পচা আবর্জনা ভর্তি ডাম্পারগুলো তলপেটের ভার খালাস করার জন্য এখানে এসে, প্যান্টের জিপার খোলার মতো করে খুলেই হুড়হুড় করে ময়লা, পচা, গলা আবর্জনা ঢালে।
মাথা ঝিম করা পচা, টক, পাহাড়ের স্তূপ হয়ে থাকা জঞ্জালের গন্ধের অদূরে শ্রমিক মহল্লা। বস্তির ওপর ঝুলে থাকা বাতাস ভারী মেঘের মতো অনড় হয়ে থাকে সর্বক্ষণ। নোংরা, উঁচু, জঞ্জালের স্তূপের চূড়ার ময়লা আঁচল সরিয়ে ওঁ জবা কুসুম শঙ্কাশং কাশ্যপেয়ং বলে সূর্য যেই মুখ তোলে, চোখ মেলে—তখনই দেখা যায় রোগা, কাঠি কাঠি, হাড্ডিসার, পাঁজর বের হওয়া মানুষ, কুকুর, হাড়গিলে, কাকের দল—সব একসঙ্গে মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ে জঞ্জালের স্তূপের ভেতর থেকে খুঁটে নিচ্ছে জীবনের রসদ।
অদূরে, উঁচু সেতুর ওপর দিয়ে হাওয়ার বেগে চলে যাওয়া গাড়ির ভেতর থাকা মানুষজনেরা নাকে রুমাল চেপে গন্ধে ভারী হয়ে থাকা এলাকাটাকে নরক, ডিসগাসটিং বলতে বলতে পার হয়ে যায়। ভ্রূক্ষেপহীন জায়গাটা এসব মন্তব্য গায়ে না মেখে দিব্যি পার করে দেয় বর্ষা, শীত, গ্রীষ্ম।
জঞ্জালের স্তূপের আড়ালে, ময়লা গায়ে মেখে, ময়লা, কালো, ঢ্যাঙা বংশী পাতাখোরদের দলের গোল চক্করে ভিড়ে গিয়ে, রাংতার ওপর সাদা গুঁড়ো রেখে, তার তলায় আগুন দিয়ে নাকের ফুটো দিয়ে টেনে নিচ্ছিল সাদা ধোঁয়া। বার দু-চার সাদা ধোঁয়া মাথার ভেতর সেঁধিয়ে গিয়ে বংশীকে টলমল করে দিল। মাথায়, শরীরে কুয়াশা মেখে, বিস্তৃত, জঞ্জালের উঁচু পাহাড় চূড়ায় উঠতে থাকে বংশী। জুট মিলের মাগী কলে কাজ করা বংশী পাহাড়ের চূড়ায় উঠে দেখতে পায় কারখানার উঁচু চিমনি। চালু থাকা অবস্থায় ডক্টর বেরির এই ফ্যাক্টরির চিমনি দিয়ে গল গল করে কালো ধোঁয়া সময় সময় বেরিয়ে মিশে যেত আকাশে। আকাশটা এখনকার মতো ফরসা, নীল থাকতো না সে সময়। এখন শালা চিমনির আশপাশের আকাশটা বিবিবাগানের মেয়েদের মতো সেজেগুজে, ফিটফাট দাঁড়িয়ে আছে। না চাইলেও চোখ চলে যায়।
কতদিন হয়ে গেল, মালতী ঘর ছেড়ে চলে গেছে। নারীর সঙ্গ পাবার জন্য এই মুহূর্তে বংশীর শরীরের ভেতরটা কেমন পাগলা ঘোড়া হয়ে উঠতে চাইল। চাপা, দমবন্ধ শরীরের না-পাওয়া ইচ্ছেরা আঁচড়ে, কামড়ে, খিমচে ধরতে চাইলে পরনের ঢিলেঢালা প্যান্টটাকে বংশী একটানে খুলে ফেলে উদোম হলো। শুকনো, ঢ্যাঙা, নগ্ন বংশী তার প্যান্টটাকে হাতে নিয়ে চক্রাকারে ঘোরাতে লাগল জঞ্জালের স্তূপের মাথায়।
একটা ড্রোন, মিলের চিমনির পাশ দিয়ে উড়তে উড়তে এই ডাম্পিং গ্রাউন্ডটার ছবি তুলে নিচ্ছিল আকাশ থেকে। তার ডিজিটাল ক্যামেরায় উলঙ্গ বংশীর ছবি উঠে যায় টিভি পর্দার বিপন্ন, বানভাসি মানুষের মতো। চৈত্রের কড়া চাবুকের মতো রোদ চারিদিকটাকে চাবকাতে থাকে।
সেলাই-ঘরের মুংলি, বংশীকে খুঁজতে খুঁজতে এদিকে আসে বহুরূপী সাজে। মুংলির চোখের তলায় গাঢ় লাল রঙের প্রলেপ। মাথায় চুড়ো করে বাঁধা ক’টা চুল। একদিকে ক্লিপ দিয়ে লটকানো আধখানা ফালি চাঁদ। চুড়োর মাঝখান দিয়ে উঁকি মারছে প্লাস্টিকের সাপ। মুখের চারপাশে লাল রঙের পাশাপাশি সাদা রঙের ছোপ। পরনে বাঘছালের মতো কাপড়। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। কানে লাল পলার মতো বড় দুল। সব মিলিয়ে দৃষ্টি কাড়ার মতোই লাগছে মুংলিকে। হাতে ধরা সিঁদুর মাখানো ত্রিশূল নিয়ে পাতাখোরদের গোল হয়ে বসে থাকার চক্করে এসে দাঁড়িয়ে, গলার আওয়াজ তুলে বলল, ব্যোম শঙ্কর। ঝিম মেরে থাকা নেশুড়েরা চোখের পাতা খোলে, মুংলির গলার আওয়াজে। দু-হাত জড়ো করে বলে ওঠে, ভিখ্ মাঙ্গাদের এখানে কিছু দেবার নেই। সাইড কাটো।
মুংলি দেখল, বংশীর ঢোলটা আছে কিন্তু বংশী নেই। ঢোল ফেলে রেখে গেল কোথায় শুয়োরের বাচ্চা! এখনই বেরুতে না পারলে, দিনটা চৌপাট হয়ে যাবে। এদিক-ওদিক দেখতে গিয়ে আচমকাই চোখ গেল তার পাহাড়ের মাথায়। বংশী তালজ্ঞানহীন, যেন শ্রীকৃষ্ণ। চক্র ঘোরাচ্ছে, প্যান্টের।
মুংলি গলা উঁচু করে বংশী, বংশী বলে ডাকতে থাকে। কিন্তু বেশরমটার কানে পৌঁছায় কিনা বোঝে না। মুংলিকে চমকে দিয়ে ড্রোন তার ঘুরন্ত পাখায় হালকা শব্দ করতে করতে খুব নীচু দিয়ে উড়ে চলে যায়।
২.
ভিক্ষার ঝোলা কাঁধে সারাদিন চৈত্রের রোদে ঘুরে এসে মুংলি সেতুর ঢালু পথ বেয়ে উঠতে থাকে। সেতুর মাঝখানে এসে একটু জিরিয়ে নেয়।
আবর্জনার স্তূপের আড়ালে সূর্যটা ঢলে গিয়ে হারিয়ে যায়। চারিদিকে ভূতের মতো অন্ধকার বাদুড়ের ডানা মেলে নেমে আসে লম্বা পাকুড় গাছ থেকে। শিকারি পশুর মতো অন্ধকারে চোখ জ্বেলে গাড়িগুলো বেরিয়ে যায় বড় বড় শ্বাস ফেলতে ফেলতে। আর একটু দূরেই সেতুর রাস্তাটা বাঁক নিয়ে হারিয়ে গেছে গাছের আড়ালে। একটা ট্রাক দাঁড়াতে, ড্রাইভারের কেবিনের দরজা খুলে, কাউকে জোর করে ঠেলে ফেলে দিয়ে ট্রাকটা সেতুর ওপর দিয়ে চলে গেল ঊর্ধ্বশ্বাসে।
কৌতূহল নিয়ে মুংলি এগিয়ে যায় জায়গাটা লক্ষ্য করে। রাস্তার বাঁকে এসে দাঁড়াতে, এদিক-ওদিক যাওয়া গাড়ির আলোয় দেখতে পায়, পার্বতী রাস্তার পাশে উবু হয়ে বসে, হাওয়ায় উড়ে যাওয়া টাকা কুড়োচ্ছে। পায়ের শব্দে মাটি থেকে মুখ তুলে, মুংলিকে দেখতে পেয়ে বলল, জগৎটা হারামি আর ঠকবাজে ভরে গেছে। রফা করে টাকা দেবে না। শালা চশমখোর।…ও, তোমাকে বলা হয়নি, ছেলেটা আশ্রমে ঠাঁই পেয়েছে। কত লোকের হাতে পায়ে ধরে তবে…।
মুংলি, পার্বতীর কথায় সায় দিয়ে মাথা নেড়ে বলল, গিরিনের খবর কী রে?
যাওয়া হয়নি, অনেকদিন। হাসপাতালেই পড়ে আছে। গেলেই তো একগাদা টাকার ওষুধের লিস্টি ধরাবে। থাক পড়ে, ওখানে দেখভাল তো হবে।
পার্বতীর কথায়, মুংলি চুকচুক করে আওয়াজ করে মুখে। তারপর বলে, গিরিনটা কত বড় মিস্ত্রি ছিল!
মুংলির কথা শেষ করতে না দিয়ে, পার্বতী বলে ওঠে, শুধু মনে রেখে তো পেট শুনবে না। মিলটা সেই কবে থেকে বন্ধ! এ আট-দশ বছরে আমরা নিজেরাই নিজেদেরকে ভুলে গেছি।
মুংলি পার্বতীর পাশ কাটিয়ে ঢালু জমি বেয়ে নীচে, নয়ানজুলিতে নেমে যায়। সারাদিনের বেশভূষা খুলে, নয়ানজুলির জলে শরীরের রং ধুতে থাকে।
পার্বতী তরতর করে নেমে, কাছে এসে, জলের কিনারে দাঁড়িয়ে মুংলিকে জিজ্ঞাসা করল, রাজনকে তুমি চেনো তো ?
মুখে জল পুরে, মাথা নাড়িয়ে মুংলি উত্তর বলে দিল সে প্রশ্নের।
সেদিন রাতে, আমার ঘরে ঢুকে আমার ওপর চড়াও হয়ে বলে, খানকি হয়ে কামাচ্ছিস যখন, তখন আমাকেও ভাগ দিতে হবে।
মুংলি বলে ওঠে, সে কী রে! ও তো তোর হাঁটুর বয়সী। চোলাই বেচে দু-পয়সা পেয়েছে বলে এতদূর!
পার্বতী বলে, তুমি এ কথা আর কাউকে বোলো না। এবারে এলে, জান নিয়ে ফিরতে দেবো না। ওকে দেখাব, আমি কেমন খানকি!
যেমন দ্রুত পায়ে এসেছিল, তেমনি চলে গেল হাইওয়ের দিকে, গিরিনের দ্বিতীয়বারের বিয়ে করা বউ, পার্বতী।
মুংলি কিছুক্ষণ বোবা, স্থির চোখে অন্ধকারের দিকে চেয়ে রইল। তারপর জল থেকে উঠে বস্তির দিকে এগোলো। দূর থেকেই মাইকের আওয়াজ কানে এল মুংলির। যত বস্তির কাছে আসতে লাগল তত জোরে কানে এসে ধাক্কা লাগল মাইকের তারস্বর আওয়াজের।
বস্তির মাঝ বরাবর ঘাসহীন ফাঁকা জায়গাটায় বাঁশ দিয়ে ঘিরে মাইক বাজাচ্ছে বস্তির উঠতি ছেলের দল। চারপাশে রঙিন রাংতা মোড়া দড়ি দিয়ে শিকলি, পতাকা টাঙিয়েছে। উঁচু বাঁশের মাথায় জোরাল সার্চলাইট জ্বলছে হুক টানা কারেন্টে। একটা নতুন সাইকেলে ঝলমলে রঙিন জ্যাকেট আর প্যান্ট পরা বাবরি চুলের একজন আরোহী সাইকেল করে জায়গাটায় গোল চক্কর মারছে।
ভিড় করে থাকা ছেলেদের পাশ কাটিয়ে, মুংলি নিজের নীচু, দমচাপা ঘরের কাছে এসে দেখল, মাস্টার তার ঘরের দরজা আগলে, দু-পা ছড়িয়ে, ঘাড় কাত করে এলিয়ে পড়ে আছে। দু-পা এমন ভাবে রয়েছে, যে ঘরে ঢোকা মুশকিল।
মুংলি মাস্টারকে ত্রিশূল দিয়ে খোঁচা দিয়ে বলল, আরে ও মাস্টার, সরো, ঘরে ঢুকব।
মাস্টার নেশায় বুজে থাকা ঢুলুঢুলু, ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে বলল, আরে যা না, আমায় ডিঙিয়ে যা।
মুংলি, মাস্টারকে ডিঙিয়ে ঘরের তালা খুলে, ঘরে ঢুকে দেখল বাইরের জোরাল আলো ঢুকে ঘরের অন্ধকারকে হটিয়ে দিয়েছে।
সেই আলোয়, কেরোসিন-স্টোভটা ঘরের কোণ থেকে এনে আগুন ধরায় সে। রাতের রান্না বসাবার তোড়জোড় করে।
মাইকে রাজনের গলা গমগম করতে থাকে।
নেশা জড়ানো গলায় মাস্টার দরজার কাছ থেকে বলে ওঠে, বুঝলি মুংলি, মিল নিয়ে এবার একটা এসপার-ওসপার হবে।
মুংলি শোনে, কিন্তু তক্ষুনি কোনো জবাব দেয় না। মাস্টার প্রায় সময় এরকম কিছু একটা বলে। একসময় ইউনিয়ন করত, গলাবাজি করত। এখন সেটা পেটে চোলাই পড়লে চাগিয়ে ওঠে।
মাস্টার ফের ধমকে উঠে বলে, আরে, এটা অন্য ব্যাপার আছে। আমাদের পাওনাগণ্ডা মিটিয়ে দেবার লড়াই।
মাস্টারের কথা শুনে হেসে ওঠে মুংলি, বন্ধ মিলের পাওনা গণ্ডা! তুমি, বুঝলে, নেহাতই বুরবক, সুখী আদমি আছ!—আরও বলে, মিল খুললেও তোমার কোনো ফয়দা নেই। বয়স হয়ে গেছে, মিলের ভেতর ঢুকতে দেবে না।
স্টোভের আগুনে বিড়ি ধরিয়ে ধোঁয়া টানে মুংলি।
বুরবক আমি না তুই, শালা মাদারচোদ। ভিখারি, ভুচ্চর।
মুংলি চুপ করে বিড়ি টানে।
মাস্টার বলে, তুই পার্টির সুব্রতকে জানিস তো। ও খোঁজখবর নিচ্ছে। মিললে, আমদের সবারই মিলবে। একদম ঝুট বাত না-রে।
মুংলি চুপ করে থাকে। স্টোভে বসানো হাঁড়ির গরম জলের ভাপকে তার মিলের চিমনি দিয়ে বেরোনো কালো ধোঁয়া বলে মনে হয়।
মাস্টার বিড়বিড় করে আপন মনে বকতে বকতে নেশার শরীর নিয়ে উঠে পড়ে। অন্ধকারে মিলিয়ে যেতে যেতে গান গায়, হাম ভুখ সে মরনেবালে…কেয়ামত সে ডরনেবালে…আজাদি কা ডংকা বাজাও…।
৩.
মাঝরাতে ভয়ানক হইচই, লোকজনের দৌড়ের শব্দ আর কুকুরের গলা ফাটানো চিৎকারে ঘুম ভেঙে যায় মুংলির। সে ধড়মড় করে চৌকির ওপর উঠে বসে। দরজা খুলে দেখে, আশপাশের বস্তি উজাড় করে ছেলেমেয়ে, বউ-রা ছুটছে।
পাশের ঘরের ল্যাংড়াকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞাসা করল, কী ব্যাপার রে?
ল্যাংড়া গলায় তাড়া লাগিয়ে বলল, যা, যা তাড়াতাড়ি, রোডে ভ্যান উলটেছে।
ল্যাংড়ার বাকি কথা শোনার মতো আর অপেক্ষা করল না মুংলি। সে-ও দেরি না করে ছুটতে শুরু করল হাইওয়ের দিকে। গতবার কেরোসিনের ট্যাঙ্কার উলটে যাওয়ায় মুফতে প্রচুর কেরোসিন মিলেছিল। দৌড়তে দৌড়তে, কাছে এসে দেখে, পিঁপড়ের মতো মানুষের দল হামলে পড়েছে উলটে যাওয়া গাড়িটার ওপর। দেখল, রাজন ড্রাইভারের কেবিনের একজনের পকেটের ভেতর হাত চালিয়ে দিল।
পেছনে, ওলটপালট কী পড়ে আছে ঠিক বুঝে উঠতে পারল না মুংলি। লোহার কিছু একটা লম্বা, সামনের দিকটা চোঙের মতো সরু, পেছনে চাকা লাগানো সে সব জিনিস ছড়িয়ে ছিটিয়ে বস্তা ছিঁড়ে বেরিয়ে এসেছে ঢালু ঘাসের জমিতে। লোকজন তাই নিয়েই চলে যাচ্ছে বস্তির দিকে। লোহার কিলো দরে বেচা দেওয়া যাবে ভেবে, মুংলিও গোটা কয়েক রকেটের মতো দেখতে, লোহার বস্তুগুলি মাটি থেকে তুলে বস্তির দিকে হাঁটা দিল।
পুলিশের টহলদার গাড়ি আসার আগেই, উলটে যাওয়া গাড়ি একদম খালি করে শ্রমিক মহল্লার লোকজন ফিরে এল।
একচোট দৌড়ঝাঁপের পর যখন মুংলি ঘরের সামনে এসে, দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে পড়ল, সেসময় সাইকেলের ওপর বাহাত্তর ঘণ্টার গোল থেকে মৃদু আওয়াজে হিন্দি সিনেমার গান বাজছে, দম মারো দম…। গান শুনতে শুনতে দু-চোখ জুড়ে ঘুম এসে যায় মুংলির।
৪.
স্নিফার ডগ, পুলিশ, প্যারা মিলিটারি ফোর্স, ব়্যাপিড অ্যাকশান ফোর্স, অ্যান্টি বম্ব স্কোয়াড, অ্যাম্বুলেন্স, মেডিকেল ও দমকল বাহিনির সার সার গাড়ি এসে দাঁড়ায় হাইওয়ের ওপর। বস্তির থেকে পাঁচশো গজ দূরে। নিউজ চ্যানেলের লোকাল করসপন্ডেন্সেরা এক্সক্লুসিভের জন্য মাইক ও ক্যামেরা নিয়ে আরেকটু পেছনে।
মাটিতে হাঁটু ঠেকিয়ে একদল পুলিশ পজিশন নেয়, অর্ধবৃত্তাকারে, তাদের রাইফেলের নল বস্তির দিকে তাক করা।
বস্তির কারো তখনও ঘুম ভাঙেনি। এমন সময় পুলিশের এক অফিসার তাঁর হাতে ব্যাটারির ছোট মাইকে গর্জে উঠলেন: বস্তিবাসী সমস্ত মানুষকে বলছি। আমরা জানতে পেরেছি, গতকাল মাঝরাতে যে ম্যাটাডোর ভ্যান উলটে গেছিল এখানে। তার মধ্যে বোঝাই ছিল মর্টার আর বারুদ। সেই সমস্ত বিস্ফোরক পদার্থ বস্তির লোকেরা নিয়ে গেছে। ওই বিস্ফোরক যে-কোনো মুহূর্তে ফেটে গিয়ে বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। পুরো বস্তিটাই নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে। শহরের আশপাশও দারুণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আপনারা এখন বারুদের স্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন। আমার অনুরোধ, আপনারা সবাই ঘর ছেড়ে ধীরে ধীরে বাইরে বেরিয়ে এই খোলা জায়গায় এসে দাঁড়ান। আমরা বস্তির প্রতিটি ঘরে ও আশপাশে তল্লাশি চালাব। নিষ্ক্রিয় করা হবে প্রতিটি বিস্ফোরক। অযথা ভয় পেয়ে দৌড়োদৌড়ি করবেন না। তাতে আপনাদেরই ক্ষতি।
বার তিন-চার এই ঘোষণার পর ক্রমে সজাগ হয়ে বস্তির ভেতরে থাকা, মুংলি, বংশী, ল্যাংড়া, মাস্টার, পার্বতী, রাজন এবং আরও সব আন্ডা-বাচ্চা, বুড়ো-বুড়ি, জোয়ান-মরদ, নারী— সবাই তাদের ঘর ছেড়ে বস্তির ফাঁকা জায়গায় জমা হয়, পরস্পরের দিকে নীরব দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে সবাই যেন সমস্বরে চেঁচিয়ে বলে ওঠে, না। আমাদের নিষ্ক্রিয় করতে এসো না। আমরা ফাটতে চাই, ফাটতে চাই, ফাটতে চাই…।
জঞ্জালের স্তূপকে প্যান করে, ক্যামেরা তার লেন্স চার্জ করে বস্তির দিকে। বস্তির মানুষের দিকে। বস্তির মানুষের সম্মিলিত গলার আওয়াজ বাতাস বাহিত হয়ে সাংবাদিক বা পুলিশ বাহিনির কাছে এসে পৌঁছয় না। থেমে যাওয়া সাইকেলের গোল থেকে তখনও গান বাজচ্ছে: আ চল কে তুঝে ম্যায় লে কে চলু…এক অ্যায়সে গগনকে তলে…যাঁহা গম ভি না হো, আঁশু ভি না হো…বস্ প্যায়ার হি প্যায়ার পলে…।
প্রচ্ছদচিত্র সৌজন্য: www.pinterest.com