কার্ল মার্কসের বিপুল-বিস্ময়কর পঠন-পাণ্ডিত্য-প্রতিভা আবিশ্বে স্বীকৃত। কিন্তু ফ্রিডরিখ এঙ্গেলসের ভূমিকাকে, তাঁর জন্মদ্বিশতবর্ষেও দেখা হয়েছে মার্কসের অধস্তন হিসেবে। এঙ্গেলস প্রবল পাণ্ডিত্য ও মেধার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও, তাঁর নিজের স্থানটি নির্দিষ্ট রেখেছিলেন, মার্কসের পিছনে। দুজনেই ছিলেন গভীর মেধা, বুদ্ধি, বোধ ও অনুভবের অধিকারী। দুজনেই ছিলেন দুটি স্বয়ংসম্পূর্ণ মানুষ, আবার তাঁরা সবসময়েই পরস্পরের পরিপূরক। অথচ সংশোধনবাদীরা সব সময়ে অণুবীক্ষণ যন্ত্র নিয়ে খুঁজে বেড়ান, এঙ্গেলসের সঙ্গে মার্কসের পার্থক্য কোথায়? যেন কোনও বিষয়ে এঙ্গেলসের কোনও স্বাধীন মতামত থাকতে পারে না। তাঁরা দুজনে পরস্পরের পরিপূরক, আবার পরস্পরের থেকে স্বতন্ত্র। দুই মৌলিক প্রতিভার সম্পর্ককে দ্বান্দ্বিক অবস্থান থেকে দেখা অত্যন্ত জরুরি। তার জন্যই প্রয়োজন এঙ্গেলসের বিদ্যাচর্চার দিকে নজর দেওয়া।

তাঁদের বিদ্যাচর্চা ও রাজনৈতিক অবস্থান দুজনকেই সাহায্য করেছে, নতুন এক তত্ত্ববিশ্ব নির্মাণ কোরে নিতে। মার্কসের কন্যা, এলিওনর মার্কস অ্যাভেলিং এঙ্গেলস প্রসঙ্গে লিখেছেন: এঙ্গেলসের মনের চিরতারুণ্য ও সহৃদয়তা ছিল বিস্ময়কর। পাশাপাশি তাঁর বহুমুখী চিন্তা ও কর্মশক্তিও ছিল তেমনই বিস্ময়কর। জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় তাঁর বিচরণ ছিল স্বচ্ছন্দ: কী প্রাকৃতিক ইতিহাস, কী রসায়নবিদ্যা, কী উদ্ভিদবিদ্যা, কী পদার্থবিদ্যা, কী ভাষাতত্ত্ব, কী রাজনীতি-সম্পর্কিত অর্থশাস্ত্র, কী সামরিকবিদ্যা সবক্ষেত্রেই তাঁর বিচরণ ছিল সাবলীল। ১৮৭০ সালে, ফ্রাঙ্কো-প্রুশিয়ান যুদ্ধের সময়ে এঙ্গেলস ‘Pall Mall Gazette’ পত্রিকায় যে প্রবন্ধগুলি লিখেছিলেন, তা দারুণ চমক সৃষ্টি করেছিল। ওই লেখাগুলিতে তিনি সেদানের যুদ্ধ ও ফরাসি সেনাবাহিনীর পরাজিত হওয়ার কথা আগেই বলে দিয়েছিলেন। তারপর থেকেই তাঁকে তাঁর ঘনিষ্ঠরা জেনারেল নামে ডাকতেন। ১৮৭০ দশকে ‘Figaro’ পত্রিকা তাঁর সম্পর্কে লিখেছিল: তিনি কুড়িটি ভাষায় তোতলান।[১]

কথাটির গুরুত্ব বোঝা যায়—এঙ্গেলসের ভাষাচর্চার দিকে নজর দিলে। মার্কসের জামাতা এডওয়ার্ড অ্যাভেলিং (এলিওনর মার্কস-এর স্বামী) বলেছেন: তিনি জীবনে যেসব ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে সবথেকে উল্লেখযোগ্য হলেন: কার্ল মার্কস, চার্লস ডারউইন, ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস ও হেনরি আরভিং (ইংরেজ নাট্যপরিচালক ও অভিনেতা। শেক্সপিয়েরের বিয়োগান্তক নাটকগুলিতে তাঁর অভিনয় ছিল অসামান্য।) এঙ্গেলসের ১২২ নম্বর রিজেন্ট পার্ক রোডের বাড়ির রবিবারের আড্ডা ছিল স্মরণীয়। পারিবারিক বন্ধুরা ছাড়াও সেখানে থাকতেন, বিভিন্ন দেশ থেকে আসা সমাজতন্ত্রীরা। এঙ্গেলস তাঁদের প্রত্যেকের সঙ্গে তাঁদের নিজস্ব মাতৃভাষায় আলাপ করতেন। মার্কসের মতো তিনিও জার্মান, ফরাসি ও ইংরেজি নির্ভুলভাবে বলতে ও লিখতে পারতেন। পাশাপাশি ইতালিয়ান, স্প্যানিশ ও ডেনিশ ভাষাও বলতে ও লিখতে পারতেন। রাশিয়ান, পোলিশ ও রুমানিয়ান ভাষা পড়তে পারতেন। লাতিন ও গ্রিক বাল্যকাল থেকেই শিখেছিলেন।

এডওয়ার্ড অ্যাভেলিং লক্ষ্য করেছিলেন: প্রতিদিন বিভিন্ন ভাষায় লেখা চিঠি ও পত্রিকা আসতো তাঁর বাড়িতে। যখন তাঁর নিজের বা মার্কসের লেখা কোনও বই অন্যান্য ভাষায় অনূদিত হয়ে প্রকাশের জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠত, তখন অনুবাদকরা অবশ্যম্ভাবীভাবে এঙ্গেলসকে স্মরণ করতেন—অনুবাদ দেখে দেওয়ার জন্য, সংশোধন করার জন্য। তাঁর মাল্টি-ডিসিপ্লিনারি বিদ্যাচর্চা-সম্ভূত জ্ঞানভাণ্ডার সব সময়েই নিয়োজিত থাকত তাঁর বন্ধুদের সাহায্যার্থে। যিনি একটি বিষয় বা ডিসিপ্লিনকে তাঁর নিজস্ব বিষয় বলে গণ্য করতেন, তিনিও যখন এঙ্গেলসের সঙ্গে আলোচনায় বসতেন, তখন তিনিও বুঝতে পারতেন, এঙ্গেলসের সে-ই বিষয়ে জ্ঞান তাঁর থেকে বেশি। প্রকৃতিবিজ্ঞানের যে-কোনো শাখার বিষয়ে তাঁকে প্রশ্ন করলেই দেখা যেত, তিনি ওই বিষয় সম্পর্কে এমন কিছু কথা বলতে পারছেন, যার সাহায্যে অন্যেরা অজানা কিছু কথা, নতুন কোনও ধারণা পেয়ে যাচ্ছেন। তিনি সব সময়েই অন্যদের জ্ঞানের পূর্ণতা সাধনে সাহায্য করতেন। বিভিন্ন দেশে তাঁর বন্ধুরা সবাই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁরা সবসময়েই এঙ্গেলসের কাছে পরামর্শ চাইতেন। বিভিন্ন দেশের ইতিহাস, অর্থনীতি ও রাজনৈতিক আন্দোলনের শুধু মোদ্দা বিষয়গুলিই তিনি জানতেন তা নয়। ক্ষুদ্রতম, খুঁটিনাটি বিষয়গুলিও ছিল তাঁর নখদর্পণে।[২] ফ্রেডরিক লেসনার তাঁর স্মৃতিচারণে লিখেছেন: এঙ্গেলসের বয়স যখন ৭০-এরও বেশি—তখন তিনি মূল ভাষায় ইবসেন ও কিয়েল্লান্ড পড়ার জন্য নরোয়েজিয়ান ভাষা শেখা শুরু করেন।[৩]

এঙ্গেলস সম্পর্কে মার্কসের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে—মার্কসের আরেক জামাতা, পল লাফার্গ বলেছেন: মার্কস অন্য যে কোনও ব্যক্তির তুলনায় এঙ্গেলসের মতামতকে বেশি গুরুত্ব দিতেন। কারণ মার্কস মনে করতেন, তাঁর সহযোগী হবার জন্য এঙ্গেলসই ছিলেন সবথেকে যোগ্য মানুষ। তাঁর কাছে এঙ্গেলস একাই ছিলেন একটি গোটা সভার সমস্ত শ্রোতাদের সমতুল্য। এঙ্গেলসকে নিয়ে গর্ব ছিল মার্কসের। তিনি সবসময়েই এঙ্গেলসের জ্ঞানের বহুমুখীনতার প্রশংসা করতেন।[৪] আবার এঙ্গেলসের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লাফার্গ বলেছেন: তিনি বিশেষভাবে ভালোবাসতেন বিজ্ঞান চর্চা। তবে জ্ঞানের সর্বক্ষেত্রেই তাঁর স্বচ্ছন্দ বিচরণ ছিল। তাঁর সবথেকে প্রিয় বিষয় ছিল ভাষাতত্ত্ব ও সমর বিজ্ঞান।[৫]


স্কুল জীবন:

১৮৩৭-এর সেপ্টেম্বরে এঙ্গেলস তাঁর স্বরচিত গ্রিক কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন, তাঁর স্কুলের (জিমন্যাসিয়ামের) অনুষ্ঠানে। ওই মাসেই তাঁকে যে স্কুল লিভিং সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছিল, তাতে তাঁর শক্তি ও সীমাবদ্ধতার কথা বলা হয়েছিল। ‘Very good behavior… modesty, frankness and good-natured disposition… commendable endeavor, supported by good talents’। সার্টিফিকেটে বলা হয়েছিল—রোমান ঐতিহাসিক টাইটাস লিভিয়াস (Titus Livius), রোমান স্টেটস্‌ম্যান মার্কাস টুলিয়াস সিসেরো (Marcus Tullius Cicero), রোমান কবি ভার্জিল (Publius Vergilius Maro) ও রোমান লিরিক কবি হোরেস (Quintus Horatius Flaccus)-এর লেখা অনুধাবনে তাঁর কোনও সমস্যা হতো না ও তাঁদের লেখা তিনি খুব ভালোভাবে জার্মান ভাষায় অনুবাদ করতে পারতেন। কিন্তু ল্যাটিন গ্রামারে তিনি খুব সাফল্য দেখাতে পারেননি। গ্রিক ভাষার মরফোলজি ও সিনটেক্সে তিনি যথেষ্ট জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। গ্রিক ভাষায় সরল গদ্য লেখকদের লেখা এবং হোমার ও ইউরিপিদিস-এর লেখাও তিনি ভালো অনুবাদ করতে পারতেন। প্লেটোনিক ডায়ালগগুলির অনুধাবনে ও ব্যাখ্যায় তিনি যথেষ্ট দক্ষতা দেখিয়েছিলেন। জার্মান ভাষায় প্রবন্ধ রচনার ক্ষেত্রে তাঁর উন্নতি ছিল সন্তুষ্ট করার মতো। প্রবন্ধগুলি ছিল বিষয়-সমৃদ্ধ, স্বাধীন চিন্তায় পূর্ণ ও বেশিরভাগ অংশই অত্যন্ত সুসজ্জিত। অভিব্যক্তি ছিল অনুভবনীয়। জার্মান ক্লাসিক্স ও জার্মান সাহিত্যের ইতিহাস বিষয়ে তাঁর উৎসাহ ছিল শ্লাঘনীয়। তিনি ক্রিশ্চিয়ান চার্চের ইতিহাসের মূল উপাদানগুলিকে ও ইভানজেলিক্যাল চার্চের মতবাদকে অনুধাবনে সক্ষম ছিলেন। নিউ টেস্টামেন্টের মূল বয়ান পড়ার অভিজ্ঞতা তাঁর ছিল। ইতিহাস ও ভূগোলে তাঁর স্বচ্ছ ধারণা ছিল। গণিত ও পদার্থবিদ্যায় তাঁর জ্ঞান ছিল সন্তোষজনক। মনস্তত্ত্ব বিষয়ে তিনি ছিলেন উৎসাহী শ্রোতা।[৬]


পারিবারিক ব্যবসায়ে:

জিমন্যাসিয়াম থেকে বেরুবার পর, তাঁর বাবা তাঁকে পারিবারিক ব্যাবসার সঙ্গে যুক্ত করেন। সেখানেও তিনি ধনতান্ত্রিক বিশ্বের বাস্তব কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে জ্ঞানার্জন শুরু করেন। তাঁর বাবার অফিসে এক বছর কাজ করার পর তিনি সমুদ্র-বন্দর ব্রেমেনে কাজ করতে যান ১৮৩৮-এর গ্রীষ্মকালে। সেখানে তিনি হারিনরিখ লিওপোল্ড-এর বৈদেশিক বাণিজ্য বিষয়ক ফার্মে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। এখানে তিনি কবিতা, সাহিত্য সমালোচনা ও অন্যান্য বিষয়ে লেখা শুরু করেন। লক্ষ করার বিষয়: এঙ্গেলসের থেকে আড়াই বছরের বড় মার্কসের প্রথম ও শেষ কবিতা ছাপা হয়েছিল—১৮৪১-এর ২৩ জানুয়ারি এবং এঙ্গেলসের কবিতা ছাপা শুরু হয়েছিল—১৮৩৮-এর ১৬ সেপ্টেম্বর। ব্রেমেনে তিনি একটি কোরাল গ্রুপে যোগ দেন। নিয়মিত কনসার্টে ও থিয়েটারে যেতেন। বিটোভেনের কম্পোজিশনকে তিনি জার্মান সাংগীতিক পরম্পরায় সর্বোচ্চ স্থান দিতেন। তিনি সবথেকে বেশি পছন্দ করতেন, ইরোটিকা ও পঞ্চম সিম্ফনি। ১৮৪১-এর ৮ মার্চ তিনি তাঁর বোন মারি এঙ্গেলসকে লিখলেন:

There is one thing in which you are less fortunate than I. You cannot hear Beethoven’s Symphony in C Minor today, Wednesday, March 10, while I can. This and the Eroica are my favourites. Practise Beethoven’s sonatas and symphonies well, so that I shan’t be ashamed of you later on. I am going to hear them not just in the piano arrangement, but played by the full orchestra. March 11. What a symphony it was last night! You never heard anything like it in your whole life if you don’t know this wonderful work. What despairing discord in the first movement, what elegiac melancholy, what a tender lover’s lament in the adagio, what a tremendous, youthful, jubilant celebration of freedom by the trombone in the third and fourth movements! Besides this I also heard a wretched Frenchman sing yesterday and it went something like this: […][৭]


এঙ্গেলসের হস্তলিখিত নোটেশন:

সে-ই সময়ে তিনি নিজেই কিছু কম্পোজিশনের চেষ্টা করেছিলেন। তিনি শেলির কবিতা ও শেক্সপিয়েরের নাটক নিয়ে চর্চা করতেন। পরবর্তী জীবনে মার্কসের পরিবারের সঙ্গে তিনিও শেক্সপিয়ের-চর্চায় যুক্ত থাকতেন। এই সময়ে তিনি গভীরভাবে দর্শন ও ধর্মতত্ত্ব চর্চা করেছিলেন। যা পরবর্তী সময়ে তাঁর বৌদ্ধিক বিকাশে সাহায্য করেছিল। যাঁদের লেখাজোখা নিয়ে তিনি এই সময়ে চর্চা করেছিলেন তাঁরা হলেন: ফ্রিডরিখ শ্লায়ারমাকর (Friedrich Schleiermacher), হাইনরিশ লিও (Heinrich Leo), ফ্রিডরিখ অগুস্ট থোলুক (Friedrich August Tholuck), এয়ার্নস্ট উইলহেল্ম হেংস্টেনবার্গ (Ernst Wilhelm Hengstenberg), অগুস্ট নিয়ান্ডার (August Neander), ডেভিড ফ্রিডরিখ স্ট্রাউস (David Friedrich Strauss) ও জর্জ উইলহেল্ম ফ্রিডরিখ হেগেল (George Wilhelm Friedrich Hegel)। এই চর্চার পরিণতিতে তিনি ঈশ্বর-বিশ্বাস হারালেন।[৮]


দর্শনচর্চা:

১৮৪১-এ তিনি মিলিটারির আর্টিলারি বিভাগে স্বেচ্ছাসেবেক হিসেবে এক বছরের জন্য যোগদান করেন। ১৬ এপ্রিল ১৮৪২-এ চিঠিতে মারি-কে তাঁর ট্রেনিং বিষয়ে বর্ণনা দিচ্ছেন। তার মধ্যে এক জায়গায় লিখছেন:

When the 12th Guards Artillery Company, to which I belong, and which is also electric, but negative, arrives there, positive and negative electricity collide, causing confusion and chaos in the atmosphere and attracting the clouds.[৯]

আবার ৮ আগস্ট ১৮৪২ তারিখে মারি-কে লিখছেন:

I too have to suffer being growled and shouted at by my Captain [Von Wedell] and think to myself: who cares, and cock a snook at him. And when he makes things too hard for me, as he did last Wednesday when everyone was dismissed except me, simply because my orderly had not got me excused, and I had to go to the artillery range at 12 noon just to see some impossible piece of nonsense not carried out–in such cases I just report sick, this time with toothache, and so save myself a night march and a two-hour exercise. Unfortunately, I have to report back for duty again today.[১০]

এইরকম আরও ৪-৫টি চিঠি থেকে থেকে বোঝা যায়, সামরিক প্রশিক্ষণ ও এই বিষয়ে জ্ঞানার্জনকেও এঙ্গেলেস অন্যান্য বিষয়ের বিদ্যাচর্চার মতোই গুরুত্ব সহকারেই নিচ্ছেন। পাশাপাশি তিনি বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে অডিট কোর্সের জন্য নিজের নাম নথিভুক্ত করছেন। বার্লিনে আসার পরে তিনি ফিলিপ মারহাইনেক (Philipp Marheineke)-এর হেগেলের ধর্মীয় দর্শন, লিবারেল হেগেলিয়ান ফার্দিনান্দ বেনারি (Ferdinand Benary)-এর ক্রিশ্চিয়ানিটির উৎপত্তি, বৃদ্ধ হেগেলিয়ান লিওপোল্ড ফন হেনিং (Leopold von Henning)-এর প্রুশিয়ার অর্থনৈতিক নীতি সম্পর্কে বক্তৃতা শুনছেন। আরও দুজন হেগেলিয়ান গিয়র্গ আন্ড্রিয়াস গাবলার (Georg Andreas Gabler) ও কার্ল ফ্রিডরিখ ভার্ডার (Karl Friedrich Werder) বক্তৃতাও শুনছেন। বার্লিনে প্রথমদিকে তিনি কবিতা ও প্রবন্ধ লেখা শুরু করলেও ১৮৪২-এর জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিনি সাহিত্যচর্চা ও লেখা স্থগিত রাখেন এবং দর্শনচর্চা করেন। সে-ই সময়ে তিনি হেগেলের ‘ফেনোমেনোলজি’, ‘সায়েন্স অব লজিক’; কান্টের ‘ক্রিটিক অব পিওর রিজন’, ‘প্রোলিগোমিনা’, ‘পারপিচুয়াল পিস’; ফয়েরবাখের ‘এসেন্স অফ ক্রিশ্চিয়ানিটি’ পড়লেন। মার্কস যে ইয়াং হেগেলিয়ান-গোষ্ঠীর সঙ্গে ১৮৩৭ থেকে ১৮৪১ পর্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন, তাঁদের সঙ্গেই বার্লিন-পর্বে এঙ্গেলসও যুক্ত হন। অবশ্য এই ক’বছরে উক্ত গোষ্ঠীর কয়েকজনের মতামত বদলে গিয়েছিল। সে-ই সময়ে তিনি লেফট হেগেলিয়ানদের বিরুদ্ধে ফ্রিডরিখ শেলিং (Friedrich Wilhelm Joseph Schelling)-এর সমালোচনার উত্তর দিয়েছিলেন। বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে শেলিং যে বক্তৃতা দিতেন, এঙ্গেলস সে-ই সভায় উপস্থিত থাকতেন। এই বক্তৃতাগুলি শোনার সময়ে এঙ্গেলস যে নোট নিয়েছিলেন, তার ভিত্তিতে তিনি ‘শেলিং অন হেগেল’ প্রবন্ধটি লিখেছিলেন। এরপরে ১৮৪২-এ তিনি ‘শেলিং অ্যান্ড রিভিলেশন’ শিরোনামে একটি পুস্তিকা লেখেন।[১১]

সামরিক বাহিনীতে তাঁর এক বছরের কাজের পরে, এঙ্গেলেস ১৯৪২-এর অক্টোবরে গোলন্দাজ সৈনিকের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পেলেন। তাঁর বাহিনীর কমান্ডার—তাঁর কাজ সম্পর্কে সপ্রশংস শংসাপত্র দিয়েছিলেন: ‘ইন হিজ পারসোনাল বিহেভিয়ার, অ্যাজ ওয়েল অ্যাজ ইন হিজ মিলিটারি পারফরমেন্স।’ সৈনিকের কাজ থেকে মুক্তি পাবার পরই তিনি বার্লিন থেকে ব্রেমেন-এর উদ্দেশ্যে রওনা হন। পথে কোলোনে ‘রাইনিশ জ়াইটুং’ (Rheinische Zeitung) পত্রিকার সম্পাদকদের (হেস, রাভে ও রুটেনবার্গ) সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য থামেন। সে-ই সময়ে মার্কস কোলোনে ছিলেন না। কিছুদিন পরে মার্কস পত্রিকার রাজনৈতিক সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মোসে হেস এঙ্গেলসের পরিণত রাজনৈতিক ভাবনা দেখে, আকর্ষিত হন ও সমসাময়িক বাস্তবতা সম্পর্কে তাঁর সঙ্গে বিস্তৃত আলোচনা করেন। মোসে হেস একাই তাঁকে কমিউনিজমে দীক্ষিত করেছিলেন কিনা তা আমরা বলতে না পারলেও, এ কথা কিন্তু ঠিক যে, ‘রাইনিশ জ়াইটুং’ পত্রিকায় মোসে হেস-এর সাম্যবাদ বিষয়ক লেখাগুলি এঙ্গেলসকে প্রভাবিত করেছিল। ১৮৪৩-এ অবশ্য এঙ্গেলস স্বীকার করেছিলেন যে, হেস-ই তাঁর সঙ্গে ও তাঁর ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে কমিউনিজম-এর পরিচয় ঘটান। ১৮৪২-এ এঙ্গেলসের বাবা তাঁকে ম্যানচেস্টার পাঠিয়ে দেন। তাঁর পদোন্নতি ঘটে ‘জেনারেল অ্যাসিসটেন্ট’ হিসেবে। সেখানে তাঁকে উন্নত ইংলিশ কমার্শিয়াল ট্রেনিং-এর জন্য পাঠানো হয়েছিল। এঙ্গেলস ইংল্যান্ড রওনা দিয়েছিলেন, এক গভীর আশা নিয়ে। তিনি ততদিনে পড়া ও শোনার মধ্যে দিয়ে বুঝে নিয়েছিলেন, জার্মানি বা ফ্রান্সের তুলনায় ইংল্যান্ডের শ্রমিক আন্দোলন অনেক এগিয়ে আছে। তিনি অনুভব করছিলেন, তাঁর নিজের দেশের অবস্থা হলো: ‘…a condition of archaic apathy, and is still in its social infancy, is not even a proper society, there’s no life, no consciousness, no action!’

সে-ই সময়ে ইয়ং হেগেলিয়ানরা নিজেদের আদর্শ নিয়ে নিজেরাই মনোযোগী ছিলেন। অন্যদিকে মার্কস, হেস ও তার সমর্থকরা সমাজতন্ত্রের দিকে সমাজ পরিবর্তনের বিষয়ে উদ্‌বিগ্ন ছিলেন। তাঁরা এই সময়ে এমন একটি পত্রিকা চাইছিলেন, যেখানে বিমূর্ত দার্শনিকীকরণের বদলে রাজনৈতিক আলোচনা ও সক্রিয়তাই প্রাধান্য পাবে। এই সংকটকালে মার্কস ও এঙ্গেলসের প্রথম সাক্ষাত হলো। [১২]


ম্যানচেস্টার পর্ব:

১৮৪২ থেকে ১৮৪৪ পর্যন্ত এঙ্গেলস ম্যানচেস্টারে তাঁর বাবার আংশিক মালিকানাধীন কোম্পানিতে কাজ করেন। এই সময়ে তিনি ‘রাইনিশ জ়াইটুং’ পত্রিকায় নিয়মিত না লিখলেও, ‘শোয়াইজ়েরিশের রিপাবলিকানের’ (Schweizerischer Republikaner) পত্রিকায়, রবার্ট ওয়েনের ‘The New Moral World’, রুগে ও মার্কস-এর ‘ডয়শ-ফ্রানজ়োসিশ য়ার্বুশার’ (Deutsch-Franzosische Jahrbucher) ও ‘ফরভার্টস’ (Vorwarts) পত্রিকায় নিয়মিত প্রবন্ধ লিখেছেন।

এই পর্বে এঙ্গেলসের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ: ‘আউটলাইন্‌স অব এ ক্রিটিক অব পলিটিকাল ইকোনমি’। লেখাটি তিনি লিখেছিলেন—১৮৪৩-এর শেষ থেকে ১৮৪৪-এর জানুয়ারির মধ্যে, ও তা প্রকাশিত হয়েছিল—‘ডয়শ-ফ্রানজ়োসিশ য়ার্বুশার’ (Deutsch-Franzosische Jahrbucher) পত্রিকায়। লেখাটি সম্পর্কে মার্কস তাঁর অর্থনীতি বিষয়ক পঞ্চম নোটবুকে ১৮৪৪-এর প্রথমার্ধে লিখেছিলেন:

Private property. Its immediate consequence–trade–like every activity, is a direct source of gain for the trader. The next category to which trade gives rise is value. Abstract real value and exchange-value. For Say utility is the determining feature of real value, for Ricardo and Mill the cost of production. For the Englishmen, competition as against the cost of production represents utility; for Say, it is the cost of production. Value is the ratio of the production costs to utility. Its immediate application: the decision whether to produce at all, whether utility outweighs the cost of production. The practical application of the concept of value is limited to the decision about production. The distinction between real value and exchange-value is based on the fact that the equivalent given in trade is no equivalent. Price: the relationship [between] cost of production and competition. Only that which can be monopolised has price. Ricardo’s definition of rent of land is incorrect because it presupposes that a fall in demand instantly reacts on rent and at once puts out of cultivation a corresponding quantity of the worst cultivated land. This is incorrect. This definition leaves out competition, that of Adam Smith leaves out fertility. Rent is the relationship between productivity of the soil and competition. The value of land [Engels stipulates: provided private property is abolished–Ed.] is to be measured by the productiveness of equal areas using equal amounts of labour.[১৩]

মার্কসের এই নোটটির সূত্রে বোঝা যায়—বইটি প্রকাশের প্রায় ১৪-১৫ বছর পরে ১৮৫৮-র আগস্ট থেকে ১৮৫৯-এর জানুয়ারির মধ্যে, মার্কস লিখেছিলেন তাঁর যুগান্তকারী লেখা: ‘এ কন্ট্রিবিউশন টু দ্যা ক্রিটিক অব পলিটিকাল ইকোনমি’। ডেভিড ম্যাকলেনন বলেছিলেন: মার্কস এই বইটি পড়ার পরে ‘মার্কড দ্যা রিয়েল বিগিনিং অব হিজ লাইফলং ইন্টারেস্ট ইন ইকোনমিক কোয়েশ্চেন্স’।[১৪]এঙ্গেলসের উক্ত বইটিকে কেন্দ্র কোরে মার্কস ও এঙ্গেলসের এই যে ইন্টেলেকচুয়াল পার্টনারশিপের নিদর্শন আমরা পাই তা মার্কসের মৃত্যু পর্যন্ত অটুট ছিল।

এঙ্গেলস তাঁর ‘আউটলাইন্‌স অব এ ক্রিটিক অব পলিটিকাল ইকোনমি’-তে সে-ই সময়ে, এই বিষয়ের যেসব ধ্রুপদি লেখকদের মতামতের সঙ্গে নিজের বোঝাপড়া সম্পন্ন করেছিলেন, তাঁরা হলেন: অ্যাডাম স্মিথ (Adam Smith), ডেভিড রিকার্ডো (David Ricardo), জে আর ম্যাক্‌কালক (J. R. McCulloch)‌, জে বি এস (Jean-Baptiste Say), জেমস মিল (James Mill), থমাস ম্যালথাস (Thomas Robert Malthus)। আমরা যদি উক্ত বইটি থেকে দেওয়া নীচের উদ্ধৃতিগুলি পড়ি, তাহলেই দেখবো যে, মার্কসীয় রাজনৈতিক-অর্থনীতির কয়েকটি মৌলিক সিদ্ধান্তে এঙ্গেলস পৌঁছে যাচ্ছেন, সে-ই ১৮৪৪-এই:

1.”The art of the economists, therefore, consisted in ensuring that at the end of each year exports should show a favourable balance over imports; and for the sake of this ridiculous illusion thousands of men have been slaughtered! Trade, too, has had its crusades and inquisitions.

2.”The eighteenth century, the century of revolution, also revolutionised economics. But just as all the revolutions of this century were one-sided and bogged down in antitheses–just as abstract materialism was set in opposition to abstract spiritualism, the republic to monarchy, the social contract to divine right–likewise the economic revolution did not get beyond antithesis. The premises remained everywhere in force: materialism did not attack the Christian contempt for and humiliation of Man, and merely posited Nature instead of the Christian God as the Absolute confronting Man. In politics no one dreamt of examining the premises of the state as such. It did not occur to economics to question the validity of private property.

3.”The immediate consequence of private property is trade… In every purchase and sale, therefore, two men with diametrically opposed interests confront each other. The confrontation is decidedly antagonistic, for each knows the intentions of the other–knows that they are opposed to his own. Therefore, the first consequence is mutual mistrust, on the one hand, and the justification of this mistrust–the application of immoral means to attain an immoral end–on the other.

4.”If we abandon private property, then all these unnatural divisions disappear. The difference between interest and profit disappears; capital is nothing without labour, without movement. The significance of profit is reduced to the weight which capital carries in the determination of the costs of production, and profit thus remains inherent in capital, in the same way as capital itself reverts to its original unity with labour.

5.”In the struggle of capital and land against labour, the first two elements enjoy yet another special advantage over labour–the assistance of science; for in present conditions science, too, is directed against labour.”[১৫]

দর্শন ও কবিতাচর্চা থেকে সরে এসে খুব দ্রুত সমসাময়িক রাজনৈতিক-অর্থনীতির চিন্তকদের অবদানগুলিকে আত্তীকৃত করে নেবার যে দক্ষতা এঙ্গেলস দেখিয়েছিলেন, তা সত্যই বিস্ময়কর। এই সময়ে তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয় মেরি বার্নস-এর। তাঁরা দুজনে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ না হলেও সারাজীবন একসাথে থেকেছেন। তিনি এঙ্গেলসের পরিচারিকার কাজ করতেন। তার আগে কারখানার শ্রমিক ছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষার সুযোগ পাননি। তাঁরা দুজনেই বুর্জোয়া-ব্যবস্থায় বিবাহ প্রথার বিরোধী ছিলেন। মেরি বার্নস-এর সূত্রে এঙ্গেলস ম্যানচেস্টারের সর্বহারাদের সঙ্গে সরাসরি পরিচিত হবার সুযোগ পান। যা তাঁর ‘দ্য কন্ডিশন অব দ্য ওয়ার্কিং ক্লাস ইন ইল্যান্ড’ বইটির প্রেক্ষাপট রচনা করে দিয়েছিল। এই বইটিকে ডেভিড ম্যাকলেনন আধুনিক আরবান ভূগোল ও সমাজবিদ্যা চর্চার ‘পাওনিইয়ারিং ওয়ার্ক’ হিসেবে বিবেচনা করেছেন।[১৬] এরপরে এঙ্গেলস ও মার্কস যৌথভাবে লেখেন: ‘দ্য হোলি ফ্যামিলি’ (১৮৪৪), ‘দ্য জার্মান আইডিওলজি’ (১৮৪৬) ও ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’ (১৮৪৮)।


জার্মান বিপ্লব:

১৮৪৮-এ ইয়োরোপের বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক অভ্যুত্থান ঘটে। বিভিন্ন দেশে এই অভ্যুত্থানকে স্প্রিংটাইম অফ পিপল্‌স বা স্প্রিংটাইম অফ নেশন্‌স বলা হয়। এই অভ্যুত্থানগুলির চরিত্র ছিল গণতান্ত্রিক ও উদারবাদী এবং উদ্দেশ্য ছিল—রাজতন্ত্রকে অপসারণ কোরে স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র গঠন। এই সূত্র ধরেই জার্মানিতে শুরু হয়েছিল মার্চ বিপ্লব। জার্মান কনফেডারেশনের বিভিন্ন রাজ্যে এই প্রতিবাদ ও বিদ্রোহগুলি ছিল অত্যন্ত অসংগঠিত ও ঢিলেঢালা। এই বিদ্রোহগুলির একটি কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল প্যান-জার্মানিজ্‌ম।

৩৯-টি স্বাধীন রাষ্ট্রের কনফেডারেশনের মধ্যে যে স্বৈরতান্ত্রিক রাজনৈতিক কাঠামো বিদ্যমান ছিল তার বিরুদ্ধে জনরোষ গর্জে উঠেছিল। এই ক্রিটিক্যাল জাংচারে বা সংকটপূর্ণ সন্ধিক্ষণে মার্কস ও এঙ্গেলস জার্মানিতে চলে এলেন। সেখানে তাঁরা ও আরও কয়েকজন মিলে ‘নয়এ রাইনিশ জ়াইটুং: পোলিটিশ-ওকোনমিশ রেভ্যু’ (Neue Rheinische Zeitung: Politische-okonomische Revue) প্রকাশ শুরু করেন। যার প্রথম সংখ্যাটি প্রকাশিত হয় ৩১ মে ১৮৪৮ ও শেষ সংখ্যাটি প্রকাশিত হয় ১৯ মে ১৮৪৯। মার্কস ছিলেন প্রধান সম্পাদক। এই পত্রিকায় এঙ্গেলস প্রচুর লেখেন ও সম্পাদনার কাজেও সাহায্য করেন।[১৭] এই সময়ে তাঁর লেখাগুলির মধ্যে কয়েকটি হলো: ‘দ্য ফ্রাঙ্কফুর্ট অ্যাসেম্বলি’, ‘দ্য মোস্ট রিসেন্ট হিরোইক ডিড অব দ্য হাউস অব বোরবন’, ‘দ্য ওয়র কমেডি’, ‘দ্য নিউ পার্টিশন অব পোল্যান্ড’, ‘দ্য বার্লিন ডিবেট অ্যাবাউট দ্য রেভোলিউশন’, ‘দ্য আর্মিস্টিক উইথ ডেনমার্ক’, ‘দি ইটালিয়ান স্ট্রাগল ফর দ্য লিবারেশন’, ‘দি আপরাইজিং ইন ফ্রাঙ্কফুর্ট’, ‘দ্য নিউ অথরিটিস-প্রোগ্রেস ইন সুইৎজ়ারল্যান্ড’, ‘দ্য পার্সোনালিটিস অব দ্য ফেডেরাল কাউন্সিল’।[১৮]

এঙ্গেলস তাঁর গুরুত্বপূর্ণ লেখাগুলি লিখেছিলেন—প্রধানত ম্যানচেস্টার-পর্বের আগে বা পরে। এই পর্বে তিনি প্রচুর বই পড়েছেন ও লেখাজোখা সংগ্রহ করেছেন, মার্কসকে লেখার কাজে সাহায্য করার জন্য ও শ্রমিক শ্রেণির মুখপত্র হিসেবে পরিচালিত হতো যেসব পত্রিকা—তাদের সহায়তা দেবার জন্য। পত্রিকাগুলির মধ্যে রয়েছে: চার্টিস্ট জার্নাল ‘The People’s Paper’ ও লাসালেপন্থী পত্রিকা ‘Social-Demokrat’। এঙ্গেলস এই সময়ে মিলিটারি হিস্ট্রি ও আর্ট অফ ওয়ার-এর সমসাময়িক প্রবণতা সম্পর্কেও গভীরভাবে চর্চা করেন।


সামরিকবিদ্যা চর্চা:

১৮৫১-র মধ্যভাগ থেকে এঙ্গেলসের এই চর্চা শুরু হয়। এই চর্চার কাজে তাঁকে প্রথম সাহায্য করতেন একজন প্রাশিয়ান, লেফটেনেন্ট যোসেফ হ্বয়েদিমেয়ার। পরে তিনি আমেরিকায় চলে যান ও অমেরিকান সেনাবাহিনীর কর্নেল হন। তার আগে ১৮৪৮-এ মার্কসের সঙ্গে কোলোনে চার্লস অ্যান্ডারসন ডানা (Charles Anderson Dana)-র সাক্ষাৎ হয়েছিল। ডানা ১৮৬২ পর্যন্ত ‘নিউইয়র্ক ট্রিবিউন’ পত্রিকার ম্যানেজিং এডিটর ছিলেন, তিনি মার্কসকে অনুরোধ করেছিলেন, ‘Putnam’s Monthly’ পত্রিকায় ইয়োরোপের বিভিন্ন দেশের সৈন্যবাহিনী সম্পর্কে লেখা দিতে। তার জন্য তাঁকে ১০ পাউন্ড পারিশ্রমিক দেবার প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছিল। তখন, মার্কস এঙ্গেলসের সাহায্য চান। বিষয়টি বোঝা যায় ১৮৫৫-র ১৫ জুন, এঙ্গেলসকে লেখা মার্কসের একটি চিঠি থেকে:

Your article just arrived (4 o’clock in the afternoon). […] From Dana’s letter, enclosed herewith, you will see that he is asking for 1. a column on the Prussian army for the Tribune, 2. a sheet on all the European armies for Putnam’s Review. If you have no time to do the latter, you must send me the material and I shall have to do it. It is true that, in the latter case, my unfamiliarity with the subject would make for a sorry result, but I cannot let slip the £10 to be earned in this way, for, on the one hand, no money is yet coming in from the legacy and, on the other, expenses have been very heavy ; added to which there has been a loss of earnings, since the worthy Dronke did not keep the Neue Oder-Zeitung supplied during my absence (despite his promise) and, as to the Tribune itself, there was still an overdraft outstanding (only cleared off by today’s poste).[১৯]

এই ঘটনার পরে, এঙ্গেলসের কাছ থেকে পাওয়া গেল তিনটি বড় প্রবন্ধ, যেগুলি ১৮৫৫-র আগস্ট থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ছাপা হয়েছিল। যেখানে আলোচনা বৃহৎ শক্তিগুলির সৈন্যবাহিনী সম্পর্কেই শুধু নয়, সে-ই সঙ্গে বাভারিয়া, স্যাক্সনি, তুর্কি, সার্দিনিয়া, পর্তুগাল ও নেদারল্যান্ড-এর সৈন্যবাহিনী সম্পর্কেও বিস্তৃত ছিল। এই যে প্রক্রিয়া শুরু হলো তার পরিণতি হিসেবে ১৮৫৮ থেকে ১৮৬৩-র গোড়ার মধ্যে, এঙ্গেলসের ৬৩-টি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় সামরিক বিদ্যা বিষয়ে। ডানা পরে আবার মার্কসকে অনুরোধ করেন, একক ভাবে লেখা দেবার জন্য। মার্কস সামরিক ব্যক্তিত্বদের জীবনী সম্পর্কে ১০টি লেখা লেখেন। পাশাপাশি এঙ্গেলসের সঙ্গে ৮টি। এই সময়ে ১৮৫৭-র মধ্যভাগ থেকে ১৮৫৮-র শুরুর দিক পর্যন্ত এঙ্গেলস স্ক্রফুলা রোগে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থতার মধ্যেও উক্ত লেখাগুলির জন্য মার্কসকে সাহায্য কোরে গেছেন। পাশাপাশি মার্কসও ব্রিটিশ মিউজিয়াম থেকে তথ্য সংগ্রহ করছিলেন ও এঙ্গেলসকে তা পাঠিয়ে গেছেন। মার্টিন বার্জার তাঁর ‘এঙ্গেলস, আর্মিস অ্যান্ড রেভোলিউশন’ বইতে মন্তব্য করেছেন: ‘ইন এ হিস্ট্রি অব দ্য নাইটিন্থ সেঞ্চুরি কমপ্লাইড বাই এ ট্রুলি সিঙ্গেল মাইন্ডেড মিলিটারি বাফ মার্কস উড ফিগার অনলি অ্যাজ এঙ্গেলস রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট।’

এঙ্গেলস এককভাবে ১৮৫৩ থেকে ১৮৫৬-র মধ্যে ৬২টি প্রবন্ধ লেখেন, ক্রিমিয়ার যুদ্ধ সম্পর্কে। লেখাগুলির বেশিরভাগই প্রকাশিত হয়েছিল ‘নিউ-ইয়র্ক ডেইলি ট্রিবিউন’ ও ‘নয়এ ওর্ড-জ়াইটুং’ (Neue Ored-Zeitung) পত্রিকায়। তখন এক কঠিন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে ইতালি একীকরণের দিকে যাচ্ছিল। এঙ্গেলস এই বিষয়ে দুটি পুস্তিকা লেখেছিলেন—‘পো অ্যান্ড রাইন’ (১৮৫৯) ও ‘স্যাভয়, নাইস অ্যান্ড দ্য রাইন’ (১৮৬০)। মার্কস ও এঙ্গেলস ভারতে সিপাহী বিদ্রোহ বিষয়ে গভীরভাবে চর্চা করেছিলেন ও লিখেছিলেন। মার্কস-ই প্রথম সিপাহী বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। ১৮৭০ থেকে ১৮৭১-এর মধ্যে এঙ্গেলস ৫৯টি প্রবন্ধ লিখেছিলেন, ফ্রাঙ্কো-প্রুশিয়ান যুদ্ধ সম্পর্কে, যেগুলি প্রকাশিত হয়েছিল ‘Pall Mall Gazette’ পত্রিকায়। জীবনের পরবর্তী সময়ে এঙ্গেলসের সমরবিদ্যা সম্পর্কিত লেখা কমে আসে।[২০]


ম্যানচেস্টার-উত্তর পর্ব:

ম্যানচেস্টারে এঙ্গেলস যে পারিবারিক কারখানায় কাজ করতেন, সেখান থেকে অবসর নিলেন ১৮৬৯-এর ৩০ জুন। সে-ই সময়ে তাঁর ম্যানচেস্টারের বাড়িতে ছিলেন কার্ল মার্কসের কন্যা এলিওনর মার্কস। প্রায় কুড়ি বছর পরে ১৮৯০-তে এঙ্গেলসের সত্তর বছর পূর্তি উপলক্ষে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এলিওনর লিখেছেন: “এঙ্গেলসের মতো অমন একজন ব্যক্তিকে যে জীবনের বিশটা বছর ওইভাবে কাটাতে হয়েছে (ম্যানচেস্টারের কারখানার কাজে) এ কথা চিন্তা করলেও আতঙ্কিত হতে হয়। অথচ এজন্য যে তিনি কোনোদিন কোনোরকম অনুযোগ করেছেন বা টুঁ-শব্দটি করেছেন তা কিন্তু নয়।” কিন্তু তিনি যে ম্যানচেস্টারে তাঁর ব্যবসায়িক কাজে সন্তুষ্ট ছিলেন না, তা এলিওনর-এর লেখা থেকে বোঝা যায়: “শেষ দিন অফিস যাওয়ার আগে সকালবেলায় টপ-বুট পড়ার সময়ে সেই-যে তিনি বলে উঠেছিলেন ‘বাব্বা বাঁচা গেল, এই শেষবারের মতো’ তাঁর মুখে জয়ের উদ্ভাসের সেই দীপ্তি আমি জীবনে কোনোদিন ভুলব না।” বাড়ি ফেরার সময়ে এঙ্গেলসের আনন্দময় অভিব্যক্তির কথা এলিওনর লিখেছেন এই ভাবে: “এর কয়েক ঘণ্টা পরে ওইদিন বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে আমরা ওঁর আসার অপেক্ষা করছিলাম। হঠাৎ বাসাবাড়ির সামনের ছোট্ট মাঠটা পার হয়ে আসতে দেখলুম ওঁকে। উনি আসছিলেন হাতের ছড়িখানা হাওয়ায় দোলাতে দোলাতে আর গান গাইতে গাইতে। মুখখানি আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল।”[২১]

এরম্যান অ্যান্ড এঙ্গেলস-এর বাণিজ্যিক পেশাগত দায়িত্ব থেকে মুক্তি পাবার পর ১৮৭০-এর ২০ সেপ্টেম্বর তিনি স্থায়ীভাবে ম্যানচেস্টার থেকে লন্ডনে চলে এলেন। লন্ডনে তাঁর বাড়িটি ছিল হাঁটা পথে মার্কসের বাড়ি থেকে দশ মিনিট দূরত্বে। মার্কসের জামাই পল লাফার্গ বলেছিলেন, তার পর থেকে তাঁদের দুজনার প্রতিদিন দেখা হতো।


প্রথম আন্তর্জাতিকে বিতর্ক ও ‘বাস-সংস্থান সমস্যা’:

১৮৬৪-তে ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্কিংম্যান্‌স অ্যাসোসিয়েশন বা প্রথম আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠার পর ১৮৬৫-তে এঙ্গেলস তাঁর সদস্য হয়েছিলেন। তার পরে তিনি প্রথম আন্তর্জাতিকের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন ও আন্তর্জাতিকের ভিতরে বিভিন্ন বিতর্কে অংশ নিয়েছেন। প্রুঁধোপন্থীদের সঙ্গে মার্কস ও তাঁর অনুগামীদের বিতর্কের পরিণতিতে আমরা পেয়েছি এঙ্গেলসের ‘বাস-সংস্থান সমস্যা’ (The Housing Question) বইটি। জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির মুখপত্র ‘ফোক্সটাট’ (Volksstaat) পত্রিকায় এঙ্গেলসের তিনটি লেখা ছাপা হয়েছিল। এই তিনটি প্রবন্ধ একত্রে ‘বাস-সংস্থান সমস্যা’ নামে প্রকাশিত হয়। ১৮৮৭-এর ১০ জানুয়ারি ‘বাস-সংস্থান সমস্যা’ বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। বইটির ভূমিকায় এঙ্গেলস জার্মানির অভিজ্ঞতা থেকে দেখিয়েছেন: প্রাচীন সংস্কৃতিসম্পন্ন একটি দেশে হস্তশিল্প কারখানা ও ক্ষুদ্রায়তন উৎপাদন-ব্যবস্থা থেকে বৃহদায়তন শিল্পে উত্তরণের যুগটাই হলো সে-ই দেশে প্রধানত ‘বসতবাড়ির অভাবের’ যুগ। যে-শহরগুলি শিল্পকেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে, সে-ই শহরগুলির দিকে গ্রামের মজুররা হঠাৎ বিপুল সংখ্যায় আকৃষ্ট হতে থাকে। পাশাপাশি পুরানো শহরগুলির বাড়িঘরগুলি নতুন বৃহদায়তন শিল্প ও সে-ই সম্পর্কিত যোগাযোগ ব্যবস্থার পক্ষে অনুপযোগী হয়ে পড়ে। পুরানো রাস্তাগুলিকে চওড়া করা দরকার হয়ে পড়ে, নতুন রাস্তা বানাতে হয়, শহরের ভিতর দিয়ে রেল লাইন চালাতে হয়। শ্রমিকরা স্রোতের মতো শহরে প্রবেশ করতে থাকে। সে-ই সময়েই দরিদ্র মানুষদের ঘরবাড়ি ভেঙে ফেলা হয়। তার ফলে শ্রমিকদের ও তাদের কেনাকাটার ওপর নির্ভরশীল ছোটো ব্যবসায়ী ও কারবারীদের গৃহসংস্থানের হঠাৎ অভাব দেখা দেয়।

ম্যানচেস্টার, লীড্‌স, ব্র্যাডফোর্ড ও বারমেন-এলবের্ফেল্ডের মতো শহরগুলি একেবারে সূচনা থেকেই শিল্পকেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছিল। তাই এইসব শহরে গৃহ-সমস্যা প্রায় ছিল না। কিন্তু লন্ডন, প্যারিস, বার্লিন ও ভিয়েনার মতো শহরগুলিতে গৃহের অভাব তীব্র ছিল এবং এঙ্গেলস এই লেখার সময়েও তা তীব্র ছিল। জার্মানিতে শিল্প-বিপ্লবের পরে এই সমস্যা সমাধানের হাতুড়ে উপায় হিসেবে প্রুঁধোপন্থী আর্থার ম্যুলবের্গের ‘ভ্যুর্তেমবের্গের ম্যুলবের্গের’ (Mühlberger of Württemberg) নামে কয়েকটি প্রবন্ধ লেখেন ‘ফোক্সটাট’ (Volksstaat) পত্রিকায়। এঙ্গেলস এই ধরনের অদ্ভুত লেখা ছাপায় আপত্তি করার কারণে, পত্রিকার পক্ষ থেকে তাঁকে অনুরোধ করা হয় তার জবাব দেবার জন্য। এঙ্গেলস তার জবাব দেন। লেখাটিতে তিনি প্রুঁধো (Pierre-Joseph Proudhon)-র সর্বরোগহর চিকিৎসা-ব্যবস্থার অলৌকিক ফলাফল সম্বন্ধে—জার্মান শ্রমিকদের জ্ঞানবৃদ্ধি সম্পর্কে যে প্রস্তাব রেখেছিলেন, তা খণ্ডন করেন। প্রথম প্রবন্ধের কিছুকাল পরেই ডক্টর এমিল জাক্স (Emil Sax)-এর গ্রন্থের ভিত্তিতে বাসস্থানের সমস্যা সম্পর্কে হিতৈষীবাদী বুর্জোয়া দৃষ্টিভঙ্গীর সমালোচনা করেন। কিছুদিন বিরামের পর ম্যুলবের্গের এঙ্গেলসের বক্তব্যের একটা জবাব দেন। এঙ্গেলস তাঁর তৃতীয় প্রবন্ধটি লেখেন প্রত্যুত্তরে। এই তিনটি প্রবন্ধ মিলিয়ে এঙ্গেলসের ‘বাস-সংস্থান সমস্যা’ বইটি প্রকাশিত হয়। প্রুঁধোর তত্ত্বভাবনার প্রবল সমালোচক হলেও ইতিহাসের একটি পর্বে তাঁর ভূমিকার কথা এঙ্গেলস স্বীকার করেছেন। উক্ত ভূমিকায় তিনি লিখেছেন:

ইয়োরোপীয় শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে প্রুঁধো এতটা তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন যে, তিনি শুধু নিঃশব্দে বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যেতে পারেন না। তত্ত্বগতভাবে খণ্ডিত ও ব্যবহারিকভাবে পরিত্যক্ত হলেও প্রুঁধোর ঐতিহাসিক আকর্ষণ আজও অক্ষুণ্ণ। আধুনিক সমাজতন্ত্রের সঙ্গে যাঁরা কিছুটা খুঁটিয়ে পরিচিত হতে চান, এই আন্দোলনে ‘অতিক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গির’ সঙ্গে তাদের পরিচয় থাকাটাও প্রয়োজন।

এঙ্গেলস মনে করিয়ে দিয়েছেন, মার্কস তাঁর ফরাসি ভাষায় লেখা ‘দর্শনের দারিদ্র্য’ বইটি (১৮৪৭) প্রকাশ করেছিলেন, পিয়েরে-জোসেফ প্রুঁধো-র ‘দারিদ্র্যের দর্শন’ (১৮৪৬) বইটির সমালোচনা হিসেবে। প্যারিস ও ব্রাসেল্‌স থেকে। যেখানে ১৮৪৩ থেকে ১৮৪৯ পর্যন্ত তিনি নির্বাসিত হয়ে বসবাস করছিলেন। তারপরেই লিখছেন:

প্রুঁধোর বিনিময়-ব্যাংককে ভ্রুণাবস্থায় আবিষ্কার করে তার সমালোচনা ছাড়া মার্কস এই বইতে (দর্শনের দারিদ্র্য) আর বেশি কিছু করতে পারেননি। এই দিক থেকে তাই আমার বইটি দুর্ভাগ্যবশত যথেষ্ট অসম্পূর্ণভাবে মার্কসের রচনারই পরিপূরক স্বরূপ। মার্কস স্বয়ং এ কাজ করতে পারতেন অনেক ভালো এবং অনেক যুক্তিগ্রাহ্য রূপে।[২২]

এখানেও আমরা মার্কস ও এঙ্গেলসের ইন্টেলেকচুয়াল পার্টনারশিপের পরিচয় পাই। সে-ই সঙ্গে মার্কসের প্রতি এঙ্গেলসের স্বাভাবিক শ্রদ্ধার পরিচয়ও পাই। মার্কস সম্পর্কে এঙ্গেলস কী গভীরভাবে শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, তা তাঁর ‘লুডভিক ফয়েরবাখ ও চিরায়ত জার্মান দর্শনের অবসান’ বইয়ের একটি ফুটনোট থেকেও বোঝা যায়:

এখানে আমি একটি ব্যক্তিগত কথা ব্যাখ্যা করার অনুমতি চাইছি। সম্প্রতি এই মতবাদে আমার অংশ বিষয়ে বারবার উল্লেখ করা হয়েছে, তাই বিষয়টির নিষ্পত্তি হিসেবে আমি কয়েকটি কথা না বলে পারি না। আমি অস্বীকার করতে পারি না যে, চল্লিশ বছর ধরে মার্কসের সঙ্গে আমার সহযোগিতাকালে এবং তার আগেও এই মতবাদের ভিত্তি স্থাপনে, বিশেষত তার পরিবিস্তারে আমার কিছুটা স্বাধীন অবস্থান ছিল। কিন্তু বিশেষত অর্থনীতি ও ইতিহাসের ক্ষেত্রে তার প্রধান মৌলিক নীতিগুলির অধিকাংশই এবং সর্বোপরি এগুলির চূড়ান্ত সুতীক্ষ্ণ সূত্রায়ন—এটা মার্কসেরই কীর্তি। বড়জোর দুএকটি বিশেষ ক্ষেত্রে আমার রচনার কথা ছাড়া আমার যা অবদান তা আমাকে বাদ দিয়েও মার্কস অনায়াসে করতে পারতেন। কিন্তু মার্কস যা করে গিয়েছেন আমি তা কখনোই করতে পারতাম না। মার্কস ছিলেন আমাদের বাকি সকলের ঊর্ধ্বে, তাঁর দৃষ্টি ছিল আমাদের চেয়ে সুদূরপ্রসারী এবং নিরীক্ষণ ছিল ব্যাপকতর ও দ্রুততর। মার্কস ছিলেন প্রতিভাবান, বাকি আমরা বড়জোর বুদ্ধিমান। তাঁকে ছাড়া এ তত্ত্ব আজ যাতে পরিণত হয়েছে তা কিছুতেই সম্ভব হত না। তাই সঠিকভাবেই এ তত্ত্ব তাঁর নামাঙ্কিত।[২৩]

যাই হোক, এঙ্গেলসের ‘বাস-সংস্থান সমস্যা’ বইটি সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো: কিছু তাত্ত্বিক উচ্চারণের পাশাপাশি, ‘ইংল্যান্ডে শ্রমিক শ্রেণির অবস্থা’ বইতে তিনি যে বৃহত্তর ভৌগোলিক ক্যানভাস নির্মাণ করে তুলেছিলেন, আরবান স্যোশিওলজি বিষয়ে যে নতুন চিন্তার সূচনা করেছিলেন, তাকেই আরও বিকশিত করে তুললেন। শ্রমজীবী মানুষদের বাসস্থানের অবস্থা চিরকালই ছিল খারাপ। পরিবেশ ছিল অস্বাস্থ্যকর ও ঘন বসতিপূর্ণ। শিল্প-শহরগুলির দিকে ধাবমান জনস্রোত সংকটকে আরও তীব্র ও ব্যাপ্ত করে তুলেছিল। এই সমস্যা থেকে মুক্তির উপায় হলো শ্রমিক-শ্রেণির ওপর থেকে শাসক-শ্রেণির শোষণ ও অবদমনের অবসান।


এঙ্গেলসের ঐতিহাসিক-রচনা:

বিশেষ ঐতিহাসিক ঘটনাকে কেন্দ্র কোরে মার্কসের ফ্রান্স বিষয়ে তিনটি লেখা ও ভারত বিষয়ে অনেকগুলি লেখা যতটা আলোচিত হয় সে-ই তুলনায় এঙ্গেলসের ঐতিহাসিক রচনাগুলি তেমন গুরুত্ব পায় না। অধ্যাপক সুশোভন সরকার ১৯৭০ সালে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে মন্তব্য করেছিলেন:

indeed the extent of historical knowledge and the depth of insight which we find in Engels fully bear out the claim that he was one of the best-educated man of his time and a worthy partner and true comrade-in-arms of Karl Marx himself. [২৪]

আবার ১৯৭৪-এ লেখা ‘লিনিএজেস অফ দ্য অ্যাবসোলিউটিস্ট স্টেট’ বইতে পেরি অ্যান্ডারসন মন্তব্য করেছিলেন: ঐতিহাসিক বস্তুবাদের নির্মাণে এঙ্গেলসের অবদানের অবমূল্যায়ন করা একটা ফ্যাশনেব্‌ল প্রবণতা হয়ে উঠেছে। মার্কস ও এঙ্গেলসের মধ্যে অবশ্যই এক ধরনের কর্ম-বিভাজন ছিল। পেরি অ্যান্ডারসন মন্তব্য করেছেন, বিদ্যাচর্চার কোনও কোনও পরিসরে এঙ্গেলস, মার্কসের তুলনায় বেশি শক্তিশালী ছিলেন। কিন্তু সামগ্রিক বিচারে মার্কস অবশ্যই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। [২৫]

এঙ্গেলসের ঐতিহাসিক রচনাবলীর মধ্যে রয়েছে: ‘পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি’, ‘জার্মানিতে কৃষকযুদ্ধ’, ‘জার্মানিতে বিপ্লব ও প্রতিবিপ্লব’, ‘সিভিল ওয়ার ইন ইউনাইটেড স্টেট্‌স’, ‘অ্যান্টি-ডুরিং’-এর রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি ও সমাজতন্ত্র বিষয়ক অধ্যায় দুটি ও কয়েকটি রচনা। যাদের মধ্যে রয়েছে পুস্তিকা ‘স্পেনের বিপ্লব’, ‘রাশিয়ার সামাজিক সম্পর্কসমূহ’ অসমাপ্ত লেখা ‘রোল অফ ফোর্স ইন হিস্ট্রি’ ইত্যাদি।

উল্লিখিত লেখাগুলি নিয়ে বিশেষ আলোচনা হয় না। এঙ্গেলসের ঐতিহাসিক রচনাবলী একটি পৃথক আলোচনার বিষয়। তাই এখানেই থামাতে হলো। এই বিষয়ে পরবর্তী সময়ে অলোচনা করা যাবে।



সূত্রনির্দেশ:

১. মার্কস-এঙ্গেলসের স্মৃতি (প্রবন্ধ সংকলন), অনুবাদ: মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড, ২০১৮, পৃষ্ঠা–১৯০-১৯১।
২. তদেব, পৃষ্ঠা–২২৬-২৩০।
৩. তদেব, পৃষ্ঠা–১৩৬।
৪. তদেব, পৃষ্ঠা–৩৯।
৫. তদেব, পৃষ্ঠা–৪৮।
৬. J D Hunley, The Life and Thought of Friedrich Engels, Yale University Press, 1991, p.-7.
৭. http://hiaw.org/defcon6/works/1841/letters/41_03_08.html
৮. J D Hunley, Ibid, p.-9
৯. http://hiaw.org/defcon6/works/1842/letters/42_04_16.html
১০. http://hiaw.org/defcon6/works/1842/letters/42_08_08.html
১১. J D Hunley, Ibid, pp.-12-13.
১২. John Green, Engels: A Revolutionary Life, Aakar, 2019, pp.-43-47.
১৩. Marx Engels Collected Works Volume 3
https://marxists.architexturez.net/archive/marx/works/1844/dfjahrbucher/sumeng.htm
১৪. J D Hunley, Ibid, p.-15.
১৫.https://www.marxists.org/archive/marx/works/1844/dfjahrbucher/outlines.htm
১৬. J D Hunley, Ibid, p.-16.
১৭. J D Hunley, Ibid, p.-18.
১৮. https://www.marxists.org/archive/marx/works/1848/ 06/01b.htm
https://wikirouge.net/texts/en/The_Latest_Heroic_Deed_of_the_House_of_Bourbon
https://wikirouge.net/texts/en/The_War_Comedy
https://wikirouge.net/texts/en/A_New_Partition_of_Poland
https://www.marxists.org/archive/marx/works/1848/06/14a.htm
https://wikirouge.net/texts/en/The_Danish_Armistice
https://www.marxists.org/archive/marx/works/1848/08/12a.htm
https://www.marxists.org/archive/marx/works/1848/09/20a.htm
https:/ www.marxists.org/archive/marx/works/1848/11/15.htm
https://wikirouge.net/texts/en/Personalities_of_the_Federal_Council
১৯. Marx and Engels Collected Works, Volume 39, Letters 1852-1855, Lawrence Wishart, 2010, Electric Book, p.-537.
২০. J D Hunley, Ibid, pp.-20-21.
২১. মার্কস-এঙ্গেলসের স্মৃতি (প্রবন্ধ সংকলন), তদেব, পৃষ্ঠা-১৮৭।
২২. কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস, রচনা সংকলন, দ্বিতীয় খন্ড, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড, ২০১০, পৃষ্ঠা-২১৯।
২৩. কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিক এঙ্গেলস, রচনা সংকলন, চতুর্থ খন্ড, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি, ২০১০, পৃষ্ঠা–৬৯।
২৪. Susobhan Sarkar, Towards Marx, Papyrus, 1983, pp.-184-185.
২৫. Perry Anderson, Lineages of the Absolutist Satae, london, Verso, 1974. P.-23.



প্রচ্ছদচিত্র সৌজন্য: www.leftvoice.org