ইস্কুলের ভাঙা টাট্টিতে বসে কুঁথে কুঁথে জমসেদের আঁত-নাড়ি উলটে আসতে চায় তেও মগর হাগুর হদিস নেই। মেলা হুজ্জোতের পর মুরগির চুনা ন্যাদা-তুল্য সামান্য একফোঁটা বিজল আসে, তারপর কয় ফোঁটা লালচে বুটের দানা, ছিট-ছিট সাদা ফেনা সমেত আর কী মজার তেলেসমাতি সঙ্গে সঙ্গে পেটের উথালপাতালও কমে যায়। এখন আর বাঁধ ভাঙার বেশুমার চাপ নেই। পায়ের নখ থেকে একটা আরাম গরম গরম চায়ের আয়েশে থুড়াথুড়ি ডেউয়ের দোলে উপর দিকে উঠে জমসেদের মাথাটা পাতলা করে দেয়। চোখের টাটানি কমে কপাল, গলার নীচ, ঘাড়-গর্ধনা, বুক আর বগলতলি চপচপা ঘামে ভিজে ওঠে। জমসেদ পানি খরচ করে দাঁড়ালে, মাথাটা ভার-শূন্যতায় ঝিমঝিমায়। দুই হাঁটুর মালাইচাকি সার শক্তিহীন। চোখের সামনে উড়ে যায় কয় সারি জোনাক। কপালের শিরা দুটো ফোলে ফোলে ফাল পাড়ে। খোলা পেন্ট হাঁটুর কাছে ধরে জমসেদ অপেক্ষা করে, ফের যদি পেট কামড়ানি শুরু হয়।

এই সময় স্কুলের ময়দানে রে…রে রব ওঠে। বৈকাল টাইম। এখন জাল ভোটের ধুম পড়েছে। মরারে কবর থেকে তুলে নিয়ে, বউ নাই বেটার বিবি হয়ে, পরবাসী ভাইয়ের রুহানী কবজ নিয়ে সিল মারার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে মানুষগুলো কিলবিল করে, শিং মাছের মতো এ-ওরে যালা মারে আর পোড়া বিষ্যের তড়পানিতে ফোঁস করে ওঠে। এক অদৃশ্য আক্রোশ ভোটের লাইনগুলো গন্ধকের ঝাঁঝে চড়-চড় করে…। একটা উছিলা, একটু তারতম্যের উনিশ বিশে সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে দেবার ভয়ংকর এক নেশায় আজ তারা খুব মেতেছে।

জমসেদের শরীরের পরতে পরতে জ্বর আর বিষ বেদনা টিপটিপ পাওয়ে হাঁটে, তার সঙ্গে ঘুরে-ফিরে হাততালি দেয় আজীবন হেরে যাওয়ার কষ্ট-অপমান। সে-ও এক আজগুবি বন্যতায় ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে ওঠে।

এই সংসারে এমন কোন মানুষ আছে, যে-তরে মানুষ কইয়া গণ্য করে? হাঁ-রে…, মানুষ তো মানুষ। নিজের বউতক তারে কুত্তা-বিলাইয়ের মতো ঘেন্না করে, তার চোখে ঝিলিক দেয় সেইসব আস্পর্ধার তাতানো বুলি, দাঁতের ফাঁকে অগৈন্যের ছুরি চিকচিক করে ঝলকায়, পারে না শুধু তার মুখে এক দলা থুথু দিয়ে কইতে, ওলো আমার লাং আমি অহন তোমারে চাই না, তোমার লেগে এক বিছনাত্‌…। বাল-বাচ্চা হয়ে মাগী অহন ভজ-ভজা গাই কওছা দ্যাহি হেরে ক্যাডা ফের নিকা কত্তে আইয়ে; এই-ডাই হইল আসল বেউয্যা।

সে সদরের আনসার ভিডিপির দলে যোগ দিয়েছিল এই ভরসায়—দুই খান বাড়তি পৈসা কামাইয়ের সঙ্গে মাইনশ্যেও মানুষ কইয়া কিছুটা মান দিবঅ। আনসার দলের কথা শুনে বউ মেলা বকে যায়, সেই সন্ধ্যার পীতবর্ণ আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে গেঁয়ো-গুমুখ্‌খ বউটা তার শুধু জ্বর তাপের প্যাঁচালই পাড়েনি জমসেদকে আউলে রেখে বার দুই চোখও মুছল। এই এক আজব মানুষ, তার হাড়হদ্দ এক ছিটাও চিনল না। এই দ্যাখে এই নাই বেত গড়ে গাই নাই। খানিকবাদেই ফোঁসে ওঠে, এ্যাহঃ তাইনের হাউস হইছে পুলিশ হইবেন, নোকে সম্মান করবেন, ইজ্জত দিবেন, তাইনের মরদ কইয়া মাইনশ্যে ছেলাম ফালবেন—ট্যাহার কথা কইন্ন্যা ক্যানে…মানুষটা ট্যাহার আলাপ জোড়ে না ক্যা—বেতন কত…হেহ্‌; বেতন… আসলখানে গডর মডর, রে-আমার ভাতার, পুটকিত্‌ নাই চাম বাঁধা-কেষ্টর নাম।

আনসার কমান্ডার মোটা গলায় ডাকে, ঊনচল্লিশ নম্বর—মোহাম্মদ জমসেদ আলী, পিতা মৃত মোহাম্মদ আরশদ আলী, গ্রাম-ইনাত গন্তরহ, থানা-ধনবাড়ি। বাঁশের লগির মতো লিকলিকে খড়ি ওঠা গতর, লম্বিত সুঁচালু দাড়ি, ছেঁড়া-ময়লা তহবন-পাঞ্জাবি খড়খড়া খালি পায়ে একজন মানুষ, বয়স তিরিশ-তিপান্ন আন্দাজ করা মুশকিল। উঁচুতে লুঙ্গি পড়া, সে জন্য পিছন থেকে পাওয়ের থোরের মোটা রগ গিট খেয়ে জিঞ্জিরের মতো উপরে উঠে গেছে তা স্পষ্ট দেখা যায়। ল্যাকল্যাক করে থপ্‌থপ পাওয়ে কমান্ডারের সামনে এসে দাঁড়িয়ে একটা সেলুট দেয়। শরীরটা ভাঙা ডিঙির আদলে বার কয় ঝাঁকি খেয়ে স্থির হয়। জমসেদের চোখ জোড়া কমান্ডারের খাটো করে ছাঁটা কালো চিকচিকে চুলের ডগায়, যা কি-না কপাল। জোরে হাওয়ায় হওয়ায় কদম ফুলের রেণু। সারা মুখে চর্বির পাতলা পলেস্তরা, খুরকাম করা বদনের গোলাপি আভাটা বিহানের কাঁচা রোদে ঝিমমিক করে। থুতনির নীচে গোশতের ছোট্ট একটা ভাঁজ বড়ো সুন্দর গড়ন নিয়ে বসে আছে। কাঁধের উপরে রূপালি তারা বসানো সোল্ডার, পাটকরা কলারখানা ঘাড় ঘুরে হাসছে। কড়া ইস্তারি করা খাকি জামার উপর ঝকঝকে কালো চামড়ার মোটা বেল্ট টাইট হয়ে বসে সামান্য ভুঁড়ির খবর কইছে—তার সঙ্গে কোমরের মসৃণ মোহনীয় খাপে বসে পিস্তলটার বাটটা বুঝি জমসেদকে ভেটকি মারে। তার চোখ পেন্টের ইস্তারি করা ভাঁজ ছোঁয়ে নীচে নামতে নামতে কালো বুটের ডগায় এসে চমক খায়—জুতা-জোড়া এত চকচকে পিচ্ছিল যেন বা তার দাড়ি-মুখের ছাওয়াও কসকে যাবে!

কমান্ডরের ঠোঁটে একটা তীক্ষ্ণ তড়ত্‌ড়ে‌ হাসি ফোটে। হাতের ইশারায় সামানের দিকে নির্দেশ করে। বলে, ইউনিফর্ম জুতা, রাইফেল তুলে নিবার জন্য। ঠোট উলটা, নাক ভাঙা গোড়ালি ফাটা ছাতলা পড়া কুঁচকানো বুট—বুক পকেটের ঢাকানা ছিঁড়া, বগল ফাটা, কুত্তার জিবের মতো ঝুলে পড়া সোল্ডারের শার্ট আর ফ্যাসকা সবুজের টুপি, বেল্টের অভাবে দড়ি বাঁধা শতেক বছরের বুড্‌ঢা মরচা পড়া একটা রাইফেল। এই নিয়ে জমসেদ হাঁফিয়ে ওঠে।

জিনিসগুলো তার গতরে চুত্‌রার জ্বলুনি ধরায়। এই জগতের মানুষত্‌-মানুষ পাঁচ বছরের মুতের পোলাও তারে পুছবো না। সারাটা জিন্দিগি—হায়, সরাটা জিন্দিগি গেল রে…, ছ্যেঁ ছ্যেঁ… তিরস্কার আর হেলায়ফেলায়।

আনসার ক্যাম্পের শতেক হাত লম্বা দালানের এক কোণায় বসে জমসেদ ঝিমায়, ষাট ওয়াটের একটা বাত্তি মাঝঘরে খাটাশের চোখের মতো পিটপিট করে। পেটের অলিতে-গলিতে ভুক্‌ বড়ো বেসবুর হয়ে কড়কড় ডাক তুলে দৌড়ে। কাছারি বাড়ির সামনে থেকে সবাই খেয়ে আসছে। জমসেদের মনে হয় রাতে আর সরকারি গুড়–চিড়া মিলবে না। সাহস করে সে কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা করতেও পারছে না। নিরাকার সন্দেহটা আশার লছমি বাতিটাকে এক ফুঁতে নিবিয়ে দেয়; উত্তরের কোণা থেকে কে একজন চিবিয়ে চিবিয়ে বকছে, হালা কামান্ডার খোরাকির ট্যাহায় হের মাগীরে রসবতী বানাইব। পাশের জনের গলা আরও এক কাঠি চড়ে, সাব-সুবেদার অইলে সব ব্যাডা হালাই মাগীর পুটকিত্‌ মুখ ঘষে।

জমসেদ রাইফেল খেতা একজনের জিম্মায় থুয়ে কাছারি বরাবর হাঁটে। শীতটা যেন কষে আসছে, কী জানি সে ভুল করল কিনা, মাত্র একখান খেতা সম্বল করে ঘরের বাইরে পাও রাখা তার কী ঠিক হলো? জমসেদ মনে মনে হাসে, আসলে তার জিন্দিগিতে ঠিক-বেঠিক সবটাই সমান কথা। তিনজন মানুষ, চারখানা খেতা, দুইখানা বালিশ, একখানা লক্কর-ঝক্কর চৌকি; বিছনাত্ উঠতে না-উঠতেই কেত্‌-কুত, মট্‌-মট কত জাতের শব্দ ওঠে…, এই বুঝি হালার–হালা মড়মড়াইয়া ভাইঙ্গা পড়ে। ছেলেটা ডাঙ্গর হউন ধরছে, তবু একখানা বালিশ বানানো হইল না। বউ খেড় বোন্দা পাকায়া ছেঁড়া লুঙ্গি পেঁচিয়ে চালিয়ে যাচ্ছে। বউয়ের পরনের কাপড় ছিঁড়তে ছিঁড়তে ত্যানা হয়, খেতা বানাইত্‌ কী বাল্‌ডা দ্যায়া। আর এই এক মাসের জন্য সে বেরিয়ে এল—ঘরে-তো থুইয়া আসেনি এক ছটাক চাউল, ওরাই বা কী খেয়ে বাঁচে?

ছনের ছাউনি আর হুগলার বেড়ার হোটেলে বসে জমসেদ ডাল-ভাতের হুকুম দেয়। টিনের গ্লাসে জল নিয়ে কুলকুচা করে, চোখে মুখে ঝাপটা দেয়, ফের ভেজা আঙুলে চুল-দাড়ি খিলাল করে খাবারের রুচিটা শানায়। একটা পিচ্চি থালা ভর্তি মোটা লালচে ভাত রেখে যায়। চড়চড়া গরম ভাতের বুক ফুঁউড়ে পাকিয়ে উঠছে ধূঁয়া। মিঠামিঠা ভাপের তাওয়ায় জমসেদ তার জীবনটার টুকটাক এক নজরে দেখে নেয়।

এক রুক্ষ-নির্দয় অভাবী খেতমজুরের পয়লা পোলা হিসাবে তার নাভির নাড় শুকাবার আগেই তাকে বাপের পিছে ছুটতে হয়—তারপর চড়-থাপ্পড়, কিল, গুঁতায়-গুঁতায় নিরীহ নরম মুখটা একদিন দাড়ি-মুচ সমেত লম্বাটে নির্বুধ আকৃতি পেয়ে যায়। জন্মসূত্রে পাওয়া ক্ষুধা আর খাবারের লোভের সঙ্গে একদিন সে আবিষ্কার করে শরীরের একটি গোপন খিদেও দিনে দিনে ক্ষুরধার হয়ে উঠছে। সেই থেকে খাবারের অনটনের সঙ্গে নারীর অভাবটাও তাকে তিলেতিলে পুড়িয়েছে—আর যত ছিছি কুড়িয়েছে সবই তার হৃদয়ে মণি-মুক্তার মতো রয়েছে মজুত।

ডালের বাটি আসতেই জমসেদ পাতে ঢেলে লবণ দিয়ে চটকাতে থাকে। মুখের ভেতরটা জেগে ওঠে ঘন লালার কলকলানিতে। বাঁ-হাতটা চোখের পলকে চলে যায় বাটি-ভর্তি কাঁচা মরিচের দিকে আর আন্ধাদিশায় তুলেও আনে একটা ডাগর-ডাসা তেজী লঙ্কা। লোকমা পাকিয়ে মুখে দেবার সময় কানে আসে, ’বাজান আমি খাইয়াম’। জমসেদ হকচকিয়ে ওঠে, তার হাত রুখে যায় আর চমকখাওয়া চোখ চর্তুদিকে তালাশ করে—একটা ক্ষুধার্ত বালকের করুণ মুখ, ময়লাভরা গালে চোখের পানি গড়িয়ে পড়ার দাগ। বুকটা তার হুহু করে ওঠে। অন্তরের হাহাকার আলগোছে ওঠে, এসে গলায় মনু গাঙের বাঁধ হয়ে দাঁড়ায়, আর-কী নীচে নামে ভাতের দলা?

জমসেদ হাঁ-করে তাকিয়ে থাকে—কাউন্টারে বসে তরমুজ-তাজা মালিকটা আঙুল ঠুকে তাল বাজিয়ে মনের খুশি ছড়িয়ে দিচ্ছে। আজ বিক্রিবাট্টা বেশ লক্ষ্মী চুয়াঁ। ক্ষুধার্ত খাদকেরা মাথা নোয়ে…, বয়-বেয়ারারা ভাত-তরকারির বাটি হাতে আসা যাওয়ায় ব্যস্ত, কে-একজন এক্সট্রা ডাইল…ডাইল বলে হাঁউক দিয়ে তার ইংরেজি জ্ঞানের ফুটানি ঝাড়ে। বাইরে ইতিউতি খানকয় বাল্ব লোডশেডিংয়ের বাবদে দড়কচামারা অন্ধকারে ঝিমায়।

ক্যাম্পের সারা ঘরে ছোটো-বড়ো গাট্টি-বোঁচকা, তেলচিট-চিটে খেতা বালিশ, লোটা-বদনা, থালি-গ্লাস আর শুকনা-পটকা গতরের মরদ-পোলা–আধাবুড়া মানুষের কাশি, বিড়ির লাল চোখ, ডাল-ভাত, ডিউটি-রাইফেল, হররোজ তিরিশ ট্যাহা, বউ-পোলা ইত্যাদি। বাকবন্ধের মধ্যে বিজলির মতো কিছু ট্যাঁড়া-বাঁকা কথা হলকে ওঠে। সব রসুনের এক পুট্‌কি; কামান্ডারের উফ্‌রে টিএনও হের উফ্‌রে আরেকজন, তার উফ্‌রে, আরঅ উফ্‌রে…উফ্‌রে উফ্‌রে ছাঁটতে ছাঁটতে আমগর কাছে আইয়া খাড়াইছে তিরিশে। কওছা দ্যাহি অত চিপলে লেম্বুর কিছু থাহে। মানুষটার খেদ গলায় ঘুরতে ঘুরতে একসময় আগুনের মতো হাউৎ করে জ্বলে ওঠে, নডির পুতাইন…! এই নডির পুতাইনরেই সেলাম দিতে দিতে কফালে কড় ফালাইয়া দিলাম, ত্যাও খানকির পুতাইনের পেট ভরে না। ঘরের কবকবানি এট্টুক ক্ষণের জন্য থেমে গিয়ে ফের জমে ওঠে। মানুষটা বোঝি দম লয় আর এই ফাঁকে কেউ কেউ হয়তো তাদের বুকের দাগদগে ঘায়ে বারকয় হাত বুলায়। একজন হাঁটুতে থুঁতনি গুঁজে ধড়ফড়ায়, হালার জীবনডাই মইধ্যে থাইক্যা ফাউ খরচা গেল। বদরাগী কেউ একজন খেড়েখেড়ে গলায় ঝলসে ওঠে, হালার পুতাইন যহন সামনে দ্যায়া যায় তহন মনডা কয় গুলি মাইরা দেই। সেই—লোকটা, ঘেন্নায় চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে চেঁচায়, আরে-ছেঃ কয়ডারে মারবা বাজান!

উত্তরের কোণায় একজন তার সঙ্গী-সহবত নিয়ে ঝোলে ঝালে জমিয়ে তোলে, পাঁচজনে করছি বুঝলা, পাঁচটা মদ্দ গুঁতাইয়াও মাগীর কিড়া মজাইতারি না, ভাইরে-ভাই আমারে কি কয় জানচ্ছ, কয়;—কের ব্যাডা, অইলা অহনই, উইঠ্যা যাও? খুশির গমগমা গলাটা থেমে যায়, চোখ বোজে, হয়তো সেই কামার্ত নারীর শরীরের স্বাদ ফের সে শিথিল করে তুলছে।

বয়স্করা খেতা টেনে-টোনে সই-সিধা করে বিছায়, বালিশে ঘাড় ফেলে মোচড়ায়, হয়তো বা দিলে বাল-বাচ্চার কায়া, না-হয় কোনো জটিল সমস্যা এক ঝলক খেলে গেল। হয়তো বা ঘরের অভাব, তার দাঁতলা মুখ্‌খানা এই ফাঁকে একবার উঁকি দিয়ে গেল। একজন পস্তায়, বোঝচ্ছস্‌—আমার একখান মাত্র খেত; বাইদের এই একছটাক জমিনটারে চাইরকুলা দ্যায়া চাটতে চাটতে গিইল্যা লাইল। এইবারঅ দ্যাখছি খেতের বাতরটারে চাইর আঙ্গুল কাইট্টালাইছে। আমিও মাইপ্যা আট আঙ্গুল কাডাম, শুওরের বাচ্চায় যুদিন সামনে আইয়া ক্যাড়ানি দ্যাহায় তে—, আল্লা যা রাখছে কপালে, মস্তক বরাবর কোদাল দ্যায়া একটা কোপ খেছাম। সর্ব দুঃখেও হাসতে পারে এমন এক তরুণ কামুক গলায় ফিসফিস করে, দুছ্‌;—যাই কও আমারে, আমি অহন থাইক্যা এমুন কচলামি কচলাইয়াম যে—মাগীর বুনি দুইড্যা লাউয়ের মতো লইছক্যা যায়; শরিলডা লইয়া সুন্দরীর বড়ো দ্যামাগ।

হরেক কথার ঢেউ জমসেদের মগজে ঘাই দিয়ে সরে যায়। কতকগুলো খাপছাড়া মানুষের বিচিত্র সব দুঃখবেদনা, হাউস তাকে তিলেকে তিলেকে খুঁচিয়ে যায়; আধবোজা চোখে এই ঘরটাকে তার মনে হয় একটা আদ্দিকালের জাহাজ, পাড়হীন সময়ের বুকে-খাবিখাওয়া-তার সওয়ারিরা, যাদের হাউস খায়েশ, ভাববচন ত্রি-সংসারের সঙ্গে অযৌক্তিক।

জমসেদের ভোটের ডিউটি ছিল গোলাপগঞ্জের বাঘিরঘাটে। সন্ধ্যায় কপালে জোটে ডাল-ভাত। এরে বুঝি খাওন কয়—এক থালি ভাত তার লগে মুতের লাহান পাতলা ডাইল ত্যাও হালার বিল ডাহে সাত ট্যাহা। সামান্য কয়ডা দানা পেটে পড়ে, কাবজাব করে আরও বেশি। জমসেদের বউ বেশি খাওনের লাইগ্যা গাইল পাড়ে, কিন্তুক কওছা দ্যাহি; ভাতে মরদ, ঘাসে বলদ, না-খায়া উপায় কী। মাগীগরত আর পৈসা কামাই করোন লাগে না—ঠ্যাং ফাঁক কইরাই খালাস। ঘিন্না ধরে গেছে তার মাইয়া-মাগীগর উপর। বিলাইয়ের লাহান হ্যারা খালি দুধের হাত-পাত চাটে। ভোটের দিনগুলোতে সকাল থেকে রাতত্‌ক‌ কত মানুষ, কত তরতাজা বউ-বেটি সেন্টারে ভোট দিতে এসেছে কিন্তুক কই কেউ কী তার দিকে একবার চোখ তোলে তাকিয়েছে। একজন নজর-কাড়া পুরুষ, কী একজন খাসা-নারী যখন সে দেখেছে তার ইচ্ছা করেছে মাটির মধ্যে সেঁধিয়ে যায়। কুত্তার জিবের মতন ইউনিফর্মের ছেঁড়া সোল্ডার ঝুলে থাকা মানুষকে কেউ মরদ কয় না, পুরুষ বলে গৈন্য করে না।

রাত হলে ইস্কুল-কলেজের ভেতর খেড়-বনের বিছানায় ছেঁড়া খেতাখানা নিয়ে জমসেদ হি হি করে। পা দুইখান ঠান্ডা পাথর, সারারাতের মধ্যে যদি একটুকু গরম হতো। হাঁটুদুটি বুকের সঙ্গে চেপে সে প্রাণপণে একটু ওম খোঁজে। গাছ থেকে হিম টপটপ করে টিনের চালে পড়ে আর দূরের গাঁও থেকে ভেসে আসা কুকুরের দীর্ঘ বিলাপের সঙ্গে শীত শিরায় শিরায় সুই ঢুকায়। পুলিশেরা রাতে সরকারি গুড়-চিড়ার চৌদ্দ আনাই খেয়ে হোল্ডারে বাঁধা বিছানায় ডাঁট মতো ঘুম দিয়েছে, হালাগর নাকের ঘেঁৎ ঘেঁৎ ডাক যেন চান সদাগরের সপ্তডিঙার দাঁড়ের টান আর জমসেদ কুকুরকুণ্ডলী দিয়ে সারাটা রাত শীতের লগে যুদ্ধ করে।

পুলিশের খাওয়ার পর ওদের কপালে গুড়-চিড়ার যে ভাগটা জোটে তাতে তেল চুড়ার ল্যাদা, ভাঙা ঠ্যাং আর কৈন-কুড়াই বেশি। খিদের মুখে ব্যাজার মনে সেই খাবার খেয়েই তো জমসেদ বিহান থেকে হাগার জুলমতে পড়ে।

এখন জমসেদ রাইফেল কাঁধে বড়োই উদাস। ভোটাররা লাইনে কাওলা-কাওলি করে। কেন্দ্ৰকর্তা তাকে বিমনা দেখে ধমকায় আর পুলিশের হাবিলদারও ভোটারদের সামনেই বাপ তোলে জবান খারাপ করে। সে শরমে মরে যায়। লোক ঠেকানো কামে ফের মন দেয় কিন্তুক খাবিখাওয়া প্রাণ রোষ-ঘেন্নায় সাবালক হয়ে মরদের বুকে তাও দেয়। বুড়া রাইফেলটার গতর-গলা হাতরে তাপ-তেজ পরখ করে। এই মরা কাঠ লোহার পেটে বারুদ ভর্তি এক টুকরা গুলি ভরে ট্রিগার নামের কলকাঠিটা নলে চিৎকার দিয়ে জগৎ কাঁপায়, গলা থেকে ধোঁয়া উগরে দিয়ে মর্দামির নজির রাখে। জমসেদ তার বুকে হাত দিয়ে ঠাহর করে কোনো ডহরে টিপ্‌ টিপ্‌ জেকের চলছে, কোনো আথাইলের ভেতর থেকে জিন্দা লহু তোলপাড় তোলে। সে-ও কী এই বুড়া রাইফেলটার মতোই যুগ-যুগের জঙ্গার বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে আছে, তার মধ্যে কী কোনো বারুদ নেই? রাতে জমসেদ খেতার ভিত্‌রে যতই কুঁকড়ায়া যায় শীত ততই খাবলায়া ধরে। টিনের বেড়ার ফাঁক দিয়ে দারুণ বাতাস করুণ দীর্ঘশ্বাসে ছড়িয়ে পড়ে। সেই হিরহিরা হিম-বাতাসের মুখে পড়ে জমসেদ কাঁপতে কাঁপতে একটা গরম খেতার খোয়াব দেখে দেখে বেফানা হয়।

সকালে একটা কষা পেশাব হয়। মুতের শেষটা বড়ো বেশি লাল আর ঘন, তার সঙ্গে কিছু পাতলা গু লুঙ্গিতে পড়তে পড়তে ও রক্ষা পায়। লুঙ্গিটা টান দ্যায়া সরাতে সরাতেই বড়ো আকারের একটা ঢল নামে। বৈশাখী ডাকের সঙ্গে আষাঢ়-মায়া কলকল ধারা। জমসেদ বড়ো চিন্তায় পড়ে, মানুষের মৌতের আগে নাড় খালাসের মতো ছাবা-ছাবা গু-পানি আলগা আলগা হয়ে ছুটে। পয়লাই মনে পড়ে তার পোলাটার কথা, চোখে ভাসে হাড়গিলা শরীরের শুখা-চোট্টু মুখটা সঙ্গে সেই আবদার, বাজান আমি খাইয়াম।

খাওন খাওন কইরা পোলাটা আদানে-কুদানে কত যে মাইর খাইল। একদিন সকালে ঘুম থাইক্যা উইঠ্যাই প্যানপ্যানানি শুরু করল, বাজান আমি নাড়ু খাইয়াম—নাড়ু খাইয়াম। আরে পেডে ভাত নাই চোখে আইন্ধার দেখতেছি পরশু বৈকাল থাইক্যা আর হালার পুতের মুহে অহন রুচি অইছে লাড়ুর; দিলাম এক থাপ্পড়—মাডিত পৈড়াও কানতে কানতে লাড়ু চায়। একটা মাইনশ্যে আইয়া যুদিন পোলাডারে ধরতো, আরে—জগতে খালি বাপই আপন, মাইনশ্যে-মাইনশ্যের কিছু না?

জমসেদের বুকে তুষের আগুন। এই দূর পরবাসে এসেও সে সম্মুখ থেকে ছেলেটাকে তাড়াতে পারছে না। তার রক্তের মধ্যেও যেন তিলেকে তিলেকে উঁকি দেয়—এক ক্ষুধাতুর বালকের করুণ মুখ। স্নেহের এক আজগুবি অন্ধ শেকল পলে পলে আরও নিবিড় হয়ে তাকে জড়ায়।

পোলাটা সারাক্ষণ বাঁ-হাতের আঙুল চুষে-চুষে ঘা করে ফেলেছে। সামনে যে যাই কিছু মুখে দেয়, সে কাছে এসে কইবে, আমিও খাইয়াম। জমসেদ যদি মরে যায় তবে তার কী দশা হবে? সেই ফজর থেকে হাগতে হাগতে পেট্টা নাল-খাল; গতরে একরত্তি শক্তি নাই, বুড়া রাইফেলটা বইতেও হাঁফ ওঠে।

জমসেদরা ইস্কুল থেকে ইস্কুলে ঘোরে। নাম বদলায়, মানুষ বদলায়, তারিখ বদলায় কিন্তু কামের কোনো হেরফের হয় না। এই কেন্দ্রের কিছু মানুষ সারাক্ষণ খালি কৈ মাছের মতো চুলবুল করে, তাগর কটা যে বাঞ্চা খোদাকা মালুম। চেঙড়া পোলারা যুইতে বেযুইতে গোল পাকায়। মাঝেমধ্যে পলু বাওয়ার মতো জিকির তোলে। কয়জন লোক একসঙ্গে ঘরে ঢুকার জন্য হল্লা করে। জমসেদ বাধা দিলে হিক্কা তোলে জাত-বেজাতের টিটকারি দেয়। লাইনের পিছন থেকে শিশ্‌ ওঠে। একজন হুকুম করে, পিংলোরে টান দ্যায়া লইয়া দ্যাহি ইলেকশানের টেনিং দ্যায়া দেই। একজন মুখ ভেটকায়, অন্যজন পিছন থেকে টুপিতে টান দেয়। যখন সেই টুপি খুঁজতে পিছন ঘুরে আরেকজন অন্য পাশ থেকে হাঁটু দিয়ে পাছায় গুঁত্তা মারে। দুর্বল গতরের জমসেদ টাল সামলাতে না পেরে দরজায় ঠোক্কর খায়। মাথাটা ঘুরে ওঠে, আর মনের মধ্যে উঁৎপাতা রক্তাক্ত জন্তুটা গর্জে ওঠে, ফাল দেয়।

জমসেদ কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে চোখের পলকে রাইফেলের বাট তোলে চিক্কইর দেয়, আমগরে চদু পাইছ্‌ যা ইচ্ছা তাই করবা, মুখের ফ্যাদা ফলাবর লাইগ্যা ইচ্ছা মতন গাইল দিবা আর আমরা পিঠে ছালা, কানে তুলা দ্যায়া অজম করাম, না, এইডা আর অইব-না। সে ধুম-ধাম পেটাতে থাকে। শরীরের ঝাল ঝাড়তে অত সুখ! অত আনন্দ! আহঃ অত শান্তি! তার শরীরটা বোঝি হাওয়ায় ভাসছে আর হাত দুটো…সে এক ভেলকিবাজি। চারিদিকে মা’রে-বাবারে বলে আর্তরবে… রবে একটা বিভীষিকা ছড়িয়ে পড়ে।

কিছু সাহসী লোক তাকে বাগে আনতে এগিয়ে আসে, যারা জগতে এমুত হামলা-হটকারিতার হিল্লে করার জন্যই সর্বক্ষণ তৈরি মাল। লোকগুলো কারিনদা হাতে পাঁঠা ধরার মতো তাকে টেনে-হিঁচড়ে মাঠের মধ্যে নিয়ে আসে। অসংখ্য উৎসাহীর কিল-ঘুষি-লাথি উল্কার বেগে ছিটকে ছিটকে আসে। রাইফেলটা বেহাত হয়ে গেছে অনেক আগেই। শার্ট-গেঞ্জি ছিঁড়ে উধাও।

পেন্ট্‌টা টানাটানিতে হাঁটুর কাছে নেমে গেছে। অনেক কষ্টেও সে মাটির নাগাল পেল না, তার দেহ শূন্যে শূন্যে ঘুরছে বিগড়ে যাওয়া মানুষের হাতে হাতে। চোখে কোনো মালুম নেই, সব কেমন ধোঁয়া ধোঁয়া। এরই মধ্যে তার মরে যাওয়া মায়ের ফুকলা মুখ, তারপরে বউয়ের ছিঁড়া মলিন শাড়ির আঁচল কামড় দিয়ে টালমাটাল দাঁড়ানোর শংকিত ছায়া বার কয় দোলে গেল। বউয়ের চোখের পাতা যেমুত ভেজা, কান্নার ঢেউ আটকানোর চেষ্টায় আকুল হয়ে ঠোঁট কামড়াচ্ছে। পেটের দিকের ছেঁড়া শাড়ির ফাঁক দিয়ে উপাসী খেংড়া শরীরের হাড়-গুড় দেখা যাচ্ছে। এইসব খোয়ারির মধ্যেই সে ধপাস করে মাটিতে পড়ে, ফলে তার ভাবনায় ছেদ পড়ে।

একটা দাঁত খুলে জিবের নীচে আটকে আছে; কিন্তুক ফেলার ফুরসত নেই। পানির তেষ্টায় সে একবার ঢুপ গিলে যার স্বাদ খুব নোনতা। গতরের উপর দিয়ে কী চলছে সে বোধ অনেক আগেই লুপ্ত, শুধু খালি দুই কানের শাঁ শাঁ শব্দ করে বন্ধ হয়ে গেল। সম্ভবত একটা শক্ত লাথি পড়েছে। জমসেদ চোখ মেলতে চেষ্টা করে, বাঁ-হাতে কানটা হাতড়ে চোখের সামনে ধরতেই ভেজা লাল টসটসে হাতটা ঝিলিক দেয়। তার সামনে পিছে, ডাইনে বাঁয়ে লুঙ্গি-পেন্টের আস্তরে ঢাকা পা। মুখের সামনেই দুইটা পায়ের গোলাপি গোশত কালো চকচকে পামশু-র মধ্যে থেকে ছলকায়। অনেক কষ্টে সে মুখটা তুলে জুতার উপরের নরম গোশতে রেখে প্রাণপণ শক্তিতে কামড় দিয়ে ধরে। লোকটা জন্তুর মতো চিক্কইর দিয়ে লাফায় কিন্তুক জমসেদ ছাড়ে না। মানুষটা অন্য পায়ে পাগলের মতো লাথি মারছে। আর তক্ষুনি একটা মুগুর নেমে আসে। তার মাথায় ফেটে পড়ে বজ্রের মতো হুংকারে। মুখটা ঢিলে হয়ে যায়; জমসেদের ক্ষমহীন পৃথিবী চোখের সামনে দপ করে থেমে গেল, আর এই ফাকে কাঁপতে কাঁপতে ভেসে আসে তার পোলার মুখে আঙুল দেওয়া ছবিটা; ছবি তো নয় এট্টুর ওশন ছায়া কিন্তু অহন-তো জমসেদের কিছু ভাবার টাইম নাই। গত কয়দিনের ঘুম তার গতরের আনাচকানাচ থেকে হল্লা করে নামে; চোখ-মগজ দখল করার জন্য। বৈশাখী দুপুরে তালপুকুরের মধ্যখানে যেখানে কালো কুচকুচা পানি বুকের উপর কলমি আর হেলেঞ্চার চালা নিয়ে বড়ো চুপচাপ বসে আছে, তার তলে ডুব দিয়ে মাটি ধরে বসে থাকলে যেমন একটা জমাট শান্তির দোলা মগজ-জব্দ করে ঘুমে ঘন আথাইলে তুলে নেয় তেমনি এই সময়টা। গত কয়টা দিন সে খুব কষ্ট পেয়েছে, অহন আর কোনোকিছুর ডর নাই, কিন্তুক তার উপাসী পোলাডায় তারে বড়ো বেউয্যা ফালছে; কিছুতেই সামনে থেকে সরে না, মুখে একটা আঙুল দ্যায়া কইছে, বাজান—আমি খাইয়াম, অ বাজন তুমি হুনছ-না ক্যা—আমি ভাত খাইয়াম।