এগুলো হলো চিরকালের বাংলাদেশের অন্তরে নিঝ্‌ঝুম দুপুরবেলায় গজিয়ে ওঠা শুনশান কয়েকটা গালগল্প! এর ভেতর মিশে আছে দজ্জাল ছোটো বউয়ের ভাসন্ত চোখ! যার নাম চালভাজা তার নাম মুড়ি, আর যার নাম পাকাচুল তারই নাম বুড়ি! আছে ভাদ্দর মাসের ভ্যাপসানিতে সংসারের জ্বলন-পোড়নের হাত থেকে দু-দণ্ড ছুটি নিয়ে পৃথিবীর নির্জনতম পুকুরঘাটের শানবাঁধানো রানারে বসে এ-বাড়ির মেজকি আর ও-বাড়ির কাজন্তি ঝিয়ের কানভাঙানির ফিসফিস। আছে জ্যৈষ্ঠের কলিজাফাটা ধুপে পিপাসাহরণ বোষ্টমির গান! আছে পুরুতের চালকলা, নিমের তিতে, ফোড়নের ঝাঁঝ, গুড়ের মিঠাস, কাঁকড়ার ঠ্যাং, গুজবের পাখা আরও কত কী! আর আছে অনেক-অনেকখানি তাতাজ্বলা খোলা মাঠ!


১. বেলা দ্বিপ্রহর

মোটা কাঠের ভারী দরজা। ভুসোকালির কালো মাখানো। ওপরে খিলানে চুনখড়ি দিয়ে লেখা—‘জয়তু বর্গীদমন’। দরজার বাইরের দিকের বাঁকা পথটি সুরকি-লাল। সে পথ, ওই দূরে কুনুর নদীর পার থেকে শুরু হয়ে গ্রাম পেরিয়ে বাঁশিয়া সায়েরের দিকে চলে গেছে। এখন নিঝ্‌ঝুম দুপুর। দুই প্রহর বেলা হলো। ঘুঘু ডোকার দিচ্ছে। একপাল হাঁসহাঁসি পথ কাটল। তাদের পিছু পিছু বোষ্টম বোষ্টমি। তারা এসে দাঁড়াল দরজার সামনে। বোষ্টমির গানের সঙ্গে করতাল বাজায় বোষ্টম—

ওলো ও ললিতে চাঁপকলিতে একটা কথা শুইনছে
আমার রাইয়ের ঘরে চোর ঢুইকেছে চূড়ো বাঁধা মিনসে…!

দুটি সেবা দাও গো মা…!

খুলে গেল নাচদোর। এসে দাঁড়ালেন যেন স্বয়ং বিষ্ণুপ্রিয়া। এক হাত ঘোমটা সরিয়ে বউ বলল,—তোমরা আজ ফিরে যাও-গো বোষ্টম বোষ্টমি। আজ হেঁশেলে শালো চাল বাড়ন্ত। তারপর এদিক-ওদিক ভালো করে দৃষ্টি মেপে গলা নামিয়ে ছড়া কাটল—

নিতে পারি খেতে পারি, দিতে পারি না।
বলতে পারি, কইতে পারি সইতে পারি না
যার নাম চাল ভাজা তার নাম মুড়ি
যার মাথায় সাদা চুল তারই নাম বুড়ি!

শুনে বোষ্টম বোষ্টমি বড়োই দুঃখ পেল। মাধুকরী জুটল না বলে ততটা নয়, যতটা শ্বশুরঘরে বিষ্ণুপ্রিয়া বউটির দুর্দশা কল্পনা করে, বোষ্টমির মুখটা কালো হয়ে গেল—

হায় হায় গো! সোনার লতা বউটি হলো ভালো
বউ কাঁটকি, নোলা দেগো শাশুড়ি দজ্জাল!
তবে আর কী করি
পোড়ার মাথা খিদেয় মরি

বোষ্টম বোষ্টমি সরে পড়ার তাল করছে, এমন সময় কাঁচাপাকা চুলে এসে পড়ল শাশুড়ি—দাঁড়াও তো বাপু বোষ্টম বোষ্টমি, সরে পড়ছো যে বড়ো!

যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধে হয়! ওই এলেন…!—এই বলে লক্ষ্মী‌‌প্র‌তিমা বউটি এক হাত ঘোমটা টেনে শাশুড়িকে পাছ দেখিয়ে ভিতর বাড়ির দিকে হাঁটা দিল।

বুড়ি মুখ ভিরকুটে বলল,—মরণ!, তারপর বাঁ-গালে হাত দিয়ে বাপান্ত করতে লাগল—হায় হায় হায়! দেইজি-ঘাঁটা হাড়হাভাতে বউ জুটেছে গো, আমি এখন কোথায় যাই! ভর দুক্কুরবেলা পাটাবুকী গুমোর দেখিয়ে ভিখিরিকে হাঁকিয়ে দিলে! আমায় একবার শুধোবার প্রয়োজনটি ভাবলো না’ক! দেখো-গো তোমরা বোষ্টম বোষ্টমি, আমার পোড়া কপালখানা একবার দেখো!—বিলাপ করতে থাকল বুড়ি শাশুড়ি!

বোষ্টম আর বোষ্টমি অভিভূত। চোখের জলে বোষ্টম বলল,—তাই তো বলি মা, তুমি সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা! তোমার হেঁশেলে চাল বাড়ন্ত তাই কখনও হয়!

শাশুড়ির বিলাপ তখনও চলছে—তাই দেখে স্বান্ত্বনা দিয়ে বোষ্টমি বলল, মনে পাষাণ বেঁধে রেখো না গো মা। আজকালকার বউ-ঝি সব এমনই অলবড্ডে। তোমার পাকা চুলে সিঁদুর অক্ষয় হোক। আমার গোরাচাঁদের প্রসাদে তোমার হেঁশেল ভরভরন্ত হোক। বৈষ্ণবকে দু-মুঠো সেবা দাও-গো মা, হাত উগলে!

বুড়ি চোখের জল নাকের জল আঁচলে মুছতে মুছতে বলল,—মাফ করো গো ঠাকুর ঠাকরণ, আজ কিছুমিছু দিতে পারবো না। হাত জোড়!

বোষ্টমি অবাক হয়ে বলল, সে কী কথা গো! এই না তুমি আপন পুত-সোহাগীকে মুখ করলে, আমাদের সেবা না দিয়ে হাঁকিয়ে দেবার জন্য। আর এখন বলছ কিছুমিছু দিতে পারবো না।

শাশুড়ি ঝাঁঝিয়ে উঠল,—এ বাড়ি কার? আমার। হেঁশেল কার? গেহ যার। তবে ভিখিরিকে বিদেয় করবার অধিকারটি কার? সে-ও আমার। তোমাদের মুখের ওপর দোর দিতে হয় আমি দেবো। ওই ছারকপালি ঘর জ্বালানি ধিঙ্গিটা সাউখুরি করতে আসে কোন অধিকারে?—এই বলে সশব্দে মোটা কাঠের ভারী দরজা বন্ধ করে দেয়।



২. কবুতরের পাখা

আমি ঠেকলাম বিষম দায় গো
ঠেকলাম বৈরাগী হইয়া।
হাঁস খাই না কইতর খাই না।
খাই না মুৰ্গির ঠ্যাং
আভাগ্যা বৈরাগী হইয়া
বৃথাই জনম গেল গো !

বৈশাখ গেল জ্যষ্ঠি গেল
ভাদ্র মাসের আধা
যেই সময় বৈরাগী হইতাম
মায় দিয়াছিল বাধা গো!

আছাড় খাইলাম পিছাড় খাইলাম
পইড়া রইলাম খালে
আমার জপের মালা লইট্‌কা রইল
ছিট্‌কি গাছের ডালে গো!

বৈরাগীর গান শুনে দু-মুহূর্ত থমকে দাঁড়াল শশী বামুন। রম্ভা-আতপ-ফুল ছেটানো যজমানিতে মজে কেটে যায় বারোমাস তিরিশ দিন। অন্নচিন্তা চমৎকারা! ইহজন্মটা তার সে চিন্তাতেই গেল। সাধন ভজন হবে কোথা থেকে! তবু পথচলতি বৈরাগ্যের ধুনোয় মনটা মাঝে মাঝে খেলিয়ে সেঁকে নিতে ইচ্ছে যায়। তবে আপাতত মুশকিলটা হলো এইরকম—এখন তার ডান হাতে একটা ছাতা ও ডান বগলে একটা গুড়ের কলসি। বাম হাতে একটা মাটির সরা ভর্তি সিন্নি। কাঁধের ঝোলায় চাল-ফল-আনাজ-নতুন ধুতি-গামছা, নৈবেদ্যের ভার। এবং সর্বোপরি গলায় ঝোলানো বটুয়ায় অবস্থান করছেন স্বয়ং—শ্ৰী শ্ৰী শালগ্রাম! তাছাড়া আজ ভোর থেকে উঠে তিন তিন বাড়ি সত্যনারায়ণ সেরে ঘরে ফিরতে ফিরতে এতক্ষণে দু-প্রহর বেলা গড়িয়েছে, ফলে খিদেয় নাড়িভুঁড়ি হজম হয়ে যাবার জোগাড়। সুতরাং চণ্ডীমণ্ডপ চাতোরের আটচালা পিছনে ফেলে, এঁটেল কাদায় পিছল সরু বিজন রাস্তাটি দিয়ে হেঁটে চলল শশী পুরুত, ভদ্রাসনের দিকে।

বাগদি পাড়ার মোড়টা ঘুরতেই, দমকা একটা হাওয়া দিল। ভাদ্র মাসের কষ্ট-গুমোট ক্ষুধার্ত পৃথিবীতে এমন অলৌকিক হাওয়া বইয়ে দেওয়া একমাত্র পরম কল্যাণময় গুরুগোপালের পক্ষেই সম্ভব। হরিবোল হরিবোল! হাওয়া এসে কপালের বিড়বিড়ানি ঘামের অসোয়াস্তিকে একটু যেন জুড়িয়ে দিয়ে গেল। যেহেতু শশী বামুনের দুটো হাতই ছিল ভারী আর পলকা জিনিসপত্রে বোঝাই, কাজেই গলায় জড়ানো গামছা দিয়ে চোখ মুখ ঢেকে ফেলবার আগেই একরাশ খড়-কুটো-বালি ধুলো উড়ে এসে লাগল মুখে চোখের পাতায়। কিচকিচে ধুলোর সঙ্গে কী যেন নরম-মতন এক ফাঁকে ঢুকে পড়ল হাঁ-মুখের ভেতরে। থু-থু করে ফেলল বামুন। একটা সাদা রঙের ছোট্ট ও হালকা পাখির পালক, তলার দিকটা মনে হলো যেন লালচে, বোধহয় রক্তমাখা। ভাবতেই ঘেন্নায় গা ঘুলিয়ে উঠল তার, ওয়াক!

ঘরে ঢুকে দাওয়ায় মালপত্র নামাতে নামাতে এক ঘটি মুখ ধোবার জলের জন্য বিশ্রী রকমের হাঁকডাক শুরু করে দিল শশী বামুন। সাড়া দিয়ে উঠল গৃহিণী—কী, হলো কী! আজ এত হুড়বিত্তি কীসের! কোনোদিন মুখ ধোবার জল দেওয়া হয় না বামুন ঠাকুরটিকে?

ঘটির জলে কুলকুচি করতে করতে নিশপিশিয়ে উঠল পুরুত—আ মলো! সে-কথা কে বলেছে! ফেরার সময় বাগদি পাড়ার মুখটাতে হাওয়ায় উড়ে একটা হাঁসের না কউতরের কে জানে, রক্তমাখা পালক মুখের মধ্যে সেঁধিয়ে গেল, সেই থেকে গা গুলোচ্ছে !

সব্বনাশের মাথায় বাড়ি! তবে তো পায়শ্চিত্তির করতে হবে? বাড়িতে গুরুগোপাল রয়েছেন যে গো!—উদ্‌বিগ্ন গলায় বলল বামনী। আর তারপর এক্কেবারে কেঁদেই ফেলল, ইনিয়ে বিনিয়ে চলতে থাকল কান্না—এ তুমি কী করলে ঠাকুর! যে পুরুত রহু-মাস দূরে থাকুক, পেঁয়াজ রসুন পর্যন্ত কোনোদিন দাঁতে কাটে না, তাকে তুমি কউতরের পাখ-কুঁকরোর লহু খাইয়ে দিলে! এ কীসের শাস্তি তুমি আমাদের দিচ্ছ ঠাকুর—কান্না চলতে থাকে !

চুপ করো তো!—ঝাঁঝিয়ে উঠল শশী, বড়ো এসেছেন আমার বিধানদাত্রী! পায়শ্চিত্তির করতে হবে, ইল্লি আর কী! বলি, রক্তমাখা থুতু কি আমি গিলে খেয়েছি নাকি? ফেলে দিলাম তো থুতকারে, তারপর মুখ কুলি করে নিলুম, তো, ব্যস! এবার অন্ন সেবার আগে গঙ্গাজলে গণ্ডূষ করে গায়ত্রী আওড়ে নিলেই চলবে। আমি চললাম নাইতে, তুমি পাত সাজাও, খিদেয় মারা গেলাম!

বামুন চলে যেতেই আরও প্রবল কান্নায় ভেঙে পড়ল বামনী—হায় হায় গো! আমার কী হবে গো! মানুষটার মধ্যে নিশ্চয়ই রাক্ষস ভর করেছে, নইলে এত বড়ো একটা বিপদের কথা ভুলে গিয়ে খাবার জন্য এত হাঁকপাঁক করবার মানুষই সে নয়! ইত্যাদি…ইত্যাদি।

খেতে বসে শশী বামুন দেখল, গিন্নি অনবরত চোখের জল মুছছে। তাতে বিরক্ত হলো শশী। কী, হলো-টা কী? বললাম তো অত ভাবার কিছু নেই।

গুরুগোপাল আমাদের এত বড়ো শাস্তি কেন দিলেন গো? তোমার জাত মেরে দিলেন! নিশ্চয়ই আরও বড়ো কোনো অমঙ্গল নাচছে আমাদের কপালে, এ শুধু বৃষ্টির আগে মেঘের ডাক! কিন্তু আমরা কী অপরাধটা করেছি তাঁর চরণে!—চোখের জলে বলল বামনী!

মেলা বকিস না তো ! গোপাল-জীউয়ের খাস সেবায়েত আমি। তাঁর সঙ্গে লেনদেনটা আমি বুঝে নেবো! আর তুই এসব কথা পাঁচকান করিস না বুঝলি ? গাঁয়ের লোক বড্ড কুটিল, কোন কথার কী মানে ধরে!—উত্তরে, ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বামনী গেল জামদহের ঘাটে গা ধুতে।

সেখানে তখন কাজন্তি ঝি হাঁড়ি-পাতিল-বাসন সাজিয়ে বসেছে। বামনী একগলা জলে নেমে আকাশের দিকে মুখ তুলে বিড়বিড় করতে লাগল,—হে গুরুগোপাল! আমার পুরুতের সব পাপ তুমি আমায় দাও! সে মানুষটাকে তুমি রক্ষা করো ঠাকুর!

কাজন্তি একবার মুখ তুলে বামনীর ভাবগতিক দেখল, তারপর আহ্লাদী সুর তুলে বলল—কি হয়েছে লা বামুন কাকি?—ঠিক এই আন্তরিক প্রশ্নটার জন্য বামনীর হৃদয় যেন যুগ যুগ ধরে অপেক্ষা করেছিল! হাউ হাউ কাঁদতে কাঁদতে মনের দুঃসহ ভার উদ্‌বেগ ঘটনা পরম্পরা সহ উগরে দিল কাজন্তির কানে। তারপর তার হাত-দুটি নিজের মাথায় রেখে বলল—এ কথা যদি তুই আর কাউকে বলেছিস তো তোর বামুন কাকির মরা মুখ দেখবি।

কী-যে সব অলক্ষুণে কথা বলো না কাকি! কাজন্তির পেট থেকে কেউ কোনোদিন একটা কথাও আজ অবধি উগলে বার করতে পেরেছে!

আরেকটু পরে, কাজন্তি যখন ছিদাম তেলির ঘরের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল, তেলি বউ তখন নাচদুয়ারের সামনের পৈঠায় বসে, ছিদাম কখন হাট থেকে ফেরে তার জন্য অপেক্ষা করছিল। তেলি বউকে দেখে কাজন্তি আর হাসি চাপতে পারল না। মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ফুলে ফুলে সে কেবল হাসতে থাকল ! সে হাসি আর থামে না !

কী হয়েছে লা কাজন্তি? অমন খেপীর মতো হাসছিস কেন! নতুন কোনো আশনাই করেছিস বুঝি ?—বলল তেলি বউ।

কাজন্তি এক নিঃশ্বাসে বলে উঠল,—তা হাসব না তো কী! ওঁ বিষ্ণু নমঃ ওঁ বিষ্ণু নমঃ, নৈবেদ্যে রম্ভা কেন কমঃ! আমাদের শশী পুরুত যে গো!

সে কী রে! শেষে বুড়ো শশী বামুনকে নাগর ধরেছিস নাকি? সব্বোনাশী! পাড়াঢলানি!—রহস্যের গন্ধ পেয়ে সকৌতুকে বলল তেলি বউ।

কাজন্তির হাসি আর থামে না—আরে ধুর, সে-কথা নয়! শোনোই না বিত্তান্তটা! শশী বামুনের মুখ দিয়ে মন্ত্রের বদলে কউতরের পাখ বেরোচ্ছে গো…হাঁ করলেই আস্ত আস্ত কউতরের পাখা, রক্তমাখা, ম্যাগো!

দূর হ ফোক্কড় মাগী!—গল্পটা আরেকটু বিশদে, রসিয়ে শোনার ইচ্ছে তেলি বউয়ের।

বিশ্বাস না হয় বামুন কাকিকে জিগেশ করো-গে যাও! ওই তো, জামদোর ঘাটে, সে কী বিচিত্তির… বুড়ি তো কেঁদেই মলো! কাঁদে আর বলে গোপালঠাকুর নাকি অভিসম্পাত দিয়েছে!

হায় হায়! কী হবে এখন! অমন যে সাত্ত্বিক বামুন শশী পুরুত তার মুখ দিয়ে কউতরের পাখ বেরচ্ছে! দেখ লা দেখ, আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে! কার যে পেটে পেটে কী আছে কে বলবে!—এতক্ষণে বিষয়ের গুরুত্বটা যেন অনুধাবন করল তেলি বউ!

হাসি থামিয়ে কাজন্তি বলে—বউ, তুমি আবার এসব কাউকে বলে বসো না, বামুন কাকির মাথার দিব্যি আছে! তোমায় বলে তাই আমি বললাম।

এই সেলাই করলাম আমি মুখ!—বলল তেলি বউ। দু-মুহূর্ত দুজনের গম্ভীর মুখ দেখে মনে হলো, যেন কোনো মন্ত্রগুপ্তির শপথ নিচ্ছে ওরা । তারপর দুইজনাই একসঙ্গে তুমুল হাসিতে ফেটে পড়ল !

দুপুর আরেকটু ঘন হলে, তেলি বউ যখন হাট ফেরতা ছিদাম তেলিকে এই আশ্চর্য ঘটনার কথা বলব না-বলব না করেও বলে ফেলল, তখন প্রথমটায় ছিদাম মোটেই বিশ্বাস করতে চায়নি—মেলা বাজে বকিসনি দিকিনি! তাই কখনও হয়! মাইনষের মুখ দিয়ে কউতরের ছানা বেরোতে পারে কখনও?

আমার কথায় তো তোমার বিশ্বাস হবে না। যাও তবে জিগেশ করে এসো কাজন্তি ঝিকে। তার কথা তো আর তুমি ফেলতে পারবে না। সে পাড়াবেড়ানি নিজের চক্ষে দেখে এসেছে—পুরুতমশাই পাখসাট দিচ্ছে আর তার মুখ দিয়ে লহুময় কউতর কেমন পাখসাট দিতে দিতে বেরিয়ে আসছে। তেলি বউয়ের কথা বলায় যা ঝাঁঝ ছিল, তা আচ্ছা আচ্ছা পতি-পরমেশ্বরের বুক কাঁপিয়ে দিতে পারত, ছিদাম তো কোন ছার!

কী বললে, শশী পুরুতের মুখ থেকে জ্যান্ত কউতর বার হচ্ছে?—চোখ কপালে উঠে গেল মোড়লের। ভর দুপুরে ছিদাম তেলি যখন তার কাঁচা দিবানিদ্রাটি ভাঙিয়েছে, তখনই তার মনটা কু গেয়ে উঠেছিল, নিশ্চয়ই এই তিনসুকিয়া গ্রামে আবার কোনো ঝামেলা পাকিয়ে উঠেছে। কিন্তু ছিদাম তেলি যা শোনাল তা তো ‘দুনিয়ার বার’, এ আবার হয় নাকি! যে শশী বামুন জীবনে কখনও আমিষ মুখে তোলেনি তারই মুখ দিয়ে রক্তমাখা জ্যান্ত কউতর ঝাঁকে ঝাঁকে উড়তে উড়তে বেরিয়ে আসছে—এ খবর মোড়লকে কেমন যেন বিহ্বল করে দিল। কিংকর্তব্যবিমূঢ় মোড়লমশাই ছিদাম তেলিকে সঙ্গে নিয়ে যখন নারায়ণ কবিরাজের নাচদোরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল, তখন, তাদের পিছনে প্রায় একটা চড়কতলার ভিড়।

নারান কোবরেজ অবশ্য বিচক্ষণ লোক, সহজে দমে যাবার পাত্র তিনি নন। চরকসুশ্রুত থেকে আরম্ভ করে পাণিনি হয়ে উজ্জ্বল নীলকান্তমণি, গীতাসারাৎসার, মার্কণ্ডেয়পুরাণ, আদিতন্ত্রপ্রভাকর এমনকি বাৎস্যায়নের কামসূত্রের অবধি দিব্যি খেলেন। শেষে, চাণক্যের অর্থশাস্ত্র থেকে একেবারে মুখস্থ বলে বসলেন—

ধনিকঃ ক্ষত্রিয়োরাজ নদী বৈদস্তু পঞ্চমঃ
পঞ্চ যত্রনবিদ্যন্তে তত্র বাসং ন করয়েত!

নারান কোবরেজ যে নিদেন দিলেন, তা হলো—শশী গভীর জলের মাছ। তার ইড়াপিঙ্গলায় প্রকূপিত বায়ু ঢুকে পড়েছে আর সেটা গিয়ে ঠেলা দিচ্ছে এক্কেবারে কুলকুণ্ডলিনীতে। ফল পিশাচযোনির শক্তি জাগ্রত হয়েছে। বিধেয় লহু বাসনা। ব্যাটাচ্ছেলে শশী কণ্ঠিধারী বামুন হয়ে তন্ত্রে হাত দিয়েছে।

দুপুর যখন বিকেলে গিয়ে মিশল, সেদিন, গ্রাম তিনসুকিয়ায় শশী বামুনের ঘরের সামনে তখন একটা রীতিমতো জমায়েত। মোড়ল আর কোবরেজের হম্বিতম্বিতে দাওয়ায় নেমে এসে দাঁড়াল শশী।

নারান কোবরেজের গলার স্বর অধৈর্য—কই হে! বের করো তোমার হ্লাদিনী মন্তর…ওং হ্রিং রিং ক্লীং…! আমরা পাঁচজন একটু স্বচক্ষে দেখি, ডুবে ডুবে কত জল তুমি খেয়েছো।

অবাক শশী বামুন আমতা আমতা করে বলল—এই মানে ভাত খেয়ে খানিক গড়াচ্ছিলাম, কখন যে চোখটা লেগে গেছে বুঝতে পারিনি…তা আপনারা…কী ব্যাপার মোড়ল মশাই? কী ব্যাপার কোবরেজ?

কি ব্যাপার কিছু বুঝতে পারছ না, না? জেগে ঘুমিও না তুমি শশী পুরুত! এখনও সময় আছে…! কোবরেজের স্বর আগের মতোই অধৈর্য।

আহা! কী আশ্চর্য ! আমি তো…!

এবার কঠিন গলায় বলল, মোড়ল,—দেখো পুরুত, এই গাঁয়ের পাঁচটা লোক তোমাকে সম্মান করে! কথা হচ্ছে শঠতা তোমাকে মানায় না! তোমার মুখ দিয়ে রক্তমাখা কউতরের পাল কেমন করে বের হচ্ছে, সেটা আমাদের স্বচক্ষে দেখা দরকার।

শশী যতটা অবাক হলো ভয় পেল তার চেয়ে বেশি—কী বলছেন গো মোড়লমশাই…বাড়িতে গুরুগোপাল আছেন…! তিন সন্ধ্যা আহ্নিক না করে জলগ্রহণ করিনি কোনোদিন—কউতরের রক্ত মুখে দেওয়া…সে যে জীবহত্যা! মহাপাপ!

কোবরেজ বলে উঠল—তুমি কি আমাদের সব বোকা ভাবছো নাকি গো পুরুত? একটু আগে কাজন্তিকে বুঝি দেখাওনি তোমার ওসব খেলা!

কথা-খেলাপি হবার বিপদ থেকে বাঁচতে, সুযোগ বুঝে কাজন্তি এবার নিজের ঘাড় থেকে বোঝা নামিয়ে দিল শশী বামুনের গিন্নির কাঁধে—বামুন কাকি সাক্ষি আছে ! সে নিজের মুখে আমাকে সব বলেছে, আমার কী দোষ!

এতক্ষণ বামনী চুপ করে সব শুনছিল, এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না—কোন দোষে গুরুগোপাল আমাদের এমন শাস্তি দিলেন মোড়লমশাই—শেষ কথাগুলো তার কান্নায় বুজে গেল!

এইবার শশী পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পারল আর বামনীর দিকে একবার আগুন চোখে তাকিয়ে সামলে নিল নিজেকে, হেঁকে বলল—এসবই আমার গোপালের ইচ্ছা! দেখব বললেই তো আর দেখা যায় না কোবরেজ মশাই! যে ভক্তি সেই শক্তি! এসব দেখতে হলে অনেক নিয়মকানুন পালন করতে হয়!

ছিদাম তেলি আপ্লুত কণ্ঠে বলল—আগেই জানতাম, ঠাকুর আমাদের সাধন ভজন করা লোক!

সবাই একটা অলৌকিক কিছু দেখার আশায় অপেক্ষা করতে থাকল। শুধু নারান কোবরেজ যেন একটু বিরক্ত। বলল—তা নিয়মকানুনগুলো কীরকম শুনি?

টানা একমাস নির্জলা উপোসের পর, আশ্বিন মাসের অমাবস্যায় আড়াই প্রহর রাতে, গলায় দড়ির ঘাটে গিয়ে, জামদীঘির জলে ডুব দিয়ে, ভিজে কাপড়ে যে আমার কাছে আসবে, সে দেখতে পাবে কউতরের খেলা!—শশী বামুন নিয়ম জানাল।

এদিকে হয়েছিল কী, ক’বছর আগে প্রকাণ্ড জামদীঘির ওই ঘাটে, জামগাছে গলায় দড়ি দিয়েছিল আগুরিবাড়ির ছোটো বউ, সেই থেকে দিনের বেলাতেও ওদিকে বিশেষ কেউ যেত না। ফলে কউতরের খেলা দেখার ইচ্ছেটা গ্রামের লোকের মনে আস্তে আস্তে কমতে লাগল। শেষে একসময় সবাই ব্যাপারটা এক্কেবারে ভুলে গেল। শুধু শশী বামুনের গিন্নিকে দেখা যেত মাঝেমধ্যে দীঘির ঘাটে, বুড়ো বটতলায় ইনিয়ে বিনিয়ে কান্নাকাটি করতে।



অতিরিক্ত:
ঈশ্বরের জন্ম হয় ভক্তের প্রয়োজনে। তিনি যে বিপত্তারণ, দুর্গতিনাশ। তিনি অরি হন্তারক। রাঢ়বাংলার গ্রামে এখনও খোঁজ মিলবে, এমন সব শতাব্দী প্রাচীন পুরোনো ভাঙা দেউল, যাতে খোদাই করা আছে মারাঠা দস্যুর (বর্গী) হাত থেকে রক্ষাকারী ইষ্টদেবতার জয়ধ্বনি—জয়তু বর্গীদমন।

এ নিশ্চিতভাবে রাঢ়বঙ্গের গল্প। কেননা এ গল্পের এক প্রান্ত দিয়ে বয়ে গেছে মেঠো আটপৌরে কুনুর নদী। আরেকদিকে বাঁশিয়া সায়ের বা সায়র। দক্ষিণবাংলার নদী-মানচিত্রে খোঁজ পাওয়া যায়, অজয়ের উপনদী কুনুরের। শহর দুর্গাপুর থেকে বিশ কিলোমিটার দূরে কয়লাখনি অধ্যুষিত ঝাঁঝরা গ্রাম। সেখানে আছে ‘মিত্র সরোবর’ ও ‘গড়’ নাম্নী দুটি ভূগর্ভস্থ ঝরনা। সেই দুই ঝরনার জল সংকলিত হয়েই জন্ম নিয়েছে কুনুর নদী। উৎস থেকে প্রায় ১১২ কিলোমিটার দূরে গিয়ে কুনুর মিলিত হয়েছে অজয় নদের সঙ্গে। কুনুরের আবার দুটি উপনদী আছে, পঞ্চগঙ্গা ও গুসকরা। পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ জানাচ্ছে, বর্ধমান জেলার আউস গ্রামের কাছে, কুনুরের অববাহিকায় মাটি খুঁড়ে তাম্রযুগের প্রাচীন সভ্যতার খোঁজ পাওয়া গেছে, যার বয়স কমপক্ষে সাড়ে তিন হাজার বছর।

সায়ের বা সায়র হলো চারদিকে মাটির পাড় দিয়ে ঘেরা মানুষের খোঁড়া বিরাট জলাশয়। দুর্গাপুর আসানসোল শিল্পাঞ্চলে অবস্থিত সুপ্রাচীন গ্রাম বাঁশিয়া। বর্ধমানের মহারাজা বিজয়চাঁদ মহতাবের আমলে গ্রাম বাঁশিয়ায় খোঁড়া হয়েছিল যে মস্ত জলাশয় তারই নাম বাঁশিয়া সায়ের। বর্ষাকালে বুক ছমছম করা তার অগাধ জলরাশি বাকি সারা বছর সেখানে পদ্মপাতা, পদ্মফুল আর উলুকঝুলুক শালুক বনের ভিতর ডুবডুব পানকৌড়ি আর উদাসীন হাঁস-বক-কাদাখোঁচার দল। এই জলাশয়কে ঘিরে গত শতাব্দী জুড়ে কত-না লোককথার জন্ম হয়েছে।

নাচদোর মানে বড়ো বা মূল ফটক, সদর দরজা। রথ্যা-লচ্ছা-নাচ। আসলে রথ এসে দাঁড়াতে পারে এমন দরজা। আর চাতোর মানে যে চবুতরা তা না বললেও চলে।

চাণক্য শ্লোকটির অর্থ হলো, যে গ্রামে বৈদ্য ইত্যাদি নেই সে গ্রাম মনুষ্যবাসের অনুপযুক্ত।

লেখা শুরুর যে গানটি (ওলো ও ললিতে চাঁপকলিতে…), সেটি ধামাইল।