মিথ ও বিজ্ঞান, এই দুটি শব্দকে মাঝখানে রেখে চিন্তাকে যথেচ্ছ বিচরণ করতে দিয়েছিলাম। অসংলগ্নতা এ ধরনের অনুশীলনের প্রত্যক্ষ ফল। এ কথা জেনেও মুঠো খুলে দেখতে চাইছি সেখানে কী ধরা পড়ল।

আজকের কথা জানি না, তবে কয়েক দশক আগেও স্কুলে বাংলা পড়েছে কিন্তু ‘বিজ্ঞান অভিশাপ না আশীর্বাদ’ শীর্ষক রচনা লিখতে বাধ্য হয়নি এমন ছাত্রছাত্রী পাওয়া দুষ্কর। ছাত্র-সহায়ক বইগুলোতে নমুনা থাকত। সেগুলো মুখস্থ করেই পার পেয়েছে আমার মতো কেউ কেউ, কোনোমতে পাস মার্ক তুলে তারা সেদিন ধন্য করেছিল নিজেদের পরিবারবর্গকে। আজ পিছন ফিরে ভাবলে বুঝি, সেই ছাত্র-সহায়ক বইয়ের রচনায় ছিল বিজ্ঞান বলতে আম-বাঙালি কী বোঝে তার প্রতিফলন।

আর মিথ? পৌরাণিক কাহিনির গণ্ডি থেকে ‘মিথ’ শব্দটাকে বার করে এনে বলতে চাই এই লেখায়, মিথ বলতে আমি ধরব সেইসব ধারণাকে—যা ব্যাপকভাবে সাধারণের মধ্যে প্রচলিত, যাকে আমরা গ্রহণ করি নিঃসংশয়ে, কিন্তু যেগুলোর সঙ্গে জড়ানো সত্য-অসত্যের জট নিয়ে ভাবনাচিন্তার অবকাশ রয়ে গেছে। মিথ-এর এই সংজ্ঞাটা নিবেদন করার পরই আমি কেবল আগের অনুচ্ছেদটা সমাপ্ত করতে পারব: ওই ছাত্র-সহায়ক বইতে ছিল, বিজ্ঞান সম্পর্কে সাধারণ্যে প্রচলিত একটা মিথ। বিজ্ঞান আশীর্বাদ। যেমন চিকিৎসাশাস্ত্র আমাদের বহু শারীরিক যন্ত্রণার অবসান ঘটিয়েছে, যেমন মানুষ রকেটে চেপে চাঁদে গেছে। বিজ্ঞান অভিশাপ। তা আমাদের দিয়েছে পরমাণু বোমা, দিয়েছে রাসায়নিক দূষণ।

সেই কম বয়সে প্রশ্নই ছিল না বোঝার, এখন নানা সময়ে মনে হয় স্বয়ং ‘বিজ্ঞান’ একটি মিথ, আজও। একজন পেশাদার বিজ্ঞানীর কাছে নিশ্চয় নয়, কিন্তু সাধারণভাবে যে জনগোষ্ঠীর কাছে ওই পেশাদার বিজ্ঞানীর কাজের প্রসাদ এসে পৌঁছনোর কথা, তাঁদের বড় অংশ আজও ‘বিজ্ঞান’ নামক বিষয়টিকে সম্যক ধরতে পারেননি। ‘বিজ্ঞান’ পরমাণু বোমা নয়, নয় রকেটও। আজ মনে হয়, ওই স্কুলপাঠ্য রচনার শীর্ষকটাই বাস্তব থেকে স্খলিত, একটা জোড়াতালি দেওয়া নির্মাণ। বলতে পারি আমাদের বৈচিত্র্যময় পুরাণকথার নানা দৃষ্টান্ত ধার করে ‘অভিশাপ’ বা ‘আশীর্বাদ’ দুটোই কোনো উচ্চক্ষমতাশীল ব্যক্তি চাপিয়ে দেয় তুলনায় হীন কোনো ব্যক্তির ওপর। বিজ্ঞানকে কেউ মানুষের ওপর চাপিয়ে দেয়নি।

যে গুণাবলীর জোরে মানুষ আজ মানুষ, তারই এক প্রকাশ বিজ্ঞান। বিবর্তনের ভেতর দিয়ে পাওয়া জটিল মগজের ক্রিয়া, যা তার পরিবেশের নানা ঘটনার কার্যকারণ সূত্রগুলো বার করতে পেরেছে সাফল্যের সঙ্গে। মানুষকে তার থেকে বিযুক্ত করা যাবে না কোনো মূল্যেই। বিজ্ঞান তাহলে কী—এ প্রশ্নের উত্তর সোজাসাপটা হবে, এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবির শেষের দিকে, সকলকে তফাতে রেখে বিজ্ঞানীকে ঘোষণা করতে শোনা যায়, ‘আমি একমেবাদ্বিতীয়ম‌্’। হাতে তার গজরাতে থাকা জ্বলন্ত ব্লো-টর্চ। একটা কাঁপুনি লাগে। যেন সেই বিজ্ঞানী—ধরে নেওয়া যায়, যে আসলে খোদ বিজ্ঞানেরই প্রতীকী রূপ, সে যেন সমাজ-সংস্কৃতিবিচ্যুত এক অস্তিত্ব, নিজেই নিজের কারণ ও আধার। বিজ্ঞান সম্পর্কে চালু মিথের এ আর-একটা দিক।

কিন্তু একটু থেমে ভাবলে মনে হয়, এর ভেতর সত্যের কোনো বীজই কি নেই? কাঁপুনি লেগেছিল কি এমনিই? যদি বলি, সাধারণ মানুষ বিজ্ঞানের স্বরূপটি বোঝেননি আজও, যদি বিজ্ঞান কেবল বিজ্ঞানীদের দ্বারা বিজ্ঞানীদের জন্য চর্চিত এক বিষয় হয়, যদি তার কোনো দায় না থাকে সমাজের কাছে, শুভ অশুভের প্রতি সমান নিস্পৃহ হয় সে। তাহলে, সন্তোষ দত্ত-রূপী ওই ভয়ংকর মুর্তিটাই কী কাপা-কাঁপা হয়ে ফুটে থাকে-না চলতে চলতে হঠাৎ আটকে যাওয়া টিভির দৃশ্যের মতো! বিজ্ঞানের স্বরূপ ঢেকে দিয়ে মিথটাই নিজেকে জাহির করতে থাকে না কি? অথচ এমনও নয় যে, বিজ্ঞানী ও সাধারণ মানুষ বসে আছে কোনো অসেতুসম্ভব দূরত্বে।


২.

খোদ বিজ্ঞান নিয়ে একাংশের মনে জন্ম নেওয়া মিথের কথা বলে, গোটা আলোচনার গোড়াতেই কুড়ুল বসানোর একটা অনিচ্ছাকৃত ব্যাপার ঘটানো গেল। কিন্তু আগেই বলেছি, অসংলগ্নতা এ রচনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বিজ্ঞানের বাইরে থাকা মিথকে এবার টেনে আনা যাক। বিজ্ঞানের ওপর আছে নাকি তাকে বিনাশ করার ভার। বলা হয়, মিথে-বিজ্ঞানে আছে আদায়-কাঁচকলায় সম্পর্ক। এ ব্যাপারটাকে দুটো দল দু-ভাবে দেখে। এক দল মনে করে, মিথ এক রঙিন জগৎ। তার ভেতর নানা নকশা, নানা সিঁড়ি, নানা স্তর, নানা নির্মাণ। মিথে আছে সৃজনের রোমাঞ্চ। তার বিপরীতে বিজ্ঞান যেন চোখ ধাঁধানো সাদা আলো, সমস্ত কিছুকে লেপে পুছে এক করে দেয়। আলো দেয়, সেই সঙ্গে তার তীব্রতায় অন্ধও করে দেয়।

বিজ্ঞান নাকি বেগবান করে। কিন্তু সেই সঙ্গে করে আবেগরিক্ত। রামধনুর সৌন্দর্যটুকুই মানুষের কাছে দামি, আলোক বিজ্ঞান ঘেঁটে খাড়া করা তার ব্যাখ্যা সেই সৌন্দর্যটাকে খাটো করতে চায়। যেন বিজ্ঞান হলো সুকুমার রায়ের ছড়ার সেই খুঁত ধরা বুড়ো, যে থেকে থেকে বলে ওঠে, ‘দেখছ কী, ওই রং পাকা নয় মোটে!’

অপর দল ভাবে, মিথ রঙিন হতে পারে, কিন্তু মিথ্যে। খ্রিস্টীয় বিশ্বাসে মাত্রই কয়েক হাজার বছর আগে নাকি সমস্ত সৃষ্টি, নানা জীব সমেত জন্ম নিয়েছিল। বিভিন্ন ভূতত্ববিদ থেকে শুরু করে খোদ চার্লস ডারউইন ও অন্যান্যরা সেই জগদ্দল মিথটাকে সরিয়েছেন বহু কষ্টে, তাও সে মিথ ফুঁসে ফুঁসে ওঠে। খোদ আমেরিকায় আজও দু-একটি রাজ্যের স্কুলে বাধ্যতামূলক খ্রিস্টীয় সৃষ্টিতত্ত্ব পড়াতে হয়।

এক পক্ষ বলে, মিথের সাহায্য নিয়ে একদল মানুষ অপর একদলের ওপর অত্যাচার করে, নিপীড়ন করে, শোষণ করে। বিজ্ঞানই এই শোষিতদের একমাত্র পরিত্রাতা। ধর্মের কথা ওঠে। ধর্মের চালিকা শক্তি তার মজ্জায় গেড়ে থাকা কিছু মিথ। এ সময়ে, ‘প্রধান’ ধর্মগুলির ক্ষেত্রে এ কথা সত্যি। ধর্ম মানুষে-মানুষে বিভেদ আর হানাহানি ঘটায়। তাই মিথগুলো সরাতে পারলে ধর্মের মাজা ভেঙে দেওয়া যায়। ধর্মে-বিজ্ঞানে তাই চলেছে লাঠালাঠি কাটাকাটি।

অপর পক্ষ বলে, মিথ হলো মানুষী-ক্রিয়া, জগৎ ব্যাখ্যার এক আদিম চেষ্টা। অপর মতে, বিজ্ঞানই হলো পরম মানবিক। তা মানুষের জন্য, মানুষের দ্বারা। বিজ্ঞানের চোখে সমস্ত মানুষ সমান। চোখের আবরণ সরিয়ে বিজ্ঞানই কেবল পারে প্রকৃতিকে তার স্বরূপে চিনতে।

উত্তরে প্রথম দলটি বলে, জগতের সমস্ত রহস্য উদ‌্‌ঘাটিত হয়ে যাওয়া খুব স্বাস্থ্যকর নয়, মানুষের পক্ষে। দ্বিতীয় বলে, আসলে উলটো। বিজ্ঞান রহস্য কেড়ে নেয় না, বাড়ায়। আমাদের অজ্ঞতা কতদূর সেটাও বিজ্ঞানের সম্যক অগ্রগতি ছাড়া বোঝা সম্ভব হত না।

অপর দলটি জানাতে ভোলে না। বিজ্ঞানের সহায়তায় যে-প্রযুক্তি আয়ত্ত করেছে মানুষ, তার জোরে সে নিজেকেই মনে করছে প্রকৃতির নিয়ন্তা। নিজেকে শক্তিশালী ভেবে বসা মানুষ নিজেই নিজের বিপদ ডেকে আনতে পারে। এনেছে, আনছে। মিথ কাহিনির ভেতর দিয়ে মানুষকে তার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন করে। এতদূর এসে হাতের কাছের একটা উদাহরণ: ১৬৩ বছর আগে ডারউইন সমস্ত মানুষের ভ্রাতৃত্বের কথা বলে গেছেন। অথচ ভারতে আজও জাতিভেদ প্রবল। এ দেশে ব্যাপারটা সংরক্ষণ উদ্যোগের মধ্য দিয়ে আজ মহা জটিলও হয়ে গেছে। সংরক্ষণধন্য অংশ নিজেরাই জাতি-ভেদ উচ্ছেদ প্রকল্পের বিরোধী হিসেবে কাজ করতে চাইবে। এই উদাহরণটাকেই হয়তো কাজে লাগিয়ে বলা যেতে পারে, সাধারণভাবে মিথগুলোকে অগ্রাহ্য করার জন্য। বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহের একটা উপায় হিসেবে বিজ্ঞানের তুলনা নেই, কিন্তু তাকে, মিথকেও, কে কতদূর কীভাবে ব্যবহার করবে—তা নির্ধারণ করে দেয় সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতি। তার চলনকে আজও বিজ্ঞান কোনো সূত্রবদ্ধ করতে পারেনি।


৩.

এ গেল গড় মিথ ও সেই মিথের বাইরের বাসিন্দা বিজ্ঞানের সম্পর্ক। কিন্তু খোদ বিজ্ঞানের মধ্যেই যে কিছু মিথ রয়ে গেছে। এর সবগুলি কেবল হাটুরে লোকেদের মিথ নয়, বিজ্ঞানে দীক্ষিত বহু মানুষ এমন অনেক কিছু বলেন, বিশ্বাস করেন, যা ঠিক ‘ঠিক’ নয়, অন্তত প্রশ্নাতীত নয়। এ ধরনের কয়েকটা বহুল প্রচারিত মিথ:

জগদীশচন্দ্র বসু আবিষ্কার করেছিলেন গাছের প্রাণ আছে।

নিউটন মাধ্যাকর্ষণ আবিষ্কার করেছিলেন। নিউটনের মাথায় আপেল পড়তেই তিনি মাধ্যাকর্ষণের ব্যাপারটা বুঝতে পারেন।

গ্যালিলিও বিরাট জনতার সামনে পিসার হেলানো মিনার থেকে দুটো ভিন্ন ওজনের বল ফেলে প্রমাণ করেন, অ্যারিস্ততলের কথা (ভারী বস্তু আগে মাটিতে পড়ে) ভুল।

গালাপাগোস দ্বীপে পৌছে ফিঞ্চ পাখিদের দেখে, ডারউইন প্রথম তার বিবর্তন তত্ত্বটির আঁচ পান। মানুষের মস্তিষ্কের বড় অংশ অব্যবহৃত থাকে।

এক কোষী প্রাণী থেকে মাছ-ব্যাং-বাঁদর-গেরিলা-শিম্পাজি-মানুষ।—এই হলো বির্বতনের ক্রম।

চাঁদের একটা পিঠ সবসময় অন্ধকার থাকে।…

এর কয়েকটি বিজ্ঞানের ইতিহাস সম্পর্কিত, মূলত ব্যক্তি-কেন্দ্রিক। কয়েকটা সংশ্লিষ্ট বিষয়ের দিকে আলগা নজর দেবার পরিণতি। গাছের প্রাণ আছে এটা জগদীশচন্দ্রের জন্মের দুশো বছরেরও বেশি আগে প্রমাণিত। চাঁদের সবখানেই আলো পড়ে, কেবল পৃথিবী থেকে তার একটা পিঠই আমরা দেখতে পাই। গ্যালিলিও পিসার হেলানো মিনার থেকে ওরকম কোনো পরীক্ষা করেছিলেন এমন কোনো প্রমাণ নেই। আরও বড় কথা, ওই সমস্যাটা গ্যালিলিওর আগেই কয়েকজন সমাধান করেছিলেন, তার লিখিত প্রমাণ আছে। ডারউইন গালাপাগোসে ফিঞ্চ পাখিগুলোর প্রজাতি চিনতে পারেননি। তার আনা পাখির দেহগুলো পরীক্ষা করে পরে সেগুলোকে আলাদা করে দেন পক্ষী বিজ্ঞানী জন গুল্ড।

নিউটনের মাথায় আপেল পড়ার বিষয়টি ধোঁয়াটে। নিউটন নিজে তা লিখে যাননি। অথচ এ ঘটনার উল্লেখ করে গেছেন এমন মানুষের মধ্যে আছেন এমনকি ভলতেয়ার। সেই নিউটনের আমল থেকে এই ঘটনা সম্পর্কে যতগুলো লিখিত বয়ান আছে, সেগুলোতে পাওয়া যাচ্ছে:

কথাটা নিউটনই বলেন, তাঁর এক নিকটজনকে।

নিউটন বাগানে বসে থাকার সময় গাছ থেকে একটা আপেলকে পড়তে দেখেছিলেন।

নিউটনের পায়ের কাছেই এসে পড়েছিল আপেলটা।

আপেলটা পড়ে নিউটনের নাকের উপর।

আপেলটা পড়ে তার মাথার ওপর।

নিউটন এ কথাটা বলেছিলেন, একটা বোকার সামনে তাঁর তত্ত্বটাকে তাৎক্ষণিক ভাবে বোঝাতে গিয়ে। ব্যাপারটা বানানো।

নিউটন যে অন্য কিছু ব্যাপারও বানিয়ে বলেছেন, তা প্রমাণিত।

একটা কথা খোলসা করা দরকার, এ মিথগুলো প্রাকৃতিক কার্যকারণ খোঁজা ব্যাপারের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। বিজ্ঞানের ইতিহাসের সঙ্গে, দু-একটা ক্ষেত্রে সঠিক প্রেক্ষিতটা বোঝার ভুলের সঙ্গে এসবের সম্পর্ক পাওয়া যাবে। তাহলেও, বিজ্ঞান, যা মিথের মুখোশ টেনে খোলে, তার ভেতরে থাকা এই মিথগুলো জন্মাল কী করে? উত্তরটা সোজা, কিন্তু একটু ভাবলেই ধরা পড়ে প্রক্রিয়াটা বেশ জটিল।

মানুষ ধোঁয়াশা পছন্দ করে না। কোনো কাহিনির অসম্পূর্ণতাটুকু আমরা পূরণ করে দিই ওই পরিপ্রেক্ষিতে যা সম্ভাব্য বলে মনে করি তাই দিয়ে।

মানুষ বীর-পূজা পছন্দ করে। একজন বিজ্ঞানী সমবেত বিরোধীপক্ষের সমস্ত আস্ফালনের একটা সমুচিত জবাব দিচ্ছেন, একটা ছোট্ট, সকলের কাছে বোধ্য পরীক্ষার মাধ্যমে—এমন নাটকীয়তাকে আমরা লালন করতে ভালোবাসি। একটা সামান্য ঘটনায় বিরাট এক সত্যের প্রতিফলন—আপেল পড়া থেকে মাধ্যাকর্ষণ, পাখির ঠোঁটের গড়ন থেকে গোটা পৃথিবীর জীবজগতের বিবর্তনকে বুঝে ফেলার ভেতরে যে রোমাঞ্চ—এই রোমাঞ্চ খুব আদরণীয় আমাদের কাছে।

এর সঙ্গে যোগ হবে আরও একটা কথা, কোনো বিষয় পুনরাবৃত্তির সময় আমরা অজান্তেই তাকে কিছু পরিমাণে বদলে দিই। যেটা পুঞ্জীভূত হতে থাকে, দিনে দিনে, শতাব্দ পেরিয়ে আর-এক শতাব্দে তা একটি কঠিন, প্রায় প্রশ্নাতীত চেহারা পায়। মানব-পরিধির প্রতিটি বিন্দুতে এমন ভাবে জন্ম নেওয়া মিথের ছড়াছড়ি। প্রতিদিন তা জন্মাচ্ছে। অজস্র মিডিয়ায় প্রতিদিন যত কিছু প্রতিধ্বনিত হচ্ছে তার ভেতরে যদি সংশয়ের বাষ্পটুকু না থাকে, না থাকে কোনো প্রশ্ন, তবে বলা চলে আমরা বাস করছি মিথ-কারখানার ভেতরে। আমরা তার কর্মী, তার উপভোক্তা। প্রশ্নহীন হলেই আপনি হবেন মিথ-আক্রান্ত।

বিজ্ঞান মিথ সংহারক, বিজ্ঞান মিথ-ধারক। বিজ্ঞান নিজে মিথ। এই শেষ প্রস্তাবনাটা কিন্তু এক শ্রেণির সমাজবিজ্ঞানীর কাছে খুব লোভনীয়। তাঁরা সেটাই বলে এসেছেন, গত শতাব্দীর গোড়ার অংশ থেকে। তাঁদেব মতে, গড়পড়তা মিথের মতো বিজ্ঞান জগৎ ব্যাখ্যার আর একটা উপায় মাত্র। সে নিজেকে কুলীন ভাবে, কিন্তু আসলে মিথের সঙ্গে এক পঙ‌্‌ক্তিতে বসে আহার করতে সে বাধ্য।

বিজ্ঞান নিজেকে কুলীন ভাবে না। কিন্তু মিথের সঙ্গে এক পঙ‌্‌ক্তিতে বসার যোগ্যতাও তার নেই। বিজ্ঞান সেখানেই মিথ হয়ে উঠেছে, যেখানে সে জনতা থেকে বিচ্ছিন্ন। জনতার চোখ রকেটে আর পরমাণু বোমায় আটকে যায়। বিজ্ঞানকে তারাই মিথ করে তোলে। কর্মস্থলমুখী যাত্রী-বোঝাই ট্রেনের ভিড়ে ঘাড়-ভাঙা বক হয়ে দাঁড়িয়ে বা রাস্তার ধারের চায়ের দোকানে শুনি,—’রাখ তোদের সায়েন্স, আজ অবধি ক্যানসারের একটা ওষুধ বার করতে পারল না, আবার সায়েন্স!’ কার উদ্দেশে বলা তা জানি না, কিন্তু ‘তোদের’ কথাটাই অনেকক্ষণ কানে বাজতে থাকে।




প্রচ্ছদচিত্র সৌজন্য: www.pixabay.com