জলের মিনার ও অন্যান্য কবিতা


১.
খুদকানা

গাছভর পাখি হয়েছে। মাঝে মাঝে ছিটকে ছিটকে উড়ছে নীল ফটিকে।
যেন সুতোধরা বেলুন একেকখানা।
আলো, কাঁচা পয়সার গড়ানো ফল।
কুড়োতে গেলেই জলে গুলে খুন।
যেমন যায়!
মাদুর ঘাসের বোলতা ফুল হাওয়াকে টাঙ্কি মারছে।

বিরাট ইয়ার্কি দিনভর।

কী হবে ভেবে আর। সন্ধ্যার ভেতর তো যেতেই হবে।
বর্ষায় ভাসবে চাঁদের ফসল, আর আমি খুদকানা।
দু-একটা জোনাকি তারার মতোই বলতে চাইবে।
যেমন চায়!




২.
জলের মিনার

ভাঙা ঘাটে আরেকটু বসি। লাল রং ফিকে হচ্ছে আকাশে।
পুটুসের ঝাঁঝালো গন্ধে কত কী যে মনে এল!

আরেকটু বসি মহলাবাড়ির বউ!

স্তনের ওঠানামায় তুলসীথানের আলো কাঁপছে,
বাতাবির বনে জোনাকির তুমুল শিহর।
একটু পরেই নিতম্বের মতো চাঁদ উঠবে,
চাঁদমালা ভেসে যাবে জলের জোছনায়।
ওপারে আঁশফল বনে কার ভীরু চোখ জ্বলে আর নেভে!

আরেকটু বসি!
কাল কোনো কোম্পানির মঠ এসে এইসব তুলে নিয়ে যাবে।




৩.
অমৃতেরা

ঠাকুমার হামানদিস্তাটার কথা মনে পড়ল আজ। মনে পড়ল, ললিতাপিসির কুলগাছে ছাওয়া মেটে ঘরের পুরোনো পালঙ্ক আর তামাকের কড়া গন্ধ। সেই কবেকার সবেদা গাছের ডালে বাঁধা কাপড়ের পুঁটুলি দুলে উঠল আজ সকালবেলায়?

আমাদের এখানে কোনো নদী নেই। ছেঁড়াখোড়া নোনামাটি। কদাচিৎ নিশিন্দা, রেড়ি, শিয়ালকাঁটার বেড়ে পড়ে থাকা চরের বালিতে অভ্রনীল আকাশ চিকচিক করে। কাঁচপোকা, ডোরাকাটা ফড়িং ওড়ে বন টেপারির ফলে। লাল রাঙচিতার বনে দোল খায় দুর্গাটুনটুনি। এখানে মাটি খুঁড়লেই দু-একটা ডিঙির পাটাতন, করোটি, হাড়।

লুপ্ত এই নদীর ভেতর অমৃতেরা সবুজ হয়ে আছে!




৪.
মাঠের সভায়

মাঠের অদূরে এক হেলে পড়া টরেটক্কা ক্রুশের ফসিল,
তার পাশে কাকেদের জমাটি লোকসভা।
শোকসভাও কি হতে পারে?
কারণ, কাছেই ডানা ছড়িয়ে আছে মৃত, নীল একজন,
খিদের আঘাত সারা গায়ে।

কী কী চর্চা হলো আজ?
নগরের হামাগুড়ি কিম্বা বাতাসের অচেনা চলাচল,
নাকি প্যারিস কাগজে লেখা বিপদ নিয়েও কিছু কিছু?
কিন্তু ওই যে ছড়িয়ে আছে ডানা,
তার কথা কি উঠল একবারও?
বলল কি কেউ: ছিনিয়ে খায়নি কেন?

নাকি এসব শুধুই প্রান্তরের ব্যর্থ হাঁকাহাঁকি?




৫.
আহ্নিকের নিয়ম

ধাড়া-পাড়ার জেলেরা সেই কবে কী কারণে বলেছিল,
পৃথিবী ঘোরে কেন, কীসের জ্বালায়!
সে-কথা শোনার পর আমার মনে হয়েছিল,
প্রবচনের উত্তরটি ঈষৎ বদলে গেছে রঙ্গে, বাঁকা হতে হতে।
যদিও লোকলব্জ পায়ুকামের বেদনাকেই ইঙ্গিত করেছে তীব্রতা হেতু।
আবহমানের তারা নিজেকে আরশি করে দুনিয়া দেখেছে চিরকাল,
আর চিরকালই যন্ত্রণা রসের ভাষায় গূঢ় হয়ে ঢেকেছে প্রকৃত।
তাগিদ আসলে নাভিমূল। সব তাড়নার সহস্রারে বসে আছে সে-ই চক্রাকার।
সে-ই অফুরন্ত জল। শস্যজন্ম। তার থেকে বীর্য, প্রাণ নিরন্তর আহ্নিকে বহমান।
সে ক্ষুধাই আগাছা-নিড়েন, রাজার হাওদায় হুল, আগুনগুলান;
আলো আঁধারির নিরন্তর ওঠাপড়া।
এখানে শুধু অপভ্রংশ গাঁড়, গূঢ়-ভাবে চক্র-মণিপুর।
ক্ষুধাই লিঙ্গরূপে এ অর্থে প্রবিষ্ট বেদনা।
পৃথিবী ঘোরে তাই গুহ্যরূপ নাভির আগুনে!




৬.
শূন্যের অলৌকিক ডালপালা

সারাদিন রং বদলায়নি আকাশ। বোঝা যায়নি কখন বিকেল গড়াল।
এখন বৃষ্টি নেমেছে। জলের তীব্র রোঁয়া ঠেলে ফিরে যাচ্ছে দুটো কানিবক।
অবাক হয়ে দেখছি, তারা থামল না কোথাও, একবারও!
শিরার ভেতর কোনো আশ্চর্য সময়ের ঘড়ি তাদের তাড়িয়ে নিচ্ছে খড়কুটো ডিমের
নিশানায়।

এই ক্ষণলুপ্ত আলোর ভেতরেও কোনো অলৌকিক কাঁটা ঘুরে যাচ্ছে ঠিক?

আবার যখন ভোর হবে, তখন মেঘের আঁধার ভেঙে তাদের শ্বনন পেন্ডুলামের মতো
আকাশে আকাশে বেজে উঠবে।

টের পাচ্ছি, প্রকাণ্ড গণিতের অলৌকিক ডালপালা বুনে আছে আমারও শরীরে,
মনে হচ্ছে, অঙ্কের নিজস্ব ধাঁধায় ভেতরে কোনো এক রহস্যময় শূন্য বারবার ডেকে ডেকে
উঠছে।




প্রচ্ছদচিত্র সৌজন্য: www.pinterest.com