মানুষ মাত্রই সৌন্দর্যপ্রিয়। কখনও আমরা ফুলের গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে এক ধরনের সৌন্দর্য উপভোগ করি, কখনও আবার কালবৈশাখীর তাণ্ডবের মধ্যে সৌন্দর্যকে খুঁজে পাই। এভাবে বিভিন্ন বস্তু বা দৃশ্যের সংস্পর্শে এসে আমাদের সৌন্দর্যবোধ ধরা পড়ে। এটি হচ্ছে নান্দনিকতা, মানুষের শিল্পীসত্তা; এ গুণ সমস্ত মানুষের মধ্যেই বিদ্যমান। কারো কম কারো বেশি। মানুষের এই শিল্পী-মন প্রকাশিত হয় নাটক, কাব্য, নৃত্য, গীত ও চিত্র প্রভৃতি শিল্পমাধ্যমে। নাটকাদি অনুশীলনের দ্বারা যেমন তার শিল্পীসত্তা প্রকাশিত হয়। ঠিক তেমনি নাটকাদির রসগ্রহণের দ্বারাও তার একই সত্তা প্রকাশিত হয়ে থাকে।

সুপ্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে, নাটক-কাব্য-নৃত্য-গীত প্রভৃতি শিল্পের বিশদ আলোচনা পাওয়া যায়। কাব্যাদির মতো চিত্রেরও শিল্প হিসেবে সমান গুরুত্ব লক্ষ্য করা যায়। সংস্কৃত সাহিত্যের বিভিন্ন জায়গায় চিত্রের বৈশিষ্ট্য, চিত্রের অঙ্কন প্রণালী, চিত্রের রসবোধ ইত্যাদি বিষয়ে অনেক আলোচনা রয়েছে। এ লেখার প্রথম ভাগে সেই সমস্ত আলোচনার কতকগুলো প্রধান দিকের উল্লেখ করে চিত্রশিল্পের একটি রূপরেখা টানার চেষ্টা আমরা করব। সংস্কৃত কাব্য নাটকাদিতে চিত্র সম্পর্কে যত আলোচনা দেখি, সংস্কৃত অলংকার শাস্ত্রে এ শিল্প সম্পর্কে ততটা আলোচনা নেই। কোনো কোনো জায়গায় সরাসরি চিত্রের কথা নেই, অথচ এমন কিছু তত্ত্বের সন্ধান আমরা পাই যা শিল্প সম্পর্কে শাশ্বত। যে-কোনো কালে যে-কোনো শিল্পের ক্ষেত্রে ওই তত্ত্ব প্রযোজ্য। মুখ্যত আলংকারিকগণ তত্ত্বগুলোকে কাব্যের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বলে মনে করলেও, তা অন্য শিল্পের ক্ষেত্রেও সমান ভাবে প্রয়োগ করা যেতে পারে বলে আমার ধারণা। এই ধারণাকে ব্যক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে দ্বিতীয় পর্যায়ে। তৃতীয় পর্যায়ে চিত্রশিল্প সম্পর্কে সমগ্র আলোচনার একটি মূল্যায়নের চেষ্টা করা হয়েছে। প্রাচীন তত্ত্বকারের সঙ্গে কিছু কিছু জায়গায় মত পার্থক্যের কথাও উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছে।

‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম’ নাটকে কালিদাস আমাদের চিত্রশিল্পের এক বিশেষ দিক সম্পর্কে ইঙ্গিত দিয়েছেন। সেখানে বলা হয়েছে—

যওৎ সাধু ন চিত্রে স্যাৎ ক্ৰিয়তে তওদন্যথা।
তথাপি তস্যাঃ লাবণ্যং রেখয়া কিঞ্চিদন্বিতম‌্।’[১]

অর্থাৎ একটি চিত্রে শুধুমাত্র প্রকৃতির অনুকরণই থাকে না বরং প্রকৃতির মধ্যে যে অপূর্ণতা থাকে তা দূর করে চিত্রকে উপস্থাপিত করা উচিত। কালিদাস দুষ্যন্তের মুখজবানীতে এ শাশ্বত চিত্রটি তুলে ধরেছেন। তিনি দুষ্যন্তকে চিত্রশিল্পী ও সমালোচক উভয়রূপেই অঙ্কন করেছেন। শকুন্তলাকে প্রত্যাখ্যান করার পর যখন তিনি বিরহানলে দগ্ধ হচ্ছিলেন, তখন তাঁর সেই দহন দূরীকরণের জন্য তিনি তাঁর মনের মধ্যে নিহিত শকুন্তলার চিত্র অঙ্কন করলেন এবং শেষে তাঁর স্বাঙ্কিত চিত্র সম্পর্কে উক্ত মন্তব্য করেন।

তাঁর মতে: সাধারণভাবে চিত্রশিল্পীর কাজ হচ্ছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে যা কিছু অপূর্ণতা রয়েছে তা দূর করা। বর্তমান শকুন্তলার চিত্রে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যর কোনোরকম অপূর্ণতা তো নেই-ই, উপরন্তু সেখানে এত বেশি সৌন্দর্য রয়েছে যে চিত্র সেই রূপের অংশবিশেষকে অনুকরণ করেছে।

চিত্র সম্পর্কে উক্ত মন্তব্যের মাধ্যমে যে তত্ত্ব পেলাম তা হলো: চিত্র যেমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ণতাকে দূর করতে সক্ষম তেমনি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে পুরোপুরি উপস্থাপন করতেও সক্ষম নয়। কাজেই বাৎস্যায়ন তাঁর কামসূত্রে যে বলেছেন—নাটকাদি শিল্পসমূহ আর কিছুই নয় স্বর্গ, মর্ত্য বা পাতালবাসীদের আচরণের অনুকরণমাত্র; তা কিন্তু কালিদাস স্বীকার করছেন না।[২] অনুরূপভাবে বলা যায়, কালিদাস পুরোপুরি অনুকরণ-তত্ত্বেরও বিরোধী। কাজেই অ্যারিস্ততল যে বলেছেন, ‘আর্ট ইজ মেড অব‌্ লিমিটেশন’—তাও একই যুক্তিতে তিনি গ্রহণ করছেন না।

পুরোপুরি অনুকরণ চিত্রে না থাকলেও তা যেন অবাস্তব না হয়—এ কথাও তিনি আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। এই বাস্তবতার খাতিরেই তিনি অনুকরণ-বাহুল্যের কথা বা অনুকরণ সীমার কথা বারবার বলেছেন। ‘বাস্তব’ বলতে এখানে বলা হয়েছে, চিত্রটি যেন মানুষের কাছে জীবন্ত বলে প্রতিভাত হয়। ‘রঘুবংশ’য় একটি চিত্রের উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়, যেখানে দেখানো হয়েছে—একটি দামভর্তি পুকুরে এক হস্তী সবৎস স্নান করছে। বিচরণরত একটি সিংহ তাকে যথার্থ মনে করে চিত্রাঙ্কিত হস্তীটিকে আঘাত করল।[৩]— এখানেই রয়েছে চিত্রের বাস্তবতা এবং সেখানেই রয়েছে শিল্পীর কৃতিত্ব। ‘সুভাষিত’ গ্রন্থেও এ মতের সমর্থন লক্ষ করা যায়। সেখানে বলা হয়েছে যে, একটি পাখি যাকে প্রাসাদের চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দি করে রাখা হয়েছিল, সে প্রাসাদের মধ্যে সমস্ত চিত্রার্পিত মানুষদের যথার্থ মানুষ মনে করে নানারকম কথা বলছে।

রাজন‌্, রাজসুতা ন পাঠয়তি মাং দেব্যোহপিতুষ্ণীং স্থিতাঃ।
কুব‌্জ ভোজয় মাম্ কুমার সচির্বনাদ্যাপি কিং ভুজ্যতে।।
ইস্বং নাম শুকস্তবারিভবনে মুক্তোহ ধ্বগৈঃ পঞ্জরাৎ।
চিত্রস্থানম বলোক্য শূণ্যবলভাবে ক ম ভাষতে ৷।

পাখিটিকে বলতে শোনা যাচ্ছে—’হে রাজন, রাজকন্যা আমাকে কথা বলতে শেখায় না, রানিগণ আমাকে অবজ্ঞা করে।’ ‘হে কুব‌্জ, আমাকে এখন ভোজন করাও।’ ‘হে রাজপুত্র তোমার খাওয়ার সময় থাকতেও কেন সচিবদের নিয়ে ভোজন করছ না।’—এভাবে শূন্য প্রাসাদে চিত্রার্পিত প্রতিটি ব্যক্তিকে উদ্দেশ করে বিভিন্ন কথা সে বলে চলেছিল। এ থেকেই বোঝা যায় যে, চিত্রে অনুকরণ এত বেশি সজীব বলে প্রতিভাত হত যে, পশুপক্ষীরাও তাকে প্রাকৃতিক মনে করে স্বাভাবিক আচরণ করত।[৪]

‘বিষ্ণুধর্মোত্তর পুরাণ’-এ চিত্রের একটি বিশেষ দিকের উল্লেখ করা হয়েছে। সাধারণত কতগুলো জিনিস চিত্রে তুলে ধরা শক্ত। সেই সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম জিনিসগুলো যিনি চিত্রে সম্যকভাবে তুলে ধরতে পারেন তিনিই যথার্থ শিল্পী। যদি কোনো ব্যক্তি চিত্রে ভেদ: প্রভাবিশিষ্ট অগ্নি, ধূম, মেঘ, মৃত মানুষ ও ঘুমন্ত মানুষের পার্থক্য, নিম্ন ও উন্নত স্থানের পার্থক্য প্রভৃতি পরিস্ফুট করতে পারেন তিনিই যথার্থ শিল্পী। অন্যভাবেও এ কথা বলা হয়েছে—একটি জীবন্ত ছবি দেখে, যেন সকলের মনে হয়—লাবণ্য যেন সমস্ত অঙ্গে খেলে বেড়াচ্ছে, চিত্রার্পিত ব্যক্তি যেন প্রাণ চাঞ্চল্যে ভরপুর হয়ে চিত্রে শ্বাস ফেলছে।[৫] সেখানে আরও বলা হয়েছে যে, চিত্রের মধ্যে রেখা, রং, বাহ্যভূষণ প্রভৃতির মধ্যে এমন এক সামঞ্জস্য থাকা দরকার যাতে বিভিন্ন দিক দিয়ে চিত্রটিকে বিভিন্ন জন দেখলেও—তা সকলের কাছে সমান ভাবে সুন্দর বলে প্রতিভাত হয়। কেননা একটি সুন্দর চিত্রের বিভিন্ন দিক বিভিন্ন জনের কাছে প্রশংসনীয় হতে পারে। একজন যেমন সেই চিত্রের রেখার প্রশংসা করতে পারেন; একজন বিচক্ষণ ব্যক্তি যেমন সেই চিত্রের ভাবের প্রশংসা করতে পারেন; তেমনি কোনো স্ত্রীলোক চিত্রে প্রদর্শিত বাহ্যিক ভূষণ পছন্দ করেন এবং বাকি সকলে রঙয়ের উজ্জ্বলতা পছন্দ করেন।[৬]

অন্য শিল্পের মতো চিত্রশিল্পের মধ্যেও রস ও ভাবের প্রাধান্য রয়েছে। রস ও ভাবকে চিত্রশিল্পের প্রাণ ও আত্মা বলে অভিহিত করা হয়। বাৎসায়ণের কামসূত্রের ‘জয়মঙ্গলটীকা’-তে তাই চিত্রের মধ্যে ছ’টি অঙ্গের কথা স্বীকার করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে—

রূপভেদাঃ প্রমাণানি লাবণ্যং ভাবযোজনম্।
সাদৃশ্যং বর্তিকা ভঙ্গ ইতি চিত্ৰং ষড়ঙ্গকম্ ॥[৭]

চিত্রে যে ছ‘টি অঙ্গের কথা বলা হয়েছে সেগুলি হলো: রূপভেদ, প্রমাণ, লাবণ্য, ভাবযোজন, সাদৃশ্য ও বর্তিকাভঙ্গ। যে-কোনো চিত্রের প্রথম অবলম্বন—রূপ। যার দ্বারা কোনো চিত্রের আরম্ভ। এই রূপ আবার অনেক, কাজেই রূপের মধ্যে ভেদ হেতু বৈষম্য। যেখানে বৈষম্য সেখানেই অনাসৃষ্টি, কাজেই বৈষম্য রোধের জন্য রূপের সীমারেখা টানা দরকার। এই রূপের সীমারেখাকে বলা হয়েছে—’প্রমাণ’। অর্থাৎ প্রকৃষ্ট মান। মা-ধাতুর অর্থ পরিমাপ করা। যেখানে প্রকৃষ্টভাবে পরিমিত অবস্থা বিদ্যমান সেখানেই রয়েছে সুষমা। তাই যেখানে রূপভেদ রয়েছে সেখানে সামঞ্জস্য আনার জন্য সীমারেখাও টানা দরকার।

রবীন্দ্রনাথের ভাষায়—

ভেদ নহিলে মিল হয় না এই জন্যই ভেদ, ভেদের জন্য ভেদ নহে। সীমা নহিলে সুন্দর হয় না এই জন্যই সীমা; নহিলে আপনাতে সীমার সার্থকতা নেই—ছবিতে এই কথাটাই জানাইতে হইবে। রূপটাকে তার পরিমাণে দাঁড় করানো চাই। কেননা আপনার সত্য মাপে যে চলিল অর্থাৎ চারিদিকে মাপের সঙ্গে যার খাপ খাইল সেই হইল সুন্দর। প্রমাণ মানে না যে রূপ সেই কুরূপ, তাহা সমগ্রের বিরোধী।[৮]

‘ভাবলাবণ্য সংযোজনম‌্’—এ কথার দ্বারা ছবির বহিরঙ্গের মতো অন্তরঙ্গসুষমার কথা বলা হয়েছে। যে চিত্রটি চিত্রিত হয়েছে, তাতে মনের ভাব ও লাবণ্য যোগ করতে হবে তবেই তা হবে জীবন্ত। রূপ ও প্রমাণের দ্বারা চিত্রের কাঠামো রচিত হয়—সেই কাঠামোকে প্রাণরসে সঞ্জীবিত কোরে তোলে ভাব ও লাবণ্য। বাহ্যজগতে যেমন রূপের ভেদ রয়েছে তেমনি অন্তর্জগতে ভাবের ভেদ রয়েছে। বাহ্যরূপ-ভেদের মধ্যে যেমন সামঞ্জস্য বিধান প্রয়োজন তেমনি ভাব-ভেদের সামঞ্জস্যেরও বিধান প্রয়োজন। যদি ভাবের সামঞ্জস্য না থাকে বা ভাবের ভেদই প্রকট হয়ে ওঠে তাহলে তা বীভৎস হয়ে উঠে। তা নিয়ে কখনও সৃষ্টি হয় না, প্রলয়ই হয়। ভাব যখন আপনার চারিদিককে মানে, বিশ্বকে মানে—তখনই তা মধুর। রূপের ওজন যেমন তার ‘প্রমাণ’ ভাবের ওজন তেমনি তার ‘লাবণ্য’।

ষড়ঙ্গের পরবর্তী অঙ্গ হিসাবে ‘সাদৃশ্য’র কথা বলা হয়েছে, কীসের সঙ্গে বা কার সঙ্গে সাদৃশ্য? রূপের সঙ্গে রূপের সাদৃশ্য এবং ভাবের সঙ্গে রূপের সাদৃশ্য। যে ভাব চিত্রে পরিস্ফুট করতে চাই তার সঙ্গে রূপের যেন বৈসাদৃশ্য না থাকে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়—’এমনি করিয়া রূপের ভেদ প্রমাণে বাঁধা পড়িল, ভাবের বেগ লাবণ্যে সংযত হইল, ভাবের সঙ্গে রূপের সাদৃশ্য পটের উপর সুসম্পর্ক হইয়া ভিতর-বাহিরে পুরোপুরি মিল হইয়া গেল।’[৯]

সর্বশেষে—বর্তিকাভঙ্গ। যেখানে চিত্রে রঙের ভূমিকার কথা বলা হয়েছে। রং সব সময় রেখা ও অ-রেখার মধ্যে সংযোগকারী সেতু। সীমিত রেখার দ্বারা চিত্র কখনও সম্পূর্ণ হয় না। অধিকাংশ জায়গা থাকে অ-রেখার আওতায়। রঙের কাজ উভয়ের মধ্যে সংযোগ সৃষ্টি করে চিত্র সৃষ্টিতে সাহায্য করা। রেখার দ্বারা সীমারেখা টানা যায়—কাজেই রেখা সীমিত। অ-রেখার ব্যাপ্তি অসীম, কাজেই সসীম ও অসীমের মধ্যে সংযোগ দরকার যা রঙের সাহায্যেই সম্ভব।

‘চিত্র’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হচ্ছে—চীয়তে ইতি চিত্রম‌্। চিত্রকর চয়ন করেন, বহির্জগৎ অন্তর্জগৎ—উভয়ের ভাব চয়ন করেন। লাবণ্য চয়ন করেন, রূপ, প্রমাণ, সাদৃশ্য, বর্তিকাভঙ্গ চয়ন করেন। এই চয়ন কার্য বা চয়নের সমষ্টিকে কেবলমাত্র চিত্র বলা যায় না।

ফুল বাছিয়া সাজি ভরানো মালীর বাহাদুরী, কিন্তু সেই বাহাদুরীটুকু তো চিত্রের সব নয়। পাঁচটা সংগ্রহ একত্র করিয়া প্রকাশ করিলে এনসাইক্লোপেডিয়া বা বিশ্বকোষ প্রস্তুত হয়, চিত্র তো হয় না। কাজেই বলতে হয় যে, চিত্রকরের চয়নের স্বাভাবিক পরিণতি যে চিত্তহরণ অকৃত্রিম ষড়ঙ্গমালা তাহাই চিত্র।[১০]

‘পঞ্চদশী’-র চিত্রদ্বীপ প্রকরণে বিদ্যারণ্য মুনি চিত্রপটের অবস্থা চতুষ্টয়ের বিবরণ দ্বারা ব্রহ্মের স্বরূপ ও ব্রহ্মাণ্ডের স্বরূপ এবং রহস্য নির্ণয় করছেন। এখানে তিনি চিত্রকে কোনো কিছু বোঝাবার জন্য মেটাফর বা উপমা হিসেবে ব্যবহার করেছেন। চিত্রের যেমন চারটি অবস্থা বিদ্যমান ঠিক তেমনি—পরমাত্মারও চিত, অন্তর্যামী, সূত্রাত্মা ও বিরাট‌্—এ চার অবস্থা বিদ্যমান।[১১] এখানে চিত্র সম্পর্কে যা বলা হয়েছে, তাতে তৎকালীন চিত্রকলা সম্পর্কে কিছু ইঙ্গিত আমরা পাই।

চিত্রের চারটি অবস্থা হচ্ছে—ধৌত, ঘট্টিত, লাঞ্ছিত এবং রঞ্জিত। যখন শুভ্রবর্ণ পট (যার উপর চিত্র অঙ্কিত হয়) আমাদের সম্মুখে বর্তমান থাকে তখন তাকে বলা হয় ‘ধৌত’ অবস্থা। যখন তার উপর প্রলেপ দেওয়া হয় তাকে অঙ্কনোপযোগী করার জন্য তখনকার অবস্থাকে বলা হয়—ঘট্টিত। কালো পেনসিলের সাহায্যে যখন চিত্রের বহির্ভাগ বা রেখাচিত্র অঙ্কিত হয় তখন তাকে বলে—লাঞ্ছিত। সেই চিত্র পূর্ণাঙ্গ রূপ পায় যখন—সেখানে যথোপযুক্ত রঙের সন্নিবেশ ঘটে।[১২] তাছাড়া, আরও বলা হয়েছে যে, চিত্রপট দু-ধরনের হতে পারে—উন্নত এবং অনুন্নত। উভয়ক্ষেত্রেই মানুষকে অঙ্কিত করা যেতে পারে। সেই মানুষ বিচিত্র কাপড় পরিহিত অবস্থায় অঙ্কিত হয় বা হতে পারে এবং সেই পোশাকগুলি এমন নিখুঁত ভাবে অঙ্কিত হয় যে, মনে হয় সমস্ত কিছুই (মানুষ ও পোশাক) সত্য।[১৩]

যদিও সমস্ত বর্ণনা ব্রহ্মের ও ব্রহ্মাণ্ডের বিভিন্ন বর্ণনা প্রসঙ্গে উত্থাপিত, তবুও এ বর্ণনা চিত্রশিল্পের বিরাট এক দিকের ইঙ্গিত দেয়, চিত্রকলা আমাদের দেশে কেবল শখের বিনোদন ছিল না, বরং আমাদের জ্ঞানের ও কাজের সঙ্গে তার নিগূঢ় সম্বন্ধ ছিল।

প্রাচীন ভারতবর্ষে চিত্রকলাকে তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে—বিদ্ধ, অবিদ্ধ ও রসচিত্র। বিদ্ধ চিত্রের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে—’সাদৃশ্যং লিখ্যতে যতু দর্পণে প্রতিবিম্ববৎ’, অর্থাৎ আয়নার প্রতিবিম্বের মতো কোনো চিত্র যদি বাস্তবের প্রতিফলন মাত্র হয় তাহলে তা বিদ্ধ। যখন কোনো চিত্রে কল্পনার ভাব বেশি থাকে তাকে বলা হয়—অবিদ্ধ।[১৪] আবার এমন কিছু চিত্র আছে যা দেখা মাত্রই মানুষের মনের মধ্যে শৃঙ্গারাদিরসের অনুভূতি জাগে, তাকে বলা হয়—রসচিত্র।[১৫]

যে-কোনো চিত্র সে বিদ্ধ, অবিদ্ধ বা রসচিত্র যাই হোক না কেন তা অঙ্কনের কারিগরি দিকেরও ইঙ্গিত আমরা সংস্কৃত ভাষায় রচিত বিভিন্ন গ্রন্থে পাই। ‘বিষ্ণুধর্মোত্তর পুরাণ’ ও ‘শিল্পরত্ন’-য় আমরা দেখতে পাই যে, চিত্র অঙ্কন করা হয় যার উপর সেই ভূমির নানারকম বর্ণনা আছে। সে যুগে কাঠের বোর্ড, পট, চওড়া পাথর ও বাড়ির দেওয়ালকে চিত্রাঙ্কনের ভূমি হিসেবে ব্যবহার করা হত। এ সমস্ত জায়গাগুলোকে চিত্রাঙ্কনোপযোগী করার জন্য চুনের প্রলেপ (যাকে সংস্কৃত ভাষায় ‘সুধা’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে) দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এই ভিত্তি তৈরি করাকে বলা হয়—ভূমিবন্ধ। লেপনের প্রস্তুতিকে বলা হয়—লেপ্যকর্ম।[১৬] বিভিন্ন ধরনের তুলির কথা বলা হয়েছে, যেমন: তুলিকা, বিহেলিকা, লেখানী প্রভৃতি এবং তাদের তৈরি করার নিয়মকানুনও যথোপযুক্ত রূপে উল্লিখিত হয়েছে।

রং করার জন্য যে সমস্ত জিনিস ব্যবহার করা হয় তার উপর নির্ভর করে চিত্রটি ‘রসচিত্র’ হবে না ‘ধূলী’। এখানে ‘রসচিত্র’ কথাটিকে একটু সংকীর্ণ অর্থে ব্যবহার করতে হবে। যখন কোনো চিত্র তরল রং দিয়ে অঙ্কিত হয় তখন তাকে বলা হয় রসচিত্র (যাকে আধুনিক পরিভাষায় ‘ওয়াটার কালার’ বলা হয়)। ‘অভিলষিতার্থ চিন্তামণিঃ’ গ্রন্থে বলা হয়েছে— ‘সাদ্রবৈবর্ণকৈলের্খ্যং রসচিত্র বিচক্ষণৈঃ’[১৭] অর্থাৎ চিত্রজ্ঞ পণ্ডিতগণ তরল রং দিয়ে অঙ্কিত ছবিকে ‘রসচিত্র’ বলে থাকেন। আবার যখন কোনো চিত্র শুকনো রঙের দ্বারা অঙ্কিত হয় তখন তাকে বলা হয় ‘ধূলীচিত্র’ যা ক্ষণিক বা তাৎক্ষণিক বলে অভিহিত।[১৮]

বানভট্টের ‘হর্ষচরিত ও কাদম্বরী’ থেকে জানা যায় যে, চিত্ররচনা তৎকালীন যুগে মহিলাদের অবসর বিনোদনের একটি উপায় ছিল। সেখানে বলা হয়েছে—শুভ্র পটের উপর যখন সুন্দরী ললনাগণ লতা, ফুল প্রভৃতি আঁকতেন তখন তাঁদের হস্তাঙ্গুলী বহুবিধ রঙের দ্বারা রঞ্জিত থাকত।[১৯]

চিত্রের রং সম্পর্কে আমরা দণ্ডীর ‘দশকুমারচরিত’-এ কিছু বর্ণনা পাই। তিনি বলেছেন, রঙের জন্য দরকার—নির্যাস কল‌্ক। নির্যাস হচ্ছে কোনো বিশেষ গাছের আঠা এবং কল‌্ক হচ্ছে বিভিন্ন গাছ থেকে তৈরি এক ধরনের মণ্ড বিশেষ। এই উভয়ের সংমিশ্রণে রং তৈরি করা হত। সেই রং যাতে আরও বেশি দীর্ঘস্থায়ী হয় সে জন্যে সেখানে ‘বজ্রলেপ’ নামক অপর এক পদার্থের সংমিশ্রণের কথাও পরিলক্ষিত হয়।[২০] কালিদাসও বলেছেন, নতুন অবস্থায় ছবির রং খুব সুন্দর থাকে। দীর্ঘদিন এই সৌন্দর্যকে ধরে রাখার জন্য শিল্পীরা চেষ্টা করতেন। তাই তাঁরা নানারকম প্রক্রিয়া অবলম্বন করতেন।[২১]

২.

আলংকারিকগণ চিত্রকলা সম্পর্কে তাঁদের ধ্যান-ধারণার কথা প্রত্যক্ষভাবে খুব কমই বলেছেন। যদিও পরোক্ষভাবে চিত্রকলা সম্পর্কে প্রায় সকলেই বলেছেন। আচার্য বামন এক জায়গায় বলেছেন, যে অর্থ দু-প্রকার ‘অযোনি’ এবং ‘অন্যচ্ছায়াযোনি’; এবং তিন ভাগে ভাগ করেছেন ‘অন্যচ্ছায়াযোনি’-কে। প্রতিবিম্ববৎ, আলেখ্যপ্রখ্যবৎ এবং তুল্যদেহিবৎ। এখানে ‘আলেখ্যপ্রখ্যবৎ’ সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তা থেকে চিত্র সম্পর্কে কিছু ধারণা হতে পারে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, যে চিত্রকর যেমন চিত্রাঙ্কন করতে গিয়ে মূলের অবিকল অনুকরণ করেন না, কবিও ঠিক তেমনি অবিকল অনুকরণের বিরুদ্ধে। চিত্রাঙ্কন করতে গিয়ে মূলের অবিকল অনুকরণ করা হয় না। আবার মূল ও অনুকৃতির পার্থক্যও একেবারে লুপ্ত হয় না—চিত্রকরের কিছুটা স্বাতন্ত্র্যও রক্ষিত হয়। ‘তুল্যদেহিবৎ’ উল্লেখের মধ্যে আচার্য বামন বলতে চেয়েছেন, দুটি সুন্দর আকৃতির মধ্যে যেমন এক সাদৃশ্য অনুভূত হয় ঠিক তেমনি দুটি কাব্যের মধ্যেও সাদৃশ্য থাকতে পারে—তাতে রমণীয়তা ক্ষুণ্ণ হয় না। আনন্দবর্ধনও বলেছেন—সাদৃশ্য মাত্রই পরিহরণীয় নয়। একই মূলবস্তু কবির লেখনীর বিচিত্র রসে অভিষিক্ত হয়ে নব নব রূপ পরিগ্রহ করে—‘সর্বে নব্য ইব আভান্তি মধুমাসে ইব দ্রুমাঃ’। এই বক্তব্য চিত্রের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। একটি চিত্রের সঙ্গে অপর একটি চিত্রের সাদৃশ্য থাকতেই পারে, তা বলে তা পরিহরণীয় নয়। একই মূল বস্তু চিত্রকরের তুলির ছোঁয়ায় বিচিত্র রসে অভিষিক্ত হয়ে নব নব রূপ ধারণ করতে পারে।[২২] রীতিরাত্মা কাব্যস্য’ এ তত্ত্বের আলোচনা প্রসঙ্গেও বামন বলেছেন—

যথা বিচ্ছিদ্যতে রেখা চতুরং চিত্রপণ্ডিতৈঃ।
তথৈব বাগপি প্রাজ্ঞৈঃ সমস্তগুণগুম্ফিতা॥[২৩]

অর্থাৎ সুনিপুণ চিত্রশিল্পী যেমন রেখাকে ছবির আত্মা বলে উল্লেখ করেছেন, ঠিক তেমনি সমস্ত গুণ-সমন্বিত বাক্ বা রীতি কাব্যের আত্মা। ভরতের নাট্যশাস্ত্রে বর্ণের বিধি এবং প্রকৃতি সম্বন্ধে অনেক কথা বলা হয়েছে। যা চিত্রের বর্ণ বা রঙের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বর্ণের বিধি বলতে বুঝি কোনো বর্ণ আকৃতিকে গোপন করে, কোনো বর্ণ আকৃতিকে ফুটিয়ে তোলে ইত্যাদি নিয়ম। ভরতের মতে: কোনো বর্ণ আমাদের আনন্দিত করে, কোনো বর্ণ বিষাদিত করে, কোনো বর্ণ বৈরাগ্য জাগায় আবার কোনো বর্ণ অনুরাগ জাগায়।

বর্ণের এ-সমস্ত প্রকৃতি জানলেই তার প্রয়োগ সম্ভব হয়। বিভিন্ন রঙের উৎপত্তি কীভাবে সম্ভব তারও বর্ণনা এখানে দেওয়া হয়েছে। শুভ্র ও পীত বর্ণের সংমিশ্রণে পাণ্ডুবর্ণ, রক্ত ও শুভ্রবর্ণের মিলনে পামবর্ণ, নীল ও শুভ্রের মিলনে কপোতবর্ণ, পীত ও নীলের মিলনে হরিৎবর্ণ, রক্ত ও নীলের মিলনে কাষায় বর্ণ, পীত ও রক্ত বর্ণের মিশ্রণে গৌরবর্ণের উৎপত্তি হয়। মূল দু-তিনটি বর্ণের সংযোগে বহুতর উপবর্ণের সৃষ্টি হয়। এভাবে বর্ণ সম্পর্কে নানারকম তথ্যের সন্ধান আমরা পাই যা চিত্রশিল্পের ক্ষেত্রে অপরিহার্য।[২৪]

কেউ কেউ মনে করেন, পূর্বে চিত্রপটের দৃশ্য রঙ্গালয়েও ব্যবহৃত হত। তাঁরা বলেন, ভবভূতি-র ‘উত্তররামচরিত’-এ সীতাকে, লক্ষ্মণ তাদের পূর্বতন ভ্রমণ-পথের যে চিত্র প্রদর্শন করিয়েছিল তাতেই প্রমাণিত হয় যে সেকালে সচিত্র দৃশ্যও ছিল। এ বিষয়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সুচিন্তিত মতামত প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন যে,

এই যে চিত্র প্রদর্শিত হয়েছিল তা আখ্যানবস্তুরই অঙ্গীভূত। তা নাট্যদৃশ্যের অংশ হিসেবে প্রদর্শিত হয়নি। সেকালের চিত্রকলার অনেক নিদর্শন পাওয়া যায় বটে, কিন্তু দূরনৈকট্যসূচক পরিপ্রেক্ষিত চিত্রকলাপদ্ধতি জানা ছিল কিনা, কিম্বা প্রচলিত ছিল কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে। বাস্তবের কতকটা অনুকরণ করে দর্শকের চিত্তবিভ্রম উৎপাদন করাই অভিনয়ের মূল উদ্দেশ্য, কিন্তু যে দৃশ্যচিত্রে দূরনৈকট্যের কৌশল প্রকটিত না হয় তা বাস্তবিক বলে ভ্রম হবার কোন সম্ভাবনা নেই। এ জন্যই বোধ হয় তখনকার নাট্যাভিনয়ে সচিত্র দৃশ্যের ব্যবহার ছিল না।[২৫]

সে জন্য ভরতের নাট্যশাস্ত্রে এ ধরনের ব্যবহারের কোনো উল্লেখ নেই। আনন্দবর্ধন তাঁর বিখ্যাত অলংকারগ্রন্থ ‘ধ্বন্যালোকঃ’-এ কাব্য সম্পর্কে অনেক কথা বলেছেন। যদিও বক্তব্যটি কাব্য সৃজন প্রসঙ্গে উল্লিখিত তবুও এ বক্তব্যের ব্যাপ্তি অনেক বেশি। তিনি এক জায়গায় বলেছেন,

যদি কোন ব্যক্তির হৃদয় সৌন্দর্য রসসিক্ত না হয় তাহলে তিনি যতই শব্দার্থ বিজ্ঞানে সুপণ্ডিত হন না কেন কাব্যের যথাযথ অর্থ বুঝতে পারবেন না বা রসাস্বাদন করতে পারবেন না, যেমন একজন সঙ্গীতবিজ্ঞানে পারদর্শী অথচ সুগায়কোচিত রস জ্ঞানাভাব বিশিষ্ট ব্যক্তি সঙ্গীতের যথাযথ সুর ও তজ্জনিত আনন্দ অনুভব করতে পারেন না।[২৬]

এ পথ অনুসরণ করে আমরা বলতে পারি যে যদি কোনো ব্যক্তি চিত্রকলার ব্যাকরণ সম্পর্কে সুপণ্ডিত হন অথচ তাঁর মন যথোচিত রসসিক্ত নয় তাহলে তিনি কখনও চিত্রের রসাস্বাদন করতে পারেন না। কেননা অভিনবগুপ্তের ভাষায় শিল্প প্রতিভা সব সময়ই ‘রসাবেশবৈশদ্য নির্ম্মাণ ক্ষমত্বযুক্ত’। অর্থাৎ যে-কোনো ধরনের শিল্প সৃজন ক্ষমতা নির্ভর করে ব্যক্তি বিশেষের রসাবেশের উপর।[২৭]

চিত্রের ক্ষেত্রেও সেই রসাবেশ কাজ করে। ব্যাপারটিকে আর একটু বিশদ ভাবে বোঝার চেষ্টা করা দরকার। চিত্রশিল্পের এবং অন্যান্য শিল্পের সৃজন ক্ষমতা বা বোধগম্যতা নির্ভর করে মানুষের অনুভূতি, আবেগ প্রভৃতির উপর। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অনুভূতি আমাদের বিভিন্ন চিত্তবৃত্তিসমুদ্ভূত। একজন শিল্পী যখন তাঁর শিল্পে রূপদান করেন তখন সেই চিত্তবৃত্তির যথাযথ রূপায়ন বা কিঞ্চিৎ কল্পনাবিজড়িত রূপায়ন সম্ভব হয়। এ ধরনের চিত্তবৃত্তিকে আমরা ভাবনা বলেও উল্লেখ করতে পারি। যাঁরা এ ধরনের সংবেদনের অংশীদার হন এবং ইচ্ছাপূর্বক এ ধরনের চিত্তবৃত্তি বা ভাবনাগুলোকে বিশ্লেষণ করেন তাঁরাই শিল্পরসিক হতে পারেন। এই ভাবনাকে বিশ্লেষণ করার জন্য বা ভাবনাকে উদ্ভাবন করার জন্যও এক ধরনের সাধনা বা নিবিড় বস্তুসংযোগ দরকার। এ প্রসঙ্গে গীতার ‘ন চাযুক্তস্য ভাবনা’—এই শ্লোকাংশটি প্রণিধানযোগ্য।[২৮] তাই এই ভাবনা শিল্পী, অভিনেতা ও দর্শকদের মধ্যে পূর্বেই থাকা চাই। ঠিক একই নীতি অনুযায়ী বলা যায় শিল্পীর মন, চিত্রকলা এবং দর্শক—এ তিনের মধ্যে ভাবনা সাধারণ উপাদান হিসেবে থাকা চাই। অর্থাৎ এখানেও চিত্রশিপী, দর্শক, রং, তুলি ইত্যাদির মধ্যে একই ভাবনার প্রতিফলন থাকা দরকার। তাই বোধহয় অভিনবগুপ্ত সহৃদয়ত্বের উপর বেশি জোর দিয়েছেন। এ সহৃদয়ত্ব অর্থাৎ শিল্পী, শিল্পকার্য ও দর্শকের মধ্যে এক সমানহৃদয়ত্ব কাব্য সম্পর্কে প্রয়োগ করা হলেও তা সমস্ত শিল্পের ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য।[২৯]

অন্যান্য শিল্পের মতো চিত্রশিল্পের ক্ষেত্রেও এক ধরনের ‘অন্যোন্যাশ্রয়’ বা পরম্পরাশ্রয় আছে। ভাবনা ছাড়া শিল্পে কখনও রস আসতে পারে না, আবার রস ছাড়া ভাবনাও আসতে পারে না। ভরত বলেছেন, ‘ন ভাবো হীনোহস্তী রসঃ ন ভাবো রসবর্জিতঃ।[৩০] একজন মানুষের মধ্যে রস লুক্কায়িত অবস্থায় থাকে। যখনই সেই মানুষ কোনো বিষয়ের সংস্পর্শে আসে, তখন তার মনে ভাবের উৎপত্তি হয় এবং পরক্ষণে এই ভাবই জন্ম দেয় এক নতুন রসের যা তার মধ্যেই লুক্কায়িত ছিল। যেমন অগ্নি দ্রুত শুষ্ক কাষ্ঠে ছড়িয়ে পড়ে ঠিক তেমনি ভাববিশিষ্ট ব্যক্তিতে দ্রুত রস সঞ্চার হয়।

ভরত বলেছেন—

যোহর্থো হৃদয়সংবাদী তস্য ভাবো রসোদ‌্ভবঃ।
শরীরং ব্যস্প্যতে তেন শুষ্কং কাষ্ঠমিবাগ্নিনা৷।[৩১]

শিল্পে রস রয়েছে বলেই তা অতিজাগতিক এক নৈর্ব্যক্তিক আনন্দের সন্ধান দেয়। চিত্র দর্শনে যে আনন্দ—তা কোনো ব্যক্তির বাহ্য দৈনন্দিন কোনো স্বার্থ-সিদ্ধিতে সহায়ক নয়। তবুও তা মানুষকে এত মুগ্ধ করে যে, মানুষ সেই চিত্রাঙ্কিত বস্তুকে সত্য বলে মনে করে। কিছুক্ষণের জন্য দৈনন্দিন ব্যথা-বেদনা বিস্মৃত হয়ে এক অনৈসর্গিক আনন্দে নিজেকে নিয়োজিত রাখে। চিত্রে অর্পিত প্রাণ ব্যক্তির অহংবোধ সাময়িক ভাবে তিরোহিত হয়। ফলে তার মধ্যে অবস্থিত সত্ত্বগুণ প্রকাশিত হয়ে পড়ে। যার প্রভাবে শিল্পের সঙ্গে একাত্মতা এবং তজ্জনিত আনন্দ লাভ করা যায়—যা অভিনবগুপ্তের অভিপ্রায়।[৩২]

বেনেদেত্তো ক্রোচে-ও এ বক্তব্যের স্বপক্ষে মত প্রকাশ করেছেন।[৩৩] অর্থাৎ তিনিও চিত্রশিল্পের এ চিরন্তন সত্যটিকেই উপলব্ধি করেছেন। তিনি বলেছেন,

A man who absorbs the subject of a picture or poem does not have it before him as a series of impressions…he knows nothing as to what happened prior to having absorbed it… [.]

বলা বাহুল্য, অন্যান্য শিল্পের মতো চিত্রের ক্ষেত্রেও রস-প্রাধান্য মনীষীগণ স্বীকার করেছেন। আলংকারিক আনন্দবর্ধনের মতে শিল্পকর্মে রস সবসময় ব্যঞ্জিত হয়। কোনো শিল্প ব্যঞ্জনার দ্বারা রসকে সূচিত করে। যে সমস্ত উপাদান ব্যঞ্জনার দ্বারা আমাদের রস প্রাপ্তিতে সাহায্য করে তাদেরও যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। অর্থাৎ ব্যঞ্জনা যখন আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয় তখন বাচ্যবুদ্ধি (যা ব্যঞ্জনাময় অর্থলাভে সহায়ক) কখনও দূরীভূত হয় না।[৩৪] কোনো চিত্রের ব্যঞ্জনাময় অর্থ উপলদ্ধি করতে হলে, সেই চিত্রের প্রতিটি অংশের পূর্ণতার উপর বা সৌন্দর্যের উপর দৃষ্টি দিতে হবে, ঠিক যেমন কোনো নারীর পূর্ণ লাবণ্য নির্ভর করে তার প্রতি অঙ্গ সুষমার উপর।[৩৫] চিত্রের ক্ষেত্রে এ ধ্বনি বা ব্যঞ্জনা প্রয়োগের কথা ‘বিষ্ণুধর্মোত্তর পুরাণ’-এও দেখা যায়। সেখানে বলা হয়েছে যে, একজন দ্যুতাসক্তকে বোঝাবার জন্য মানুষকে চিত্রিত করা উচিত তার উত্তরীয়বিহীন অবস্থায়, আবার একটা বড় রাস্তাকে বোঝাবার জন্য চিত্রিত করা উচিত নানারকম দ্ৰব্যবহনকারী একদল উট ইত্যাদি।[৩৬] এ সমস্ত উদাহরণ থেকে বোঝা যায় ধ্বনির ভূমিকা চিত্রের ক্ষেত্রেও কোনো অংশে কম নয়।

৩.

প্রাচীন ভারতবর্ষ যে শিল্পচর্চা করা গিয়েছে—তার মূলে যা রয়েছে তা হলো: চিত্তৈকাগ্রতা বা যোগ বা সমবধান। প্রায় সমস্ত আলংকারিকগণ সমস্ত ধরনের শিল্পকে তথা চিত্রশিল্পকেও সম্যক যোগের ফলস্বরূপ বলে বর্ণনা করেছেন।

শিল্পের মাধ্যমে যে সৃষ্টি তা কখনই যোগ বা চিত্তের একাগ্রতা ছাড়া সম্ভব নয়। আলংকারিক বামন এ কথার উপর বারবার জোর দিয়েছেন। আনন্দবর্ধনও এ কথা প্রকাশ্যভাবেই বলেছেন যে, যদি কোনো শিল্পী মনে করেন যে, তিনি অন্যের অনুকরণ না করে স্বকীয় ক্ষমতার দ্বারা শিল্পজগতে কিছু সৃষ্টি করবেন এবং এ সংকল্প নিয়ে ওই বিষয়ে নিবিড় মনঃসংযোগ করেন তাহলে তিনি অবশ্যই সরস্বতীর কৃপায় সৃজনশালিনী প্রতিভা অর্জন করবেন।[৩৭] এখানে ‘সরস্বতীর কৃপা’ বলতে বোঝান হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি কোনো শিল্পকর্মে একান্তভাবে মনোনিবেশ করতে পারেন বা মনঃসংযোগ ঘটাতে পারেন তাহলে সেই যোগ-সমুদ্ভূত এক শক্তি তার মধ্যে জাগে যার দ্বারা শিল্প সৃজন সম্ভব হয়। এই প্রতিভার অন্য কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না বলেই তাকে ‘সরস্বতীর কৃপা’ বলে উল্লেখ করা হয়ে থাকে।

‘বিষ্ণুধর্মোত্তর পুরাণ’ ও ‘অভিনয়দর্পণ’-এ চিত্রশিল্পকে নৃত্যাদির পরে স্থান দেওয়া হয়েছে, এই স্থানাঙ্ক গ্রহণযোগ্য নয় বলেই মনে করি। ‘বিষ্ণুধর্মোত্তর পুরাণ’-এ বলা হয়েছে—’বিনা হি নৃত্যশাস্ত্ৰেণ চিত্রসূত্রং সুদূরবিদম‌্’[৩৮] অর্থাৎ নৃত্যশাস্ত্রের জ্ঞান ছাড়া চিত্রসূত্রের জ্ঞান জানা বা বোঝা কখনই সম্ভব নয়। নৃত্যের অঙ্গভঙ্গির সঙ্গে পরিচিত না হলে কখনই চিত্রের সূত্র জানা সম্ভব নয়। মানুষের মনের ভাব প্রথমে নৃত্যাকারে প্রকাশিত হয়, পরে সেই নৃত্যভঙ্গিকে আমরা ছবিতে স্থান দিই। নন্দিকেশ্বর তাঁর ‘অভিনয়দর্পণ’-এ সেই সঙ্গে এও বলেছেন, যাঁরা অভিনয়ের সঙ্গে পরিচিত নন তাঁরা কখনই নৃত্যভঙ্গির সঙ্গে পরিচিত হতে পারেন না। অভিনয়ই সম্ভবত নৃত্যশিল্পের উৎস, যদি একজন ব্যক্তি অভিনয় সম্পর্কে সজাগ হন তাহলে তিনিই একমাত্র সুদক্ষ চিত্রশিল্পী হতে পারেন। কেননা তিনি বিভিন্ন ভাবের সঙ্গে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গির সঙ্গে পরিচিত। চিত্রকে সার্থক করতে হলে, বিভিন্ন ধরনের শারীরিক ভঙ্গি বা মানসিক প্রতিক্রিয়াকে যথাযথভাবে ভাবানুযায়ী ব্যক্ত করার ক্ষমতা থাকা প্রয়োজন। অভিনয়ের জ্ঞান কেবলমাত্র ওই ভাব ও ভঙ্গিগুলিকে সুচারুভাবে প্রকাশ করতে শেখায় যা চিত্রে প্রতিবিম্বিত হয়।[৩৯]

একই কারণে ভরত বলেছেন—

ন তজ‌্ জ্ঞানং ন তবিছুল্পং ন সা বিদ্যান সা কলা।
ন ম যোগো ন তৎকর্ম নাট্যেহস্মিন‌্ যন্ন দৃশ্যতে॥ [৪০]

অর্থাৎ, এমন কোনো জ্ঞান, শিল্প, কলা, বিদ্যা বা কৰ্ম নেই যা নাটকে দৃষ্ট হয় না। এই উক্তির দ্বারা কেবল নাটকের তথা অভিনয়ের মহিমা সর্বাগ্রে তুলে ধরা হয়েছে। আমার মনে হয় উপরোক্ত মত গ্রহণযোগ্য নয়। তাঁরা যে সকলেই চিত্রের সার্থকতার জন্য অভিনয় জ্ঞানের অপরিহার্যতার উপর জোর দিয়েছেন তা বোধহয় গ্রহণযোগ্য নয়। অভিনয়কে চিত্র ও নৃত্যের উৎস বলাও সমীচীন নয়।

আমরা পূর্বে দেখানোর চেষ্টা করেছি যে, যে-কোনো শিল্প মানুষের ভাবের অভিব্যক্তি। সেই ভাবকে কীভাবে ব্যক্ত করব তা আমাদের মধ্যে অনেকটা স্বতঃস্ফূর্ত। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বহু ঘটনা ঘটে, যা প্রকাশ করার জন্য কোনোরকম কষ্ট করতে হয় না। যখন আমাদের আনন্দ বা দুঃখ হয় তখন তা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই প্রকাশিত হয়, আমাদের কোনোরকম আয়াস করতে হয় না। যখন আমাদের মনে কোনো ভাব জাগে, তখন সেই ভাবের প্রকাশভঙ্গিও আমাদের মনেই থাকে অর্থাৎ ভাবকে প্রকাশ করার জন্য যে অঙ্গভঙ্গি দরকার তার একটা চিত্র স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই আমাদের মনে আসে। এই স্বতঃস্ফূর্ত ভাবই শিল্পের অপর একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। কোনো গান, নৃত্য বা চিত্র কতখানি শিল্পমর্যাদাসম্পন্ন তা নির্ভর করে সে শিল্পগুলির স্বতঃস্ফূর্ত রূপায়নের মধ্যে। যদি কোনো শিল্পীর মনে রস সৃজন হয়ে থাকে তাহলে তিনি সেই শিল্প সৃষ্টি না করে থাকতে পারেন না। সহজাত প্রবৃত্তি হিসাবে আনন্দ, বিষাদ, বিস্ময় প্রভৃতি ভাবের প্রকাশ কীভাবে করতে হয়—তা কেউ কারো শেখানোর অপেক্ষায় থাকে না। বাস্তবজীবনে সকলেই এর সঙ্গে পরিচিত। এর প্রকাশভঙ্গি সকলেরই মনে ‘অভিজ্ঞতা’র চিত্র-রূপে রয়েছে। এই মানসিক চিত্রের প্রকাশ কখনও নাটকের মধ্যে অভিনয়ের মাধ্যমে কখনও বা চিত্রের মাধ্যমে, কখনও বা নৃত্যের মাধ্যমে হয়ে থাকে। আমাদের মনের মধ্যে যদি কোনো ঘটনার চালচিত্র অঙ্কন না করি তাহলে অভিনয়াদি কখনই সম্ভব নয়। কাজেই চিত্রের প্রয়োজনীয়তা আমাদের জীবনে অসীম। আমরা বাস্তবে কোনো কাজ করার আগে তার নকশা বা চালচিত্র বা মানচিত্র প্রস্তুত করি। যখন আমরা কোনো গৃহ নির্মাণ করি, নগর পরিকল্পনা করি তখন তার পরিকল্পনা বা চিত্র-নকশাও প্রস্তুত করি। তারপর সেই চিত্রকেই বাস্তবে রূপ দিয়ে থাকি। যেখানে মনের মধ্যে কোনো চিত্র নেই—সেখানে ছন্দ থাকতে পারে না।

নাটকাদি শিল্পের ক্ষেত্রেও এ ধরনের চিত্রের বাস্তবায়ন না হলে তা মানুষের হৃদয়ে কখনও অনৈসর্গিক আনন্দ বা রসসৃষ্টি করতে পারে না। কাজেই অভিনয়কে চিত্রের উৎস না বলে চিত্রকেই সমস্ত শিল্পের উৎস বলে বর্ণনা করা বোধহয় অত্যুক্তি নয়। তাছাড়া চিত্র শব্দের অপর একটি ব্যুৎপত্তিগত অর্থ অনুধাবন করলে, এ বক্তব্য আরও বেশি পরিস্ফুট হবে—‘চিত্তম‌্ রাতি ইতি চিত্র’—অর্থাৎ যা আমাদের চিত্তকে অনুরঞ্জিত করে তাই চিত্র। কাজেই চিত্ৰ-ই একমাত্র অনুরঞ্জক যা সমস্ত আনন্দদানকারী মাধ্যমের মধ্যে রয়েছে।

‘অভিলষিতার্থ চিন্তামণিঃ’-তে এক ধরনের চিত্রকে ‘ভাবচিত্র’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।[৪১] আচার্য বামন বলছেন, নাটক প্রভৃতি দশরূপক সৌন্দর্যের দিক দিয়ে সবচেয়ে বেশি উপাদেয়। তার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে যে, চিত্রের সমস্ত বৈশিষ্ট্য সমূহ এই দশরূপকে রয়েছে।[৪২] এখানে চিত্রকে সৌন্দর্যের মডেল বা আদল হিসেবে স্বীকার করা হয়েছে। অভিনবগুপ্ত আরও পরিষ্কার করে বলেছেন যে,

নয়নসমুখে স্থিত চিত্রপটে যেমন সমস্ত ঘটনাকে আবির্ভূত হতে দেখে রসাস্বাদন করি ঠিক তেমনি প্রেক্ষাগৃহে নাটকের অভিনয় কালে নয়নসমুখে বিষয়সমূহ দর্শন করে দর্শক রসাস্বাদন করে থাকে। কাব্যপাঠাদি অন্যান্য ক্ষেত্রেও অভিনয়দর্শনের ন্যায় অথবা চিত্রস্থ ঘটনার ন্যায় রসাস্বাদন করে থাকি।[৪৩]

চিত্রের উক্ত গুরুত্বের কথা মনে রেখেই বোধহয় মনু ‘ত্রৌর্ষত্রিক’ বলতে নৃত্য গীত ও বাদ্যকে বোঝাতে চেয়েছেন। রাজ ধর্মের কথা বলতে গিয়ে তিনি এ তিনটিকে এক ধরনের ব্যসন বলে উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ, কলার মধ্যে এ তিনটিকে বিশেষ করে রাজাদের ক্ষেত্রে, পরমার্থ লাভের পথ বলে উল্লেখ করেননি, বরং এগুলিকে ব্যসন বা কু-অভ্যেস বলে বর্ণনা করেছেন।[৪৪]

এগুলো যথাযথ কু-অভ্যেস কিনা সে আলোচনায় যাচ্ছি না কিন্তু এটুকু বলা যায় যে, এগুলোর মধ্যে চিত্রের উল্লেখ নেই। তার কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে—মনু চিত্রের উপকারিতা সম্পর্কে বা তার অপরিহার্যতা সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিলেন। অন্যভাবে তিনি চিত্রচর্চাকে অনুমোদন করেছেন—বা কু-অভ্যেস বলে গণ্য করেননি। আমাদের জীবনে চিত্রের সৌন্দর্যগত প্রয়োজন বা অন্যান্য প্রয়োজনের কথা চিন্তা করেই তিনি চিত্রশিল্পকে ব্যসন বলে উল্লেখ করেননি।

উপসংহারে বলা যায় যে, চিত্রই হচ্ছে সমস্ত শিল্পের উৎস এবং জনসমাজে সবচেয়ে বেশি সমাদৃত। পৃথিবীর সমস্ত কিছুই চিত্র-বিযুক্ত তো নয়ই বরং সমস্তই চিত্র-সমুদ্ভূত। যেমন আমরা কূপে জল এবং জলে কূপ দু-ভাবেই বলতে পারি ঠিক তেমনি চিত্রময় বিশ্ব অথবা বিশ্ব চিত্র উভয়রূপেই চিত্রকে বর্ণনা করা যায়। তাই শাস্ত্রে বলা হয়েছে—

চিত্রং হি সর্বশিল্পানাং মুখং লোকস্য চ প্রিয়ম‌্
চিত্রমূলোদ‌্ভবং সর্বং ত্রৈলোক্যং সচরাচরম‌্।
কূপো জলে জলং কূপে বিধিপৰ্যায়তস্তথা
তদ‌্বচ্চিত্রময়ং বিশ্বং চিত্রং বিশ্বে তথৈব চ ॥[৪৫]


নির্দেশিকা:

০১. অভিজ্ঞান শকুন্তলম্‌, ষষ্ঠ অঙ্ক।

০২. বাৎসায়ন, কামসূত্র, বিদ্যাসমুদ্দেশ প্রকরণ।

০৩. রঘুবংশ, ১৬/১৬,
    চিত্রদ্বীপাঃ পদম‌্‌বনাবতীর্ণা
    করেণুভির্দও মৃণালভঙ্গাঃ।
    নখাংশুকাধান বিভিন্নকুম্ভাঃ
    সংবদ্ধসিংহপ্রহৃতং বদন্তি ॥

০৪. Dr. K. Krishnamoorthy, Studies in Aesthetics and Criticism, Mysore, 1979, p. 8

০৫. বিষ্ণুধর্মোত্তর পুরাণ, ৩য় খণ্ড,
    তরঙ্গাগ্নিশিখাধূম বৈজয়ন্ত্যম্বরদিকম‌্।
    বায়ুগত্যা লিখেদ‌্ যস্তু বিজ্ঞেয়ঃ স তু চিত্রবৎ॥
    সুপ্তং চ চেতনাযুক্তং মৃতং চৈতন্যবর্জিতম‌্।
    নিম্নোন্নত বিভাগং চ যঃ করোতি ম চিত্রবিৎ॥
    লস্তীব চ ভূলম্বো বিভ্যতীব তথা নৃপঃ।
    হস্তীব চ মাধুর্যং সজীব ইব দৃশ্যতে ।।
    সশ্বাস ইব যচ্চিত্রং তচ্চিত্রং শুভলক্ষণম্।

০৬. বিষ্ণুধর্মোত্তর পুরাণ, ৩য় খণ্ড,
    রেখাং প্রশংসয়ন্ত্যাচাৰ্যা বৰ্ত্তনাং চ বিচক্ষণাঃ।
    স্ত্রীয়ো ভূষণমিচ্ছন্তি বর্ণাঢ্যমিতরে জনাঃ।।

০৭. যশোধর পণ্ডিত, ‘জয়মঙ্গলটীকা’, বাৎসায়ন বিরচিত কামসূত্রের উপর প্রথম অধিকরণ, তৃতীয় অধ্যায়।

০৮. রবীন্দ্র রচনাবলী, বিচিত্র প্রবন্ধ, ‘ছবির অঙ্গ’ পৃ. ১২২।

০৯. রবীন্দ্র রচনাবলী, বিচিত্র প্রবন্ধ, ‘ছবির অঙ্গ’ পৃ. ১২৭।

১০. অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ভারত শিল্পের ষড়ঙ্গ, বিশ্ববিদ্যা সংগ্রহ, পৃ. ১৩।

১১. পঞ্চদশী, ‘চিত্রদ্বীপ প্রকরণ’, কারিকা: ১-২,
    যথা চিত্রপটে দৃষ্টমবস্থানাং চতুষ্টয়ম্।
    পরমাত্মনি বিজ্ঞেয়ং তথাবস্থাচতুষ্টয়ম্।।
    চিদন্তর্মী সূত্ৰাত্মা বিরট চাত্মা তথের্যতে।

১২. পঞ্চদশী, ‘চিত্রদ্বীপ প্রকরণ’, কারিকা: ২-৩,
    যথা ধৌতো ঘট্টিতশ্চ লাঞ্ছিতো রঞ্জিতঃ পটঃ।
    স্বতঃ শুভ্রোহত্র ধৌতঃ স্যাদ‌্ট্টিতোহন্নবিলেপনাৎ।
    মষ্যাকারৈর্লাঞ্ছিতঃ স্যাদ‌্‌রঞ্জিতো বর্ণপুরণাৎ।

১৩. প্রাগুক্ত, কারিকা: ৪-৫।

১৪. ‘বাস্তুশাস্ত্র’, দ্বিতীয় খণ্ড, ডি. এন. শুক্লা (সম্পাঃ), গোরখপুর বিশ্ববিদ্যালয়, পৃ. ৩৮৯,
    আকস্মিকে লিখামীতি যদা তুদ্দিশ্য লিখ্যতে ।
    আকার মাত্র সংপত্তেঃ ওদবিদ্ধমিতি স্মৃতম্ ॥

১৫. Dr. K. Krishnamoorthy, ‘ঐশৃঙ্গারাদিরসো যত্র দর্শনাদেব গমতে’ (তৎ রসচিত্রম‌্), Studies in Aesthetic and Criticism, p. 7.

১৬. বিষ্ণুধর্মোত্তর পুরাণ, অধ্যায় ৪০; এবং শিল্পরত্ন ১/৪৬/ ১৪-২৫।

১৭. অভিলষিতার্থ চিন্তামণিঃ, ৩/১/৯৪২।

১৮. শিল্পরত্ন, অংশ: ১, অধ্যায়: ৪৫, কারিকা: ১৩৯-১৪৪।

১৯. বাস্তুশাস্ত্র, দ্বিতীয় খণ্ড, ডি. এন. শুক্লা (সম্পাঃ), গোরখপুর বিশ্ববিদ্যালয়, পৃ. ৪৪০।
    ‘বহুবিধ বর্ণদিগ্ধাঙ্গুলীভির্গ্ৰীবা সূত্রাণি চ চিত্রযন্তীভিশ্চিত্ৰপত্ৰলতা লেখ্যকুশলাভিঃ।’

২০.বাস্তুশাস্ত্র, পৃ. ৪৮০।

২১. মালবিকাগ্নিমিত্র, প্রথম অঙ্ক,
    ‘চিত্রশালাং গতা দেবী প্রত্যগ্রবর্ণরাগাং চিত্রলেখামাচার্য ম্যাবলোকয়ন্তী তিষ্ঠতি।’

২২. অনিল কুমার বসু (সম্পাঃ), কাব্যালঙ্কার সূত্রবৃত্তিঃ, ভূমিকা, পৃ. ১১-১২।

২৩. কাব্যালঙ্কার সূত্রবৃত্তিঃ, ৩/১।

২৪. নাট্যশাস্ত্র, অধ্যায়: ২১, শ্লোক: ৬০-৬৫,
    বর্ণনাং তু বিধিং জ্ঞাত্বা তথা প্রকৃতিমেব চ কুর্যাদঙ্গস্য রচনাম‌্।…
    সিতপীত সমাযোগঃ পাণ্ডুবর্ণ ক্ষতি স্মৃতঃ।
    সিতরক সমাযোগঃ পদম‌্‌বর্ণ ক্ষতি স্মৃতঃ ৷।
    সিতনীল সমাযোগঃ কাপোতো নাম জায়তে।
    পীতনীল সমাযোগাৎ হরিতো নাম জায়তে ৷
    নীলরক্ত সমাযোগাৎ কাষায়ো নাম জায়তে।।
    রক্তপীত সমাযোগাৎ গৌর ইত্যভিধীয়তে ৷৷
    এতে সংযোগজাবর্ণাহ্যপবর্ণাস্তথা পরে।
    ত্রিচতুবর্ণ সংযুক্তা বহবঃ পরিকীর্ত্তিতাঃ।।

২৫. জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, ভারতের নাট্যকলা ও রচনা পদ্ধতি, ‘ভরত নাট্য শাস্ত্র’ (২য় খণ্ড অন্তর্ভুক্ত), নবপত্র, ১৯৮২, পৃ. ২০৫-২০৬।

২৬. ধ্বন্যালোকঃ, ১/৭ (গদাংশ),
    অথ চ বাচ্য বাচক লক্ষণমাত্ৰকৃত শ্ৰমাণাং কাব্যতত্ত্বার্থ ভাবনা বিমুখানাং
    স্বর-শ্ৰুত্যাদি লক্ষণমিবাপ্রগ্নীতানাং গান্ধর্ব লক্ষণবিদামগোচর এবাসাবর্থঃ

২৭. Dr. K. Krishnamoorthy (Ed.): ‘Dhvanyaloka’, Motilal, Delhi, 1982, p. XL.

২৮. শ্রীমদ‌্‌ভগবদ‌্‌গীতা ২/৬৬।

২৯. ‘Dhvanyaloka’, p. XXXVII.

৩০. ভরত মুনি, নাট্যশাস্ত্র ৫১/৩৬।

৩১. ভরত মুনি, নাট্যশাস্ত্র ৭/৭।

৩২. ধ্বন্যালোকঃ ও লোচন, চৌখাম্বা, পৃ. ১৯৩,
    ‘সত্বময় নিজচিৎ স্বভাব নিবৃতি বিশ্রান্তি লক্ষণঃ পরব্রহ্মস্বাদসবিধঃ।’

৩৩. Benedetto Croce, Aesthetics, Vision Press, London, 1962, p. 12.

৩৪. ধ্বন্যালোকঃ, ৩/৩৩ (গদ্যাংশ),
    ‘ন হি ব্যক্তে প্রতীয়মানে বাচ্যবুদ্ধি দূরীভবতি।’

৩৫. ধ্বন্যালোকঃ, ১/৪,
    প্রতীয়মানং পুনরন্যদেব বস্ত্বস্তি
        বাণীষু মহাক বীনাম্।
    যৎ প্রসিদ্ধাবয়বাতিরিক্তং
        বিভাতি লাবণ্য মিবাঙ্গনাসু।।

৩৬. বিষ্ণুধর্মোত্তর পুরাণ, অধ্যায়: ২৪,
    উত্তরীয়বিহীনাংশ্চ দ্যুতাসজ্ঞান‌্, প্রদর্শয়েৎ
    যুক্তং মভারৈরুষ্ট্রাদ্যৈঃ মার্গং সার্থং প্রদর্শয়েৎ।

৩৭. ধ্বন্যালোকঃ, ৪/১৭,
    পরস্বাদানেচ্ছাবিরত মনসো বস্তু সুকবেঃ।
    সরস্বত্যে বৈম ঘটয়তি যথেষ্টং ভগবতী ।।

৩৮. বিষ্ণুধর্মোত্তর পুরাণ, ৩/২/৪,

৩৯. Abhinayadarpan, Manomohan Ghosh (Ed), p. 15.

৪০. নাট্যশাস্ত্র, ১/১১৬।

৪১. বাস্তুশাস্ত্র, ২য় খণ্ড, ডি. এন. শুক্লা (সম্পাঃ), পৃ. ৪৩৭,
    শৃঙ্গারাদিরসো যত্র দর্শনাদেব গম্যতে।
    ভাবচিত্রং তদাখ্যাতং চিত্ৰকৌতুক কারম‌্ ৷

৪২. কাব্যালঙ্কার সূত্রবৃত্তিঃ, ১/৩/৩০-৩১,
    সন্দর্ভেষু দশরূপকং শ্রেয়ঃ তদ্ধি চিত্রং চিত্রপট বিশেষ সাকল্যাৎ।

৪৩. কাব্যালঙ্কার সূত্রবৃত্তি, অনিলকুমার বসু (সম্পাঃ), ভূমিকা, পৃ. ৩৯।

৪৪. মনুসংহিতা, ৭ম সর্গ।

৪৫. বাস্তুশাস্ত্র, ২য় খণ্ড, ডি. এন. শুক্লা (সম্পাঃ), তৃতীয় অধ্যায়, চিত্রলক্ষণ।




প্রচ্ছদচিত্র ও অন্য ছবি সৌজন্য: www.pinterest.com