এক.

ফরাসি ভাষায় উচ্চারণ জ়াঁ-লুক গোদা, ইংল্যান্ডে উচ্চারণ জ়াঁ-লুক গোদার, হলিউডে উচ্চারণ—জ়াঁ-লুক গোহ্‌দার। নামগুলোর ক্ষেত্রে আমি ইংল্যান্ডের উচ্চারণ ব্যবহার করছি।

১৯৯৪ সালে ‘মানবতা, সাহিত্য ও সাম্যবাদ’ [Michelanea. Humanisme, litteratur og kommunikation (Aalborg: Alborg Universitetsforlag, 1994, ed. Inge Degn, Jens Høyrup)] প্রবন্ধে রিচার্ড রাসকিন জ়াঁ-লুক গোদার-এর ‘ব্রেথলেস’ ফিল্‌মে জাম্পকাট শৈলীর উদ্ভাবনা সম্পর্কে আলোচনায় বিভিন্ন বিতর্ককে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, সবাই একতরফা ভাবে শৈলীটিকে নিয়েছেন; সম্পূর্ণ পরিপ্রেক্ষিত তাঁরা বুঝতে পারেননি। তাছাড়া কয়েকজনের মন্তব্যকে ঈর্ষান্বিত বলা যায়। এ-পর্যন্ত চুয়াল্লিশটি ফিল্‌ম করেছেন গোদার; তার মধ্যে ‘ব্রেথলেস’ প্রথম।

‘কাহিয়ে দ্যু সিনেমা’ (সিনেমা সম্পর্কিত নোটবুক) পত্রিকার সূত্রে যে চিত্রপরিচালকরা একত্রিত হয়ে ফরাসি সিনেমায় নতুন ঢেউ বা নব তরঙ্গ বা নবকল্লোল এনেছিলেন, জ়াঁ-লুক গোদার তাঁদের অন্যতম। ফিল্‌ম-পত্রিকাটি ১৯৫১ সালে আরম্ভ করেন আঁদ্রে বাজ়িঁ, জ়াক দোনিয়োল-ভালক্রোজ এবং জ়োসেফ-মারি লো দুচা। এই পত্রিকাটির পূর্বসূরী ছিল ‘রেভ্যূ দ্যু সিনেমা’ (সিনেমার রিভিউ) যার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন প্যারিসের দুটি ফিল্‌ম ক্লাবের সদস্যরা (‘অবজেকটিভ ৪৯’-এর রবার্ত ব্রেসঁ, জ়াঁ ককতো এবং আলেকজ়ান্দ্রে অসত্রুচ) এবং সিনে ক্লাব দ্যু কার্ত্যে লাতাঁ (লাতিন কোয়ার্টারের সিনেমা ক্লাব)। ১৯৫৭ সালে এরিক রোমার পত্রিকাটির সম্পাদক হবার পর তাতে প্রবন্ধ লেখা আরম্ভ করেন ফিল্‌ম সম্পর্কে নতুন ভাবুক একদল যুবক, যেমন, জ়াক রিভেত, জ়াঁ-লুক গোদার, ক্লদ শাবরল এবং ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো প্রমুখ যাঁরা পরে পৃথিবীর অত্যন্ত প্রভাবশালী চিত্রনির্মাতা হিসাবে খ্যাত হন। আঁদ্রে বাজ়িঁর সঙ্গে এই যুবকদের সম্পর্ক ছিন্ন হয় ১৯৫৪ সালে, ত্রুফোর প্রবন্ধ ‘লা কোয়ালিতে ফ্রাঁসে’ বা ‘ফরাসি বৈশিষ্ট্য’ প্রকাশিত হবার পর।

‘ব্রেথলেস’ (A bout de souffle) জ়াঁ-লুক গোদার পরিচালিত একটি অপরাধ-নাট্য ফিল্‌ম, যার কাহিনি তিনি নিজেই লিখেছিলেন, যদিও ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো কাহিনিটির ছক পেয়েছিলেন সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি ঘটনা থেকে এবং সেটিকে কিছুটা রদবদল করে ফিল্‌ম তৈরি করেন গোদার। কাহিনিটি জ়াঁ-পল বেলমোন্দো নামে এক ভবঘুরে অপরাধী আর তার মার্কিন বান্ধবী জ়িন সেবার্গকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। এটিই গোদারের প্রথম ফিচার ফিল্‌ম এবং অভিনেতা হিসাবে বেলমোন্দোকে প্রতিষ্ঠা ও খ্যাতি এনে দ্যায়। ফরাসি নিউ ওয়েভ সিনেমার প্রভাবশালী ফিল্‌ম হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে ‘ব্রেথলেস’, এক বছর আগে মুক্তি-পাওয়া ফ্রাসোঁয়া ত্রুফোর ‘দি ফোর হান্ড্রেড ব্লোজ’ এবং অ্যালাঁয় নেসের (Alain Resnais) ‘হিরোশিমা, মন আমোর’-এর পাশাপাশি। ফিল্‌মগুলো ফরাসি চিত্রনির্মাণশৈলীর দিকে আন্তর্জাতিক আলোচক-দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সফল হয়। গোদারের ফিল্‌মটি সাহসী কল্পনা এবং অপ্রচলিত গোদার-জাম্পকাট উদ্ভাবনের জন্য আন্তর্জাতিক স্তরে চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছিল। ফিল্‌মটি প্রথম যখন ফ্রান্সে মুক্তি পায় তখন কুড়ি লক্ষ দর্শক তা দেখেছিলেন।

মিশেল (জ়াঁ-পল বেলমোন্দো) একজন বিপজ্জনক অপরাধী, যে নিজেকে হলিউডি ফিল্‌মের হামফ্রি বোগার্ট-এর মতন বেপরোয়া মনে করে। মার্কিন ক্লাসিকাল ফিল্‌মের যুগে হামফ্রি বোগার্ট ছিলেন ফিল্‌ম ও মঞ্চাভিনেতা এবং অভিনয়ের গুণে তিনি হয়ে ওঠেন মার্কিন সংস্কৃতির একজন আইকন। আমেরিকার ফিল্‌ম ইন্সটিটিউট বোগার্টকে ক্লাসিকাল মার্কিন সিনেমার সবচেয়ে বড়ো পুরুষ অভিনেতার খেতাব দিয়েছিল। মার্সাইতে একটা মোটরগাড়ি চুরি করার পর মিশেল একজন অনুসরণকারী পুলিশকে গ্রাম্য পথে খুন করে। পুলিশের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়ানো নিষ্কপর্দক মিশেল তার প্রেমিকা প্যাট্রিশিয়া (জ়িন সেবার্গ)র দিকে সাহায্যের হাত বাড়ায়। সেবার্গ একজন ছাত্রী, যে সাংবাদিক হতে চায়, প্যারিসের রাস্তায় ‘নিউ ইয়র্ক হেরাল্ড ট্রিবিউন’ বিক্রি করে। দোটানায় পড়ে প্যাট্রিশিয়া বোকার মতন তাকে নিজের ফ্ল্যাটে আশ্রয় দ্যায়। মিশেল মেয়েটিকে ফোসলাবার পাশাপাশি ইতালিতে পালাবার জন্য ঋণের চেষ্টা করে। প্যাট্রিশিয়া জানায় সে গর্ভবতী, সম্ভবত মিশেলের বাচ্চার। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে প্যাট্রিশিয়া জানতে পারে যে, মিশেল একজন ফেরারি অপরাধী। শেষ পর্যন্ত প্যাট্রিশিয়া মিশেলকে ধরিয়ে দ্যায় আর পুলিশ আসার আগেই প্যাট্রিশিয়া মিশেলকে জানিয়ে দ্যায় সে কী করেছে। মিশেল জেলেতে জীবন কাটানোর জন্যে তৈরি হয়ে, প্রথমে নিজেকে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দ্যায়, পালাবার চেষ্টা করে না। পরে পালায়, আর পুলিশ তাকে দীর্ঘক্ষণ তাড়া করে রাস্তায় গুলি করে মারে। মৃত্যু পথযাত্রী মিশেলের শ্বাস ফুরিয়ে আসে, সে ‘ব্রেথলেস’ হয়ে মারা যায়।

মিশেলের মৃত্যু দৃশ্যটি মনে রাখার মতন, কিন্তু যাঁরা ফরাসি ভাষা জানেন না তাঁদের কাছে ফিল্‌মের শেষ সংলাপগুলো বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে। মূল ফরাসিতে সংলাপের উদ্দেশ্য ছিল অনিশ্চয়তা গড়ে তোলা; তাতে টের পাওয়া যায় না যে, মিশেল প্যাট্রিশিয়াকে নাকি জগৎসংসারকে দোষারোপ করছে, এবং এটাও অস্পষ্ট যে, প্যাট্রিশিয়া মিশেলের নিন্দা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলছে, নাকি একটা ফরাসি শব্দ সম্পর্কে প্রশ্ন তুলছে; মার্কিন হবার দরুন ফরাসিতে অভিব্যক্ত লজ্জার ধারণা সে বুঝতে পারছে না।

গোয়েন্দা ভিতাল আর প্যাট্রিশিয়া মরণাপন্ন মিশেলের কাছে পৌঁছলে তাদের মধ্যে এইভাবে কথাবার্তার আদানপ্রদান হয়—

মিশেল : ব্যাপারটা বিরক্তিকর, সত্যি।
প্যাট্রিশিয়া : ও কী বলল?
ভিতাল : ও বলল ‘তুমি একজন সত্যিকারের স্কামবাগ।’
প্যাট্রিশিয়া : স্কামবাগ কী জিনিস?

১৯৮৩ সালে ‘ব্রেথলেস’ ফিল্‌মটি হলিউডে রিচার্ড গেয়ার আর ভ্যালেরি কাপরিস্‌কিকে নিয়ে তৈরি হয়েছিল, কিন্তু তা গোদারের ফিল্‌মটির মতন সাড়া ফেলতে পারেনি।


দুই.

‘ব্রেথলেস’-এর কাহিনি মোটামুটি ‘দি নিউজ ইন ব্রিফ’ সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি ঘটনার ছায়া। ঘটনাটি ছিল মিশেল পোরতেল নামে একজন লোকের আর তার মার্কিন সাংবাদিক বান্ধবী বিভারলি লিনেটের। ১৯৫২ সালে পোরতেল একটা গাড়ি চুরি করেছিল তার অসুস্থ মায়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য, আর তা করতে গিয়ে লে হাভরেতে গ্রিমবার্গ নামে একজন পুলিশকে খুন করে ফ্যালে। খবরটা ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো পড়েছিলেন আর ক্লদ শাবরলের সঙ্গে ঘটনাটা নিয়ে ফিল্‌ম করবেন ভেবেছিলেন, কিন্তু কাহিনির ছক নিয়ে দুজনের মতের মিল না হওয়ায় তাঁরা ব্যাপারটা বাতিল করে দ্যান। সেই সময়ে গোদার টোয়েন্টিয়েথ সেনচুরি ফক্সের এজেন্টের কাজ করতেন এবং প্রযোজক জর্জ দ্য বোরগেয়া (Georges de Beauregard)কে বলেন যে, ওঁর সাম্প্রতিক ফিল্‌মটা ভালো হয়নি। বোরগেয়া গোদারকে ‘আইসল্যান্ডের জেলে’ (Pecheur d’Islande) নামে একটা কাহিনির চিত্রনাট্য লিখতে বলেন। ছয় সপ্তাহ চিত্রনাট্যে খাটাখাটুনির পর বিরক্ত হয়ে গোদার প্রস্তাব দেন ‘ব্রেথলেস’ তৈরি করার। শাবরল আর ত্রুফো তাঁদের ছকে নেয়া ছবিটা এই শর্তে বোরগেয়াকে দিতে রাজি হন যদি তা গোদার পরিচালনা করেন। ত্রুফো আর শাবরল তখন নামকরা পরিচালক, আর তাঁদের নামের দরুন টাকা তুলতে প্রযোজকের অসুবিধা হয়নি। ফিল্‌মের ক্রেডিটে ত্রুফোকে মূল লেখকের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে এবং শাবরলকে টেকনিকাল পরামর্শদাতা। শাবরল পরে জানিয়েছেন যে উনি মোটে দুইবার ফিল্‌মের সেটে গিয়েছিলেন আর ত্রুফোর অবদান সীমিত ছিল গোদারকে অনুরোধ করে লিলিয়ান ডেভিডকে একটা ছোটো ভূমিকায় অভিনয় করতে দেবার। ফিল্‌মে নিউ ওয়েভ পরিচালক জ়াক রিভেত অভিনয় করেছেন গাড়ির ধাক্কায় রাস্তায় মরে পড়ে থাকা একজন লোকের।

ফিল্‌মটা তুলতে-তুলতেই গোদার চিত্রনাট্য লিখেছেন। উনি ত্রুফোকে বলেছিলেন, ‘গল্পটা মোটামুটি একজন যুবককে নিয়ে যে মৃত্যুর কথা ভাবে আর একজন যুবতী যে ভাবে না।’ বাস্তব জীবনের মিশেল পোরতেল ছাড়া নায়কের উপাদান গোদার নিয়েছিলেন চালবাজ ও বেপরোয়া চিত্রনাট্যকার পল গেগফের চরিত্র থেকে, যে, ফিল্‌ম-মহলে যুবতীদের ফুসলিয়ে আকর্ষণ করার জন্য খ্যাত ছিল। জ়েনেভায় থাকার সময়ে চিনতেন এমন লোকেদের থেকেও কয়েকটি চরিত্রের উপাদান নিয়েছিলেন গোদার। ত্রুফো জানিয়েছেন যে,

কাহিনির শেষটায় বদল ঘটাবার পরিকল্পনা গোদারের নিজস্ব কেননা তাঁর লেখা চিত্রনাট্যে ফিল্‌ম শেষ হবার কথা ছিল রাস্তা দিয়ে নায়কের হেঁটে চলে যাওয়ার দৃশ্যে, আর পথচলতি লোকেরা তার দিকে তাকিয়ে দেখছে, এইরকম, যেহেতু প্রতিটি সংবাদপত্রে অপরাধীর ফোটো প্রকাশিত হয়েছে গোদার ফিল্‌মের ভয়ংকর পরিণতি বেছে নিয়েছিলেন তার কারণ উনি আমার চেয়েও দুঃখী প্রকৃতির মানুষ।


তিন.

১৯৬০ সালে সিনেমা জগতে জ়াঁ-লুক গোদার-এর ‘ব্রেথলেস’ ফিল্‌মটি জনগণের সামনে আসার পর নানা রকমের তর্ক জোড়া হয়েছে যে, ঠিক কোন কারণে পরিচালক একটি ফিল্‌ম-সম্পাদনার ক্ষেত্রে চিত্রনাট্যের ধারাবাহিকতা থেকে সরে গিয়ে বৈপ্লবিক টেকনিক প্রয়োগ করলেন। রিচার্ড রাসকিন বিভিন্ন তর্কগুলো আলোচনা করেছেন এবং বলেছেন যে, প্রতিটি তর্কই প্রমাণসাপেক্ষ। ‘ব্রেথলেস’-এর আলোচনায় প্রত্যেকে নিজের মতামত দিয়েছেন; অন্যের মতামতকে গুরুত্ব দেননি।

যদিও তাঁর প্রবন্ধে যে কথাগুলো রাসকিন বলেছেন তা আগে প্রকাশিত হয়নি, গোদার-এর ‘জাম্পকাট’ ব্যাখ্যায় এক নতুন দিক উন্মোচন করার চেষ্টা করা হয়েছে। দেখা যাবে যে-কোনো বৈপ্লবিক টেকনিক প্রয়োগ হলে, তা বিভিন্ন ধরনের ব্যাখ্যার সুযোগ গড়ে তোলে। যেহেতু এই ফিল্‌মটি পৃথিবীর সিনেমার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকচিহ্ন, এবং ফিল্‌ম নির্মাণের নতুন তরঙ্গ (La Nouvelle Vague)র প্রতিনিধিত্ব করে, যাঁরা ফিল্‌ম নির্মাণের ইতিহাসে আগ্রহী এবং এখনকার ফিল্‌ম সম্পাদনা কর্মের সঙ্গে যুক্ত, বিভিন্ন ফিল্‌ম-শৈলীর রদবদলের খেয়াল রাখেন, তাঁরা ফিল্‌ম নির্মাণের নান্দনিকতার সমস্যাগুলোর সম্মুখীন হতে পারবেন। মনে রাখা দরকার যে ফ্রান্সে পঞ্চাশের শেষ ও ষাটের দশকের উথালপাতালের সামাজিক রাষ্ট্রীয় বীজভূমিতে পালিত হয়েছিলেন গোদার।

সবচেয়ে কম খোশামুদে ব্যাখাটি দিয়েছেন, পরিচালক ক্লদ ওতো নাহা (Claude Autant-Lara), যাঁকে ত্রুফো তীব্র আক্রমণ করেছিলেন, ওপরে উল্লেখিত, ১৯৫৪ সালের জানুয়ারিতে ‘কাহিয়ে দ্যু সিনেমা’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ফরাসি সিনেমার একটি নির্দিষ্ট ধারা’ (Une Certaine Tendance du Cinema Francais) প্রবন্ধে। ক্লদ ওতো নাহা, যিনি মনে করতেন যে, নতুন তরঙ্গের তরুণ সমালোচকগুলো তাঁর কেরিয়ার ধ্বংস করে দিয়েছে, তিনি গোদার-এর ঘোরপ্যাঁচ সম্পাদনার নিম্নোক্ত ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। ১৯৮৩ সালে রেনে প্রেদালকে দেয়া সাক্ষাৎকারে ক্লদ ওতো নাহা বলেছিলেন যে,—‘আমিই এই তরুণগুলোকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলুম আর এরা আমাকেই উপড়ে ফেলে দিয়েছে।’

ব্রেথলেস ফিল্‌মের আসল গল্পটা আমি জানি, আর আমি বলতে পারি যে, ওটা নিছক একটা চমক! একজন ছোটোখাটো প্রযোজক একজন ছোটোখাটো পরিচালককে ভাড়া করেছিলেন অপরাধীদের নিয়ে একটা ছোটোখাটো ফিল্‌ম তৈরির জন্য, যা ৫০০০ মিটারের বেশি হবে না। কিন্তু পরিচালক ৮০০০ মিটার ফিল্‌ম তুলে ফেললেন; প্রযোজক বললেন ছবিটা কাটছাঁট করতে, কিন্তু পরিচালক রাজি হলেন না। তারপর পরিচালককে বাধ্য করা হলো। সাহস দেখাতে গিয়ে, প্রযোজকের ওপর চটে গিয়ে গোদার নিজেই কাটছাঁট করলেন, যেভাবে পারেন, যেখান-সেখান থেকে, যাতে ফিল্‌মটা বাজারে বিক্রি না হয়। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, ফিল্‌মটা পুরো তৈরি হয়ে গেলে, প্রযোজক জর্জ দ্য বোরগেয়া মনে করলেন যে, ব্যাপারটা বুদ্ধিকৌশলময়, প্রতিভা প্রয়োগ করে সম্পাদনা করা হয়েছে, অসাধারণ কাজ। পরিচালক প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে, তাঁর ফিল্‌মকে কাটাকুটি করা অসম্ভব, কিন্তু উনি যা করলেন তা কাজে লেগে গেল। তখন গোদার নিজেকে আবিষ্কার করলেন, এবং পরের ফিল্‌মগুলোতে, উনি আরও বেশি করে গোদার সৃষ্টি করতে লাগলেন! মাথামুণ্ডুহীন ফাঁকতাল্লা গড়া, চলতে থাকা দৃশ্যের মাঝখান থেকে দুম করে ছাঁটাই, এগুলোকে নাম দেয়া হলো ফিল্‌মের নতুন নান্দনিকতা। এটা একটা ফ্যাশান হয়ে দাঁড়াল। আর ফ্রান্স হলো সিনেমায় চালিয়াতির দেশ—এমন একটা দেশ যেটা সব হুজুগেই মেতে ওঠে, তাতে যাই হোক না কেন!

অনেকটা ক্লদ ওতো নাহার ব্যাখ্যার কাছাকাছি, কিন্তু ততটা খোশামুদে নয় যদিও, মন্তব্য করেছিলেন রবের বেনায়ুঁ (Robert Benayoun)। যেখানে ক্লদ ওতো নাহা বলেছিলেন যে, প্রযোজককে শিক্ষা দিতে গোদার ফিল্‌মটাকে ফালতু করে ফেলতে চেয়েছিলেন, সেখানে বেনায়ুঁ বললেন যে, গোদার জাম্পকাট প্রয়োগ করেছিলেন ফিল্‌মটার অবধারিত হেলাছেদ্দা থেকে বাঁচাবার খাতিরে, তা না করলে সমালোচকরা তাঁর মুণ্ডুপাত করত। ১৯৬২ সালের জুন সংখ্যা ‘পজিটিফ-৪৬’ পত্রিকায় তিনি লিখলেন :

যে ফিল্‌মটা দেখানো যাবে না, গোদার তাকে যথেচ্ছ কাটছাঁট করলেন, যাতে সমালোচকরা তা দেখে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে ওঠেন, আর অমন বাজেভাবে তৈরি একটা ফিল্‌ম দেখে, তাঁরা প্রশংসা করে তাঁকে বরং সাহায্যই করলেন, নতুন ফ্যাশান আনার জন্য। ফিল্‌মের অপচয় ঘটাবার সংশোধনাতীত পরিচালক, অত্যাচার ও ভীতিপ্রদর্শন সম্পর্কে আপত্তিকর বক্তব্যের মূর্খ স্রষ্টা, একজন আত্মপ্রচারকামী, গোদার লোকটি প্রতিনিধিত্ব করেন ফরাসি সিনেমার বুদ্ধিহীন অশিক্ষা আর কাঁচকড়ার ধাপ্পার বেদনাদায়ক অধঃপতনকে ।


চার.

১৯৮০ সালে ‘সিনেমার সত্য ইতিহাসের পরিচয়’ (Introduction à une véritable histoire du cinéma) প্রবন্ধে গোদার নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন যে, ‘ব্রেথলেস’ ফিল্‌মের অমন সম্পাদনার প্রয়োজন হয়েছিল তার দৈর্ঘ্য কম করার জন্য, কিন্তু ক্লদ ওতো নাহা যে কারণ দেখিয়েছেন সে জন্য নয়। গোদার বলেছেন যে, চুক্তি অনুযায়ী ফিল্‌মটার দৈর্ঘ্য এক ঘণ্টা কমানো জরুরি ছিল, এবং তার জন্য প্রযোজক কোনো চাপ সৃষ্টি করেননি, এবং তিনি নিজেও ফিল্‌মটার দৈর্ঘ্য ১৩৫-১৫০ মিনিট রাখতে চাননি। তিনি জানিয়েছেন যে, অনভিজ্ঞতার কারণে ফিল্‌মটার দৈর্ঘ্য বেশি হয়ে গিয়েছিল, এবং তাকে ছোটো করা জরুরি ছিল :

প্রথম ফিল্‌ম সব সময়েই বেশ দীর্ঘ হয়। তার কারণ বেঁচে থাকার তিরিশ বছর পর লোকে তার প্রথম ফিল্‌মে সবকিছু পুরে দিতে চায়। ফলে তা সব সময়ে দীর্ঘ হয়ে যায়। আর আমি সেই নিয়মের বাইরের মানুষ ছিলুম না। আমি একটা ফিল্‌ম তৈরি করেছিলুম যা ছিল সওয়া দুই ঘণ্টা বা আড়াই ঘণ্টার; আর ব্যাপারটা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিল, কেননা চুক্তি অনুযায়ী ফিল্‌মটা দেড় ঘণ্টার বেশি হবার কথা ছিল না। আর আমার স্পষ্ট মনে আছে কেমন করে আমি কেটে ফেলবার বিখ্যাত উপায় আবিষ্কার করলুম, তা এখন বিজ্ঞাপনগুলো প্রয়োগ করে: আমরা প্রতিটি দৃশ্য বাছাই করলুম আর একটা নিয়ম মেনে যেখানে ছাঁটা যায় কেটে ফেললুম, আর সেই সঙ্গে ফিল্‌মের গতি-ছন্দটা বজায় রাখার চেষ্টা করলুম। যেমন ধরা যাক, বেলমোন্দো আর সেবার্গ একটা মোটরগাড়িতে যে সময়ে ছিল, আর নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল, একবার একজনের শট নেয়া হয়েছিল, আরেকবার অন্যজনের। এই জায়গাটায় এসে, ছোটো করার খাতিরে, দুজনকেই ছাঁটাই করার বদলে, সম্পাদক আর আমি একটা কয়েন টস করলুম; আমরা বললুম, দুজনকেই একটু-একটু ছাঁটাই করার বদলে, ওদের যে-কোনো একজনকে চার মিনিট ছাঁটাই করে দেয়া যাক, যাতে মনে হয় সেটা একটাই শট। টস করার ফলে বাদ গেল বেলমোন্দো, টিকে গেল সেবার্গ।

বেলমোন্দোকে দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু দৃশ্যের বাইরে তার সংলাপ ছিল: ‘হায়! হায়! হায়! আমি একজন মেয়েকে ভালোবাসি যার গলা বেশ সুন্দর, বুক বেশ সুন্দর, কন্ঠস্বর বেশ সুন্দর, হাতের কবজি বেশ সুন্দর, কপাল বেশ সুন্দর, হাঁটু বেশ সুন্দর…কিন্তু সে বড্ডো ভীরু।’—এই সংলাপ যখন শোনা যায়, তখন দেখা যায়, চুরি করা গাড়িতে প্যাসেঞ্জার সিটে বসে আছে সেবার্গ; বেলমোন্দো গাড়িটা প্যারিসের রাস্তায় চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। একবার অভিনেত্রীর মাথা, আরেকবার সরাসরি আলোছায়া, পৃষ্ঠভূমিতে দাঁড়িয়ে-থাকা বা চলন্ত মোটরগাড়ির শটগুলোর একটা থেকে আরেকটার অসংবদ্ধতা গোদার-এর জাম্পকাট শৈলী প্রয়োগের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ, পরপর সাতটি অমন দৃশ্য দ্রুত ঘটে যায়।

অন্যান্য আলোচকরা এই জাম্পকাটকে জ়াঁ-পল বেলমোন্দো অভিনীত মিশেল পোইচা ওরফে ল্যাসলো কোভাক চরিত্রের সিনেমাটিক অভিব্যক্তি হিসাবে মান্যতা দিয়েছেন, যে চরিত্রটির বিবেকদংশন বলে কোনো ব্যাপার নেই; যে ঠান্ডা মাথায় একজন মোটরসাইকেল-আরোহী পুলিশকে খুন করতে পারে, কিংবা পেচ্ছাপখানায় একটা লোককে পিটিয়ে বেহুঁশ করে তার টাকাকড়ি নিয়ে কেটে পড়তে পারে। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে, ফাঁকফোকরগুলো মর্মার্থপূর্ণ, কেননা তা ফিল্‌মে চরিত্রগুলোর আচরণের সঙ্গে খাপ খেয়ে যায়। ফলে ফিল্‌মটাকে যেভাবে সম্পাদনা করা হয়েছে, আর চরিত্রগুলোর আচরণ চিত্রিত করা হয়েছে, তারা কাঠামোগতভাবে মানিয়ে গেছে।

যেমন ধরা যাক, ‘কাহিয়ে দ্যু সিনেমা’ পত্রিকার এপ্রিল ১৯৬০ সংখ্যায় লুক মোলে লিখেছেন, ‘যেহেতু ফিল্‌মের চরিত্রগুলোয় এক ধার থেকে প্রতিফলিত হয় নৈতিক জাম্পকাট, ফিল্‌মটি গড়ে উঠেছে জাম্পকাটের অনুবর্তীতা নিয়ে।’ নিউইয়র্ক টাইমস সংবাদপত্রে ‘ব্রেথলেস’-এর সমালোচনায় বোস্‌লে ক্রাউথার (১৯৬১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি), আরও মজাদার কথা লিখেছিলেন। ক্রাউথার এই পর্যালোচনাতে বলেছিলেন যে, বেলমোন্দো এমন একজন অভিনেতা যিনি সময় শুরু হওয়ার পর থেকে সবচেয়ে কার্যকর সিগারেট-ফুঁকিয়ে আর ঠোঁটে বুড়ো আঙুল ঠেকানো পুতুল। ক্রাউথারের মতে, “সংযোগহীন ছাঁটকাটগুলো গড়ে তুলেছে ছবির শ্রুতিকটুতা—যা ফিল্‌মটায় এই জন্য মানিয়ে গেছে যাতে যৌবনের জটিল উপাদানকে প্রদর্শনের করা যায়, যে যুবকেরা সব সময়ে অস্পষ্ট, অসন্তুষ্ট, পশু স্বভাবের এবং কারও বা কোনো কিছুকে পাত্তা দেয় না, এমনকি নিজেদেরও গুরুত্ব দেয় না।”

জাম্পকাটের সংকেতকে বিস্তারিত পাঠোদ্ধারের প্রয়াস করেছেন অ্যানি গোল্ডম্যান, ‘সিনেমা এবং আধুনিক সমাজ’ [Cinéma et société moderne (Paris: Denoël/Gonthier, 1971/1974), pp. 85-86.] পত্রিকায় প্রকাশিত আলোচনায়। গোল্ডম্যানের মতে, ব্যক্তি-এককের মাঝে সম্পর্ক প্রদর্শনের ক্ষেত্রে গোদার জাম্পকাট শৈলী প্রয়োগ করেননি; এই দৃশ্যগুলোতে, যেখানে মিশেল আর প্যাট্রিসিয়ার ভূমিকায় বেলমোন্দো আর সেবার্গ অভিনয় করছেন, সম্পর্ক চিত্রায়িত হয়েছে তাদের আদিম গুরুত্বের কারণে। কিন্তু যেখানে সামাজিক জগতকে চিত্রায়িত করা হয়েছে—যেমন পুলিশটাকে খুন করার—ফিল্‌মের উপস্থাপনে খাপছাড়া ভাব দেখানো হয়েছে, সম্পাদনা সেখানে হয়ে উঠেছে নির্বস্তুক, শটগুলোর মধ্যে তৈরি করা হয়েছে ফাঁকফোকর, কেননা মিশেলের দৃষ্টিতে সমাজের কর্তৃত্ব যারা করে তাদের প্রতিনিধিদের নিয়ে তৈরি ঘটনা গুরুত্বহীন। “কর্মকাণ্ডটাকে সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে, দ্রুততার ছাপ দেওয়ার উদ্দেশ্যে নয়, কারণ নায়ক ঘটনাটিতে আগ্রহী নয়। তার কাছে, এবং দর্শকদের কাছে, যারা জগতকে মিশেলের ভাবনা দিয়ে পরখ করছে, তাদের কাছে এইসব ঘটনাবলীর কোনো গুরুত্ব নেই, কেননা সমাজের ব্যাপারে মিশেল মাথা ঘামায় না। পরিচালক তাই এই দৃশ্যগুলোকে অবহেলায় তুলে ধরেছেন, এমনকি সময়ে-সময়ে দুর্বোধ্যভাবে।”

রিচার্ড রাসকিন বলেছেন, এটা দুর্ভাগ্যজনক যে, গোল্ডম্যান নিজের দাবি প্রমাণ করার জন্য বিভিন্ন দৃশ্যের আলোচনা করে দেখাননি, যেখানে জাম্পকাট প্রয়োগ করা হয়েছে আর যেখানে করা হয়নি, সেই দৃশ্যগুলোতে সামাজিক ও ব্যক্তিগতের ধারাবাহিকতা উপস্থাপন কেমন ভাবে করা হয়েছে। ব্যক্তি সম্পর্কের ক্ষেত্রে তিনি কেবল একটাই উদাহরণ দিয়েছেন এবং তা দিয়ে ফাঁকফোকর তৈরি আর ধারাবাহিকতা বজায় রাখার গোল্ডম্যান-মডেল প্রয়োগ করা যায় না।


পাঁচ.

গোদার-এর জাম্পকাটকে ফিল্‌ম তৈরির নতুন নান্দনিকতা হিসাবেও দেখা হয়েছে, সিনেমার থোড়-বড়ি-খাড়ার একঘেয়ে ডিসকোর্স থেকে মৌলিক পৃথগীকরণ, ভিন্ন পথ আবিষ্কার, এবং অন্যান্য শিল্পে যে বৈপ্লবিক শৈলী প্রয়োগ করে পরিবর্তন আনা হচ্ছে, ফিল্‌ম নির্মাণের ক্ষেত্রেও তাকে নিয়ে এলেন গোদার। ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৬১ সালে ফিল্‌মটি রিভিউ করে আমেরিকার ‘টাইম’ পত্রিকা লিখেছিল যে, ফিল্‌মের ভাষাতে গোদার নিয়ে এসেছেন কিউবিজম।

দুঃসাহসিকভাবে কিউবিক শৈলী প্রয়োগ করে গোদার একত্রিত করেছেন তাঁর ফুটেজ। প্রতি মিনিটে, অনেক সময়ে প্রতি সেকেন্ডে, তিনি ফিল্‌ম থেকে কয়েক ফিট ছাঁটাই করেছেন, তারপর পরিবৃত্তি ছাড়াই আবার জোড়া লাগিয়েছেন। তা সত্বেও কাহিনিকে অনুসরণ করা যায়, কিন্তু প্রতিটি ছাঁটাইয়ের দরুন ফিল্‌ম যেমন-যেমন তাল-ছন্দের অধৈর্য প্রবাহে এগিয়ে চলে, তা নায়কের অবধারিত অধঃপতনের অমোঘ পীড়াদায়ক সিঁড়িগুলোর ধাপের দিকে ইশারা করে। আরও সূক্ষ্মভাবে, কৌতুকটি সময়কে বিকৃত করে, পুনর্বিন্যাস করে, পুনঃব্যবস্থা করে—অনেকটা পিকাসো যেমন তাঁর পেইনটিঙ ‘আভিনঁর যুবতীরা’ (Les Demoiselles d’Avignon)য় পরিসরের হেরফের ঘটিয়েছেন। সমস্ত অর্থবহ ধারাবাহিকতা বিস্ময় সৃষ্টি করে।

‘ফিল্‌ম কোয়ার্টারলি’ পত্রিকার ১৯৬১ সালের বসন্ত সংখ্যায় ‘ব্রেথলেস’ ফিল্‌মের সমালোচনাকালে আরলেন ক্রোচে গোদারের সম্পাদনাকে তুলনা করেছিলেন জ্যাজ় সংগীতের সঙ্গে। তিনি বলেছিলেন যে, গোদার যে নান্দনিক শৈলী সৃষ্টি করলেন তা মর্মার্থ থেকে কিছুটা সরে গিয়ে ফিল্‌ম-মাধ্যমকেই আগ্রহের কেন্দ্র করে তুললেন । ‘ব্রেথলেস’ হলো পদ্ধতিগত কল্পনা, সিনেমাটিক জ্যাজ় সংগীত। ফিল্‌মটি দেখার সময়ে গোদারের প্রধান উদ্দেশ্যকে অনুভব করা যায়, তিনি সবার ওপরে সিনেমার একত্রিত টুকরোর স্বয়ংসম্পূর্ণ শৈলী গড়ে তুলতে চেয়েছেন—শট, ছবি, আইকনোগ্রাফি—যে সমস্ত উপাদান নিয়ে ‘কাহিয়ে দ্যু সিনেমা’ পত্রিকায় তাঁরা আলোচনা করতেন। গোদারের বাস্তব সব সময়ে সিনেমাটিক; ক্যামেরার উপস্থিতি রয়েছে সেখানে, সেলুলয়েডের দীর্ঘ ফাঁকফোকরের এলোমেলো বিচরণ কিংবা সংক্ষিপ্ত ঝাঁকুনি রয়েছে। সুষম ছাঁটাই আর ডিজল্‌ভ প্রায় নেই বললেই চলে; আর ছাঁটাইগুলো প্রায়ই এত দ্রুত যে, কয়েক মুহূর্তের জন্য দর্শক বিলকুল হতভম্ব হয়ে যান। যেমন ধরা যাক সেই দৃশ্যটি, যেখানে বেলমোন্দোর প্যারিসে আগমন দেখানো হয়েছে, এইভাবে: শহরের একটা লঙ শট, একটা গাড়ি এসে দাঁড়ায়, বেলমোন্দো টেলিফোন বুথে ঢোকে, ফোন করে, জবাব দেয় না কেউ, বেরিয়ে আসে, বেলমোন্দো একটা দরোজার সিঁড়িতে, একটুখানি সংলাপ, বেলমোন্দো কেয়ারটেকারের ডেস্কের ওপর থেকে চাবি চুরি করে, বেলমোন্দো ফ্ল্যাটের বাথরুম থেকে বেরোয়, বেশ দীর্ঘ একজন পুরুষ। কাটছাঁট করা এই সিকোয়েন্স এক মিনিটের কম দেখতে পায় দর্শক; কোনো অবস্থান্তর ঘটে না, কোনো ধারাবাহিকতা থাকে না। প্রায়ই ছাঁটাইগুলো একই শটের ভেতরে দেখা যায়। কেটে কিংবা প্যান করে, অ্যাকাডেমিক মন্তাজের শৈলীতে, কোনোরকম মর্মার্থ আরোপ করা হয় না। ব্যাপারটা স্রেফ সিনেমা জগতের। ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘দি কনটেমপোরারি সিনেমা’ গ্রন্থে পেনিলোপ হুসট্‌ন বলেছেন :

আমরা যা দেখতে পাই তা হলো পরিচালক আমাদের যা দেখাতে চেয়েছেন: যদি তাঁর মনে হয় কোনো অংশ বিরক্তিকর আর তা বাদ দিয়ে দিতে চান, তাহলে ধরে নিতে হবে যে, দর্শকরা সিনেমার প্রচল রীতিনীতির সঙ্গে তাঁর মতনই যথেষ্ট পরিচিত। নিঃসন্দেহে ‘ব্রেথলেস’ ফিল্‌মে, চরিত্রগুলোয় যে জীবনবোধ ও উদ্দীপনা গোদার আরোপ করেছেন, তার বাইরে তাদের অস্তিত্ব নেই। ফিল্‌মটি নিজেই একটি আধুনিকতাবাদী বা উত্তরাধুনিক শিল্পবস্তু; এবং অন্যান্য আধুনিকতাবাদী বা উত্তরাধুনিক শিল্পবস্তুর ক্ষেত্রে যা ঘটে, দর্শকরা পরিচালকের উত্তেজনার অংশভাক হয়ে ওঠেন; পর্দা আলোকিত হয়, সময়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষা, সিনেমার ভাষায় অনুসন্ধান ইত্যাদি তাঁদের মনেও পরিচালকের আহ্লাদ জাগিয়ে তোলে।

গোদারের নন্দনশৈলী হলো কাহিনি বা ন্যারেটিভ থেকে সরে গিয়ে তাৎক্ষণিক অভিজ্ঞতা সঞ্চারিত করার প্রয়াস, যা কিনা সিনেমাটিক ভাষার পটভূমিতে নির্মিত। ফিল্‌মটি সম্পাদনা করা হয়েছে, জাম্পকাটের দ্বারা, যাতে প্রথাগত সময়ানুক্রমকে ভাঙা যায় (আমরা একটি ঘটনার শুরু আর শেষটা দেখি কিন্তু মাঝখানটা দেখতে পাই না), আর বারবার দৃষ্টিকোণ ও স্থানকে বদল করা হয়। এই ধরনের কৌশল নিছক শৈলীগত অভিনবতা নয়। তা ফিল্‌ম তৈরির মনোভাবকে স্পষ্ট করে তোলে। পরিচালকের উদ্দেশ্য যদি হতো একটা বিরাট দর্শকদলকে টেনে এনে গল্প দেখানো, তাহলে তিনি দর্শকদের সাহায্য করতেন যাতে তারা সহজে বুঝতে পারে: যদি একটা চরিত্র দেখাতে চায় যে, সে কিছু একটা করতে যাচ্ছে, আর তারপর একটা ছাঁটাই এসে যায়, আমরা অপেক্ষা করি কখন সে সেই কাজটা করতে যাচ্ছে, আমরা সিনেমা দেখে-দেখে অমনভাবে চিন্তা করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। কিন্তু চিত্রনির্মাতা যদি গল্প নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে তত চিন্তিত না হন, দর্শকদের জড়িয়ে নেন ন্যারেটিভকে ছাপিয়ে গিয়ে একটা অভিজ্ঞতার সংবেদন উপভোগ করতে, জীবনে যে ধরনের গোলমাল আর অনিশ্চয়তা দেখা দেয়, তাহলে সেইসব প্রথাগত তারগুলোকে কেটে ঝুলিয়ে দেয়া চলে। ফিল্‌মটা নিজের যুক্তি খুঁজে পেয়ে তা দর্শকদের ওপরে চাপিয়ে দিতে সফল হয়।

সম্পাদনার সময়-প্রবাহে বিরামহীনতার মৌলিক নিয়মকে অস্বীকার করার গোদারীয় কর্মকাণ্ডকে সিনেমাটিক শিল্পে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসাবে দেখা হয়েছে। অন্য দৃষ্টিতে, বিশেষ করে ষাটের দশকের আগের সিনেমাটিক ‘ঐতিহ্য’ অনুসারী পরিচালক ও সমালোচকদের চোখে, যাকে মনে করা হয়েছে ধ্বংসাত্মক, এই তর্কে গোদারের জাম্পকাট একটি গঠনমূলক কাজ।

গোদার নিজে, অন্তত একবার যা বলেছেন, তা কিন্তু তত ইতিবাচক নয়, যতটা তাঁর গুণগ্রাহীরা জাম্পকাট প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তায় জোর দিয়ে বলেছেন। ‘ফিল্‌মস্‌ অ্যান্ড ফিল্‌মিং’ পত্রিকায়, অগস্ট ১৯৬১ সালে প্রকাশিত গর্ডন গাউকে ‘ব্রেথলেস’ সম্পর্কে দেয়া সাক্ষাৎকারে, তাঁকে যখন প্রশ্ন করা হয় যে, ‘ব্রেথলেস’ ফিল্‌ম তোলার সময়ে তাঁর মনে ঠিক কী কাজ করেছিল, তার জবাবে গোদার বলেছিলেন যে, তিনি কোনো নিয়ম মানতে চাননি, আর ফিল্‌ম তৈরি করার প্রচলিত নিয়মাবলীকে অস্বীকার করতে চেয়েছিলেন। তাঁর মতে ‘হিরোশিমা, মন আমোর’ হলো নতুন সিনেমার পথিকৃৎ, আর ‘ব্রেথলেস’ ছিল পুরোনো সিনেমার সমাপ্তি। তিনি ফিল্‌মটা তুলেছেন বাস্তব লোকেশানে আর বাস্তব ঘরে, কোনো স্টুডিওর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল না। পরে অবশ্য গোদার ফিল্‌ম স্টুডিওতে কাজ করেছেন আর জানিয়েছেন যে, স্টুডিওতে কাজ করার সুবিধাও আছে। ‘ব্রেথলেস’ ফিল্‌মে তিনি হ্যান্ড-ক্যামেরা ব্যবহার করেছিলেন, কেননা তিনি অধৈর্য চরিত্রের মানুষ, এবং যখন তিনি ছবি তোলার জন্য তৈরি, তখন তিনি ক্যামেরার অবস্থানের জটিলতা নিয়ে চিন্তা করতে চান না । আর ফিল্‌ম তোলা শেষ হবার পর, তিনি কাটছাঁট করেছিলেন সিনেমাটিক নৈরাজ্য আনার খাতিরে, আনতে চেয়েছিলেন প্রযুক্তিগত কালাপাহাড়ি। ওই একই সাক্ষাৎকারে গোদার বলেছেন যে, জাম্পকাট প্রয়োগ করার সময়ে তাঁর মাথায় অমন ধারণা ছিল না যে, ব্যাপারটা মিশেলের গোলমেলে মানসিকতার প্রতিনিধিত্ব করবে, তবে গোদার এ কথাও বলেছেন যে, চরিত্রটা স্বাভাবিক হলে তিনি টেকনিকটা তার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতেন না ।

অ্যানিয়েস গুইমো (Agnes Guillemot), যিনি ষাটের দশকে গোদারের অধিকাংশ ফিল্‌ম সম্পাদনা করেছিলেন বা গোদারের সঙ্গে সহ-সম্পাদনা করেছিলেন, তিনি ‘কাহিয়ে দ্যু সিনেমা’ পত্রিকার ১৯৯০ সালের নভেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত থিয়োরি জুস (Thierry Jousse) ও ফ্রেদেরিক স্ত্রস (Frédéric Strauss)কে দেয়া সাক্ষাৎকারে গোদারের অভিনব সম্পাদনা-শৈলী সম্পর্কে এই কথাগুলো বলেছেন : গোদার জাম্পকাটের বিশেষজ্ঞ নন, তিনি সিনেমার শ্বাসপ্রশ্বাসের বিশেষজ্ঞ, এবং এই দুটি ব্যাপার এক নয়। তাছাড়া সিনেমার শ্বাস নেয়ার ক্ষেত্রে সম্পাদকদের কাটছাঁটের তথাকথিত প্রথাগত রীতিনীতি ছিল একটা বিরাট বাধা। গোদার হলেন ফিল্‌ম নির্মাণে সাহস ও স্বাধীনতার বিশেষজ্ঞ। সম্পাদনার ক্ষেত্রে সিনেমা কেমন হওয়া উচিত সে-কথা মাথায় রাখতেন গোদার।



প্রচ্ছদ ও লেখায় ব্যবহৃত ছবি সৌজন্য : Pinterest.com, rialtopictures.com