অপেক্ষাকৃত নীচু লাইটপোস্টের তার-জট থেকে নানা বিচিত্র সর্পিলাকার তার এঁকেবেঁকে শেষপর্যন্ত অন্ধকারের বেশ কিছুটা প্রবীণ অভ্যন্তরে মিলিয়ে গিয়েছে, যার কিছুটা গন্তব্য ঠাহর হয়, কারণ জটের মাথা থেকে বেরিয়ে তলার দিকে নুয়ে থাকা টিমটিমে আলো জ্বলে বলেই, চারপাশে নির্মিত অন্ধকারের দাপট এতটাই অক্ষুণ্ণ থাকে যে, তার পাশেই শির উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা ভগ্নপ্রায়, আংশিক চুনকামের এবং মেরামতির স্পষ্ট-অস্পষ্ট ক্ষত সমেত দীর্ঘ রোগাটে তিনতলা বাড়িটার বেশ খানিকটা নেই যেন মনে হয়, যেন প্রবীণতর অন্ধকারের গভীরে আকাশের কিছুটা কাছাকাছি হয়তো বা পৌঁছোনোর আগেই উধাও হয়ে গেছে, যার অন্তরে কোনো আলো জ্বলে না বলেই সামনের দিকে হঠাৎ ঝুঁকে আসা কন্দরের মতো মনে হয় শূন্য বারান্দাটিকে।
হাঁ-মুখ বিশালাকার প্রাগৈতিহাসিক কন্দরের সন্মুখে শুধুমাত্র মনোরমা নামের কালো শীর্ণকায়া মধ্যবয়সি মেয়েটি এসে দাঁড়ালে সহসা বারান্দার রূপ হয়। রোদ আসে, একটা ভিজে ছাপা শাড়ি, মলিনতর, ফ্যাকাশে, রঙের অভাবেও উজ্জ্বল দেখায় রোদে। জ্যামেতিক ছায়ায় বারান্দার দেওয়ালে তির্যক ছায়ার অন্তর্বাস প্রায়শই একইরকম অস্তিত্বে প্রতিদিন থাকে বলেই, এক এক সময় মৃত পাখির ডানার মতো, ক্লান্ত প্রভাহীন ব্লাউজের ছায়ায় তার সব উড্ডীন কামনাগুলি নিংড়ে শেষ জলীয় অথবা রসালো উপাদানটুকু নিঃশেষ করে সম্পূর্ণ বিশুষ্ক হয়ে ওঠার সাধনায় বেলাশেষের ম্রিয়মাণ রোদে ঠায় লেপটে রয়েছে বলে মনে হয়।
একটি অতি স্বল্পমুহূর্তও মহার্ঘ বলে বিবেচিত হতে পারে, যেমন সদ্য ভাতঘুম-জনিত অসাড়তা তার চোখের দৃষ্টিকে কিঞ্চিত মেদুরতা দিয়েছে বলে মনে হতে পারে, যখন সে নিবু-নিবু রোদের কাছে পৌঁছে সামান্য হলুদ-বর্ণ ধারণ করে শরীরে। সারা দিনে দ্বিতীয় ব্যক্তিরহিত এই সংসারযাপনের দণ্ড মাত্র সময়ে হলুদ-বর্ণ রোদও তাকে পায় বারান্দায় দীর্ঘ জ্বরের পর। নিস্পন্দ দূরের গাছপালা থেকে হাওয়া উঠলে তার শনের মতো সাদাকালো কেশগুচ্ছ অ-পরিপাটি হলে বারান্দার কোনো একটি আলোকসম্ভব কোণ থেকে তার ক্ষয়াটে সৌন্দর্যে আপাত মাধুর্য হয় নিশ্চয়ই, কেননা ভ্রম হয় কোনো বিলুপ্ত সাম্রাজ্যের বিস্মৃত-প্রায় রাজকুমারী মনোরমা আজও এই জনাকীর্ণ আধুনিক শহরের কন্দর সদৃশ বারান্দায় উপস্থিত হয়েছে বুঝি বা। তথাপি তার সদ্য গা ধুয়ে আসার কোনো গন্ধবাহিত অথবা দৃশ্যগত কোনো অলীক শিহরন পায় না সোনালি রোদসকল এবং জনপদবহুল শহর, শুধু শুকনো জামাকাপড়গুলি সরিয়ে আর একদফা বিবর্ণ, ময়লা, স্থান বিশেষে ছেঁড়া, তালি দেওয়া পোশাকের বাহার সাজিয়ে অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখে। রাতে কন্দরের বারান্দায় হাওয়া এসে মেলে রাখা পোশাকের ভেতরে প্রবেশ করলে, বিশাল গগনচুম্বী তাঁবুর আকারে স্ফীত উদরের মতো বৃহৎ অলৌকিক কিংবা ভূতুড়ে হয়ে ওঠে চরাচর। আঁধার সকাশে এ দৃশ্য কারও চোখে না পড়লেও, মনোরমা দেখে বাতাসের বাচালতা এবং মনেমনে এক বিকল্প চেতনার সুখে নিমজ্জিত হয়।
কোনো কোনো মার্জিত বিকেলে বহু অযত্ন-লালিত একটিমাত্র টবের স্বল্প মাটিতে স্থিত গোলাপ চারাটির জন্য টান লাগে মনোরমার। তার দু-একটি বৃন্তের মুক্ত প্রান্তে রক্তাভ কচিপাতার ফাঁকে একটিমাত্র সূচ্যগ্র, রোগা শরীরে লক্ষণীয় যৎসামান্য চিকন মাংসল পুষ্টি নিয়ে কুঁড়ি জেগেছে। মনোরমা চোখ পাতে সবুজ রেশম, কুসুমসম্ভব কুঁড়িটিতে, যাকে দেখলে তার স্মরণ হয় এমন সু-চিহ্ন সম্বলিত ধারণ ছিল তারও শরীরে, যার রূপ-রস-গন্ধের অবশিষ্ট স্মৃতির খানিকটা মস্তিষ্কর কোষ-কোষান্তরে মৃদু আলোড়নে চকিত হয়ে ওঠে সহসা আর তখনই অনুভূতি অবচেতন অচেতন ঠেলে এসে তাকে বলে যায়—ওই, ওরই নাম বসন্ত!
বহু প্রাচীন বলে মনে হয় তার বসন্তকে! কোনো এককালে যেন পাখা বিস্তার করে সে, এই ভাঙা বাড়িটার সোঁদা গন্ধের ইট-কাঠ কঙ্কালের গায়ে আবরণের মতো লেপটে যাচ্ছিল মান্ধাতার কালে। সেই বিশালাকার ডানার ওমে মনোরমার পূর্বজ সহোদর-সহোদরা সকলেই পুড়ে ছাই হতে চেয়েছিল। মনোরমার শুধু ছাই হওয়া হলো না। সে সময় কারও-কারও চোখে অকিঞ্চিৎকর কালো কুচ্ছিত মনোরমার মুখশ্রীতে এক ধরনের চটুল লাবণ্য এসেছিল, এসে বসেইছিল শরীরে। তারপর যা হয়, দু-তিনটি বসন্তের পরপারে পাখিটির কণ্ঠে আর অলীক মূর্ছনা থাকে না, চোখের লাল প্রবালে সাদা আঁষের মতো ছানি আসে। ডিম পাড়ার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরতে ইচ্ছে হয় না। সে তখন ডানার ভারে নিমজ্জিত জবুথবু এক বীতকাম জুজুর মতো একা।
তথাপি এই অকাল কুসুমের প্রকাশসম্ভব ক্ষণটিকে স্মরণাতীত কালের মাধুর্য ভাবনায় কিছুটা জল দেয় টবে, মনোরমা। এবং তখনই নীচের বারান্দার গ্রিলে ধাতব শব্দ হয়। শব্দটি মনোরমার চেনা বলেই তার উদ্বেল ভাব হয় না, বিচলন হয় না, শুধু একবার অনুভূতির কথাটি উচ্চারিত হয় অস্ফুটে—ওরই নাম বসন্ত! দু-একটা সম্ভাব্য গোধূলির আগে-পরে সে আসে প্রায়, তার আসার ঋতুকালতিথিনক্ষত্র নেই, হঠাৎ মৃদু পদক্ষেপে আহত, মর্মাহত ন্যুব্জ দীর্ঘ শরীরের নীচে গোড়ালির বেশ কিছুটা ওপরে উঠে যাওয়া সাদা পায়জামা এবং গায়ে হাফহাতা একটি সুতির জল কাচা ফতুয়ায় নিজেকে ঢেকে সে ওপর দিকে কল্পনায় বর্ণিত চাতক পাখির মতো মুখ করে দাঁড়াবার আগে গ্রিলে দু-বার ধাতব শব্দ করে, খ্যাশখ্যাশে গলায় ডাকে—মনোরমা আছো? মনোরমা তার ঊর্ধ্বে রাখা মুখের দিকে বারান্দার ওপর বুক অবধি নামিয়ে শুধু কালো ফ্রেমের চশমা ভিন্ন অন্য কিছু ঠাহর করতে পারে না কারণ চশমাটাই তার মুখমণ্ডল হয় তখন। তাছাড়া সামনে থেকে দেখলে চশমার পিছনে তার চোখ অবিশ্বাস্য স্ফুরিত হয়ে ওঠে এবং তার মাথা ঈষৎ কাঁপে।
বিস্তৃত পাখার নীচে সেই বসন্তবন্দনার পাখিটির ওমে ছাই হবার বাসনায় সে একদা এসেছিল, গ্রিলে ধাতব শব্দ তুলে দাঁড়িয়ে ছিল সে সুঠাম যুবক। মনোরমার অপেক্ষমাণতা বিন্ধ্যপর্বতের মতো ধৈর্যশীল হয়ে দেখেছিল শুধু। তার সত্যকার শিলীভূত হবার উপক্রম বলে সে জানত না।
রসস্থ সদ্য মাটির দিকে তাকিয়ে, তার রক্তাভ কচি পাতাগুলির দিকে তাকিয়ে মনোরমা ক্ষীণ গলায় ‘যাই’ শব্দটি উচ্চারণ করলেও, তা নীচের মানুষটির কাছে সম্ভবত পৌঁছায় না, সে দাঁড়িয়েই থাকে বিমূঢ়ের মতো। মনোরমা সিঁড়ির অনালোকিত সোপানে এসে দাঁড়ায়।
গড়ানের পথে জলের মতো নেমে যাচ্ছে মনোরমা। তার পদক্ষেপে, তার নিজের শরীরের মাংসল উত্থানপতনে নিজেরই লাজ হয়, মুখ টিপে হাসে, গায়ের কাপড় ভালো করে জড়িয়ে নেবার মধ্যে সেই সংকোচদীর্ণ আহ্লাদ ফুটে ওঠার মুহূর্তগুলিকে থমকে দাঁড় করায় সে, যেখানে সিঁড়ির পাশের দেওয়ালে বহু স্পর্শজনিত মোলায়েম এবং উজ্জ্বল হয়ে থাকা সিমেন্টের ওপর খোদাই করে ‘মরণ’ শব্দটি লিখেছে রণজিৎ। মনোরমা নাম-শব্দের প্রথম অক্ষরটির সঙ্গে নিজের নামের দুটি অক্ষর দিয়ে সে রচনা করেছে—মরণ! নিজের মনেই হাসতে হাসতে মরণের গায়ে হাত দিয়ে মুহূর্তে সে ইঙ্গিতবাহী গোপন আচরণে, ঠোঁট কৌশলে কিছু জানায় বুঝি মরণকে এবং পরক্ষণেই দ্রুত পায়ে নামতে থাকে।
আচমকা দরজা খোলার ক্ষিপ্রতা চমকে দেয় রণজিৎকে। মনোরমা দুই হাত প্রসারিত করে দরজার পাল্লা দুটিকে সরিয়ে দাঁড়িয়েছে, রণজিৎ তার ত্রিশ বছর পূর্বের তাজা শরীর থেকে ক্লান্তিজনিত ঘাম এবং সুগন্ধির তীব্র আবহ ছড়িয়ে, আকাঙ্ক্ষিত দৃষ্টি সম্বল করে ঘরে প্রবেশ করে। মনোরমা কিশোরী কৃষ্ণা মূর্তির মতো, চোখের সাদা কড়ির তড়িৎ চলনকে শরীরের প্রত্যঙ্গ ঘেঁষে প্রবেশাধিকার দেবার সময়, দীর্ঘশ্বাসে বড়ো এলাচের গন্ধ ছড়ায় এবং খানিকটা স্ব-প্রতিভ ভঙ্গিতে, ঠোঁট উলটিয়ে ভেংচি কাটে—মরণ!
রণজিৎ সামনের চেয়ারে উপবিষ্ট হয়ে, মনোরমার মুখ নির্গত এলাচের গন্ধ টেনে নিয়ে বলে, কেমন নামের অক্ষরে বেঁচে থেকেই মরণ পুষছি সেটার জন্য একটা কমপ্লিমেন্ট দাও! রণজিতের বাজিমাত করা হাসি উপেক্ষা করে টপকে যায় মনোরমার উচ্ছ্বাস। সে শাড়ির আঁচল সামলে, রণজিতের হাতে খবরের কাগজটা ধরিয়ে দিয়ে ভেতরের ঘরের দিকে যাবার উদ্যোগে সিঁড়ির তলায় পানের সরঞ্জাম হাতড়ে এলাচ বার করে মুখে দিয়ে মা’কে ডাকে—মা, রণদা এয়েচে।
‘মরণ’ শব্দটিকে হাত উঁচু করে ছুঁতে চাইলে, মনোরমার কাঁধের হাড়ে ব্যাথা করে, দ্রুত সিঁড়ি ভাঙতে গেলে হাঁটুর সংযোগস্থলে ব্যথা হয় এবং হাড়ের মধ্যে শব্দ হয় মৃদু যা আসলে মনোরমার বাইরে ভেতরে ক্রমশ যুগপৎ রসহীন অস্থিচর্মসার একটি মূর্তি মাত্র হয়ে ওঠার আর্তনাদ। তথাপি সে একা এই ভূতুড়ে অনাসক্ত সংসারে কেবল পদচারণ করে অথবা জুজুর মতো স্থবির হয়ে শ্বাস নেয় মাত্র। রণজিতের দেওয়া ধাতব শব্দ তার আবিষ্টভাব কাটিয়ে তাকে মৃদু পদচারণায় দরজার কাছে পৌঁছে দেয় কেবল। দরজা খোলার আগে সে আলো জ্বালে, গুমোট ভ্যাপসা গন্ধ তার এলাচবাহিত গন্ধের সঙ্গে মিশে একটি মুহূর্ত রচনা করে, যা মনোরমার কাল যাপনে কিছুমাত্র ব্যতিক্রম না হলেও তাকে অস্বীকারের অছিলায় আরও কিছুটা এলাচ আঁচলের খুঁট থেকে নিয়ে সে মুখে দেয় এবং দরজা খোলে।
পুরু পরকলার পেছনে, কম্পমান মস্তিষ্কের ছন্ন দৃষ্টি মনোরমার ওপর নিবিষ্ট করতে করতেই দু-ধাপ সিঁড়ির ওপরে কাঁপা পায়ে উঠে আসে রণজিৎ। হাতে তার রোল করা সাদা কিছু কাগজ, পকেটে রাখা মোবাইলের ভারে ফতুয়ার বাঁ-দিকের গলা এবং হাতার খানিকটা তেরছা হয়ে রোগা শরীর থেকে নেমে চোঙাকৃতি আকারে দুলছে, শরীরের চলনে। মনোরমা দরজার কাছ থেকে সরে দাঁড়ালেও, এলাচের গন্ধ ছড়িয়ে থাকে তার চলার পথে যা একদা প্রতিদিনের শ্বাসপ্রশ্বাসের চেয়ে আলাদা কিছু তার রক্তপ্রবাহের একটি অনন্য সতর্কতা হয়ে জেগে উঠত, তাকে নীরবে গ্রহণ করে সাময়িক স্মৃতি বিচলনের নিস্পৃহ ধারকের মতো সে প্রবেশ করতে করতে বলে, অনেকদিন পর বিকেলে একটু বেরোলাম। বিকেলের শহরটা রণজিৎ অনেককাল না দেখলেও, তার স্নায়বিক অস্থিরতার কারণে সে যে নিয়ত কম্পমান সেটা সে জানে, বিশ্ব চরাচর কে সে আর স্থির দেখে না। মনোরমার বিকেলগুলো বহুকাল ধূলিধূসরিত স্থিরচিত্রের আদল, শহরের হাল-কথা সে জানেই না। যদিও একবার রণজিতের পেছনে দণ্ডায়মান হয়ে সহসা তার পরকলার ভিতর দিয়ে দেখেছিল, সম্মুখ দরজার বাইরে দৃশ্যমান খণ্ডিত শহর, অতি বৃহৎ, তিরতির করে কাঁপছে কী যেন এক আশঙ্কায়। বিকেলের কথায় তার মনের গহনে ফুটে ওঠে, বড়দির গানের মাস্টার আসত বিকেলে। তাদের ডুয়েট গানের ঝরনা ঠিক যখন অবগাহনের মত্ততা নিয়ে আসত মনোরমার অন্তরে, ঠিক তখনই আসত রণজিৎ। মনোরমা ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে রণজিতকে পাশে বসিয়ে অনুভব করত, বসন্তের কোনো ক্ষণ নেই তার কোনো আব্রু নেই। অনেকদিন পর কথাগুলো মনে পড়লেও, গুনগুনিয়ে ওঠার স্বাভাবিক একটি হৃদয়ের অভাব বোধ করে সে নিজের মধ্যে, অথবা ভাবে এই অসমবয়সে, এই সময় রণজিৎ যদি কিছু ভাবে। শুধু তার বলতে ইচ্ছে করে—শুধুই শহর! আর কিছু নয়? পরিবর্তে সে বলে, এই চোখ নিয়ে কী দরকার বেরোনোর?
রণজিৎ হাসে। হাসলে তার নেমে যাওয়া গাল একটু ওঠে আর মনোরমা পুরোনো চেহারার আদল পায় সহসা। রণজিৎ আন্দাজ করে বুঝি মনোরমার উপস্থিতি ঘরের কোনো একটি অংশে এবং সেই আন্দাজে তার কম্পমান মাথা অনির্দেশ ঘুরিয়ে, ঈষৎ উঁচু করে বলে, অনিতা মারা যাবার পর তোমার কোনো খবর নিতে পারিনি। একা একা, এভাবে তুমি…! শেষ করার অভিপ্রায় না থাকলেও, নিজের না বলা কথার একাকীত্বের গভীর ব্যঞ্জনার কাছে রণজিৎ বৃথা চেষ্টা করে তার মাথা স্থির রাখতে, অথচ সে কেবলই কাঁপে আর সরে সরে যায় সামনের দৃশ্যপট। মনোরমা রণজিতের কথার ওপর নিজের মৃদু উচ্চারণের আস্তরণ বিছিয়ে দেয় থমথমে পরিবেশে। সে বলে, ও আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। মনোরমা হয়তো বলতে চায় একাকীত্ব কারও মুখাপেক্ষী নয়, সে বহু যোজনবিস্তারেও কুণ্ডলীময়।
রণজিৎ আরও একটা কথা সাজায় এবং কথাটা সবেগে উত্থাপন করা জরুরি মনে হয় বলেই সে ঘাড় ঘুরিয়ে মনোরমার দিকে চোখ তুলতে গিয়ে থমকে যায়, মনোরমা নেই!
এক এক করে মনোরমার সবাই চলে গেছে। বড়দা, বড়ো বোন, মেজো বোন, ছোটো বোন কেউ নেই। ঘন কুয়াশারা ফিকে হয়ে যাবার পর হিমের বিন্দুর মতো স্মৃতিরা বিছিয়ে থাকে তার চারপাশে। মনোরমা সেই বিনবিনে হিমের ভেতরে কতকাল যে কাটিয়ে দিয়েছে, হিসেব করতে হয়। বড়দি অণিমা কাছেই থাকত, তার প্রেমিক তাকে দিনের আলোয় হাত ধরে নিয়ে চলে গিয়েছিল একদিন। আজ দুজনেই নেই। তাদের এক ছেলে তবলা বাজানো শিখতে শিখতে গুরুর সঙ্গে আমেরিকায় চলে গেল বাজাতে, আর এল না। বড়দা বিয়ের পরই বাড়ি ছেড়েছিল, বিবাহ-পূর্ব সন্তানের জন্ম দিতে। বউদির মুখটাই মনে পড়ে না। মনোরমার অবাক লাগে ভাবলে, আজ আর কেউ নেই। শুনেছিল, বউদির ব্রেস্ট ক্যান্সারের কথা, মারা গেল, তারপর দাদাও। অথচ তাদের তীব্র জীবনযাপনের উদ্দাম স্রোত বীতকাম মানুষদের চোখে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। এখন মাঝে মাঝে তাদের দুই মেয়ে ধেয়ে এলে, তাদের হাই-হ্যালোর সমাজে মনোরমার ক্ষীণ কালো শরীর কুঁকড়ে যায়। সব স্মৃতি ঝাপসা করে দিল মেজো বোনের মৃত্যু। তারও একমাত্র মেয়ে বিয়ে করে কোথায় উধাও হয়ে গেল—সে আজও অজানা মনোরমার কাছে। তার জীবন জুড়ে যেন মৃত্যুর সঙ্গে সহজ হয়ে ওঠার খেলা। বাবা মা’র মৃত্যু তার সহজ এবং স্বাভাবিক মনে হয়েছিল কেননা আর পাঁচটা জীবনের ছন্দের সঙ্গে সে জড়িয়েই ছিল এতকাল, তাতে শূন্য হয়ে ওঠার ভীতি নেই। সে ভাবেওনি যে চারপাশ খালি হয়ে ওঠার জন্যই এতকাল তার বেঁচে থাকা। একমাত্র ছোটো বোন অনিতাই ছিল, যাকে প্রথাসিদ্ধ বিবাহের গৌরব বহনের অহংকার দিলেও, তার নপুংসক স্বামী তাকে মনোরমার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছিল অন্য অছিলায়। সেই ছিল মনোরমার অদ্বিতীয় ছায়া। তার মৃত্যুর কথাও নিষ্ঠুরের হৃদয় নিয়ে ভাবতো মনোরমা এবং সে-ও সত্য বই মিথ্যা হয়নি। অনিতা চলে যাবার পর এখন মনোরমার মুখোমুখি সে নিজে।
রণজিৎ অনেকদিন পর জীর্ণ একটি দরজায় যেন টোকা দেবার অভিপ্রায় বয়ে নিয়ে এল তার কাছে। তারই পূর্বাভাসে ঝুরঝুর করে খসা পলেস্তারার মতো মনোরমার মনে হলো খসে পড়ছে দরজার বন্ধনী সকল।
ছোটোবেলায় মনোরমা চিনের পুতুল নামে একটা সিনেমায় অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছিল। তখন সে ক্লাস ফাইভ। ছবিটা শেষ পর্যন্ত মনোরমার নিজস্ব বক্স-অফিসের অন্ধকারে থেকে গেলেও মা’র সঙ্গে যেতে যেতে মুক্তি পেয়েছিল তার ভেতরে অনেক কাছে থেকেও অনেক দূরের মলয় পর্বতের বাতাস। পথের ধারে সাইকেল নিয়ে ত্রিভঙ্গের ছন্দে দাঁড়িয়ে থাকত সে বালক, যার ভাস্কর্য প্রতিম প্রতীকটিকে ঘিরে ঘিরেই পরীর পোশাকে মনোরমা চিনের পুতুলের অভিনয় করত মনে মনে। সেই বালকও একদিন কাছে এল, ছুঁয়ে দিল পুতুলমাফিক আয়তন ছাপিয়ে ওঠা মনোরমাকে। রণজিতের গালে তখন হালকা রোমশ কৈশোর!
তখনই মনোরমা উপলব্ধি করেছিল, ডানার একটি অদৃশ্য রূপ আছে। তার উড্ডীনের একটি কৌশল আছে, এমনকি সে যৌবনকে বস্তুজগতের সামগ্রী করে তোলার যাদু জানে বুঝি, কারণ বস্তু জগতকে সে ছুঁয়ে দিতে পারে অবলীলায়, এবং এই অনায়াস উপলব্ধি যে আদপে সীমাহীন নয়, তারও যতি আছে কোনো একপ্রান্তে, সেটি সে বুঝতে পেরেছিল, যখন তার সমাগত বসন্তের মুখে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল তারই চারপাশের পরিবেশ। রণজিতের সঙ্গে তার প্রণয় কেউ মেনে নেয়নি। নিজেকে তখন মনোরমার মনে হয়েছিল, বহু বসন্ত পার হয়ে আসা বৃদ্ধ পরভৃত সে যেন এক!
এখন এই বাড়িতে মনোরমা একা। ইদানীং এই ফাঁকা পরিসরে আসে যায়, থাকে মাঝেমধ্যে দু-একদিন, মেজো বোনের স্বামী সৌমিত্র। অনিতা চলে যাবার পর সে নিজেই মনোরমার পাশে দাঁড়ানোর একটা মানবিক কারণ যেন খুঁজে পায়। একাকীত্বের আপাত চিরকালীন ধারণায় যে পাথুরে অমসৃণতা তৈরি হয়েছিল তার, তা সে ভাগ করে নিতে চেয়েছিল মনোরমার সঙ্গে। তার বিমিশ্র অনুভূতিতে সৌমিত্র ধরা দেয় মৃদু। সে যেন সংসার করছে, একটা পুরুষ-আধিপত্যের গহ্বরে যেন সে তলিয়ে যায় সেই দুটো দিন। সময় মতো চা, জল, বাজার করা, কাগজ এগিয়ে দেওয়া, ভাতের থালা সাজানো—অকিঞ্চিৎকর এই অধ্যায়গুলি জুড়ে জুড়ে মনোরমার বেঁচে থাকাটা একটা গড়ানের মুখ থেকে আচমকা ঠেলে উঠে আসে সমতলে যেন। অহেতুক! খাদের কিনার বরাবর হাঁটে যে দিনগুলি মনোরমার, সেই দুটো দিনের দিকে এগিয়ে যায় তবু!
রণজিৎ গুমোট, ম্লান বিকেলের আলোয় খোঁজে—মনোরমাকে। এলাচের গন্ধ নেই আর, কেননা তার ছড়িয়ে রাখা এলাচের গন্ধের তারতম্যে আভাসিত হয় সে। চোখের সামনের দেওয়ালে ঝাপসা ছায়ামূর্তির মতো এক সময় সে আবিষ্কার করে তাকে, কিন্তু তার ভেতরে তাকানো যায় না, কেবল সে বুঝতে পারে মনোরমার সহসা পিছিয়ে দেওয়ালের কাছে ঘেঁষে যাবার কারণ। তবু তার বুকের ভেতর জমে থাকা প্রশ্নটা ছায়ামূর্তির উদ্দেশে সে নিবেদন করে গলার স্বরে যতটা সম্ভব স্পষ্টতা এনে—সৌমিত্র আসে শুনেছি, থাকে তোমার কাছে? মনোরমা নিজেকে ছায়ামূর্তিই মনে করে। কিন্তু রণজিতের কাছে সেটা ভ্রম। ছায়ার মতোই সে দৃঢ় কিন্তু দুর্বল। তার মনে হয়, ধূসর হয়ে গেলেও, মরণ শব্দটাই সে ছুঁতে চেয়েছিল একমাত্র। কিন্তু সে যে কী দীর্ঘ অতিবাহিত কালের যন্ত্রণা, কীভাবে বোঝাবে রণজিৎকে। সে চুপ করে থাকে। চুপ করেই সে আছে—এই ভারঘন জীবন, রণজিৎ, সৌমিত্র আর স্মৃতি নিয়ে।
রণজিৎ নিজের ঝাপসা দৃষ্টিকে বিশ্বাস করে না। সে শব্দের প্রামাণ্য অস্তিত্ব চায় বুঝি, তাই আর একবার শব্দ করে নিজের কন্ঠে—কই বললে না তো?
মনোরমাও শব্দ করে সামান্য—ঠিকই শুনেছ!
আর তোমার যে রাত করে জ্বর আসত, এখনও আসে, না…কথাটুকু বলার আগে নির্বিকার হাসে একবার রণজিৎ।
এখন আর জ্বর নেই তার। বেশ কিছুদিন গোধূলি শেষের পর থেকে তার কম্পন আসত। জ্বরের মাত্রা কম হলেও আলুলায়িত হয়ে যেত সে। বেশ কিছুদিন ধরে থাকতে থাকতে জ্বরের একটা নেশা হয়েছিল তার। ঈষৎ হলুদ হয়ে আসা টিউবের আলোয় তার একানে খাট, খাটের চারপাশের আসবাবহীন ঘর মোহময় হয়ে উঠত। জ্বর বাড়লে ক্ষীণদৃষ্টিতে মনোরমার অনুভব হতো, সৌমিত্র তার কপালে হাত দিচ্ছে। অন্য হাতে ধরা থার্মোমিটার দেখে সে কুঁচকে যেত ভিতরে। ব্লাউজের হুক খুলে সেটা তাকে রাখতে হবে বগলের খাঁজে আর সৌমিত্র সেটা দাঁড়িয়ে দেখবে। যদিও তার শরীরের খরস্রোতগুলি আর নেই প্রায়। রণজিতের অবগাহনের জন্য অপেক্ষা করে করে মজে গেল। রণজিৎ নিজেও তার দীর্ঘ সুঠাম প্রত্যঙ্গগুলির প্রতি উদাসীন থেকে গেল, সুযোগ্য হয়ে ওঠার বহু অবসর সে ফিরেও দেখল না।
সৌমিত্র দেখে। দু-দিন ধরে সে এসে রয়েছে। মনোরমা টের পায় দুটি সক্ষম চোখ ঘিরে রয়েছে তার রোগগ্রস্ত বয়স্ক, বেমানান, সাদা সাদা চামড়ার ঔজ্জ্বল্য। সেই তাকে জ্বর থেকে তুলে একদিন উজ্জ্বল ছাদের কার্নিশে হেলান দিয়ে বলেছিল—মনো, এবার দেখবে, তোমার চেহারায় একটা জোয়ার আসবে। জ্বরের শেষে এমনটাই হয়।
রণজিৎ মনোরমার চোখের মধ্যে তাকিয়ে থাকে আন্দাজে। মনোরমা তার জ্বর বিষয়ক প্রশ্নের উত্তর সাজাতে গিয়ে থমকায়। রণজিৎ নিজেই উত্তর আনে—এখন তুমি ভালোই মনে হয়, তাই না? মনোরমা হাসে, ম্লান হাসি সে, জ্বরের সে কী বোঝে! তার বাইরের আবরণে শুধুই তাপ অনুভূত হয়, তার নিভৃত দাহ কে জানে?
মনোরমা, সৌমিত্রকে তার নকল সংসারের একটা উপকরণ, পুতুল ভাবতে ভাবতে—ক্রমশ একটু একটু করে সুস্থ হয়ে উঠছিল। বর্ষা-পুষ্ট নদীর মতো চিকচিক করছিল জলরাশি। ক্রমশ অনেক কালের স্থগিত ভাটা সরিয়ে জোয়ার টের পাওয়ার আগেই, সৌমিত্র, বহুকাল অপেক্ষমাণ স্নানরতার বিশুষ্ক রুগ্ন শরীর নিয়ে, তীরের কাছ দাঁড়িয়ে থেকে বলে—মনো, আমার গায়ে হাত রেখে দেখো, কেমন এক জ্বর-জ্বর ভাব!
রণজিৎ আনমনে কিছু একটা ভাবে নিশ্চল হয়ে। তার চোখে মনোরমার ছায়ামূর্তিটুকু ছাড়া আর কিছুই নেই। মনোরমার শরীর থেকেও বোধহয় একসময় এলাচের গন্ধ পেত মানুষটা, ঘরে ঢুকেই সে বুঝত, মনোরমা আছে—না, নেই! আজ মিলিয়ে গেছে যেন সেই গন্ধ, মুখের ভেতর কেমন বোদা ভাব, আঁচলের খুঁটে আনমনে হাত রেখে সে টের পায় এলাচ নেই আর।
তোমার নামের আদ্যাক্ষর যেমন আছে তেমনই যদি থাকে, আর আমি নিজের অক্ষরগুলি তোমার পাশ থেকে সরিয়ে নিয়ে যাই, তবে?—রণজিৎ বলে। ধূসর হয়ে আসা পরকলার ওপারে সে যেমন থেকেও নেই, তেমনই নিঃসাড় মনে হয়, শব্দবন্ধ, যার নির্মিত অর্থ তারই অভিধান থেকে উঠে এসেছিল, এখন তাকেই অর্থের উপমা-অলংকারে শ্বাসরোধ করে দিচ্ছে যেন। উত্তরের কথা ভাবে না সে আর, দেখতেও পায় না মনোরমাকে চার দেয়ালের মধ্যে কিন্তু মনে হয় থাকলে ভালো হতো, আবার একটা শব্দ সাজানোর ধাঁধাঁ শোনাতে ইচ্ছে হয় খুব। শব্দ বড়ো সপ্রাণ—সে মনোরমা জানে!
আচ্ছা মনোরমা, সৌমিত্রর মি-অক্ষরটি যদি আমার দুটি অক্ষরের শূন্য স্থানে রাখি, ভাবো একবার ভাবো…বলতে বলতে একা একাই হাসে রণজিৎ। ফাঁকা ঘরে সে চিৎকার করে—মমি—মমি, শুনতে পাচ্ছ মনোরমা?
মনোরমা কবেই হারিয়ে গেছে যেন, মমির কথা পড়েছে সে অনেককাল আগে ইতিহাসের পাতায়। মাটির নীচে একটা মানুষের স্থাবর-অস্থাবর নিয়ে শুয়ে থাকা। সে এক দীর্ঘ সমাধি কালযাপন! মনোরমাও যেন শুয়ে আছে, সে স্বপ্ন দেখে পুরো বাড়িটাই একটা মস্ত পিরামিড, তার ভেতরে সে ইতিহাস বিস্মৃত কোনো এক রানি। রণজিৎ তাকে আবিষ্কার করতে পারল যেন কত যুগ পর নত হয়ে আসা বিকেলের শেষ আলোয়, যখন তার মুখ নিঃসৃত এলাচের গন্ধ আর নেই, অথচ সে ছিলই এতকাল। সৌমিত্রও তাকে খনন করে নিতে পারল না, সে শুধু মৃতের চারপাশে ঘোরে।
রণজিতের কবে যেন জ্বর এসেছিল, সে কোনকালে। চিলেকোঠার সিঁড়ির শেষ ধাপে দাঁড়িয়ে গোলা পায়রার পালক আর বিষ্ঠার প্রচীন গন্ধের এঁদো অনুভূতিতে ছুঁয়ে দেখেছিল তার তাপ। রণজিৎ যেন বিচ্ছুরিত হয়েছিল সেই সদ্য বিকেলের নিভৃতে।
রণজিৎ ঠাহর করতে পারে না কিছু। ঘরের গন্ধ-বাতাসে একটা গুমোট ভাব হচ্ছে। এলাচের ঘ্রাণ নেবার চেষ্টা করে সে মাথা নীচু করে নাক টেনে—গন্ধ নেই! সে ডাকে,—সৌমিত্র—মনোরমা! তার পুরু পরকলায় কোনো ছায়াপাত নেই।
সৌমিত্র আসে। রণজিতের সামনে যে কুয়াশার চাদর ছিল, সেটা খানিক সরিয়ে তার পরকলার পেছনে দুটি কাঁপা চোখের ওপর ছায়া ফেলে বলে,—অন্ধকার নেমে আসছে, আপনি বাড়ি যাবেন না? রণজিৎ মাথা তুলে তাকাতেই এলাচের গন্ধ আসে নাকে, একটু বেশিই তীব্র সে।
আর মনোরমা? রণজিৎ যেন সৌমিত্রর মতো একটি নিছক ছায়াকে অস্বীকার করতে চায়, তার নাকের সামনের বাতাসকে ভীষণ একটা অট্টহাস্যে উড়িয়ে দিয়ে বলে,—তুমি তো চেইনস্মোকার ছিলে এখন…!
সৌমিত্র হাসে হয়তো, রণজিৎ তেমন একটা শব্দ অনুভব করে। সৌমিত্র বলে, বাড়িটা দেখাশোনা করার জন্য আসি মাঝেমধ্যে। আপনিও চলে আসবেন, দুজনে গল্প করা যাবে। সিগারেট অনেকদিন ছেড়ে দিয়েছি।
রণজিৎ জানে তার মাথা স্নায়বিক তাড়নায় কাঁপে নিরন্তর, তবু সে যথাসম্ভব দৃঢ় এক চকিত পলক হানে। কাউকেই দেখা যায় না। বাইরের আলো নত হয়ে এল অন্ধকারের সামনে।