প্রথমেই আপনার ছোটবেলার কথা, আপনার পড়াশোনা ও বড় হয়ে ওঠার কথা জানতে চাইছি।

আমার নাম অসীমকুমার হালদার। আমি বহরমপুর (ধনিয়াখালি, হুগলি) গ্রামের বাসিন্দা। আমার পিতৃপরিচয় দিচ্ছি। আমার বাবার নাম হচ্ছে পাঁচুগোপাল হালদার। মায়ের নাম নীলিমা হালদার। আমার দাদু ছিলেন বিধুভূষণ হালদার। ঠাকুমা ছিলেন ঊষারানি দেবী। আমরা তখন জয়েন্ট ফ্যামিলিতে ছিলাম। একান্নবর্তী পরিবার। আমার বাবারা চার ভাই। আমার বাবা ছিলেন বড়। আমার বাবা সার্ভিস করতেন পোস্টাল ডিপার্টমেন্টে। আমার মেজো কাকা ছিলেন জুনিয়র বেসিক স্কুলের টিচার। সেজো কাকাও পোস্টাল ডিপার্টমেন্টে কাজ করতেন। আবার ছোট কাকা ছিলেন ইস্টার্ন রেলওয়ের বুকিং ক্লার্ক। দাদু ঠাকুমা মারা যাওয়ার পর একান্নবর্তী পরিবারটা ছোট হয়ে যায়। যে যার সংসার হয়ে যায়। বাবার একটা সংসার, মেজো কাকার সংসার, সেজো কাকার সংসার, ছোট কাকার সংসার। এরকম। আর সে-ই সময় জমিজায়গা সব একজায়গায় ছিল। আলাদা হয়ে যাওয়ার পর সব ভাগাভাগি হয় বাবা-কাকাদের মধ্যে। অল্প জমির মালিক ছিল আমার বাবা-কাকারা।

আমি আমার গ্রামের স্কুল, এই পশ্চিম বনপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। পরে আমি যাই কানানদী জুনিয়র বেসিক স্কুলে। ওখানে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়াশুনো করি। ক্লাস সিক্সে ভর্তি হই দেধারা হাই স্কুলে। ওখান থেকেই ১৯৭২ সালে হায়ার সেকেন্ডারি পাস করি।

আমি যখন ক্লাস সেভেনের ছাত্র তখন থেকেই নাটক, অভিনয়, নাটক দেখা, যাত্রা দেখা, যাত্রাভিনয়ের প্রতি আমার তখন থেকেই একটা আগ্রহ… আকর্ষণ ছিল। এবং আমি ক্লাস সেভেনে যখন পড়ি তখন দেধারা হাই স্কুলের বাৎসরিক অনুষ্ঠানে একটা নাটক অনুষ্ঠিত হয়। নাটকটা ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘অচলায়তন’। ওই নাটকে আমার জীবনে প্রথম অভিনয়। একটা ছোট্ট চরিত্রে অভিনয় করি। কোন চরিত্র মনে নেই। তারপর আমি যখন ক্লাস নাইন টেনের ছাত্র, আমার এক পরম-আত্মীয়, সম্পর্কে আমার মামা হন, তপন বন্দ্যোপাধ্যায়, উনি মারা গেছেন, ওঁর নির্দেশনায় আমি গ্রামেতে বেশ কিছু নাটকে অভিনয় করি। তখন আমার ছাত্র জীবন।

১৯৭২ সালে হায়ার সেকেন্ডারি পাস করার পর আমি বিএ পড়ার জন্য ভর্তি হই শ্রীরামপুর কলেজে। তা, ওই কলেজ থেকে আমি বিএ পাশ করি ১৯৭৫ সাল। পাস করার পর আমার নাটক শেখা। তবে, ওখানে বাংলার শিক্ষক ছিলেন অশোক পালিত, তিনি টিভি-রেডিওয় প্রোগ্রাম করতেন। ওঁর সান্নিধ্যে এসে নাটক বিষয়ে অনেক কথা প্রথম শুনি। উনিই বলেন, ‘ভালো অভিনয় করতে হলে ভালো জায়গায় যেতে হবে। প্রত্যন্ত গ্রামে পড়ে থাকলে হবে না। গ্রাম ছেড়ে শহরে যেতে হবে তোকে। তুই গ্রুপ থিয়েটারে যা।’ অ্যামেচারে আমি নাটক করতাম বটে কিন্তু আমার মন ঠিক সে-ই ভাবে সায় দিত না। ভাবতাম বোধহয় অনেক কিছু শেখার বাকি আছে। সেখানে আমি ঠিকমতো শিখতে পারছি না গুরুর অভাবে। যার জন্য মন ছটফট করত। আমি কলকাতা গ্রুপ থিয়েটারে যোগাযোগ করে ক্যালকাটা এপিক থিয়েটারে চান্স পাই, ওটা ১৯৭৫ সাল।

বাড়ির অভিভাবকরা আপনার মত মেনে নিলেন?

নাটকের ব্যাপারে মেনে নিয়েছিল। বাবার বন্ধু ছিলেন, তিনি বলেছিলেন, ইটাচুনায় ওঁর কলেজে ট্রেনিং নিয়ে স্কুলমাস্টারি করতে। আমার মেজো কাকা তখন স্কুলমাস্টার। আশি টাকা মাইনে পেতেন। বাবা বললেন, ‘ও তোকে শেষে ভিক্ষে করতে হবে। মাস্টার হয়ে লাভ নেই।’ প্রথম কথা আমার বাবার বাসা ছিল বালিগঞ্জ কসবাতে। বললেন, ওখানে থাকবি। দেখ নাটক-ফাটক শিখে কিছু যদি করা যায়। মোটামুটি আমি ওখানে (ক্যালকাটা এপিক থিয়েটারে) অভিনয় করি ১৯৮০ সাল পর্যন্ত। তারপর আমি যাত্রা জগতে চলে আসি।

হঠাৎ করেই চলে এলেন, না কোনও পরিকল্পনা ছিল?

এর কারণটা বলতে… তখন আমাদের যিনি ডিরেক্টার ছিলেন ক্যালকাটা এপিক থিয়েটারে, দেবেশ চক্রবর্তী, মনে হয় উনি এখন বেঁচে নেই, আমার সঙ্গে আর সে-ই ভাবে যোগাযোগ নেই, উনি বলেছিলেন, ‘তোর যাত্রার প্রতি একটা ন্যাক আছে, তোর অভিনয়ে সেটা ধরা পড়ে। তুই এক কাজ কর, ওখানে পয়সাকড়ি আছে। গ্রুপ থিয়েটারে আমরা তো ঠিকমতো পয়সা দিতে পারি না।’ তখন অ্যাকচুয়ালি আমরা যে গ্রুপ থিয়েটার করেছি শেখার জন্য, মানে ওখানে গিয়ে যে ঠিকমতো ইনকাম, সে-ই ইনকামের ব্যাপারটা ছিল না। এখন কিন্তু গ্রুপ থিয়েটারে একটু পরিস্থিতি বদলেছে… পঁচাত্তর সাল ছিয়াত্তর সাল… তখন পয়সাকড়ি পাওয়া যেত না। নিজের পয়সা খরচা করে শিখতে হতো। অভিনয় শিখতে হতো।

তার মানে ততদিনে আপনি যাত্রা দেখা বা অভিনয় অল্প কিছু করেছেন?

হ্যাঁ। দেখছি, করছি। যখন থিয়েটার থাকে না, তখন আমি বাড়ি চলে আসি। তখন বিভিন্ন অ্যামেচারে আমি কিন্তু শো করি, কল-শো করি। প্রথম আমি যাত্রা করি আমারই গ্রামে। মঞ্চস্থ হয়েছিল ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘বেদনাহত নয়নতারা’। আমার পাশের বাড়ির একজন অভিনেতা সে হঠাৎ যাত্রার দিন অসুস্থ হয়ে পড়ে। আমি বাড়িতে বসে আছি। ক্লাবের ছেলেরা আমায় এসে ধরল যে, তুই তো নাটকের সঙ্গে যুক্ত আছিস, খুব একটা বড় ক্যারেক্টার নয়। ক্যারেক্টারটা তুইই করতে পারবি, নইলে তো আজ যাত্রা বন্ধ হয়ে যাবে। এরম পরিস্থিতি। তখন আমি চিন্তা করতে পারছি না। আমি তো যাত্রা কোনওদিন করিনি। আমি স্টেজে উঠে ঠিকমতো অভিনয় করতে পারবো কিনা ভাবছি। তখন বাবা বললেন, ‘করে দে না, নইলে গ্রামের অনুষ্ঠান, বহু জায়গা থেকে লোকজন আসে এখানে দেখতে, নষ্ট হয়ে যাবে অনুষ্ঠানটা!’ আমি রাজি হলুম। ওরা বইপত্র দিয়ে গেল আমাকে। পার্টটা দেখলুম। একটা সামাজিক ক্যারেক্টার। বইটা ঐতিহাসিক, কিন্তু আমার ক্যারেক্টারটা সামাজিক একদম। দুলাল বলে চরিত্রটার নাম। সে-ই চরিত্রে আমি প্রথম অভিনয় করি। এবং বললে বিশ্বাস করবেন না, ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পার্টটা মুখস্থ করে নিয়ে আমি যে অভিনয় করেছি, তাতে আমি প্রচণ্ড প্রশংসা পাই। সে-ই থেকে যাত্রা করার নেশাটা আমায় পেয়ে বসেছিল। বুঝছেন তো? যাত্রা করার নেশাটা আমায় পেয়ে বসল। তারপর থেকে বিভিন্ন ক্লাবে আমি যাত্রা করেছি।

আরও শুনতে ইচ্ছে করছে। কোন কোন গ্রামে যেতেন? কীভাবে কাজটা করতেন? কখন রিহার্সাল দিতেন?

আমি তো কলকাতায় গিয়ে রিহার্সাল দিতাম, ওখানে নাটক তো প্রতিদিন নয়, হয়তো সপ্তাহে দুটো শো হতো। রিহার্সাল একটা টাইমে হয়ে যেত, তারপর শোয়ের ব্যাপার ছিল। তখন একটা নাটক বহুদিন ধরে হতো। কলকাতায়, গ্রুপ থিয়েটারে। তা যখন আমি বাড়ি আসতাম কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমি বিভিন্ন অ্যামেচার ক্লাবে—কখনও ধরুন দশঘরা, (কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে) ধনেখালি ব্লকের বিভিন্ন ক্লাব… বেশ কিছু ক্লাবের সঙ্গে আমি যুক্ত ছিলাম। বর্ধমান জামালপুর, সাতগেছিয়া গেছি শেখাতে। এবং বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক যাত্রা আসরে আমি বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে অভিনয় করেছি। সাফল্যের সঙ্গে অভিনয় করে সেখানে পুরস্কার পেয়েছি—নাইট বেস্ট, অল নাইট বেস্ট।

গ্রামের ক্লাবগুলি বাইরে থেকে অভিনেতা ডাকতো কেন?

বিভিন্ন ক্লাবগুলো ডাকতো-মানে ওই এলাকায়, যেসব এলাকায় আমি অভিনয় করতাম, হয়তো ওদের মনের মতো আর্টিস্ট পেতো না। আমার মোটামুটি… একটা গ্রামীণ এলাকায় দু-চার পালা অভিনয় করার পর, একটা মোটামুটি সাড়া ফেলেছিলাম। যে এখানে এক ভালো অভিনেতা কাজ করছে। যার ফলে বিভিন্ন জায়গা থেকে আমার এই ডিমান্ডটা আসতো।

তখন কি পারিশ্রমিক দেওয়া হতো অ্যামেচার যাত্রাপালায় অভিনয়ের জন্য?

না, না। একেবারেই না। কোনও পারিশ্রমিক আমি পেতাম না। একেবারেই অ্যামেচার। গ্রাম কালেকশন মানে গ্রাম্য চাঁদা আর নিজেরা যারা অভিনয় করত তাদের চাঁদা সিস্টেম থাকত। এই… এই চাঁদা দিতে হবে। আমাকে চাঁদা দিতে হতো না। এইটুকুই যা। আমাকে কোনও চাঁদা ফাঁদা দিতে হতো না। আমি শুধু অভিনয়টা করে দেবো। এই ব্যাপার।

এমন কিছু যাত্রাপালার নাম মনে পড়ছে যেগুলো তখন এইভাবে অভিনয় করেছেন?

অ্যামেচার যাত্রা হতো তখন মূলত চৈত্র-বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে। অ্যামেচারে আমি বাইরে করেছি বহু যাত্রাপালা। যেমন ধরুন ‘নাঙ্গা তলোয়ার’, ‘মা ও ছেলে’, ‘রাজবন্দী’, ‘মহালগ্ন’… তারপর হচ্ছে আপনার ‘ময়ূর মহল’,‘জমিন আসমান তারা’, ‘একটি পয়সা’ বহু বহু নাটক। অ্যামেচারে করেছি ‘রক্তে বোনা ধান’।

এর মধ্যে কোন যাত্রাপালার অভিনয় আপনাকে পরিচিতি এনে দেয়? কোনও নির্দিষ্ট পালার কথা মনে আছে?

হ্যাঁ। একটা বিরাট সাড়া জাগিয়েছিল, একটা বই। লব্ধপ্রতিষ্ঠিত নাট্যকার কানাই নাথ। কানাই নাথের লেখা—‘মা ও ছেলে’। ‘মা ও ছেলে’ বইতে, চরিত্রটার নামটা মনে নেই, নায়ক চরিত্র। ওই ক্যারেক্টারটা করে আমি বিরাট সাফল্য পেয়েছিলাম। এবং ধনেখালি ব্লকে ওই ক্যারেক্টারটা করার পর, ব্লকের মানুষ আমায় চিনে ফেলেছিল, মানে যারা যাত্রামোদী মানুষ। বেশ কয়েকটা জায়গায় ওটার শো হয়েছিল। নাইট বেস্ট, অল নাইট বেস্ট পুরস্কারও পেয়েছি। ওই নাটকটা, আমার অ্যামেচার যাত্রা করতে এসে, মানে ‘মা ও ছেলে’ যে নাটক, আমার… কী বলব, যাত্রা জগতে আমার একটা উত্থান! আমি তখনও পেশাদার (যাত্রার) জগতে ঢুকিনি। তখন আমি নাটকের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। তারপরে যখন এইভাবে নামডাক হয়ে গেল আমি পেশাদার যাত্রায় গেলাম।

আচ্ছা, পেশাদার যাত্রার প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে একটা প্রশ্ন করছি। যাত্রায় তো বিশেষ ঘরানায় অভিনয় হয়। আপনি যখন অ্যামেচার যাত্রা করছেন তখন ডিরেক্টর হিসেবে কাদের পেয়েছেন? নাটক আর যাত্রাভিনয়ে পার্থক্য কোথায়?

অ্যামেচার যাত্রায় যাঁকে প্রথম গুরু হিসেবে পেয়েছি, আগেই আমি বললাম, সম্পর্কে আমার মামা হন। তপন বন্দ্যোপাধ্যায়। মারা গেছেন। ওঁর কাছেই আমার হাতেখড়ি। যাত্রায়। বুঝলেন? ওঁর কাছেই আমার শিক্ষা। আর জগন্নাথ ভট্টাচার্য বলে একজন ছিলেন, দশঘরাতেই বাড়ি। হাই স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। ওঁর কাছেও আমি শিখেছি। যাত্রা কীভাবে করতে হয়। অ্যামেচার এই ভাবেই শেখা। তারপর পরিচালনার দায়িত্ব বিভিন্ন ক্লাব আমার উপর দিতে থাকে যে—আপনিই পরিচালনা করবেন নাটক। বেশিরভাগ অ্যামেচার যাত্রায় যে অভিনয় করেছি, আমার নিজের নির্দেশনায়। নিজেই কাজ করা শুরু করেছি। নিজে ডিরেকশন দিতে শুরু করেছি, তখন, ধরুন ১৯৮৭ সাল হবে। মূল পার্থক্য ধরুন সংলাপ বলাতেই। নাটকে সংলাপ ছোট ছোট করে ভেঙে বলে। যাত্রায় রাবারিং করে। স্পেস নিয়ে টেনে বলে। নাটকে বলবে (অভিনয় করে দেখান) ‘আমি’, যাত্রায় বলবে ‘আমিইই’। থিয়েট্রিক্যাল অভিনয় নরম্যাল, যাত্রার অভিনয় লাউড। একটার মঞ্চ ছোট, বড়জোর দু-হাজার দর্শক, কাছেই আছে সবাই। আর একজনের সামনে দশ হাজার দর্শক, তিন দিক খোলা। ন্যাচারেলি লাউড অ্যাক্টিং না করলে শেষের লোকটা বুঝতে পারবে না। তারপর তখন মাইক্রোফোনও আসেনি পেশাদার জগতে। আগেকার দিন চলে গেছে। এখন মাইক্রোফোন এসে গেছে। যাত্রায় লাউড অ্যাক্টিং উঠে গেছে প্রায়। তবে ধারাটা থেকে গেছে বলেই যাত্রার অভিনয় অন্যরকম আশা করে দর্শক। যাত্রায় মাইক্রোফোন ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন স্বপন কুমার। মাইক্রোফোন চাই। মানে দর্শকের আসনে লাস্ট যে ম্যানটা বসে আছে তার কানে গিয়ে যেন আমার সংলাপটা বেঁধে। এটা করতে হলে স্পিকারের দরকার। যখন ছিল না মানুষ করেছে। এখন সময় আলাদা। মেনে নিতে হবে।

যাত্রা মঞ্চ তো থিয়েটারের চেয়ে আলাদা। একজন নতুন অভিনেতা কী কী জানবেন অভিনয় করার আগে?

রস্ট্রাম সহ তিনদিক খোলা মঞ্চ বললেই সব মিটে যায় না। ক্রিকেট খেলা বা ফুটবল… একটা মাঠের ভাগ থাকে। সেখানে পজিশন আছে। পজিশন নিয়ে খেলে। মঞ্চ ঠিক তেমনি। একটা স্টেজকে ন-ভাগে ভাগ করে নিই আমরা। লেফ্‌ট-আপ, লেফ্‌ট-সেন্টার, লেফ্‌ট-ডাউন। রাইট-আপ, রাইট-সেন্টার, রাইট-ডাউন। মিড-আপ, মিড-সেন্টার, মিড-ডাউন। ডায়লগ যেমন, তেমন করে অভিনেতাকে সেইসব ভাগে গিয়ে দাঁড়াতে হয়। হুগলির বহু ক্লাবে, বর্ধমানের বহু ক্লাবে যখন শেখাতে গেছি এই ভাবেই শিখিয়েছি। সব কিন্তু সে-ই… এই নিয়ম ফলো করে। এটা আমার গর্ব, আমার গ্রামেতেই আছে। তথাকথিত অশিক্ষিত। স্কুলে পড়েনি, নাম সই করতে পারে না। অথচ তারা দিনের পর দিন যাত্রা করছে। অভিনয় জানে। লক্ষ্মীনারায়ণ দাস, নিমাই ঘোষ। আমার ডিরেকশনে তারা উইথআউট প্রম্পট অভিনয় করেছে। তারা প্রথমের দিকে ভয় পেয়েছিল। তারা বলেছিল, আমরা তো প্রম্পট শুনে যাত্রা করেছি, আমরা কী পারবো? কিন্তু পরে উচ্চপ্রশংসিত হয়েছে। এবং চ্যারিটি শো। মানুষ টিকিট কেটে এদের যাত্রা দেখেছে। এটা আমার বিরাট গর্ব। মানুষ তাজ্জব হয়ে গেছে। এবং এরা কেমন করে পার্ট মুখস্থ করত? কোনও সহ শিল্পী হয়তো পড়ে শোনাত। বাড়ির যে পড়তে জানে পড়ে শোনাত। শুনে শুনে মুখস্থ করত। আর আমার নির্দেশ ছিল, তোমরা যে কাজ করো না কেন, হয়তো মাঠে লাঙল দিচ্ছ, বারবার ডায়লগ বলবে। কাজ করবে আর বলবে। দেখবে আলাদা ইন্টারেস্ট পাবে। আমি দেখেওছি, নিমাই ঘোষ লাঙল দিতে দিতে ডায়লগ দিচ্ছে। এই অনুশীলনের বিকল্প নেই। আমার এলাকার ছেলেরা অভিনয় করেছে পেশাদারের মতো। তাই মানুষ টিকিট কেটে দেখতে এসেছে। এখানে আমার লেখা ‘মহালগ্ন’ নাটকে আমিই প্রথম চ্যারিটি শো করি। তখন ১৯৮২ সাল। তখনকার দিনে… পেশাদারে তখন পাঁচ টাকা টিকিট। আমরা শো করেছি তিন টাকা টিকিটে। তখন আমাকে ধনেখালির তথ্য সংস্কৃতি দপ্তরের লোকেরা বলেছে, ‘সাংঘাতিক সাহস আপনার, কোথাও দেখি না অ্যামেচার শোয়ে চ্যারিটি হয়। আপনি অসম্ভব একটা কাজ করেছেন।’ আমার দেখাদেখি দশঘরাতে শুরু হলো। আর একটা কাজ করেছি, শুধু মেয়েদের দিয়ে যাত্রা করিয়েছি, ২০১০ সালে। এখানে, ধনেখালিতে। সব লোকাল মেয়ে। বারো-চোদ্দজন ছিল ওরা। ‘কান্নায় ভেজা স্বর্গের সিঁড়ি’। আমার স্ক্রিপ্ট। আমার স্ত্রীও ছিলেন দলে। এখন যে সাব সেন্টার হয়েছে হেলথের, সে-ই দিদিমণি ক্যারেক্টারটাকে তুলে ধরেছি। সে-ও সাড়া ফেলেছিল। যাই হোক, আগেকার ডিরেক্টররা সব শেখাত। এখন কেউ যাত্রা জগতে গেলে শিখে যেতে হবে। ফিনিশ্‌ড আর্টিস্টকে যেতে হবে। সব জেনে যেতে হবে। ওইভাবে হাতেখড়ি দেওয়ার সুযোগ আর নেই। এখন ডিরেক্টর বলবেন, আপনি লেফ্‌ট-আপে চলে যান। নোটেশন করে দেবে, সংলাপের পাশে। আপনি রাইট-ডাউনে বসুন। আপনাকে লিখে নিতে হবে। ওরা বলে দেবে না কোনটা লেফ্‌ট-ডাউন। আমরা যে সময় ঢুকেছিলাম সে সময় হাতে ধরে দেখিয়ে দিতেন ডিরেক্টররা।

আপনার প্রথম নির্দেশিত যাত্রাপালার কথা শুনতে ইচ্ছে করছে।

আমি প্রথম ডিরেকশন দিই… ‘শেষ উত্তর’ বলে একটা বই ছিল, চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা। ‘শেষ উত্তর’ যাত্রাপালা আমার প্রথম ডিরেকশন। এবং সে-ই বইটা আমার গ্রামেতেই মঞ্চস্থ হয়। তারপর টোটাল গ্রামে যত অভিনয় হয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে আমার নিজের ডিরেকশনে। এবং এই সুবাদে বাইরে থেকে আমার কাছে কল আসতো। অভিনয় এবং ডিরেকশনের জন্য।

আমার নিজের গ্রামে দেখেছি, যাত্রার ডিরেক্টর মানে মাস্টারমশাইরা, সাম্মানিক পেতেন। সে-ই বিষয়ে যদি একটু ধারণা দেন।

পেয়েছি। তবে সেটা বলার মতো নয়। তবে অনেকের কাছেই চাইতে পারিনি। সামান্য সাম্মানিক। হাতখরচা একটা পাওয়া যেত। তাতে যে সংসার চলবে এমন নয়।

তখন কী অ্যামেচার যাত্রায় মেয়েরা আসতে শুরু করেছে?

আমি যখন প্রথম যাত্রায় অভিনয় করি, তখন ছিল ‘মেল ফিমেল’—মানে ছেলেরা মেয়ে সেজে অভিনয় করত। বাইরে থেকে মেয়েরা আসতো না। যখন ডিরেকশন দিয়ে যাত্রা তৈরি করলুম, ওই ‘শেষ উত্তর’, তখন মেয়েরা আসতে শুরু করেছে। বাইরে থেকে মেয়েরা আসতো। হয়তো চারটে মহিলা ক্যারেক্টার আছে, নারী চরিত্র। সেখানে দেখা যাচ্ছে দুটো মেয়ে বাইরে থেকে আসছে। দুটো ‘মেল ফিমেল’ দিয়ে অভিনয় হচ্ছে। আস্তে আস্তে চার-পাঁচ বছর যাওয়ার পর দেখেছি, ‘আঁধারের মুসাফির’-এ সমস্ত অভিনয় যখন করছি ১৯৯০, ’৯১-’৯২ সাল, এমন হবে, তখন দেখেছি বাইরে থেকে মেয়েরা আসতে শুরু করেছে।

এবার আমরা আপনার পেশাদার যাত্রাদলে কাজের অভিজ্ঞতার কথা শুনব।

আমি যখন গ্রামে অভিনয় করছি বা কলকাতা গ্রুপ থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত আছি, তখনই কিন্তু আমার নাটক লেখার অভ্যাসটা দাঁড়িয়ে গেছে। আমি কিন্তু তখন থেকেই যাত্রা-নাটক লিখতে শুরু করেছি। দু-একখানা নাটক আমি লিখেছি। সামাজিক নাটক। তা, থিয়েটার জগৎ থেকেই আমার এক বন্ধু, তার বাড়ি হচ্ছে খিদিরপুরে, সমীর দাস ছেলেটির নাম, ও বলল তুই এক কাজ করগে যা, কলকাতায় ‘নিউ শ্রীমা নাট্য কোম্পানি’ নামে একটা দল নতুন খুলছে, ১৯৮০ সাল ওটা, ওখানে ওরা আর্টিস্ট নেবে, ভালো বই চাইছে, ডিরেক্টর চাইছে। আমি তখন বিভিন্ন ক্লাবে ডিরেকশন দিচ্ছি। আমি ওই বন্ধুটিকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে, শ্রীমা নাট্য কোম্পানির যে মালিক, বাবলু বর্মণ, ওর সঙ্গে আমি দেখা করলুম। বললে, ঠিক আছে আপনার নাটক নিয়ে আসুন। আমার লেখা নাটক ছিল ‘রাজনন্দিনী’। সামাজিক বই। বললেন, ‘…নিয়ে আসুন। আপনার নাটক দেখি। তারপর আপনার সঙ্গে কনট্যাক্ট করব। তারপর দেখব, আপনি আমার দলে অভিনয় করবেন কিনা।’ উনি পনেরো দিন টাইম নিয়েছিলেন। উনি যোগাযোগ করলেন, বললেন, আপনি আসুন। আমার সঙ্গে কথা বলুন। (গিয়ে দেখা করাতে) বললেন, ‘আপনার নাটক আমার পছন্দ হয়েছে। আপনাকেই ডিরেকশন দিতে হবে। আর এতে আপনাকে মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করতে হবে।’

১৯৮০ সাল। ‘রাজনন্দিনী’ বইতে আমি একটা ছোট চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম। মি. সুইফ বলে ক্যারেক্টারটা। সে-ই থেকে আমার পেশাদার জগৎ শুরু হয়ে গেল। আমার নিজের লেখা নাটক, নিজের ডিরেকশন, এবং মুখ্য চরিত্রে আমি! বুঝলেন? তার পরের বছর, ওই একই দল, মালিকপক্ষ আমাকে বলল, আপনার লেখা বই আমরা করব। আপনি বই দিন। আপনাকে থাকতে হবে মেইন চরিত্রে। এবার আমি বই দিলাম ‘কামিনী-কাঞ্চন’। ওটা ১৯৮১। ১৯৮২ থেকে বিভিন্ন রকম দল বদলের ব্যাপার হয়ে গেল। তখন আর কোনও দলে আমি বই দেওয়ার চেষ্টা করিনি। বই হয়তো ওদের পছন্দ হয়নি। অন্য লেখকদের লেখা অভিনয় করতে হতো। অন্য লেখকরা যখন আসতেন, বই দিতেন, মালিকপক্ষ আমাকে দেখিয়ে বলতেন, ইনি একজন রাইটার, এর সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন। যারা বই দিতেন তারা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। যে সিনটা নিয়ে অসুবিধা হতো কীভাবে কী করা যায়, মোটামুটি পরামর্শ নিতেন। এবং প্রয়োজনে আমি সংলাপ লিখে দিয়েছি। এরকম বহু নাটক আছে। সিন সাজিয়ে দিয়েছি।

আমি যখন নাটক দিয়েছি তখন সেভাবে চাহিদা ছিল না। খুব কম পয়সাতেই চুক্তি হতো। নাটকের জন্য তখন সে-ই ভাবে পয়সা দেওয়া হতো না রাইটারদের। কোনও রাইটারই পায়নি সে-ই সময়। রাইটার পয়সা পেয়েছে ধরুন, তখন ১৯৮০ তো… তার অনেক পরে, ধরুন ১৯৯৫, ’৯৬-’৯৭ সাল থেকে রাইটাররা পয়সা পেতে শুরু করেছে। উপযুক্ত যে পারিশ্রমিক সেটা তারা পেয়েছে। আমাদের টাইমে আমরা সে-ই পারিশ্রমিক পাইনি। আমরা যে অভিনয় করেছি, যে শ্রমটা আমরা দিয়েছি সে-ই শ্রমের যে পারিশ্রমিকটা সেটাও আমরা পাইনি। অনেক পরে… যাত্রার আর্টিস্টরা অনেক পরে ভালো পয়সা… মাইনে পেয়েছে। সারা বছরে ১৪০-১৫০ পালা শো হতো। নর্থ বেঙ্গলে আমরা যখন ঢুকতাম, প্রায় দেড় দু-মাস পড়ে থাকতে হতো। আসাম, ত্রিপুরা-টিপুরা যখন গেছি বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ থাকত না, সে-ই টাইমে। (পেশাদার) যাত্রার সিজনটা ছিল, ধরুন, বিশ্বকর্মা পুজো থেকে স্টার্ট হতো। শেষ হতো একেবারে জ্যৈষ্ঠ মাসে গিয়ে। বর্ষা না নামা পর্যন্ত নিস্তার নেই।

সে-ই সময়ের কোনও বিশেষ ঘটনা মনে পড়ছে, আপনাদের কাজকে ঘিরে?

হ্যাঁ। মনে পড়ে। যেমন, এই… ঘটনা বলতে কী দুর্ঘটনা। নদিয়াতে একটা শো ছিল। তার আগের দিন দলের ছুটি ছিল… ওটা হচ্ছে… যাত্রালোক না যাত্রামঞ্চ… দলটার নাম মনে পড়ছে না! সে-ই দলে আমি অভিনয় করছি। আগের দিন আমি বাড়ি চলে এসেছি। আমি ম্যানেজারদের বলেছিলাম, স্পটে পৌঁছে যাব… তার পরের দিন স্পটে পৌঁছে যাব, সাড়ে সাতটা আটটায় আপনার যাত্রা… না, মনে পড়েছে। ওটা ছিল বুলবুলিতলা। বর্ধমান বুলবুলিতলায় শো ছিল। সন্ধ্যে ছটায় পৌঁছে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি টোটাল অন্ধকার। কোনও স্টেজ নেই। মাইকের আওয়াজ নেই। ওখানকার দু-একজনকে জিজ্ঞাসা করতে বলল, ‘না, না। এখানে যাত্রা হবে না। যাত্রা ছিল, বন্ধ হয়ে গেছে।’ একজন মার্ডার হয়ে গিয়েছিল। চিন্তায় পড়ে গেলুম। কোনও আর্টিস্ট আসেনি। মালিকরা খবর পেয়ে গেছে, এ জায়গায় যাত্রা হবে না। তাই গাড়ি পাঠায়নি। আর কোনও স্কোপ পায়নি আমাদের জানানোর। তখন তো ফোন টোন ছিল না।

তারপর মেমারি থেকে একটা আর্টিস্ট গিয়ে হাজির হয়। আমি বললুম, এখানে তো শো হবে না রে! সে বলল, বাড়ি তো তুমি এখন যেতে পারবে না, এখানে বুলবুলিতলায় আমার মাসিমা’র বাড়ি। চলো আমরা দুজনে মাসিমা’র বাড়িতে থেকে যাই। কাল তো নদিয়াতে শো আছে। একেবারে কালকের শো অ্যাটেন্ড করবো। তা আমি বললুম, ঠিক আছে। মালিকও সেভাবেই জানতো, আমরা নদিয়ার শো অ্যাটেন্ড করবো বাড়ি থেকেই। সে বাড়িতে থেকে তার পরেরদিন যখন আমরা বুলবুলিতলা বাস স্ট্যান্ডে গেছি, দেখা গেল হঠাৎ করে বাস ধর্মঘট হয়ে বাস সব বন্ধ হয়ে গেছে। এবার যে জায়গার শো, তেহট্ট এরকম একটা জায়গা নদিয়ার। এবার আমরা যাব কী করে? ভীষণ দুশ্চিন্তা হচ্ছে। সে-ই দলে ছিলেন নটশেখর রাখাল সিংহ। মেইন ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। অনেক কষ্টে একটা অটো আমরা পাই। যে টাইমে অটো পেয়েছি তখন দেরি হয়ে গেছে অনেক। সন্ধ্যে ছ’টা হয়ে গেছে।

যখন আমরা যাচ্ছি, সে-ই জায়গা থেকে একটু দূরে, দেখি রাস্তায় ঝামেলা হচ্ছে, চেঁচামেচি হচ্ছে। আমরা অটো থামালাম। জিজ্ঞাসাবাদ করতে বলল, যাত্রা প্যান্ডেল লুট হয়ে গেছে। ওখান থেকে দু-কিলোমিটার দূরে যাত্রা মঞ্চ। ওখানে গাড়িটা আমরা দাঁড় করিয়ে দিয়েছি… দিয়ে জানা গেল, দুজন আর্টিস্ট আসেনি। চট-টট যা ছিল পাবলিক খুলে নিয়ে চলে গেছে। জিনিসপত্র সব লুঠতরাজ হয়ে গেছে। অটোওয়ালা ভয় পেয়ে গেছে, বলছে, আমাকে ছেড়ে দিন। শেষে আমার ওপর ঝামেলা হবে। পয়সাকড়ি মিটিয়ে, গাড়ি ছেড়ে, আমরা দু-বন্ধু এবার সাধারণ দর্শকের মতো একে ওকে জিজ্ঞাসা করে আমাদের দলের কে কোথায় আছে জানতে চেষ্টা করছি আর এগোচ্ছি। যে জায়গায় ম্যানেজার ছোটাছুটি করছে, তার চোখে আমরা পড়ে যাই। দেখেই বললেন, ‘এ কী করলেন আপনারা!’ আমরা তখন বললাম সব… পরিস্থিতি হাতছাড়া হয়ে গেছে। যাই হোক, রাখালবাবু যে ঘরে ছিলেন, আমাকে সেখানে নিয়ে গেল। ওদের কমিটি এল। আলোচনা হলো। প্রথমে তো একটা বিরাট ড্যামারেজ চাইছিল। সে তো আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। তখনকার দিনে পঞ্চাশ হাজার টাকা! সেটা সম্ভব? দেখুন, আমি তো একটা দুর্ঘটনার কবলে পড়েছি। আসতে পারিনি কেন বলেছি। আমি তো ঠিক টাইমেই বেড়িয়েছি। রাত আটটায় শো, আমি তিনটের সময় বেড়িয়েছি। এখানে আসতে দু-ঘণ্টা সময় লাগে। আমরা গাড়িই জোগাড় করতে পারিনি।

যাই হোক, কমিটির সঙ্গে চুক্তি হলো, (তারা বলল) আপনারা শো করে দেবেন এখানে। কিন্তু টোটাল স্টাফদের বিনে পয়সায় শো করতে হবে এখানে। নতুন করে কোনও টাকাপয়সা যাত্রাদলকে দেবে না। ম্যানেজার মালিকের সঙ্গে কথা বলে মেনে নিল শর্ত। এই একটা ঘটনা।

অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা। আচ্ছা যাত্রামোদী দর্শকবৃন্দ আমরা বলি, কিন্তু তাদের এই আচরণ! এ তো মানা যায় না! আপনার ব্যক্তিগত মতামত কী?

দেখুন, কিছু মানুষ থাকে হুজুগের। হুপে পড়ে কাজ করে। অবশ্যই ভালো মানুষ নয় এরা। অভ্যাসটাই তাদের এরম। এই মাইক খুলে নেবো, লাইট নিয়ে চলে আসবো। একটা ঝামেলা করে দেবো। ঝামেলা করার লোক তো থাকেই। তবে ভালো মানুষ থাকে। থাকে না যে এমন নয়।

একটা ভালো অভিজ্ঞতার কথা তবে শোনান।

ভালো অভিজ্ঞতার কথা বলতে… (চুপ থেকে অনেকক্ষণ ভেবে) হ্যাঁ, ভালো অভিজ্ঞতার কথাও আছে। সে বছর আমি একটা ঐতিহাসিক বই করছি। নটশেখর রাখাল সিংহ ছিলেন। যাত্রার নাম মনে পড়ছে না। রাখালবাবু নবাব হয়েছিলেন। আর, ওই যে, বেশ কিছু টিভি সিরিয়াল করেছেন, হ্যাঁ, শিবানী ভট্টাচার্য, উনি ছিলেন নায়িকা। ওটা ছিল মুর্শিদাবাদ ওই সাইডে… জলঙ্গি ওই সাইডে শো ছিল। হঠাৎ হয় কী, দুপুরে খাওয়ার পর থেকে গলাটা আমার চোক্‌ড হয়ে যায়। এবং আমি মেইন চরিত্র। মেইন চরিত্র বলতে নায়ক চরিত্র। গলাটা চোক্‌ড হয়ে গেছে—এদিকে আটটার সময় যাত্রা। রাখালদাকে গিয়ে বলছি, দাদা আমার তো গলার এই অবস্থা, তখন ছ’টা বেজে গেছে, কোনও সাউন্ড নেই। মানে সাউন্ডলেস হয়ে গেছে। ওখানকার এক ডাক্তার ওষুধ দিয়েছে, ইনজেকশন করেছে। গরম জলে গার্গল করতে বলেছে। সব করছি। কিন্তু গলা সারছে না। এ আমার চরম অভিজ্ঞতা।

ভালো মানুষ ছিলেন, ওদের যাত্রা কমিটির সেক্রেটারি। নামটা মনে পড়ছে না। ওকে রাখালদা বললেন, না হলে তো মুশকিল হয়ে যাবে, স্টেজকে বাঁচানো যাবে না। ঝামেলা হবে। সেক্রেটারিকে বললাম, আমি কী করব বলুন। বললেন, এক কাজ করুন। স্টেজে আপনাকে উঠতে হবে। স্টেজে আপনি উঠবেন। দাঁড়িয়ে থাকবেন। আপনার মুখ দিয়ে তো সাউন্ড বেরোচ্ছে না। আপনি যেটুকু পারবেন আকারে ইঙ্গিতে বোঝাবার চেষ্টা করবেন। যতটুকু সম্ভব করবেন। আর আপনার কো-আর্টিস্টদের বলুন ওরা অ্যাক্টিং করে নেবে। আমি আপনাকে নিয়ে মঞ্চে উঠব। রাখালবাবু সঙ্গে থাকবেন। উঠে পাবলিককে বোঝাব। পাবলিক নিশ্চয়ই বুঝবে। যাত্রা আরম্ভ হওয়ার আগে আমরা স্টেজে উঠলাম। জোড় হাত করে মানুষকে বললাম, আমাকে ক্ষমা করবেন। এই পরিস্থিতি। এটা ইচ্ছাকৃত নয়। হঠাৎ করেই এরকম শারীরিক প্রবলেম হয়েছে। দর্শকরা তো উচ্ছ্বসিত, বলল, ‘ঠিক আছে, আপনি দাঁড়িয়ে থাকবেন, আপনার কথা বলার দরকার নেই। কথা বলতে হবে না।’ আমি তো ভাবতে পারিনি, যে একটা ক্যারেক্টার, নায়ক ক্যারেক্টার সে ওরম ভাবে কথা বলতে পারবে না (আর শো দেখতে আসা) পাবলিক সমস্বরে বলছে—”না আপনি দাঁড়িয়ে থাকবেন। যেমন মেকআপে থাকবেন, এসে দাঁড়াবেন। সাজপোশাক পরবেন। পরে দাঁড়িয়ে থাকবেন। কথা বলার দরকার নেই। আপনার এটা ইচ্ছাকৃত নয় আমরা বুঝতে পেরেছি।”—এটা আমার জীবনের একটা স্মরণীয় ঘটনা। ওই ভাবেই যাত্রা হলো সেদিন। আশ্চর্যের ব্যাপার পরেরদিন সকাল দশটা নাগাদ আমার গলা আবার ঠিক হয়ে গেল। বললে বিশ্বাস করবেন না, কোনও দর্শক কোনও বাজে কথা বলেনি। ডিস্টার্ব করেনি। কিচ্ছু নয়। একেবারে চুপচাপ। লাস্টে দর্শকরা হ্যান্ডসেক করে গেছে। জীবনের এটা একটা পাওনা বলতে পারেন। আমি ভাবতে পারিনি! নাট্য জগতে, যাত্রা জগতে এমন ঘটনা বিরল। কী করে যে মেনে নিল পাবলিক—সেটা ভগবান জানে!

আচ্ছা, সাইক্লোরামা পদ্ধতিতে যাত্রা হতো একসময়। বিশিষ্ট অভিনেতা শান্তিগোপালবাবুর যাত্রাও দেখেছি। ‘টিপু সুলতান’, ‘সুভাষচন্দ্র বসু’। এই সাইক্লোরামা বিষয়টার উপর একটু আলোকপাত করতে পারবেন?

সাইক্লোরামা পদ্ধতির সবটাই লাইটিংয়ের ব্যাপার। আর একাধিক স্টেজ। উড়িষ্যা থেকে লাইটের লোক আসতো। উড়িষ্যার যাত্রা থেকেই আমাদের এখানে ওটা এসেছে। ওদের যাত্রা—কল্পনার অতীত! সে জায়গায় আমাদের পশ্চিমবাংলা এখনও আসতে পারেনি। উড়িষ্যায় দেখাচ্ছে, নায়ক স্নান করছে, বাথরুমে ট্যাপ খুলে দিল অরিজিনাল জল পড়তে শুরু করল। দৃশ্য শেষ হয়ে গেল তো গোটা বাথরুমটা সাজঘরে চলে গেল। সব চাকা সিস্টেম থাকে। একটা পার্ক দেখাচ্ছে, অরিজিনাল পার্ক। উড়িষ্যার যাত্রা এক সময় কলকাতায় আসতো। আমি যখন পেশাদারে কাজ করছি ওদের আসতে দেখেছি। ওরা আসতো, টানা পনেরো দিন অভিনয় করত। ওদের রেট প্রচুর বেশি তো। গ্রামাঞ্চলে ওরা সে-ই কারণে শো করতে পারতো না। সাইক্লোরামায় খরচ অনেক। সে যাত্রায় লোকও হতো। একটা ঘটনা বলছি। সাইক্লোরামা পদ্ধতিতে আমি এক বছরই অভিনয় করেছি। সে বছর আমি লক্ষণ হয়েছিলাম। নটশেখর রাখাল সিংহ হয়েছিলেন রাবণ। মানবাজার, পুরুলিয়ায় যাত্রা করেছি। যাত্রার নাম ছিল ‘রক্তাক্ত স্বর্ণলঙ্কা’, রাবণকে নিয়ে লেখা। ছ’খানা স্টেজ। মই সিস্টেম থাকত। মই বেয়ে উঠতে হতো। মূল স্টেজটায় সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হতো। হয়তো একটা সিনে দেখাচ্ছে পাঁচ নম্বর স্টেজটা লঙ্কা। একেবারে প্রাসাদের মতো। লাইটিংয়ের কায়দা ছিল। হয়তো অশোক কানন। ফুলে ফুলে ভরা। কী অপূর্ব! আমরা মেকআপ তুলছি, কাউন্টার থেকে কমিটির লোক এসে বলে গেল আজ এত টাকার টিকিট বিক্রি হয়েছে। লোক হয়েছে বাইশ হাজার। বাইশ হাজার! বুঝতে পারছেন! বাইশ হাজার লোকের মাঝে আমরা যাত্রা করেছি। লাস্টে বসে থাকা লোকটাকে দেখতে পায়নি কেউ স্টেজ থেকে। লাইট মাইক্রোফোনের খেলা দেখিয়ে গেছেন তরুণ অপেরার শান্তিগোপাল। এবং তা পাবলিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছে। ব্যাপক লাইট ব্যবহার করতেন। ‘হিটলার’ করেছেন, চোখ ধাঁধানো কালারিং লাইট। মানুষ নিয়েছে। উনি দিক্‌পাল অভিনেতা। ওঁর সঙ্গেও অভিনয় করেছি। ‘হিটলার’, ‘লেনিন’, ‘নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু’। কী না করেছেন! শেষের দিকটায় আর সে-ই জায়গাটা ধরে রাখতে পারলেন না। হ্যাঁ, মনে পড়েছে। ওঁর সঙ্গে আমি বই করেছি—‘অগ্নিগর্ভ পশ্চিমবঙ্গ’। শমীক লাহিড়ী ছিলেন ডিরেক্টর। উনি আবার পিএলটি-তে উৎপল দত্তের সঙ্গে কাজ করতেন।

সত্যিই চমৎকার একটা ঘটনা। আচ্ছা, আপনি তো তিন দশক যাত্রা জগতে আছেন (থামিয়ে)…

হ্যাঁ। আমি তিরিশ বছর একদম যাত্রা করেছি। ১৯৮০ থেকে… আমি যাত্রাটা ছেড়েছি ২০১০। তার মধ্যেই যাত্রা লিখেছি।

বেশ। তিন দশক যাত্রা জগতে যে কাজ করেছেন, কী কী পরিবর্তন দেখলেন? কীভাবে যাত্রা জগৎটা ধীরে ধীরে বদলে গেল! এখন তো টিভি-সিরিয়ালের যুগ চলছে। যাত্রার ঢঙে সিরিয়ালে সাজপোশাক-অভিনয়-কাহিনি সব পরিবেশিত হচ্ছে। গত দুশো বছরে যাত্রা যে একটা বিশেষ জায়গায় পৌঁছতে পেরেছিল তা মোটামুটি শেষ হয়ে গেছে। হুগলি হাওড়া বর্ধমান বাঁকুড়ার অ্যামেচার যাত্রা আজ প্রায় শেষ। আপনার অভিজ্ঞতার কথা শুনতে চাইছি।

যাত্রায় আমি যখন প্রথম যাই, তখন তো একটা বিশাল ব্যাপার! তখন এত পপুলারিটি ছিল গ্রামাঞ্চলে! সে-ই ভাবে দর্শকও আমরা পেতাম। তখনকার দিনে আমার প্রিয় আর্টিস্ট ছিলেন শেখর গাঙ্গুলি। আমার তীব্র আকর্ষণ ছিল ওঁর প্রতি। কেন বলি—ওঁর অ্যাক্টিং-এর যে মডিউলেশন—ধারণার অতীত—ওই শিল্পী আর জন্মাবে বলে মনে হয় না। বাড়ি থেকে পনেরো কিলোমিটার দূরে চলে গেছি ওঁর টানে। এখান থেকে হরিপাল গেছি আমি, শেখরবাবুর যাত্রা দেখতে। হয়তো সেদিন আমার অফ আছে। ওদিকে শেখরবাবুর যাত্রা আছে। আমি চলে গেছি। দিক্‌পাল অভিনেতা ছিলেন সব। আমি যেমন অভিনয় করেছি নটশেখর রাখাল সিংহের সঙ্গে। দীর্ঘ ছ’বছর অভিনয় করেছি। বহু কিছু শিখেছি। বিশেষ করে শেখরবাবু, রাখাল সিংহ, শিবদাস মুখার্জি—ওঁদের যে অ্যাক্টিং, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমরা অভিনয় করেছি।

কিন্তু পরবর্তীকালে ওঁরা যখন সরে গেলেন যাত্রা জগৎ থেকে, সিনেমা-সিরিয়ালের আর্টিস্টরা এসে এখানে ভিড় করতে লাগল, তখন তাঁদের সঙ্গেও পাল্লা দিয়ে আমাদের অভিনয় করতে হয়েছে। এটা আমার পক্ষে সম্ভব হয়েছে, কারণ আমি গ্রুপ থিয়েটারের ছেলে। আমি অভিনয়ের তারতম্য ঘটিয়ে দিতে পারবো বিশ্বাস ছিল। সিনেমা আর্টিস্টরা থিয়েট্রিক্যাল টেকনিকে অভিনয় করত। ওঁরা নিজেরাই বলতেন, আমরা যাত্রার ‘য’ জানি না। চিৎকার চেঁচামেচি ওইগুলো আমরা করতে পারবো না। থিয়েটার, সিনেমায় যেভাবে অভিনয় করি, আমরা সে-ই ভাবে করব। তো ওইভাবেই করতেন ওঁরা। আমরাও পাল্লা দিতাম। আর বলতে কী প্রচুর ছেলেমেয়ে। মেয়ে প্রচুর। মেয়েরা গ্রুপ থিয়েটার থেকে যাত্রায় এসেছে। সে-ই ভাবে তো পয়সাকড়ি ইনকাম হয় না গ্রুপ থিয়েটার করে। এখনকার যত নামকরা করা শিল্পী, সবই প্রায় গ্রুপ থিয়েটারের ছেলেমেয়ে, এই যাত্রা জগতে। আজ থেকে পনেরো কুড়ি বছর আগেও প্রবণতা ছিল সিনেমা সিরিয়ালের আর্টিস্ট দিয়ে যাত্রা করানোর। প্রকৃত যাত্রা-আর্টিস্ট পয়সা পেতো না। আস্তে আস্তে দেখছি সেটা কমছে।

দর্শকরা ওপেনলি বলেছে, ভালো লাগছে না। আমি যেমন বলছি, নাম বলছি না… বিশিষ্ট অভিনেত্রীর মেয়ে, তাঁর সঙ্গে অভিনয় করছি, দুজনে স্টেজে আছি, দর্শকরা বলছে—’ওকে স্টেজ থেকে নামিয়ে দিন।’ এরকম ব্যাপার। ওঁরা দর্শকের মন জয় করতে পারেননি, নিজেরাই সাইড হয়ে গেছেন। সুমিত্রাদি, মুনমুন সেন এমন কতজন আছেন; যাত্রার দর্শকের মন জয় করতে পারেননি, নিজেরাই সরে গেছেন। একমাত্র সত্য মুখার্জি যাত্রাটাকে ধরতে পেরেছিলেন, ধরেও রেখেছিলেন। পেশাদার যাত্রা জগতে তাই এখন যথার্থ যাঁরা যাত্রা-আর্টিস্ট তাঁদেরকে নিয়েই চিন্তাভাবনা করছেন যাত্রা মালিকরা, তাঁদেরকে নিয়েই দল গড়ার স্বপ্ন দেখছেন। আর সিনেমা আর্টিস্ট আনতে চাইছে না। এদেরকে এনে তো দর্শক হচ্ছে না। আমরা দেখেছি—নর্থ বেঙ্গলে শক্তি কাপুরের যাত্রা হচ্ছে। আমাদের শোয়ের আগের দিন। দেখতে গেছি। তখনকার দিনে দলের রেট ছিল একলাখ টাকা। লোক হয়েছে বড়জোর হাজার। হাজার লোক হলে তো টাকাই উঠবে না। নায়েক বন্ধুরা মার খেল। যার ফলে মানুষ অ্যাভয়েড করল ওঁদের। এখন খুব কম আছে। নেই বললেই চলে। অ্যাকচুয়ালি যাঁরা যাত্রাভিনেতা তাঁরা কিন্তু ওঁদের সঙ্গে অভিনয় করে মজা পেতো না, বুঝেছেন তো? খাপছাড়া অভিনয় হয়ে যেত। সে একটা টেকনিকে অভিনয় করছে, আর এ একটা টেকনিকে অভিনয় করছে। যার জন্যে দুটো অভিনয়ে পার্থক্য হয়ে যেত। যেটা পাবলিকের চোখে ধরা পড়ে যেত। বাজে বাজে মন্তব্য করত। আমরা নিজের কানে শুনেছি, বাজে মন্তব্য করতে।

কেন এরা আসেন? না, পয়সার জন্য। অ্যাকচুয়ালি বহুগুণ বেশি পয়সা পেতো সিনেমা আর্টিস্টরা। এটা সত্যি। যাত্রায় ডেইলি, রোজের ব্যাপার ছিল না। যাত্রায় মালিক কাউকে ডেইলি-পে করত না। মাস মাইনে ছিল। কিন্তু দৈনিক রোজের যে ব্যাপারটা, ডেইলি পেমেন্ট, সিনেমা আর্টিস্টরা গিয়ে এটা চালু করেছে। বা ওই আপনার ধরুন একটা সাজঘর… পার্সোনাল গ্রিনরুম, সেটা কোনওদিন থাকেনি। অত বড় বড় যে যাত্রা-আর্টিস্ট অত দিক্‌পাল অভিনেতা তাঁরা কিন্তু খোলামেলা আমাদের পাঁচজন বিভিন্ন সাধারণ আর্টিস্টের সঙ্গে বসে মেকআপ করেছে, কিন্তু পার্সোনাল গ্রিনরুম—সেটা সিনেমা আর্টিস্টরাই চালু করেছে। হ্যাঁ, হয়তো বসার তারতম্য ছিল। নটশেখর রাখাল সিংহ তিনি হয়তো একটা ট্রাংকের উপর বসলেন, একজন সাধারণ আর্টিস্ট পাশেই আসনে বসল। তখন প্রাইভেট কারের ব্যাপার ছিল না। বাসেতেই যেত সবাই। তবে এক নম্বর আর্টিস্ট, যেমন, নির্মল মুখার্জির মতো আর্টিস্ট, বা রাখাল সিংহ—থ্রি-সিটকে একসাথে করে যেতেন, টু-সিটকে জুড়ে শুয়ে যেতেন। পরে সিনেমা আর্টিস্টরা পার্সোনাল কার পেয়েছে, একেবারে হাতে গোনা কতিপয় যাত্রা-আর্টিস্ট গাড়ি পেয়েছেন। এখন কিন্তু যাত্রা-আর্টিস্টরা সে-ই জায়গাটা ধরে নিয়েছে। মেনেও নিয়েছে মালিকপক্ষরা। এখন দিচ্ছে। আর একটা দিক—তখন মাস মাইনে ছিল ধরুন দেড় দু-হাজার টাকা। সেটা ধরুন ১৯৮০, ’৮১-’৮২ এরকম। বাড়তে বাড়তে নিরানব্বই সাল বা দু-হাজার সাল যখন, দৈনিক পারিশ্রমিক ঢুকে গেছে। শো হলেই টাকা। ওটা আমায় শিখিয়ে দিয়েছিলেন, নটশেখর রাখাল সিংহ। বললেন, ‘তুই একবছর এটা নে। তারপর সেটাই রটে গিয়ে নিয়ম হয়ে যাবে।’ চিৎপুরে তখন ওটাই নিয়ম হয়ে গেল। ওইভাবেই মালিকরা চুক্তি করে নিত। এখনকার এক নম্বর, দু-নম্বর আর্টিস্ট যাঁরা তাঁরা ওই ডেইলি পারিশ্রমিকেই অভিনয় করছেন। পথটা দেখিয়ে গেছেন সিনেমা আর্টিস্টরা।

চিৎপুর যাত্রা জগতের বিশেষ দিন রথযাত্রা। সেদিনের কর্মকাণ্ড বিষয়ে আপনার অভিজ্ঞতার কথা শুনতে চাইছি।

রথযাত্রা তো যাত্রা জগতে একটা বিশাল ব্যাপার! বিশেষ করে পেশাদার যাত্রা জগতে। শিল্পীদের আমন্ত্রণ করতেন মালিকরা। নতুন করে শিল্পীদের এগ্রিমেন্ট হতো। প্রায় বেশিরভাগ শিল্পী, বিশেষ করে নায়ক, নায়িকা, ভিলেন চরিত্রের অভিনেতা অভিনেত্রীরা ওইদিন আসতেন। আমরা ওইদিন যেতাম, যে যার অফিসে। বিভিন্ন নায়েক পার্টি আসতো। কনট্যাক্ট করত। তাদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় হতো। এরাই কিন্তু যাত্রাকে জেলায় জেলায় নিয়ে যায়। তারা কিন্তু জিজ্ঞাসা করত, এবারে কী ধরনের নাটক, গল্পটা কেমন? আমাদের হয়তো বই পড়ে শুনিয়েছে ক’দিন আগে। তখনও রিহার্সাল হয়নি। রথের পর থেকে রিহার্সাল চালু হতো। তা আমরা নাটকটা যেহেতু জানতে পারতাম, ওদের সঙ্গে আমাদের ডিসকাশন করতে হতো। আমি একজনের কথা বলছি একটু পরে।

এই রথযাত্রার যে উৎসবটা, বিশেষ করে সোজা রথ যেটাকে বলা হয়, সেটা সত্যিই যাত্রা জগতে বড় উৎসব। ওখানে এমন একটা টাকাপয়সার লেনদেন হতো, যেটা আমরা চাক্ষুষ দেখেছি, বিশাল ব্যাপার! যেমন ধরুন, এক একটা দলে যেখানে ভালো কাস্টিং আছে, দেখা গেছে একশো নাইট পর্যন্ত বুকিং হয়ে গেছে। একশো নাইট! আর সে তো ধরুন দু-পাঁচ টাকা দিয়ে বুকিং নয়। একটা দলের পঞ্চাশ হাজার টাকা রেট হলে বিশ হাজার টাকা দিয়ে বুকিং করতে হতো নায়েক বন্ধুদের। ভাবুন এবার! রাত্তির ন’টা দশটা পর্যন্ত প্রায় জমজমাট থাকত চিৎপুর। সকাল সাতটা থেকে রাত্রি দশটা পর্যন্ত জমজমাট ব্যাপার। রথের দিন। বহু লোকের আনাগোনা। বহু ভিড়ভাট্টা। প্রতিটা অফিসে পূজাআচ্চা থাকত। খাওয়াদাওয়া থাকত। এসব কী বলব! যখন দু-একজন করে সিনেমা আর্টিস্ট আসতে আরম্ভ করেছেন, ওঁরা আসতেন। রাখালবাবু, শেখরবাবু, শিবদাস মুখার্জি, পান্না চক্রবর্তী এঁরা আসতেন অফিসে। ওঁদের দেখে এগ্রিমেন্ট হতো। এরকম ব্যাপার।

এমনিতে পোস্টার ব্যানার সব থাকত। তাও ওঁদের দেখে এগ্রিমেন্ট হতো। বড় বড় অভিনেতাদের দেখে। এখনও ওই জায়গাটা আছে। তবে যাত্রা জগতে আগের মতো বিশাল ব্যাপারটা আর নেই। ধরুন দুটো সিনেমা আর্টিস্ট আছে যে দলে, তার যদি এক লাখ টাকা রেট হয়, সে-ই টাকাটা তোলা মুখের কথা নয়। নায়েক পার্টির পক্ষে সেটা সম্ভব নয়। বিশাল টাফ ব্যাপার। যার জন্যে এক একটা ব্লক থেকে কত কমিটি যে নষ্ট হয়ে গেছে! ওরা হেরে গেল বলেই তো যাত্রা জগতের এত অধঃপতন। দু-হাজার দশে যখন সরে এসেছি, তখন একদম সংকীর্ণ অবস্থা। বছরে পঞ্চাশ পালা যাত্রা পাওয়া যেন খুব কষ্টদায়ক ব্যাপার ছিল। ওই সময় থেকেই শিল্পীরা সরতে আরম্ভ করছে, অন্য জীবিকায় চলে গেছে। আমি নিজেই তো যাত্রা ছেড়ে দিয়ে একটা প্রাইভেট স্কুলে ক্ল্যারিকাল জবে আছি। প্রথমে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করে, পরে ওরা সিদ্ধান্ত বদলায়।

নায়েক বন্ধু বা ব্রোকারদের একটা গল্প বলবেন বললেন—

হ্যাঁ। যেমন ধরুন আসানসোলে। কোলিয়ারি ফিল্ড। ওখানে যাত্রা করতে হলে, নায়েক পার্টিরা সরাসরি চিৎপুর এসে বায়না করে না। ওখানকার স্বনামধন্য ব্রোকার সন্দীপ ভাণ্ডারী। ওখানে ওর বিরাট অফিস। যাত্রার মতো। কলকাতা, চিৎপুরে ওরকম অফিস কম আছে। এরকম ব্যাপার। সে-ই অফিসে যোগাযোগ করে, ওখানকার লোক যাত্রা বায়না করে। এই দলের যাত্রা করাবো—আপনি করে দিন। বিভিন্ন দলের সঙ্গে ওই ব্রোকারের চুক্তি থাকত। যে আমাকে এই পারসেন্টেজ দিতে হবে, আমি আপনার দল বায়না করে দেবো। এক একটা ব্রোকার তো লক্ষ লক্ষ টাকার মালিক হয়ে গেছে এই ভাবে। সন্দীপ ভাণ্ডারী তো কোটিপতি লোক। এখানে খন্যানেও তাই। একই সিস্টেম। তবে কয়েক বছর চালিয়েই খন্যানের অফিস উঠে যায়। এখান থেকে তো কলকাতা কাছে। কেন খন্যান আসবে? নর্থ বেঙ্গলেও আলাদা ব্রোকার আছে। সরাসরি এখানে বায়না হয় না। ওদের থ্রু দিয়ে করতে হয়। ব্রোকারের ঘরে বায়না হয়, ব্রোকার দলকে কনট্যাক্ট করে। এই তারিখে আপনার শো, এই কথা হয়েছে, আমাকে এই পারসেন্টেজ দিতে হবে। বেশিরভাগ বাইরের শো ব্রোকারের মাধ্যমে হয়। ডিরেক্ট বায়না আজও হয় না। ডেট বুক করেই ওরা ফোনে জানিয়ে দেয়, আপনার এই ডেট বুক হয়ে গেছে, আপনি এই ডেটে আর পালা ধরবেন না। রথের দিন থেকেই ওরা ফোনে ফোনে যোগাযোগ শুরু করে দিত।

এবার আমরা আপনার যাত্রাপালাকার হয়ে ওঠার কথা শুনব। ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায়, অনল চক্রবর্তী, মেঘদূত গঙ্গোপাধ্যায়, তাপসী রায়চৌধুরী প্রমুখের নাম শুনেছি। তাঁদের কাজের কথা জানি। পাশাপাশি আপনার মতো পালাকাররা আছেন… (থামিয়ে)

হ্যাঁ। আমার মতো বহু নাট্যকার আছেন। অনেক। অনেক।

আপনার যে প্রথম যাত্রাপালা লেখার অভিজ্ঞতা, সেটা শুনব।

সালটা হচ্ছে… আপনার তখন ১৯৭৫-৭৬ এরকম। অ্যামেচারে অভিনয় করছি আমি। আমারই বন্ধুবান্ধব তারা সব, বলত যে, তুই অপরের নাটকে অভিনয় করছিস, এত কথা বলছিস, নিজে লেখ না। আমার এক বন্ধু, সে তখন বই লিখতে আরম্ভ করেছিল। তার নাম স্বপন চট্টোপাধ্যায়। স্বপন আমাকে বলল, আমি যদি বই লিখতে পারি, তুই কেন পারবি না? ও কীভাবে লিখত, কীভাবে কাহিনিকে সাজাত সেটা আমি স্বপনের মুখ থেকে শুনতাম। স্বপন বলত এইভাবে ক্যারেক্টার সিলেকশন করতে হয়, এইভাবে সিন সাজাতে হয়, তারপর এইভাবে লিখতে হয়। তখন দু-একটা বই লিখি। সেটা ঠিক যাত্রা নয়। নাটকের মতো বই। আমার গ্রামেতে অভিনয়ও হয়েছে। কিন্তু সে-ই ধরনের আমি সাড়া পাইনি। যাত্রা লিখলুম ‘রাজনন্দিনী’। বন্ধু স্বপনকে দেখিয়েছিলুম। ও বলল, খারাপ নয়। সামান্য ত্রুটি আছে। সেগুলো সংশোধন করে দেবো। আর বলল, তুই যা মোটামুটি দানা বেঁধেছিস, বইটা অ্যামেচারে কর। বইটা অ্যামেচারে করব বলে ঠিক করে রেখেছি। ১৯৮০ সালে তখন তো আমি পেশাদারে ঢুকেছি। তখন মালিক বই চাইছে আমার কাছে—আমি বললুম বই আমার রেডি আছে। অভিনয় হয়নি কোথাও। উনি বললেন, ‘ঠিক তো, কোথাও শো হয়নি তো?’ আমি বললুম, না। পনেরো দিন পর আমায় জানালেন, ‘আপনার বই আমাদের পছন্দ হয়েছে, আমরা অভিনয় করব। ডিরেকশন আপনাকেই দিতে হবে। মুখ্য চরিত্রে আপনাকেই অভিনয় করতে হবে।’—আগেও বলেছি বোধহয়। আমি সে-ই ভাবেই এগ্রিমেন্ট করি। ওই যে, আমার বই অভিনয় হচ্ছে; আমার ডিরেকশনে, বিভিন্ন জায়গায় যাচ্ছি, গ্রাম থেকে গ্রামে, বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছি, ব্লকে যাচ্ছি—মনের মধ্যে একটা বিরাট ব্যাপার চেপে গেল। বুঝছেন তো? আমাকে আরও লিখতে হবে। বই লিখবই। মালিকপক্ষ আমাকে জানিয়ে দিল—পরের বছর আমরা আপনার বই করব। বই কিন্তু রেডি রাখবেন। ওই ‘রাজনন্দিনী’র অভিনয় চলাকালীন আমি ‘কামিনী-কাঞ্চন’ পালার প্লট সাজাই। মালিককে শোনালাম। মালিক বললেন, লিখতে আরম্ভ করুন। তৈরি হলো— ‘কামিনী-কাঞ্চন’।

এই দুটো যাত্রাপালার গল্পটা সংক্ষেপে যদি আমাদের বলেন।

‘রাজনন্দিনী’টা প্রথমে বলছি। একজন শিল্পপতি ও তার পরিবার, এর বিপরীতে নিম্নমধ্যবিত্ত একটা পরিবার দেখানো হয়েছে। আর একটা খল বা ভিলেন চরিত্রর দিক দেখানো হয়েছে। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েটি হচ্ছে নায়িকা। তার নাম নন্দিনী। রাজ হচ্ছে ওই যে আপনার শিল্পপতি দর্পনারায়ণ চ্যাটার্জি, তার ছেলে। ওদের বাড়ি একই এলাকায়। পড়াশোনা করেছে একসাথে। এরপর রাজ ও নন্দিনীর প্রেম হয়। কিন্তু একজন দাম্ভিক লোক শিল্পপতি দর্পনারায়ণ চ্যাটার্জি, সে একটা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে ছেলের বিয়ে দেবে কেন? চরম সংঘাত। মেয়েটাকে মারার জন্যে ছেলেটার বাবা বিভিন্ন কলাকৌশল অবলম্বন করে। ম্যানেজারের নাম ছিল টাইগার। তাকে দিয়ে নানারকম অশালীন আচরণ, কুৎসিত ইঙ্গিত ইত্যাদি করায় ওই শিল্পপতি। বিশাল ঘাতপ্রতিঘাতের শেষে ধর্মের জয়, ভালোবাসার জয়। এইভাবেই প্লট সাজানো হয়েছিল। দাম্ভিক দর্পনারায়ণ চ্যাটার্জির মাথা নত হয়েছে। সে বলছে,—ছেলের ভালোবাসাকে নোংরা আক্রমণ করে সে ভুল করেছে। সে শেষ পর্যন্ত ক্ষমা চেয়েছে।

আর ‘কামিনী-কাঞ্চন’ ছিল ঐতিহাসিক কাহিনি। নাসিরুদ্দিন শাহ্‌ নামে একজন নবাব ছিলেন। ইলিয়াস শাহের বংশধর। এই ঘটনা সে-ই নাসিরুদ্দিন শাহ্‌-র। তিনি একজন প্রজা দরদী মানুষ ছিলেন। কিন্তু তাঁর যে মেজোভাই ছিল, শাহ্‌জামাল শাহ্‌ সে চাইতো দাদাকে উৎখাত করে নবাবী সিংহাসন দখল করতে। দুই ভাইয়ের সংঘাত—বুঝলেন তো—এই করে যুদ্ধ, দাঙ্গাহাঙ্গামা এইসব হতে থাকে রাজ্যের মধ্যে। প্রজাদের উপর অন্যায় নিপীড়ন এইসব হতো। শেষে মেজোভাই তার ভুল বুঝতে পারে। প্রজারা মেজোভাইকে মেনে নিতে চায়নি। কারণ সে লোভী-খল-ধূর্ত, দাদার বিরুদ্ধাচরণ করেছে সব সময়। প্রজারা যখন তাকে মেনে নিল না, সে ভাবলো প্রজারাই যখন মেনে নিচ্ছে না, আমি কাদের নিয়ে থাকব! কাদের নিয়ে রাজত্ব চালাবো! তার ফলে চরিত্রটা স্যারেন্ডার করেছে। সে নারীলোভী ছিল, তার দাদা তাকে সংশোধন করেছে—আমি যেহেতু নবাব, আমার ভাই তুমি, তোমার একটা সম্মান আছে। এসব করলে মর্যাদাহানি হয়, সেটা ভুললে চলবে না।—এইভাবে সে দাদার কাছে ফিরেছে—আমার দরকার নেই রাজস্ব, দরকার নেই এই সাম্রাজ্য। তুমিই নবাব। আমি তোমার আদর্শে চলবো।— প্রজারা তখন বাহবা দিয়েছে। এই গল্প।

একেবারেই আলাদা দুটো বিষয়। আপনি যখন লেখেন, তখন এই কাহিনির সূত্র বা বীজ কেমন করে সংগ্রহ করেন?

অ্যাকচুয়ালি আমি ইতিহাস নিয়ে পড়াশুনো করেছি। আমার এক পাড়ার দাদা ছিলেন। প্রতিবেশী দাদা। বিশ্বনাথ হালদার। মারা গেছেন। উনিও অনেক নাটক লিখেছেন। নাট্যকার ছিলেন।

হ্যাঁ, নাম শুনেছি। আমাদের পাড়ার ক্লাবে ওঁর লেখা নাটক অভিনয় হয়েছে, দেখেছি।

এই তো আমার বাড়ির পাশেই বাড়ি। ‘ময়ূর মহল’ ওঁর বই। ঐতিহাসিক বই লিখতেন। সব বই ক’টাই ঐতিহাসিক। আমাকে বলেছিলেন—’দেখ, শুধু সামাজিক বই লিখলে তো হবে না। তোকে ঐতিহাসিক বইও লিখতে হবে।’ দাদাই ওই সাবজেক্ট ম্যাটারটা আমাকে দিল। বলল,—দেখ, খুব দরদী নবাব। প্রজা দরদী নবাব। নাসিরুদ্দিন শাহ্‌-র একটা জিস্ট করে দিয়ে বলল, এর উপর লেখ। দাদার অনুপ্রেরণায় আমি ওইটা লিখতে শুরু করি। উনি আমার বংশেরই মানুষ। ওঁর বড় ছেলে মারা গেছে। ছোট ছেলে বর্তমান। বেশি বই লেখেননি। তিনটি বই লিখেছেন। তিনটেই ঐতিহাসিক বই। ‘সতী সুলতানা’, ‘ময়ূর মহল’, ‘নাঙ্গা তলোয়ার’।

‘নাঙ্গা তলোয়ার’ খুব পপুলার ছিল।

ঠিক। খুব পপুলার বই। বহুদিন চলেছে। বহু দর্শক নিয়েছে। আমি নিজেই তো বহু জায়গায় অভিনয় করেছি। প্রধান চরিত্রে অভিনয় করতাম। ধনেখালি ব্লকের বহু জায়গায় অভিনয় করেছি। খানাকুলে তো মানপত্র দিল অভিনয় দেখে। দ্বারহাট্টা থেকেও ‘নাঙ্গা তলোয়ার’-এ অভিনয় করে মানপত্র পেয়েছি। আমার নিজের একটা গ্রুপ ছিল। ড্রামাটিক ক্লাব। আমরা গিয়ে গিয়ে অভিনয় করতাম। বহরমপুর ড্রামাটিক ক্লাব—আমার গ্রুপের নাম ছিল। কম্পিটিশন, শো এইসব করতাম। যাই হোক, আগের আলোচনায় ফিরে যাই। আমি টোটাল আঠারোখানা বই লিখেছি। এর মধ্যে এগারোখানা প্রিন্টেড বই। মার্কেটে বই আছে আমার—এগারোখানা। আর সাতখান বই এমনি আছে। বিভিন্ন ক্লাব নিয়ে গেছে বেশ কিছু স্ক্রিপ্ট। আবার দিয়ে যায়। যেমন বলছি, ‘রাজনন্দিনী’ বা ‘কামিনী-কাঞ্চন’—যেগুলো আমার পেশাদার বই, সেগুলোই প্রিন্ট হয়নি। কারণ ওগুলো পেশাদারদের কথা ভেবে লেখা। পেশাদারদের বই লেখার ঢং একরকম হবে। আর অ্যামেচারদের জন্য লেখার ঢং হবে আলাদা। বুঝলেন?

আর একটু বিস্তারিত আলোচনা যদি করেন। ভবিষ্যতের কোনও একজন যাত্রাপালাকারকে বুঝিয়ে বলছেন এমন করে বলুন

(হাসি) ব্যাপার হচ্ছে পেশাদার জগতে, যেমন হচ্ছে, ধরুন, আমার ‘রাজনন্দিনী’ নাটকেই মেয়ে চরিত্র ছিল ছ’টা। সেটা তো আর অ্যামেচারে সম্ভব নয়। ছ’টা মেয়ে বাইরে থেকে নিয়ে আসা মানে বহু প্রবলেম, ওদের আনার যে খরচা সেটা জোগানো অসম্ভব। যার জন্যেই ওই বইগুলো ঠিক ছাপার অক্ষরে প্রকাশ হয়নি। ওগুলো ঠিক করেছি—তিনটে চারটে মেয়ে চরিত্র রাখব। এডিট করে বের করব। তখন নাটকের বাঁধুনিটা অন্যরকম হয়ে যাবে। পেশাদার যাত্রায় চরিত্র হবে অল্প। কিন্তু যখন অ্যামেচার, অ্যামেচার শো যখন একটা ক্লাব করবে, তখন যদি ক্যারেক্টার বেশি না থাকে—একটা চাঁদার ব্যাপার আছে তো? পেশাদার যাত্রা দশটা মেল ক্যারেক্টার দিয়ে হয়ে যাবে। কিন্তু অ্যামেচারে সেটা হবে না। আমি যদি বইটা দশটা মেল চরিত্র দিয়ে প্রিন্ট করে দিই—বইটা চলবে না। একটা অ্যামেচারে কম করে চোদ্দ-পনেরোজন শিল্পী থাকে। তারপরের ব্যাপারটা ইকোনমিক। সেটাও অনেকখানি মার খাবে। কারণ হচ্ছে চাঁদা। অ্যামেচার যাত্রা হয় চাঁদা দিয়ে। একজনের হয়তো তখন একশো টাকা চাঁদা। পাঁচটা আর্টিস্ট যখন বাদ চলে যাবে, তখন পাঁচশ টাকাও চলে যাবে। অ্যামেচারটা এইভাবে দেখতে হয়। আর একটা ব্যাপার গান। তখনকার যাত্রায় আমরা নিজের লেখা গান প্রয়োগ করতুম। তাতে প্রচুর ফ্যাসাদ আছে। ফ্যাসাদটা এটাই, অ্যামেচার দল তো সুরকার আনবে না পেশাদারদের মতো! তখন স্বরচিত গান উঠেই গেল আস্তে আস্তে। এখন দিতে হচ্ছে ফিল্‌মের গান। বাইরে থেকে পেশাদার একটি মেয়েকে আনা হচ্ছে। সে ফিল্‌মের গান জানে। হয়তো পালায় ব্যবহৃত গানটা তার জানা নেই, কিন্তু ওই সিন ওয়াইজ সে আর-একটা গান গেয়ে দিচ্ছে। ওই জাতীয় একটা গান তার নলেজে আছে, সে গেয়ে দিচ্ছে। এইগুলো দেখতে হচ্ছে অ্যামেচার যাত্রা লিখতে হলে।

আরও কিছু দিক আছে নাকি?

হ্যাঁ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেটা… যেটা এড়িয়ে গিয়ে অনেক বড় বড় রাইটার অ্যামেচার যাত্রা লিখতে গিয়ে মার খেয়ে গেছে। মঞ্জিলদার কথাই বলছি। ওই মানের একজন পেশাদার রাইটার। প্রথম স্তরে অ্যামেচারদের জন্য লিখতে গিয়ে ফ্লপ হয়ে গেছে। বইগুলো চলেনি। পরে উনি বুঝতে পেরেছেন ভুলগুলো। এই অ্যামেচারে-পেশাদারে তফাতটা কোথায়? পেশাদার জগতে মূল আর্টিস্ট বড় জোর তিন থেকে চারজন। মালিকরা জানতো বাকিরা সব তলাঝাড়া আর্টিস্ট। ওই হয়তো পঞ্চাশ-ষাট-সত্তর-আশি টাকা রোজ। সে-ই ক্যারেক্টারগুলো কী, দু-সিন এক সিন করে ক্যারেক্টার। আর এরা প্রায় সব সিনেতেই। এরাই গোটা যাত্রাটা পরিচালনা করবে—তিনটে লোকে। বাকি চরিত্রগুলো না থাকলেই নয়। ওরা ওই আসবে দুটো কথা বলবে চলে যাবে।

এবার আসা যাক অ্যামেচারে। আমি ধরুন একটা চরিত্র লিখেছি। ওসমান বলে। তার দেখা গেল দশটা কথা আছে টোটাল। তিনটে অ্যাপিয়ার। তার কথা হচ্ছে দশটা। শিল্পী যেই যাত্রা পড়বে, সে ক্লাবের সেক্রেটারিকে বলে দেবে যে, দাদা এই চরিত্রটা আমি করব না।—(যদি কারণ জানতে চাওয়া হয়, উত্তর আসবে)—না, না। এ তো মানুষ আমাকে চিনতেই পারবে না। আমার বাড়ির লোক কী বলবে? যাচ্ছেতাই করবে। এর চেয়ে আমাকে তুমি বাদ দিয়ে দাও দল থেকে।—এই যে ব্যাপারগুলো! এ করতে হবে কী, চোদ্দটা চরিত্র যদি থাকে ফিমেল নিয়ে, তবে (তার ভেতর) এদের বারোটা চরিত্র—এ বলবে আমায় দেখ, ও বলবে আমায় দেখ—এরকম হতে হবে। এরকম হলে তবেই অ্যামেচার ক্লাব চলবে। তবে সে-ই প্রোডাকশন হবে। আর অ্যামেচারের জন্য লেখা বই চলবে। নচেৎ চলবে না। এটাই মেইন দিক। লিখতে লিখতে আমার এই অভিজ্ঞতা হয়েছে।

ঠিক। আমি যখন কলেজে পড়তাম, আমাদের ক্লাবে যাত্রা হতো। আমাদের অযোধ্যা গ্রামে দুটো যাত্রাদল ছিল… (থামিয়ে)

আরে… অযোধ্যায় তো আমার খুব পরিচিত একজন ছিল, ওঁদের তখন যাত্রা জগতে খুব নাম। ওঁর নাম ছিল কৃষ্ণচন্দ্র গুছাইত… হ্যাঁ, কৃষ্ণচন্দ্র গুছাইত।

ওঁর বাড়ি কাশীপুরে। আমাদের পাশের গ্রাম।

হ্যাঁ, হ্যাঁ। কাশীপুর। তারকেশ্বরে ওঁদের যে অধিকর্তা ছিল, দীর্ঘদিন ওখানে যাতায়াত করেছি। দীর্ঘদিন। হ্যাঁ বলুন, যা বলছিলেন—

হ্যাঁ, আমি দেখেছি, অভিনেতারা বলতো আমার কুড়ি নম্বর পার্ট, চল্লিশ নম্বর পার্ট—প্রথমে বুঝতে পারতাম না। এরা আসলে কী বলতে চাইছে! পরে বুঝলাম, আসলে ওরা ক’টা ডায়লগ সেটা গুণে দেখতো। গুণে দেখে সে-ই অনুযায়ী টাকা দেবে।

ঠিক, ঠিক। একদম গুণে দেখবে ক’টা ডায়লগ।

ঠিক। নায়ক তিনশো নম্বর পার্ট করছে আর কেউ কুড়ি নম্বর পার্ট করছে দুজনের এক চাঁদা! হতেই পারে না! এটা দেখেছি। আর একটা সুবিধে হলো, সবাই দলে সমান সময় দিতে পারে না। আমি নিজে যখন বোলপুর থেকে সপ্তাহে দু-একদিন গ্রামে ফিরেছি, যাত্রায় অভিনয় করেছি, তখন আমায় ওই কুড়ি নম্বর পার্টটা দেওয়া হয়েছে। এমন আরও দু-একজন যারা কলকাতা ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করত তারাও একটু কম ডায়লগের চরিত্র বেছে নিত। আর যারা সারাদিন চাষ সামলে সময় দিতে পারতো তারাই প্রধান চরিত্রগুলো করত। সবাই মূলত গ্রামের মানুষ। চাষি, শ্রমিক, স্কুলমাস্টারএরাই কুশীলব। আপনি ঠিক বলেছেন। বলছি যে, আমরা তো অনেকক্ষণ কথা বলছি, আপনার অসুবিধা না থাকলে আরও কিছুক্ষণ কথা বলা যেতে পারে।

আরে, না, না। লকডাউনে তো বসেই আছি। কোনও অসুবিধে নেই। এখন একটা নতুন নাটক লিখছি। জোড়া দিঘির চৌধুরী পরিবার। যেটা প্রচলিত সেটা না। নামটা নিয়েছি। কাহিনি আমার কল্পনা বলতে পারেন। করুন… প্রশ্ন করুন।

আচ্ছা, যাত্রার যে অদ্ভুত নামকরণ করা হয় অনেক সময়সেটার কোনও কারণ আছে?

আমি বলছি। ১৯৮০ থেকে ১৯৯০। এই দশ বছরে আমি দেখেছি, তখন নামকরণ করতেন রাইটাররা। (পালা লেখার ক্ষেত্রেও) তাঁদের তখনও স্বাধীনতা ছিল। সাবজেক্ট অনুযায়ী নামকরণ হতো। পরবর্তীকালে দেখেছি, নামকরণের স্বাধীনতা নাট্যকারদের ছিল না। নামকরণ করত মালিকপক্ষ। এবং মালিকপক্ষই সাজিয়ে দিত সামনের বছর যে যাত্রা হবে—সেখানে কে এক নম্বর চরিত্রে অভিনয় করবে, কে দু-নম্বরে। মেয়েদের মধ্যেও কে এক নম্বরে, কে দু-নম্বরে। এবার এসব মাথায় নিয়ে আপনি নাটক লিখুন। লেখার আগেই নাম বলে দিত। ওঁরা একদম স্বাধীনতা হরণ করে নিয়েছিলেন। এখন তো মালিকপক্ষ নিজেই ডিরেকশন দিচ্ছে! কী বলবেন! দীর্ঘদিন ম্যানেজারি করে মালিক হয়েছে, এখন পরিচালনাও করছে। আলাদা করে ডাইরেকশনে লোক লাগল না। এই তো! এক সময় যেখানে জ্ঞানেশ মুখার্জি, উৎপল দত্তের মতো লোকেরা যাত্রার ডিরেকশন দিতে এসেছেন! তখন মালিকরাও ছিলেন আসল যাত্রামোদী।

বেশ, এবার আবার আপনার লেখায় ফিরি। এই যে লেখক আর প্রকাশিত বই। দুটো সম্পূর্ণ আলাদা জগৎ। কীভাবে প্রথম পালা প্রকাশিত হয়েছিল তার গল্প যদি বলেন।

আমি তখন পেশাদার দলে অভিনয় করছি। তা, অভিনয় করতে করতে, প্রসাদকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, রাইটার, ওঁর একটা বই সে বছর আমি অভিনয় করি। ঐতিহাসিক বই, আমার নাম মনে পড়ছে না, উনি লিখেছিলেন। পাগলা রাজা বলা হয় মহম্মদ বিন তুঘলক… ওকে নিয়ে বইটা লিখেছিলেন। মহম্মদ বিন তুঘলক চরিত্রে অভিনয় করতেন রাখাল সিংহ। ওতে আমি নায়কের চরিত্রে অভিনয় করছিলাম। প্রসাদবাবু আমাকে বললেন, ‘অসীম তুই তো বই লিখিস, দেখ না, আমার বইগুলো একটু এডিট করে দে না—রাখালদা বলছে এডিট করতে।’ রাখালদাও আমাকে ডেকে বললেন, ‘প্রসাদ তো লিখেই চলেছে। এডিট করছে না। তুই একটু দেখে দে।’ উনি নিজেও একজন সাহিত্যিক। উপন্যাস লিখতেন। বললেন, ‘আমার সময় নেই।’

আমি এডিট করতে আরম্ভ করলাম। বই এডিট করতে গিয়ে প্রসাদবাবুর চোখে পড়লাম। বললেন, ‘আমার ডায়লগ বাদ দিয়ে, একটা নতুন ডায়লগ দিয়ে তুই তো সিনটা দারুণ সাজিয়েছিস!’ উনি মাঝে মাঝেই প্রশংসা করতে আরম্ভ করলেন। হঠাৎ করেই উনি একদিন বললেন, ‘অসীম তুই তো অনেকগুলো বই লিখেছিস!’ আমি বললুম, হ্যাঁ। বললেন, ‘বই তো ছাপাসনি!’ আমি বললুম, না। আমি তো সে-ই স্কোপ পাইনি। সে-ই সুযোগ তো হাতে আসেনি। ‘নির্মল সাহিত্য মন্দির’-এ বই দিয়েছিলাম। নির্মল শীল প্রকাশক। আমি উপযাচক হয়েই দিয়েছিলাম—যে, আমি একজন রাইটার, পেশাদার দলে অভিনয় করি, আপনি এই বইটা একটু দেখুন না, দেখে যদি পছন্দ হয় ছাপবেন। দু-মাস পরে আমায় বইটা ফেরত দিয়ে উনি বলেছিলেন, ‘বইটা ছাপার উপযোগী না।’ অথচ সে-ই বই আমার পেশাদারে চলেছে—‘কামিনী-কাঞ্চন’—সারা পশ্চিমবাংলায় অভিনয় করেছি, আসামে অভিনয় করেছি। সে বই বললে—’ছাপার উপযোগী না।’ তার পর থেকে আর কোনও পাবলিশারকে বই দেওয়ার বাসনা হয়নি। মনটা দমে গিয়েছিল, যে ফিরিয়ে দিল বইটা? এত ভালো বই, এতদিন অভিনয় করলুম! তো একদিন রিহার্সাল খাওয়াদাওয়া মিটিয়ে শুয়েছি, বেডিং করে দিয়েছেন ম্যানেজাররা, আমার পাশেই শুয়েছেন প্রসাদবাবু। বললেন, ‘এক কাজ করবি? তোর কাছে বই আছে?’ বললুম, কাছে নেই, বাড়িতে আছে। বললেন, ‘তাহলে একদিন ছুটি নিয়ে, একটা স্ক্রিপ্ট নিয়ে আয় না। আমার জানাশোনা পাবলিশার আছে। সে-ই পাবলিশারের ঘরে আমার বই ছাপা হয়।’ বললুম, তাই নাকি! বললেন, ‘হ্যাঁ। ডায়মন্ড লাইব্রেরী। আমার বই ছাপে।’

আমি বললুম, ঠিক আছে। আমি দেখছি। ‘স্বামী আজ আসামী’—এই স্ক্রিপ্ট রেডি ছিল। নিয়ে এসে প্রসাদদাকে দিলুম। আমাকে একজন বলল, ‘তুই প্রসাদদাকে বই দিয়েছিস? ও একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠিত নাট্যকার। ও নিজের নামে চালিয়ে দেবে ভালো লাগলে।’ আমি বললুম, অতবড় একজন রাইটার এটা করবে? বললে, ‘ওরা বেশিরভাগজন এটা করে। এমন ঘটেছে। নতুন রাইটারের লেখা নিজের নামে চালিয়ে দিয়েছে।’ মনটা খটকা ঠেকল। এবার আমি প্রসাদদাকে জিজ্ঞেস করছি, বইটা দিয়েছেন? বললেন, ‘দেওয়া হয়নি।’ এদিকে দশ-পনেরো দিন হয়ে গেছে। আমি বললুম, কোথায় দিতে হবে বলুন, আমি গিয়ে দিয়ে আসছি। প্রথমে কিছু বললেন না, তারপর কী ভেবে বললেন, ‘আচ্ছা তুই নিজেই যাবি। নিজে গিয়ে দিয়ে আসবি। ডায়মন্ড লাইব্রেরী।’ এদিকে আমাদের রিহার্সাল চলছে চিৎপুরে। একটা ঘর ভাড়া নেওয়া হয়েছে। তো, আমি চলে গেলুম একদিন। বললে, ‘কী ব্যাপার?’ আমি বললুম, আমায় প্রসাদদা পাঠিয়েছেন। একটা যাত্রাপালা আছে। ছাপার ব্যাপারে এসেছি। সব দেখে বললেন, ‘শুনুন এই মুহূর্তে আমরা নতুন রাইটারের বই ছাপছি না। একমাত্র প্রতিষ্ঠিত নাট্যকারদের বই ছাপছি।’ মনটা খারাপ হয়ে গেল। ফিরে এলাম।

হঠাৎ করে মালিক তিনদিনের ছুটি ডিক্লেয়ার করল। বাড়ি চলে এলাম। বসে আছি, একদিন গোপীনগর থেকে একজন বন্ধু এসে হাজির, তোমায় একদিন থাকতে হবে। কেন?… না, আমরা তোমার লেখা বই করছি, শো করছি। আমি বললাম, তাই নাকি? বললে, হ্যাঁ।—আমার লেখা বই বলতে, তখন প্রিন্ট হয়নি। ওই মহেশপুর ক্লাব (স্ক্রিপ্ট) নিয়ে গিয়েছিল, ওরা আবার ওদের দিয়েছে, আমি ভাবলুম, বাবা! ওরা আবার ওদের দিয়েছে, আচ্ছা তো! বন্ধু বলল, শোয়ের দিন থাকতেই হবে। প্রথম দিন হবে মহাদেব হালদারের বই, কৈকালাতে বাড়ি ওঁর।—ওইদিনও আপনাকে থাকতে হবে। মহাদেবদা নিজে উপস্থিত থাকবেন।—আমায় চিঠি দিয়ে ছেলেরা নিমন্ত্রণ করে গেল। ইছাপুর কমিউনিটি হেলথ সেন্টারটা যেখানে আছে তার পাশে একটা জায়গায় শো-টা হয়েছিল। মহাদেবদাকে আমি চিনতাম না। বই পড়েছি, অভিনয় করেছি। কিন্তু ওঁকে চিনতাম না। যাত্রার বইয়ে ছবি থাকত, দেখেছি। ক্লাবের ছেলেরা পরিচয় করিয়ে দিল অইখানে,—এই মহাদেবদা। সেদিন যাত্রা দেখছি, মহাদেবদা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি কতগুলো বই লিখেছেন?’ আমি বললুম, বেশ কিছু লিখেছি, পেশাদারেও আমার বই চলছে। তখন বললেন, ‘আপনার বই ছাপেননি?’

আমি বললুম, না। বই ছাপা হয়নি। আমি সে-ই ভাবে যোগাযোগ করে উঠতে পারিনি। তখন মোটামুটি মার্কেটে মহাদেবদার তিরিশখানা বই প্রিন্টেড। সে-ই জায়গায় দাঁড়িয়ে উনি। উনি বললেন, “ঠিক আছে। আমি আপনাকে একটা চিঠি লিখে দিচ্ছি। এটা নিয়ে ইউনাইটেড পাবলিশার্সের কাছে চলে যান। সুভাষ ধর, পাবলিশার। ওই চিৎপুরেই বাড়ি। তিনতলার উপরে চলে যাবেন। আর যেটা এখানে অভিনয় হচ্ছে—তার স্ক্রিপ্ট আছে তো? আপনি অরিজিনাল স্ক্রিপ্ট নিয়ে যাবেন। গ্যারান্টি দিচ্ছি, আপনার বই চোট হবে না। আমি সুভাষবাবুকে ফোন করে দেবো। নতুন রাইটার। ওর বইটা যদি পছন্দ হয় ছাপবেন।” তার দু-দিন পরেই আমি চলে গেছি কলকাতা। গিয়ে সুভাষবাবুর সঙ্গে দেখা করেছি। উনি খুব আপ্যায়ন করলেন। বললেন, “আপনাকে মহাদেব পাঠিয়েছে? আসুন আসুন। কতগুলো বই লিখেছেন।… বললেন, এক কাজ করুন, বইটা দিয়ে যান, আপনার বই যে ছাপবো এই কথা আপনাকে দিতে পারছি না এই মুহূর্তে। তবে বইটা যদি আমার পছন্দ হয়ে যায় অবশ্যই ছাপবো। আপনার ল্যান্ডফোন নাম্বার দিন।” আমি বললাম, দেখুন, আমি এই দলে রিহার্সাল দিচ্ছি। বললেন, ‘তাহলে তো অতি উত্তম কথা। তাহলে আপনি আপনার মালিকের অফিসের ফোন নাম্বার দিয়ে যান।’ সে বছর ছিলাম আমি যাত্রালোকে। নাম্বার দিয়ে চলে এলাম।

বললে বিশ্বাস করবেন না, বুঝলেন, একদিন রাত্রিবেলা, আমরা অফিসে বসে আছি, মালিক আছে, ম্যানেজার আছে, আমরা বসে গল্প করছি নাটক সম্বন্ধে। হঠাৎ ফোন এল। আমায় বলল, অসীমবাবু আপনার ফোন। আমার মনে হল এ তো নিশ্চয়ই সুভাষবাবুর ফোন!… উনি বললেন, ‘আপনি কলকাতায়? কালকে এসে দেখা করুন।’ বললুম, কী ব্যাপার? আপনি পড়েছেন বইটা? বললেন, ‘আপনি আসুন, আপনার সঙ্গে কথা আছে।’ গেছি পরের দিন। বললেন, ‘হ্যাঁ, আপনার বই পছন্দ হয়েছে। আমরা ছাপবো। কিন্তু প্রথম বই। আমি বেশি পয়সা দিতে পারবো না। আপনাকে পাঁচখানা বই দেবো। প্রিন্টেড বই। হাজার টাকা পারিশ্রমিক আপনাকে দেবো।’ হাজার এক টাকা। আমি টাকাটা নিয়ে তখন আর ভাবিনি। খুব আনন্দ হলো। এগ্রিমেন্ট হয়ে গেল, উকিলের কাগজে। ওইদিনই উনি হাজার এক টাকা দিয়ে দিলেন। বুঝলেন? আমি শুনেছি, ভৈরববাবু এত টাকা পান! কিন্তু আমি আর সে-ই অবস্থায় ছিলুম না। বইটা ছেপে বেরোবে এটাই একটা বড় ভাবনা তখন। পাঁচজন পাঁচটা জায়গায় পড়বে, অভিনয় করবে এটাই তখন বড় মনে হলো। এক মাসের মধ্যেই উনি বই ছেপে ফেললেন। আমায় আবার ফোন করে ডাকলেন। পাঁচটা বই আমার হাতে দিলেন। এসে যাত্রালোকের মালিককে একটা কপি দিলাম। সে বই চুটিয়ে ব্যাবসা করল। আমায় মালিক বলল, শুনুন, মার্কেট খেয়েছে আপনার বই। খবর আছে।

ওঁরা বই ফার্স্ট ছেপেছিল দু-হাজার কপি। ওটা ছাপার চার মাস পরেই প্রকাশকের ফোন এল—বই আছে আর? আপনি নতুন কিছু লিখছেন? আপনি বই নিয়ে আসুন।—তখন বুঝতে পারলুম বইয়ের ডিম্যান্ড আছে। আমি বললুম, আছে। কী নামকরণ করেছেন? আমি বললুম, ‘মা কুমারী মেয়ে যাচ্ছে শ্বশুরবাড়ি’। শুনে তো চমকে উঠলেন। অ্যাঁ! এতো সাংঘাতিক নামকরণ। আমি বললুম হ্যাঁ। আলট্রা মডার্ন বই। বললেন, আরে নিয়ে আসুন স্ক্রিপ্ট। বাড়ি থেকে স্ক্রিপ্ট নিয়ে গিয়ে জমা দিলুম। দশ দিন পরেই ফোন, ‘আপনার বই আমরা ছাপছি।’ তখন আমায় দিলেন, পাঁচ হাজার এক টাকা। দ্বিতীয় বইয়েই। ওই বইটার পাঁচ-ছ’মাস পরেই আবার ফোন। নতুন বই লিখছেন? আমি বললুম, হ্যাঁ। আর কয়েকটা সিন বাকি। বললেন, লিখুন। লিখে নিয়ে আসুন দিন পনেরোর মধ্যে। তাড়াতাড়ি। ‘মোহন গাঁয়ের মোহিনী’ লিখলুম। নিয়ে চলে গেলুম। এবার দিলেন সাড়ে ছ’হাজার টাকা। তার পরেই হঠাৎ, একদিন আমার দল থেকে হেঁটে সত্যনারায়ণ অপেরার দিকে যাচ্ছি, যে ভদ্রলোক আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন প্রথমে, যে আমরা নতুন রাইটারদের বই নিই না, সে-ই ডায়মন্ড লাইব্রেরীর, উনি বসেছিলেন দোকানের মুখেই, দরজার সামনে, আমায় ডাকলেন। ডায়মন্ড লাইব্রেরী কলকাতার বিশাল পাবলিশার্স। ব্রজেনবাবু থেকে হেন রাইটার নেই যাঁদের বই ওখান থেকে বেরোয়নি!… বললুম, কী ব্যাপার বলুন তো! বললেন, আপনি অসীমবাবু না? আমি বললুম, হ্যাঁ। বলুন। বললেন, ‘আপনি বইগুলো লিখছেন, আর সব ওই ইউনাইটেড পাবলিশারকে দিয়ে দিচ্ছেন?’ বললুম, প্রথম বইটা তো ওঁরাই ছেপেছেন। আপনারা তো আমার বই ছাপলেন না, বললেন নতুন রাইটার। উনি বললেন, ‘হ্যাঁ, বলেছিলাম, সেটা অস্বীকার করব না। এক কাজ করুন, আপনার বই লেখা আছে?’ বললুম, কাজ চলছে। সময় দিতে হবে আমাকে। বললেন, ‘মাস দুয়েকের মধ্যে আমায় একটা বই দিন না!’ বুঝলেন? আমি বললুম, ঠিক আছে। দেবো। এই করে, ‘দোহাই বৌমা ঘর ভেঙো না’, বইটা লেখা হলো। লিখে দিয়ে এলুম। পাঁচ থেকে ছ’দিনের মাথায় আমায় ফোন করেছেন—‘আমার বই পড়া হয়ে গেছে। আপনার বই ছাপবো। আপনি কত টাকা নেবেন, বলুন?’

আমি সত্যি কথাই বলেছি, ওরা আমাকে লাস্ট সাড়ে ছ’হাজার টাকা দিয়েছে। এবার আপনার সিদ্ধান্ত। উনি বললেন, ‘আমরা দশ হাজার টাকা দেবো। আপনি কিন্তু অন্য জায়গায় আর বই দিতে পারবেন না।’ আমি বললুম—সে কী! বললেন, ‘না, যা লিখবেন, আপনার সমস্ত বই এবার আমরা ছাপবো।’ হঠাৎ করেই রাজি হয়ে গেলুম। ঠিক আছে, তাই হবে। পরের পর ওদের বই দিতে আরম্ভ করলুম। লাস্ট বই ছেপে বেরিয়েছে, ‘রক্ত চন্দনে সেজেছে দুর্গা’। উনি বাইশশো বই ছাপতেন। সেটাও বিশাল টাকার ব্যাপার। একটা বই ফ্লপ হয়ে যাওয়া মানে একদম শেষ। একটা বই যদি অ্যামেচারে না চলে, বহু টাকা লস করে যাবে পাবলিশার। তবে ওরা লাভও করে। বর্তমানে ধরুন একটা যাত্রার বইয়ের দাম আশি টাকা। আমায় দিতে হয়েছে দশ হাজার টাকা। এবার আপনি হিসেব করুন। এই হচ্ছে বই ছাপার গল্প।

আপনার নিজের লেখা, পছন্দের তিনটে যাত্রাপালা যদি বেছে নিতে বলি—কোনগুলি বেছে নেবেন? ধরুন আপনার যাত্রাপালাকে কেউ বুঝতে চাইছে। তার সবগুলো পড়ার সময় নেই। অথচ সে আপনার লেখার ধরন বুঝতে চাইছে, আবার অ্যামেচার যাত্রা কী সেটা বুঝতে চাইছে। আপনি কোনগুলি পড়তে বলবেন?

আমি তিনটে পালার নাম বলছি। একেবারে বর্তমান সমাজকে তুলে ধরেছে। একটা হচ্ছে, ‘পাপের আগুনে পুড়ছে প্রতিমা’। দু-নম্বর বলব, ‘বোধনে বিজয়ার বাজনা’। আর তিন নম্বরে রাখব, ‘মায়ের মন্দিরে দেবীর লাশ’। এই তিনটে যাত্রা আমি পড়তে বলব। বহু জায়গায় অভিনয় হয়েছে, আজও হচ্ছে। শুধু পশ্চিমবাংলায় নয়। কলকাতার যে পাবলিশার, ডায়মন্ড লাইব্রেরী, তার যে কর্ণধার, তাঁর মুখ থেকে আমি শুনেছি, ‘আপনার বই শুধু পশ্চিমবাংলা নয় আসাম ত্রিপুরা থেকে বাংলাদেশে পর্যন্ত অভিনয় হয়।’ শুনে আমার খুব ভালো লেগেছিল। আসামে যাত্রা করতে গিয়ে দেখেওছি, আমার যাত্রা হচ্ছে। পোস্টারে আমার নাম। অসীমকুমার হালদার রচিত ‘কলির কালনেমি’।

আপনি নিজে নট ও নাট্যকার। কখন লিখতেন? লেখা তো একটা নিরবচ্ছিন্ন সময় দাবি করে।

লেখাটা কী বলুন তো… সবসময় বসলেই যে লেখা যাবে এমন কিন্তু নয়! আমি যখন বাড়িতে থাকতাম, সবাই শুয়ে পড়ত, সব চুপচাপ হয়ে যেত, লিখতে বসতাম। দেখা গেল লিখতে লিখতে ভোর হয়ে গেছে। কোনও জায়গায় আটকে গেছে, মেলাতে পারছি না, মাইন্ডটা ডিস্টার্ব করছে, নাছ খুলে নিজেই বেরিয়ে গেছি, পায়চারি করেছি, আবার এসে লিখতে বসেছি। যাত্রাদলে অভিনয় করা কালীন যেসব বই লিখেছি, সেটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার! যেখানে সমস্ত আর্টিস্ট খাওয়াদাওয়া করে শুয়ে ঘুমোচ্ছে, আমি ঘুমটা ত্যাগ করে একঘণ্টা সময় অন্তত বের করে নিতুম। ক্লান্তি থাকলেও লিখতে বসতুম। আমাকে রাখালবাবু বলেছিলেন, ‘যদি তুই নাট্যকার হিসেবে স্বীকৃতি পেতে চাস, তবে এর থেকেই তোকে সময় বের করতে হবে। না হলে তুই সময় পাবি না।’ সবাই ঘুমিয়ে পড়তো, আমি বসে বসে লিখতুম। একঘণ্টা দেড় ঘণ্টা লিখে শুয়ে পড়তুম। যাত্রা চলাকালীন এটা আমার প্রতিদিনের অভ্যাস ছিল। সব আর্টিস্টরাই এটা জানতো যে, ‘দাদা লেখে’। কেউ ডিস্টার্ব করত না। আমায় বলত যে, ‘দাদা ঘুমিয়ে পড়ছি, আপনি লিখতে শুরু করুন।’ বাড়িতে থাকলে, সে-ই রাত দুটো তিনটে হয়ে যেত। একই লেখা বারবার লিখে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছি। হয়নি। পায়চারি করছি। ফিরে আসছি। আবার লিখছি। লেখা সত্যিই আলাদা জিনিস! বসলেই লেখা যাবে না!

শুধু লিখব অভিনয় করব এটা নয়। পড়াশোনা করতে হবে। আমি অভিনয় করার জন্য প্রচুর পড়েছি। এপিক থিয়েটারে যখন ছিলুম, দেবেশ চক্রবর্তী প্রচুর বই দিয়েছেন পড়তে। পাঁচ বছর ছিলুম। উনি বলেছিলেন, যেটুকু শিখিয়েছি, যাত্রা জগতে চলে গেলে ইনকাম হবে, তোর অসুবিধে হবে না। আরও একটা ব্যাপার। যেমন ধরুন, শ্যামল চক্রবর্তী ডিরেকশন দিচ্ছেন, আমার চেয়ে ছোট, বললেন, ‘আপনাকে কী নির্দেশ দেবো, আপনিই তো আমাদের শেখাবেন।’ আমি বললুম না, একদম না। ছোটদের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। শ্যামল, তুমি আমাকে ডিরেকশন দাও, আমি নিশ্চয়ই নেবো। সত্যিই শেখার জিনিস আছে এখনও। উৎপল দত্তের কথা আসবেই। বলেছিলেন, ‘অ ভয়ে হ্রস্বই ন অন্তস্থ য় এই নিয়ে যে অভিনয়, আমি অ-টাই শিখে উঠতে পারিনি, ভিনয় তো দূরের কথা।’ তাহলে বুঝতে পারছেন? যে হচ্ছে অভিনয় জগতে সাগর, যাঁর অত পড়াশোনা, ওই লোক যদি এই কথা বলে, আমরা কী! আমরা কিছুই নয়! সত্যি কথা এটাই, আমরা কিছুই জানি না। আমি যখন ডিরেকশন দিই, বলি, আমি যেটা দেখালুম এটাই লাস্ট পয়েন্ট নয়। আর কেউ ডিরেকশন দিলে আরও ভালো জিনিস হয়তো তোমাকে দেখাতে পারবে। আপাতত এইটা দেখাচ্ছি, শেখার চেষ্টা করো। শেখার শেষ নেই। আমি বলি, এই ক্যারেক্টারটা করছো তো, দুটো সিন পড়ে শোনাও তো। পড়ে শোনাবার পর আমি ওকে বোঝার চেষ্টা করি। তারপর চয়েস করি। বলি, তোমার এই ত্রুটিগুলো কাটিয়ে উঠতে হবে।

আচ্ছা এবার একেবারেই অন্য বিষয় জানতে চাইব। আপনি আর কোন পালাকারদের যাত্রাপালা পড়তে বলবেন? যাঁরা আপনার প্রিয়। যাঁদের লেখায় আপনি বিশেষ কিছু খুঁজে পেয়েছেন। এমন পাঁচজন পালাকারের নাম যদি বলেন।

ভৈরববাবু তো কিংবদন্তী। প্রসিদ্ধ নাট্যকার। যেটাকে বলিষ্ঠ সংলাপ বলে সেটা ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখায় আছে। আমার তো মনে হয় যাত্রার জগৎটাকেই উনি পালটি খাইয়েছেন। আগেকার দিনে প্রসাদবাবু, কানাই নাথ তাঁদের যে স্টাইল, সে-ই স্টাইল থেকে বেরিয়ে এসে আধুনিক ছাঁচে উনি বই লিখতে শুরু করলেন। ওঁর লেখা অনেক বইতে আমি অভিনয় করেছি। ‘মা মাটি মানুষ’, ‘একটি পয়সা’, ‘রক্তে বোনা ধান’, ‘অরুণ বরুণ কিরণমালা’। আমি এখনও অ্যামেচার ক্লাবকে ওঁর বই অভিনয় করতে বলি। গত পরশুদিনই একজন এসেছিল, তাকে বললুম, যদি জোগাড় করতে পারিস, ভৈরববাবুর ‘একটি পয়সা’ কর। আর একজন রাইটার, ওঁর বই মার্কেটে প্রিন্টেড নেই, নিজে একজন বলিষ্ঠ অভিনেতা ছিলেন, ক্লাসিক্যাল অভিনেতা, ওঁর নাম হচ্ছে শ্যামল চক্রবর্তী। উনি মারা গেলেন গতবছর গাড়ি দুর্ঘটনায়। অভিনয় করতে গিয়েছিলেন গোঘাটের ওদিকে। ওঁর স্ক্রিপ্ট পেলে অভিনয়ের কথা বলি, মানে এককথায় অপূর্ব। উনি নিজে ভিলেন চরিত্রে অভিনয় করতেন, আমি পেশাদার জগতে ওরকম ভিলেন দেখিনি। ‘অ-এ অজগর আসছে তেড়ে’-যেটা উনি গত বছর করছিলেন, ও অভিনয় কল্পনার অতীত! আমরা ভাবতেও পারি না এমন একটা চরিত্র। ওঁর লেখা সংলাপও সম্পূর্ণ আলাদা। উনি লেখক-নির্দেশক-অভিনেতা। লিখছেন ধরুন—একটা ক্ষ্যাপা চরিত্র। সেভাবেই সে আসছে। নাটকের মিড্‌ল-পয়েন্টে গিয়েও সে ক্ষ্যাপা। শেষ সিনের আগে চরিত্রটা দেখা যাচ্ছে—আসলে ভিলেন। একটা মামা চরিত্রকে খাড়া করে সে নাটকের ঘাতপ্রতিঘাত নিয়ন্ত্রণ করেছে এতক্ষণ। দর্শক তো চমকে উঠছে তখন। এ ভিলেন! আমি একটা অমন চরিত্র সাজিয়ে তৈরি করে লিখলুম, ‘মায়ের মন্দিরে দেবীর লাশ’। আর কার কথা বলব? হ্যাঁ, নির্মল মুখার্জি। উনিও নট ও নাট্যকার। আমি অভিনয় করেছি ওঁর সঙ্গে। পেশাদার অ্যামেচার দু-রকমই লিখেছেন। ওঁর বই সাদামাটা ঘরোয়া। সাংসারিক ব্যাপার। হয়তো তিন ভাই আছে। জামাই আছে। জামাই হয়তো খল চরিত্রটা করছে—এইরকম। ভৈরববাবুর মতো মদের ভাঁটি থেকে রাজনীতি—এসব এই নাটকে নেই। আমি মূলত চেষ্টা করেছি ভৈরববাবুর ছাঁচে ফেলে যাত্রা সৃষ্টি করতে। বুঝেছেন তো? বর্তমান রাজনীতি, সাংসারিক সমস্যা সব এক জায়গায় আছে—ভৈরবদার পালায়। আর সত্যগোপাল দত্ত আছেন। নিঃসন্দেহে ভালো রাইটার। মহাদেব হালদারের কথা তো বলেইছি। উনি থিয়েটার-যাত্রা মিলিয়ে প্রায় আশিটা বই লিখেছেন। একদম সহজ বই। নতুন ক্লাব যারা আসে, আমি তাদের অ্যাপ্রোচ করি, তোমরা মহাদেবদার বই করো। এই পাঁচজন মোটামুটি আমার প্রথম পছন্দের রাইটার।

দীর্ঘ যাত্রা জীবনে আপনার প্রাপ্তি অনেক। পশ্চিমবঙ্গ যাত্রা আকাদেমি আপনাকে মানপত্র দিয়ে সম্মানিত করেছে। যাত্রা করেই সংসার সামলেছেন। আপনার সংসার জীবনের কথা শুনব।

আমি যাত্রা করা কালীন বিয়ে করি। আমার স্ত্রীর নাম কল্যাণী হালদার। ওর বাড়ি পোলবা, কাসুন্দি পাড়া। ওদের বড় ফ্যামিলি। তিন ভাই, চার বোন। আমাদের এক ছেলে, এক মেয়ে। মেয়ে বড়। মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে আজ পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ বছর তো হলোই! মেয়ের যে বছর বিয়ে দিয়েছি, আমি অভিনয় করছি তখন শিলাদিত্য পত্রনবিশের সঙ্গে। উনিও মারা গেলেন ড্রিঙ্ক করে করে। আর ছিলেন জয় ব্যানার্জি। দুজনেই চলচিত্র জগতের মানুষ। মেয়ের দুই মেয়ে। সে-ও ঘোর সংসারী। বড় নাতনি এয়ার হোস্টেসের ট্রেনিং নিচ্ছে। আর আমার ছেলে একটা ছোটখাট কাজ করছে। ওর বিয়ে হয়েছে। একটি ছেলেও হয়েছে। আমি এখন কী করি তো বলেইছি। একরকম চলছে।

আমার প্রশ্ন মোটামুটি শেষ। কোনও প্রশ্ন করা হয়নি মনে হচ্ছে? হয়তো বলবেন ভেবে রেখেছিলেন। আমরা প্রশ্ন করিনি তাই বলা হয়নি, এমন। আপনি যোগ করতেই পারেন।

(ভেবে নিয়ে) হ্যাঁ। একটা প্রশ্ন করেননি, আমার শেষ অভিনয় কবে? আমার শেষ অভিনয়, ২০১৭ সালে। ২০১৭ সালের ২৭ জানুয়ারি সরকারি উদ্যোগে তারকেশ্বরের কাছে কোটালপুর মাঠে কৃষি মেলা হয়। কোটালপুর হাই স্কুলের হেড মাস্টারমশাই একটা চিঠি লিখে অনুরোধ করেন। উনি আমায় চিনতেন। লিখেছেন, নাটকে একটা ভিলেন চরিত্রে আমায় অভিনয় করে দিতে হবে। বইয়ের নাম, ‘অসমাপ্ত অঙ্গীকার’। তখন ওই স্কুলের কাজে জড়িয়ে আছি। অভিনয় করলে টাইম দিতে হবে। আমি ফিরিয়ে দিলুম অনেক ভেবে। আবার দশদিন পরে এসে হাজির। ছেলেরা রাগারাগি করছে, যে আমাকেই তারা চায়। না পারলে কোনও আর্টিস্ট জোগাড় করে দিতে হবে। তখন আবার চিন্তা করে বললুম, আচ্ছা করে দেবো। সেদিনই ওরা স্ক্রিপ্ট দিয়ে গেল। কালেকশন টিম। বিভিন্ন জায়গার শিল্পীরা অভিনয় করবে। ডিরেকশন দিতে হবে আমাকেই। মেয়েরা সব আসবে পেশাদার দল থেকে। গায়কও পেশাদার। তিনদিন ফুল স্টাফ রিহার্সাল দিয়েছিল। সবার পার্ট মুখস্থ ছিল। সবাই প্রায় পেশাদার। অতএব কোনও অসুবিধা হলো না। ওই আমার শেষ অভিনয় ২৭ জানুয়ারি ২০১৭। আমার ওই বোর্ডিং স্কুলের কাজ। ওই কাজ সামলে আর সময় হয় না। অনেক দায়িত্ব। মসাগ্রাম থেকে, সাতগেছিয়া থেকে কত ক্লাব এসেছে। আমি আর সময় দিতে পারি না। পারিশ্রমিক দিতে চাইছে—কিন্তু সেটাই তো বড় কথা নয়। আমাকে তো সময় দিতে হবে।

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। অনেক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বিনিময় করলেন। অনেকটা সময় দিয়েছেন। আবার প্রয়োজন হলে আসবো।

আপনাকেও ধন্যবাদ।



[এই আলাপন রেকর্ডেড হয়েছে ৬ অক্টোবর ২০২০ তারিখে। এই দীর্ঘ আলাপ-পর্বে সঙ্গী ছিলেন প্রীতি ঘোষ। তাকে কৃতজ্ঞতা জানাই।]


প্রচ্ছদ ও অন্যান্য ছবি সৌজন্য: সুব্রত ঘোষ, সোহম মিত্র।