প্রেসিডেন্সি কলেজে ছাত্রদের সহিত কোনো কোনো য়ুরোপীয় অধ্যাপকের বিরোধ ঘটিয়াছে তাহা লইয়া কোনো কথা বলিতে সংকোচ বোধ করি। তার একটা কারণ, ব্যাপারটা দেখিতেও ভালো হয় নাই, শুনিতেও ভালো নয়।…
কিন্তু কথাটা চাপা দিলে চলিবে না। চাপা থাকেও নাই, বাহির হইয়া পড়িয়াছে। মনে মনে বা কানে কানে বা মুখে মুখে সকলেই এর বিচার করিতেছে।
বিকৃতি ভিতরে জমিতে থাকিলে একদিন সে আর আপনাকে ধরিয়া রাখিতে পারে না। লাল হইয়া শেষকালে ফাটিয়া পড়ে। তখনকার মতো সেটা সুদৃশ্য নয়।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ছাত্রশাসনতন্ত্র’ শীর্ষক প্রবন্ধের একেবারে গোড়াতে এই কথা ক’টি লিখেছেন অত্যন্ত ব্যথাতুর হৃদয়ে। যে সংকটের প্রেক্ষিতে তাঁকে এই কথাগুলো লিখতে হয়েছে সেই ‘বিরোধ’ প্রসঙ্গটিও যে খুব অপরিচিত বা অজ্ঞাত, তা নয়। সংঘাতের কারণে সরকারের শিক্ষা দফতরের প্রায় একতরফা সিদ্ধান্তে ছাত্রটিকে বহিষ্কার করা হয়। পরবর্তীকালে এই বিষয়ে বিস্তর আলোচনা হয়, উত্তেজনা প্রশমিত হয় সময়ের চিরন্তন প্রভাবে। ইংরেজ শাসিত ভারতবর্ষে এমন ঘটনা ঘটবার একটা আপাত-সঙ্গত কারণ হয়তো ছিল এই যে, শিক্ষক ও ছাত্রেরা পারস্পরিক সম্পর্কের বন্ধনটি পরাধীনতার নিগড়ে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা ছিল; ফলে শিক্ষার্থীর প্রতিবাদী-সত্তাটিকে মেনে নেওয়া অনেকক্ষেত্রেই শিক্ষক তথা শাসকের পক্ষে সম্ভব হত না। সংঘাতের বীজ সেখানে সুপ্তই ছিল, সামান্য ঘটনার প্রেক্ষিতে তা ফুলে ফলে পল্লবিত হত।
কিন্তু একালে?
বছর কয়েক আগের কথা বলি, সরকারের শিক্ষা বিভাগ আয়োজিত এক শিক্ষক প্রশিক্ষণ শিবিরে হাজির হয়েছি স্থানীয় সরকার-পোষিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর একদল শিক্ষক শিক্ষিকা। নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের হালহকিকত সহ নতুন শিক্ষা ভাবনার প্রয়োগ ও সঞ্চালন বিষয়ে শিক্ষক শিক্ষিকাদের উপলব্ধি, অভিজ্ঞতা এবং পরিকল্পনার কথা সর্বসমক্ষে ব্যক্ত করার জন্য আহ্বান করা হলো। প্রাথমিক অভিভাষণের পর্ব মিটতেই এক নবীনা শিক্ষিকা ভাষণ দেবার জন্য মঞ্চে উপস্থিত হলেন। সকলেই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন, কী বলেন শোনার জন্য। কিন্তু গোল বাঁধল শুরুতেই। তাঁর প্রতিষ্ঠানের কথা বলতে গিয়ে তিনি বললেন,
স্কুলগুলোর সামগ্রিক অধঃপতনের মূল কারণই হলো শিক্ষাঙ্গনে প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়াদের অবাঞ্ছিত উপস্থিতি। এই প্রথম প্রজন্মের অর্বাচীন, অশিক্ষিত পড়ুয়ার দল স্কুলযাপনের মান্য বিধিনিয়ম বিষয়ে নিতান্তই অনভিজ্ঞ, তাই তাদের কারণেই আজ স্কুলগুলো এক সংঘাতের ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।…
তাঁর কথা শেষ করার আগেই উপস্থিত শিক্ষক শিক্ষিকাদের বৃহত্তর অংশ প্রবল উল্লাস ও করতালি দ্বারা অভিনন্দিত করলেন বক্তাকে। সুধী শ্রোতৃবৃন্দের তরফে এমন সমর্থন পেয়ে ত্রিগুণ উৎসাহে দিদিমণি তাঁর ভাষণের পরবর্তী অংশ পেশ করতে থাকলেন, অবিচল ভাবে। স্বাভাবিক ভাবেই পরবর্তী অংশের ভাষণে, অনিবার্যভাবে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে আরও বাছাই করা বিশেষণ প্রযুক্ত হলো। মনে মনে ভাবলাম, ছাত্র-ছাত্রীদের অজান্তেই যখন এমন মধুবাক্যবর্ষণ তখন সাক্ষাতে না জানি কত কী ঘটে! স্কুল-পরিমণ্ডলে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের পারস্পরিক অনুভবের বুনিয়াদ যদি নড়বড়ে ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে, তাহলে সংঘাত ঠেকানো কার সাধ্য? অভিধান বলে, শিক্ষা-র উৎপত্তি ‘শাস’ থেকে; আর ‘শাস’-এর অর্থ হলো শাসন। সংঘাত লাগলে, শাসকের স্থান-বদল হতে বিশেষ সময় লাগে না।
সব সম্পর্কের মতো শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের পারস্পরিক স্থূল সম্পর্কের বিষয়টিও পরিবর্তনীয় এমনটা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে, বিশেষত যেখানে লেনদেনের একটা ব্যবস্থা কায়েম রয়েছে। শিক্ষকেরা যদি তাদের ‘গুরুসুলভ’ আধিপত্যবোধের তাড়নায় নিরন্তর তথাকথিত জ্ঞানের ঝোলা শিক্ষার্থীদের কাঁধে চাপিয়ে দায়মুক্ত হবার চেষ্টা করেন, তাহলে সংঘাত লাগবেই। মুশকিল হলো আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষা সঞ্চালনের বিষয়টি বরাবরই একতরফা। ঘড়ির কাঁটার যান্ত্রিক চলনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কিছু কথা উগরে দিয়েই শিক্ষকেরা দায়মুক্ত হলে, শিক্ষার্থীরা এক গভীর বঞ্চনার শিকার হয়। যার ফলে বিশ্বাস বোধের পরিবর্তে জন্ম নেয় বিকার। এই বিকারই যখন বিস্ফোরিত হয় প্রবলভাবে তখনই প্রাজ্ঞাজনেরা ‘গেল গেল’ রব তোলেন। শিক্ষাক্ষেত্রে নৈরাজ্যের হাহাকার ধ্বনিত হয়।
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, প্রবল একটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে চলেছে গোটা পৃথিবীই। এমন অস্থিতির কারণ বহুবিধ। রাজনৈতিক সংকটের হাত ধরেই হাজির হয়েছে অর্থনৈতিক সংকট। এই দুটি ক্ষেত্রের টালমাটাল পরিস্থিতি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রকেও পর্যুদস্ত করেছে গভীরভাবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো তো সমাজেরই অংশ। সমুদ্রের জল জোয়ারের প্রভাবে ফুলেফেঁপে উঠলে, তা যেমন নদীখাতেও প্লাবনের ঢেউ তোলে, ঠিক তেমনই বৃহত্তর সমাজ পরিমণ্ডলের আলোড়ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর একান্ত যাপনের পরিসরকেও বিশৃঙ্খল করে দেয় বারংবার। আর তাই সংবাদমাধ্যমের টুকরো খবর হয়ে ওঠে তেমন সব ঘটনার স্থূল বিবরণী।
শিক্ষার্থীরা তো কেবল পাঠ্যপুস্তকের গোদা কথামালা থেকে জীবনাভিজ্ঞতা অর্জন করে না; পরিবার পরিমণ্ডল তথা বৃহত্তর সমাজের টানাপোড়েন থেকেও তারা অনেককিছু শেখে। এই শেখাটাই যখন শিক্ষাঙ্গনে প্রয়োগ করতে যায় তখনই বিপদের মেঘ ঘনিয়ে ওঠে। আসলে, যে নৈরাজ্যের কথা সাধারণত আমরা বলি, তারও রয়েছে একটা নিজস্ব রাজনীতি। সবকিছুকে নিজের কুক্ষিগত করার। শাসন, ত্রাসন, ভীতি প্রদর্শন, হুমকি, গালিগালাজ—এসবই নৈরাজ্যের হাতিয়ার। আর এরই বশবর্তী হয়ে, সর্বসমক্ষে একজন শিক্ষক সহ-শিক্ষকের সঙ্গে প্রতিপক্ষ-রূপে অশালীন হাতাহাতিতে লিপ্ত হন। মহাবিদ্যালয়ের আঙিনায় স্রেফ দাদাগিরির বাহানায় কোনো রাজনৈতিক দাদা তথা ছাত্র নেতা জলের জগ ছুঁড়ে মারেন কোনো এক অধ্যাপকের দিকে। বৃহত্তর রাজনীতির স্বার্থে—শিক্ষার্থীদের প্ররোচিত করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে নানারকম ভাবে হেনস্থা করতে। এমনই সব অবাঞ্ছিত ঘটনা শিক্ষাস্থলে কোনো সুমধুর বসন্তের বার্তা করে না। বরং ঘোর সংকটের আবহকেই স্বীকৃতি দেয়।
যদিও আমরা জানি, সমাজ জীবনে ছাত্র আন্দোলনের সদর্থক ভূমিকার কথা, যা কেবল মাত্র গাজোয়ারি ব্যাপার নয়। পৃথিবীর ইতিহাসের সাপেক্ষে এমন অনেক কথাই বলা চলে। কিন্তু রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থেকে যা খুশি তাই করার এই যে মানসিকতা তাকে তো আমরাই প্রশ্রয় দিয়েছি, মিথ হিসাবে গড়ে তুলেছি। তা সে বেঞ্চের ওপর ছোরা গেঁথে পরীক্ষা দেওয়াই হোক বা পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্র পেয়ে যাওয়া কিংবা একজন পরীক্ষার্থীর পরিচয় পত্র নিয়ে অপরজনের পরীক্ষাকেন্দ্রে যাওয়া। দাদাদের হাত ধরে, টাকার বিনিময়ে কলেজে প্রবেশাধিকার পাওয়া থেকে শংসাপত্র পাওয়া অবধি। এসব ঘটনা ঘটেছে—একবার নয় বারবার। প্রতিবারেই যৎকিঞ্চিৎ ‘গেল, সব উচ্ছন্নে গেল’ জাতীয় কোলাহল এবং আবার কিছুদিন পরে একটি নতুন ঘটনা ঘটে যাওয়া।
খুব সম্প্রতি ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা: ইচ্ছকৃত ভাবে পরীক্ষায় কম নম্বর দিয়ে ফেল করিয়ে দেওয়া হয়েছে—এমনই এক অভিযোগ তুলে শিক্ষার্থীরা তাদের বিদ্যালয়ের গণিত শিক্ষককে গাছের সঙ্গে দীর্ঘ সময় বেঁধে রেখে এক চরম অবমাননার কাণ্ড ঘটিয়েছে আমাদের প্রতিবেশী এক রাজ্যে। এ রাজ্যে অতিমারি পরবর্তী সময়ে বিদ্যালয় ও সড়ক অবরোধ করে জেলায় জেলায় বিনা পরীক্ষায় পাস করানোর দাবি উঠলেও, সে কারণে কোথাও কোনো শিক্ষক নিগ্রহের খবর বিশেষ মেলেনি। বরং কোথাও কোথাও শিক্ষক বা শিক্ষিকা অভিভাবকদের হাতে অপদস্থ হয়েছেন, ছাত্রছাত্রীদের শ্রেণিকক্ষে ‘শাসন’ (?!) করার কারণে। বিনা পরীক্ষায় পাস করানোর দাবি জানানো অথবা কোনো কারণবশত পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হলে পরে শিক্ষককে নিগ্রহ করার ক্ষেত্রে অবশ্য আঙুল ওঠে যেন বা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মৌলিক ত্রুটির দিকেই।
২.
আমরা জানি, এদেশের স্কুল পড়ুয়াদের এক বিরাট অংশ অর্থনৈতিক ভাবে অনগ্রসর শ্রেণির। অধিকাংশ শিক্ষার্থীর কাছেই শিক্ষা শব্দটা রংচঙে রকমারি পাঠ্যপুস্তক মাত্র। তদুপরি এদেশে পরিসংখ্যান নিয়ে নানা কারচুপি চলে। শিক্ষাক্ষেত্রই বা তার থেকে বাদ যায় কেন? মাধ্যমিক স্তরের পরীক্ষার্থীর সংখ্যাবৃদ্ধি তৃমমূল স্তরে শিক্ষা প্রসারের একটা বড় পরিচায়ক। ২০০৯ সাল থেকে, শিক্ষার অধিকার আইনের দ-য়ে পড়ে পরবর্তী এক দশক না হয় বিদ্যালয়ে ‘পরীক্ষা’ বলে কিছু ছিল না সেভাবে অষ্টম শ্রেণি অবধি। কিন্তু তথাপি সেই সংখ্যাটা কেন পরবর্তী উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে তার কম বা অর্ধেক হয়ে পড়ছিল বা এখনও পড়ছে তার সদুত্তর মেলে না।
শিক্ষা মানে পরীক্ষা ও পরীক্ষা মানে নম্বর। নম্বর যখন সব শিক্ষার (?) কেন্দ্রক হয়ে ওঠে তখন শিক্ষক নিগ্রহের মতো এমন নৈরাজ্য এড়ানো সম্ভব বলে মনে হয় না। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদেরই বা দোষ কোথায়? আমরা মুখে যতই নীতিবাক্য আউড়াই না কেন, পরীক্ষায় পাস-ফেল বড় নয় বলি না কেন—সবর্ত্রই ‘গ্রেড’ আর ‘পার্সেন্টজ’ নামীয় সংখ্যামানের গুরুত্ব। সুতরাং ভবসাগর উত্তরণের জন্য যেনতেনপ্রকারেণ নম্বর-রূপ পারানি সংগ্রহের প্রাণান্তকর প্রয়াস। কেবলই প্রাপ্ত নম্বরের বিচারে কৃতী শিক্ষার্থীর শিরোপা পাওয়া কোনো ছাত্র বা ছাত্রী যখন পাঠ-সহায়িকা পুস্তক হাতে নিয়ে, গদগদ কণ্ঠে নিজের স্থানাঙ্ক ঘোষণা করে বলে, আমার সাফল্যের পিছনে অমুক তুষুক প্রকাশনী প্রকাশিত ‘প্রশ্ন বিচিত্রা’ বা ‘উত্তর বিচিত্রা’র ভূমিকা ‘সর্বাধিক’ তখন বিদ্যালয়-কেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় নৈরাজ্যের আর বাকি কী থাকে?
অথচ এমন অবস্থা তো রাতারাতি তৈরি হয়নি। এই ক্ষয়রোগ অনেক অনেকদিন ধরেই ঘুণ পোকার মতো আমাদের সরকারি শিক্ষাব্যবস্থাকে কুরে কুরে খেয়েছে, আমরা সে সব জেনে বুঝেও নিরাসক্ত সাধকের মতো উদাসীন থাকার অভিনয় করে গিয়েছি। আর আজ যখন যাবতীয় পরিকাঠামো, ‘শুদ্ধতা’ ভেঙেচুরে অস্থিকঙ্কালসার চেহারাটা বে-আব্রু তখন—পরস্পর পরস্পরকে দোষারোপ করে চলেছি অর্থহীনভাবে। আমাদের চিৎকৃত আর্তনাদের মধ্য দিয়েই ঘোষিত হচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থার অন্তর্জলি যাত্রার করুণ আখ্যান।
শিক্ষার, বিশেষ ভাবে সরকার-পোষিত শিক্ষাকেন্দ্রের এই ঘনায়মান নৈরাজ্যের পেছনে অভিভাবকদের ভূমিকাও কম নয়। অভিভাবক মণ্ডলীর সদর্থক পৃষ্ঠপোষণার ওপর ভর করে একসময় বহু বিদ্যালয়ের স্থাপনা হয়েছিল এ রাজ্যে। বহু কৃতী, দরদী, যথার্থ বিদ্যোৎসাহী শিক্ষকদের নিবিড় সাধনার ওপর ভর করে আত্মপ্রকাশ করেছিল অসাধারণ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সামাজিক কারণেই তখন অভিভাবকরা প্রত্যাশা করতেন তাদের সন্তানরা যেন ‘মানুষ’ হয়। এই কাঙ্ক্ষিত ‘মানুষ’-এর বৈশিষ্ট্য কী তা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক চলতে পারে, তবে তা কখনই অভিভাবকদের ‘অসীম আকাঙ্ক্ষা’র প্রতীক হয়ে ওঠেনি।
কিন্তু আজ? নিউক্লিয় পরিবারে সন্তানের অবস্থান সমস্ত সম্পর্কের ভরকেন্দ্রে। সন্তানকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে পারিবারিক কর্মকাণ্ড। আয়োজনের আতিশয্যে শিশুটির জেরবার অবস্থা। সন্তানের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে, নিজের মতো করে তালিম দেবার মতো সময়ের বড় অভাব ‘প্যারেন্ট’দের। তাই সন্তানের শিক্ষাদীক্ষার জন্য নিযুক্ত রয়েছেন একালের নিয়ম মতো সব পারঙ্গম এডুকেটররা। অভিভাবকরা তাদের হাতেই সমস্ত নির্মিতির দায়ভার তুলে দিয়ে একরকম নিশ্চিত থাকছেন। ভবিষ্যতে তাদের বিনিয়োগ থেকে মোটা অঙ্কের লভ্যাংশ পাবার আশায়। অথচ এই সহজ সত্যটাকে তারা হয়তো মানতে চান না যে, সংসারে অভিভাবক হয়ে কেউ জন্মায় না। প্রত্যেককে নানান অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে ‘অভিভাবক’ হয়ে উঠতে হয়। সন্তানের প্রকৃত হিতার্থে এই পর্বটিও এক সাধনার পর্ব।
প্রচল শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে শিশুর কোনো মানসিক সম্পৃক্তি না থাকায়, হাসিখুশিময় বাল্যকাল, নাতিদীর্ঘ জীবন ধ্বস্ত হয় অখুশি-অসুখের চোরাটানে। এক ধরনের বিচ্ছিন্নতা বোধের জন্ম হয়। শিশুমন বিশারদের রোজনামচায় এমন অসংখ্য ঘটনা ‘কেস হিস্ট্রি’ হিসেবে ফাইলবন্দি হয়ে আছে। এমনই একটা ছবি এঁকেছিলেন কথাকার শিবদাস ব্যানার্জী, সনৎ সিংহ গেয়েছিলেন দরাজ কণ্ঠে, মজার ছলে আকুতি মেশানো সে-ই গান: ‘সরস্বতী বিদ্যেবতী…’। নিম্নবিত্তের, নিম্ন-মধ্যবিত্তের সংসারে ‘মনের রোগ’ বলে কোনো অসুখ আজও সেভাবে নেই, এক যদি না তা খুব সহজ ভাবে মস্তিষ্ক বা স্নায়বিক অসুস্থতাজনিত ‘পাগলামি’ সাব্যস্ত হয়! ফলে যে বিকার অঙ্কুরিত হয়েছিল শৈশবে, কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে তা জন্ম দেয় এক নৈরাজ্যিক প্রতিক্রিয়ার।
এইসব দেখতে দেখতে এক সময় মনে হয়, আমরা কী আমাদের তথাকথিত শিক্ষাকে দর্শন মুক্ত করে ফেলেছি? মাঝে মাঝেই পরিচিত মহলে কান পাতলে শুনতে পাই, এমন কথা: ‘এই সময়ের ছেলেপিলেরা অনেক স্মার্ট, অনেক বেশি জানে।’ কিন্তু আত্মঘাতী এই সময়ে, ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে, কিছু জানার সঙ্গে কিছু শেখা কতদূর জড়িত তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ থাকলেও—কে আর অহেতুক জটিলতা বাড়াতে চায়!
এতাবৎকালের শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের আমরা পাঠ্যপুস্তকের বাঁধা শব্দবন্ধের মধ্যেই আটকে রাখতে চেয়েছি, চাইছি। যে কারণে শিক্ষার্থীর মনোজগতে এক গভীর শূন্যতার সৃষ্টি হলেও, সে শূন্যতা ঢাকা পড়ে যায়। প্রথাগত নৈতিকতার আশ্রয় ছেড়ে যে নতুন নৈতিকতার বলয়ে শিক্ষার্থীদের আমরা লালন করেছি, সেখানে একটি মাত্র বাক্যবন্ধের স্থান: ’এ লড়াই টিকে থাকার লড়াই। এই ময়দান তীব্র প্রতিযোগিতার ময়দান। এখানে তোমাকে জিততেই হবে।’—এই একমুখী মনোচলনের ফলে, পরিপূর্ণ শিক্ষার লক্ষ্য থেকে যোজন দূরত্বে অবস্থান করে আমাদের শিক্ষার্থীরা।
কর্মজীবনে প্রবেশের পর, ভারী হয়ে ওঠা শূন্যতার বোঝাকে বহন করতে না পারার দরুন গভীর হতাশার শিকার হতে হয় তাদের। মনে রাখতে হবে, জাতির শিক্ষার বুনিয়াদ যদি অপূর্ণ, নড়বড়ে হয়—তাহলে তার প্রতিফল ভুগতে হয় গোটা সমাজকে। আজ আমাদের চারপাশের সমাজে প্রকটিত অবক্ষয়ের মূল কারণই হলো অসম্পূর্ণ শিক্ষা। বহিরঙ্গের চাকচিক্য ছেড়ে অন্তরের ঐশ্বর্যের ঔজ্জ্বল্যে ভরিয়ে তুলতে হবে শিক্ষার্থীদের। সেই কোনকালে রবীন্দ্রনাথ আমাদের সাবধান করে বলেছিলেন, ‘শিক্ষাকে আমরা বহন করিলাম, বাহন করিলাম না।’ চেনা ছকের বাইরে এসে, অন্তরের আনন্দকে অনুভব করতে না পারলে শিক্ষার সার্থকতা কোথায়? মনে রাখা দরকার প্রত্যেকটি শিক্ষার্থীর মানসিক গঠন স্বতন্ত্র, ফলে একই শ্রেণিকক্ষের মধ্যে বন্দি প্রত্যেকটি শিক্ষার্থীর ভাবনা, চিন্তা, আগ্রহ, আদর্শ, উপলব্ধির স্তর, চাহিদা স্বতন্ত্র। এমন বিভিন্নতাকে মাথায় রেখেই শ্রেণিকক্ষে শিক্ষা সঞ্চালন করা উচিত শিক্ষকের। এর অন্যথা হলেই জন্ম নেবে দ্বন্দ্ব, অসন্তোষ। আর কে না জানে, অসন্তোষ থেকেই জন্ম নেয় নৈরাজ্য।
বলা বাহুল্য কোটিকে গুটিক ব্যতিক্রম বাদে, মাস মাইনের পেশাজীবী-শিক্ষক এতসব ভেবে শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করেন না। তাঁর এবং শিক্ষার্থীদেরও সময়ে ‘সিলেবাস’ শেষ করার তাড়া থাকে। অতএব…। অথচ আমরা এখনও সভা সমিতির পোস্টারে, বিদ্যালয়ের দেওয়ালে লিখে চলেছি, ‘শিক্ষা আনে চেতনা, চেতনা আনে বিপ্লব।’ বস্তুত পরিবর্তন আসে পুঁজির হাত ধরে। ভাসিয়ে নিয়ে যায় আমাদের চেনা জীবনের সব চিহ্নগুলোকে।
৩.
স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পেরিয়ে, খুব আশা ভরা চোখে এদেশের ‘সাধারণ’, প্রাথমিক শিক্ষার ভবিষ্যতের দিকে যে তাকাতে পারছি—তা বোধহয় নয়। স্থূল অর্থে শিক্ষাব্যবস্থাপনার প্রভূত বিকাশের কথা হলেও, বাস্তব কিন্তু সে-কথা বলে না। অথচ তাবড় তাবড় শিক্ষাবিদদের নায়কতায় একাধিক শিক্ষা কমিশন বসেছে, তাঁদের মূল্যবান প্রতিবেদনে দেশীয় শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ সব প্রস্তাব রাখা হয়েছে। আশু কর্তব্য বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। কিন্তু ওখানেই ইতি। দীর্ঘ ঔপনিবেশিক অনুশাসনে গড়ে ওঠা ব্যবস্থাপনাকে খানিকটা জোড়াতাপ্পি দিয়ে কলি ফেরানো হলেও মূল সমস্যা অধরাই রয়ে গেল। কেবল স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনার মধ্য দিয়েই যে সে দায় মুক্ত হওয়া যায় না—তা বুঝে উঠতেই এতগুলো বছর কেটে গেল আমাদের। রাজনীতির তক্তা বদলের সঙ্গে সঙ্গে আশঙ্কাও বেড়েছে এই ভেবে যে, এবার আবার নতুন করে ঘাঁটাঘাঁটির পর্ব শুরু হবে।
জাতীয় স্বাক্ষরতা মিশনের পরিকল্পনায় সর্বশিক্ষা অভিযান প্রকল্পের কথাই ধরা যাক। অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে, অনেক অনেক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের আশাবাণী শুনিয়েই এক সময় শুরু হয়েছিল মাঠ-ঘাট তোলপাড় করা এই প্রকল্পের কাজ। নির্দিষ্ট সময়সীমা পার হবার পর, যখন প্রচারের জোয়ার থিতিয়ে এল। তখন দেখা গেল, কাজের কাজ কিছুই হয়নি। ভগ্নপ্রায় স্কুলবাড়ি মেরামত হলো, দেওয়ালে দেওয়ালে রংচঙে প্রচারচিত্র এঁকে বা চোঙা ফুঁকে প্রকল্পের সার্থকতা শুনিয়েই ব্যয়বরাদ্দের টাকা শেষ হলো। সরকারি-শকটে চেপে শাহী মেজাজে এ কেন্দ্র সে কেন্দ্র ঘোরাঘুরি করেই আধিকারিকরা ভেবে নিলেন, ‘কেল্লা ফতে’! অথচ তখনও দিল্লি বেশ দূরেই।
শিক্ষা যেহেতু সংবিধানের যুগ্ম তালিকাভুক্ত বিষয় সেহেতু কেন্দ্রীয় সরকারের পাশাপাশি রাজ্য সরকারগুলিও বিষয়টি নিয়ে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার পথে হেঁটেছে নানা সময়ে। এমনই এক প্রয়াস হিসাবে ১৯৮১ সালের তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার প্রাথমিক স্তরে ইংরেজি পড়ানো বন্ধ করে দেয় এই যুক্তিতে যে, একেবারে প্রাথমিক স্তরের পঠন পাঠনের কাজ মাতৃভাষার মাধ্যমে হওয়াই বাঞ্ছনীয়। খুবই সাধু প্রস্তাব সন্দেহ নেই। এই সময়েও শিক্ষা-ভাবুকরা এমন কথাই বলছেন, যার ফলে প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের কাছে শিক্ষা আরও সহজ ও মনোগ্রাহী হয়। কিন্তু সেক্ষেত্রে নিজের মাতৃভাষাকেও যে আরও উপযুক্ত করে গড়েপিটে নিতে হয়। সে কাজটা হলো কই?
প্রবল আন্দোলন, গণ-বিরূপতার সামনে পড়ে সরকার যখন তার পূর্ববর্তী সিদ্ধান্ত বাতিল করল; তখন দেখা গেল, অভিভাবক সমাজের একটা বড় অংশ; বিশেষ করে শহর ও শহরতলি অঞ্চলের অভিভাবকরা সরকার-পোষিত মাতৃভাষা তথা বাংলা মাধ্যমের বিদ্যালয়গুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এই বিমুখতাজনিত শূন্যতাকে কাজে লাগিয়ে রাতারাতি বর্ষার জল পাওয়া আগাছার মতো গজিয়ে উঠল টিং টং, ডিং ডং, টাইনি টক-এর ন্যায় ভুঁইফোঁড় শিক্ষা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো। ততদিনে সরকারের পায়ের তলার মাটি অনেকটাই নরম হয়ে গিয়েছে; অপ্রতিদ্বন্দ্বী সরকারি দল অবক্ষয়ের শিকার হয়ে আস্ফালন সর্বস্ব হয়ে উঠেছে। ফলে সর্বনাশ যা হবার তা হয়ে গেছে।
‘লার্নিং’ আর ‘নলেজ’ কখনই এক নয়। যদিও বাহ্যত তাদের মধ্যে একান্ত সম্পর্ক রয়েছে। ভোটব্যাংক হারানোর ভয়ে বিষয় ফিরে এল হয়তো কিন্তু বিশ্বাস ফিরে এল কি? পথে সবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গেলেও—ভাবনার ক্ষেত্রটাকেও যে কিছুটা বদলে ফেলতে হয়—সে-কথা আমরা সেভাবে উপলব্ধিই করিনি। বরং স্বকীয়তার সৌরভ ছড়িয়ে যে প্রতিষ্ঠানগুলো স্বকীয়তায় উজ্জ্বল ছিল, তাদেরও সিদ্ধান্তের জোর খাটিয়ে গড়পড়তা করে দেওয়া হলো। একে নৈরাজ্য বললে, তাকে কি খুব অন্যায় বলা হবে?
ইদানীং সেই গণদাবির কথা স্মরণে রেখে, সরকার-পোষিত বিদ্যালয়ে ‘ডবল ভার্সান’ পাঠ-সঞ্চালনার কথা বলা হচ্ছে। বাছাই করা বিদ্যালয়গুলোতে ইংরেজি মাধ্যমের শাখা খোলা হয়েছে। কিন্তু শিক্ষার মৌলিক সমস্যার সুরাহা এভাবে যে হওয়ার নয় এমনটা আমরা বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারছি। উপরন্তু আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাপনা থেকে ‘বিশ্বাস’ নামীয় অতুলনীয় মূলধনটি কালক্রমে বেমালুম উবে গিয়েছে, ফলে সেখানে ভবিষ্যতের স্বপ্ন মাথা কুটে হাহুতাশ করে।
পুঁজির পরাক্রম যে অপ্রতিরোধ্য একালের শিক্ষাব্যবস্থা হয়তো বা তার বড় প্রমাণ। সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যয়বরাদ্দ বাড়াবে না। গালভরা প্রতিশ্রুতি আর স্বপ্নকল্প ঘোষণায় মনোরঞ্জনের ব্যাপক ব্যবস্থা করা হলেও যথার্থ সাধনের অভাব থেকেই যাবে। অসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাড়বৃদ্ধি সরকার-পোষিত ব্যবস্থাপনাকে চূড়ান্ত অর্থহীন ও অকাজের বলে প্রতিপন্ন করেছে। সাম্প্রতিক অতিমারি পরিস্থিতির সুযোগকে কাজে লাগিয়ে শিক্ষা প্রযুক্তির প্রসার বেড়েছে। অনলাইন-ব্যবস্থা নির্ভর শিখন-শিক্ষণ কার্যকলাপে ক্রমশ অভ্যস্ত করে তোলা হয়েছে শিক্ষার্থীদের। এই শিক্ষাব্যবস্থা আগামী দিনে, আগামী প্রজন্মের শিক্ষার্থীর মানসিক বিকাশ ও স্বাধীন চিন্তার ক্ষমতাকে কতদূর প্রভাবিত করবে তা অবশ্য গবেষকের গবেষণার বিষয়।
বেশ কিছুকাল আগে, মার্কিনি এক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জোডি ডিন ডিজিটাল ব্যবস্থাপনার এই আগ্রাসন প্রসঙ্গে, ‘কমিউনিকেটিভ ক্যাপিটালিজ্ম’-এর বিপদ সম্পর্কে আমাদের সতর্ক করার চেষ্টা করেছিলেন। ডিজিটাল ব্যবস্থা পুঁজিবাদের পরিপুষ্টিতে সাহায্য করে। তাঁর এই ভবিষ্যদ্বাণীর যাথার্থ্যতা প্রমাণ করে, বিপুল সংখ্যক আইএসও-অ্যান্ড্রয়েড ও কম্পিউটার অ্যাপলিকেশনের উপস্থিতি। বিশ্বায়নের ফলে হাট করে খোলা দরজা দিয়ে অবাধে ঢুকেছে নানা কিসিমের পশরা। আমরা, ক্রেতা-সাধারণ হামলে পড়েছি বিকিকিনির আসরে।
বর্তমান বা তার কিছু আগের প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা ছোটবেলা থেকেই এমন বাজারি ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সড়গড় হয়ে উঠেছে ও উঠছে। অভিভাবকরাও এতেই তাদের সন্তানদের সুরক্ষিত জীবনের সুলুকসন্ধান করছেন। আমরা সবাই প্রায় তাই করি, করতে বাধ্য হই। এমনিতেই নানা বৈষম্যের ভারে দীর্ণ আমাদের সমাজ। বস্তুত ‘শিক্ষা’ নামীয় উপকরণের হাত ধরে ‘হ্যাভ্স’ আর ‘হ্যাভ নট্স’দের ব্যবধান আরও বাড়বে, সমাজে ও শিক্ষাকেন্দ্রে নৈরাজ্যও। এ আশঙ্কা কি খুব অমূলক?
প্রচ্ছদচিত্র ও অন্য ছবি সৌজন্য: www.needpix.com