তেমন কিছুই নয়, এ হলো ঘুমের মধ্যে হেঁটে চলার মুদ্রাদোষ; রেললাইনে কান পেতে অন্য গ্রহ থেকে উড়ে আসা মৌমাছিদের গুঞ্জন শোনার অভ্যাস। স্বপ্নের মধ্যে চলতে থাকা একটা শোভাযাত্রা। স্থান-কালের সীমানা ছিঁড়ে ফেলে হাওড়া-টু-এশিয়া মাইনর, ভায়া কপিলাবস্তু। যে পথ হাজার হাজার বছর ধরে অর্বুদ কোটি নারী-পুরুষের ভালোবাসায় ভয়ে নষ্টামিতে বীর্যে ঋতুরক্তে অবজ্ঞায় শীৎকারে ঔদার্যে বিশ্বাসঘাতকতায় গভীর আর পিচ্ছিল হয়ে উঠেছে।

ভারতবর্ষের সেই সুপ্রাচীন আত্মাকে স্পর্শ করার বিস্ময় থেকেই এই লেখার উৎপত্তি। প্রত্নতত্ত্ব আর লোকশ্রুতি; কবিতা আর কৃষি সমাচার; ত্রৈরাশিক থেকে আবহাওয়া বিজ্ঞান; দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, রসশাস্ত্র, বাৎসায়ন থেকে বাবুরনামা অবধি; পথ-চলতি কুড়িয়ে নেওয়া নুড়ি মায় রেসের মাঠে ঘোড়ার মুখে শোনা খবর পর্যন্ত—যা-কিছু আমাদের ছুঁয়ে ফেলে—সে সবই হয়ে ওঠে এই অমিতকথনের বিষয়বস্তু যার নাম—’পথের দেবতা’।


১.
দুগ্গা! দুগ্গা!

মৃত্যুর তীরে দাঁড়িয়ে আর কী ভিক্ষা চাইব সম্রাট
শুধু এক ভিক্ষা…
মোতিয়ার কবরের পাশে যেন আমাকে কবর দেওয়া হয়!

আগুনের মতো সর্বগ্রাসী, আলোর চেয়েও দ্রুতগামী, চেতনার চেয়েও ত্বরিত ছড়িয়ে পড়ল এই সংলাপ। শুধু তো সংলাপ নয় একটা আস্ত বিষাদসিন্ধু যেন উথলে উঠল, জান্তব আর চিরকালীন একটা মহাসত্য যেন ফেটে পড়ল বিস্ফোরণে ৷ পড়বি তো পড় হাজার হাজার ওয়াটের সাইকেডেলিক আলোর নীচে, লাল-সবুজ লেজারের ধারালো ছটায়, তিনদিক খোলা মঞ্চে, ছয় মাস আগে রাজধানী কলকাতায় গিয়ে বায়না করে রাখার সুবাদে, জেলায় এই প্রথমবার…আজ ২৯-এ চৈত্র, ১৪১৮ কৈওড় গ্রাম পঞ্চায়েতের মাঠ, দক্ষিণ দামোদর, বর্ধমান। কাল ৩০-শে চৈত্র, ১৪১৮ চড়কতলা, মারিশদা, পূর্ব মেদিনীপুর…পরশু চড়ক!…

ওই তো দাঁড়িয়ে আছেন নটসম্রাট…সারকথাটুকু প্রাণরস মাখিয়ে সবেমাত্র ছুঁড়ে দিয়েছেন লোকারণ্যে, চারিদিকে হল্লাগোল, হাত্তালি, চারিদিকে চিরকালীন ব্যথার বেশ একটা ওম ছড়িয়ে পড়েছে। ‘মৃত্যুর তীরে দাঁড়িয়ে আর কী ভিক্ষা চাইব সম্রাট…’— ব্যথার মৌতাত!

এই মহাসম্মিলনকে আবৃত করে রেখেছে এক মহতী প্যান্ডেল—প্যান্ডেল ভেসে যাচ্ছে আলোয়। আলো যেখানে শেষ সেখানে তৈরি হয়েছে কুয়াশার একটা বলয়। তার ও-পারে অপার কৃষ্ণ পৃথিবী! সেখানে আছে ব্ল্যাকআউট—জাতীয় সড়ক। সারারাত ছুটে চলে নিকাশি খালের জলে পুষ্ট উপচাপা সবজি বোঝাই মোটরচালিত দু-চাকার ভ্যানো। এক হিমঘর থেকে অন্য পাইকারের দোরগোড়ায়, এক ইলেকশান থেকে পরের ইলেকশানের ছায়ায় ছায়ায়, বাংলা-বিহার-ওড়িশার বর্ডার ভেদ করে সুদূর অবন্তী রাজ্যের শ্ৰেষ্ঠীমণ্ডলে, গান্ধারের বাজারে, বিরাট রাজার পাকশালায় তার অনন্ত যাতায়াত। ‘মোতিয়ার কবরের পাশে ঠাঁই পাবার আকুতি’ তার নেই। সে কখনও বলে না— ‘চিরসখা হে! সঙ্গে সঙ্গে থাকো, ছেড়ে চলে যেও না।’ রতিক্লান্ত রজনী ফুরিয়ে গেলে আঁচল টেনে ধরার সত্যি তার জন্য নয়।


২.
জেব্রা ক্রশিং! উত্তরাধিকার!

ফাস্ট কেলাস‌্কা টিকট কটাইকে
চড় গয়া ডিব্বা জনানী মে।
ভইস‌্‌‌বা গইল পানি মে…

ডিসেম্বরের শেষে, রাত সাড়ে এগারোটার সময় গঙ্গার হাওয়া খেতে যাওয়া কোনো ছাপোষা মাঝারি গোছের কাজ নয়। এজন্য প্রতিভাধর হতে হবে, যথাযথ সাধনা বা প্রস্তুতির দরকার। আমি আজও জোর গলায় বলব—সেই পরিমাণ প্রস্তুতি আমাদের ছিল।

এ কথা সত্যি যে, ভাগীরথীর পূর্ব তীরে সাড়ে তিনশো বছরের পুরোনো একদা ডাচ উপনিবেশ বরাহনগরের ফেরিঘাটে আসন নেবার মিনিট তিনেকের মধ্যেই তিন সদস্যের আমাদের এই ছোট্ট অভিযাত্রী দলটিকে ঘিরে ছোটখাটো একটা মেলা বসে গিয়েছিল। আর ঠিক পাঁচ মিনিটের মধ্যে আঁচ পোহাবার জন্য জ্বলে ওঠে টায়ারপোড়া আগুন। ঠিক সেই সন্ধিক্ষণে কমরেড মামুকো তাঁর হাঁটু অবধি লম্বা কাঁথা-কাপড়ের ঝোলা থেকে বের করে আনেন মাটির তৈরি, অগ্নিপক্ক কালো ও তেলপালিশ চকচকে বিষাণ। হই হই অভ্যর্থনা করে ওঠে সমবেত জনতা। অভ্যস্ত হাতে কামানে বারুদ ঠেসে ফেলতে সময় লাগে না।

‘মালানা ক্রিম ডিলাইট’—কমরেড মামুকো সগর্বে জানান। বহুদূর হিমাচলের সাদা বরফ চূড়ার গ্রাম মালানার মাটিতে উৎপন্ন কৃষিজাত এই তীব্র ও বিশুদ্ধ ভেষজটির এক পৃথুল আয়তনের সংগ্রহ মজুত আছে আমার বন্ধুটির মালিকানায়, জানা রইল। উঁহু, ভুরু কোঁচকাবেন না! হিহি শীতরাতে গঙ্গাধারে প্রবল প্রতিভাবান ছাড়া আরও যারা থাকেন, তারা নিজেদের শীতবোধক স্নায়ুগুলোকে অকেজো করে ফেলতে, যে বিশুদ্ধ ভেষজটির একান্ত মুখাপেক্ষী তার নাম ‘গাঁজা’। এই হক কথাটা জেনে রাখুন। সুতরাং হাত থেকে হাতে ঘুরতে থাকে ছিলিম।

ওই দ্রব্যগুণের ধুনকিতে সওয়ার হয়ে আর কিছুক্ষণ পর থেকেই বাঁশবোঝাই দু-চাকার ঠেলাগাড়ি ঠেলতে ঠেলতে শহর কলকাতার এই উত্তর-প্রান্ত থেকে ‘ওরা’ পৌঁছে দেবে দক্ষিণে মুকুন্দপুর কী রাজডাঙা, কালীঘাট বা গড়িয়ার প্রকাণ্ড নির্মীয়মান আবাসনক্ষেত্রে। সত্তর-আশি বছর আগেও এই চালান হত জলপথে, আজকের টালা আর টালির নালা তখনও ছিল শাখা নদী, নিদেন পক্ষে খাল। সারি সারি বাঁশ পরপর বেঁধে জলে ভাসিয়ে দিলেই চলত, তার ওপরে নিশ্চিন্তে চড়ে বসে লগি ঠেলে গন্তব্যে পৌছে দিত ওদেরই পূর্বপুরুষ। প্রজন্মের পর প্রজন্ম, গত সাড়ে তিনশো বছর ধরে। ‘ওদের’ লগ্নি করা উদ‌্‌‌বৃত্ত শ্রমে জন্ম নিয়েছে আজকের সুতানটি, এদেশের তাবৎ স্মার্টসিটি। ‘ওরা’ ভোজপুর…‘ওরা’ ছাপরা…‘ওরা’ গয়া জেলা…‘ওরা’ মুঙ্গের.. সম্বলপুর এমনকি কান্ধমাল।

গোল হয়ে বসা মহাতামাকের এই মৌতাত অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই ফেটে পড়ে কৌতুকগানে আর হাহা হল্লায়। সমবেত দেহাতি ঠেলাওয়ালাদের কাছে আজকের নৈশকালীন ধূমপানের আসর বিশেষ ও কৌতুককর বটে। কেননা আজ আর কমদামি ভেজাল গাঁজাপাতা পুড়িয়ে কটুগন্ধী ধোঁয়া টানা নয়। খয়েরি রঙের মহার্ঘ্য চরসের চিট আঠালো ডেলা, লাইটারের আগুনে অল্প পুড়িয়ে নিয়ে তারপর গুঁড়ো করে আঙুলের চাপে সিগারেটের তামাকের সঙ্গে মিশিয়ে ছিলিমে ঠেসে দিচ্ছেন উড়ে এসে জুড়ে বসা এক খোদ ‘গোরা বিলাইতি’। তারপর মুখে আগুন মেরে লম্বা একেকটা টানে ছিলিম ফাটো ফাটো। নীলাভ সাদা ধোঁয়া গলগল ঢুকে যাচ্ছে ফুসফুসে, আর কী তার খুশবু—ঠিক যেন ধুনোর মতো একটা গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে! গোরা বিলিতি সাহেব পরম যত্নে নিজে টেনে বৈষ্ণবোচিত বিনয়ে সেই ধূম্রকূট এগিয়ে দিচ্ছেন অন্যদের দিকে।

ঠিক বিলিতি না হলেও কমরেড মামুকো গোরা চামড়া বটে! জর্জিয়া থেকে আসা তরুণ আর্ট হিস্টোরিয়ান ম্যাথিউ বাস্তিয়ানেলি মামুকো ও তাঁর সঙ্গী প্রৌঢ় ব্রিটিশ চিত্রকর ব্রুস অ্যালানের সঙ্গে আমার আলাপ এই ঘটনার মাত্র চার ঘণ্টা আগে, মধ্য-কলকাতার এক সস্তা পানশালায়। রাত্রিকালীন এই গঙ্গাযাত্রার আয়োজন ব্রুসের মস্তিষ্কপ্রসূত। আলাভোলা, খেয়ালি মামুকোর পাশে ব্রুস ইয়র্কশায়ারি রকমের সংযত ও পোশাকি। চরস-গাঁজায় তাঁর রুচি নেই। ষাট ছুঁই ছুঁই ব্রুস অ্যালানের জন্ম পরাধীন ভারতে। বাবা ছিলেন আসাম প্রদেশের কোনো এক চা-বাগানের মালিক, টি-প্ল্যান্টার। ব্রুসের ছয় মাস বয়সে ভারত ছেড়ে দেশে ফিরে যায় ওদের পরিবার। তারপর থেকে এই নিয়ে তৃতীয়বার ওর এদেশে আসা। ফলে মাঝে মাঝেই ভারত সম্পর্কে সঙ্গী মামুকোর অজ্ঞতা নিয়ে রসিকতা করতে ছাড়ে না ব্রুস।

মাঝরাতে খুশিমনে বিদায় নেয় ঠেলাচালক বাহিনি। আমরা কথাহীন বহুক্ষণ বসে থাকি ঘাটের সিঁড়িতে। গঙ্গায় জোয়ার আসে রাতের অন্ধকারে। জল বাড়ে। সিঁড়ি টপকে টপকে জল উঠে আসে ওপরে। ওপারের বিখ্যাত বেলুড় মঠ প্রাঙ্গনের সার সার আলোকস্তম্ভ থেকে উলম্ব প্রতিফলন পড়েছে গঙ্গায়। নিকষ কালো জলের ওপর আলো দিয়ে তৈরি ডোরাকাটা একটা সেতু যেন ভেসে উঠেছে তাতে। ওপার থেকে এপার। এক দুই তিন চার…আমি গুনতে শুরু করি আলোকস্তম্ভের সংখ্যা। ব্রুস-ও যোগ দেয় তাতে। মামুকো বলে ওঠে—”ঠিক জেব্রা ক্রসিং এর মতো দেখতে ওই ডোরাগুলোয় পা দিয়ে দিয়ে এপার থেকে ওপার পৌঁছে যাওয়া সম্ভব, যদি ভারতীয় যোগীদের মতো মনের জোর থাকে।” ব্রুস সকৌতুকে আমার দিকে তাকায়। আমরা উঠে পড়ি।

এই হলো সাড়ে তিনশো বছর আগে তৈরি বরাহনগরের ডাচ উপনিবেশের চিহ্ন ‘ডাচকুঠি’; যা আসলে ছিল স্থানীয় ডাচ গভর্নরের আবাস, আমি আঙুল তুলে দেখাই। অন্ধকারে লাইটার জ্বালিয়ে ডাচকুঠির গায়ে বসানো প্রস্তরফলকের পাঠোদ্ধার করার বৃথা চেষ্টা করে মামুকো। ওর অধ্যবসায় দেখে হেসে খুন ব্রুস। মামুকো রেগে ওঠে। ততক্ষণে ব্রুস অ্যালানের ভাবগতিক কিঞ্চিৎ উন্নাসিক আর নিষ্ঠুর লাগতে শুরু করেছে আমারও। ওকে জানাই সে-কথা।

হেসে ওঠে চিত্রকর—।

”মামুকো তোমার জানা উচিত, শুধু ইউরোপিয়ানদের কলোনি চিহ্ন নয়, ভারতবর্ষের অলিতে গলিতে হাজার হাজার বছরের প্রকাণ্ড ইতিহাস মণিমুক্তোর মতো ছড়িয়ে আছে।”—ব্রুস বলে; আরও বলে, “কৌষিক, তুমি ভাগ্যবান যে সারাটা জীবন তুমি তোমার জন্মভূমিতেই কাটাবার সুযোগ পাবে। কিন্তু ভুলে যেও না, এই ভারতবর্ষের মাটিতেই আমার জন্ম—এই আমার জন্মভূমির গর্বিত উত্তরাধিকার!”

মাথা নীচু হয়ে আসে আমার। আমাকে লজ্জিত হতে দেখে দু-হাতে জড়িয়ে ধরে বিশাল চেহারার ব্রুস। ওর নাক-উঁচু ইয়র্কশায়ারিয় হম্বিতম্বির নীচে লুকিয়ে থাকা সপাট ভারতবর্ষীয় হৃদয় উঁকিঝুঁকি মারে!


৩.

সুন্দর অসুন্দর জীবন নদীর দুই টান, একে মেনে নিয়ে যে চলল সেই সুন্দর। সুন্দরকে অসুন্দরের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখলে সুন্দরকে খর্ব করে দেখা হয়। সুরূপ কুরূপ দুইয়ে মিলে অখণ্ড সুন্দর মূর্তি কল্পনা করা সহজ হয়।

—’বাগেশ্বরী শিল্প প্রবন্ধমালা’, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

কারপিন ঘাট রোড। বরাহনগরের এঁদো এক গলিতে জুট মিলের ইট-পাঁজর বার করা প্রকাণ্ড লাল পাঁচিলের পাশ দিয়ে ঘিঞ্জি পুতিগন্ধময় জন-বিস্ফোরণে ধ্বস্ত কুলি লাইন পার হয়ে যে কয়েকশো বছরের পুরোনো সংক্ষিপ্ত রাস্তাটা গঙ্গার ভাঙাচোরা ভিড়াক্কার স্নান ঘাটে গিয়ে পড়েছে তা আসলে সারা পৃথিবীর ছবি আঁকিয়ে আর শিল্পরসিকদের কাছে একটা তীর্থক্ষেত্র। কেন সে কথায় পরে আসছি। আপাতত যা দেখা যাচ্ছে, এটা একটা পুরোনো শ্মশান। স্নানের ঘাট সংলগ্ন ফাঁকা প্রান্তরে সারি দেওয়া ছ’টি ইট-বাঁধাই কাঠের চুল্লি। বহুদিন অব্যবহৃত। লোহার গ্রিল-দরজা দিয়ে আগলানো।

হিন্দিভাষী ডোমনি জানালেন, শেষ দাহ হয়েছে আট বছর আগে। চুল্লির পাশে গঙ্গার ধারে পাঁচিলঘেরা খানিকটা ঘাসজমি ও জনমানবহীন পরিচ্ছন্ন আরেকটা ঘাট, যার উপস্থিতি বাইরে রাস্তার দিক থেকে চোখে পড়ে না। সাদা মিউনিসিপ্যাল চুনকলি করা মামুলি গড়নের নিরলংকার এক সমাধি-পাথর এবং তার গায়ে লাগানো আবছা হয়ে আসা মার্বেললিপি৷ মার্বেলের গায়ে যা খোদাই করা আছে তা বিস্ফোরক এবং হতভম্ব করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। ওটা বেঙ্গল স্কুল অফ আর্টের প্রতিষ্ঠাতা শিল্পগুরু অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অস্থি-সমাধি!

প্রথম ধাক্কায় কিছুটা বাকরুদ্ধ হয়ে যায় আর্ট হিস্টোরিয়ান ম্যাথিউ বাস্তিয়ানেলি মামুকোর। তারপর এক নিঃশ্বাসে বলে যায়: উনি আধুনিক ভারতীয় শিল্পকলার জনক। উনি, রাজা রবি বর্মা প্রমুখ শিল্পীরা ইউরোপের অনুকরণে তৈরি ব্রিটিশ-ভারতীয় ক্লাসিকাল শিল্পধারার বিপরীতে পুনরাবিষ্কার করেন মুঘল এবং রাজপুত মিনিয়েচার পেইন্টিং; প্রাগৈতিহাসিক অজন্তা গুহাচিত্র থেকে পটচিত্র; তাঞ্জোর চিত্রকলা; মধুবনী পেইন্টিং এইসব খাঁটি ভারতীয় উপাদান, পদ্ধতি আর প্রকাশভঙ্গির।

পশ্চিমি বস্তুবাদের পালটা দর্শন হিসেবে ওরিয়েন্টালিজ‌্ম মানে প্রাচ্যের আধ্যাত্মবাদকে তিনি প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন তাঁর ছবিতে। অবনীন্দ্রনাথ সারা পৃথিবীর শিল্পী ও রসিকদের চোখ ঘুরিয়ে দিয়েছেন ভারতবর্ষের দিকে, প্রাচ্যের দিকে। উনি পথ-প্রবর্তক, উনি শিল্প-দার্শনিক।

ছবি আঁকিয়ে ব্রুস অ্যালান নীচু গলায় বলে ওঠে—”জানো, অবনীন্দ্রনাথ যদি তাঁর ভারতীয়ত্ব নিয়ে হাজির না হতেন শিল্পের ইতিহাসে, তাহলে হয়তো আমার ছবি আঁকার ইচ্ছেই হত না।”

পা ছুঁয়ে যাচ্ছে জল। গঙ্গার ধারে লোকচক্ষুর অন্তরালে বড় নিরালায় বিশ্রাম করছেন ভারত-শিল্পের প্রাণপুরুষ। হয়তো এমনটাই চেয়েছিলেন কত্তামশাই অবনবাবু। বেশি জগঝম্প হই-রই সইতে পারতেন না যে মোটে। গুণমুগ্ধ দেশী বিদেশী শিল্পী এবং সমালোচকের দল দেখা করতে আসতো জোড়াসাঁকোর বাড়িতে আর কত্তামশাই পাচক ঠাকুরকে ডেকে বলতেন, তাঁদের লুচি ভেজে খাওয়াতে। তারপর ঝাড়া হাত-পা কেটে পড়তেন অন্যদিকে।

ও পারেতে কালো রং বৃষ্টি পড়ে ঝমঝম
এ পারেতে লঙ্কা গাছটি রাঙা টুকটুক করে

গুণবতী ভাই আমার—এসো আমার ঘরে


৪.
সামসিং… সামসিং!

আঁকাবাঁকা খানাখন্দময় একফালি কালো অ্যাসফল্ট শাড়ির আঁচলের মতো লুটিয়ে পড়ে আছে। ওই হলো পথ। আর তাকে ঘিরে দু-দিকে এই মর্ত্যপৃথিবী থেকে সবুজ রঙের অপরিসীম এক ঢাল বেয়ে আকাশ প্রমাণ উঁচু দিগন্তের দিকে চলে গেছে চা-গুল্মের আবাদ। নীচে ঠাহর করলে বোঝা যাবে একটা চা-গাছের গুঁড়ি থেকে আরেকটার দূরত্ব কমপক্ষে দু- ফুট। নিখুঁত ও পরিকল্পিত জ্যামিতি। চা-গাছের শিকড়ে জড়ানো থাকে সাপ। মাটি থেকে রক্তমাংসের শরীর অবধি লাফ দিতে উদ্যত পরজীবী জোঁক।

পথ চলতি দেখা মিলবে চা-পাতা বোঝাই ঝুড়ি পিঠে দলবদ্ধ নারী পুরুষের। ওরা বাগিচা শ্রমিক। পাহাড়বাসীদের মতো হলদেটে নয়; ওদের গায়ের রং কৃষ্ণ কালো। কয়েক শতাব্দী আগে ছোটনাগপুর বা সাঁওতাল পরগনার গ্রাম ছেড়ে ঠিকাদার-আড়কাঠির প্ররোচনায় এই কুয়াশা-প্রদেশে পা রেখেছিল কোল-মুণ্ডা-সাঁওতাল জনজাতির মানুষেরা। সাপের ছোবল খেয়ে, চিতাবাঘ আর ম্যালেরিয়ার থাবা এড়িয়ে যারা নেহাতই টিকে গেল শেষপর্যন্ত তারা গিয়ে পড়ল লালমুখো প্ল্যান্টার সাহেবদের হান্টারের সামনে। বাংলা কথাসাহিত্যের বিস্ময় সতীনাথ ভাদুড়ির লেখা ‘আণ্টাবাংলা’ নামক কৃশ ছোটগল্পটি যাদের পড়া আছে, তারা সেই অপরিসীম অসহায়তা ও নির্মমতার ইতিহাস জানেন।

‘এই রোডে গাড়ি চালানোয় হেভি রিস্ক আছে।’—আচমকা ব্রেক কষলেন সৃজন তামাং। স্টার্ট বন্ধ। কয়েক মিনিট গাড়ির ভিতরে নিথর বসে থাকবার পর গাড়ি আবার চলতে শুরু করল ঠিকই, কিন্তু আশু সাবধান! যে-কোনো মুহূর্তে মহাকাল এসে পথ রোধ করে দাঁড়াতে পারেন। শ্যাওলালাগা কাষ্ঠল কাণ্ডের আড়াল থেকে। লতাঝিল্লির ফাঁক দিয়ে। ক্ষরস্রোতার অনতিঅতল ফুঁড়ে…পাহাড়ের বাঁকে! স্লেট পাথরের রং তার গাত্রবর্ণে। তিনি বক্রতুণ্ড মহাকায়। শাল্মল-সৰ্জ-অগ্নিবল্লভ-শিংশপা প্রভৃতি প্রাজ্ঞ ও বিশ্বস্ত প্রহরীকুলের ঘনঘন অভিবাদনের মধ্যে তিনি আবির্ভূত হবেন। তিনি যূথচারী! কেননা, উপনিষদ বলছে, তিনি একা থাকতে ভয় পেয়েছিলেন… তাই আজও আমরা একা থাকতে ভয় পাই!

খণ্ড পাথরের গায়ে লালমাটি, সিঁদুর লেপা। চকচকে পাথর। কণ্টকারক ও গুঞ্জা ফুলের অর্ঘ্যে সাজানো মনস্কামনা! সুতোয় বাঁধা চৌকাঠিতে অধিষ্ঠান করছেন—পথের দেবতা। কিন্তু পুরোহিত কই? রম্ভা ও অন্নভোগ সবুজ পাতার পাত্রে নামিয়ে রেখে চলে যান ভক্ত। পথ চলতি এসে দাঁড়ায় বনপথে হারিয়ে যাওয়া ক্ষুধার্ত কিশোর, কাঠকুড়ুনির মেয়ে, উৎসবের গন্ধ পাওয়া বুড়ো মজ-মাতাল, ভাগ্য বিড়ম্বিত প্রেমিক, ছোপ রং প্রজাপতি! শুরু হয় ভাণ্ডারা!


৫.
ও পালনহারে…
তুমরা বিন হামরা কোনো নাহি…

শেষ পর্যন্ত ঘুম ভাঙল প্রার্থনা সংগীতে। গত কাল মাঝরাতে পুরোনো ব্রিটিশ পল্টন শহর জব্বলপুরের যে জনমানবহীন বাসগুমটি থেকে আধোজাগ্রত স্বপ্নের মধ্যে এই দুধসাদা ডিলাক্সে চড়ে বসেছিলাম—তা ছিল অবাস্তব!

দিনমানে সেখানে হাজার হাজার মানুষের লেন-দেন, আসা যাওয়া আর ধ্যাস্টামিতে চাপা পড়ে যায় অনতিদূরে বয়ে যাওয়া বাঁধ বিড়ম্বিত অভিমানিনী নর্মদার পাথরের বিছানায় আছড়ে পড়ার আর্তনাদ। তারপর মধ্যরাতে ওলটানো চেয়ার টেবিলের ফাঁক দিয়ে হুহু শীতের কামড়ে, ধাতব হ্যালোজেনের উলম্ব আলোয়, পাথুরে সুরাখ দিয়ে বয়ে যাওয়া খলখল জল গড়িয়ে যাওয়ার আওয়াজে ও শূন্যতায় সেই বাস ডিপো অপার্থিব ও বিশ্বাসের অযোগ্য বলে মনে হয়। এরকমই অতিজাগতিক এক শূন্যতার ছোঁয়াচ হয়তো পেয়েছিলেন ঘিয়াসউদ্দিন উমর খইয়াম নৈশাপুরি।

সমরখন্দ কী বুখাওয়ারার কোনো সরাইখানায়—একাদশ শতাব্দীর অলৌকিক এক হাওয়া বাতাসের রাত যখন প্রায় শেষ হতে চলেছে—আয়নার পেছনে বসে থাকা এক অত্যাশ্চর্য রূপসী গণিকাকে বাঁধানো দাঁতের পাটি নিস্পৃহ খুলে রাখতে দেখেছিলেন। সম্ভবত আমূল চমকে উঠেছিলেন উমর। বাইরে ‘বাতাস তখন নষ্ট জমির গা চাটে শয়তানের মতো।’

যাক‌্! যখন ঘুম ভাঙল তখনই প্রভাত! শীত-সকালে আমাদের শয়নযান এসে ভিড়েছে মাঝ পথের বিশ্রাম চটিতে। বাসের গায়ে লেখা ‘জঙ্গলদূত’ আর চটি মানে জেলা সদর মান্ডলা। প্রত্ননাম—মাহিষ্মতী।

এ অঞ্চলের ভূমিপুত্ৰ গোন্ড জনগোষ্ঠী। সাতপুরা আর ময়কাল পর্বতমালার অন্ধিসন্ধি দিয়ে বয়ে চলা নদীগুলো হলো তাদের মা। শাল-সেগুন-খয়ের-বয়রা-বাঁশ-অমলতাসের দুর্ভেদ্য জঙ্গল তাদের খেলাঘর। ক্ষিপ্র গতির তেন্দুয়া, অপরূপ বারাসিঙা, জল-জঙ্গলের শান রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার কিংবা সুদর্শন ভারতীয় বাইসন (যার ডাকনাম গোড়) এরা সবাই ছিল ওদের খেলার সঙ্গী, ভাই-বন্ধু।

তারপর ষষ্ঠ শতক নাগাদ পশ্চিমের রাজপুতানা থেকে তেজি ঘোড়ার পিঠে এল এক দুঃসাহসী অভিযাত্রী। গোন্ডরাজের দরবারে চাকরি জুটল রাজপুতের। আর কী উচ্চাকাঙ্ক্ষা! সুন্দরী রাজকন্যার নীলাকাশের মতো মন কিনা হরণ করে বসল সেই বিদেশী!

গড়হা-মান্ডলা, গড়ে উঠল রাজপুত-গোন্ড রাজবংশ। তৈরি হলো কেল্লা। পরে ষোড়শ শতাব্দীতে যে গড়হা-মান্ডলা রক্ষা করতে আকবর বাদশার মোগল সেনাবহরের বিরুদ্ধে প্রবল পরাক্রমে যুদ্ধ করবেন গোন্ড রানি দুর্গাবতী।

কেল্লার অপরপারে নর্মদা আর বানজার নদীর সঙ্গমে লোক জড়ো হয়েছে। আরাধ্যা হলেন মকর-বাহিনী নর্মদা। পুজো মানে ইট দিয়ে মাটির উনুন তৈরি করে মোটা বাজরা আর আটা মেশানো রুটি সেঁকে, সবজি চোখা সহ নর্মদা-জী কে উৎসর্গ করা। তারপর সপরিবারে চড়ুইভাতি। একটু বেশি পুণ্যার্জনের ইচ্ছে থাকলে স্নান করানো ও ফুল চড়ানোর জন্য গো-মাতা পাওয়া যাচ্ছে ভাড়ায়। ভাগের মা’র গঙ্গা না-হোক নর্মদা-প্রাপ্তি ঘটুক…আমরা ততক্ষণে ভাড়ার নৌকায় নদীবক্ষে কেল্লার দিকটা একবার টহল দিয়ে আসি। ক্ষীণ শরীর উড়নচণ্ডে বানজার নদী এখানে বাঁক ঘুরতেই প্রসিদ্ধ আর ভারিক্কি নর্মদার মুখে পড়ে একটু থমকে দাঁড়িয়েছে। নর্মদার জল সাতপুরা থেকে নেমে আসা প্রাচীন ও প্রসিদ্ধ শ্যাওলায় সবুজ। তুলনায় বানজার লঘু স্বভাব ও অজ্ঞাতকুলশীল। ‘কিলার ঘাটে’ আগুন জ্বালাবার আগে উনুন পুজো হচ্ছে। অগ্নি-উপাসক নয়, ওরা উনুনের পূজারি! এটা হয়তো একটা প্রত্নচিহ্ন! ভারতীয় গো-বলয়ে অবলুপ্ত প্রাচীন মাতৃতান্ত্রিক সভ্যতার টিকে যাওয়া একটা প্রতীক।

অনেক কাল আগের কথা:

তখন আমাদের বানজার একেবারে কচি মেয়ে। পথ চলতি খয়েরি ছোপ হরিণের ছানাগুলোর মতো যখন তখন নেচে উঠত, বৃষ্টি এলেই লাল হয়ে যেত লজ্জায়। তখনও শ্যাওলা আর পাতা ঝিল্লির আড়ালে গতর ঢেকে আব্রু রাখতে শেখেনি বানজার। সে সময় গ্রামের অন্য এক কুটিরে থাকত দো বহেন। বড়ি বহেন সারাদিন গাঁয়েই থাকত, ছোটি বহেন জলে-জঙ্গলে ঘুরে ফলমূল নিয়ে আসতো। বড়ি বহেন সবকিছু খেতো সেদ্ধ করে। আর ছোটি বহেন কাঁচা। সিদ্ধ করার কায়দা সে জানতো না। একদিন ছোটি বহেন লুকিয়ে দেখল, বড়ি বহেন দুই-পা ফাঁক করে তলপেট থেকে আগুন জ্বেলে রান্না করছে। ছোটি বহেন কাছে এসে বড়ি বহেনের মানা সত্ত্বেও সেই আগুন নিয়ে বনের গাছ জ্বালিয়ে দিল। সেই থেকে মানুষ পেল আগুন। মেয়েদের শরীর হলো উনুন—তার মধ্যে আগুন থাকে; আর আগুন থাকে জঙ্গলের গাছে।

৬.
‘এলিফ্যান্ট সাফারি অভি বন্ধ হ্যায়!’

আরও বহুবছর আগে: গোন্ডদের আদি দেবতা যেমন ফারসা পেন তেমন জঙ্গলের পশু পাখি পোকামাকড় আর গাছেদের দেবতা হলো হাতি। অন্যান্যদের থেকে আলাদা করার জন্য ফারসা পেন হাতিদের দুটো করে ডানা দিয়েছিলেন। তাই দিয়ে হাতিরা ওই উঁচু উঁচু শালগাছের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে বেড়াত। একবার এক হাতি আকাশে উড়তে উড়তে প্রচণ্ড থকে যায়। নীচের দিকে তাকিয়ে তখন সে দেখল, একটা প্রকাণ্ড আর ঝাঁকালো বটগাছ। হাতি দেবতা ভাবল, ওই গাছের মাথায় শরীরটা এলিয়ে দিয়ে বরং একটু বিশ্রাম নেওয়া যাক। কিন্তু যেহেতু হাতি ছিল জঙ্গলের দেবতা, তাই গাছের শাখা-প্রশাখাগুলো আর ডালপাতারা সবাই মাটি অবধি মাথা ঝুঁকিয়ে তাকে সম্মান জানাতে গেল। ব্যস্! হাতি গাছের মাথা থেকে নীচে পড়ে গেল। গাছতলায় তখন একজন খুব শক্তিমান মানুষ, তার নাম দীর্ঘতাপস, কঠোর তপস্যা করছিল। হাতি ডালপালা সমেত তাঁর ঘাড়ে গিয়ে পড়ল। দীর্ঘতাপস খুব রাগী। ধ্যান ভেঙে যাওয়ায় সে আগুন-রেগে গেল আর হাতি দেবতাকে অভিশাপ দিয়ে বলল, আজ থেকে তোমাকে মাটিতে পা দিয়ে হাঁটতে হবে।

রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার
ভারতীয় বাইসন বা গোড়
তেন্দুয়া বা ভারতীয় লেপার্ড
দুর্লভ বারাসিঙা প্রজাতির হরিণ
হায়না ও ভারতীয় নেকড়ে
বুটিছোপ ও চারশৃঙ্গ হরিণ
ভল্লুক বা আলসে ভল্লুক
ভারতীয় জংলি কুকুর
সজারু, ব়্যাটেল স্নেক
ভারতীয় সম্বর
বাঁদর ও লঙ্গুর
জংলি বিড়াল
নীল গাই
শৃগাল

—এই হলো ভারতবর্ষের সবচাইতে বড় অভয়ারণ্যের বন্যজন্তুর বৈচিত্র্য। সূর্যোদয়ের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে কানহা জাতীয় উদ্যানের সরকারি প্রবেশ পথের সামনে অসংখ্য দেশী-বিদেশী ট্যুরিস্টের কম্বল-জড়ানো জবুথবু ভিড়ে আমি নিজেকে আবিষ্কার করি। আমার দিকে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসে চৈন সিং, ফরেস্ট গাইড। তার পোশাকের রং অবশ্য সবুজ।

‘শুধু বাঘ নয়, জঙ্গল দেখার চোখ থাকা চাই। তবে কথা হচ্ছে, কানহায় এসে বাঘ না দেখতে পেলে সবার মন খারাপ হয়ে যায়।’

প্রথম দর্শনেই নাগপুরী চৈন সিং আমার দিকে ছুঁড়ে দেয় অব্যর্থ ও পরস্পর বিরোধী এই ‘দ্বান্দ্বিক রিয়েলিটি’। তাকে আমার জ্ঞানী বলে মনে হয়।

‘আর হাতি?’—আমি প্রশ্ন করে বসি।

‘গোন্ডয়ানা-মে হাথি নহি মিলতা দাদা, ইধর টাইগার রিজর্ভ হ্যায়!’

বক্রতুণ্ড মহাকায় মাতঙ্গকুলের সম্পর্কে কেমন যেন অবজ্ঞা ঝরে পড়ে সরকারি গাইডের চোখে মুখে। আমার রোখ চেপে যায়। মনে মনে আমি এক দিগন্তগামী সওয়াল-জবাব বুনে তুলতে থাকি…

হস্তীপুরাণ: সওয়াল জবাব

বিবেচনা করে দেখুন ধর্মাবতার; সেই কোন আদিমকাল থেকে অরণ্যচারী মানুষের বিশ্বস্ত পথ-প্রদর্শক ওই মহাকায় স্তন্যপায়ী জীব। শ শ মাইল ব্যাপী চারণভূমিতে ওরা একই পথে ফিরে ফিরে আসে প্রজন্মের পর প্রজন্মবাহিত যূথবদ্ধ স্মৃতি ও ভূগোলের অধিকারে। এ প্রসঙ্গে প্রথমেই সাক্ষী মানবো ব্রিটিশ আমলের নামজাদা বাঙালি সার্ভেয়ার অসমসাহসী শ্ৰীযুক্ত প্রমদারঞ্জন রায় মহাশয়কে। তিনি পরিষ্কার লিখছেন, জঙ্গলে পথ চলায় যাঁরা অভিজ্ঞ তাঁরা জানেন, বনভূমিতে হাতির পায়েই সবচেয়ে প্রশস্ত ও নিরাপদ রাস্তা তৈরি হয়—

সরকারি জরিপের কাজে অনেক লোককে দলে দলে নানা জায়গায় যেতে হয়। সঙ্গে মালপত্র ও জরিপের কাজের যন্ত্রপাতি। বনের মধ্যে থাকতে হয় তাঁবুতে। এক এক সময় এমনও হয় যে চারদিকে কুড়ি পঁচিশ মাইলের মধ্যে কোনো লোকালয় নেই। বন এমনই ঘন আর অন্ধকার হয়ে আসে যে তার ভিতরে অনেক সময় সত্যি সত্যিই সূর্যের আলো প্রবেশ করে না। চলবার পথ জঙ্গল কেটে তৈরি করে নিতে হয়, তবে অগ্রসর হওয়া যায়। যদি জানোয়ারের রাস্তা, বিশেষত হাতির রাস্তা পাওয়া গেল তো বিশেষ সুবিধার কথা বলতে হবে।

‘কে এই প্রমদারঞ্জন?’

প্রমদারঞ্জনকে এক ডাকে চিনতে না পারলেও, তাঁর বিখ্যাত কন্যা লীলা মজুমদার ও জিনিয়াস ভ্রাতুষ্পুত্র সুকুমারকে বাঙালি মনে রেখেছে। শিবপুরের বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে পাস দিয়ে প্রমদারঞ্জন সার্ভেয়ারের কাজ নিয়ে দীর্ঘ বাইশ বছর অতি দুর্গম চীনা হিল‌্স, লুসাই বা জন্তিয়া পাহাড়ে, বর্মা মুলুকের শান রাজ্যে কিংবা কেংটুং জঙ্গলে, বন্নু আর টর্চি উপত্যকার দুর্ভেদ্য অরণ্যে সরকারি জরিপের কাজ করে ফিরেছেন। জঙ্গল ও বন্য জন্তু সম্পর্কে তাঁর রুদ্ধশ্বাস অভিজ্ঞতা তিনি লিখেছেন ‘বনের খবর’ নামের এক অমূল্য বইতে।

দ্বিতীয় সাক্ষী

প্রমদারঞ্জনের নির্ভার বাংলা নয়; এবার সাক্ষ্যগ্রহণ চলবে চুগতাই তুর্কি জবানে। ওই তো, ঝড়ের বেগে ইট রঙের ঘোড়া ছুটিয়ে আসছেন, আমাদের পরবর্তী সাক্ষী বাবুর। শিরস্তানে যাযাবর পাখির পালক। সকাল সকাল তুল পরিমাণ মাজুন (আফিমজাত নেশার জিনিস) গলাধঃকরণ করে ইতিমধ্যেই রক্তচক্ষু। সঙ্গী পক্ককেশ শ্মশ্রুগুম্ফধারী কুতলুক খাজা গোকুলতাস।

হিন্দুস্তানের বিচিত্র জীব জানোয়ারের মধ্যে একটি হচ্ছে হাতি। আগ্রার কাছে কালপি জেলায় (জালাউন অঞ্চলে, উত্তরপ্রদেশ) অনেক হাতি পাওয়া যায়। এখান (আগ্রা) থেকে দক্ষিণ ও পূর্বদিকে যতই যাওয়া যায় ততই বেশি সংখ্যায় জংলা হাতি মেলে। কাবরা (বর্তমান ইলাহাবাদ জেলা) ও মানিকপুরে (দিল্লির কাছে) এমন অনেক গ্রাম আছে যার বাসিন্দাদের প্রধান পেশা-ই হচ্ছে হাতি ধরা। ৯৩৫ হিজরিতে আমি যখন চুনার দুর্গ দখল নিতে গেলাম, তখন সেখানে গিয়ে জানতে পারলাম চুনারের চারিদিকে জঙ্গলে অনেক হাতি আছে। আমরা হাতি শিকার করব ঠিক করলাম।

—’বাবুরনামা’

তাহলে কী দাঁড়াল?

ক.
অভিযাত্রী বাবুর শাহ আগ্রা থেকে যমুনা ও গঙ্গা নদীর তীর বরাবর পূর্বদিকে ঘোড়া ছুটিয়ে চুনার অবধি পৌঁছে গিয়েছিলেন। আরেকবার দ্বিতীয় একটি পথে আগ্রা থেকে চম্বল নদী পার হয়ে গ্বালিয়র ছিল তাঁর গন্তব্য। তবে সাতপুরা পার হয়ে দক্ষিণে গোন্ডয়ানার দুর্ভেদ্য অরণ্যপ্রদেশে অনুপ্রবেশ করার কোনো উৎসাহ তিনি দেখিয়েছিলেন এমন প্রমাণ নেই।

খ.
চুনার দূর্গ থেকে গোন্ডয়ানা অরণ্যের দূরত্ব অনধিক চারশো কিলোমিটার। ভ্রাম্যমাণ হস্তীযূথের পায়ে তা নগণ্য। পানীয় জলের খোঁজে আফ্রিকান সাবানায় হাতির পালকে সপ্তাহে সাড়ে তিনশো কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে দেখা গেছে। এবং যে ভারতীয় হস্তীকুলের প্রিয় বসতি উত্তর-পূর্ব হিমালয় ও বর্মা পাহাড়। সেই মাতঙ্গগুষ্টি অনতিউচ্চ সাতপুরা পার হবার ভয়ে থমকে দাঁড়াবে—এ কথা আজগুবি শোনাচ্ছে।

একটি পারিপার্শ্বিক প্রমাণ:

ঠিক সরাসরি হাতি সংক্রান্ত কোনো আলোকপাত না করলেও, বাদশা আকবরের জমানায় আবুল ফজল তাঁর বিবরণীতে স্বীকার করেছেন যে, তাঁর সহচররা মধ্য-ভারতের উচ্চভূমি বা সাতপুরার অরণ্যে সিংহের দেখা পেয়েছিল। তার মানে আজ থেকে পাঁচশো বছর আগেও গোন্ডয়ানার জঙ্গলে বাঘ সিংহ দুয়েরই দেখা মিলত। কিন্তু আজ আর সেখানে পশুরাজের টিকিমাত্র নেই, তারা সরে গিয়েছেন আরও পশ্চিমে, আরব সাগরের দিকে! তবে কি হাতিও একসময় ছিল সাতপুরার ঢালে? তারপর কোনো কারণে…!

এভিডেন্স নম্বর: তিন:

সাতপুরার উত্তর দিকের ঢাল বেয়ে আমরা এবার নেমে পড়ব মধ্যম পাণ্ডব বৃকোদরের ডেরায়। ভীমের বৈঠক(খানা) মানে ভীমবেটকা। গুহা-পাথরে আঁকা প্রাগৈতিহাসিক জ্যামিতি ও জীবন। তিরিশ হাজার বছর আগেকার মৃগয়া উৎসব। জ্যা-মুক্ত তির, ভোঁতা বা ধারালো পাথরের অস্ত্র। অশ্বারূঢ় বা ভূমিতে দাঁড়ানো শিকারি। বধ্য বাঁকানো শিং-হরিণ, নীল গাই এবং হাতি! পলায়নরত আরণ্যক ভারতীয় হাতি!

সুতরাং মহামান্য ও সুবিবেচকেরা এ কথা এখন নিশ্চিত, সাতপুরায় হাতি ছিল। তবে সে হলো দক্ষিণ-এশীয় প্রস্তর যুগ, মানে আজ থেকে তিরিশ হাজার বছর আগেকার কথা।

এভিডেন্স নম্বর: চার:

ধাতব পারম্যাঙ্গানেটের গেরুয়া ও কমলা হেমাটাইট থেকে এসেছে লাল। পাথুরে সবুজ। অঙ্গার কালো। ভীমবেটকার গুহার ভিতরে বহুবর্ণ সচিত্র রসায়ন। জীবন্ত অথচ নিথর। আমরা বাইরে বেরিয়ে পড়ি। অনেক সহস্রাব্দের পথ পেরিয়ে এসে দাঁড়াই রাজধানী পাটলিপুত্রের বাজারে। ভিড়ে মিশে থাকি। দেখি, চূড়া ও তণ্ডুলের রমরমা ব্যাপার। পট্টবস্ত্রের বিপণী। মাধ্বী বিকোচ্ছে; সস্তা ও তরল। অতর্কিতে ঘণ্টা বেজে ওঠে দূরে। উপস্থিত নাগর নাগরীর ভিড়ে তৎপরতা শুরু হয়ে যায়। পথ ছেড়ে দাঁড়ায় সৌরিক ও পানশৌণ্ড। অশ্বরথ ছুটে আসে। তাতে আসীন…না, কোনো ক্ষত্রিয় রাজপুরুষ নন, এক ব্রাহ্মণ। মুক্তশিখা। মুখমণ্ডলে নির্মম ও প্রখর জ্ঞানের দীপ্তি। মেধাই তাঁর শৌর্য। রাজচক্রবর্তী নন, উনি কূটনীতির ব্যবসায়ী, উনি রাজশক্তি নির্মাণ করেন, উনিই কৌটিল্য। এই চাণক্য বা বিষ্ণুশর্মার নামে প্রচারিত চতুর্থ থেকে দ্বিতীয় খ্রিস্টপূর্বাব্দে সংকলিত প্রাচীন জ্ঞানকোষ ‘অর্থশাস্ত্র’য় এমনকি সমসাময়িক ভারতবর্ষের বনভূমি ও বন্যপ্রাণ সম্পর্কেও তথ্য সূত্রায়িত করা হয়েছে—

কলিঙ্গম‌্ চেদি-করুশম‌্ দর্শানাম‌্ চ বনম‌্‌‌বরম‌্ ।
অঙ্গিরেয়ম‌্ তথা প্রাচ্যমে মধ্যমম‌্ বন‌্মিষ্যতে।।
অপারন্তম‌্ পঞ্চদম‌্ সৌরাষ্ট্রম‌্ চ অধমম‌্ বনম‌্।
ইবম‌্ বনয়াহুর গজানম‌্ জন্মানহ‌্ পদম‌্ ।

অর্থাৎ, সবচেয়ে উৎকৃষ্ট আরণ্যক গজের সন্ধান পাওয়া যায়: ১. কলিঙ্গ ২. চেদি-করুশা ৩. দর্শণা অঞ্চলের অরণ্যে! ৪. প্রাচ্য ও ৫. অঙ্গ এই দুই রাজ্যের অরণ্যে মাঝারি গুণমানের হাতি দেখা যায়! ৬. পঞ্চনদের ধারে ও ৭. সৌরাষ্ট্রের জঙ্গলের হাতি নিকৃষ্ট মানের!

ক্লাইম্যাক্স বা চূড়ান্ত প্রমাণ:

ধর্মাবতার, খেয়াল করুন ‘চেদি-করুশা’ নামের জনপদটির উল্লেখ! চেদিরাজ শিশুপালের নাম জেনেছি বটে মহাভারতে, কিন্তু ‘করুশা’? সে আবার কোথায়? খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ থেকে তৃতীয় শতকে ভারতবর্ষে যে ষোলটি মহাজনপদ গড়ে উঠেছিল তার মধ্যেও ‘করুশা’ কোথাও নেই। আমাদের অপেক্ষা করতে হলো আরও প্রায় দেড় হাজার বছর। তারপর এলেন রাজা সোমেশ্বর। পশ্চিমা চালুক্য বংশ। এখনকার বেঙ্গালুরুর কাছে তাঁর রাজধানী বল্লীগবী নগরীতে। চৌখস রাজা। সমর-প্রতিভা ও কারু-প্রতিভা দুটোতেই তিনি সমান অধিকারী। বিদেশীরা যখন রাজ্য আক্রমণ করে রাজধানী অবরোধ করে বসল, নগরের নিরাপত্তার ব্যবস্থা পাকা করে তিনি মন দিলেন, নতুন এক ভারতকোষ রচনায়। ভাষা নতুন, সংস্কৃত। একশোটি অধ্যায়ে বিস্তারিত ভারত ইতিহাসের সেই অমূল্য গ্রন্থটির নাম রাখলেন ‘মানসোল্লাস’। সেই মানসোল্লাসে মিলবে ‘চেদি-করুশার’ হদিস—‘ত্রিপুরিয়ম‌্ কৌশলাদ্রৌ চেদি-করুশাকম‌্ বনম‌্’ (‘মানসোল্লাস’, ৩য় সোমেশ্বর, খ্রিস্টীয় ১১২৬-১১৩৮)।

উত্তরে ত্রিপুরি বা জব্বলপুরের কাছে তেওয়ার নগরী থেকে দক্ষিণে পার্বত্য কোশল প্রদেশ, যা এখনকার রায়পুর-বিলাসপুর অঞ্চল, ছত্তিশগড়—এই হলো ‘চেদি-করুশা’ অরণ্যভূমির সীমা। মধ্য-ভারতীয় উচ্চভূমির হাল-আমলের মানচিত্রটির দিকে একবার দৃষ্টিপাত করুন ধর্মাবতার। লক্ষ করুন ওই ‘চেদি-করুশা’র অরণ্য, যা উৎকৃষ্ট বন্য হাতির স্বাভাবিক এক বসতি, তা আসলে গোন্ডয়ানার জঙ্গল। অভেদ।

তাহলে ধর্মাবতার, গোন্ডয়ানা ছেড়ে মহাকায় দিগ‌্গজকুল গেলেন কোথায়? কেনই বা ভিটে জমি ছেড়ে উদ‌্‌‌বাস্তু হলেন? কবে?

এতদূর অবধি এসে কোম্পানি শাসনের অবসান ঘটেছে। বিকল সিগন্যাল। লাল কাঁকড়ের ওপর টায়ারের দাগ। ওপারে অন্ধকারে যে জলশরীরের আভাস পাওয়া যাচ্ছে তা সুবর্ণরেখা আর খড়কাই নদীর সঙ্গমস্থান। দোমোহানি। তখন অনেক নক্ষত্রে ভরে গেছে কৃষ্ণপক্ষের আকাশ। সামনে আশেপাশে ঝোপেঝাড়ে বিড়ালের চোখের মতো জ্বলে উঠল জোনাকি। আরও গভীর হলো অন্ধকার। ওই প্রকাণ্ড কালো জল, আকাশ আর দিগন্তের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমার ভয় করতে শুরু করে। তাকিয়ে দেখি, বিবিজানই আসলে বিশালাক্ষী। তাঁর গলায় নাগকেশরের মালা, মাথায় কুরুবক। একটা প্রশ্নচিহ্নের মতো আমি তার ওপর ভেঙে পড়ি। ‘নিজের ঘরে ফিরে যাও’— এই ছিল তাঁর আকুল উত্তর!

আজও ছোটনাগপুরের প্রত্যন্ত মৌজাগুলোয়, দলমায়—বনের ভিতর গরামঠাকুরের থানে, বারাসাতে কী বসিরহাটে পুরোনো ইট ভাটায়, শহর কলকাতায়—লকআউট কারখানার পরিত্যক্ত ক্যান্টিন-ঘরের আবডালে—নিউ ইয়র্ক থেকে বহুদূর এক পোড়া খামারবাড়ির গলতায় বিপথগামী মাতাল মাঝরাতে শুনতে পায় সেই ঐশী ইশারা—‘ঘরে ফিরে যাও!’

৮.
‘তোমার ঘরে বসত করে…’

‘বাস্তুহারা’ শব্দটা এ বঙ্গের শব্দভাণ্ডারে বিপুল জনসমর্থিত। নেতাজি কলোনি, আজাদগড়, হকার্স কর্নার, ব্যবসায়ী সমিতি, সুগন্ধী ধূপকাঠি, ভোটব্যাংক, সাহিত্যসভা, সেতু, স্কুল, বাজার সর্বত্র অবলীলায় উড়ে এসে জুড়ে বসেছে এই শব্দবন্ধ—আগে হোক বা পরে। ব্যূৎপত্তি থেকে সরে গিয়ে ‘বাস্তুহারা’ শব্দার্থ এখন দাঁড়িয়ে গেছে ইংরেজি ‘রিফিউজি’-তে। যার নিকটতম বাংলা প্রতিশব্দ অবশ্য হতে পারে ‘আশ্রয়প্রার্থী’ বা ‘অভিবাসন প্রত্যাশী’ বা ওইরকম কিছু!

নিজের দেশ থেকে সবলে উৎখাত হওয়া মানুষের ঢল যখন সীমান্ত পেরিয়ে অন্য কোনো দেশে আশ্রয় নেয় তখন বলাবাহুল্য তাদের শরীরে-আত্মায় লেগে থাকে বিয়োগ-ব্যথা আর অত্যাচারের কালসিটে; হেরে যাওয়ার গ্লানি। সর্বার্থেই তারা তখন সর্বহারা। আশ্রয়প্রার্থিত ভূখণ্ডে গিয়ে প্রায় সর্বক্ষেত্রেই তাদের কপালে জোটে সমপরিমাণ অবহেলা হেনস্থা ঘষটানি। এমনকি বুলেট। যখন ‘ধৈর্য ছাড়া হাতের কাছে ধরার মতো আর কিছুই থাকে না’…ভূত-ভবিষ্যত-বর্তমান কিছুই না…তখন কেউ কেউ আশ্রয় নেন কল্পনার!

প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া সিরিয়া থেকে প্রতিবেশী দেশ লেবাননে আশ্রয় নেওয়া তেমনই একদল মানুষের স্বপ্ন-কল্পনাকে কাহিনির আকারে লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল রাষ্ট্রপুঞ্জ পরিচালিত এক শিবির উদ্যোগে। আর কী আশ্চর্য—সেই রচনাগুলোতে খুঁজে পাওয়া গেল রূপকথার ক্লাসিক চরিত্রলক্ষণ, সৌন্দর্যবোধ! খোঁজ মিলল স্বপ্নের গভীরতা, মেধাবী নীতিবোধ, ক্ষমতা ও অর্থনীতি সম্পর্কে নির্মোহ ধারণা। নিছক গালগল্পের বদলে তাতে মিশে রইল বিবাহ ও নারী-পুরুষ সম্পর্কের খুঁটিনাটি, স্বাধীনতার অভিপ্রায়, অধ্যাত্ম ও নিসর্গ সম্পর্কে প্রজন্মের পর প্রজন্মসঞ্চিত গভীর সিরিয় অভিজ্ঞান—সে সব গল্পের কোনো কোনোটার আসল বয়স হয়তো ‘ইসলাম’-এর থেকেও বেশি। আখ্যানগুলিকে সিরিয়-আরবি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন জুলেইখা আবুরিশা।

‘নোনতা পানি!’

অনেক অনেক দিন আগেকার কথা, সিরিয়ার দক্ষিণে জর্ডন সীমান্ত ঘেঁষা সয়েদাউ তখন ছিল রমরম ব্যাবসা বাণিজ্য আর হই হই জীবনযাত্রার উচ্ছল এক শহর! শেহির আল সয়েদাউ থেকে উত্তর-পথে মাত্র পঁচিশ কিলোমিটার গেলে কোরেদান (গ্রাম) আতিল! রাস্তার দু-ধারে সুপ্রাচীন রোমান সভ্যতার প্রত্নচিহ্ন! এখানে সেখানে আগাছায় ঢাকা মাটির ঢিবির নীচ থেকে উঁকি মারছে মাটি পুড়িয়ে গোলাকার ইট দিয়ে তৈরি দেওয়ালের ধ্বস্ত অবশেষ! ভাঙা খিলান, মুণ্ডু কাটা ব্যাসল্ট মূর্তি, ছাদহীন কলোসিয়াম, গম্বুজ, স্তম্ভ, অ্যাম্ফি থিয়েটার! সেই রাস্তায় হেঁটে চলেছে আনবার আতিল ইবনা!

‘আতিল গ্রামের সন্তান আনবার’! মিয়াঁ আনবার হলো চাষার বেটা চাষা! আতিল থেকে সে চলেছে বহুদূরের কানবাত গ্রামে! সঙ্গে সুজনিতে বাঁধা শুকনো ফল, শুকনো নোনতা মাংস আর রুটি! কাঁধে পশুচামড়ার ভিস্তিভরা পানি! ভোরবেলা পথে বের হবার আগে আনবার মিয়াঁর বিবি ধরে বেঁধে গুছিয়ে সব দিয়ে দিয়েছে!

বিশাল মাটি-ঢাকা ভগ্নস্তূপগুলোকে পাশে রেখে ধুলো-ওড়া রাস্তায়, চড়া রোদে একা একা হাঁটতে হাঁটতে মিয়াঁ আনবারের বারবার মনে পড়ে যাচ্ছিল বিবিজানের দরদভরা মুখখানা! গত রাতে খানার টেবিলে বসে, তার চোখে পানি দেখেছিল মিয়াঁ! ব্যাপারটা এরকম ঘটেছিল যে, অনেকদিন পর বিবিজান নারকোলের কাত্থ আর গোলমরিচ দিয়ে ভেড়ার মাংস রেঁধেছিল, যে রান্নাটা তার হাতে বড্ড ভালো খোলে! ছোটবেলায় আনবারের দুই মেয়ে তো আম্মার হাতের ভেড়ার গোস্ত খাবার জন্য একেবারে পাগল হয়ে যেত! তা প্রায় সাত বছর হয়ে গেল আনবার মিয়াঁর বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে, বহুদূরের কানবাত গ্রামে। আর তার দু-বছরের মাথায় ছোট মেয়ের বিয়ে হয়ে গেল আল মাসলাখে। সে-ও অনেক দূর!

তারপর থেকে, গত পাঁচ বছরে মেয়েদের মুখ দেখা তো দূরস্থান, তাদের একটা খবর পর্যন্ত আসেনি কোরেদান আতিলে! গত রাতে বিবিজানের চোখের পানির ইতিহাস হলো এই! কিন্তু একজন সাচ্চা ইমানদার পুরুষ মানুষ কেমন করে সহ্য করতে পারে তার বিবির চোখের পানি! আনবার মিয়াঁ তো তখন নিজের মনে মনে বিড়বিড় করছিল, ‘কান্না একদম বারণ! পুরুষ মানুষের চোখের পানি হারাম! একদম কাঁদব না!’

আনবার যখন কানবাত গ্রামে তার বড় মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে পৌঁছল, ততক্ষণে অনেক নক্ষত্রে ঢেকে গেছে রাতের আকাশ, কাক জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর! এতদিন পরে হঠাৎ আব্বাকে দেখে, নেচে কুঁদে হেসে কেঁদে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে ঠিক কী করবে—বুঝে উঠতে পারছিল না বড় মেয়ে! বড় জামাইটিও ভারী ভদ্র সভ্য সজ্জন আর কঠোর পরিশ্রমী এক চাষা! আনবারকে দেখে সে-ও খুশি হয়েছে কম না! খানাপিনার তরিবত শুরু হয়ে গেল! চাঁদের আলোর নীচে বসে তারা পান করল খেজুরের তাড়ি! খাবার বলতে একটাই পদ—ঘি দিয়ে পাক করা আস্ত একটা দুম্বা! সারা রাত বাপ-মেয়ের কথা আর যেন ফুরোয় না! ভোরের দিকে জামাই বাবাজীবন যখন নাক ডাকতে শুরু করল, আনবার তার মেয়েকে কাছে ডেকে চাপা গলায় শুধাল—’সত্যি করে বল তো মা, কেমন আছিস তুই? আমার কাছে কিন্তু কিছু লুকোস না!’

’আব্বা! ভোরের আলোয় পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ চারদিকটা একবার ঠাওর করে দেখো! বলো তো, কী দেখতে পাচ্ছ?’—বলল মেয়ে!
—’কী আবার দেখব! খেত, জমি, চাষের মাঠ—চারদিকেই তো তাই!’
—“আব্বা! ওই জমিতে আমরা যব বার্লি তরমুজ বরবটি আরও কত কী যে ফলাই! ফসল ভালো হলে আমরা ভালো থাকি! আর ফসল ভালো হয় বৃষ্টি ভালো হলে! তুমি ওপরওলার কাছে প্রার্থনা করো, এ মরসুমে যেন ভালো বৃষ্টি হয়!”

খুব ভোরে বড় মেয়ের শ্বশুরবাড়ির দেশ, মানে কোরাদান কানাবাত থেকে ছোট মেয়ের বাড়ি আল মাসলাখের দিকে রওয়ানা দিল আনবার মিয়াঁ। হাঁটা পথে ১৪ ঘণ্টা! মনে মনে একটা কথাই শুধু জপ করে চলেছে—‘ইয়া আল্লাহ! এ মরসুমে যেন আকাশ থেকে ভালো বৃষ্টি পড়ে! হে আল্লা! বৃষ্টি যেন পড়ে!’

আল মাসলাখ আধা শহর। বাড়িগুলো ব্যাসল্ট পাথরে তৈরি। দরজায় দরজায় কারুকার্যময় অর্ধচন্দ্রাকৃতি খিলান। বাড়ির গায়ে আঙুরলতার আলপনা খোদাই করা। ছোট মেয়ের ঘর অবধি পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধে ঢলে পড়েছে। আব্বাকে দেখে, ছোট মেয়ের তো আনন্দে আতিশয্যে অবাক হয়ে দম আটকে যায় আর কী! ছোট জামাই কুমোরের ছেলে কুমোর! যেমন আমুদে তেমন মেহমান নওয়াজ! রাতের ভোজে, মস্ত বড়, গায়ে নকশা আঁকা গলা উঁচু মাটির কলসি বোঝাই আঙুরের মদ এনে হাজির করল! মেয়ের নিজের হাতে নাকি চোলাই করা। আর তার সঙ্গে বাতাবি লেবুর রস মাখানো ঝলসানো ভেড়ার মাংস!

খানাপিনা চলল প্রায় মাঝ রাত অবধি! ছোট মেয়ের শ্বশুর, যিনি ছিলেন নিজের সময়ের নামকরা একজন মৃৎশিল্পী, তিনি বেদুইন-দোতারা হাতে মর্মস্পর্শী একটা গান ধরলেন। কথাগুলো ভারী মনে ধরল মিয়াঁর—মিশব ধুলোয়, তার আগেতে সময়টুকুর সদ‌্‌‌ব্যবহার/ফুর্তি করে নিই না কেন? দিন কয়েকেই সব কাবার/পঞ্চভূতে মিলিয়ে যাব মৃত্যুপারের কোন সে দেশ/নাই কো সরাব বা সুর সেথায়, সেই অজানার নেই কো শেষ…!

গান আর আঙুরের মদ যখন ফুরোলো ততক্ষণে রাত খতম! বেরিয়ে পড়ার আগে ছোট মেয়েকেও সেই একই প্রশ্ন শুধালো আব্বা জান, বাপের মনের গভীর থেকে উঠে আসা প্রশ্ন—‘সত্যি করে বল তো মা, কেমন আছিস?’

মেয়ে বাবার হাতটা ধরে ফেলল—”আব্বাজান, আম্মিকে বোলো তোমাদের ছোট মেয়ে ভালো আছে। শুধু একটা কথা, এখানে দাঁড়িয়ে যে-দিকেই তাকাও না কেন, তুমি শুধু দেখতে পাবে কাঁচা মাটির ছাঁচ, হরেক কিসিমের পাত্র, কলসি, মূর্তি। আজ যদি আকাশে কড়া রোদ ওঠে তবে ওগুলো ভালো শুকোবে। ভালো দাম পাব, আর তাতে আমরাও ভালো থাকব। কিন্তু যদি বৃষ্টি পড়ে, তবে মাটি যাবে গলে, ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাবে সব। তুমি আল্লার কাছে দোয়া করো এ মরসুমে যেন না বৃষ্টি পড়ে।”

পরদিন যখন আনবার বাড়ি ফিরল, আর তার বিবিজান ছলছলে জিজ্ঞাসু চোখ নিয়ে ব্যস্তসমস্ত হয়ে তার কাছে ছুটে এল, আনবার শুধু এটুকুই বলতে পেরেছিল যে, ‘বৃষ্টি পড়ুক না-পড়ুক আমাদের চোখের পানি পড়বেই!’


৯.
রাজকাহানি!

এই মুখ, কথা বলতে বলতে ঠোঁট দিয়ে ঠোঁট টিপে ধরার এই যে ভঙ্গি, ওই চাহনি…হলফ করে বলতে পারি, এ আমার অনেক কালের চেনা। ঠিক এই কথাগুলো যখন মনে মনে ভাবছি, এসে পড়লেন রাজবাড়ির খাস আর্দালি। সাহেবি দস্তুরের সাদা চোগা চাপকান। হাতে চায়ের সরঞ্জাম। মহার্ঘ্য মিং পটারি; টি-পট ও টি-কুজি।

চায়ের পেয়ালা হাতে তুলে নিতে নিতে পায়ের ওপর ভাঁজ করা পা চড়িয়ে যুত করে যিনি বসলেন, উনি হিজ হাইনেস, মহারাজাধিরাজ বন্ধেশ শ্ৰী মহারাজা পুষ্পকুমার সিংজু দেও বাহাদুর। সাম্রাজ্য রেওয়া।

‘আমার বাড়িতে চা-পাতা আর কাঠের আসবাব আপনাদের রাজ্য থেকেই আসে; দার্জিলিং আর কলকাতা।’ পুষ্পকুমার সিং কথা বলে চলেছেন নীচু গলায়…আর আমার কেবলই মনে হচ্ছিল, চায়ের ট্রে তার কারুকার্য আর রাজামশাইয়ের পা-গুটিয়ে বসা সমেত এই পুরো সংলাপ ও ঘটনাপ্রবাহ অবিকল আগে কখনও ঘটেছে। কোথায় আর কবে সে-কথাটাই যা কিছুতে মনে পড়ছে না! আবার বলছি, রেওয়া রাজপ্রাসাদে সেদিন সকালের অপ্রত্যাশিত সেই রাজসন্দর্শনের ঘটনা তার প্রতিটি অনুপুঙ্খ সমেত আমার অভিজ্ঞতায় আগে থাকতেই মজুত বলে মনে হচ্ছিল। একটা খুব চেনা দৃশ্যের যেন পুনরাভিনয় হয়ে চলেছে আমার সামনে।

কিন্তু কী করে হবে তা? রেওয়া শহরে জীবনে এই প্রথমবার পা দিলাম আমি। তাছাড়া বাঘেলা রাজবংশের উত্তরপুরুষ অর্বুদপতি মহারাজা পুষ্পকুমারের সঙ্গে মুখোমুখি কথা বলার সুযোগ নেহাতই আচমকা ও অলৌকিক।

অধুনা মুম্বইনিবাসী রাজামশাই রেওয়া শহর থেকে পনেরো কিলোমিটার দূরে গোবিন্দগড়ে, রাজসম্পত্তির কী-একটা বিক্রিবন্দোবস্ত করতে নিতান্তই এক সপ্তাহের জন্য দেশে ফিরেছেন গতকাল রাতে। তবে কী জাতিস্মর! আমি? জয় বাবা সত্যজিৎ!!!

বলব-না বলব-না করেও শেষপর্যন্ত আমার এই আশ্চর্য অনভূতি বলে ফেললাম, হিজ হাইনেসকে। শুনে, মৃদু হাসলেন। বললেন, ‘আপনি টাইম ব়্যাপিংয়ের কথা শুনেছেন?’

এই ঘটমান বর্তমান প্রতিনিয়ত রূপ-বর্ণ-ধ্বনি আঘ্রাণের একেকটা সমুদ্রস্রোত আছড়ে পড়ছে আমাদের শরীরে। গ্রীষ্মবাতাসে ভেসে আসে যে পেয়ারার সুগন্ধ আর জ্বরতপ্ত কপালে যে শীতল করতল স্পর্শ আমাদের উদ‌্‌‌বোধিত করে যায়—সে সবই আসলে আমাদের মস্তিষ্কে তৈরি করে একেকটা মৌলিক সংবেদ। প্রবহমান বাস্তবের কোনো আস্ত ফোটোকপি অবশ্য জমা হয় না আমাদের মস্তিষ্কে, বরং মস্তিষ্কে জমা হতে থাকে রাশিরাশি ক্ষণ পল দণ্ডের হিসেব—পুঞ্জীভূত সে সব মৌলিক সংবেদ নতুন আরেক রকম বিন্যাসে জুড়ে জুড়ে আমাদেরই মনের ভিতর বানিয়ে তুলতে পারে আরেকটা কম্পোজিশন। সুতরাং ঘটতে থাকা বাস্তব আর সেই বাস্তব অভিজ্ঞতার সূত্রে তৈরি হয়ে ওঠা স্মৃতি বা কম্পোজিশনের মধ্যে ফারাকটা নীল সমুদ্র আর তার ওপরে ঝুঁকে থাকা নীল আকাশের মধ্যবর্তী দূরত্বের সমতুল।

দুটো আলাদা আলাদা ঘটনার স্মৃতি কখনও কখনও তাই কাকতালীয় ভাবে হতেই পারে অভেদ। রেওয়া রাজপ্রাসাদে আজকের এই বৈঠকও মনে হতেই পারে খুব চেনা…এই তো ক’দিন আগে…ঠিক যেন মনে পড়ছে না…! বাস্তব সময় আর স্মৃতি-সময়ের এই লুকোচুরিকেই আমরা বলতে পারি সময়-ভাঁজ! এবার আমার চোখের দিকে সরাসরি তাকান রাজামশাই, ইষৎ বিরক্ত যেন। ‘আপনারা গোবিন্দগড় ঘুরে আসুন, পরে আর দেখার সুযোগ নাও মিলতে পারে।’

টেকদী গোডয়াঁ গড়,
পড়গী বৈসকয়া বুরজাঁ,
গিটগী চিত্রাম ভীঁতাঁ
দুগওয়া সুনয়াঁ সতখড়া ভৈল।
অঠৈ হো কদেই ধরতী রে কোই
লুণ্ঠৈ ধনী রো রৈবাস
ভরৈ ইন রী সাখ
উন্দরা রৈ বিলাঁ মে লাখ্যোড়ী
হাথোয়াঁ রী জূনী লীদ

মহাকবি কানহাইয়ালাল সেঠিয়া লিখিত রাজস্থানি এই ছোট কবিতার সারমর্ম হলো: হাঁটু ভেঙে পড়ে আছে গড়/ নিঃশঙ্ক বুরুজগুলো ভেঙে চুরমার/ চিত্রিত দেওয়ালেরা কাত/ সাতমহলা বিশাল প্রাসাদ ধূলিসাৎ/ একদিন এই মাটিতেই/ বাস করেছিল কোনো ধনপতি বা মহারাজ/ সাক্ষী তার…/ ইঁদুরের গর্তে পাওয়া/ হাতির পুরোনো শুকনো নাদ।

গোবিন্দগড় হলো পৃথিবীতে প্রথম জীবিত অবস্থায় বন্দি ‘মোহন’ নামের সাদা বাঘটির বাসস্থান। রেওয়ার জঙ্গলে মোহন ধরা পড়ে সন ১৯৫০-এ। পুষ্পকুমারের পিতা রেওয়ার শেষ স্বাধীন অধিপতি মহারাজাধিরাজ মার্তণ্ড সিং গোবিন্দগড় কেল্লায় পোষ মানিয়েছিলেন ব্যাঘ্র মোহনকে। কেল্লার ধারে তলাব‌্। দোতলা জলটুঙি। নীচে মেয়েদের স্নানের ঘাট। যৎকিঞ্চিৎ নেশার মৌতাতে মগ্ন জলটুঙিতে আসীন রাজপুরুষেরা উপর থেকে উঁকি দিয়ে কী দেখতেন? সিক্তবসনা কেল্লা-সুন্দরীদের বিভাজিকা দৃশ্য? প্রেমের ঢেউ লেগে পিতলের কলসি বুঝি আপনি ভেসে যেত! কেল্লার দ্বিতীয় ফটকের সামনে রাজরথের, তিনটে হাতি চালিত, ভগ্নাবশেষ—এক অবিশ্বাস্য ইস্পাতের স্তূপ। পাশে ঘোড়ায় টানা মহারানির রথটি তুলনায় সজীব ও কারুকার্যময়। কাশ্মীরি কাঠের কাজ করা ঘেরাটোপ অবধি দেখতে পাওয়া গেল।

এক বহুজাতিক কোম্পানির কাছে সদ্য বেচে দেওয়া গোবিন্দগড় কেল্লা নিকট ভবিষ্যতে দেশী বিদেশী রইস ট্যুরিস্টদের জন্য হেরিটেজ রিসর্ট হবে। জোর কদমে কাজ চলছে। এবং এখন রেওয়ায় কোনো সাদা বাঘ নেই।

বর্তমান রাজা মার্তণ্ড সিংহের পূর্বপুরুষ লেফট্যানেন্ট কর্নেল মহারাজ ভেঙ্কটরামন রামানুজ প্রসাদ সিংহের সঙ্গে ইংল্যান্ডেশ্বরীর বেহদ খাতির ছিল! আর আকবর বাদশার সঙ্গে সখ্য ছিল যাঁর, তিনি মহারাজ রামচন্দ্র। তানসেন ও বীরবল—রেওয়ার এই দুই রত্নকে তিনি উপঢৌকন দিয়েছিলেন মুঘল দরবারের শোভা বাড়ানোর জন্য। বদলে, রেওয়ার সার্বভৌমত্ব। প্রায় আটশো বছর ধরে রেওয়ার মসনদে আসীন এই বাঘেলা রাজবংশের উৎপত্তি অবশ্য রাজপুতানায়।

গোবিন্দগড়ের প্রমোদকেল্লা নয়, রাজধানী রেওয়ার রাজপ্রাসাদের দরবার ঘর এখন মিউজিয়াম। অসংখ্য খড়-পোড়া সাদা ও হলুদ বাঘের মৃতদেহ—কালো আবলুশ কাঠে আক্ষরিক অর্থে সোনার হরফে লেখা বাঘেলা রাজবংশের আটশো বছর। এছাড়া, ইংরেজ মহারানির দেওয়া মানপত্র, সোনার তৈজস, রুপোর টেবিল, বেলজিয়ামের আয়না, রংবেরঙের রত্ন-মণিমুক্তো, স্ফটিক। এবং অস্ত্রশালা। সোনার বাটওয়ালা তরোয়ালটি অবশ্য বিখ্যাত অন্য কারণে। পরিচালক সন্তোশ শিবনের বলিউডি চলচ্চিত্র ‘অশোক’-এর শিল্প নির্দেশনায় নিখুঁত ভাব আনার জন্য তরোয়ালটি ব্যবহৃত হয় এবং এক অভিনেতা শুটিং চলাকালীন সেটির হাতল ভেঙে ফেলেন।

আমরা জাদুঘরের প্রবেশমূল্য পুরোপুরি উশুল না করেই অবশ্য বেরিয়ে পড়ি। প্রাসাদ সদরের বাইরে বাজার। সওয়ার হলাম সাত অশ্বশক্তিবিশিষ্ট ত্রিচক্রযানে। পশুশক্তির অমোঘ ভারতবর্ষীয় বিজ্ঞাপন শরীরে সেঁটে ছুটে চলেছে ‘টুকটুক’—ডাকনামটি আদুরে। অন্যথায় অটো রিকশা বললেই, গড়িয়াহাট কী উল্টোডাঙার বেঢপ কেজো ভিড়ের কথা মনে পড়তে বাধ্য। আমরা এগিয়ে চলি রেওয়া বাজার পেরিয়ে…ধুলো ওড়ানো পাথুরে রাজপথ পার হয়ে, সর্ষে খেতের মাঝখান দিয়ে উঁচুনীচু পাথরে ধাক্কা খেতে খেতে তেরচা ও কড়া সূর্যাতপের হুমকি উপেক্ষা করে শহর থেকে দূরে।

‘ডাগর চোখে অনেক জল ঝরে!’

আমাদের হাসিতামাশা ও কথাবার্তা আচমকা শেষ হয়ে আসে। মাথার ওপর আকাশে চক্কর কাটে চিল। হাজির হই এক দিগন্তবিস্তৃত মর্মান্তিক মৃত্যুদৃশ্যের সামনে। ওখানে খরস্রোতা বিহাদের বুক থেকে লাফ দিয়ে পড়ত জল। একশো তিরিশ মিটার নীচের পাথুরে খাত থেকে ছিটকে আসা ফেনচূর্ণ জলের রেণু ভিজিয়ে রাখত তিনদিক ঘেরা পাহাড়ের শরীর। আদিম এক জঙ্গলের আস্তরণে ঢেকে গিয়েছিল এ-গিরিখাত। এই সেই অরণ্যপ্রদেশ যেখানে ভারতীয় সাদা বাঘের খোঁজ মিলেছিল। তারপর নদীর ঘাড় ধরে আদায় করে নেওয়া হলো বিদ্যুৎ। মাত্র আড়াই দশকে মরে গেল সেই কোন সুপ্রাচীন কালের শ্যাওলালাগা চাঁচাই জলপ্রপাত। চাঁচাই খাতের ধারে বনবাংলোর ধ্বংসাবশেষ। জনমানব শূন্য চবুতরা। দেওয়ালে হলুদ ছাপ—ওই বোধহয় ছিল ক্যান্টিন। বাইরে আগাছায় ঢাকা শ্বেত পাথরের ফলকে উৎকীর্ণ উদ‌্‌‌বোধিকার নাম—মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, ভারতবর্ষ। তখন সংসদে সবেমাত্র পাস হয়েছে ব্যাংক ও ভারী শিল্প জাতীয়করণের বিল। পোড়ো টুরিস্ট কোয়ার্টারের সারসার ছাদহীন ঘরের ভিতর ঘুরতে ঘুরতে খুঁজে পাই দেওয়াল আয়না। এখনও অক্ষত! তার গায়ে খয়েরি টিপ ও আঠার দাগ। রক্তের ভিতর কামনার আদিম একটা ঢেউ এসে ধাক্কা মারে।


১০.
অমৃত মহোৎসব: সংখ্যার গুরু লঘু!

সবশেষে আসবে কালান্তক শীত। বনপথে যে ছোপ-রং প্রজাপতিরা এতক্ষণ তোমায় সঙ্গ দিয়েছে কোনো অজানা আশঙ্কায় তারা খসিয়ে ফেলবে তাদের ডানা। ঝরনার জল হয়ে যাবে ধাতুর মতন। মানুষ একা একা কাঁপতে শুরু করবে, সে কাঁপুনি আর কোনোদিনও থামবে না।

তাই বলছিলাম, এই ভূমা পৃথিবীর সব দৃশ্য, প্রতিটি পল-অনুক্ষণ ফ্রেমবন্দি করে রাখা যায় না। অতএব হে মোবাইলধারী বীর ও বীরাঙ্গনারা, পকেট থেকে গুরুভার ক্যামেরা তোমরা বরং এখানেই নামিয়ে রাখো। ক্যামেরা চলতে থাকুক, কয়েক সহস্রাব্দের অতীত থেকে আগামী সহস্রাব্দ পর্যন্ত। পোড়া কাঠ, গনগনে সীতা মাটি, ঝলসানো পশুমেদ—এক বিধ্বংসী দাবানলের শেষে স্রোতার জলে প্রথম জন্ম নিয়েছিল মাছ—যুবতী বর্ষার গর্ভে—শতাব্দী প্রাচীন এক কাছিমের ঔরসে। তখন রৌদ্রে-মেঘে সোডা ও গন্ধক তীব্র বেগে ফুটে উঠল। একে একে আকাশে দেখা দিল উঁট…সিংহ…মেষ…বৃশ্চিক। পথ কাটল গিরগিট। উড়ে এল দূর মরু প্রান্তরের হাওয়া…ফুলের পরাগ…লোধ্ররেণু। পাহাড়ের ঢালু তলপেট বেয়ে পিছু পিছু উঠে এল মানুষ। পশ্চিমের ঢালে যারা জড়ো হলো: তারা হো; লাল পালকে এরা মুণ্ডা; যারা পশুপালন জানত না তারা বৈগা; যারা নদীতে বাঁধ দিল তারা আদপে ‘গক‌্‌‌কর’; মন্দির বানাতো ‘চান্দেলা’ বংশীয়রা। মর্কট গোত্র ষাঁড়ের বীর্য পান করত! টাট্টুতে চড়ে যারা এসেছিল তারা বর্গী। গোত্রভেদে জল-অচল।

হরে মুরারে মধুকৈটভারে
গোপাল গোবিন্দঃ মুকুন্দ স্মরে
কৃষ্ণ বিষ্ণু যজ্ঞেশ নারায়ণ
নিরাশ্রয়াম‌্ মাম‌্ জগদীশোরক্ষঃ

‘ওগো জগদীশ্বর আমার মতন আশ্রয়হীনকে তুমি রক্ষা করো!’ ঘুম ভাঙল ঝড়ের দাপটে, চোখ ধাঁধানো প্রলয় বিদ্যুতে। বন্ধ কাচের গায়ে আছড়ে পড়ছে শুকনো পাতা, ছিন্ন লতা, আধফোঁটা ফুলকুঁড়ি, ভাঙা গাছের ডাল। গতকাল সন্ধেবেলা আগুন জ্বালানো হয়েছিল উঠোনে, উড়ে আসছে ছাই ও পোড়া কাঠকার্বন। ঘুম ভেঙেছে বটে, কিন্তু সংবিৎ ফিরে পেতে তখনও বাকি। হতভম্বের মতো উঠে বসি বিছানায়। নিরন্ধ্র অন্ধকারের ঘন কাত্থ থিতিয়ে পড়েছে চাদরে বালিশে। আধো অনচ্ছ দেওয়াল জোড়া কাচের গায়ে নাক ঠেকাই। বাইরে ধূসর পৃথিবী। মরা আকাশের আলো। ধুলো-ঘূর্ণি। তবে কি ভোর এখনও আসেনি? প্রলয় এসেছে!

শীতে কাতর সকাল ন’টা। কাঠচুল্লির ধার ঘেঁষে বসে আছি। সামনে আগুন এবং আগুনের মালিক আহ্লাদ বেহুরা, পাচক—ডারিংবাড়ি ইকো ট্যুরিজম কেন্দ্রর। বাইরে এখনও ফোঁটায় ফোঁটায় বৃষ্টি পড়ছে। যদিও বহুক্ষণ ঝড় থেমে গেছে। রান্নাঘরের জানলা দিয়ে যতদূর চোখ যায় জঙ্গলাকীর্ণ ঘন সবুজ স্তেপ। আর তার ওপর বিছানো মায়া-কুয়াশার চাদর। একেক জায়গায় বড়সড়ো গাছের গুঁড়িকে ঘিরে কুয়াশা জমাট বেঁধেছে, যেন মেঘ! বড় গাছ বলতে পাইন, শাল মহুল আর আম।

না, আমবাগান নয়, আমগাছের জঙ্গল! কুষি আম ঘাসে পড়ে আছে। নয়ানজুলিতে খসে পড়া গাছ-পাকা আম। অবহেলায় পচছে। এই প্রেক্ষাপট থেকে সামান্য দূরে হলুদের বন, কফি বাগিচা আর লতানো গোলমরিচের উপবন। তার থেকে আর একটু মাত্র বেশি দূরে লুটিয়ে পড়ে আছে গেঁয়ো ডলুরি নদী; তাতে স্রোত বেশি—গভীরতা মামুলি। পূর্বঘাট আর মালকানগিরির উপত্যকায় এই হলো—ডারিংবাড়ি। জেলা কান্ধমাল। ওড়িশার কাশ্মীর।

উনুনে, চায়ের কেটলিতে ফুট ধরেছে; বুদ‌্‌‌বুদ উঠছে; এই কনকনে শীতে এক পেয়ালা ধোঁয়া-ওঠা চা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পানীয়গুলির অন্যতম। কিন্তু বাইরের ওই দিগন্তব্যাপী সবুজের ওপর সাদা কুয়াশার আস্তরণ আরও রহস্যময়। সুতরাং আহ্লাদ বেহুরার প্রতিশ্রুত গরম মালাই চায়ের পিছুটান কাটিয়ে ফেলাই বুদ্ধিমানের কর্তব্য। রিপু আর রিপু-মুক্তির মধ্যবর্তী ধূসর দোলাচলের মুহূর্তে হইহই এসে হাজির হয় কেয়ারটেকার চক্র দেহুরি। তার মুখে মর্মান্তিক ব্রেকিং নিউজ: ‘বন পার্টি আর সবুজ পার্টির মধ্যে গুলির লড়াই শুরু হয়েছে ডারিংবাড়ি বাজারে!’

সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে ট্যুরিস্ট সেন্টারের লোহার মূল ফটক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। দরজার বাইরের রাস্তা ধরে মিনিট তিনেক হাঁটলেই ডারিংবাড়ি বাজার। ভিতরে কাঁটাতার আর প্রকাণ্ড পাইন গাছের সারি দিয়ে ঘেরা নয়-দশ বর্গকিলোমিটার জোড়া ডারিংবাড়ি ইকো ট্যুরিজম সেন্টার ও ট্যুরিস্ট ক্যাম্পের চৌহদ্দি।

চোখে পড়ে সাইনবোর্ড—’ইন্টিগ্রেটেড অরগ্যানিক ফার্মিং’-এর, দু-ফুট লম্বা ফলবতী পেঁপে গাছের পাশে, প্রকাণ্ড, জেনেটিক্যালি মডিফায়েড বাঁধাকপির হাস্যকর কেতাবি-ফসল বৈচিত্র্য! সরকারি বাঁধানো চাতাল ও পরিবেশ সচেতন একশো দিনের কাজের বরাভয়। ডাঁই করা এমু পাখির বিষ্ঠা ও গোবরের স্তূপের পাশে ঝুড়ি ও কোদাল হাতে কন্ধ নারী-পুরুষ। গাঢ় খয়েরি রঙের শরীর। মেয়েদের নাকে কানে ভারী রূপোর বালা—ওই ওদের পারিবারিক নিশান। সারা মুখে পিঠে আর শরীরের খোলা অংশে নীল উলকি। যাদের চুলে রংবেরঙের কেশসজ্জা তারাই কেবলমাত্র কুমারী। ওরা ডোঙারিয়া কন্ধ, কান্ধমালের ভূমিপুত্র ও কন্যা। অন্যান্য দিন কাজের তালে তালে ওরা নিজস্ব সুরে মন ভিজিয়ে নেয়। আজ মুখে কুলুপ। চোখে আশঙ্কার ছায়া পড়েছে। গোলাগুলির বিপদ সংকেত সম্ভবত ওরা আগেই জেনে গেছে।

‘পর্বতের দেবতা নিয়ামগিরি!’

পৃথিবীর আদি পিতা আর মাতা পর্বতের দেবতা নিয়াম পেনু আর মাটির দেবতা ধরণী পেনুর কাছ থেকে কুয়াশাময় এই অরণ্য পাহাড়ের, দুনিয়াদারির অধিকার পেয়েছিল কন্ধরা। হাজার হাজার বছর ধরে নিয়ামগিরি-কে পিতা আর ঈশ্বর বলেই জেনে এসেছে ভারতবর্ষের প্রাচীনতম এই জনগোষ্ঠী। মায়ের কোলে শুয়ে একজন কন্ধ শিশু যে ভাষায় প্রথম কথা বলতে শেখে তার নাম—‘ক্যুই’।

দ্রাবিড় ভাষা-গোষ্ঠীর অন্তর্গত কন্ধদের মাতৃভাষাটি আজকাল লেখা হয় ওড়িয়া লিপিতে। বেদ উপনিষদের ভাষার থেকে অনেক পুরোনো ক্যুই ভাষায় লেখা আছে কন্ধদের পুরাণ পুথি। তাতে আছে নিয়ামরাজার নির্দেশ ও মন্ত্র। ডোঙারিয়া (ডোঙার অর্থাৎ পাহাড়) প্রকৃতি রাজ্যের আইন, চাষবাসের পদ্ধতি, গাছগাছালি পশুপাখিদের জগৎ সম্পর্কে জ্ঞান। আবহাওয়া বিজ্ঞান। শিকড়বাকড় আর ওষধির হালহদিস। আছে এমনকি সৃষ্টি রহস্য আর সৌন্দর্য তত্ত্ব এবং শিল্প জিজ্ঞাসা।

আয়ুর্বেদের জন্মের অনেক আগে থেকেই নিয়ামগিরি পাহাড়ের ঢালে কন্ধরা চাষ করত এক আশ্চর্য শস্য। এক বিশেষ প্রজাতির ধান। সেই ধান ঢেঁকিতে ভেঙে পাওয়া যায় ওষধি চাল—যা একাধারে ওষুধ ও পথ্য। হালে অবশ্য নিয়ামগিরির ওষুধ-চালের বদলে কন্ধরা ইউনিসেফের স্বাস্থ্য প্রকল্পে বেশি নির্ভর করতে শিখেছে। কেননা, এই তো কয়েক দশক মাত্র আগে, ভারত সরকারের কাছ থেকে নিয়ামগিরির ওষুধ-চালের পেটেন্ট কিনে নিয়ে গেল সুদূর আমেরিকার এক বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানি।

আর কয়েক বছর আগে একদিন, বারিক (কন্ধ সমাজের সাংবাদিক) এসে জানান দিল দিল্লির রাজা কন্ধদের কাছে নিয়ামগিরি আর ধরণী পেনুকে চেয়ে পাঠিয়েছে। কারণ, বিস্তৃত কলিঙ্গঘাটের এই পর্বতময় অরণ্যভূমির গর্ভে আছে বক্সাইট, চুনাপাথর, সীসা, দস্তা, গ্রাফাইট, কোয়ার্টজ সমেত হাজারো খনিজের এক আলিবাবার গুপ্তভাণ্ডার। আছে নদী ভরা জল। আর আছেন কঠোর পরিশ্রমী কন্ধরা; যাঁরা আসলে এতই ভদ্র, যে, যুগের পর যুগ ধরে হিন্দু (বৈদিক) থেকে শক হুন পাঠান মোঘল আর বাইবেল হাতে ইংরেজ এবং হনুমান চালিশা হাতে হিন্দিভাষী নব্যহিন্দু যে যেভাবে চেয়েছে—অকাতরে বেগার খেটে দিয়েছেন। সুতরাং কারখানা তৈরির জন্য এমন উপযুক্ত পরিবেশ আর কোথায় বা মিলবে? এবং এ কথা তো দিনের আলোর মতো পরিষ্কার যে, এই বিপুল পরিমাণ খনিজ সম্পদ ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক বিকাশকে গতিশীল করে তুলতে, জিডিপি রাতারাতি বাড়িয়ে তুলতে একান্ত দরকার। সুতরাং কান্ধমাল, কালাহান্ডি, কোলাপুট, গ্যাঞ্জাম, মালকানগিরির জঙ্গলে কন্ধদের হাত-পা ছড়িয়ে থাকতে দেওয়াটা এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে একটা বিলাসিতা। কাজে কাজেই নিয়ামরাজার সন্তানসন্ততিদের উচ্ছেদ তো করতেই হবে নিয়ামগিরি থেকে।

ব্যাপারটা যতটা নির্মম শোনাচ্ছে ততটা নির্মম মোটেই নয়। কেননা প্রস্তাবিত খনি, কারখানা তৈরির জন্য মাটি কাটার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো তো ভূমিপুত্ররাই পাবে। কুলি লাইনে তাদের জন্য পাকা কংক্রিটের ছাদওয়ালা স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা-যুক্ত বসতি তৈরির ডিজাইনও তৈরি। এছাড়াও বুদ্ধিমান রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার বছরে অন্তত একশো দিন শ্রমের বিনিময়ে নিশ্চিত রোজগারের ঢালাও বরাদ্দ করেছেন, পিছিয়ে পড়া সংখ্যালঘু কন্ধ সম্প্রদায়ের জন্য।

এতকিছু সত্ত্বেও বেঁকে বসল সেই কন্ধরা; যাঁদের কিনা নিজস্ব একটা ভাষা আছে, আছে দর্শন, বিজ্ঞান, শিল্প আর হাজার হাজার বছরের ইতিহাস। প্রতিবেশী তেলেগু রাজ্য থেকে এল বন পার্টির মুরুব্বিরা। বলল, জঙ্গলে লুকিয়ে থেকে যুদ্ধ করতে হবে। বলল, আমরা তোমাদের শেখাব কী করে যুদ্ধ করতে হয়। অন্ধ্র-ওড়িশা বর্ডার কমিটি, ওড়িশা স্টেট কমিটি, মালকানগিরি কমিটি…কমিটিতে কমিটিতে ছেয়ে গেল নিয়ামগিরি। তখন বনপার্টির সঙ্গে যুদ্ধ করতে দিল্লির সরকার সবুজ পার্টিকে পাঠাল—তাদের গায়ে জংলা ছাপের ক্যামোফ্লেজ পোশাক। হাতে প্রকাণ্ড শক্তিশালী বারুদ-ঠাসা চকচকে বন্দুক।

এরপর একদিন সকালে, বন পার্টির লোকেরা এক ফাঁকে লুকিয়ে এসে ঘরে ঘরে ডাক দিয়ে হাট্টাকাট্টা মরদ আর সোমত্ত কুমারীদের নিয়ে আরও ঘন জঙ্গলের দিকে চলে গেল। বলে গেল, বন্দুক চালানো শেখাতে নিয়ে যাচ্ছে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হয়ে গেল, তবু ওরা আর বাড়ি ফিরল না।

সময় ফুরায় আর সকলই ফুরায় আর সামান্যই থাকে
দু চার বসন্ত আমি ঘোরালাম সামান্য লেখাকে

‘আজ হোক বা কাল নিয়ামগিরি থেকে কন্ধদের বাস হয়তো উঠে যাবে।’—চলনসই হিন্দিতে কথাটা বলেছিল কেয়ারটেকার চক্র বেহুরি। পঁচিশ বছর বয়সি চক্র বেহুরির বাড়ি কালাহান্ডি জেলায়। জাতে ‘রাজ-কন্ধ’। চক্র বেহুরি আরও বলল, ‘তখন হয়তো আমাদের ক্যুই ভাষায় কথা বলার আর দরকারই পড়বে না।’ কথা বলতে বলতে একসময় একদম চুপ করে যায় ও। আমি উঠে পড়ি। হাঁটা লাগাই ট্যুরিস্ট ক্যাম্পের দিকে।

‘মেঘে মেঘে অন্ধ অসীম আকাশ…’

এক নিরূপায় আলস্যে ট্যুরিস্ট লজের বিছানায় উপুর শুয়ে আছি। অন্যমনস্ক হাতে চালু হয়ে যায় বৈদ্যুতিন গানের বোতাম। বেজে ওঠে আজ সকালের প্রথম কোমল নিষাদ। গানটি নজরুল রচিত, মেঘে মেঘে অন্ধ অসীম আকাশ। কণ্ঠ ‘বাংলা খেয়ালের পায়োনিয়ার’ জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামীর। রাগ ‘জয়জয়ন্তী’। ভারতীয় মার্গসংগীতের প্রধান রাগগুলোর মধ্যে জয়জয়ন্তীর হদিশ নেই। রাগ বিলাবল আর রাগিণী ‘সোরাঠ’—যা ‘মেঘ’ রাগের অন্তবর্তিনী, এ দুয়ের মিলনে ‘জয়জয়ন্তী’-র জন্ম। এ রাগের স্রষ্টা নবম শিখ গুরু তেগ বাহাদুর! এমনটাই বর্ণনা আছে গুরু গ্রন্থসাহেবের ‘রাগমালায়’!

গুরু গ্রন্থসাহেবের নাম শুনে কপাল কুঁচকোবেন না। এই প্রাচীন ধর্মগ্রন্থের সর্বশেষ পরিশিষ্টটির নাম—‘রাগমালা’। তাতে বারোটি শ্লোক ও ষাটটি পঙ‌্‌‌ক্তিতে আদি গুরুমুখী ভাষা-লিপিতে সংকলিত হয়েছে রাগ রাগিণীর গড়ন-মেজাজ-চলন ও ব্যাকরণ। গ্রন্থসাহেবের প্রতিটি স্তোত্র বা পদ (গুরুবাণী) সুর যোগ করে ভজন আকারে ভক্তের হৃদয়ে পৌঁছে দেওয়াই রেওয়াজ। যে পদ বা স্তোত্রের আত্মা বা মর্মার্থ যেমন, তার বাহক রাগ বা রাগিণীটির মেজাজও তেমনই সুপ্রযুক্ত।

গ্রীষ্ম-রাতের প্রথম প্রহর ‘জয়জয়ন্তী’ গাইবার পক্ষে প্রশস্ত—বলছেন স্বয়ং স্রষ্টা, গুরু তেগ বাহাদুর। গ্রন্থসাহেবের দুটি মাত্র স্তোত্রে সুর দেবার জন্য এই নতুন রাগটি সৃষ্টি করার দরকার পড়েছিল তাঁর। সেই দুটি স্তোত্রের মর্মবাণীটি কি? সে হলো এক আত্মা—যার সব সংশয় এইমাত্র খসে পড়ল। শরীরী মোহের হাঁসফাঁস থেকে মুক্ত হয়ে এবার সে আনন্দের সঙ্গে মিলিত হতে যাবে। মোহের সঙ্গে যুদ্ধে সদ্য বিজয়ী সেই আত্মার জয়যাত্রার সুর— জয়জয়ন্তী। কোমল নিষাদ আর কোমল ও শুদ্ধ গান্ধারের পর্যায়ক্রমিক ব্যবহারে প্রাচীন এই রাগটির চলনে বিসৃষ্ট হয়েছে অবরোধহীন এক অসীম সম্ভাবনা। যেমন, মহীয়ান আকাশে মেঘের মহাভারত। যেমন, জয়গাথার গৌরব!

পূর্বঘাটের পাহাড় চূড়োয়, এক ধূসর মরা আকাশের আলোর নীচে দাঁড়িয়ে সম্ভাবনাহীন এক সকালে জয়জয়ন্তীর সেই গৌরব আমাকে ছুঁয়ে যাচ্ছিল, ঠিক যেমন জাতীয় সংগীত শুনলে আমাদের গলা আপন হতেই কখনও কখনও বুজে আসে—বাষ্পোচ্ছাসে! চোখ বুজে আমি মনে করছিলাম—চক্র দেহুরির গর্বিত চিবুক আর বিমর্ষ মুখভঙ্গিকে। উনি ভারতবর্ষের এক প্রাচীনতম জনগোষ্ঠীর তরুণ এক প্রতিনিধি—নিজস্ব একটা ধর্ম, একটা ভাষা ও একটা লিপির ইতিহাস নিয়েও সরকারি দলিলে উনি সংখ্যালঘু, উনি ‘পিছড়ে বর্গ’!


১১.
উত্তর দক্ষিণে ও পুবে পশ্চিমে—
নদী মাতৃকার দেশে পেতে রাখি হাত।
যেখানে আগুন মুছে নেয় আষাঢ় শ্রাবণ
যেখানে বর্ষার রঙে রেঙে ওঠে ফসলের মাঠ।

ওই মাঠ ওই নদীকুল আমার জীয়নকাঠি
আমার উত্তরাধিকার শুক সারি জীবন মরণ।

সুতরাং দেবতার সঙ্গে আপনার কখন কোথায় কী অবস্থায় দেখা হয়ে যাবে কেউ বলতে পারে না! আমরা যদি ধরে নিই কেবলমাত্র কালীঘাট কী তিরুপতি, স্বর্ণমন্দির কী জেরুজালেম; ১৫০০ বছরের কাবাগৃহ বা ১২০০ বছরের পুরোনো খাজুরাহ মন্দিরের বিস্মৃত গর্ভগৃহ ছাড়া দেবতা আসন গ্রহণ করেন না; তবে সে হবে মস্ত প্রমাদ! বস্তুত পথেই তাঁর অধিষ্ঠান, তিনি অতর্কিতে এসে আমাদের স্পর্শ করে আবার মিলিয়ে যান মাটিতে, ত্যেজে, মরুৎ, ব্যোমে, পাকদণ্ডির বাঁকে, অরণ্য গভীরে! এমনকি শিয়ালদহ ফ্লাইওভারের নীচে একঝলক দেখা দিয়ে তৎক্ষনাৎ তিনি ভ্যানিশ হয়ে যেতে পারেন!

এতদ্বারা যা বোঝা যাচ্ছে, আমাদের ডাইনে বাঁয়ে মঙ্গলে ঊষায় দেবতা ছিলেন, আছেন এবং আরও হাজার বছর থাকবেন! যদি না আমরা তার মৃত্যুর আশু প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে একটা চটজলদি সিদ্ধান্তে আসতে পারি! তবে যদি মরতেই হয়, কেন মরতে হবে দেবতাকে ?

মরতে হবে, কেননা—প্রথমত দেবতার জন্ম যতখানি কৌতূহলোদ্দীপক, তার অধিষ্ঠান ততটাই উত্তেজনাহীন, কার্বন কূপিত ও শ্বাসরোধকারী! এবং দ্বিতীয়ত আমরা সর্বান্তকরণে দেবতা হতে চেয়েছিলাম! প্রত্যেকটি অণু, প্রতিটি পরমাণু, আমাদের চৈতন্যের প্রতিটি ক্ষুদ্রতম একক একেকটি স্বয়ম্ভূ দেবতা হয়ে ওঠার পথে যাত্রা শুরু করেছিল! সে যাত্রাপথের প্রতিটি তোরণ ছিল রবাব-মন্দ্রিত! শঙ্খধ্বনিতে, কাড়া-নাকাড়ার তালে তালে প্রতিটি পদক্ষেপকে সমর্থন করেছিল করতালি! যাত্রা শুরুর ঠিক সেই মাহেন্দ্রক্ষণটি থেকে আমরা পাহাড়-প্রমাণ জাহান্নমের দিকে, ব্যর্থতার দিকে নিশ্চিত পা ফেলেছিলাম! আমরা দেবতা নই—তাই দেবতাও কোনোদিন ছিলেন না!




প্রচ্ছদচিত্র ও অন্য ছবি সৌজন্য: ফোটোগ্রাফার ভূমিকা ভট্টাচার্য (প্রচ্ছদচিত্র), www.needpix.com