স্কুল শিক্ষার ক্ষেত্রে যেমন অতীতের মূল্যায়ন না করে তাকে নতুন দিকে চালনা করার কথা বলা হয়েছে, নতুন শিক্ষানীতিতে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও কার্যত সে-ই পথই নেওয়া হয়েছে। এর আগে, ‘শিক্ষানীতি: ২০২০’ নিয়ে যে আলোচনাটি করা হয়েছিল, তা মূলত বিদ্যালয়-কেন্দ্রিক। সে-ই ধারাবাহিকতায় কিছু কথা এখানে বলার চেষ্টা করা হয়েছে উচ্চশিক্ষা বিষয়ে।

‘বিশ্বমান’-এ পৌঁছানোর নামে এখানে উচ্চশিক্ষাকে কার্যত ‘ধনীর দুলাল’দের জন্যই সীমাবদ্ধ রাখার ব্যবস্থা পাকা করা হয়েছে। বিশ্বপুঁজির চাহিদা অনুসারে শিক্ষাকে বেসরকারিকরণ করার রাস্তা পরিষ্কার করা হয়েছে—সরকারি ব্যবস্থাপনায়। ২০১১-১২ সালের শিক্ষার সর্বভারতীয় এক সমীক্ষায় জানা যায়, উচ্চশিক্ষায় শিক্ষার্থীর হার সে সময় ছিল ২০.৮ শতাংশ। ২০১৭-১৮ সালে সেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫.৮ শতাংশে। ২০১৮-১৯ সালে, দেশব্যাপী উচ্চশিক্ষার এক সমীক্ষায় জানা যায়—২০১৮-তে দেশে ৯৯৩-টি বিশ্ববিদ্যালয় ৩৯৯৩১-টি কলেজ এবং ১০৭২৫-টি একক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল। কলেজের মধ্যে মাত্র ২২ শতাংশ ছিল সরকারি, ৭৮ শতাংশ বেসরকারি। গত সাত বছরে দেশে, যে ৩৫১-টি বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হয়েছে, তার মধ্যে ১৯৯-টি বেসরকারি। এই বৃদ্ধির হারকে ২০৩৫ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে। এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী পরিকল্পনা সফল করার জন্য কয়েকটি পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। সে বিষয়ে কথা বলার আগে, আমাদের দেশের শিক্ষাখাতে সরকারি ব্যয়বরাদ্দের কথাটি জেনে রাখা উচিত।

১৯৬৮ সালে ঘোষিত প্রথম জাতীয় শিক্ষানীতি থেকে এখনও পর্যন্ত শিক্ষাখাতে জিডিপির ৬ শতাংশ বরাদ্দ করার কথা বলে আসা হলেও, সরকারি স্বীকৃতি অনুযায়ী তা ছিল জিডিপির ৪.৪৩ শতাংশ। ১৯৯৯ সালে এই খরচ ছিল। তা ২০১৩ সালে দাঁড়ায় ৩.৮ শতাংশে, ২০১৪-তে ৩.১ শতাংশ আর ২০১৭-তে তা নেমে এসেছিল ২.৭ শতাংশে। বিশ্বব্যাংকের বিভিন্ন রিপোর্টে জানা গেছে, শিক্ষাখাতে সে সময় কিউবার বরাদ্দ ছিল ১২.৯ শতাংশ, নরওয়ের ৮ শতাংশ, ভুটানে ৬.৬ শতাংশ উজ়বেকিস্তানে ৬.৩ শতাংশ, ব্রেজ়িলে ৬.২ শতাংশ, ইজ়রায়েল ৫.৮ শতাংশ, ব্রিটেন ৫.৫ শতাংশ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৫ শতাংশ। শিক্ষাখাতে জিডিপির বরাদ্দের নিরিখে পৃথিবীর ১৯৭-টি দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান ১৪৩ নম্বরে। বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট জানাচ্ছে—২০১৩ সালে, জাতীয় আয়ের শতাংশের হিসেবে শিক্ষাখাতে সরকারি ব্যয়ের বিচারে বিশ্বের ১১৯টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ৭৭। এশিয়া মহাদেশের কথা আলোচনা করলে, ভারতের শিক্ষাখাতে সরকারি ব্যয় মোট ব্যয়ের মাত্র ১০ শতাংশ। পাশাপাশি ভুটানে ব্যয় ২২.৮ শতাংশ, ইরানে ২১.১ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ায় ২০.৫ শতাংশ, ইজ়রায়েলে ১৫.৫ শতাংশ, বাংলাদেশে ১৪.৫ শতাংশ। নতুন শিক্ষানীতিতে তা জাতীয় আয়ের ৪.৪ শতাংশ বলা হলেও বাস্তবের ছবিটা কিন্তু তা নয়। এরই মধ্যে সরকারের দাবি তা ৬ শতাংশে নিয়ে যাওয়া হবে। সাম্প্রতিক কোভিড-জনিত অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে, তা কীভাবে সম্ভব বোধহয় সরকারও জানে না।

নতুন শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থা থাকার জন্য নানা ধরনের বাধ্যবাধকতার ওপর নির্ভরশীল হতে হয়। সে কারণে—ন্যাশনাল হায়ার এডুকেশন রেগুলেটরি অথরিটি (NHERA) গঠন করার কথা বলা হয়েছে, যেটি হবে একটি স্বাধীন সংস্থা। ইউজিসির ক্ষমতা ছেঁটে ফেলে হায়ার এডুকেশন গ্রান্ট্‌স কাউন্সিল (HEGC) নামের এক নতুন সমিতি তৈরি করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। ন্যাশনাল এ্যাক্রেডিটেশন অ্যান্ড এ্যাসেসমেন্ট (NAAC) নামের পুরোনো সমিতির ঢালাও পরিবর্তনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। NAAC-এর কার্যাবলীও নিয়ন্ত্রণ করবে, রাষ্ট্রীয় শিক্ষা আয়োগ (RSA)। স্কুল শিক্ষার মতো উচ্চশিক্ষাতেও কারিকুলাম, পেডাগগি, অ্যাসেসমেন্ট ইত্যাদি দেখা হবে। পাশাপাশি অল ইন্ডিয়া কাউন্সিল ফর টেকনিকাল এডুকেশন (AICTE), বার কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়ার মতো সংস্থাগুলির ক্ষমতা সংকুচিত করা হবে।

বর্তমান নিয়মে, পার্লামেন্ট বা রাজ্য বিধানসভা উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান স্থাপনের অনুমতি দিয়ে থাকে। নতুন শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে, নতুন এই ধরনের প্রতিষ্ঠান (NHERA) থেকে বাধ্যতামূলক স্বীকৃতি করিয়ে নিতে হবে। সব ধরনের উচ্চশিক্ষার জন্য বড় আকারের বহুমুখী (Multi Disciplinary) বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজ তৈরি করা হবে, যাদের প্রত্যেকটিতে কমপক্ষে পাঁচ হাজার বা তারও বেশি শিক্ষার্থী, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে শিক্ষা অর্জনের সুযোগ পাবে। সমস্ত উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানকে প্রশাসনিক বিষয়, পঠনপাঠন সংক্রান্ত এবং আর্থিক বিষয়ে পূর্ণ স্বশাসন দেওয়া হবে।

উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির পুনর্গঠনের কথা বলা হয়েছে নতুন দলিলে। রিসার্চ ইউনিভার্সিটি, টিচিং ইউনিভার্সিটি এবং কলেজ—তিনভাগে ভাগ করা হবে এদের। বর্তমানের সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি, সেন্ট্রালি ফান্ডেড টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট এবং ইনস্টিটিউট অফ ন্যাশনাল ইমপর্ট্যান্স-এর অধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেমন—CSSR, ICPR, ICHR, DAE, DBT-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলো নিজের নিজের গবেষণায় অনুদানের স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। ন্যাশনাল রিসার্চ ফাউন্ডেশন (NRF) নামে নতুন এক কেন্দ্রীয় সংস্থা তৈরি হবে। তারাই বিষয়টি দেখভাল করবে। বেসরকারি সংস্থাগুলিও এর মাধ্যমে গবেষণার কাজে লগ্নি করতে পারবে। পরিণতি সহজবোধ্য। সমস্ত গবেষক শিক্ষার্থীদের নিজেদের গবেষণার পাশাপাশি বাধ্যতামূলকভাবে আটটি করে টিচিং অ্যান্ড পেডাগগি কোর্স পড়াতে হবে, ইংরেজি ভাষার সঙ্গে অন্য কোনও একটি ভারতীয় ভাষার আরেকটি ইউনিট নিতে হবে। অবশ্য বিদেশি গবেষকদের জন্য এটি প্রযোজ্য নয়। প্রশ্নটা উঠবে এর ফলে গবেষণার গুণমান নিয়ে। পাশাপাশি সরকারের আরেকটি উদ্দেশ্যও স্পষ্ট। অধ্যাপকদের শূন্য পদে সাংবিধানিক নিয়ম মেনে নিয়োগ না কোরে, গবেষক-ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে কাজ চালিয়ে—কর্মসংস্থানের সু্যোগ না বাড়িয়ে, নিজেদের দায়িত্ব এড়ানোর চেষ্টা রয়েছে সরকারের।

১৯৪৯-এ রাধাকৃষ্ণ কমিশন সহ পরবর্তীকালের বিভিন্ন শিক্ষা দলিলে, সাধারণ উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করার পাশাপাশি জাতীয় পুনর্গঠনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত বৃত্তিমূলক শিক্ষা বা ভোকেশনাল এডুকেশন। ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মতো ব্যবহারিক দক্ষতামূলক শিক্ষা। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদির কথাও বলা হয়েছে। কিন্তু, ২০২০-র নতুন শিক্ষানীতিতে: বিষয়-ভিত্তিক স্বতন্ত্র জ্ঞান ভাণ্ডারগুলিকে ভেঙে, সুসংহত ব্যবস্থার নামে সে-ই পরিকল্পনার গুরুত্ব কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। যুক্তি দেওয়া হয়েছে যে, একমুখী বিষয় শিক্ষার বদলে, লিবেরল বোর্ড বেস্‌ড মাল্টি-ডিসিপ্লিনারি শিক্ষা চালু করাই উচ্চশিক্ষার চূড়ান্ত লক্ষ্য। বলা হচ্ছে যে, প্রাচীন নালন্দা তক্ষশীলারও এমন আদর্শ নাকি ছিল!

নতুন শিক্ষানীতিতে চার বছরের স্নাতক ও এক বছরের স্নাতকোত্তর শিক্ষাক্রম চালু করার কথা বলা হয়েছে। বিএ, বিএসসি, বিকম—আগের মতো চালু থাকলেও, তাকে চারটি পর্যায়ে ভাঙা হবে। সার্টিফিকেট, ডিপ্লোমা, ডিগ্রি ও অনার্স। এক্ষত্রে কেউ যদি প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় বছরে পড়তে পড়তে পড়া ছেড়ে দেন, তাহলে তিনি যতদূর পড়েছেন, সে-ই পর্যায় পর্যন্ত পড়াশোনা করার জন্য কোনও একটি সার্টিফিকেট পাবেন। আবার ইচ্ছা করলে, ভবিষ্যতে বাকি পাঠ্যক্রমও শেষ করতে পারবেন। কিছু কিছু বিষয় যেমন নতুন হবে, তেমনই কিছু বিষয় বাতিল হবে। বিষয় বাছাই করার ক্ষেত্রে পড়ুয়ার স্বাধীনতা থাকবে। কলা বিভাগের সঙ্গে বিজ্ঞান ও বাণিজ্য বিভাগের বিষয় নেওয়া যাবে। অর্থাৎ চার বছরের স্নাতক পাঠ্যক্রমে, যে একাধিক ‘এগ্‌জিট পয়েন্ট’ ঘোষণা করা হয়েছে—তার আসল উদ্দেশ্য বুঝতে কষ্ট হয় না। স্নাতক হবার পরেও, বর্তমানে অধিকাংশ শিক্ষিত পড়ুয়া ‘চাকরি’ পায় না। সেখানে মাঝপথে পড়া থামিয়ে বিভিন্ন সার্টিফিকেট পেলে, তাদের চাকরির ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনও কথা নেই। বরং বলা যেতে পারে, এতে মাঝপথে কলেজ ছুটকেই (Dropout) প্রশ্রয় দেওয়া হবে। ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মতো বিষয়ের স্নাতক স্তরে ভর্তির ক্ষেত্রে একটি সর্বভারতীয় পরীক্ষা নেওয়া হবে, যেখানে র‍্যাঙ্কিংয়ের ভিত্তিতে কলেজে ভর্তি হতে হবে। এখানে আরও একটা গুরুতর দিকের প্রতি আমাদের নজর দেওয়া দরকার। এই শিক্ষানীতিতে স্কুল-স্তরে নারী শিক্ষা সম্বন্ধে কিছু কথা বলা হলেও, উচ্চশিক্ষা স্তরে প্রায় কিছুই নেই।

শ্রেণিকক্ষে পাঠদান প্রক্রিয়ার উন্নতির জন্য, শিক্ষকের পেশাগত দক্ষতা বাড়ানোর জন্য এবং পরিকল্পনা মতো শিক্ষাকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য, সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রযুক্তি-নির্ভর শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। কোভিড পরিস্থিতি সে-ই পরিকল্পনায় যেন বাড়তি ইন্ধন। সরকারি বা বেসরকারি; মাধ্যমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় আগে-পরে সবাই এল—অনলাইন ক্লাসের ছাতার নীচে। পরীক্ষা নেওয়া, স্কুল-কলেজে ভর্তি হওয়া সবটাই ফিজিক্যাল থেকে ডিজিটালে চালু হয়ে গেল। উচ্চশিক্ষায় অনলাইন মাধ্যমের ব্যবস্থা ২০১৭ সাল থেকেই সরকার শুরু করেছিল, SWAYAM পোর্টাল সহ আরও কয়েকটি সংস্থার মাধ্যমে। শিক্ষানীতির খসড়ায় যদিও ছিল না, তবু এই বছর (২০২১) জানুয়ারি মাসে সে-ই খসড়ার সংশোধন করে, সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়কে অনলাইন ডিগ্রি দেওয়ার অনুমতি দিয়েছে ইউজিসি। যদিও দেশে ডিজিটাল পরিকাঠামো ও অনলাইন শিক্ষার হাল বুঝতে—সরকারি তথ্যই যথেষ্ট। অবশ্য সরকার যে কোনওদিকেই কর্ণপাত করবে না, তাও জানা। হিসাব মতো শহরাঞ্চলে বসবাসকারী সমাজের ‘সচ্ছল’ পরিবারের সন্তানদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশের স্মার্টফোন বা ল্যাপটপ না থাকায় পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই অনুপাতের হার ২৭ শতাংশ। একইভাবে বিদ্যুৎ ঘাটতি বা নেট সংযোগ দুর্বল হওয়ায় ২৮ শতাংশ ছাত্রছাত্রীর পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দেশে এখনও লক্ষাধিক গ্রামে বিদ্যুৎ সংযোগ পৌঁছয়নি। কম্পিউটার ও ইন্টারনেট দুটোই ব্যবহার করেন দেশের মোট জনসংখ্যার মাত্র ৮ শতাংশ। আর দেশের ৩৭ শতাংশ পরিবার সমস্ত সদস্যদের নিয়ে একটিমাত্র ঘরে কোনওরকমে জীবন কাটায়। অনলাইন-শিক্ষাব্যবস্থায় এক বিরাট সংখ্যক পড়ুয়া যে শিক্ষার আঙিনা থেকে ছিটকে যাবে, তা নিয়ে সন্দেহ নেই একটুও। প্রমাণ, এই সময়ের মধ্যে দেশের মোট শিক্ষার্থীর মাত্র ১৪ শতাংশ অনলাইন-শিক্ষা নিচ্ছে। ভারতের শিল্পপতিরা ২০০০ সালে শিক্ষা সংস্কারের উদ্দেশ্যে যে রিপোর্ট পেশ করেছিল, ‘আম্বানি বিড়লা রিপোর্ট’ নামে যা পরিচিত, সেখানে শিক্ষার প্রযুক্তিগত প্রয়োগ ও সেক্ষেত্রে পুঁজি বিনিয়োগের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। ২০১৭ সালে নীতি আয়োগের তৈরি করা অ্যাকশন প্ল্যানে, অনলাইন-শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে বলা হয়েছিল, কারণ তা নাকি এনরোলমেন্ট বাড়াতে সহায়ক হবে।

কথায় বলে, কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ। ছাত্রছাত্রীরা দুশ্চিন্তায় মাথায় হাত দিক, কিন্তু উল্লসিত কর্পোরেট হাউসগুলো। ২০০৮-০৯ সাল থেকে দেশে, ইনফর্মেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি (ICT) যা বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্টারনেট সংযোগ ব্যবস্থা বা কারিগরি সহায়তা প্রদানে কর্মরত, ‘ডিজিটাল ভারত’ নির্মাণে যা যথেষ্টই গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রকল্প বর্তমানে, ইনফর্মেশন টেকনোলজি ইন্টারমিডিয়ারি গাইডলাইন ২০১৮-র প্রেক্ষিতে যে তথ্য পাওয়া যায়, তাতে দেখা যাচ্ছে, ২০১৩ সালে যেখানে ৫.৫ শতাংশ মানুষ স্মার্টফোন ব্যবহার করতেন, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে তা বেড়ে হয়েছে ২৬.২ শতাংশ। ইন্টারনেট ডেটা খরচ মাসে যেখানে ২০১৩-১৪ সালে ছিল ৭.১ জিবি, ২০১৮ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮.৩ জিবি-তে। গুগলের সিইও সুন্দর পিচাই বলেছেন, ভারতে ডিজিটাল ব্যবস্থা প্রসারে আগামী ৫-৭ বছরে, তিনি ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবেন। অনলাইন-শিক্ষায় শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যাপারে, সিবিএসই-কে সাহায্য করবে গুগল ও ফেসবুক। এই প্রযুক্তি-নির্ভর শিক্ষার সঙ্গে গড়ে তোলা হবে—জাতীয় সংগ্রহ ভাণ্ডার। এখানে ডিজিটাল আকারে সংরক্ষিত হবে প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সংক্রান্ত যাবতীয় নথিপত্র যা সমস্ত ভাষাতেও পাওয়া যাবে।

উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে দেশে বেসরকারি উদ্যোগকে স্বাগত জানানো হয়েছে—আড়াই দশক আগেই। ১৯৯৫ সালে গ্যাট চুক্তির মাধ্যমে শিক্ষা হয়ে গিয়েছিল আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক পণ্য। ১৯৯৫ সালের পর থেকে, দেশের শিক্ষা সংক্রান্ত সমস্ত কমিটির সুপারিশ ছিল, উচ্চশিক্ষায় বেসরকারি উদ্যোগ বাড়ানোর। ওই বছরই প্রথম বেসরকারি শিক্ষাকেন্দ্র হিসাবে নথিভুক্ত হয় মণিপাল বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে ভারতের মোট উচ্চশিক্ষার্থীর দুই তৃতীয়াংশ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়ে। এই শতকের প্রথম পনেরো বছরে, দেশে প্রতি বছর গড়ে ২০০০ করে নতুন কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তার অধিকাংশই ব্যক্তি বা গোষ্ঠী মালিকানাধীন বাণিজ্যিক উদ্যোগে। বলা বাহুল্য কর্পোরেট কায়দায় পরিচালিত হয় সে সব বিশ্ববিদ্যালয়গুলি। শিক্ষানীতি অনুযায়ী—একটি মনোনীত সার্বভৌম প্রশাসনিক সমিতি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করবে। সেখানে দশ থেকে কুড়িজন স্বাধীন ও উচ্চ দক্ষতা-সম্পন্ন মানুষ থাকবেন। শিক্ষক, প্রশাসনিক আধিকারিকেরা থাকবেন। কর্পোরেট কায়দাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে বলা হবে সিইও বা চিফ এগ্‌জিকিটিভ অফিসার। প্রশাসনিক সমিতি তাঁকে মনোনীত করবে এবং সমিতি বা বোর্ডের অনুমোদিত নীতির ভিত্তিতে তিনি একাডেমিক কাউন্সিল তৈরি করবেন। একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্যরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্তদের মধ্যে থেকে যেমন আসবেন, তেমনি বাইরে থেকেও আসতে পারেন। এঁদের মধ্যে শিক্ষাবিদ থাকবেন দুজন, বাকিরা আমলা।

ঝলমলে স্মার্ট ক্লাসরুম, অনলাইন-শিক্ষা—এসব গালভরা শব্দের আড়ালে মূল যে প্রশ্ন, তা হলো, টাকা কোথা থেকে আসবে? এখানে, শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারি অর্থবরাদ্দ বাড়ানোর আশ্বাস রয়েছে। বলা হয়েছে, বিগত চার বছরে মোট আভ্যন্তরীণ উৎপাদনের অনুপাতে, পরোক্ষ কর আদায়ের হার ১.৫ শতাংশ বেড়েছে। জিএসটির আওতায় গত চার বছরে ৫০ শতাংশ বেড়েছে, বিশেষ পরোক্ষ করদাতার সংখ্যা। ১৮ লক্ষের মতো ব্যক্তিগত করদাতা বেড়েছে। এইসব বাড়তি করের একাংশ শিক্ষায় আসবে বলে আশা করলেও, শিক্ষা সেসের ব্যাপারটির উল্লেখ নেই। জাতীয় আয়ের ৬ শতাংশ শিক্ষাখাতে খরচ করার কথা বাতিল না করা হলেও, জোর পড়েছে আগামী দশ বছরে মোট সরকারি ব্যয়বরাদ্দের ২০ শতাংশ শিক্ষাখাতে খরচ করার লক্ষ্যে যাওয়ার। যা নির্ভর করে করের অনুপাত বাড়ার ওপর। অর্থাৎ বর্তমানে সর্বজনীন খরচের ১০ শতাংশ, যা পরের দশ বছরে ২০ শতাংশে নিয়ে যাওয়া হবে, যার মধ্যে ৫ শতাংশ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য, ২ শতাংশ বিদ্যালয় শিক্ষায় অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ ও পরিকাঠামো তৈরির জন্য এবং ১.৪ শতাংশ বিনিয়োগ হবে প্রাথমিক শিক্ষায়। অথচ মোটেই জোরের সঙ্গে শিক্ষাখাতে ৬ শতাংশ ব্যয় করার কথা বলা হয়নি। সরকারি অর্থঘাটতি মেটাতে বেসরকারি সংস্থার মানবহিতৈষী অনুদানের ওপর নির্ভর করা হবে। অথচ কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপন্সেবিলিটি (CSR) বিষয়টি আইনের ফাঁক গলে এখনও বাধ্যতামূলক নয়।

নতুন শিক্ষানীতিতে উৎকর্ষমূলক জ্ঞানসমৃদ্ধ সমাজ গঠনের স্বপ্ন ফেরি করা হয়েছে। প্রতিজ্ঞা রয়েছে শিক্ষার সর্বজনীন প্রসার ঘটানোর। যদিও ‘সকলের জন্য শিক্ষা’কে বাস্তবায়িত করার পদক্ষেপ নেই। ২০০১ সাল থেকে সর্বশিক্ষা অভিযান চালু হয়। ৬-১৪ বছরের শিশুদের ‘এলিমেন্টারি এডুকেশন’ দিয়ে শিক্ষার আঙিনায় নিয়ে এসে, তাদের শিক্ষা সম্পূর্ণ করার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। বিশাল সংখ্যক শিশু এর ফলে বিদ্যালয়ে এল। তাদের পঠনপাঠনের জন্য পার্শ্বশিক্ষক নিয়োগ করা হলো। এই প্রকল্পের পরিকল্পনায় কেন্দ্র-রাজ্যের অংশীদারিত্ব স্পষ্ট হয়েছিল। পার্শ্বশিক্ষক, শিক্ষাবন্ধু ইত্যাদি পদের বিলুপ্তিকরণের কথা বলা হয়েছে নতুন শিক্ষানীতিতে। ফলে বিপুল সংখ্যক পার্শ্বশিক্ষক সংকটে পড়বেন। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সরকারি বা বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিও ‘অতিথি’ শিক্ষক/অধ্যাপক নিয়োগের কথা ভাববে না। উল্লেখযোগ্য যে, ৪৮৪ পাতার শিক্ষানীতির বক্তব্যে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজবাদ কথা দুটি অনুপস্থিত। রাধাকৃষ্ণণ কমিশন থেকে শুরু করে শিক্ষার যত দলিল স্বাধীন ভারতবর্ষে তৈরি হয়েছে, তারা দেশের পুনর্গঠনে শিক্ষাকে বিশেষ ভূমিকা দিয়ে, সংবিধানের মুখবন্ধে ঘোষিত নীতিগুলির বিশেষ উল্লেখ করেছে। অথচ বিভিন্ন ধর্মের মিশ্রণে গড়ে ওঠা নৈতিক মূল্যবোধ ছাড়া গণতন্ত্র, বহুত্ববাদ, মুক্ত ভাবনার প্রসার বাস্তবায়িত হওয়া কঠিন। সমাজবিজ্ঞানের নানা শাখায় এবং বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও ধর্মনিরপেক্ষতার সুস্পষ্ট অবস্থান না থাকলে ইতিহাসের বিকৃতি, বৈজ্ঞানিক ধারণার উদ্ভট ব্যাখ্যা আরও জোরালো ভাবে ছড়িয়ে পড়বে।

‘জাতীয় শিক্ষানীতি: ২০২০’ প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদ অনিল সদ্‌গোপাল বলেছেন: কোনও শিক্ষানীতিকে ভালো ভাবে বোঝার জন্য তার মূল পাঠের পাশাপাশি ভেতরের কথাকেও বুঝে নেওয়া দরকার। যে কথাগুলো উল্লেখ করা হয় না। এই শিক্ষানীতির আসল উদ্দেশ্য বোঝা কঠিন নয়। শিক্ষার দায় নিজেদের কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলা, ধাপে ধাপে শিক্ষার সমস্ত স্তরকে মুনাফা-লোভী শিক্ষা ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দিয়ে; কার্যত দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষকে শিক্ষার আঙিনা থেকে দূরে সরিয়ে রাখা, এবং ভারতবর্ষের শিক্ষার যে নিজস্বতা ছিল, পরিকল্পিতভাবে তা গুরুত্বহীন করে দেবার আশঙ্কা রয়েছে বলে শিক্ষাবিদদের অনেকে মনে করছেন। আশার কথা, বিপুল জনসংখ্যার এই দেশে, শিক্ষার ওপর নেমে আসা কর্পোরেটাইজ়েশন সহ নানা ধরনের আক্রমণের মোকাবিলায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের মত ব্যক্ত করছে। এই শিক্ষানীতি চালু করার বিরুদ্ধে দেশজুড়ে প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে। যদিও সে সব প্রতিবাদ বা আপত্তিতে কর্ণপাত না করে কস্তুরীরঙ্গণ কমিটি এই রিপোর্ট পেশ করেছে। এই নীতির পরিকল্পনায় বা রূপায়ণে রাজ্য সরকারগুলোর সঙ্গে তেমনভাবে আলোচনা করা হয়নি এবং সংসদে পেশ না কোরে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা তাতে সম্মতি দিয়েছে। আর দেশে এক ‘অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ’ ছাড়া অন্য কোনও গণসংগঠনের মতামতও নেওয়া হয়নি নতুন শিক্ষানীতি নিয়ে।

আমাদের বিরাট দেশের বিশাল সংখ্যক মানুষের জাগতিক ও মানসিক চাহিদা বিপুল। সেদিকে নজর দিতেই হবে, শিক্ষানীতির সফল রূপায়ণের জন্য। পাশাপাশি দেশের সামাজিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতা সম্পর্কেও সচেতন থাকতে হবে। কিন্তু এই দলিলে তার যথাযথ প্রতিফলন পড়েনি। দলিলের শুরুতে তৃতীয় অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “জ্ঞানের ভুবনে পৃথিবী দ্রুত পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। বৃহৎ তথ্যভান্ডার (বিগ ডেটা) যন্ত্রগত শিক্ষা (মেশিন লার্নিং) এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো নাটকীয় বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তনগুলির কারণে বিশ্বজুড়ে নানা অদক্ষ শ্রমের কাজ যন্ত্রই করে দেবে (মানব শ্রমের প্রয়োজন পড়বে না)। কিন্তু বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা, সমাজ বিজ্ঞান ও কলাবিভাগের বিভিন্ন শাস্ত্রের বিবিধ দক্ষতার সংযাগে বিশেষত গণিত, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও তথ্য বিজ্ঞান (ডেটা সায়েন্স) নির্ভর দক্ষ শ্রমের চাহিদা খুবই বেড়ে উঠেছে।”—২ সেপ্টেম্বর ২০২০-র ‘দেশ’ পত্রিকার ২৯ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য। অটোমেশন নিয়ে মন্তব্য-প্রতি মন্তব্য এক-দেড় দশকে পৃথিবীতে কিছু কম হয়নি। শ্রমের চারিত্রিক পরিবর্তনের কারণে, বাঝাই যাচ্ছে যে, এই চাহিদা মেটানোর জন্য একদিকে যেমন বিশ্বমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা পাওয়ার জন্য ধনীর ঘরের ছেলেমেয়েরা যাবতীয় প্রস্তুতির সুযোগ পাবে, ঠিক বিপরীতে কোটি কোটি অভুক্ত অর্ধভুক্ত শিশুরা স্কুলে গিয়ে নিজেদের মাতৃভাষায় সাবলীল ভাবে লিখতে বা পড়তে পারবে না। শিক্ষা মানুষের অধিকার। সে-ই অধিকারকে সকলের কাছে সমানভাবে পৌঁছে দেওয়ার দায় রাষ্ট্রের। ‘শিক্ষানীতি: ২০২০’-তে ভারত রাষ্ট্রের সে-ই দায় পালনের কোনও অঙ্গীকার নেই। নতুন দিনের আগমন বোধহয় এভাবেই হবে। প্রসঙ্গত, মদনমোহন তর্কালঙ্কারের ছড়া মনে পড়ে—‘লেখাপড়া করে যে/ গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে।’—বর্তমানের আচ্ছে দিনের পরিস্থিতিতে হয়তো বলতে হবে—বেশি কড়ি দিয়ে লেখাপড়া করবে যে/ গাড়ি ঘোড়া চড়বে একমাত্র সে!