নির্জন পরবাসে

আজও অনাহত আঙুলের স্নেহ মর্মরবীণা ঘিরে—
দেবশিশু ক-টি উড়তে চেয়েছে, অথচ ওদের ডানা
ধ্বস্ত কারও-বা, খসেছেও, কালপ্রহারচিহ্ন ধীরে
জানান দিচ্ছে শরীরে ওদের মৃত্যুর পরোয়ানা।

সমাধিতে কত গাছড়া, শিকড়—কে বলবে মুখ ফুটে
শাতন কোরো না পক্ষ ওদের, চিন্ময় উৎসবে
যোগ দেবে ওরা, এ-ওকে কেমন ধরলেও পিছু ছুটে,
লোরেলমুকুটে রম্য সবাই নির্জন কলরবে।

কারও শির, কারও বাঁশি, করতলে চিড় ধরে বহু অংশ
কীটাণুর বাসা, উচ্ছ্বাসহীন ফোয়ারাও ব্যবধানে—
বাহারি গাছের কেয়ারি দিয়েও আড়াল হয়নি ধ্বংস,
পশু-পাখি-নাগ-কেন্নো-কেঁচোর স্বর্গ এ-উদ্যানে।

সমাধিফলকে পাখিরা আঙুলে গায় নিজেদের ভাষা,
উঁকি দেয় শুধু রাতের আকাশে মাঝে মাঝে জিজ্ঞাসা।




দু-টি রঁদো

১. কিংবদন্তি

দ্যাখো ওই মাস্তুল—কত ঝড়, অশনি
পেরিয়ে সে আস্তরে ঢাকা আজ, শান্ত!
একদিন সাগরের ঝড়ে দিগ্‌ভ্রান্ত
নৌজীবী ডেকেছিল, ‘পার করো জননী—
দেব পাল, মাস্তুল, বাঁচালে গো তরণি!’

জলে জ্যোতি অদ্ভুত—স্বপ্নেও দান্ত
জোয়ান ডা ক্রুশো যেন শুনলেন তখনই,
‘ওই যে মা ফিরছেন, বাঁচালেন প্রাণ তো’—
    দ্যাখো ওই মাস্তুল।

ঠিক সেই ভোরবেলা দ্বারে এল জননী—
জেলেদের হাতে এক মূর্তি প্রশান্ত!
উৎসব ক-দিনের হয়ে এলে ক্ষান্ত,
গির্জার কাছাকাছি দেখা গেল তরণি—
ওরই গুণবৃক্ষটি বুকে নেন অবনি;
    দ্যাখো ওই মাস্তুল।


২. বিনশ্বর

ফল এসে ঝরে যায় ক্ষত নিয়ে আবরণে,
গাঁ উজাড় হয়ে গেল, নদী বয় আনমনে,
ঝিম মেরে থাকে দিলকিতাবের লিপি, আর
বহুরূপে হয়ে গেছে শতমারী ব্যবহার—
প্রতিদিন বিনাশের তিল তিল আয়োজনে।

কথাসব যদি আজ সময়ের আলোড়নে
আমাদের বুলি হয়ে ওঠে তার অকথনে,
কাল তবে হয়ে থাকে আমাদের কথাকার,
   ফল এসে ঝরে যায়!

অজাগর তারাদের অতিকায় শবাসনে
জ্বলে যায় গ্রহদীপ, দেখা হল হুতাশনে
রণচোয়ালের ফাঁকে দেশমুখ কদাকার;
কুঠারের আঘাতেও উঠেছিল হাহাকার
বসতির মরশুমে একদিন বনে বনে—
   ফল এসে ঝরে যায়।




মৃত্যুর অসিত লিপি

পরিচিত দৃষ্টি সেই শান্ত অপলক—
চলকে দেয় অকস্মাৎ নিথর যাপন,
মৃত্যুর অসিত লিপি: স্মৃতির ফলক
বিশ বাঁও নীচ থেকে হলে উদ্‌ঘাটন।

তামাদি হয়েছে কত মহার্ঘ বাচন,
করতলে নিয়েছিল যারা আমলক
স্নান সেরে তমসায়—একই নির্বাসন
শোণিতপ্রবাহে তাঁরও, তেমনই হলফ।

সময়ের গ্রন্থি খুলে পুরাণে আবার—
যা গেছে হারিয়ে তার কিছু কি পেলেন,
দিন যত ঢলে রোজ আয়ুর নিয়মে?

চোখ গেল, দ্রুত সব ঘটনার ক্রমে
লঘু হল চলাচল, দূরভাষে তাঁর
ব্যক্ত হতে চেয়ে শেষে অব্যক্তে মেলেন।




পিতামহীর পত্র লেখা

চিঠির কথা বলতে গেলে তোমার মুখ জাগে।
পোস্টোকাডে লিখতে বেশি, ঠাকুরঘরে, জানি—
দোয়াত-কালি-কলম নিয়ে গভীর অনুরাগে,
সকালবেলা পুজোর পরে, দেবী হে বীণাপাণি।

তোমার সাথে লিখব চিঠি—আঁচল টানাটানি,
বায়না বুঝে তখন তুমি দিতেও অবশেষে
উলটো পিঠে; টেবিল হত তোমার পাঁজিখানি,
কলম-কালি আমার শিশুমুঠির মাঝে এসে।

পূর্ণযতি দ্বৈত হয়ে চিঠির প্রতিবেশে
মোহর হয়ে থাকত সেই সাবেক প্রণালীতে;
বাঁকড়ো যেত, হাজারিবাগ—সুতার সন্দেশে,
বিশেষ কথা নজরটানে ফুটত লেখনীতে।

নেই সে ঋজুলিপির কোনো বয়ান, আর তুমি,
কালের স্রোতে জমায় পলি দীন এ মনোভূমি।




মায়ের দেশের সহজ পাঠ

ছিল কৌতুক আর পিঠোপিঠি বিন্নির সাদা খই
ছিল গোচারণ, বিনি পিসি আর জল নিতে আসা বামী
ছিল সোলেমান, আবদুল মিয়া, বর্ষার পদ্মাও
ছিল পারাপার বুড়িগঙ্গায়, বেণুবন, কালো মেঘ

ছিল বৈরাগী, কালীকীর্তন, বিবাহের চিরগান
ছিল পির আর সিন্নিও ছিল মসজিদ, জয়নাল
ছিল আমবন, মেহগনি, খাট-পালঙের আতাফল
ছিল লন্ঠন, গোল হয়ে বসা গল্পের পিতামহী

ছিল পাঠশালা, গোলাঘর, ছিল কথকতা, হরিহর
কাকাতুয়া আর জাব-দেওয়া, গোরু ফিরে-আসা ঠুনঠুন
ছিল সারমেয় নীল লুব্ধকে উজ্জ্বল উত্তাপ
ছিল রাত্রির সেই নিশিডাক আর জ্যোৎস্নায় বুজরুক

ছিল ফার্স্টবুক আর আঁক কষা, লাল অভিমান টিয়াঠোঁট
ছিল হার—সাত লহরার, ছিল অম্বরে সারিগান




প্রচ্ছদচিত্র সৌজন্য: www.pinterest.com