অর্ধশতাব্দী পার হয়ে গিয়েছে, ম্যালকম এক্সের মৃত্যুর। নয়ের দশকের শুরুর দিকে ম্যালকমের জীবনী নির্ভর একটি সিনেমা নির্মিত হয়। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসাবে কার্যকালের প্রায় শেষ দিকে সে সময় জর্জ এইচ. ডব্লিউ. বুশ। এমসিএ অ্যাক্ট ২০০৬-এর দলিলে সিলমোহর দিয়ে তাকে বাস্তবায়িত করেন, প্রকৃত-অর্থেই তাঁর উত্তরসূরী। ‘বর্ণবাদ’ যে মানুষের শরীরের ত্বকের রঙের থেকেও মানসিকতায় গভীর তা আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ইতিহাস ও সংস্কৃতির পথ-পরিক্রমায় আমাদের জানা। সাম্প্রতিক সময়ে (২৫ মে ২০২০) জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর সংঘটিত আন্দোলনটি স্বয়ং একটি ইতিহাস। কিন্তু তাতে পরিস্থিতি যে বিশেষ পালটায়নি, সদ্য সমাপ্ত ইওরো কাপ থেকে ব্রিটেনের বিদায় নেওয়া ও পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ তার উদাহরণ। উদাহরণ: ২০২১ সালের ১১ এপ্রিল মিনিয়াপোলিস শহরে দন্তে রাইটের কিংবা ১৯ নভেম্বর ২০২০ ব্রাজিলের পোর্তো আলেগ্রের হোয়াও শহরে আলবার্তো সিলভেরিয়া ফ্রেতিয়াসের মৃত্যু। মনে রাখতে হবে যে, ব্রাজিলে ২০ নভেম্বর তারিখটি ‘ব্ল্যাক অ্যাওয়ারনেস ডে’ হিসাবে পালিত হয়।

বর্ণবাদ-এর এই আবহে, সন্ত্রাসবাদী-সংশয় এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প ও জো বাইডেন প্রশাসনের গৃহীত নীতি অনুযায়ী প্রায় দু-দশক পর ‘শান্তি রক্ষা’য় নিযুক্ত আফগানিস্তান থেকে আমেরিকান সৈন্যের অপসারণ—প্রভৃতি ঘটনা পরম্পরার প্রসঙ্গ-বিবেচনায় ‘বাংলা মান্থলি রিভিউ’ পত্রিকার সম্পাদক আশীষ লাহিড়ী ও অনুবাদক নীলাঞ্জন দত্তর সানন্দ-সম্মতিতে আমরা ফিরে পড়লাম, নীলাঞ্জন দত্তর বঙ্গানুসরণে জঁ-ক্লদ পেয়ে (Jean-Claude Paye) এবং মাইকেল ই. টিগার (Michael Edward Tigar) লিখিত লেখা দুটি। জঁ-ক্লদ পেয়ে, একজন বেলজিয়ান সমাজতত্ত্ববিদ, ‘গ্লোবাল ওয়ার অন লিবার্টি’ (২০০৭) তাঁর প্রকাশিত অন্যতম গ্রন্থ। মাইকেল ই. টিগার একজন আমেরিকান আইনজীবী, অধ্যাপক ও সক্রিয় সমাজকর্মী। সমাজ-রাজনীতি ও আইন বিষয়ে বহু প্রবন্ধ লিখেছেন। ‘ল অ্যান্ড দ্যা রাইজ অব ক্যাপিটালিজ্‌ম’ (২০০০), ‘মিথোলজিস অব স্টেট অ্যান্ড মোনোপলি পাওয়ার’ (২০১৮) তাঁর প্রকাশিত অন্যতম গ্রন্থ।

‘পাঠের আরাম’ অনেকাংশেই যে সেভাবে রক্ষিত হয়নি তা অনস্বীকার্য। কিন্তু, বিষয়-বক্তব্যকে অনুধাবন করতে পাঠকের অসুবিধে হয় না বিশেষ। স্বাভাবিকভাবেই কিছু বিষয়ে লেখকদের মন্তব্য তৎকালীন সে-ই ঘটমান বাস্তবের প্রেক্ষিতেই। ইতিহাসে তার পরেও অনেকগুলি দিন জুড়েছে। তবে সেগুলি এতই চর্চিত যে, সে বিষয়ে নতুন কোনও তথ্য-সংযোজন প্রায় অনাবশ্যক।


‘শত্রুপক্ষের যোদ্ধা’, না সরকারের শত্রু?

জঁ-ক্লদ পেয়ে

যুদ্ধের ধরনকে জাতীয় আইনের আওতায় নিয়ে এসে, মিলিটারি কমিশন্‌স অ্যাক্ট অব ২০০৬ (এম সিএ) নামে সাম্প্রতিক মার্কিন সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী আইনটি পাশ্চাত্য জগতের আইনি ও রাজনৈতিক সংগঠনে এক নতুন মোড় এনে দিয়েছে। এর মাধ্যমে সে-ই ধরনের রাষ্ট্রের অবসান ঘটেছে, যা ‘আভ্যন্তরীণ ভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে এবং বৈরিতাকে আইনের ধারণার বাইরে রাখতে’ সফল হয়েছিল।[১] এটা এক নতুন ধরনের রাষ্ট্র গঠনের কাজ করছে, যা যুদ্ধকে গড়ে-ওঠা কর্তৃত্ব এবং দেশের জনগণের মধ্যে এক রাজনৈতিক সম্পর্ক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করছে।

সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সূত্র ধরে যুদ্ধকে ফৌজদারি আইনের মধ্যে ঢোকানো হচ্ছে। বৈরিতাকে আইন-ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল প্রথমে, বিদেশীদের সম্পর্কে প্রশাসনিক আইনগুলির মাধ্যমে, এবং জরুরি অবস্থার নামে তাকে ন্যায্যতা দান করে। এবার এমসিএ যুদ্ধকে স্থায়ীভাবে আইনের অন্তর্ভুক্ত করল। একইসঙ্গে তা এর প্রয়োগের ক্ষেত্র এবং মর্মবস্তুকে পরিবর্তিত করেছে। তা নাগরিকদের এবং বিরোধীদের—শত্রু—বলে চিহ্নিত করার অধিকার দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতিকে।


যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসনকার্য-পরিচালক শক্তির কাছে, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম একটি যুদ্ধ, কোনও সাধারণ পুলিশি অভিযান নয়। এই ব্যাখ্যার ওপর ভিত্তি করে, তারা এক ঝাঁক অধিকার বিনাশী ব্যবস্থা বলবৎ করেছে, যাকে ন্যায্যতা দেওয়া হয়েছে, জরুরি অবস্থার দোহাই দিয়ে। এই ভাবে, সন্ত্রাসবাদী সন্দেহভাজন বিদেশীদের, হেবিয়াস কর্পাসের অধিকার স্থগিত রাখা এবং সমগ্র জনগণের ওপর নিরন্তর নজরদারি জারি রাখা সম্ভব হয়েছে।

যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির উল্লেখ সরকারকে অধিকার দিয়েছে বিদেশী ‘সন্ত্রাসবাদী’দের শত্রু হিসাবে গণ্য করতে এবং যুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত তাদের প্রশাসনিক নির্দেশবলে বিনা বিচারে আটক রাখতে। যুদ্ধ যেহেতু ঘটমান এবং অনির্দিষ্ট, এদের আটক রাখার মেয়াদও তাই অনির্দিষ্ট। এইসব ‘শত্রুপক্ষের যোদ্ধা’দের যুদ্ধকালীন রক্ষাকবচও জোটে না। যেহেতু তারা ‘যুদ্ধের নিয়ম লঙ্ঘন করেছে’, তাই তারা সাধারণ যোদ্ধা নয়, তারা হলো ‘বেআইনি যোদ্ধা’, যারা আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলির দ্বারাও রক্ষিত নয়। ফলত, শাসক-শক্তি যে বিদেশীকে ‘বেআইনি শত্রুপক্ষের যোদ্ধা’ বলে ঘোষণা করেছে, সে তাদের খেয়ালখুশির ওপর নির্ভরশীল।

সরকারের মতে (ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে) ১১ সেপ্টেম্বরের আক্রমণ সাধারণ কোনও অপরাধ নয়, তা হলো যুদ্ধ। এই মতের ভিত্তি হলো ১৮ সেপ্টেম্বর ২০০১-এ গৃহীত কংগ্রেসের একটি প্রস্তাব, ‘অথরাইজ়েশন ফর ইউজ অব মিলিটারি ফোর্স’, যা শাসনকার্য পরিচালকদের বিশেষ ক্ষমতা দিয়েছে। এতে বলা হয়েছে যে—“রাষ্ট্রপতিকে অধিকার দেওয়া হচ্ছে ১১ সেপ্টেম্বর ২০০১-এর সন্ত্রাসবাদী আক্রমণের পরিকল্পনা, নির্দেশনা, নির্বাহ বা সহায়তার সঙ্গে যে-যে দেশ, সংগঠন বা ব্যক্তি জড়িত আছে বলে তিনি মনে করবেন, তার বিরুদ্ধে সমস্ত প্রয়োজনীয় ও উপযুক্ত শক্তি প্রয়োগ করবার…।”[২] শাসনকার্য-পরিচালকরা এই প্রস্তাবের এই ব্যাখ্যা করেছে যে, তা হলো এক যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির অভিব্যক্তি, যে-যুদ্ধ অন্য দেশের বিরুদ্ধে নয়, বিদেশী কোনও সরকারের সঙ্গে যোগ-হীন সংগঠন বা সাধারণ নাগরিকদের বিরুদ্ধে। এই ব্যাখ্যা যুদ্ধের এক নতুন সংজ্ঞা দেয়, তাকে এক অসামঞ্জস্যপূর্ণ চরিত্র প্রদান করে। এই সংজ্ঞা অনুযায়ী যুদ্ধ হলো, বিশ্বের মহাশক্তিধর রাষ্ট্র এবং শত্রু বলে চিহ্নিত ব্যক্তিদের মধ্যে এক ‘মরণপণ লড়াই’। যুদ্ধের এই নতুন ধারণা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোনও সত্যিকারের বিপদের অস্তিত্ব নিরূপণ করার অপেক্ষা রাখে না। তা একান্ত ভাবেই শাসক-শক্তির ভাবনার ফসল। এই যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি বিরাজ করছে এই জন্যেই যে তা ঘোষণা করা হয়েছে। ‘মন্দের বিরুদ্ধে ভালোর’ যুদ্ধের নামে মার্কিন রাষ্ট্র এই কাজের রাজনৈতিক চরিত্রকে অস্বীকার করে; শত্রু ও অপরাধীর মধ্যেকার পার্থক্যকে আবছা করে দিয়ে তা বাহ্যিক সার্বভৌমত্বের সঙ্গে আভ্যন্তরীণ সার্বভৌমত্বকে এক করে দেয়।

কংগ্রেসের বিমূর্তভাবে ‘অনুমোদিত’ ক্ষমতাকে ছাপিয়ে গিয়ে রাষ্ট্রপতি ‘মিলিটারি অর্ডার অব নভেম্বর ১৩, ২০০১’ নামে এক প্রশাসনিক নির্দেশ জারি করেন, যাতে বিশেষ মিলিটারি ট্রাইব্যুনাল দ্বারা সন্ত্রাসবাদী সন্দেহভাজন বিদেশীদের বা বেআইনি শত্রুপক্ষের যোদ্ধাদের বিচারের অনুমতি দেওয়া হয়। ‘শত্রুপক্ষের যোদ্ধা’ বা ‘বেআইনী যোদ্ধা’ কথাগুলি শাসন বিভাগের আইনি নির্দেশে না থাকলেও তার প্রশাসনকৃত ব্যাখ্যা থেকে সেটাই নিষ্পন্ন হয়। ২৮ ও ২৯ সেপ্টেম্বর ২০০৬ এমসিএ পাস করে, হাউস ও সেনেট বেআইনি শত্রুপক্ষের যোদ্ধার ধারণাটিকে আইনের অন্তর্ভুক্ত করল। কাউকে বেআইনি শত্রুপক্ষের যোদ্ধা বলে অভিযুক্ত করার সম্ভাবনা এতে যথেষ্ট বেড়ে গেছে, যেহেতু এখন আমেরিকায় বসবাসকারী বিদেশী এবং আমেরিকার নাগরিক, উভয়কেই শত্রু বলে গণ্য করা যাবে। তার ফলে, বেআইনি শত্রুপক্ষের যোদ্ধার ধারণাটিকে আইনের অন্তর্ভুক্ত করার মধ্যে দিয়ে, বিষয়টি এখন আর জরুরি অবস্থার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, একটা স্থায়ী ব্যাপার হয়ে গেছে। ব্যতিক্রমই রীতি হয়ে উঠেছে, তা গঠনবৈশিষ্ট্যের অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এইভাবে কংগ্রেসের দুই কক্ষ মিলে এক নতুন আইনি ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে আইনের স্বীকৃতি দিয়েছে। যে-কোনো মার্কিন নাগরিককে, বা আমেরিকার সঙ্গে যুদ্ধ চলছে না, এমন কোনও দেশের নাগরিককে শত্রু বানিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা দিয়েছে তা। যুদ্ধ আর পুলিশি অভিযানকে এক করে দিয়েছে।

এইভাবে, সরকার ভেতর আর বাইরের মধ্যে সম্পর্কটা পালটে দিয়েছে। আমেরিকান নাগরিককে শত্রু বলে আমেরিকার বাইরে আটকে রাখা যেতে পারে। এই গ্রহের যে-কোনো অধিবাসীকে ‘শত্রুপক্ষের যোদ্ধা’, অর্থাৎ অপরাধী, বলার ক্ষমতা অর্জনের মধ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজের কাঁধে দুনিয়া জুড়ে পুলিশগিরি করার দায়িত্ব তুলে নিয়েছে। অন্যান্য দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিভিন্ন প্রত্যর্পণ চুক্তি স্বাক্ষর করার মাধ্যমে তার এই একতরফা ভাবে ঘোষিত অধিকারকে কোনও প্রশ্ন করেনি। এইভাবে, তারা নিজেদের দেশের সার্বভৌমত্বের একটি অংশ বিসর্জন দিয়ে, তা আমেরিকার হাতে তুলে দিয়েছে। মার্কিন কর্তৃপক্ষ চাইলেই, দেশের নাগরিকদের তাদের হাতে তুলে দিতে রাজী হয়ে, তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামাজিক বিচার বিভাগীয় কর্তৃত্বকে মেনে নিয়েছে।

সুতরাং বেআইনি শত্রুপক্ষের যোদ্ধার ধারণাটি আইনগত ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার রূপান্তরের পথে এক কেন্দ্রীয় স্থান অধিকার করে আছে। মার্কিন রাষ্ট্রের সঙ্গে তার অধিবাসীদের সম্পর্ক এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অন্যান্য দেশের সম্পর্কও এর সঙ্গে জড়িত। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর আইন ও আন্তর্জাতিক আইনের ছেদবিন্দুতে অবস্থান করছে। ফলত এই ধারণার বিশদ ব্যাখ্যার সঙ্গে জড়িয়ে গেছে মার্কিনি সার্বভৌমত্বের প্রয়োগের বিভিন্ন রূপ, বাকি পৃথিবীর সঙ্গে এবং নিজের ভূখণ্ডের বসবাসকারীদের সঙ্গেও—তারা বিদেশী বা মার্কিন নাগরিক যাই হোক না কেন, তার সম্পর্ক। এ থেকে আমরা আমেরিকান রাষ্ট্রের নতুন রূপের সংজ্ঞা নির্ণয় করতে পারি।


বিদেশী শত্রুপক্ষের যোদ্ধা

সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রসঙ্গে শত্রুপক্ষের যোদ্ধা বা বেআইনি যোদ্ধার ধারণাটির ব্যবহার প্রথম পাওয়া যায়—১৩ নভেম্বর ২০০১-এর কার্যনির্বাহী সমিতির ঘোষিত প্রশাসনিক ব্যাখ্যায়। এতে বলা হয়েছে যে—“ব্যক্তিদের… আটক রাখা যাবে, এবং বিচার হলে তাদের সামরিক ট্রাইব্যুনাল দ্বারা যুদ্ধের আইন ও অন্যান্য প্রযোজ্য আইন লঙ্ঘনের দায়ে বিচার করা হবে।”[৩]

‘এই আদেশের অধীন কোনও ব্যক্তি’ বলতে এমন ব্যক্তিকে বোঝানো হয়েছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক নয়, এবং যার সম্পর্কে এমন বিশ্বাস করার কারণ আছে যে, সে ‘আল-কায়দা নামক সংগঠনের সদস্য বা প্রাক্তন সদস্য’ অথবা “এমন আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী কাজ বা তার প্রস্তুতির কাজ করেছে, বা তাতে সাহায্য করেছে বা উসকানি দিয়েছে, বা করবার ষড়যন্ত্র করেছে, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের, তার নাগরিকদের, জাতীয় নিরাপত্তার, পররাষ্ট্রনীতির, বা অর্থনীতির ক্ষতিসাধন বা তার উপর ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করছে, করার হুমকি দিয়েছে বা করতে চেয়েছে”[৪] প্রথম সংজ্ঞাটি ‘সদস্য হওয়া’কে অপরাধের পর্যায়ে নিয়ে এসেছে, যা অবশ্য আল কায়দার ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ। কোনও ব্যক্তি একটি অপরাধমূলক সংগঠনের সদস্য হতে পারে—এই সন্দেহের বশেই, সে কোনও নির্দিষ্ট অপরাধ না করলেও, এক্ষেত্রে তাকে প্রশাসনিক নির্দেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য আটক রাখা বা মিলিটারি কমিশনে তার বিচার করা যেতে পারে। যদি অ্যাটর্নি জেনারেল সন্দেহ করেন যে, এই ব্যক্তি এমন কাজ করেছে, করবার চেষ্টা করেছে বা করবার ইচ্ছা পোষণ করেছে, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি বা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ওপর প্রতিকূল প্রভাব ফেলেছে, সেক্ষেত্রেও এটা খাটে। ব্যাখ্যার অনির্দিষ্ট সীমারেখার ফলে যে-কোনো গ্রেপ্তারকেই ন্যায্যতা দেওয়া সম্ভব।

সরকার বিদেশীদের বেআইনি শত্রুপক্ষের যোদ্ধা হিসাবে চিহ্নিত করার সম্ভাবনাকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছে। এই চিহ্নিতকরণ শুধুমাত্র ২০০১-এর প্রশাসনিক নির্দেশ অনুসারে আল কায়দার সদস্যদের ক্ষেত্রেই করা হয়নি, আফগানিস্তানের যুদ্ধের সময় ধৃত তালিবান বন্দিদের ক্ষেত্রেও করা হয়েছে। হোয়াইট হাউসের প্রাক্তন আইনজীবী অ্যালবার্তো গঞ্জালেস (Alberto R. Gonzales)-এর ব্যাখ্যা অনুযায়ী, জেনিভা কনভেনশনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন না-করাটা অন্যায্য হয়নি, যেহেতু আফগানিস্তান একটি ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’।[৫]

গুয়ান্তানামো বন্দিদের বিচারের জন্য ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত কমব্যাটান্ট স্টেটাস রিভিউ ট্রাইব্যুনাল-এর চৌহদ্দির মধ্যেও এই ধারণাকে বিস্তৃত করা হয়েছে।[৬] এই প্রেক্ষিতে, পৃথিবীর যে-কোনো জায়গায় সন্ত্রাসবাদ বিরোধী সংগ্রামের সূত্রে ধৃত, যে-কোনো বিদেশীই শত্রুপক্ষের যোদ্ধা। ২৮ জুন ২০০৪, ‘রসুল বনাম বুশ’ মামলায় সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত একান্তভাবে প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের সৃষ্ট একটি আইনকে প্রাথমিকভাবে যুক্তির ওপর দাঁড় করিয়েছে।[৭] এই সিদ্ধান্ত বলে যে, বিদেশী শত্রুপক্ষের যোদ্ধাদের অসামরিক বিচারালয়ে তাদের সম্পর্কে অভিযোগের বিরোধিতা করার অধিকার আছে। কিন্তু, এই অপরাধটির অসাংবিধানিক চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন না তুলে, তা এই প্রশাসনিক নির্দেশকে ন্যায্যতা দেয় এবং তাকে আইন শাস্ত্রের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়।[৮]

কোনও বিদেশী, তাকে আটক রাখার তথ্যগত ভিত্তির বিরোধিতা করে, অসামরিক বিচারালয়ে বিচার চাইতে আসার সম্ভাবনাকে একেবারে নাকচ করে দেয়, ২০০৫ সলের ডিটেইনি ট্রিটমেন্ট অ্যাক্ট।[৯] এই আইন যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালতের হাত থেকে গুয়ান্তানামো বন্দিদের পরিস্থিতিকে যাচাই করার সমস্ত যোগ্যতা কেড়ে নেয়, এবং তার বদলে তা ন্যস্ত করে—কমব্যাটান্ট স্টেটাস রিভিউ ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্তকে পুনর্বিবেচনা করার জন্য বিশেষভাবে সৃষ্ট এক কর্তৃপক্ষের ওপর।


আমেরিকান শত্রুপক্ষের যোদ্ধা

স্বঘোষিত সামরিক নির্দেশ লঙ্ঘন করে, প্রশাসনিক শক্তি অবিলম্বেই ‘শত্রুপক্ষের যোদ্ধা’র ধারণাটি আমেরিকানদের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করল। এইভাবে, ২০০১ সালে আফগানিস্তানে ধৃত হামদি (Yaser Esam Hamdi)-কে কোনও চার্জ গঠন না করেই তিন বছর আটক রাখাকে ন্যায্যতা দান করা হলো এই বলে যে, প্রশাসন তাকে ‘বেআইনি শত্রুপক্ষের যোদ্ধা’ বলে চিহ্নিত করেছে। অ্যাটর্নি জেনারেল বললেন যে— ‘হামদির অবস্থাটা একজন বিদেশীর থেকে আলাদা নয়, কারণ সে যুদ্ধক্ষেত্রে ধরা পড়েছে। যাই হোক, জুন ২০০২-এ প্রশাসন এই অভিধাকে ব্যবহার করল আরও একজন আমেরিকান, হোসে পাদিলা (José Padilla ওরফে Abdullah al-Muhajir)-র আটক রাখাকে ন্যায্যতা দিতে। তাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, এবং মার্কিন ক্রিমিনাল বেঞ্চ বা জেনিভা কনভেনশন অনুযায়ী তাকে কোনওরকম সুরক্ষা দিতে অস্বীকার করে প্রশাসন।

নিজের দেশের একজন নাগরিককে, শত্রুপক্ষের যোদ্ধায় পরিণত করার জন্য, প্রশাসনিক বিভাগকে প্রদত্ত অধিকার আইনের মধ্যে গ্রথিত হয়েছে—২৮ জুন ২০০৪ ‘হামদি বনাম রামসফেল্ড’ মামলায় সুপ্রিম কোর্টের মতামতের মাধ্যমে। সংবিধানে প্রদত্ত নিশ্চিত অধিকারগুলি যে-কোনো নাগরিকের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, এটা বলার বদলে আদালত বলেছে যে—একজন আমেরিকান নাগরিককে শত্রু হিসাবে গণ্য করার কোনও বাধাই নেই। আদালত আগেকার একটি সিদ্ধান্তের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে; তা হলো—’এক্স পার্টে কুইরিন’[১০] নামক মামলার সিদ্ধান্ত। এই মামলা হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, জার্মানির পক্ষে নাশকতামূলক কার্যকলাপ চালানোর জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাদের ধরা হয়েছিল, তাদের বিরুদ্ধে। ধৃতদের মধ্যে একজন বন্দি ছিল আমেরিকার নাগরিক। আদালত বলেছিল যে, কিছু কিছু কাজকর্ম—এক্ষেত্রে যুদ্ধের নিয়ম লঙ্ঘন—তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দরুন অসামরিক আদালতের এক্তিয়ার বহির্ভূত এবং সামরিক আদালতে বিচার্য।

এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আদালত আগেকার একটি সিদ্ধান্তকে উলটে দিয়েছিল।[১১] সেটি হলো, ১৮৬৬ সালের ‘এক্স পার্টে মিলিগান’ মামলার[১২] সিদ্ধান্ত, যেখানে উত্তরাঞ্চলের এক অসামরিক ব্যক্তির প্রতি কনফেডারেট সৈন্যদলের হয়ে ‘ষড়যন্ত্র’ এবং ‘যুদ্ধের নিয়ম লঙ্ঘন’ করার অভিযোগ আনা হয়। আদালত বলেছিল যে, সামরিক আদালতে কেবলমাত্র কনফেডারেট সৈন্য, অথবা শত্রু দেশের সামরিক বা অসামরিক নাগরিকেরই বিচার হতে পারে। সে-ই রায় পরিষ্কার ভাবেই সরকার পক্ষের এই যুক্তিকে নাকচ করে দিয়েছিল যে, একজন মার্কিন নাগরিকও ‘শত্রু’ হতে পারে। আদালত আরও বলেছিল যে, এরকম ক্ষেত্রে অভিযুক্তকে অসামরিক আদালতে বিশ্বাসঘাতকতার জন্য বিচার করতে হবে, সামরিক আদালতে নয়।

২০০৪-এর সিদ্ধান্তে সুপ্রিম কোর্ট ‘এক্স পার্টে কুইরিন’ (১৯৪২) মামলার সিদ্ধান্তে আইন শাস্ত্রের যে বিপরীতধর্মী ঝোঁক দেখা গিয়েছিল, তাকে জোরদার করেছে এবং সরকার কর্তৃক নিজের দেশের কোনও নাগরিককেও শত্রু হিসাবে গণ্য করায় সম্মতি দিয়েছে। অবশ্য, ‘হামদি বনাম রামসফেল্ড’ মামলার সিদ্ধান্ত এই অপরাধের প্রয়োগের ক্ষেত্রেই পরিবর্তন এনেছে। সত্যিকারের যুদ্ধ থেকে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে নিরন্তর ও অনির্দিষ্টকালীন সংগ্রাম। ২০০৪ সালের এই সিদ্ধান্ত, যাকে নাগরিক অধিকার সংগঠনগুলি আইনের শাসনের প্রত্যাবর্তন বলে স্বাগত জানিয়েছে, সেটি আসলে বিচারের ক্ষেত্রে একটি অভ্যুত্থান। কারণ, তা সরকারের সুবিধা করে দিয়েছে, কংগ্রেসকে তার ফরমায়েশ অনুযায়ী এক নতুন আইন-ব্যবস্থা তৈরি করতে বলার জন্য।


সরকারের শত্রু

সত্যিই, এই অধিকার পাওয়ার জন্য প্রশাসনিক বিভাগ কংগ্রেসের কাছে ফিরে গেছে। ১৭ অক্টোবর ২০০৬, প্রেসিডেন্ট বুশ এমসিএ স্বাক্ষর করেন।[১৩] এই আইন সুপ্রিম কোর্টের ২৯ জুন ২০০৬-এর এক নতুন সিদ্ধান্তকে অনুসরণ করে; যা মিলিটারি কমিশনগুলিকে বেআইনি করে দেয় এই বলে যে, সেগুলির গঠন ও কর্মপদ্ধতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিলিটারি কোড এবং ১৯৪৯ সালের জেনিভা কনভেনশনে বিবৃত আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকারকে লঙ্ঘন করে।[১৪] অথচ, সুপ্রিম কোর্ট বন্দিদের অবস্থার কোনও পরিবর্তন করল না এবং তাদের অন্যভাবে বিচার করতে প্রশাসনকে অনুমতি দিল।

এমসিএ, এই প্রথম বেআইনি শত্রুপক্ষের যোদ্ধার ধারণাটিকে আইনের মধ্যে নিয়ে এল এবং এই অপরাধের পরিধিকে বিস্তৃত করল। নভেম্বর ২০০১-এর সামরিক নির্দেশ এবং কমব্যাটান্ট স্টেটাস রিভিউ ট্রাইব্যুনালগুলি যে ‘সংজ্ঞা’ ব্যবহার করে, সে-ই অনুসারে। কেবলমাত্র আমেরিকার বাইরে ধরা পড়া বিদেশীরাই শত্রুপক্ষের যোদ্ধা বলে গণ্য হতে পারে। কিন্তু এমসিএ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী যে-কোনো আমেরিকান বা বিদেশীকেই বেআইনি শত্রুপক্ষের যোদ্ধা বলে গণ্য করাকে অনুমোদন করে। এটা কেবল অপরাধের ভৌগোলিক চরিত্রের সম্প্রসারণ নয়, তার গুণগত পরিবর্তনও বটে৷ যারা কখনও আমেরিকার বাইরে পা ফেলেনি এবং কোনও যুদ্ধক্ষেত্রে যায়নি, তাদের শত্রু বলে গণ্য করে অপরাধী সাব্যস্ত করা হচ্ছে, যাদের সঙ্গে কোনও যুদ্ধ বা পুলিশি অভিযানের সম্পর্ক নেই, কিন্তু যারা দেশের মাটিতে দাঁড়িয়েই সরকারের নীতির বিরোধিতা করেছে।

এমসিএ অনুসারে, ‘বেআইনি শত্রুপক্ষের যোদ্ধা’ মানে হলো “এমন ব্যক্তি যে আইনত শত্রুপক্ষের যোদ্ধা না হয়েও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি শত্রুতা করেছে বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা তার সহযোদ্ধাদের প্রতি ইচ্ছাকৃতভাবে ও বস্তুগতভাবে শত্রুতাকে সমর্থন করেছে… অথবা এমন ব্যক্তি যে… কোনও কমব্যাটান্ট স্টেটাস রিভিউ ট্রাইব্যুনাল বা রাষ্ট্রপতি বা প্রতিরক্ষা সচিবের নির্দেশে প্রতিষ্ঠিত অন্য কোনও সুযোগ্য ট্রাইব্যুনাল দ্বারা বেআইনি শত্রুপক্ষের যোদ্ধা বলে সাব্যস্ত হয়েছে।”

এইভাবে ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি শত্ৰুসুলভ আচরণকারী বা শত্রুতাকে সমর্থনকারী’ যে-কোনো ব্যক্তিকে বেআইনি শত্রুপক্ষের যোদ্ধা বলে চিহ্নিত করার মধ্য দিয়ে এই অপরাধটিকে একটি সরাসরি রাজনৈতিক চরিত্র দেওয়া হচ্ছে। ২০০১ সালের প্রশাসনিক নির্দেশের মধ্যেই এই সংজ্ঞা নিহিত ছিল, কিন্তু তা কেবলমাত্র আফগানিস্তানের রণক্ষেত্রে ধৃত বিদেশীদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য ছিল। এমসিএ-র মাধ্যমে এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ পৃথিবীর যে-কোনো জায়গার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হলো। এর আর কোনও ভৌগোলিক সীমারেখা রইল না, এটা এখন বিশ্বজোড়া সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী সংগ্রামের অঙ্গ হয়ে উঠল। এইরকম বিমূর্ত পরিবেশে, এই সংজ্ঞা এতটাই বিস্তৃত যে, তাকে সামাজিক আন্দোলন বা আইন অমান্য আন্দোলনের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা যায়; বস্তুত তা প্রয়োগ করা যায় এমন যে-কোনো কার্যক্রমের ক্ষেত্রে, যা মার্কিন সরকার বা তার মিত্রশক্তিগুলির নীতিকে চ্যালেঞ্জ করে। যদি ‘এক্স পার্টে কুইরিন’ মামলার সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে লব্ধ আইনি জ্ঞান থেকে এই মীমাংসায় উপনীত হওয়া যায় যে, কারোর কাজের চরিত্রই তাকে শত্রুপক্ষের যোদ্ধায় পরিণত করে, তাহলে এমসিএ-র পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, কারোর রাজনৈতিক চরিত্রই তাকে শত্রুপক্ষের যোদ্ধার কাজকর্মে লিপ্ত বলে চিহ্নিত করে।

সংজ্ঞাটির দ্বিতীয় অংশ একেবারে খামখেয়ালি। একজনকে ‘শত্রুপক্ষের যোদ্ধা’ বলা হবে সে কোনও কাজ করেছে বলে নয়, অথবা করার ইচ্ছা পোষণ করে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে বলেও নয়, প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ এ কথা বলেছে বলে। প্রশাসনের নিজের সিদ্ধান্তের ন্যায্যতা প্রমাণ করারও কোনও দায় নেই। তার সিদ্ধান্তই একমাত্র সম্ভাব্য সত্য। আইনটিতে একবার দ্রুত চোখ বোলালে মনে হতে পারে, তা কেবলমাত্র বিদেশীদের ওপরেই প্রয়োগ করা হতে পারে, যেহেতু কমব্যাটান্ট স্টেটাস রিভিউ ট্রাইব্যুনাল শুধুমাত্র অন-আমেরিকানদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কিন্তু, এর বয়ানেই মার্কিনিদের বেআইনি শত্রুপক্ষের যোদ্ধা বলে গণ্য করার সম্ভাবনা রয়েছে। নতুন প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল গঠন সম্ভব এবং তা যে নাগরিকদের ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হবে না, তা বলা যায় না।


মিলিটারি কমিশনের আইনি স্বীকৃতি

এমসিএ মিলিটারি কমিশন বা ২০০১-এর প্রশাসনিক নির্দেশে প্রতিষ্ঠিত বিশেষ মিলিটারি ট্রাইব্যুনালগুলিকে আইনি স্বীকৃতি দিয়েছে। এর উদ্দেশ্য ছিল আফগানিস্তানে ধৃত বিদেশীদের বিচার করা। এদের বিরুদ্ধে ছিটেফোঁটাও প্রমাণ ছিল না, যাতে তাদের কোনও অসামরিক আদালতের সামনে নিয়ে আসা যেত। এই আইন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী বিদেশী-সহ সব দেশের নাগরিকদেরই এইসব ট্রাইব্যুনালগুলির আওতায় নিয়ে আসে।

মিলিটারি কমিশন ব্যবস্থায় আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার প্রায় লোপ পেয়েছে। অভিযুক্তের নিজস্ব আইনজীবী নির্বাচনের কোনও অধিকার নেই। তার বদলে, অভিযুক্তের প্রতিনিধিত্ব করবার জন্য প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ একজন মিলিটারি অ্যাটর্নি নিয়োগ করে। এই ট্রাইব্যুনালগুলি প্রমাণের দায়কে উলটে দেয়। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করবার দায় অভিযুক্তের ওপর বর্তায়। অভিযুক্তকে বাদ দিয়েও বিচারের কিছু কিছু অংশ চলতে পারে। সে সমগ্র কেস ফাইল দেখতে পাবে না, বিশেষ করে তার বিরুদ্ধে হাজির করা ‘প্রমাণগুলি’, যদি তা জাতীয় প্রতিরক্ষার গোপন তথ্য বলে গণ্য হয়।

এই আইনে ধৃতদের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই, এমনকি মিলিটারি কমিশনের কাছেও। এইভাবে তা পেট্রিয়ট অ্যাক্ট-এর মাধ্যমে ‘সন্ত্রাসবাদী’ সন্দেহভাজন কোনও বিদেশীকে অনির্দিষ্টকাল প্রশাসনিক বন্দিদশায় রাখার সম্ভাবনাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। এই আইনে সিদ্ধান্তগুলি অসামরিক আদালতে পুনর্বিবেচনা করবার এক পোশাকি বন্দোবস্ত রয়েছে। এই ধরনের মামলাগুলির বিবেচনা করবার এক্তিয়ার আছে শুধুমাত্র—ইউএস কোর্ট অব অ্যাপিল্‌স ফর দ্য ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়া সার্কিট-এর। কিন্তু তা কেবল যাচাই করতে পারে সবকিছু আইন অনুযায়ী হয়েছে কিনা। যে তথ্যগুলির ভিত্তিতে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা হলো, তা যাচাই করার কোনও ব্যবস্থা নেই। যেহেতু এই আদালত—২০ ফেব্রুয়ারি ২০০৭, গুয়ান্তানামো বন্দিদের আটক রাখার বিষয়টিকে, কোনও অসামরিক আদালতে ‘চ্যালেঞ্জ’ করবার সম্ভাবনাকে নাকচ করে দিয়েছে, কাজেই তার পর থেকে বিচার বিভাগের তদারকির এই পোশাকি সম্ভাবনাটুকুও আর নেই।[১৫]

মিলিটারি কমিশন ‘শোনা কথা’ বা নির্যাতন করে আদায় করা জবানবন্দিও প্রমাণ হিসাবে গ্রহণ করতে পারে। যদিও নির্যাতন নিয়ম-মাফিক নিষিদ্ধ, তবু ‘কিছুটা পরিমাণে চাপ সৃষ্টি’ করা যেতে পারে। জিজ্ঞাসাবাদের সময় কতটা চাপ দেওয়া চলবে, তা ঠিক করার দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির। যেসব দেশে নির্যাতন করা হয়ে থাকে, সেখানে গৃহীত জবানবন্দিও ‘প্রমাণ’ হিসাবে গণ্য হতে পারবে। একই সঙ্গে, এই আইন ২০০৫-এর শেষ পর্যন্ত, নির্যাতন বা নিষ্ঠুর আচরণের জন্য কোনও আমেরিকান প্রতিনিধির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা নিষিদ্ধ করেছে। তাই প্রেসিডেন্ট বুশ এই আইনে সই করার পর ঘোষণা করতে পেরেছেন যে, এর বয়ান—”সন্ত্রাসবাদী সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে গোপন বন্দিশালায় আটক রাখার কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার জন্য সিআইএ-কে অনুমতি দিয়েছে।” [১৬]


নাগরিকদের জন্য পরিকল্পিত ব্যবস্থা

কেবলমাত্র বিদেশী ‘বেআইনি শত্রুপক্ষের যোদ্ধা’দেরই মিলিটারি কমিশনের সামনে হাজির করা যাবে। আমেরিকানরা অসামরিক আদালতে হেবিয়াস কর্পাস আইনের ভিত্তিতে আবেদন জানতে পারবে। যাই হোক, এমসিএ এমনভাবেই তৈরি হয়েছে, যাতে বিশেষ ট্রাইব্যুনালগুলি নাগরিক সহ সমগ্র জনসমষ্টির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হতে পারে। আইনটির প্রাথমিক খসড়া এ ব্যাপারে একেবারে পরিষ্কার ছিল।[১৭] যেরকম দ্রুততার সঙ্গে আইনটি পাস করা হলো, তাতে এখনও এই প্রাথমিক লক্ষের রেশ রয়ে গেছে। যেসব অপরাধ মিলিটারি কমিশনে বিচার করা যাবে, তার মধ্যে এমন ব্যক্তির শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে, যে ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য বা কর্তব্য ভঙ্গ করে’ ইচ্ছাকৃত ভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা তার মিত্রদের প্রতি শত্রুতামূলক কোনও কাজকে সমর্থন করে।[১৮] আমেরিকান নাগরিক ছাড়া কে আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য বা শৃঙ্খলা-ভঙ্গ করতে পারে?

আইনটিতে মিলিটারি কমিশনে বিচার্য এমন কিছু অপরাধের সংজ্ঞা দেওয়া আছে, যা সরাসরি সামাজিক আন্দোলনগুলিকে আক্রমণের লক্ষ্য করে তোলে। যেমন, সংরক্ষিত সম্পত্তির ওপর আক্রমণ বা লুঠতরাজের ধারণা, যা বেআইনি দখলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধকে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে পরিণত করতে পারে। এই অপরাধগুলির সরাসরি রাজনৈতিক চরিত্র এটাও বুঝিয়ে দেয় যে, সরকারের ইচ্ছা হলো আমেরিকানদের এই কমিশনগুলির সামনে হাজির করার ক্ষমতা অর্জন করা।


এক নতুন সাম্রাজ্যবাদী রাজনৈতিক ব্যবস্থা

এমসিএ সন্ত্রাসবাদী সন্দেহভাজন সমস্ত বিদেশীদের এক নিখাদ হিংসাত্মক ব্যবস্থার মুখে ফেলে দেয়। যাই হোক, এটা শুধু সেনাবাহিনী বা সিআইএ-র হাতে মার্কিন ভূখণ্ডর বাইরে ধরা পড়া ব্যক্তিদের বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী বিদেশীদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়; এটা অন্যদের, যেমন, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অধিবাসীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। জুন ২০০৩-এ স্বাক্ষরিত প্রত্যর্পণ চুক্তিগুলি অনুযায়ী, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কোনও দেশে বসবাসকারী সন্ত্রাসবাদী সন্দেহভাজন যে-কোনো ব্যক্তিকে আমেরিকান কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেওয়া যাবে এবং তাদের খুশি-মতো সিদ্ধান্তের দ্বারাই তার ভাগ্য নির্ধারিত হবে।[১৯] মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যেসব চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে তার ফল হলো তার আইন ও ব্যতিক্রমী ব্যবস্থাগুলিকে মেনে নেওয়া। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা রয়েছে বিদেশীদের বিচার করার জন্য তার নিজস্ব মানদন্ড এবং বিশেষ এক্তিয়ার চাপিয়ে দেওয়ার। নিজেদের আইনকে জলাঞ্জলি দিয়ে ইউরোপের দেশগুলি তাদের নাগরিকদের এইসব প্রক্রিয়ার মধ্যে নিয়ে আসতে রাজী হয়েছে। সাম্প্রতিক চুক্তিগুলি তাই ইউরোপীয় নাগরিকদের উক্ত মার্কিন ব্যবস্থার মধ্যে ঢুকিয়ে নিয়েছে, আইনের ব্যতিক্রমই যার বৈশিষ্ট্য। এর মধ্যে দিয়ে একটি নিখাদ সাম্রাজ্যবাদী কাঠামো প্রকাশ পেয়েছে, যাতে মার্কিন প্রশাসকদের অধিকার রয়েছে, ব্যতিক্রমটা ঠিক করার এবং তাকে এক নতুন আইন-ব্যবস্থার ভিত্তি হিসাবে ব্যবহার করার। যেখানে আন্তর্জাতিক আইনকে আর সম্মান করা হয় না এবং যুদ্ধকে এক সাধারণ পুলিশি-অভিযান হিসাবে দেখানো হয়।

আমেরিকান ফৌজদারি আইন শত্রুতার এক নতুন সংজ্ঞা হাজির করেছে, যা বিশ্ব জুড়ে প্রয়োগ করা হচ্ছে। মিলিটারি কমিশন প্রথম শাস্তি দিয়েছিল—২৭ মার্চ ২০০৭, ‘অস্ট্রেলিয়ান তালিবান’ ডেভিড হিক্‌স (David Matthew Hicks)-কে। এইভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন বিভাগের, অন্যান্য দেশকে এক নতুন আইন-ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠাকে বৈধতা দিতে বাধ্য করার অধিকারই প্রকাশিত হয়েছে। এ অধিকার তাকে সমস্ত অন-আমেরিকানদের হেবিয়াস কর্পাস অবদমিত করার ক্ষমতা দেয়। এই গুয়ান্তানামো বন্দি অস্ট্রেলিয়ায় তার কারাদণ্ডের মেয়াদ কাটাতে পারে—এটা মেনে নিয়ে, সে দেশের সরকার বস্তুত এই ব্যতিক্রমী এক্তিয়ারকেই মেনে নিয়েছে। কেবল আন্তর্জাতিক আইনই নয়, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার সংবিধানকেও লঙ্ঘন করে এ ঘটনা। [২০]

অস্ট্রেলিয়ার সরকার ডেভিড হিক্‌সকে ছাড়া পাওয়ার পর প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে রাখার কথাও ভাবছে।[২১] মিলিটারি কমিশন এই ব্যবস্থার কথা বলেনি। এভাবে মার্কিনি ব্যতিক্রমী আইনের এক্তিয়ারে দণ্ডিত একজন ব্যক্তি, এক বে-আইনের বিশ্বব্যবস্থার মধ্যে ঢুকে পড়ছে। আইন প্রণেতা, প্রশাসন ও বিচার বিভাগের পার্থক্যকে মুছে দিয়ে এমসিএ রাষ্ট্রের সংগঠনে এক পরিবর্তন এনেছে। তা এক পুরোপুরি ভাবগত আইনের সৃষ্টি করেছে এবং তাকে প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দিয়েছে। এই কর্তৃপক্ষ যে-কোনো ব্যক্তিকে ‘শত্রুপক্ষের যোদ্ধা’ বলে চিহ্নিত করতে পারে, যে-কোনো বিদেশীকে সারাজীবন আটক রাখার প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে, অথবা, তাকে বিচারের কাঠগড়ায় তুলতে চাইলে, তার জন্য সামরিক বিচারক নিয়োগ করতে পারে, এবং তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে কতটা জোর প্রয়োগ করা হবে তা ঠিক করতে পারে। আইনের বয়ানে শারীরিক ও মানসিক চাপকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে, যা নির্যাতন ছাড়া আর কিছুই নয়। এইভাবে তা নিখাদ হিংসাকে আইনের মধ্যে গেঁথে নিয়েছে, যা এক নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থার ভিত্তি হয়েছে, যা আবার রাষ্ট্রপতিকে স্থায়ীভাবে বিচারকের ক্ষমতা দিয়েছে।

মিলিটারি কমিশনগুলি যদিও বৈধতা পেয়েছে, তবে তা বহিরঙ্গের দিক থেকেই কেবল পশ্চিমি দুনিয়ার আইনি পরম্পরার অংশ। এ হলো এক দ্বৈত আইনি ব্যবস্থা—নাগরিকদের জন্য সীমিত আইনের শাসন এবং বিদেশীদের জন্য নিখাদ হিংসা।[২২] এই প্রশাসনের লক্ষ্য হলো সমগ্র জনসমষ্টির ওপর সেইসব পদ্ধতি প্রয়োগ করা, যা বিদেশীদের ধরে নির্যাতন করা ও নিজের খেয়ালখুশিমতো আটক রাখাকে অনুমোদন করে। ‘ডোমেস্টিক সিকিউরিটি এনহ্যান্সমেন্ট অ্যাক্ট ২০০৩’, যা ‘পেট্রিয়ট ২’ নামেও পরিচিত, তা ছিল সরকারের এই লক্ষ্যপূরণের জন্য আগেকার চেষ্টা।[২৩] এর উদ্দেশ্য ছিল সন্ত্রাসবাদী সন্দেহভাজন আমেরিকানদের নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করে বিদেশী হিসাবে বিবেচনা করা। মিলিটারি কমিশন্‌স অ্যাক্ট-এর মাধ্যমে সরকারের প্রাথমিক আকাঙ্ক্ষা—সমগ্র জনসমষ্টির ক্ষেত্রে হেবিয়াস কর্পাসকে অবদমিত করা—যা এখনও পূরণ হয়নি। কিন্তু এই গ্রহের যে-কোনো অধিবাসীকে শত্রু বলে চিহ্নিত করার এই ক্ষমতা অর্জন এমনই একটি সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকে পদক্ষেপ, যা আর ভেতর-বাইরে ফারাক করবে না। যে-কোনো জনসমষ্টির ভাগ্যই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনিক শক্তির দয়ার ওপর নির্ভর করবে।


অধিকার হরণের ঢালাও ব্যবস্থা

মাইকেল ই. টিগার

অতীতের মতোই এবারেও আমেরিকানরা জঁ-ক্লদ পেয়ে-র কাছে ঋণী হলেন। ব্রাসেলস-এ একজন সমাজতত্ত্ববিদ হিসাবে কর্মরত হয়েও, তিনি প্রমাণ করেছেন যে, জর্জ বুশ আর ডিক চেনি-র আমেরিকায় কী ঘটছে—তা তিনি অনেক আমেরিকাবাসীর থেকেও স্পষ্ট দেখতে পান।

পেয়ে, লক্ষ করেছেন যে—’ডিটেইনি ট্রিটমেন্ট অ্যাক্ট ২০০৫’ (ডিটিএ) এবং ‘মিলিটারি কমিশন্‌স অ্যাক্ট ২০০৬’ (এমসিএ) যে, শাসনব্যবস্থার সৃষ্টি করেছে, তার দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে। এমসিএ সেইসব ‘শত্রুপক্ষের যোদ্ধা’দের মধ্যের তফাতকে স্বীকার করে, যারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক এবং যারা সে দেশের নাগরিক নয়। তিনি দেখেছেন যে, বিদেশী শত্রুপক্ষের যোদ্ধাদের পুরোপুরি মিলিটারি কমিশনের হাতে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে, এবং সীমিত পরিস্থিতি ছাড়া তাদের অসামরিক আদালতে যাওয়ার অধিকার থাকছে না। নাগরিক শত্রুপক্ষের যোদ্ধাদের যদিও অসামরিক আদালতে যাওয়ার অধিকার রয়েছে, তাদের অধিকার আবার খর্ব করা হচ্ছে অন্যভাবে। এমসিএ-তে বিদেশী ও নাগরিকদের মধ্যে, কংগ্রেস এই পার্থক্য করতে বাধ্য হয়েছে, ‘হামদান বনাম রামসফেল্ড’ (২০০৬) মামলায় সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তের ফলে, যেখানে পাঁচজন বিচারকের সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সাব্যস্ত হয়েছে যে, রাষ্ট্রপতির কোনও ক্ষমতা ছিল না, নাগরিক ও বিদেশীদের একইভাবে অসামরিক আদালতে যাওয়ার ও হেবিয়াস কর্পাসের রিট করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করার। আদালত রাষ্ট্রপতিকে আহ্বান জানিয়েছিল, তার ক্ষমতার দাবিকে যাচাই করার জন্য কংগ্রেসের কাছে ফিরে যাওয়ার, এবং কংগ্রেস তাকে বাধিত করে এটাই প্রমাণ করেছিল যে, পেয়ে, যে সাম্রাজ্যিক-শক্তি সম্পর্কে লিখেছেন, তার বিরুদ্ধে কথা বলার মতো ব্যক্তি, নির্বাচিত নেতৃত্বের মধ্যে খুব কমই রয়েছেন।

যেসব আমেরিকানের গত ছয় দশকের রাজনৈতিক সংগ্রামের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অভিজ্ঞতা রয়েছে, চারের দশক থেকে, তাদের কাছে ‘শত্রুপক্ষের যোদ্ধা’র সংজ্ঞাটি অস্বস্তিকর ভাবে পরিচিত বোধ হবে। এখানে, দায় নিরূপণের প্রাথমিক ভিত্তি হলো, হয় (১) আল কায়দার সদস্য হওয়া বা তার সঙ্গে যুক্ত থাকা, যে-সংগঠনটির কোনও নির্দিষ্ট কাঠামোই নেই, অথবা (২) নীচে আলোচিত কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া—এমন আচরণ যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে শত্রুতার বস্তুগত সমর্থন জোগানোর তুল্য। ‘শত্রুপক্ষের যোদ্ধা’র সংজ্ঞার মধ্যে এমন লোকেদেরও ফেলা যেতে পারে, যারা শুধুমাত্র প্রস্তুতিমূলক কাজে নিয়োজিত ছিল, অথবা এমন কাজ করেছে যা কোনও নিষিদ্ধ উদ্দেশ্যে করা হয়েছে, কিন্তু বর্তমানে যার বিপদ বা প্রভাব প্রমাণ করা যায় না। ‘আল কায়দা’র টেনে বড় করা যায় এমন সংজ্ঞা, এবং নিষিদ্ধ সংগঠন বলতে কী বোঝানো হয়েছে, তার ধোঁয়াটে ভাব, সন্দেহ ভাজনদের ছেঁকে তোলা ও আটক করার দায়িত্বে থাকা প্রশাসনিক আধিকারিকদের বিবেচনার ওপর অসীম ক্ষমতা অর্পণ করেছে।

এই ব্যাপক দৃষ্টিভঙ্গী নতুন নয়। এটা হলো ১৯৯৪ সালে ক্লিন্টন প্রশাসনের দ্বারা গৃহীত এক সংজ্ঞার কাঠামোকে নতুন মাত্রায় প্রসারিত করা, এবং তা বিগত কয়েক দশকের দমনমূলক আইনের কেন্দ্রীয় ধ্যানধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত। এ কথা মিলিয়ে নেওয়ার জন্য—সাংবিধানিক আইনের কয়েকটি মূলনীতির দিকে তাকানো যাক।

প্রথম সংশোধনীর দ্বারা বাক্‌স্বাধীনতা ও সংগঠনের স্বাধীনতা রক্ষিত হয়েছে। ‘ব্রান্ডেনবুর্গ বনাম ওহাইও’ (১৯৬৯) মামলায় সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বেআইনি হিংসার কথা বলাও সাংবিধানিক ভাবে সুরক্ষিত, যদি না তা অবিলম্বে কোনও হিংসাত্মক ঘটনা ঘটানোর উদ্দেশ্য নিয়ে, এখনই সুস্পষ্ট ভাবে বিপদের সম্ভাবনা রয়েছে এমন পরিস্থিতিতে বলা হয়ে থাকে। অর্থাৎ, কেউ বিশ্বাস ও প্রচার করতে পারে যে, মার্কিন-নীতি ভুল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তথাকথিত শত্রুদেরই জয় হওয়া উচিত, ধনতন্ত্রের বদলে সমাজতন্ত্র আসা উচিত, এবং যা ব্রান্ডেনবুর্গ (Clarence Brandenburg) প্রচার করেছিলেন—জনগণের রাষ্ট্রীয় আধিকারিকদের ওপর প্রতিহিংসা নেওয়া উচিত।

দ্বিতীয় এবং এরই সঙ্গে যুক্ত একটি ধারণা হলো—এই যে, কেউ এমন কোনও সংগঠনের সঙ্গে জড়িত থাকতেই পারে, যার লক্ষ্যকে বেআইনি বলে দেখানো যায়, কিন্তু এটা ভাবলে প্রমাণ করা যায় না যে, সে নিজের কাজকর্মের দ্বারা সে-ই লক্ষ্যগুলিকে অর্জন করতে চায়। এমন অনেক সংগঠন রয়েছে, যারা আইনি-বেআইনি দু-রকম কাজই করে। ১৯৬১ সালের ‘নোটো বনাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র’ মামলায় সুপ্রিম কোর্ট নোটো (John Francis Noto)-র দোষী সাব্যস্ত হওয়া খারিজ করে দেয়। যে মামলার ভিত্তি ছিল; তার, সরকারকে উৎখাত করতে চায়—এমন এক সংগঠনের সদস্য হওয়া। সেখানে সরকার-পক্ষ প্রমাণ করতে পারেনি যে, সদস্য হিসাবে তার কাজকর্ম সে-ই সংগঠনের সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত কাজের সমর্থনের বেশি কিছু ছিল। লক্ষ করুন, এইসব কাজকর্মের মধ্যে হিংসার প্রচারও চলতে পারে।

সাংবিধানিক সীমারেখার নীতির সবচেয়ে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটানো হয় ১৯৯৪ সালে ক্লিন্টন প্রশাসনের আনীত সংজ্ঞার মধ্যে ‘বস্তুগত সমর্থন’ কথাটির সূত্রে। যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে কেউ এমন কোনও গোষ্ঠীকে অস্ত্রশস্ত্র পাঠায়, যা মার্কিন সেনাবাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র সংঘাতে লিপ্ত, তবে তা প্রতিষ্ঠিত ও সীমিত ফৌজদারি আইনে গ্রাহ্য ‘বস্তুগত সমর্থন’ বলে মানা যেতে পারে। কিন্তু, অন্তত ১৯৯৪ থেকে এই কথাটি বিভিন্ন আইনের অংশ হয়ে গেছে, যা তথাকথিতভাবে সন্ত্রাসবাদকে সমর্থনকারী কাজকর্ম নিষিদ্ধ করে। ‘পেট্রিয়ট অ্যাক্ট’ এবং সংশ্লিষ্ট আইনগুলিতে এই কথাটি অতি ব্যাপক এক অর্থ পরিগ্রহণ করেছে।

যদি কোনও বিদেশী—যে নাগরিক নয়—তালিবান বাহিনীর জন্য অথবা তথাকথিতভাবে আল কায়দার সঙ্গে যুক্ত কোনও গোষ্ঠীর জন্য রাঁধুনী বা নার্স-এর কাজ করতে বাধ্য হয়, তবে সে ‘বস্তুগত সমর্থন’ জুগিয়েছে বলে ধরে নেওয়া হবে এবং সে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় থেকে বঞ্চিত হতে পারে ও ‘শত্রুপক্ষের যোদ্ধা’ বলে চিহ্নিত হতে পারে। যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একদল লোক বিদেশে কোনও মুসলিম সেবামূলক সংস্থায় চাঁদা দেয়, যার কিছু কাজকর্ম মার্কিন স্বার্থবিরোধী কাজের সমর্থন জুগিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে ‘বস্তুগত সমর্থনকারী’ ও ‘শত্রুপক্ষের যোদ্ধা’ হওয়ার অভিযোগে মামলা করা যেতে পারে।

এইভাবে, বস্তুগত সমর্থনের সংজ্ঞাটি আর সমর্থনের মাত্রা ও উদ্দেশ্যের ওপর নির্ভর করে না। শব্দের সাধারণ অর্থকে এইভাবে টেনে বাড়িয়ে নেওয়ার ফলে, রাজনৈতিক বক্তব্যের অধিকারের ক্ষেত্রেও বিপদ দেখা দিয়েছে। লিন স্টুয়ার্ট (Lynne Stewart)-এর কথাই ধরা যাক। তিনি ছিলেন নিউইয়র্কের এক সাহসী আইনজীবী, যিনি বর্তমানে একটি হিংসাত্মক সংগঠনকে রাজনৈতিক সমর্থন জোগাতে রাজী হওয়া ইত্যাদি অভিযোগে দণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত।

সংশ্লিষ্ট সংগঠনটি হলো ইজিপ্‌শিয়ান ইসলামিক গ্রুপ, যারা দীর্ঘদিন ধরে ইজিপ্টের অত্যাচারী সরকারের বিরোধিতা করে আসছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের বার্ষিক কান্ট্রি রিপোর্ট অনুসারেও ওই সরকারের মানবাধিকারের রেকর্ড খুবই খারাপ। লিন স্টুয়ার্ট ১৯৯৫-৯৬ সালে নিউ ইয়র্কে শেখ আবদেল রহমান (বা, Omar Abdel-Rahman)-এর বিচারের সময় তাঁর আইনজীবী ছিলেন। শেখ আবদেলের বিরুদ্ধে ১৯৯৩ সালে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে বোমা ছোঁড়ার ঘটনার সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছিল, এবং তাঁকে এমন প্রমাণের ভিত্তিতে দণ্ডাজ্ঞা দেওয়া হয়, যা সন্দেহাতীত ছিল না।

দণ্ডাজ্ঞা পাওয়ার পরে তাঁকে জেল হাসপাতালে নির্জন কারাবাসে রাখা হয়। তিনি দৃষ্টিহীন, বয়স্ক ও বহুমূত্র রোগে আক্রান্ত। তিনি ইংরেজি বলতে পারেন না। বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয় কেবলমাত্র তাঁর আইনজীবীরা দেখা করতে এলে, বা কখনও কখনও তাঁর স্ত্রী ও নিকট আত্মীয়দের সঙ্গে টেলিফোনে কথা হলে। এইসব কথাবার্তায় খোলাখুলিভাবেই আড়ি পাতা হয় এবং আইনজীবীদের সঙ্গে তাঁর কথোপকথনও গোপনে রেকর্ড করা হয়।

লিন স্টুয়ার্ট ইজিপ্টের সংবাদপত্রে দুটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন, যাতে তিনি ইসলামিক গ্রুপের ইজিপ্টের সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত না-হওয়ার বর্তমান নীতি বজায় রাখা উচিত কিনা, তা নিয়ে শেখ আবদেল রহমানের মতামত জানিয়েছিলেন। এই বিবৃতিগুলিতে হিংসার পক্ষে কথা বলা হয়নি। শুধুমাত্র অহিংসাই বাঞ্ছিত পথ কিনা, সে-ই প্রশ্ন তোলা হয়েছিল, এবং সিদ্ধান্তটা ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল যাঁরা ইজিপ্টে আছেন তাঁদের ওপর। তাঁরা অহিংসার পথেই থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এই বিবৃতিগুলির ফলে কেউ নিহত হয়নি, কারোর কোনও ক্ষতিও হয়নি।

সরকার-পক্ষের বক্তব্য ছিল, মক্কেলের মতামতের পুনরুক্তি করে স্টুয়ার্ট ‘জনবল’ রূপে ‘বস্তুগত সমর্থন’ জুগিয়েছিলেন, এবং বিচারক আদালত তা মেনেও নিয়েছিল। অর্থাৎ, বুশ প্রশাসন এই যুক্তিকে প্রতিষ্ঠা করতে সফল হয়েছিল যে, স্পষ্টভাবে ও অবিলম্বে বিপদের প্রমাণ ছাড়াও, জনস্বার্থ সম্পর্কিত কোনও বিষয়ে, রাজনৈতিক বক্তব্যও বেআইনি।

এটা দেখিয়ে দেয় যে, তথাকথিত সন্ত্রাসবাদের অপরাধমূলক সমর্থনের প্রসারণশীল সংজ্ঞার মধ্যেই বিপদ লুকিয়ে আছে। যাই হোক, লিন স্টুয়ার্টের মতো বেশিরভাগ মামলায় সাংবিধানিক রক্ষাকবচের ব্যাপারে সওয়াল করবার জন্য সাধারণ আদালতের দরজা খোলা আছে। শরণার্থীদের সে-ই অধিকার নেই। তাঁদের জন্যে বিচার বিভাগীয় পুনর্বিবেচনার পথ রয়েছে, কিন্তু এটা প্রমাণিত যে তা যথেষ্ট নয়। বক্তব্য ও সংগঠনের ক্রমবর্ধমান অপরাধীকরণ যেভাবে চলছে, তা বিগত দশকগুলিতে যাঁরা রাজনৈতিক সংগ্রামের সঙ্গে জড়িত থেকেছেন, তাঁদের কাছে পরিচিত।

‘শত্রুপক্ষের যোদ্ধা’র এই ক্রমপ্রসারমান সংজ্ঞার আওতায় যেসব নাগরিক পড়েন, তাঁদের অন্তত অসামরিক আদালতে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। আমরা দেখাব, এই আদালতগুলি রাষ্ট্রপতির ঘোষণার থেকে বাইরে বেরিয়ে নিরপেক্ষ ভাবে বিচার করে কিনা। আইন প্রণয়নকারীরা নিরপেক্ষতার খুব একটা ভালো উদাহরণ রাখতে পারেননি। ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’র সঙ্গে জড়িত কয়েকটি মামলায় যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালতের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তের মধ্যে সরকারি বাড়াবাড়ি সম্পর্কে কিছু সাহসী কথাবার্তাও যেমন রয়েছে, তেমনি কোনও কোনও ক্ষেত্রে প্রশাসনিক ক্ষমতার কাছে সরাসরি বশ্যতাও রয়েছে।


মৌলিক পার্থক্য

কিন্তু, পেয়ে লক্ষ করেছেন, রাষ্ট্রপতির ঘোষণাগুলি, ডিটিএ এবং এমসিএ-র মধ্যে মৌলিক পার্থক্যটা ঘটে গেছে ‘শত্রুপক্ষের যোদ্ধা’ বলে পরিগণিত বিদেশীদের ক্ষেত্রে। তিনি দেখেছেন, প্রশাসনের স্পষ্ট লক্ষ্য হলো এই ব্যক্তিদের হেবিয়াস কর্পাসের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা, অর্থাৎ তাদের কোনও অসামরিক আদালতে যেতে না দেওয়া, যেখানে সরকারকে আইনসঙ্গত ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে প্রমাণ করতে হবে যে, তার বন্দিকে আটক রাখার অধিকার আছে। উপরন্তু, এই পুনর্বিবেচনাহীন বন্দিত্ব হয়ে উঠেছে এক অসীম, নির্জন কারাবাস, যেখানে জিজ্ঞাসাবাদের পদ্ধতিগুলিকে অনেকেই নির্যাতন বলে মনে করেন, যেখানে স্বাধীন আইনজীবী নিয়োগ করার সুযোগ নেই, এবং প্রকৃত অর্থে একে কোনও ফোরামে চ্যালেঞ্জ জানানোর কোনও অধিকার নেই।

এ বিষয়ে পরিষ্কার হয়ে নেওয়া ভালো। আমরা যারা বন্দিদের প্রতিনিধিত্ব করি, তারা স্বীকার করি না যে অসামরিক আদালতগুলির কোনও ক্ষমতা নেই, এবং বুশ প্রশাসনের উদ্দেশ্যসিদ্ধি বিনা বাধায় হতে পারে। এটা দেখা যাবে। কিন্তু সাংবিধানিক শাসনের ঘোষিত ব্যবস্থার থেকে একটা যে গুণগত পার্থক্য ঘটে গেছে, তা বোঝার জন্য আমাদের প্রশাসনের দাবিগুলি যাচাই করতে হবে। রাষ্ট্র যে এক নিরপেক্ষ মধ্যস্থতাকারী, এই ভণিতা ছেড়ে প্রশাসন একতরফাভাবে সে-ই সামাজিক চুক্তি ভঙ্গ করেছে, যার কথা সাংবিধানিক আইনজ্ঞরা অনেক সময় বলে থাকেন।

অবশ্যই, এই চুক্তির কথাটা অনেকাংশেই রূপকার্থে ব্যবহৃত, কিন্তু এক্ষেত্রে তার গুরুত্ব কম নয়। এর সবচেয়ে বিখ্যাত উদাহরণ হলো জুডিথ কোপলন (Judith Coplon)-এর মামলা। তিনি ছিলেন একজন মার্কিন আইনজীবী যার বিরুদ্ধে ১৯৪৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ আনা হয়েছিল। এফবিআই তার বিরুদ্ধে প্রমাণ সংগ্রহের জন্য বেআইনি ভাবে টেলিফোন ট্যাপ করেছিল, এবং তা আদালতে প্রকাশ করতে অস্বীকার করেছিল। আপিল আদালতের রায় দিতে গিয়ে বিচারপতি হ্যান্ড (Learned Hand) বলেছিলেন যে—ট্যাপ করা কথাবার্তা প্রকাশ করতেই হবে, যাতে আদালত ঠিক করতে পারে, সরকার-পক্ষ কোপলনের বিরুদ্ধে বেআইনি ভাবে সংগৃহীত প্রমাণ ব্যবহার করেছে কিনা। তিনি এই মত প্রকাশ করেছিলেন যে, সরকার দু-মুখো নীতি নিতে পারে। সরকার যদি মনে করে যে, কাউকে শাস্তি দেওয়া উচিত, তবে সে আবার পিছিয়ে গিয়ে ‘রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তার’ পর্দার আড়ালে লুকোতে পারে না এবং এমন কোনও তথ্য থেকে আসামি-পক্ষকে বঞ্চিত করতে পারে না, যার ভিত্তিতে কোনও জুরি তাকে ছেড়ে দিতেও পারে—যদি তা ‘দেশের নিরাপত্তা’র ক্ষেত্রে সবচেয়ে স্পর্শকাতর তথ্য বলে ধরে নেওয়া হয়, তবুও।

ব্যাপকতর পটভূমিতে, সংবিধানে কিছু বিশেষ বিধান রয়েছে যার দ্বারা রাষ্ট্র কীভাবে কাউকে শাস্তি দিতে পারে তা নিয়ন্ত্রিত হয়। ষষ্ঠ সংশোধনী বলে যে, সমস্ত ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্তদের তাদের বিরুদ্ধে প্রমাণের মোকাবিলা করবার জন্য আইনজীবী দাঁড় করানো এবং জুরির বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে, ইত্যাদি। পঞ্চম সংশোধনী বলে যে, সঙ্গত পদ্ধতি ছাড়া, অর্থাৎ নির্ভরযোগ্য, আইনসম্মত প্রমাণ শুনবে—এমন একটি নিরপেক্ষ ট্রাইব্যুনাল ছাড়া, কাউকে তার জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। এই সংশোধনী বলে যে, ‘কোনও ব্যক্তি’কে গ্র্যান্ড জুরি দ্বারা দোষী সাব্যস্ত না হলে, কোনও গুরুতর অপরাধের জন্য বিচার করা চলবে না। ফৌজদারি মামলায় এমন কোনও বিচারপতিকে সভাপতিত্ব করতে হবে, যিনি সারা জীবনের জন্য নিযুক্ত এবং প্রশাসনিক শাখার অধীন নন। এটা কেবল সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩ (তিন) বলেনি, এর একটা দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে। চতুর্থ সংশোধনী অনুসারে খানাতল্লাশি করবার জন্য আদালতের ওয়ারেন্ট দরকার। এই সংশোধনী যাঁরা লিখেছিলেন, তাঁরা বিশ্বাসঘাতকতা ও বিপ্লবের ধারণাগুলির সঙ্গে পরিচিত ছিলেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রশাসনিক বিভাগগুলিকে এইসব ক্ষেত্রে কোনও ছাড় দেননি।

এই নীতিগুলির কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে, কিন্তু তার মধ্যে এক্ষেত্রে বিচার্য বোধহয় একমাত্র এই বিধানটি যে, কংগ্রেস ‘সরকার এবং ভূমি ও নৌবাহিনীর নিয়ন্ত্রণের জন্য নিয়মকানুন তৈরি করতে পারে’, যার মধ্যে আছে সামরিক বাহিনীর বিচার্য অপরাধের জন্য, কোর্ট মার্শাল প্রতিষ্ঠা করার ক্ষমতা। বিদেশী শত্রুপক্ষের যোদ্ধাদের বিচারের জন্য এমসিএ ব্যবস্থায় জেনারেল কোর্ট মার্শালে অভিযুক্তদের যেটুকু রক্ষাকবচ রয়েছে তাও অনুপস্থিত। এ বিষয়ে আমরা পরে আরও আলোচনা করব।

সংবিধানে কংগ্রেসকে আরও অধিকার দেওয়া হয়েছে, জলদস্যুবৃত্তি এবং আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনকারী অন্যান্য অপরাধের সংজ্ঞা নিরূপণ করার ও তার শাস্তিবিধান করার। যখন সংবিধান গৃহীত হয়েছিল, সে-ই সময়ে এমন অনেক বিদেশী ছিল যারা আমেরিকানদের ওপর গুলি চালাতো, তাদের সম্পত্তি লুঠপাট করত এবং অন্যান্যভাবে আন্তর্জাতিক শান্তি বিঘ্নিত করত। তাদের বলা হতো ‘জলদস্যু’ (পাইরেট)। জলদস্যু-বৃত্তির বিরুদ্ধে কংগ্রেসকে সতর্কভাবে নিরূপিত সাংবিধানিক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ১৭৮৭ সালে জলদস্যুদের বন্দি করে বিচারের জন্য বন্দরে নিয়ে আসাই ছিল রীতি।[২৪]

সুতরাং, খুঁটিয়ে পড়লে, যুক্তরাষ্ট্রীয় আইন-ব্যবস্থা এবং সংবিধান কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতি সর্বাত্মক এবং তার মধ্যে ব্যতিক্রমের কোনও অবকাশ নেই। যাই হোক, আমাদের মানতেই হবে যে, সশস্ত্র সংঘর্ষের ইতিহাসে এমন অনেক উদাহরণ মেলে, যেখানে অসামরিক ও সামরিক ব্যক্তিদের সঙ্গে যেরকম ব্যবহার করা হয়েছে তা ঠিক সংবিধান-স্বীকৃত মান অনুসারে হয়নি। এই বিষয়গুলি নিয়ে আন্তর্জাতিক সমাজ সরাসরি তার মতামত জানিয়েছে, এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এমন এক শ্রেণির চুক্তির অংশীদার, যা সশস্ত্র সংঘর্ষের সময় যোদ্ধা ও অসামরিক ব্যক্তিদের রক্ষা করে। এই রক্ষাকারী নীতিগুলির বেশিরভাগই সূত্রবদ্ধ রয়েছে জেনিভা কনভেনশনের মধ্যে, যা যুদ্ধবন্দি ও অ-যোদ্ধাদের রক্ষা করে, এবং হেগ কনভেনশনের মধ্যে, যা যুদ্ধের রীতিনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন এই রক্ষাকবচগুলিকে পরিপূরণ ও সম্প্রসারণ করে।

বুশ প্রশাসনের ঘোষণা এবং তৎপরবর্তী আইন প্রণয়নের আগে, সাধারণভাবে মনে করা হতো যে, সংবিধান ও চুক্তিগুলির ভিত্তিতে এই ব্যবস্থা সশস্ত্র সংঘর্ষে লিপ্ত বা জড়িত ব্যক্তিদের আটক, বিচার ও শাস্তির সমস্ত সম্ভাবনার মোকাবিলা করতে পারে। ‘শত্রুপক্ষের যোদ্ধা’ এবং বিশেষ করে বিদেশী ‘শত্রুপক্ষের যোদ্ধা’-র এই ধারণাগুলিতে, এমন এক শ্রেণির মানুষের কথা বলা হচ্ছে, যাদের কোনও অধিকার নেই, এবং থাকলেও সে অধিকার প্রয়োগ করবার কোনও উপায় নেই। এটা অস্বস্তিকরভাবে আমেরিকার ইতিহাসে আগের এক অন্ধকারময় অধ্যায়ের কথা মনে পড়িয়ে দেয়। আমি ক্রীতদাস-প্রথার কথা বলছি। বুশ প্রশাসন আইনগত কৌশলে সাংবিধানিক কাঠামোয় এমন এক ছিদ্র খুঁজে বার করতে চেয়েছে, যে-ছিদ্র দিয়ে বিদেশী ‘শত্রুপক্ষের যোদ্ধা’ বলে বর্ণিত এক শ্রেণির মানুষ গলে তলায় পড়ে যায়।

ড্রেড স্কট (Dred Scott)-এর নাম প্রায় সকলেই শুনেছেন, এবং ড্রেড স্কট মামলার (১৮৫৭) কথা সবাই জানেন। ড্রেড স্কট ১৭৯৫ সাল নাগাদ এক ক্রীতদাসের সন্তান হিসাবে জন্মেছিল। ১৮৩০-এর দশকে, তার মালিক, উইসকনসিন টেরিটোরির ইলিনয়তে থাকত এবং কাজ করত। সে-ই সময়কার ইলিনয়ের আইন অনুযায়ী, সেখানে বাইরে থেকে কোনও ক্রীতদাসকে নিয়ে এলে, তাকে স্বাধীন হিসাবে গণ্য করা হতো, এবং যেখানে দাসপ্রথা আইনসম্মত এমন কোনও প্রদেশে ফিরে গেলেও, তাকে আর দাস রূপে গণ্য করা যেত না। সে-ই সময়ে, যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নতুন নতুন ভূখণ্ডকে যুক্ত করা হচ্ছিল এবং নতুন নতুন রাজ্য সৃষ্টি হচ্ছিল, তখন দাসপ্রথার সম্প্রসারণ নিয়ে ভয়ানক রাজনৈতিক বিবাদ, এমনকি সশস্ত্র সংঘর্ষ চলছিল।

স্কটের মালিক যখন মিসৌরিতে ফিরে গেল, তখন সে স্কটকে দাস হিসাবেই নিয়োগ করল, যা ইলিনয়তে বেআইনি হলেও মিসৌরিতে সম্ভবত আইনসম্মত ছিল। স্কট প্রথমে প্রাদেশিক, তারপর যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালতে মামলা কোরে, স্বাধীন মানুষ হিসাবে তার স্বীকৃতি দাবি করল। দাসপ্রথার বিরোধী আইনজীবীরা এবং তাদের সমর্থকরা তার পাশে দাঁড়াল।

স্কটের দাবি ছিল যে, তার মামলায় যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালতের এক্তিয়ার রয়েছে, যেহেতু সে মিসৌরির নাগরিক এবং তার ‘মালিক’ নিউ ইয়র্কের স্যানফোর্ডের নাগরিক। এটা নাগরিকত্বের ভিন্নতার দাবি, যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধান এবং প্রথম বিচার বিভাগীয় আইনে যার স্পষ্ট স্বীকৃতি রয়েছে। স্কট এও দাবি করেছিল যে, স্যানফোর্ড তাকে শারীরিকভাবে আঘাত করেছে। কিন্তু মামলার কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু ছিল—যা এই আঘাতের দাবির সঙ্গেও আবশ্যিকভাবে যুক্ত—স্কট তার অধিকারকে সম্মান করার মতো একজন স্বাধীন ব্যক্তি কিনা।

মামলাটি শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টে এল, ১৮৫৪ সালে। কোর্টে ১৮৫৬ সালের ফেব্রুয়ারি ও ডিসেম্বর মাসে একাধিক দিন এর শুনানি হলো। তার মধ্যে দাসপ্রথা নিয়ে বিতর্কটি রাজনৈতিকভাবে কেন্দ্রীয় গুরুত্ব পেতে শুরু করেছে। ১৮৫৬ সালে জেমস বুখানন (James Buchanan) রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন এবং ৪ মার্চ ১৮৫৭ তার মেয়াদ শুরু হয়। বুখানন বিচারকদের স্কটের বিরুদ্ধে প্রভাবিত করতে চেষ্টা করেন এই আশায় যে, তাহলে দাসপ্রথার সাংবিধানিক অবস্থান প্রতিষ্ঠিত হবে, এবং এ বিষয়ে জাতীয় বিতর্কের অবসান ঘটবে।

বুখাননের মেয়াদ শুরু হওয়ার দু-দিন পর, ৬ মার্চ ১৮৫৭, আদালত ছয়-তিন ভোটে তার রায় ঘোষণা করল। মুখ্য মত ছিল প্রধান বিচারপতি, মেরিল্যাণ্ডের রজার ট্যানি (Roger Brooke Taney)-র। আদালত ঘোষণা করল যে—স্কট মিসৌরির নাগরিক নয় এবং তার কোনও রাজ্যেরই নাগরিক হওয়ার ক্ষমতা নেই। আদালত আরও বলল—যে-কোনো টেরিটোরির—ফলত কোনও প্রদেশের আইনসভার ক্ষমতা নেই, এমন আইন প্রণয়ন করার, যাতে কোনও ক্রীতদাস সেখানে এলেই স্বাধীনতা পেয়ে যায়। ট্যানি-র মতে, এরকম আইন দাস মালিকদের তাদের সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করবে।

ট্যানি-র মতের কয়েকটি উদ্ধৃতি দিলেই পাঠকরা বুঝতে পারবেন, তার সঙ্গে বুশ প্রশাসন এখন যা করতে চাইছে, তার কতটা মিল আছে: কোনও রাজ্য, সংবিধান গৃহীত হওয়ার পর থেকে, একজন বিদেশীকে এমন নাগরিক অধিকার প্রদান করতে পারে না, যা যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের অধীনে কোনও রাজ্যের নাগরিকের প্রাপ্য। তবে শুধুমাত্র সে-ই রাজ্যে সে নাগরিকের অধিকার পেতেই পারে এবং সংবিধান ও সে-ই রাজ্যের আইন অনুসারে সমস্ত অধিকার ও রক্ষাকবচ পেতেই পারে। কোনও রাজ্য, সংবিধান গৃহীত হওয়ার পর প্রণীত, তার নিজের আইন বা নিয়ম অনুসারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানসৃষ্ট রাজনৈতিক সমাজে কোনও নতুন সদস্যকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারবে না।

ট্যানি বলেছিলেন, সংবিধান রচয়িতারা মনে করতেন যে—আফ্রিকানরা, দাস হোক বা স্বাধীন হোক, হলো “নিকৃষ্ট স্তরের জীব, এবং শ্বেতাঙ্গ জাতির সঙ্গে সামাজিক বা রাজনৈতিক সম্পর্কে আবদ্ধ হতে একেবারেই অযোগ্য, এতই অযোগ্য যে তাদের এমন কোনও অধিকারই নেই যাকে শ্বেতাঙ্গরা সম্মান করতে পারে।” অবশ্যই, তিনি বলেছিলেন—স্কটের দাবি “নিগ্রো জাতিভুক্ত ব্যক্তিদের… তাদের ইচ্ছামতো যে-কোনো রাজ্যে ঢোকার অধিকার দিয়ে দেবে… সেখানকার নাগরিকরা যার ওপর প্রকাশ্যে এবং একান্তে বক্তব্য রাখতে পারে এমন যে-কোনো বিষয়ে কথা বলার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেবে, এবং রাজনৈতিক বিষয়ে জনসভা করবার ও ইচ্ছামতো অস্ত্র নিয়ে ঘোরার অধিকার দেবে।”

ড্রেড স্কট মামলার সিদ্ধান্ত গৃহযুদ্ধকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছিল। ফ্রেডেরিক ডগলাস (Frederick Douglass)-এর মতো দাসপ্রথা উচ্ছেদপন্থীরা আশা করেছিলেন যে, সাংবিধানিক ব্যাখ্যার মাধ্যমে দাসপ্রথার অবসান ঘটানো যাবে। তিনি ট্যানি-র থেকে অন্যভাবে সংবিধানকে গড়েছিলেন, যা দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিক থেকে দাসপ্রথাকে দেখেছিল। প্রথমত, কর নির্ধারণ ও আইনসভায় আসন বণ্টনের ক্ষেত্রে তা এক-একজন দাসকে একজন ব্যক্তির তিন-পঞ্চমাংশ হিসাবে গণ্য করেছিল, এবং ১৮০৮ সাল পর্যন্ত দাসব্যাবসাকে নিষিদ্ধ করা থেকে কংগ্রেসকে বিরত রেখেছিল। দ্বিতীয়ত, সংবিধানের প্রথম অনুচ্ছেদের দ্বিতীয় ভাগ থেকে এটা পরিষ্কার ছিল যে, সাংবিধানিক অর্থে দাসরা ‘ব্যক্তি’ এবং যেসব রাজ্যে দাসপ্রথা ছিল সেখানে, কংগ্রেসের আসন বণ্টনের ক্ষেত্রে তাদের অন্তত কিছুটা পরিমাণে গণ্য করা হয়েছিল।

ট্যানি এবং আদালতের সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকরা—বেশিরভাগই দক্ষিণ থেকে আসা—অন্যরকম সিদ্ধান্তে আসতে পারতেন, যদি তারা সংবিধানের ভাষায় ‘ব্যক্তি’ শব্দটির ওপর নির্ভর করতেন, এবং আদালতের দাসপ্রথা সম্পর্কিত পূর্বতন সিদ্ধান্তগুলিকে খুঁটিয়ে পড়তেন। ১৮২৫-এ, প্রধান বিচারপতি জন মার্শাল (John Marshall) ‘অ্যান্টিলোপ’ নামে একটি মামলায় আদালতের সিদ্ধান্ত হিসাবে লিখেছিলেন যে—তখন যেভাবে দাসপ্রথা ও দাস ব্যবস্থা চলত তা আন্তর্জাতিক আইনকে লঙ্ঘন করেনি, সুতরাং সংবিধানকেও লঙ্ঘন করেনি। ১৮৪১-এ অবশ্য দাসব্যাবসা সংক্রান্ত বিখ্যাত মামলা ‘আমিস্টাড’ সুপ্রিম কোর্টে আসে, এবং দাসপ্রথা বিরোধী শক্তিগুলি ব্যাপকভাবে তাকে সমর্থন করে। বিচারপতি জোসেফ স্টোরি (Joseph Story)-র লেখা ‘আদালতের সিদ্ধান্ত’ এ কথা বলেনি যে, দাসপ্রথা অসাংবিধানিক। কিন্তু, তা এক দাস-জাহাজে, আফ্রিকানদের, তাদের স্বাধীনতার জন্য বিদ্রোহ করার অধিকারকে সমর্থন করেছিল। বিচারপতি স্টোরি ‘ন্যায়বিচার ও আন্তর্জাতিক আইনের চিরকালীন নীতিগুলির’ কথা বলেছিলেন।

এই ধারণাটা এমনকি ‘অ্যান্টিলোপ’-এও প্রচ্ছন্ন ছিল। এবং ‘আমিস্টাড’-এ খোলাখুলি ভাবেই ব্যক্ত হয়েছিল যে, স্বাধীনতাকামী আফ্রিকানরা আইনের চোখে ‘মর্যাদা’ পাওয়ার যোগ্য ব্যক্তি। ‘মর্যাদা’র কোনও অর্থই হয় না, যদি না রাষ্ট্রশক্তিকে দিয়ে তা আদায় করানোর কোনও পদ্ধতি থাকে। ড্রেড স্কট মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছিল যে—এক শ্রেণির মানুষ রয়েছে, যারা সংজ্ঞাগত ভাবেই সংবিধানের চৌহদ্দির বাইরে, কেবল কিছু রাজ্য আফ্রিকানদের স্বাধীনতা অনুমোদন করতে পারে, এবং যদি তারা দাস হয়ে থাকে, তাদের মালিকদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

আদালতের সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকদের মতে, আমার সহকর্মী মুনীর আহমদ-এর বাঙ্ময় ভাষায় বললে, ড্রেড স্কটের ‘কোনও অধিকার থাকবার অধিকার ছিল না’। এই সিদ্ধান্ত যে গৃহযুদ্ধকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছিল, তার এক সরাসরি ফল হিসাবে, সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী দাসপ্রথাকে বিলুপ্ত করে। যে কথা সংবিধানে প্রচ্ছন্ন আছে, বলে অনেকেই মনে করেছিল, চতুর্দশ সংশোধনী তা পরিষ্কার করে বলে: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণকারী বা নাগরিক অধিকার প্রাপ্ত এবং তার এক্তিয়ারভুক্ত সমস্ত ব্যক্তি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এবং তারা যে-রাজ্যে বসবাস করছে, তার নাগরিক। কোনও রাজ্য এমন কোনও আইন প্রণয়ন বা বলবৎ করবে না, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের অধিকার ও রক্ষাকবচগুলিকে খর্ব করে; কোনও রাজ্য, আইনের যথাযথ পদ্ধতি ছাড়া, কোনও ব্যক্তিকে তার জীবন, স্বাধীনতা বা সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করবে না, বা তার এক্তিয়ারভুক্ত কোনও ব্যক্তিকে আইনের সমান সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত করবে না।

অবশ্যই, ১৮৭২-এর পরে, দক্ষিণের রাজ্যগুলি চতুর্দশ সংশোধনীর এই কথাগুলিকে কার্যত হত্যা করে ‘ব্ল্যাক কোড’ প্রণয়ন করে, যা ভূতপূর্ব ক্রীতদাসের ব্যক্তি ও নাগরিক হিসাবে সমস্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত এই আইনি বিভাজন অটুট ছিল। তাদের সে-ই চেষ্টা আজও চলছে।

রাষ্ট্র এক শ্রেণির মানুষকে ন্যায়বিচার পাওয়ার সমস্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারে, এই ধারণা ড্রেড স্কট মামলার সিদ্ধান্ত থেকে আসেনি, এমনকি দাসপ্রথার আইনি ভাবাদর্শ থেকেও আসেনি। আরও আগে, ঊনবিংশ শতাব্দীতেই, উপনিবেশ স্থাপনকারী শ্বেতাঙ্গদের হাত থেকে তাদের পরম্পরাগত জমি বাঁচানোর জন্য আমেরিকার আদিবাসীদের জাতি ‘চেরোকি’ সংগঠিত হয়েছিল, জর্জিয়া রাজ্যের বিরুদ্ধে তাদের দাবি প্রতিষ্ঠিত করতে, যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালতে গিয়েছিল।

‘ল অ্যান্ড দ্যা রাইজ অব ক্যাপিটালিজ্‌ম’ বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণে আমি লিখেছি: জর্জিয়ার চেরোকি জাতি একটি লিখিত সংবিধান গ্রহণ করেছিল, এবং তাদের জমির ওপর তাদের সার্বভৌমত্ব ঘোষণা করেছিল। জর্জিয়ার আইনসভা উত্তর দিয়েছিল, চেরোকিদের আইন ও প্রথা নাকচ করে দিয়ে, এবং চেরোকিদের জমিকে উপনিবেশের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়ে। প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু জ্যাকসনের চাপে, যুক্তরাষ্ট্রীয় কংগ্রেস, আমেরিকান আদিবাসীদের জমি ছেড়ে দিয়ে আরও পশ্চিমে সরে যেতে বাধ্য করবার জন্য আইন পাস করল। জর্জিয়া কর্তৃপক্ষ চেরোকি ভূখণ্ডে কৃত এক তথাকথিত অপরাধের জন্য একজন চেরোকিকে গ্রেপ্তার কোরে, বিচার কোরে ফাঁসি দিল।

চেরোকি জাতি আদালতে বিচার চাইল।[২৫] হাজার হোক, তারা একটা জাতি তো বটে। তারা জর্জিয়ার আইনের প্রয়োগ আটকাতে চাইল এই বলে, যে, তা “এক রাজনৈতিক সমাজ হিসাবে চেরোকিদের ধ্বংস করতে চায়, এবং জর্জিয়ার ব্যবহারের জন্য এই জাতির জমি কেড়ে নিতে চায়, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দৃঢ় চুক্তির দ্বারা তাদের দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, যে চুক্তি এখনও বলবৎ আছে।” চেরোকিদের আইনজীবী সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপ চাইল এই বলে, যে, এই মামলা এক বিদেশী রাষ্ট্র—চেরোকি—এবং জর্জিয়া রাজ্যের মধ্যে এবং নিম্ন আদালতের সিদ্ধান্ত ও তারপর আপিল শোনার জন্য অপেক্ষা না কোরে, সুপ্রিম কোর্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান অনুসারে এর ওপর তার মৌলিক এক্তিয়ার খাটাতে পারে।

প্রধান বিচারপতি মার্শাল ‘বিদেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে, একাধিক রাজ্যের মধ্যে, এবং ইণ্ডিয়ান জনজাতিদের সঙ্গে’ বাণিজ্যকে নিয়ন্ত্রণ করবার জন্য কংগ্রেসকে দেওয়া সাংবিধানিক ক্ষমতা খুঁটিয়ে দেখলেন। দেখে তার মনে হলো যে, চেরোকিরা ‘একটি আভ্যন্তরীণ, নির্ভরশীল জাতি’ এবং ‘অভিভাবকের কাছে সন্তানের মতো’ এক ‘আশ্রমিক অবস্থান’-এ রয়েছে। তিনি এও বললেন— ‘আদালতের চোখে তারা একটি সত্যিকারের বিদেশী রাষ্ট্র’ নয়।

আদালত ‘চেরোকি নেশন বনাম জর্জিয়া’ মামলার রায় দেয় ১৮৩০ সালে, বিচারপতি স্টোরি এবং থম্পসনের ভিন্ন মত সহ। দু-বছর পর, ‘উরস্টার বনাম জর্জিয়া’[২৬] মামলায় প্রধান বিচারপতি মার্শাল একটু পিছু হটে এই মত প্রকাশ করলেন যে, চেরোকি ভূখণ্ডে কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণের অধিকার জর্জিয়ার নেই। তিনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন—চেরোকি জাতির অবস্থানকে স্বীকৃতি দেওয়ার ভিত্তিতে নয়, জর্জিয়ার মতো রাজ্যগুলির একান্তভাবে যুক্তরাষ্ট্রীয় কোনও বিষয়ে হস্তক্ষেপের অধিকার নেই, এই মতের ভিত্তিতে। অর্থাৎ, কেবল জাতীয় সরকারেরই আমেরিকান আদিবাসীদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সাংবিধানিক ক্ষমতা আছে, এবং এ ব্যাপারে রাজ্যগুলির ভূমিকা সীমিত।

‘চেরোকি নেশন’ মামলার সময় সাম্রাজ্যবাদী মতাদর্শ সবে দানা বেঁধেছে, প্রশাসনিক শক্তির হাতে এক সর্বময়, পুনর্বিচারের অতীত ক্ষমতার আবাহনের মাধ্যমে, ‘অধীন মানুষ’দের সেইসব মঞ্চের বাইরে সরিয়ে রাখাকে ন্যায্যতা দেওয়া হচ্ছে, যেখানে তারা তাদের অধিকার জাহির করতে পারে। চেরোকি নেশন ও ড্রেড স্কট মামলা, এবং জাঁ-ক্লদ পেয়ে যা নিয়ে লিখেছেন, সে-ই ‘শত্রুপক্ষের যোদ্ধা’র সংজ্ঞার মধ্যে, একটি সাধারণ সূত্র রয়েছে, তা হলো, কারো কারো ন্যায় বিচারের দাবিকে যাবতীয় আলোচনার সম্ভাবনার বাইরেই রাখা।

পক্ষান্তরে, কোনও রাজনৈতিক গোষ্ঠী বা ব্যক্তি মত প্রকাশের বা সংগঠনের অধিকার দাবি করতে পারে। সে সাংবিধানিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত একটি ট্রাইব্যুনালে যেতে পারবে। এই ধারণাগুলি কীভাবে কার্যক্ষেত্রে প্রযুক্ত হতে পারে, আদালতে তা নিয়ে বিতর্ক হবে। তারপর আদালত তথ্য যাচাই করে আইনকানুন প্রয়োগ করবে।

বহু দশকের অভিজ্ঞতা আমাদের শিখিয়েছে যে, সাংবিধানিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত এইসব আদালত অনেক সময় নিয়মকানুন সূত্রায়িত করা এবং তথ্য নিরূপণ করার ক্ষেত্রে অযৌক্তিক ভাবে প্রশাসনিক বিভাগের কাছে নতি স্বীকার করে। নিরপেক্ষতার সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি হলো আরেকটি মিথ্যা কথা, যা শাসকরা জনগণকে বলে। যখন প্রক্রিয়াটাকে ন্যায্য বলে মনে হয়, তখনও এমন কোনও গ্যারান্টি থাকে না, যে অন্যায্য ফল হবে না। যাই হোক, এই মামলাগুলোর ক্ষেত্রে অন্তত শাসকরা সাধারণভাবে জনগণকে বলে যে, তাদের ন্যায়বিচার বলে কোনও একটা কিছু পাওয়ার অধিকার আছে, এবং এই প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ট্রাইব্যুনালগুলি এমন কিছু নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করে, যাতে মনে হয় যে, ন্যায়সঙ্গত ভাবেই ফলাফলে পৌঁছানো হচ্ছে।

নবাবিষ্কৃত ‘শত্রুপক্ষের যোদ্ধা’ শ্রেণি বিভাগটি, বিশেষত তা যখন অ-নাগরিকদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়, রাষ্ট্রপতি এবং যে-ব্যক্তির বিরুদ্ধে সে-ই শক্তি প্রয়োগ করা হচ্ছে, তার মধ্যেকার সম্পর্কের সূত্রটাই ছিঁড়ে দেয়। বুশ প্রশাসন এমন এক চরিত্রায়ণ—এমন একটা লেবেল—তৈরি করেছে, যাতে অধিকারের প্রশ্নটাই বিতর্কের থেকে বার করে দেওয়া যায়।

১৮৪২ সালে মার্ক্স একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন, বিষয় ছিল—’কাঠ চুরি সম্পর্কিত আইন’। সেখানে তিনি দেখিয়েছিলেন, কীভাবে প্রুশিয়ান রাষ্ট্র কৃষক-জীবনচর্যাকে বেআইনি করেছিল, শুধুমাত্র এই ঘোষণা কোরে যে, গাছের তলায় পড়া ডালপালাও গাছের মালিকেরই সম্পত্তি। কৃষকরা, যারা চিরকাল উনুন ধরানো আর আগুন পোয়ানোর জন্য এইসব ডালপালা কুড়িয়ে এসেছে, তারা এইভাবে সমাজের আরও প্রান্তের দিকে সরে যেতে বাধ্য হলো এবং মজুরি-শ্রমিকের সারিতে গিয়ে দাঁড়াল। ১৭২১ এবং পরবর্তীকালে ইংল্যাণ্ডের ‘ব্ল্যাক অ্যাক্ট’গুলি একই উদ্দেশ্যে সেখানকার কৃষকদের একইরকম ক্ষতি করেছিল, থম্পসন (Edward Palmer Thompson) যা নিপুণভাবে দেখিয়েছেন।

‘রোমার বনাম ইভান্স’ (১৯৯৬) মামলায় সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তও মনে রাখা দরকার। কোলোরাডোর অনেক শহরই বিভিন্ন ভাবে সমকামীদের অধিকার সুরক্ষিত কোরে আইন করেছিল। ১৯৯২ সালে এক রাজ্যস্তরের গণভোটে কোলোরাডোর ভোটাররা এক রাজ্য-সংবিধান সংশোধনী অনুমোদন করে। এটি রাজ্য সরকারের দ্বারা, কোনও পর্যায়ে, এমন কোনও আইন সভাগত, বিচার বিভাগীয় বা প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা নিষিদ্ধ করে, যা সমকামীদের বৈষম্যের শিকার না-হওয়ার অধিকারকে স্বীকৃতি দেবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট বলে যে, এই রাজ্য-সংবিধান সংশোধনী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনীর সমান-সুরক্ষা সংক্রান্ত অনুচ্ছেদকে লঙ্ঘন করে। ছ’জন বিচারকের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের পক্ষে বিচারপতি কেনেডি (McLeod Kennedy) বলেন—এই আইন সমকামীদের এমন এক শ্রেণির মানুষ হিসাবে চিহ্নিত কোরেছে, যাদের বৈষম্যের প্রতিকার চাইবার কোনও অধিকার নেই। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বিচারপতি কেনেডি বলেছেন যে, তার কাছে কোলোরাডোর এই ব্যবস্থা উদ্দেশ্য ও ফলাফলের দিক থেকে ড্রেড স্কট মামলার সিদ্ধান্তের মতোই মনে হয়েছে।

‘রোমার’ মামলায় আদালতের সিদ্ধান্ত এবং বিচারপতি কেনেডির মন্তব্য ‘শত্রুপক্ষের যোদ্ধা’ শ্রেণি বিভাগটির সম্পর্কে আরেকটা কথা মনে পড়িয়ে দেয়। ঘোষণা ও স্ট্যাটিউটগুলি এক শ্রেণির লোক তৈরি করছে, যাদের কিছু বিপজ্জনক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আছে, বলে দাবি করা হচ্ছে। তারপর কমিশনের সামনে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তাদের আচরণে কোন কোন বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেয়েছে তা নির্ধারণ করার জন্য। এটা বিনা বিচারে শাস্তির এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ, যা সংবিধান অনুসারে নিষিদ্ধ। যেমন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বনাম ব্রাউন’ (১৯৬৫) মামলায় সুপ্রিম কোর্ট একটি স্ট্যাটিউট নাকচ করে দেয়, যা কোনও কমিউনিস্ট পার্টি-সদস্যের শ্রমিক ইউনিয়নের কোনও পদে থাকাকে অপরাধ বলে গণ্য করেছিল, কারণ এই স্ট্যাটিউট এক শ্রেণির সন্দেহভাজন লোকের সৃষ্টি করেছিল: তারা কোনও নির্দিষ্ট অপরাধ করেছে কিনা তা আদালতের বিচারে ঠিক না করেই তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করে ফেলা হয়েছিল।

এবার দেখা যাক পাইকারি হারে অধিকার হরণের ব্যবস্থা করার আদৌ কোনও ন্যায্যতা আছে কিনা। ইতোমধ্যেই, খবরের কাগজে রিপোর্ট বেরোতে শুরু করেছে যে, এই বন্দি বা ওই বন্দি স্বীকার করেছে যে, সে কোন আমেরিকান লক্ষ্যবস্তুর বিরুদ্ধে সশস্ত্র হামলায় অংশগ্রহণ করেছে। কাগজে সামরিক অফিসারদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হচ্ছে যে, তারা আরও এরকম তথ্য প্রকাশের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে। এই রিপোর্টগুলির একটা বাঁধাধরা উত্তর হলো, ‘এই প্রশাসনের কোনও কথায় কেউ কি বিশ্বাস করে?’ তারপর মাথা নেড়ে বেশিরভাগ মিডিয়া এখন কী সহজে সবকিছু বিশ্বাস করে নেয় তার সম্পর্কে মন্তব্য করা হয়।

একটা আরও সিরিয়াস উত্তর পাওয়া যায়, রাষ্ট্রপতির ঘোষণা এবং কংগ্রেস প্রণীত আইনগুলির বয়ান থেকেই। এমসিএ নির্যাতনকে অনুমোদন না-করার কথা প্রকাশ্যে বললেও, যেসব আমেরিকান তা করে, আইন তাদের দায় থেকে আড়াল করে। সরকারের যুক্তি হলো যে, এই সীমিত নিষেধ লঙ্ঘন কোরে, আদায় করা, সে-ই স্বীকারোক্তিগুলিকেই কেবল প্রমাণ হিসাবে ব্যবহার করা, অনুমোদন করা হচ্ছে, যা এই স্ট্যাটিউট প্রণয়ন করার আগে নেওয়া হয়েছে। তাছাড়া, প্রেসিডেন্ট বুশ এই আইনে স্বাক্ষর করার সঙ্গে সঙ্গে আর একটি স্বাক্ষরিত বিবৃতিও দিয়েছেন, যা এই স্ট্যাটিউটের নির্দেশ মানা হবে কিনা তা নিয়েই সন্দেহ জাগায়। যাই হোক, প্রশাসন নির্যাতন কাকে বলে, সে সম্পর্কে অত্যন্ত সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গী নিয়েছে। ফলে জিজ্ঞাসাবাদের এমন সব পদ্ধতিকে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে, যা আন্তর্জাতিক সমাজে বহুদিন আগেই নিন্দিত হয়েছে। সংক্ষেপে বলতে গেলে, এইসব তথাকথিত ‘স্বীকারোক্তি’ দীর্ঘ, নির্জন ও অমানবিক বন্দিত্ব এবং এমন জিজ্ঞাসাবাদের ফল, যা ঐতিহাসিকভাবে নিন্দিত হয়েছে এই কারণে যে, সেরকম অবস্থায় পড়লে মানুষ অভিযোগ অসত্য হলেও তা মেনে নেয়। আমি যখন এই কথাগুলি লিখছি, তখন আঠারো জন ব্রিটিশ নাবিক, ইরানের জলসীমা লঙ্ঘন করার জন্য, সেখানে বন্দি হয়ে আছে। তাদের মধ্যে অন্তত একজন টেলিভিশনের পর্দায় হাজির হয়ে এই লঙ্ঘনের জন্য ক্ষমা চেয়েছে। বেশিরভাগ কাগজেই এই বিবৃতিকে ‘স্বীকারোক্তি’ বলা হয়েছে, এবং উদ্ধৃতি চিহ্নগুলি বুঝিয়ে দিয়েছে যে, ইরানের জিজ্ঞাসাবাদের পদ্ধতিকে তারা বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে করছে না। অথচ, এই একই কাগজগুলি গুয়ান্তানামোর বিষয় লিখতে গিয়ে উদ্ধৃতি চিহ্ন ব্যবহার করে না।

গুয়ান্তানামো এবং আরও বিচ্ছিন্ন বন্দিশালাগুলিতে ঠিক কী ধরনের জিজ্ঞাসাবাদের পদ্ধতি নেওয়া হয়, তা নিয়ে যখনই নাগরিকদের, সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের, এমনকি আইনসভার পক্ষ থেকেও কোনও তদন্ত করা হয়, তখনই প্রশাসন বলে যে, এটা রাষ্ট্রের গোপন তথ্য। সত্যিই, গুয়ান্তানামোর মামলাগুলিতে, সরকার আইনজীবীদের জিজ্ঞাসাবাদের পদ্ধতি জানা থেকে বিরত করতে চেয়েছে এই বলে যে, সন্ত্রাসবাদীরা যদি জানতে পারে, কীভাবে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে, তবে তারা এইসব পদ্ধতি সহ্য করার জন্য নিজেদের তৈরি করতে পারবে।

গুয়ান্তানামো থেকে বেরিয়ে আসা একটি সাম্প্রতিক তথ্য হলো যে, একজন তানজ়ানিয়ান, আহমেদ ঘাইলানি (Ahmed Khalfan Ghailani), এবং একজন পাকিস্তানি, ওয়ালিদ বিন আতাশ (Walid bin Attash), তাদের স্বীকারোক্তিতে বলেছে যে, তারা ১৯৯৮ সালে তানজ়ানিয়া ও কেনিয়ার মার্কিন দূতাবাসে বোমা বিস্ফোরণের এক পরিকল্পনায় সাহায্য করেছিল। যেসব বন্দিকে সম্প্রতি সিআইএ-র গোপন বন্দিশালাগুলি থেকে গুয়ান্তানামোয় পাঠানো হয়েছে, তারা তাদের মধ্যেই ছিল। এই বন্দিশালাগুলিতে নিঃসন্দেহে তাদের নির্যাতন করা হয়েছিল। এই দুজনের কী হবে? মিলিটারি কমিশনের হাতে তাদের মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞা হতে পারে, এবং ইতোমধ্যেই তারা কোনও আদালতের বিচার অথবা তাদের গ্রেপ্তার বা বন্দিত্বের পরিস্থিতির পুনর্বিচার চাওয়ার কোনও সুযোগ ছাড়াই, তাদের আটক ও তাদের সঙ্গে আচরণের মাধ্যমে শাস্তিভোগ করছে। পাঠকদের হয়তো মনে পড়বে যে, ২০০১-এ চার ব্যক্তিকে দূতাবাসে বোমা বিস্ফোরণের সঙ্গে জড়িত থাকার জন্য নিউ ইয়র্ক ফেডারেল কোর্টে বিচার করা হয়েছিল। সরকার মৃত্যুদণ্ড চেয়েছিল। একজন আসামি, খালফান খামিস মহম্মদ (Khalfan Khamis Mohamed), দক্ষিণ-আফ্রিকায় গ্রেপ্তার হয়েছিল, সেখানে সে গিয়েছিল তানজ়ানিয়া থেকে। এফবিআই এবং কিছু নীচু পদের দক্ষিণ-আফ্রিকান আধিকারিক গল্প বানিয়েছিল যে, মৃত্যুদণ্ড হতে পারে জেনেও সে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে বিচারের মুখোমুখি হতে সম্মত হয়েছিল, যার ভিত্তিতে তাকে নিউ ইয়র্কে নিয়ে যাওয়া হয়।

দক্ষিণ-আফ্রিকার সাংবিধানিক আদালত মামলাটি গ্রহণ করে, এবং রায় দেয় যে, তাকে এভাবে পাঠানো দক্ষিণ-আফ্রিকান ও আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে অবৈধ। আদালতের রায়ে প্রকাশ হয়ে পড়ে কীরকম অসাধু উপায়ে মহম্মদকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আনা হয়েছিল। যাই হোক, মার্কিন আইনে তাতে তার বিচার আটকায়নি। বিচারে মহম্মদ দোষী সাব্যস্ত হয়, কিন্তু বিচারপতি স্যান্ড (Leonard Burke Sand) জুরিদের বলেন যে, তাঁরা সম্ভাব্য মৃত্যুদণ্ড মকুব করার কথা ভাবতে পারেন, এই কারণে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি আইন মানতো তবে মহম্মদ মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি হতেন। এ কথা নির্ভুল, কেননা, অন্যান্য কারণ ছাড়াও, দক্ষিণ-আফ্রিকা কখনওই আইনসঙ্গতভাবে প্রত্যর্পণ অনুমোদন করত না এই শর্ত না-দিয়ে, যে আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে না।

ফেডারেল বিচারে আসামিদের সাক্ষীদের জেরা করার অধিকার ছিল, এবং এই নিশ্চয়তা ছিল যে, বিচারক আইনসঙ্গতভাবে প্রমাণ সংগ্রহ করা হয়েছে কিনা তা বিবেচনা করবেন। এই বিচারে, জুরি কোনও আসামির ক্ষেত্রেই মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন করতে রাজী হয়নি।

ঘাইলানি এবং আতাশের ক্ষেত্রে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ন্যায্য প্রক্রিয়ার সমস্ত অসুবিধাগুলিকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার একটা পথ আবিষ্কার করে ফেলেছে, যেহেতু তারা আর এই প্রক্রিয়ার অধিকার প্রাপ্ত কোনও ‘ব্যক্তি’ই নয়। ‘বিদেশী শত্রুপক্ষের যোদ্ধা’ তকমাটি এমন একটি অপরাধের জন্য, যা আদালতের বিচার পাওয়ার অধিকার সম্পূর্ণভাবে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছে, যার নির্দিষ্ট সংজ্ঞা ছিল এবং যা স্পষ্টভাবেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আদালত ও জুরিদের কংগ্রেস নির্দিষ্ট এক্তিয়ারভুক্ত ছিল। এখানে মনে রাখা দরকার যে, সিআইএ-র কারাগারগুলির ক্ষেত্রে, যার একটিতে ঘাইলানি আটক ছিল, বুশ প্রশাসন দাবি করে যে, জিজ্ঞাসাবাদের পদ্ধতির সীমা নির্দিষ্ট করে, এমন কোনও চুক্তি নেই। বুশ প্রশাসন এবং সিআইএ-র মতে, এমসিএ-তে জিজ্ঞাসাবাদের ওপর কংগ্রেস-আরোপিত বিধিনিষেধ সিআইএ-র জেরাকারীদের ওপর প্রযোজ্য নয়। বস্তুত, ২০০১-এর যে-রায়ে চারজনকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল, তাতে ঘাইলানিরও নাম ছিল। বুশ প্রশাসনের ঘোষণা একজন ফৌজদারি আসামিকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করবার জন্য, তাকে ন্যায্য আইনি প্রক্রিয়ারই বাইরে নিয়ে গেছে।

আমার অবশ্য এরকম কোনও মোহ নেই যে, অশ্বেত বর্ণের মানুষদের, অথবা সন্ত্রাসবাদী যোগসাজসে অভিযুক্ত যে-কোনো বর্ণের মানুষদের, ‘সাধারণ’ ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্তদের সঙ্গেও, দৈনন্দিন খুব একটা সাংবিধানিক ভাবে মর্যাদাপূর্ণ আচরণ করা হচ্ছে। আমি এ বিষয়ে আগেও লিখেছি।[২৭] রোলাঁ বার্থ-এর কথায়—‘বিচার’ নামে ব্যবস্থাটা সবসময় তোমাকে বিচার করবার জন্য তৈরি—তোমার যা হওয়া উচিত সে-ই হিসাবে, তুমি যা আছে সে-ই হিসাবে নয়; এক সামাজিক নির্মিতি হিসাবে, একজন মানুষ হিসাবে নয়।—কিন্তু ব্যবস্থাটা যখন এইরকম আচরণ করে, তখন অন্তত একটা সুযোগ থাকে রাষ্ট্রের ঘোষিত মানদণ্ডের সঙ্গে তার কাজকর্মকে মিলিয়ে দেখবার, প্রচার ও আদালতের বাদানুবাদের সহায়তা পাওয়ার।

আমরা আইনজীবীরা আমাদের কাজ করে যাব, এখনও যেসব মঞ্চ আমাদের কাছে খোলা রয়েছে সেখানে এই বিষয়গুলিকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসার জন্যে, যথাসাধ্য যুক্তি ও ব্যাখ্যা দিয়ে। এই গুরুত্বপূর্ণ কাজের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা যেন কারোর, বিশেষত আমাদের, দৃষ্টি সেইসব ঘটনা থেকে সরিয়ে না দেয়, যা প্রতিনিয়ত ঘটে চলে, যখন রাষ্ট্র একতরফা ভাবে নিরপেক্ষতার বা ন্যায়সঙ্গত ও দায়িত্বশীল আচরণের সমস্ত ভণিতাকে সরিয়ে রাখে।


সূত্রনির্দেশ:

জঁ-ক্লদ পেয়ে
১. Carl Schmitt, The Concept of the Political (Chicago: University of Chicago Press, 2007).
২. U.S. Congress, Joint Resolution of September 18, 2001, Authorization for Use of Military Force, Public Law 107-40, 115 Stat. 224.
৩. President G. W. Bush’s Military Order of November 13, 2001: “Detention, Treatment, and Trial of Certain Non-Citizens in the War against Terrorism,” Section 4, http://www.law.uchicago.edu.
৪. President G. W. Bush’s Military Order of November 13, 2001, section 2.
৫. Terry Gill and Elies Van Sliedregt, “Guantánamo Bay: A Reflection on the Legal Status and Rights of Unlawful Enemy Combatants,” The Utrecht Law Review 1, no. 1 (September 2005), http://www.utrechtlawreview.org.
৬. http://www.defenselink.mil.
৭. U.S. Supreme Court, Rasul v. Bush CA C 321 F. 3d 1134, http://www.supremecourtus.gov.
৮. Jean-Claude Paye, “Guantánamo and the New Legal Order,” Monthly Review 57, no. 1 (May 2005).
৯. Detainee Treatment Act of 2005, December 31, 2005, http://www.justicescholars.org.
১০. U.S. Supreme Court, Ex Parte Quirin 317 U.S. (1942), http://www.law.umkc.edu.
১১. Dirt Rhodes Scholar, “Understanding Enemy Combatant Status and the Military Commissions Act,” part 1, http://stewart-rodes.blogspot.com.
১২. U.S. Supreme Court, Ex Parte Milligan 71 U.S. 2, http://www.law.uchicago.edu.
১৩. S.390 Military Commissions Act of 2006, http://www.govtrack.us.
১৪. U.S. Supreme Court, Hamdan v. Rumsfeld (no. 05–184).
১৫. Josh White, “Guantánamo Detainees Lose Appeal,” Washington Post, February 21, 2007, http://letters.washingtonpost.com.
১৬. William Branigin, “Bush Signs Bill Authorizing Detainee Interrogations, Military Commissions,” Washington Post, October 17, 2006.
১৭. “The Enemy Combatant Military Commissions Act of 2006,” http://balkin.blogspot.com.
১৮. Military Commissions Act of 2006, article 950v (b)26, http://thomas.loc.gov.
১৯. “Draft Agreement on Extradition between the United States of America and the European Union,” Council of the European Union, 8295/1/03, Rev. 1, June 2, 2003.
২০. “Le tribunal militaire de Guantánamo rend sa première condamnation,” Le Monde, March 31, 2007.
২১. Caitlin Price, “David Hicks Could Face Australian Control Order after Guantánamo Release,” Jurist, April 1, 2007, http://jurist.law.pitt.edu.
২২. Giorgio Agamben, Homo Sacer: Sovereign Power and Bare Life (Stanford, CA: Stanford University Press, 1998).
২৩. Domestic Security Enhancement Act of 2003, http://www.eff.org.

মাইকেল ই. টিগার
২৪. অবশ্যই, জলদস্যু যদি বিদেশী হতো, তবে সে বাড়তি জুরির সুরক্ষা পেত, যার অর্ধেক সদস্য হতো বিদেশী— তাকে বলে হতো জুরি ‘দে মেদিয়াতাতে লিঙ্গুয়া’। দেখুন: Respublica v. Mesca, 1 Dall. 73, 1L.Ed. 42; People v. McLean, 2 Johns.(N.Y.) 381. This practice has been abrogated. See United States v. Wood, 299 U.S. 123, 145 (1936).
২৫. Cherokee Nation v. Georgia, 30 U.S. 1 (1830).
২৬. 31 U.S. 515 (1832).
২৭. Lawyers, Jails, and the Laws Fake Bargains, Monthly Review 53, no. 3, July-August, 2001.



ছবি সৌজন্য: www.usatoday.com