডকোষ-বীর্য ও তার লেজ কীভাবে হলো, কোথা থেকে এল! বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে জানা তো পরের কথা! যদিও জীবন-যাপন আহার নিদ্রা মৈথুন, ওই সর্বসম্যক জেনেও ঢের উপভোগ্য করে নিতে জানে সে নিজেকে।

পৃথিবীর তাই বহু অলৌকিক সৃষ্টিতত্ত্ব আছে। মানুষ কল্পনা করেছে। তত মধ্যে কল্পনা করেছে রোম্যান উপজাতিরা: আদম তার অ্যাডোলেসেন্স পিরিয়ডে টের পায়, তার কোনো সঙ্গীনী নেই। যদিও জীবজগতে আর সবার সঙ্গীনী আছে, হাতে গোনা যায়, এমন কয়েকটি উভলিঙ্গ জীব ছাড়া। তখন তো আদম প্যারাডাইসে থাকত! তখনও তো ‘প্যারাডাইস লস্ট’ হয়নি! তাই ঈশ্বরের সঙ্গে চলতে ফিরতে দেখা হত। একদিন কামার্ত সন্ধ্যায় আদম ঈশ্বরের দর্শন পায়।

—হা ঈশ্বর, তুমি সকলকে সঙ্গিনী দিলে, আমাকে তো দিলে না ? তোমার জীব-সৃষ্টিই তো এক প্রকার যুগল সৃষ্টি—সঙ্গী সঙ্গিনী—আমার ক্ষেত্রে তা হলো না কেন?

বিস্মিত ঈশ্বর অনিমেষ চেয়ে থাকেন আদমের দিকে।
—সে কী! আমি তোমার সঙ্গিনী সৃষ্টি করিনি? বড় ভুল হয়ে গেছে তো তাহলে! …দাঁড়াও দেখি…!

ঈশ্বর ফিরে গিয়ে দেখল, আদমের সঙ্গিনী কৃষ্ণকায় অজগর সর্পরূপী শয়তানকে কামার্ত আশ্লেষে সঙ্গম করছেন। রতিক্লান্ত শয়তান ঈশ্বরকে দেখে বললেন…


আলজিভের এপিঠ

শোন ঈশ্বর, এই তোমার প্রথম সৃষ্টি; ইনি ভবিষ্যের গর্ভধারিণী—তাই তোমার সৃষ্টি প্রবহমান এই নারীই রাখবে—যে জন্য সে আমার অধিকারে থাকবে, তোমার অধিকারে থাকবে বাকি সব। আমার অধিকারে থাকুক তোমার ‘an object just before anything’ অর্থাৎ ‘Eve’। এর নাম ইভ-ই থাক। আমি ওকে আমার গল্প শুনিয়েছি, শুনিয়েছি ঝরনার গল্প, সারঙ্গ সারঙ্গীর গল্প, ঘাসের ও লতার গল্প, ক্যাট ফ্যামিলির গল্প, ম্যান ইটারের গল্প—ইভ মুগ্ধ হয়ে আমার গল্প শোনে।

—এ তুমি কী করলে, স্যটার্ন ? আমার প্রথম সৃষ্টিকে পলিউট করলে?
—ঠিক আছে, পারো তো তুমি নিজের কাছে রেখে সংশোধন করো।
—অসম্ভব, শয়তানের স্পর্শমাখা কাউকে আমি গ্রহণ করতে পারি না।
—তাহলে আদমকে দিয়ে দাও।
— দিতে পারি, তবে তাদের প্যারাডাইস লস্ট হবে।
—দেখো, তাতে আদম রাজি কিনা!

ঈশ্বর আদমের কাছে ইভকে নিয়ে গেলেন। ইভকে দেখে আদম ষড়রিপুর দাস বনে গেল, গভীর আশ্লেষে, ইরাটিক প্রেশারে তখনি ইভকে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে স্থানান্তরে গেল। ঈশ্বর বজ্রনির্ঘোষে বল্লেন, তোমাদের ইডেন ত্যাগ করতে হবে, তোমরা স্বর্গভ্রষ্ট হলে, যাও মর্ত্য-জীবন যাপন করো গিয়ে এবং মরণশীল তথা নশ্বর হও। অর্থাৎ প্রেতদেহী হও।

আদম ইভ কর্ণপাতও করল না ঈশ্বরের ঘোষণায়।


খণ্ডিত আলজিভ

মর্ত্যে শুরু হলো তাদের ফ্যামিলি হ্যাপিনেস।

যায় যদি সুখ জ্বলে—যাক না। তবু তো আহার-নিদ্রা-মৈথুন! মর্ত্যে প্রত্যুষে পুষ্প ও সন্ধ্যায় কুসুমগন্ধ, নিশীথে বৃষ্টিস্নাত সহবাস।

সঙ্গে দেখল, এ জগৎ মহা হত্যাশালা।

হরিণ-হরিণী যুগল স্নানে মত্ত ছিল। এমন সময় বাঘ; Like fog comes on little catfeet; বাঘ এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল যুগল স্নানে। সেই ঝরনা রক্তে লাল হয়ে নেমে গেল সমতলে। কুমির সন্তরণরত। নদী বয়ে যায়। তার তীরে এক ছাগল জলপান করছিল। কুমির টেনে নেয় তাকে। নদী শিকারের রক্তে লাল। সেই রক্তাক্ত শব খেয়ে নেয় ইলিশ এবং মুহূর্তে প্রেতনদী বনে যায়। তার প্রেতযোনিতে জন্ম নেয় সহস্র ইলিশ। জন্মিয়েই সে সোমত্ত। এবং প্রেতনদী হয়ে যায় সহস্র শব প্রবাহিনী গঙ্গা। ভূস্বর্গচ্যুত আদম ইভ সে সময় বিচরণ করছিল গাঙ্গেয় সমতলে। ক্ষুধার্ত ছিল। ঝলকে ঝলকে ইলিশের ঢেউ ও পলকহারা ইভ মাতামাতি করল গঙ্গায় নেমে। নদীর আস্ত আস্ত রুপোলি ফসল, যা বস্তুত প্রেতদেহ, ধরে ধরে খেতে লাগল ইভ। আদম সেই দেখে ঝাঁপিয়ে পড়ল গঙ্গায়। দুজনায় তুমুল কাড়াকাড়ি চল্ল। ইভের সঙ্গে পেরে উঠছিল না আদম। চিতাবাঘিনীর স্বভাবে তখন ছিল ইভ। ক্রমে ইভের স্যালাইভায় আদম রাক্ষস হয়ে গেল। তার ক্যানিবাল দাঁত সূচ্যগ্র ভক্ষণও ছাড়ে না।


দ্বিখণ্ডিত আলজিভের সহবাস

ব্লু-লেগুনে উঠে উভয়ে সঙ্গমরত হয়। গর্ভস্থ হয় ইভ। এতদিন ঋতুস্রাব চেটে নিত আদম মাস মাস। ঋতুবন্ধ হয়ে গেলে, আদম ইভের স্তনবৃন্ত জিভ আঙুল কামড়াতে লাগল। সময় কালে ভূমিষ্ঠ হলো ইভের প্রথম সন্তান। পুরুষ। দশমাথা সর্বস্ব। প্রেত হাস্যে দশমুখে ইভ স্তন্যদান করতে লাগল। স্তন্যদানে কামার্ত হয়ে প্রেতিনী ইভ আদমকেও তার নাভি থেকে জাত স্তন থেকে দুগ্ধ পান করাতে থাকে। মধ্যবর্তী দশাননকে সহ্য করতে না পেরে, প্রেত আদম এক ঝটকায় স্বীয় ঔরসজাত সন্তানকে ইভের বুক থেকে ছিনিয়ে নিয়ে দূরে নিক্ষেপ করে। পলকে দেখতে পায় ইভের দশটি স্তন।

‘—তুমি কি বরাহ?’—বলতে বলতে আদম ইভের নাভি খেতে থাকে। বেশ শক্ত। জীর্ণ হয় না। এ যে সে-ই নাভি অগ্নি ভস্ম করতে পারে না যাকে।

ঈশ্বর সজোরে ঘোষণা করেন: এই হলো মর্ত্য জীবন!

মর্ত্যে তখন মানব-মানবীর সংখ্যা তিন। আদম-ইভ কাছাকাছি। কিন্তু সেই দশানন দূরবর্তী কোথাও কোনো দ্বীপে।

একদিন ইভকে স্বপ্ন দিল দশানন। বিমর্ষ কণ্ঠে জানাল, সে এক জলবেষ্টিত দ্বীপ-স্থলে আছে। তাকে সর্বদাই চিত হয়ে শুতে হয়। পাশ ফিরে শুতে পারে না। মাথায় লাগে। ‘আমাকে দশমাথা করলে কেন?’—এও সে বিষাদে জানায়। স্বপ্নের কথা আদমকে জানায় ইভ।

আদম তার অক্ষমতা জানায়। বলে;
—প্রেতযোনি জাত পুত্রের প্রেত হবারই কথা। এ-বিশ্বে সবাই প্রেত, যেহেতু সবাই নশ্বর। তোমার আর আমাজাত সব সন্তানই প্রেত হবে।
—আমি সর্প প্রসব করব।
— সে কী!
—হ্যাঁ, স্যাটার্ন আমাকে আলিঙ্গন কালে জানিয়েছিল, সে আমার গর্ভে আসবে। কিন্তু তৎপূর্বে আমাদের সর্পমৈথুনে যেতে হবে।
—না কক্ষনো না, আমি সর্পের পিতা হতে চাই না— সর্প শয়তান!
—কেন তুমি শয়তান নও?—স্বর্গভ্রষ্ট সব্বাই শয়তান!

বলতে বলতে ইভ সর্পভাবে আদমকে আলিঙ্গন করতে থাকে। আদমের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়।

—আর পারছি না। আমাকে পরিত্যাগ করো।
—না, আগে তুমি তোমার প্রেত লিঙ্গ উন্মোচন করো—তাহলে আমি শিথিল করব আমার
অলিঙ্গন, তুমিই তখন আলিঙ্গনরত হবে…হতে পারবে।

বাধ্য হয়ে আদম তার লিঙ্গ উন্মোচন করে এবং ইভকে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে। কিন্তু ইভের অষ্টাঙ্গ শৃঙ্খল থেকেই যায় আদমের শরীরে। সঙ্গম শেষ হলে, ইভ ঘোষণা করে: একেই সর্পমৈথুন বলে। তৎক্ষণাৎ এক দীর্ঘ সৰ্প ইভের গর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হয়েই অতিদ্রুত ঘাসের মধ্যে লুকায়—Like serpent in the grass! এবং ইভও যথারীতি Serpent in the grass হয়ে অদৃশ্য হয়। সে ক্রমে দশাননের সন্ধানে দ্বীপবর্তী হতে থাকে।

দশানন তাকে দেখামাত্র হরণ করে নিজেও Serpent in the grass হয়ে লোকচক্ষুর অন্তরালে যায়। প্রেতযোনিজাত এই দশানন জনক-জননীর জিনে, দৈত্য জিন হয়ে ইভকে এক কণ্টকাকীর্ণ কাননে লুকিয়ে রাখে। মাঝে মধ্যেই সেখানে গিয়ে ইভের কাছে সঙ্গম প্রার্থনা করে। যেহেতু উভয়ে প্রেত ও প্রেতিনী তাই দশাননের কামনা পূরণ হয়। মানুষ এভাবেই বহুকামী; যেন বা মাতা-পুত্রে, পিতা-কন্যায়, ভাই-বোনে, পুরুষে-নারীতে, পুরুষে-পুরুষে, নারীতে-নারীতে সহবাস আদিম অনায়াস অব্যাহত।

ইভ তার দশ স্তনে কামনা কাতর ছিল কিন্তু সঙ্গম কালে সর্প-স্বভাবে দশাননের ঘাড়ের উপর একটি মুখ ছাড়া বাকি মুখ খেয়ে ফেলে। মানুষ একটি মাথা ছাড়া আর একাধিক মাথা পায় না। কিন্তু ইভ এই রাক্ষস স্বভাবের পুত্রের ঔরসে আর দুই যমজ পুত্রের জন্ম দিলে, একজন লাল, অন্যজন নীল হলে উভয়কেই গিলে খেতে যায়। তারা তখন কঙ্কালী পাহাড়ে উভয়ে রাক্ষস খোক্ষস হয়ে বাড়তে থাকে। সেখানে তারা সঙ্গীনীর জন্য মরিয়া হলে, সেই কামনা কাতরতা ইভ টের পায়। তৎক্ষণাৎ একমুখী পুত্রের সঙ্গে সঙ্গমরত হয় এবং প্রেতযোনির বলে তৎক্ষণাৎ দুই সোমত্ত প্রেতিনীর জন্ম দেয়। তাদের কঙ্কালী পাহাড়ে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে অযুত রাক্ষস রাক্ষসীর জন্ম হয় ওই দুই লাল ও নীলের সঙ্গমে। এভাবে পৃথিবীতে লোক সমাগম হয়। ভাষার জন্ম হয়। কোলাহলে ভরে যায়, এ পৃথিবী। এই প্রেত পৃথিবীর প্রেত মানবকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে থাকে হেমন্তের ঝড় অবিরল পাতার মতন।

—দেখো ইভ, এই যে তুমি ও তোমার কন্যাগণ গর্ভে কেবলি সন্তান ধারণ করছ—এতে জনবৃদ্ধি ঘটে পৃথিবীতে দাঁড়াবার জায়গাও থাকবে না।
—তুমি জানো না এ পৃথিবী কত বিশাল!
—অনুমান করতে পারি। তবুও যদি স্থান সংকুলান হয় আমাদের সন্তান সন্ততির!
—তাহলে সাগরের জল পান করে তার তলদেশের স্থল ছিনিয়ে আনব।
—জানো তো, তোমার স্যাটার্ন চায় অমরত্ব। তাই প্রেতযোনি সৃষ্টি করেছে। কিন্তু ঈশ্বর মর্ত্যের অমরত্ব চান না, তাই জরার জন্ম দিয়েছেন। নশ্বর করেছেন। নশ্বরতা যেমন সত্য; মৃত্যু যেমন না চাইলেও সত্য; তেমনি এ-মর্ত্য জনশূন্যও হতে পারে—এও সত্য।
—এই যে এতকাল ধরে রাক্ষস খোক্ষস প্রেত প্রেতনীর সৃষ্টি করে গেলাম, এদের প্রতি রক্তবিন্দুতে অযুত সন্তান সন্ততি জন্মাবে।
—কিন্তু জানো, ওদের মুখ আসলে কঙ্কাল-করোটি। মানুষের মুখাবয়বের মুখোশ পরে থাকে—তদুপরি হিংস্র, প্রতিশোধপরায়ণ!
—যেমন ওদের মুখ, তেমনি ওদের মুখোশ আইডেন্টিক্যাল।
—মোটেই না, আমি মুখোশ খুলে দেখেছি, সে-ই একই কঙ্কাল-মুখ থেকে যাচ্ছে।
—ও তোমার মতিভ্রম! তাছাড়া আরো দূরবর্তী এক তৃণভূমিতে আমি অযুত সন্তান-সন্ততি পাঠিয়ে দিয়েছি, তারা স্বভাবে রাক্ষস নয়।
—কিন্তু তারা স্যাটার্ন। তারা স্যাটার্নকৃত প্রেতযোনি জাত। দেখো-গে, তারা কেমন পাথর ছুঁড়ে পশু শিকার করছে। তাদের বলি দিয়ে কাঁচা মাংস খাচ্ছে, এ কী রাক্ষস-স্বভাব নয়?
—যে জগৎ মহাহত্যাশালা, সেখানে কী করে হত্যা ছাড়া টিকে থাকবে তারা।
—দেখো-গে, পাথরের কত তীক্ষ্ণ অস্ত্র বানাচ্ছে তারা, ঠুকে ঠুকে আরেকটি পাথরের আঘাতে আঘাতে।
—পশু শিকারের জন্য তার প্রয়োজন আছে।
—কিন্তু সেই অস্ত্র ভবিষ্যতে বুমেরাং হয়ে পরস্পরকে হত্যা করবে, কেননা মাতব্বরি করা প্রেতযোনিজাত সন্তান-সন্ততির জিন বা অভ্যন্তরীণ দৈত্য স্বভাব। ক্ষমতাবান হওয়া তোমার সন্তান সন্ততির দস্তুর। কেননা তারা স্যাটার্নের দ্বারা বশীভূত—দয়া মায়া নিছক প্রলাপ মাত্র। নিছকই Struggle for existence…!
—তাই বলে কী Struggle for justice নেই?
—আছে, সঙ্গে ওই Struggle for Supremacy-ও আছে।
—তুমি আদ্যন্ত দুঃখবাদী—তাই এসব বলছ!
—তুমি তো দেখছই, ওরা কোলাহল করে, গান করে না… ওরা নাচে, শরীরে শরীর ঠেকিয়ে নাচে—ওকে বলে, তান্ত্রিক নাচের আসর…সঙ্গে গান নেই, কেবল কোলাহল আছে…মনে কী পড়ে সেদিনের কথা আজকে সখি… যখন আমরা ইডেনে থাকতাম, স্বর্গরাজ্যে? ঈশ্বর প্রথম সূর্যোদয় ঘটালেন এ পৃথিবীতে…

ঈশ্বর আহ্বান করলেন:
ঈশ্বর গাইতেন এই প্রভাতে প্রেতভীড় অতিক্রম করে:

নিভৃত প্রহরে কবির চকিত প্রাণে,/ নব পরিচয়ে বিরহব্যথা যে হানে/ বিহ্বল প্রাতে সংগীতে সৌরভে/ দূর আকাশের অরুণিম উৎসবে।

— কই গান? এ গান তো শুনি না আর!
—শুনবে কী করে! শয়তানের আওতায় আছি আমরা। শয়তান গান ভালোবাসে না। তবে মাঝে মধ্যে কবি আসবে, তারা ঈশ্বরের কৃপায় ক্ষণকালের জন্য দ্বিতীয় ঈশ্বর হয়ে শয়তান মুক্ত হবে, কিন্তু বাকি প্রেত জনতা তাদের কোনো গান হৃদয়ে নিতে পারবে না। তারা কেবল কোলাহলই করে যাবে। আর ব্যথা নিয়ে চিরতরে ঘুমিয়ে পড়বে কবি। কেউ তাকে জাগাতে যাবে না।
—তাহলে ভেবে লাভ কী!
—লাভ কিছু নেই। তবে অধিকাংশ প্রেত মানুষই এ মর্ত্যে নরক যন্ত্রণা ভোগ করবে।
—স্যাটার্ন বলেছিল নরকে এক কামনাকাতর জগৎ আছে সেখানে…
—সেখানে প্রবৃত্তি জ্বলে, সুখও দগ্ধ হয়।
—অত সব ভেবে মন খারাপ করছ কেন?
—আমি একা করছি নাকি, তোমার সেই দশানন সন্তান, যার মুখ তুমি অবলীলায় ভক্ষণ করেছ, সে দারুচিনি দ্বীপে বিষাদগ্রস্ত। সে জ্যোৎস্নায় ভূত দ্যাখে, তার হৃদয় নষ্ট শশার মতো পচনশীল হচ্ছে। তার হাহাকার আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে আছে। বজ্রপাতেই কেবল সে-ই হাহাকার এ-মর্ত্যে নেমে আসে। স্পষ্ট বুঝি, সে সংগীত-প্রসন্ন হতে চায়। অথচ সে আর দশমুখে গান গাইতে পারে না বলে, তার সপ্ত মুখের সপ্ত সুরও তার একক কণ্ঠে বাজে না—কেননা শয়তান তার সপ্ত কণ্ঠরোধ করে। কেননা শয়তানের বিশ্বাস, গান মানুষকে অবিনশ্বর করবে। মানুষ অবিনশ্বর হলে আর প্রেত-প্রেতিনী থাকবে না। শয়তানের সাম্রাজ্য যাবে।
—তুমি কি পারবে শয়তানকে উৎখাত করতে? ঈশ্বরই পারলেন না!
—আমিই পারব। পারলে মানুষই পারবে। আমি প্রেত হতে পারি, কিন্তু আমার জন্ম প্রেতযোনিতে নয়। বাকি সব প্রেতযোনিজাত। এ পৃথিবীতে কেবল আমিই একা—তাই I am He!
—আমি নই?
—তুমি শয়তানের আলিঙ্গনে ছিলে। তোমার স্তন নাভি যোনি শয়তান তার চেরা জিভ দিয়ে আস্বাদন করেছে। তোমার বাসনালোকে এখন প্রত্যক্ষ স্যাটার্ন। তুমি আদ্যন্ত প্রেতিনী। হায় তোমাকে আস্বাদ করে আমিও স্বভাবে প্রেত হয়েছি।
—তোমার ছেলে মেয়েরা তো দুনিয়া দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।
—বেড়াক!
—পৃথিবী দখলের ধান্ধায় আছে!
—তাতে কী?
—তাহলে পিঁপড়ে, পতঙ্গ, সরীসৃপ, সিংহদের কী হবে? ওরা কেবল আঙুল চুষবে? জীব সৃষ্টির সময় ঈশ্বরের বিধান কী তাই ছিল?
—রাখো তোমার ঈশ্বর! সে কী আর আছে? শয়তান তাকে বন্দি করে রেখেছে। God is dead!
—শয়তান তাহলে মরবে।
—শয়তান ক্রমে ছড়াবে দেখো, এ বিশ্বময়। শয়তানের স্বভাবই হলো ঈগল পাখির মতো। নেতা নেতা ভাব, জানো তো। Leaders are like eagles they don’t flock. You find them one at a time—শয়তানও তেমনি একা। শয়তানের বহুবিধরূপ। কিন্তু তাকে সর্বদাই একা দেখি। তোমার সন্তান সন্ততির সন্তানেরা বাসা বাঁধছে শুনি ওই শয়তানের বেড়াজালে।
—ক্ষতি কি?
—সংখ্যায় বাড়বে।
—বাড়ুক।
—পৃথিবীতে বাসস্থানের জায়গা কমে যাবে।
—কমুক।
—ভার্টিকাল বাড়ি বানাবে। হাইড্রোজেন বোমা বানাবে।
—বানাক।
—তুমি তো দেখছি আদ্যন্ত স্যাটার্ন। জানো কি তোমার সন্তান সন্ততিদের সন্তান সন্ততিরা তামা লোহা-ইস্পাত কয়লা-পেট্রোল পেয়ে গেছে।
—পাক। —Caos will come!
—তোমার কি শরীর খারাপ?
—হ্যাঁ, আদম! আমার দিন শেষ হয়ে আসছে। ঈশ্বর বলেছিলেন, তোমরা নশ্বর—তোমরা মরবে। আমার মৃত্যু আসন্ন। স্যাটার্নের প্রেয় আমার এই প্রেত-শরীরের অবসান ঘটলেও প্রেতযোনি থেকে যাবে এই মর্ত্যে।
—তুমি মরে গেলে, আমি যে একা হয়ে যাব।
—তোমারও মৃত্যু আসন্ন, আদম। তুমি যদি চাও, আমরা একত্রে মরতে পারি—এসো আমরা নিজেদের কবর নিজেরাই খনন করি।
—তার দরকার হবে না—ওই দেখো, ঘষা কাচের মতো চোখ—কৃষ্ণকায় মৃত্যু আসছে। সেই অমাদের কবর খনন করবে। এসো আমরা কবরের সন্নিকটে যাই। পৃথিবীর প্রথম মৃত্যু নিঃশব্দে হোক।

শেষ অবধি মৃত্যু নিঃশব্দে হয় না। আদম ইভের সন্নিকটস্থ সন্তান সন্ততিরা কবরের চতুষ্পার্শ্বে চলে আসে। তাদের প্রতি আদম ইভের নির্দেশ উচ্চারিত হয়।

আদম ইভের শেষ নির্দেশে, সম্পত্তি কেন্দ্রীকরণের জন্য প্রেত মানবসন্তানের মধ্যে বিবাহ প্রথা সূচিত হয়। বিবাহ—একটি রক্তের নেশা, বর-বউ যেন বাঘের মতো—এভাবেই নবদম্পতিরা খাদ্য খাদক হয়। শুভদৃষ্টির মুহূর্ত থেকে শুরু হয় বেশ্যাবৃত্তি। তাদের সন্তান-সন্ততিরা কামার্ত হয়ে প্রেতযোনিতে ভগাঙ্কুর চাটতে থাকে। নারীর মধ্যেই যে থেকে যাচ্ছে পুরুষাঙ্গ। যেমন পুরুষের মধ্যে থেকে যাচ্ছে স্তনবৃন্ত এবং অণ্ডকোষে যোনির প্রেত বন্ধন।

Scar! কেননা আদম ইভ জন্মায় একই অঙ্গে। ঈশ্বর চিরে দেন তাদের অর্ধাঙ্গ। একে অপরের অঙ্গের জন্যই তাদের বাসনালোকে ইরাটিক আকাঙ্ক্ষা জন্মায়। ভালোবাসার বদলে আসে—যৌন অভ্যাসের পুনরাবৃত্তি। যে মুহূর্তে বিবাহ প্রথা, সেই মুহূর্তে বারাঙ্গণার আবির্ভাব হয়। মানব সভ্যতা ক্রমেই শরীরী এবং সুখ-সন্ধানী। তারা জলে স্থলে মায়াজাল গাঁথে।

দুনিয়াময় খুঁজতে খুঁজতে সনাতন রূপাকে পায় দক্ষিণ-গোলার্ধের এক নদী পাড়ে। সে সময় রূপা রোদ পোহাচ্ছিল। তখন হেমন্তের হিম, শিশির শব্দের মতো মৃদু পায়ে নামছিল। রূপাকে দেখেই তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সনাতন। মুদিত চক্ষু রূপা টের পায় সনাতনের আলিঙ্গন।

—আমি তোমাকে চাই না সনাতন। কেন তুমি রূপের ছদ্মবেশে এসেছ?
—আমি তোমাকেই চাই।

সনাতনের বজ্র/সেনসুয়াস আলিঙ্গনে ধর্ষিতা রূপা ক্রমে কামার্ত হয়। বিপরীত ধর্ষণে সাড়া দেয়। রূপার প্রবৃত্তি।

ইত্যবসরে নদী থেকে উত্থিত এক অতিকায় কুমির তাদের পায়ের আঙুল খেতে থাকে। এভাবে পায়ের পাতা ক্রমে জানু খেয়েই চলে…

ওরা সুখের লাগি শরীর চায়, প্রেম মেলে না শুধু সুখ যায় চলে।
—If it be love indeed, tell me how much!
—There’s beggary in the love that can be reckon’d.
—I’ll set a bourn how for to be belov’d!
—Then must thou needs find out new heaven, new earth.


Let there be light: আলো আসে না

লালকমল ও নীলকমল দুই ভাই। প্রথম জন মানব প্রেতযোনিজাত। দ্বিতীয় জন রাক্ষসীর গর্ভে ন’মাস দশ দিন ছিল।

মৃত্যুর আগে আদম তাদের কঙ্কালী পাহাড়ে যেতে বলে। রাক্ষস রাজ্যে। লালকমলকে কানে কানে বলে, যাও রাক্ষস খোক্ষসের প্রাণ ভোমরাকে হত্যা করে এসো। নতুবা এ পৃথিবী রাক্ষসশূন্য হবে না কখনও।

নীলকমলের আগে তাই লালকমল যায়। তার হাতে প্রাণের লাল নিশান। যেতে যেতে পথে নানা দৃশ্য দেখে। দেখে, এক কন্যা অযুত সর্প প্রসব করেই তাদের খেতে থাকে। কিন্তু কিছু সর্প পালাতে পারে। দেখে, বাঘ হরিণের পিছু ধায়। সব্বাইকে ধরতে পারে না। বাঘের পিছনে অতিকায় হস্তীযূথ দ্রুত বেগে মাতাল ধায়। সব বাঘকে হস্তী খুঁড়ে বাঁধতে পারে না। কিছু বাঘ পালিয়ে যায়। চিতাবাঘ ইত্যবসরে গাছের মগডালে লুকায়।

হিংসা, হত্যালীলা থেকেই যাচ্ছে দেখে, শুনে, লালকমল বোঝে, বৃথা রাক্ষস খোক্ষসের প্রাণ ভোমরা নিধন। বরং দুই ভাই ওই প্রাণ ভোমরার স্ফটিকস্তম্ভ পাহারা দেয়। রাক্ষস থেকেই যায় এ দুনিয়ায়।




লেখা-সৌজন্য: সুহৃদ তন্ময় মণ্ডল।
প্রচ্ছদচিত্র সৌজন্য: www.pexels.com