জীবন!
১.
ওই যে শান বাঁধানো ঘাটের পুকুর দিঘি পুরোনো দালান
ওইখানে মহিষ ঘাস খেত, দুধে ভরা গাভীর উলান
আজ নেই, একদিন ছিল
আমার বাবার বাবার—বাহারি দিনগুলো
অনেক পুরোনো এখন, ঝাপসা স্মৃতি। বাবা ছিলেন
আজ তিনি নেই, তার বাবা আরও আগে চলে গেছেন
এই তো, এইদিকে আসুন, ছোট কুঁড়ে ঘর,
ছন দিয়ে ছাওয়া। আমার হাড়ের মতোই বাঁশ নড়বড়
ভেঙে গেছে দরজার একটি পাট
একদিন গায়ে কোট পরা ছিল, আজ ছেঁড়া শার্ট
সকালে রেঁধেছি খুদ, এখন গন্ধ ছুটে
এসব খাইনি কখনও, দিয়েছি মুটে
মজুরের কোঁচায় তুলে
মা রাঁধতেন বাসমতী চাল
আজ সে-ই বাসনে খরা, দারুণ আকাল
ছিকার ঘিয়ের বোতলে এখন মাকড়সারা ঝুলে
২.
সামান্য বাতাসেই উড়ে আসে যে বীজ
তা থেকেই জন্ম নেয় বিরাট বৃক্ষ
‘ম’ একটি ব্যঞ্জনবর্ণ, কেবলই ব্যঞ্জনবর্ণ
যদি এর সাথে ‘আ’ স্বরধ্বনি যোগ করো
তবে সৃষ্টির উৎস খুঁজে পাবে
বিশ্ব পরিব্রাজক মার্কো পোলোর হাজার মাইল পরিভ্রমণ শুরু হয়েছিল
মাত্র একটি কদম থেকে
রাইফেল থেকে ছোঁড়া প্রথম একটি গুলিই বাঁধাতে পারে মহাযুদ্ধ
মাত্র একটি কদম ফেলতে পারিনি বলেই
কোনোদিন তোমার পুকুরে আর সাঁতার কাটা হলো না
৩.
নত হতে হতে
এতটাই নত হয়েছি যে,
পদতলেও আর মাথাটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না
যেন তীব্র শীত—
শীত দেশে যেমন নদীর জল বরফ হয়ে যায়,
যেমন মাছগুলি বরফে আটকে থাকে, অবিকল দেখতে পাওয়া যায়,
তথাপি সে মৃত—
তেমনি মাছের মতো,
কেবল মানুষ হয়ে আটকে আছি—এই হাওয়ায়,
অসহ্য আগুনে, স্থির, অচেতন
যেন আমাদের আর নিস্তার নেই
যেন আমাদের আর অন্য কোনো পথ নেই
আমাদের আর অন্য কোনো গন্তব্য নেই
যেন বরফের মতো অনড় শেকলে বাঁধা
ওই গানটির মতো ‘দয়াল যেমনি নাচাও তেমনি নাচি… ‘
৪.
সবকিছু সঁপে দিয়েছি রাজা আমি তোমার নিকটে
আমার চোখ আমার কান আমার আড়ষ্ট মগজ
এইসব ছাড়া অবশিষ্ট আছে কেবল ক্যালসিয়ামবিহীন আমার দুটি পা
হাড় পচে গেছে প্রায় এক যুগ আগে
হাড় ক্যালসিয়াম ছাড়া পা আর কীভাবে দাঁড়াতে পারে ডাক্তার?
আমার হাতের কলমের সবটুকু কালিই তো রাজার কথা বলে—
রাজা মস্ত ভালো লোক, রাজার কোনো পাপ নেই
রাজা মস্ত বড় প্রাণী, রাজা ঈশ্বরের সমান
আগুন দেখতে দেখতে আমার ক্লান্তি এসে গেছে।
আমি মরে গেলে চিতায় তুলো না আমাকে
চিতায় যে খায় ঘুমায় তাকে আর চিতায় তুলে কী হবে?
চিতার আগুনে সিগ্রেট ধরালে নাকি অনন্তকাল সে সিগ্রেট নেভে না
অন্য কোনো কথা বোলো না, রাজার মন খারাপ হবে
বাসে চড়িয়া মরদ হাঁটিয়া চলিল
৫.
মহান যা কিছু, থাকে নিম্নভূমিতে
অজস্র ঝরনার জল সাগরপানে ধায়
একটি ছোট্ট শিশু সর্বদা ঘুমায় তার মায়ের বুকে
এই যে জ্যৈষ্ঠ মাস শাখায় ঝুলছে থোকা থোকা আম
মাটির গভীরে প্রোথিত যার প্রাণ
শিকড় কখনও করে না বড়াই
গুরু সর্বদা চুপ থাকেন, শিষ্য শিশুর মতোই চঞ্চল
তিনি মগ্ন থাকেন ধ্যানে, স্পর্শ না করেই সবকিছু ছুঁয়ে দেন
প্রকৃত যে নেতা, শোভিত মঞ্চের হন না প্রত্যাশী
যিনি ভণ্ড, প্রয়োজন পড়ে তার ঢাকঢোলের
কিছুই না কোরে প্রচার করে সবকিছুর
মহান সাধক শস্যের পিতা কৃষক অহংকার করেন না তাঁর কর্মের
বরং বিনয় আর সরলতাই যাঁর অলংকার
এই কথাগুলো জানতে আমার তিন যুগ কেটে গেছে
৬.
যদিও সত্তায় মৃত
তথাপি দাঁড়িয়ে আছে মানুষের মতো মূর্তিমান রূপে এক পিশাচিনী
চারপাশে ঘূর্ণায়মান সে, এবং সমাহিত শবের মতো একাকী
ভয়ের শিহরন জাগায় আড়ষ্ট হয়ে আছি কাঠের ঘোড়ার ন্যায়,
বেল টিপলেই কেবল চিঁহিঁ স্বরে কেঁপে উঠি ক্ষণকাল
পুনরায় ফিরে আসি বোধহীন ভাষাহীন অ-বিপ্লবী পরাধীন নিশ্চল পাথরের
ন্যায়
কানের খুব নিকটে বাজাও দামামা
নয়তো ইসরাফিলের শিঙার ন্যায় ফুৎকারে টুটাও শীত-নিদ্রা
নয়তো আরও বিপুল ভর্ৎসনায় ছুঁড়ে মারো
চামড়ায় বারুদের আঘাত করো—
প্রজ্জ্বলিত হোক এ শরীরের স্তব্ধ শিরা-গ্রন্থি মগজ ও মননের মূলে
ফুটুক নতুন কুসুম
প্রচ্ছদচিত্র সৌজন্য: www.pinterest.com