লিপিকুশলতা

ক্ষয়ে ক্ষয়ে একদিন মুছে যায় লিপিকুশলতা।
তবু সেই লুপ্ত লিপি থেকে বিস্ফারিত চোখ থেকে
আলো আসে কোন্ রজনির! বিপুল স্তব্ধতা আসে,
তুমি কোন্ নাক্ষত্রিক ধুলো মেখে এসেছ আবার!
পাখি নও তবু এক দরবেশ খুলে নেয় ডানা
অজস্র পালক ঘুম রক্ত স্বপ্ন ধুলো-মাখামাখি
পাথরের ঘরে শুয়ে, কিংবা অন্ধ চাঁদের শিখরে,
সবচেয়ে দুর্নিরীক্ষ্য, ম্লান, কূট, ধীর কোনো সত্য
অগ্রসরমান যেন, কে-বা এসে শেখাবে তোমায়
রণভঙ্গি, সজলতা, বুদ্ধিবিপর্যয় কেটে গেলে
পশুবুদ্ধি পশুঘুম যেন কিছু অবশিষ্ট থাকে,
তারপর মহাসর্প তোমার নৌকাটি ঘুমঘোরে
ক্রমশ পেঁচিয়ে ফেলে, আর এক আধ্যাত্মিক বিভা
নক্ষত্রদের বিস্মিত করে চলে অন্তরীক্ষ জুড়ে।




রুটিগাছ

রুটিগাছ তলে বসে সারারাত দেবনিন্দা করি—
রাতের বাগানে ঢুকে স্মৃতিগুলো বাদুড়ের মতো
নষ্ট করে ফল, দেখি, ডুবে যাচ্ছে কর্দমাক্ত পথে
গরুর গাড়ির চাকা, সাত মিনিটের আয়ু নিয়ে
এক্ষুনি জন্মাল কেউ, তুমি কেন অস্থির কুসুম?
আজ সুফি-ধূলিকণা যত আছে এখানে ওখানে
বাতাসে গভীরভাবে অন্ধ হতে হতে উপস্থিত।
ভ্রমণশীল উদ্ভিদ, এত কেন ভয় হেমন্তকে?
ভ্রমণশীল পাহাড়, কার হাত থেকে ওই রুটি
গর্ধবের পিঠে জমা হয় তুমি তার কিছু জানো?
গরম রুটির গন্ধ-ভরা এই আয়না-সমাধি
কেন যে পাহারা দিই আমি আছে যদি এত বুলবুলি,
রক্তাক্ত সমাধানের দিকে এত কারা ছুটে যায়,
তস্করতাপূর্ণ চক্ষু মুদে ফের ধূলিকণা হও—




এই সুফি-রাস্তার ওপর

উড়াইনি ফুর্তির পায়রা। দুলিনি হ্যামকে। আমার জন্যে নয়
ক্ষীরকদম। শুধু হাউই ছুটে যাওয়া দেখি, আর, কাছে কাছে ঘুরছে
একটি মোরগফুল। দাঁড়ের ময়না বলে উঠল সহসা, অনিশ্চিত! অনিশ্চিত!…

ডায়েরিতে টুকে রাখলাম সেই নির্দেশ, এই তোমার মুকুল-রাঙানো পৃথিবী
পার হও, ঘুম ঘুম যত শব্দার্থ, ছোটো ছোটো পদক্ষেপে পার হয়ে যাও—

কখনও খুঁজিনি কোনো সংজ্ঞা। সন্ধ্যার ধূপছায়া ঝুঁকে আছে
এই সুফি-রাস্তার ওপর। আমি রক্ষা করে চলি নীচু কোনো সুর।
আরও অনন্ত কোনো পুস্তক আর অন্ধকারে প্রস্থান, যেখানে কবিতা
ও বাঘিনী। নোনা হাওয়া ক্রমে ক্ষইয়ে দিচ্ছে সমস্ত মুখরতা।

কোনো তত্ত্বনির্ণয় করিনি। শুধু কোনো ক্লাউন যখন গুটিয়ে নেয় তার
পেখম, তার ইশারার ছন্দ, চাবুক, ঝুড়িভর্তি ডুমুর বয়ে নিতে থাকি।
তার অর্ধউচ্চারিত পঙ্‌ক্তিমালা আমারই, আমাতে বিলীন হতে দি
তার মৃত্যুরঙিন অবয়ব।




শশীগল্প

এবার রাজজম্বুগাছের ফল আস্বাদন করো
নর-বানরের সুনির্মম ঠাট্টা উপভোগ করো।
শশীগল্প আর নৃত্য করে মজে আছ রাতভর,
ভোর থেকে বুটিদার পাখি ডেকে ডেকে হয়রান
একবার তুমিও তাকে ডাক দিয়ে আনারস ঝোপে
ছিন্ন লাল ঝুঁটি আর বহুবর্ণ সাপের খোলস
কুড়াতে গিয়েছ, কত পণ্ডশ্রম রেখে গেলে পিছে,
বলি, কোন্ অবিনাশী রূপ আজ ধরেছ সম্পুটে!
তোমাকে বিমর্ষ দেখে শুধু নেচে যায় টারান্টেলা
স্ফটিকের পাখনা পড়ে থাকে ঘাসে এই ষোলোশিঙা
হরিণের দেশে, আর তুমি নর-বানরের সামনে
নগ্ন বসে রইলে, যেন এক মৃত্যুমথিত প্রেমিক!
বিদ্যুচ্চমকের মতো সত্যেরা কোথায় পালিয়েছে,
স্বপ্নের, জ্ঞানের, আদিতম বীজ রয়েছে কোথায়—




অতি শাদা ফুলের রাত্রিসংলাপ

অস্তিত্বের রং কী—মাঝে মাঝে ভাবি। যেমন কোনো রাজমহিষীকে দেখিনি
কখনও, তবু তার মুখের রংকাহিনি মনে পড়ে। ওই হাবা অরণ্যের পাশে, চুম্বকের
বিছানাই আমার সব। রাত্রিবেলা, প্রান্তরে, দেখা দেয় মহাজাগতিক ডিম। হারেমের
রূপসীরা সেই দিকে দৌড়াতে থাকে। সবাই রং পেয়েছে, রসিকতাও। কেবল এই
বহু ছিদ্রময় অস্তিত্ব, প্রতিমুহূর্তে অস্বীকার করে রং, আর সর্বত্র কায়েম রাখে তার
অট্টহাসি। সেদিন সাপরাজার সাথে দেখা, বৃত্তান্ত শুনে বললেন, এইসব রেখে,
কিছুকাল মেঘে মেঘে পায়চারি করুন।

রক্তবর্ণনার ভিতর দিয়ে যাই। হে অভিরূপ, তুমি কোন্ পাখি? নির্জন ঘাটে শুয়ে
কেউ কেউ ক্ষয় হয়ে যায়। মাছরাঙা একপ্রকার আলোযাদু। কাব্যের, ইশারার
সমস্ত বীজ, জবাকুসুমের মুখ থেকে শুনি। আমার মৃত্যুচিন্তা মুদ্রিত আছে ওই
কাঠবাদামের গায়ে, কাঠবেড়ালি আজ সকাল থেকে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
যত অদ্ভুত আলো দেখো, সবই মাছরাঙাটির।

যে-কোনো সুদূরকে আজ অপরাহ্ণ বলে মনে হয়। যে-কোনো প্রণয়, বল্মীকস্তূপের
প্রায়। অতি শাদা ফুলের রাত্রিসংলাপ ছুটে যায় কার পানে! মনে রেখো ঘাসেদের
বিপুল অভ্যর্থনা, পতঙ্গদের মৃত্যুনাচ। আমার সবুজ অক্ষরগুলো ধুলোয় ঘুমায়।
বাঁকা পথে যেতে যেতে কিছু শশীবাক্য আজ তোমায় শোনাতে হলো। আগামী
কোনো ঝড়ে হাতি, হিতোপদেশ সবই হয়তো একসঙ্গে উড়বে।