[আন্ডারগ্রাউন্ড বা ইন্ডিপেন্ডেন্ট সিনেমার ইতিহাস শতবর্ষ প্রাচীন। তবে ১৯২০ পরবর্তী সময়ে সিনেমায় স্টুডিওর বাইরে বেরিয়ে কাজ করার প্রবণতা যে বেড়েছিল তা বলা বাহুল্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ফরাসি নিউ ওয়েভও বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে যে কারণে। ‘ব্রেথলেস’ সিনেমার ষাট বছর পূর্তিতে, আমরা ফিরে পড়লাম, ২৫ বছর পূর্বে লেখা, ইন্ডিপেন্ডেন্ট সিনেমার ইতিহাসের সামান্য এক অংশ। আন্ডারগ্রাউন্ড বা ইন্ডিপেন্ডেন্ট সিনেমা বলতে কেবলমাত্র তথ্যচিত্র যে বোঝায় না তা বলা বাহুল্য।]
আন্ডারগ্রাউন্ড শব্দটি সিনেমার ভূগোলে বহুল পরিচিত একটা চিন্তা হিসাবে উপস্থিত। এই শব্দটির নানা ব্যাখ্যাও দিয়েছেন ছবিকরিয়েরা। কোনো কোনো ব্যাখ্যা, আবার শ্লীল বনাম অশ্লীল বিতর্কের আবর্তে জড়িয়ে যায়। প্রগতিশীলতার নিরিখে আন্ডারগ্রাউন্ড শব্দটির সঙ্গে যেসব শব্দের অনুষঙ্গ মনে আসে তা হলো সেন্সরশিপ, ছাড়পত্র না পাওয়ার বিষয়টি, ছবি প্রদর্শনের অসুবিধে, সরকারি হয়রানি ইত্যাদি ইত্যাদি। আন্ডারগ্রাউন্ড ছবি সম্বন্ধে আরও একটা সংজ্ঞা চালু আছে। তার অন্তর্বস্তু হচ্ছে এস্টাব্লিশড মেইনস্ট্রিম সিনেমার প্রচলিত প্রণ্যাসের বিরুদ্ধে পালটা একটা প্রচেষ্টা গড়ে তোলা। এই ধারার প্রবক্তাদের মতে সিনেমা নামক কলাটি আর পাঁচটি কলার মতন, নাগরিকের ধরাছোঁয়ার মধ্যে, কবিতা, গল্প লেখা বা ছবি আঁকার মতন আরেকটা ব্যাপার মাত্র। একজন চিত্রকর, ভাস্করের সঙ্গে ছবিকরিয়ের কোনো পার্থক্য থাকতে পারে না। এই বোধের থেকেই আন্ডারগ্রাউন্ড মুভমেন্টের জন্ম। প্রথম ধারার ছবি মূলত লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা বা উন্নতকামী দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ আর দ্বিতীয় ধারা উত্তর আমেরিকা, চলচ্চিত্রে নব্যধারা, যা চল্লিশের দশক থেকেই সক্রিয় সপ্রাণ আন্দোলন হিসাবে উপস্থিত।
লাতিন আমেরিকার প্রত্যেকটি শহরে মানবাধিকার রোজ লঙ্ঘিত হয়। সাধারণ মানুষের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে রোষ দানা বেঁধে ওঠে। লাতিন আমেরিকার ছবিকরিয়েরা তাদের সে পুঞ্জীভূত মূক ক্ষোভকে সেলুলয়েডে মূর্ত করেন, ভাষা দেন। সরকারও সরাসরি ঘোষণা করেন, ‘Only authorised films are works of art’—পক্ষান্তরে, ‘anti authorised art’ নির্মাণে সরকারের জেহাদের মুখোমুখি হতে হয়। নির্মাণ পদ্ধতি নিজস্ব তাগিদে জঙ্গিরূপ নেয়।
আর্জেন্টিনার বিশ্ববরেণ্য ছবিকরিয়ে ফার্নান্দো সোলানাসের তিন পর্বের ‘আওয়ার্স অফ ফারনেস’ (Hours of Furnace) আর্জেন্টিনার এক জীবন্ত দলিল। দীর্ঘ এই প্রযোজনাটি দেখতে দেখতে কলকাতা শহরেই ভয় করে। এই ছবি নির্মাণের পিছনে কতখানি ঝুঁকি থাকে তা সহজেই ধরা পড়ে। সমকালীন আর্জেন্টিনার রাজনৈতিক-সামাজিক জীবন, কমিউনিস্ট পার্টির ইতিবৃত্ত সেলুলয়েডে বন্দি হয়। সোলানাস বা সোলানাসের উত্তরসূরীরা আন্ডারগ্রাউন্ড ছবি তৈরি করে চলেন। তাঁদের নির্মিত ছবি আর্জেন্টিনা সরকারকে ভীত, উন্মাদ করে তোলে।
আলফানসো গুমুসিয়ো ডাগ্রন (Alfonso Gumucio Dagron) তাঁর ‘Cine, Censura Y exilloen America Latina’ (সিনেমা, সেন্সরশিপ ও এক্সাইল ইন লাতিন আমেরিকা) প্রকাশনায় বলিভিয়ার সিনেমা সম্বন্ধে বলতে গিয়ে লিখছেন, ‘Cinema there was born under the burden of censorship and grew with the weight upon it throughout its short and exemplary history.’—বলিভিয়ার ফিল্ম আন্দোলনের ইতিহাস ক্ষুদ্র হলেও তা দৃষ্টান্তমূলক এবং তা বেড়ে উঠেছে সরকারি সেন্সরশিপের চাপের মধ্যে। ইয়োরোপীয় লাতিন আমেরিকার বিষয়ে নির্মিত ছবিকেও মার্কিন পরিবেশকের সার্টিফিকেট নিয়ে বলিভিয়ায় পৌঁছতে হতো। সেন্সরশিপের কবলে পড়ে বলিভিয়ান ছবিকরিয়েরা ক্যামেরা নিয়ে প্রকাশ্যে চলাফেরা করতে পারেন না, তাদের তৈরি সিনেমাও দেখাতে পারেন না।
বলিভিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাস খুব জটিল। ১৯৭৮ থেকে ৮০-র মধ্যে তিন বছরে তিনটি সামরিক অভ্যুত্থান হয়। রাজনৈতিক জীবন এমন অবস্থায় পৌঁছোয় যে বুদ্ধিজীবীরা আর নিরাপদ থাকতে পারেন না। তাঁরা তৈরি করেন বলিভিয়ান ফিল্ম মেকার্স অ্যাসোসিয়েশন আর বলিভিয়ান ফিল্ম ক্রিটিক্স অ্যাসোসিয়েশন।
অ্যালেন ল্যাবরুস (Alaen Labrouse) টিন কারখানায় কর্মরত পাঁচজন মহিলা শ্রমিকের অনশনের ঐতিহাসিক ঘটনাকে সেলুলয়েডে ধরে রাখেন। এই ঘটনাই জেনারেল বানঝেরের পতন ঘটায়। ১৯৭৯ সালে কর্নেল আলবার্তো নাট্শ বুশ (Colnel Alberto Natusch Busch)-এর নেতৃত্বে এক সামরিক অভ্যুত্থানে বলিভিয়ার রাস্তায় তিনশো জনের নরসংহার ঘটে। পেদ্রো সুজ় (Pedro Susz) তাঁর বিখ্যাত ডকুমেন্টারি ‘কেন এই রক্তপাত?’ (Para que la sangre)-এ, এই ঘটনাকে বিধৃত করেন। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে ১৯৮০ সালে এই ধরনের ছবির ওপর সরকার নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এখন বলিভিয়ায় ক্যামেরা হাতে নেওয়া রিভলবার তুলে নেওয়ারই নামান্তর। মিলিটারিদের মতে ক্যামেরার অগ্নুৎপাদনের শক্তি মেশিনগানের থেকেও বেশি।
একজন ভারতীয় চিত্রপরিচালকের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে বলিভিয়ান ছবিকরিয়ে জর্জ স্যানজিনেস (Jorge Sanjinés) বলেছিলেন, “বলিভিয়া একটি গরিব দেশ। এখানকার মানুষজন নানা টানাপোড়েনের মধ্যে সিনেমা দেখে। তাই আমরা সিনেমা দেখাটাকে উদ্দেশ্যমূলক করে তুলতে চাইছি। দেশের জনগণ সিনেমার মাধ্যমে তার রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক ঘটনার কথা জানুক—এটাই আমাদের প্রচেষ্টা।”
চিলিতে মিলিটারি শাসনের সময়কালে ডেভিড ভেরা মেজিস (David Vera Meiggs) ‘ডেলাগাডিনো’ (Delagdino) তৈরি করেছিলেন। আশ্চর্যের বিষয় এই ছবি করতে ডেভিড হস্তশিল্পের শ্রমিকদের থেকে সরাসরি সাহায্য পেয়েছিলেন।
লাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশে সশস্ত্র সংগ্রামের দীর্ঘ ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও চিলি ভেবেছিল শুধু গণতান্ত্রিক শান্তিপূর্ণ উপায়েই বিপ্লব হবে। কিন্তু চিলিতে আলেন্দে সরকারের পতন ও সামরিক অভ্যুত্থান প্রমাণ করে দিয়ে গেছে সশস্ত্র সংগ্রাম ছাড়া সশস্ত্র শত্রুর মোকাবিলা অসম্ভব। প্যাট্রিশিও গুজম্যান পরিচালিত ‘দ্য ব্যাটল অব চিলি’ ওই অবিস্মরণীয় রাজনৈতিক মহাকাব্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়টি আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরে। আলেন্দের নির্বাচনী বিজয়ের পর মৃত্যুবরণ পর্যন্ত চিলির শোষক ও শোষিতদের মধ্যে যখন যেমন লড়াই হয়েছে তারই ছবি ধরে রেখেছেন পরিচালক। তিনি মানুষকে দিয়ে কথা বলিয়েছেন নিজে বিশেষ কিছু বলেননি। একজন গ্রন্থিক আছেন, কিন্তু তার চাইতেও বেশি বাঙ্ময় সাধারণ মানুষের সাক্ষাৎকার। বিপ্লবের সংগ্রাম সশস্ত্র হবে না শান্তিপূর্ণ হবে। এই পদ্ধতিগত বিতর্কে পরিচালক নিজের রায় দেননি; শুধু দেখিয়েছেন আজকের দুনিয়ায় প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি কতটা হিংস্র হয়ে উঠতে পারে এবং নিরস্ত্র জনতা কতটা লড়াই করার ক্ষমতা রাখে। দক্ষিণপন্থীদের নীরব করে রাখতে পারতেন পরিচালক কিন্তু তিনি তাদের বক্তব্য রাখার সুযোগ দিয়েছেন। গুজম্যান এক নূতন মান রচনা করেছেন এই মননশীল উদারতা দেখিয়ে। যেখানেই সভা, যেখানেই মিছিল সেখানেই উপস্থিত গুজম্যানের ক্যামেরা ও সাউন্ডম্যান। কর্মরত শ্রমিকের কথোপকথন। এমনকি, ‘আমার এখন কথা বলার সময় নেই।‘—এমন ভঙ্গিতে যে শ্রমিকটি অগ্রাহ্য করে কাজ করে, তাকেও সঠিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মিছিলের ছবিতে যে এত বৈচিত্র্য থাকতে পারে, মিছিলের মুখগুলো যে এতটা বাঙ্ময় হতে পারে তা ‘দ্য ব্যাটল অব চিলি’ না দেখলে বিশ্বাস করা শক্ত। যে শটের কথা না বললে লাতিন আমেরিকার ছবির পৃথিবী সম্পূর্ণ হয় না সেটা হচ্ছে সেই উৎসর্গীকৃত মহৎপ্রাণ ক্যামেরাম্যানটির কথা, যিনি ছবি তুলতে গিয়ে সামরিক অভ্যুত্থানের গুলিতে নিহত হন। সেই ছবিটি ‘দ্য ব্যাটল অব চিলি’র প্রথম খণ্ডে ও দ্বিতীয় খণ্ডের শুরুতে যুক্ত করে পরিচালক ছবিটিতে এক অসামান্য মাত্রা এনেছেন।
এবার আসা যাক আন্ডারগ্রাউন্ড ছবির অন্য সংজ্ঞায়, যেটা মোটামুটিভাবে উত্তর আমেরিকায় সীমাবদ্ধ। জোয়ান মেকাস (Joans Mekas) নিজেকে আন্ডারগ্রাউন্ড আন্দোলনের দিশারী বলে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাঁর ছবির কথা ইয়োরোপে বিশেষ জানা নেই। সিনেমা প্রণ্যাশের কৌলীন্যকে ভেঙে এই প্রথম সাধারণের হাতে সিনেমাকে পৌঁছে দেওয়ার প্রয়াস ঘটে। সিনেমাকে যৌথ প্রচেষ্টা থেকে একান্তভাবে একক প্রচেষ্টায় রূপান্তরিত করার মধ্য দিয়ে মুক্ত ছবির নির্মাণ-কাণ্ডের শুরু। হলিউড বাতাবরণে মেকাসের এই চেষ্টাকে ‘উগ্রবাদী’ চিন্তা বলে অভিহিত করা হতে থাকে। অনুপুঙ্খ ভাবে লক্ষ করলে দেখা যায় এই প্রচেষ্টা সিনেমাকে গণমাধ্যমের হাতিয়ার হিসাবে স্বীকার না করার প্রবণতার জন্ম দেয়। যৌথ থেকে একক চিন্তায় নিয়ে আসে।
‘Cahiers du Cinéma’ পত্রিকায়, মেকাস ফরাসি নিউ ওয়েভ ছবির প্রশংসা করে জাঁ রচ (Jean Rouch’s)-এর ‘Moi, Un Noir’ (I, a Negro) ছবিটিকে নব্য আমেরিকান ছবির মডেল হিসাবে উল্লেখ করেন। অর্থাৎ ‘Moi, Un Noir’ আন্ডারগ্রাউন্ড আন্দোলনের মডেল ছবি। অবশ্য জন ক্যাসাভেটের (John Cassavetes) ‘Shadows’ ছবিটিকেও তিনি অতি উচ্চমানের আখ্যা দিয়ে বলেছিলেন, এ ছবির ভাষা, অবস্থান, ক্রিয়াপ্রণালী তাজা বাতাসের মতো এবং একেই বলা যেতে পারে স্বতঃস্ফূর্ত ছবি নির্মাণের দিশারী। এই ছবির মধ্য দিয়ে ছবিকরিয়ে পূর্বনির্দিষ্ট কিছু আকাঙ্ক্ষাকে প্রতিভাত করেননি। দর্শক নিজের মতো করে, নিজের বিচার বিবেচনায় ছবিটির বক্তব্যকে ধরতে পারে, উপলব্ধি করতে পারে, নিজের মতো করে নিজের প্রশ্নের উত্তর খুঁজে নিতে পারে।
চিত্রকর আলফ্রেড লেস্লি আর আলোকচিত্রী রবার্ট ফ্র্যাঙ্ক-এর যৌথ ছবি ‘পুল মাই ডেইজি’ (Pull my daisy) ছবিটিকে বিশ্লেষণ করে মেকাস বলেন, জ্যাক কেরুক (Jack Kerouac)-এর অভিনয় না হওয়া একটা নাটকের স্বতঃস্ফূর্ত ও মুক্ত প্রযোজনা।
ছবিতে গ্রিনউইচ গ্রামে এক যুবকের সঙ্গে বিশপ এবং তার প্রখ্যাত কবিবন্ধুরা সাক্ষাৎ করতে আসেন। কবি বন্ধুদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন আলেন গিনস্ব্যার্গ, পিটার ওরলক্সি, গ্রেগরি বার্স। তাঁরা আলোচনা করেছেন, তর্ক করেছেন, বাঁধনহারা কথা বলেছেন। কেরুক (Kerouac) প্রত্যেকের কথা বলেছেন, তাঁদের ক্রিয়াপদ্ধতি খোলাখুলি ব্যাখ্যা করেছেন। পূর্বনির্দিষ্ট ছক ছাড়াই কেরুক ধারাভাষ্য তৈরি করেছেন। ‘পুল মাই ডেইজি’ ছবিটির কোনো ছক ছিল না, কোনো গাণিতিক ছন্দ ছিল না। একটা প্রজন্মের একটা গোপন দলিল। যুবকেরা সজ্ঞানে বা অজ্ঞাতসারে ব্যবসায়িক মনোবৃত্তিকে, মধ্যবিত্তের মধ্য-মানসিকতাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন এ ছবিতে। কোনো কপটতা নেই, কোনো মিথ্যাচার নেই, কোনো জ্ঞানদানের বিষয় নেই। ক্যামেরাকে আভিজাত্যের গণ্ডি থেকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন মেকাস। তাঁর এই চিন্তাকে স্ট্যান্লি ব্রাকেজ (Stanley Brakhage) তাঁর ছোট্ট ছবি ‘ডেসিস ফিল্ম’-এ মূর্ত করেছিলেন। যুবকদের একটা প্রাণোচ্ছল পার্টিতে তাদের স্বতঃস্ফূর্ততা, তাদের যৌবনের উন্মাদনা তাদের নিজেকে প্রকাশ করার অদম্য আকাঙ্ক্ষাকে ব্রাকেজ সেলুলয়েডে ধরে রেখেছিলেন।
চিত্রগ্রহণ হয়েছিল সত্যিকারের এমন একটা পার্টিতে, যেখানে পাত্রপাত্রীরা জানতেনই না যে তাদের নিয়ে সিনেমা হতে চলেছে। তাদের প্রতিটি খুঁটিনাটি আন্তরিক মুহূর্তগুলোকে তুলে রাখা হয়েছে। তাদের ছোটো ছোটো অভিব্যক্তিকে ক্যামেরা যত্ন সহকারে ধরে রেখেছে। ছবিটার উত্তাপ তার জঙ্গমত্বে, ছবিটার বিশেষত্ব তার অপ্রস্তুততায়, ছবিটার অভিনবত্ব তার স্বতঃস্ফূর্ততায়। তাই ছবিটা লিরিক্যাল। অনেকটা রেমব্যান্ডের কবিতার লাইন। ছবিটার মধ্যে বাস্তব ও শিল্পের সঠিক দূরত্ব বজায় রাখা হয়েছে।
নব্যধারার আন্দোলন গড়ে উঠেছে নৈতিকতার আধারে, নান্দনিক বোধে জারিত হয়ে নয় মাত্র। এই ধারার ভিত্তিভূমি স্বতঃস্ফূর্ততায়, কঠিন অনুশাসনে নয়। চিত্রকর, নৃত্যশিল্পীর মতোই ছবিকরিয়েরা ছবিকে ধরতে চায় মুক্ত মনে, গতানুগতিকতায় নয়। কোনো ঘটনার পৌনঃপুনিকতা নয়, আবেগের, অনুভূতির ফলশ্রুতি হিসাবে। সুজ়ুকির ভাষায় আন্ডারগ্রাউন্ড ছবিকরিয়েরা জীবনকে জীবনের মধ্য থেকেই ধরতে চায়, জীবনের বাইরে গিয়ে নয়। ১৯৬০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ন্যু আমেরিকান সিনেমা গ্রুপের জন্ম। এই গ্রুপে একে অপরকে সহযোগিতার হাত বাড়ায় যাতে সবাই ছবি করতে পারে, ছবির পরিবেশন হতে পারে।
১৯৬২-তে ফিল্মমেকার্স কোঅপারেটিভ হয়। আরও ছবিকরিয়েদের সদস্য হবার জন্য আহ্বান জানানো হয়। যে-কোনো ছবিকরিয়ে যে-কোনো মুহূর্তে তাদের ছবি তুলে নিতে পারে। কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। লাভের ৭৫% প্রযোজক পায়। ছবিগুলি কলেজে, ইউনিভার্সিটিতে, আর্ট গ্যালারিতে পরিবেশনের জন্য পাঠানো হয়। এই ছবিকরিয়েরা আশা করে আগামী দিনে তারা বছরে তিনশো ডলার রোজগার করতে পারবে। কোঅপারেটিভ আশা করে যে, ভবিষ্যতে ছবিকরিয়েদের টাকা ধার দেবে। অনেক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও মেকাসের কল্পনা আজ বাস্তবায়িত। স্বাধীন ছবি তৈরি করা যায় বা স্বল্প বাজেটে ছবি হয় এই ভাবনাবৃত্ত আজ বাস্তব। নিগ্রো ছবিকরিয়েরা কোঅপারেটিভ মারফত ছবি করেন। তারা কীভাবে আমেরিকাকে দেখেন, তা নিয়ে ছবি করেন। কেউ বাধা দেবার নেই, তারা ছবি করেন মুক্ত মনে, স্বাধীন ভাবে।
স্ট্যানলি ব্রাকেজ আন্ডারগ্রাউন্ড ছবির একজন বিশেষ ব্যক্তিত্ব। তিনি কোথাও কোনোদিন আত্মসমর্পণ করেননি। ব্রাকেজ চিৎকার করে বলেন যে, সমস্ত কিছু দেখা প্রত্যেক মানুষের অধিকার। তাই সমস্ত কিছুকে নিয়েই তিনি ভাবনা করতে পারেন। অনেকে তাকে এবেল গান্স (Abel Gance) আর আন্তোনিওনির সংমিশ্রণ বলে ভাবেন। তিনি যুক্তির দর্পণে নিজের কাছে প্রশ্ন রাখেন, আবার যুক্তি দিয়েই তাকে খণ্ডন করেন। অনেকের ধারণায় ব্রাকেজের চিন্তাই আগামী দিনের আন্ডারগ্রাউন্ড ছবিকে প্রভাবিত করবে। যদিও গ্রেগরি মার্কোপুল্স (Gregory Markopoulos) ও ধ্রুপদি ছবি করিয়ে কেনেথ অ্যাংগের (Kenneth Anger) স্ট্যানলির সমকক্ষ। গ্রেগরির ছবি—‘Twice a Man’ ১৯৬৩ সালে ‘ফেস্টিভ্যাল অফ এক্সপেরিমেন্টাল ফিল্মস্’-এ গ্রাঁপ্রি পায়। এই তিন মূর্তির উপস্থিতি আন্ডারগ্রাউন্ড ছবির জগতে এক মাইলস্টোন।
ভারতবর্ষে এই আন্দোলনের খবর সরাসরি এসে পৌঁছোয় না। মাধ্যমের নানা অনুশাসন ডিঙিয়ে, বিভিন্ন সূত্রের মধ্যবর্তিতায় গোটা পৃথিবীর ছবির খবর চুঁইয়ে চুঁইয়ে আসে। যেমন এসেছে, আলফানসো গুমুসিও ডাগ্রন, অ্যালেন ল্যাবরুস, ডেভিড ভেরা মেজিস, স্ট্যানলি ব্রাকেজ, মার্কোপুল্স, অ্যাংগের প্রভৃতির কথা। এ মুহূর্তের খবর, সে-ও আসতে একটু সময় লাগবে, আমাদের অপেক্ষা করে থাকতে হবে।
১৯৮২ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে ‘Cahiers du Cinéma’ পত্রিকার, ৩৩২ সংখ্যায় একটা খবর বেরিয়েছিল—“The third World Film Festival will be held in Paris from 3rd March to 24th March, 1982. Films of Africa, Asia and Latin America will be shown in the Festival. There will be 150 films of 35, 16, super 8 mm and a Retrospective of Mrinal Sen’s films will also be screened.”
ওই খবরের একটাই তাৎপর্য যে, তৃতীয় দুনিয়ার ছবির সঙ্গে ভারতবর্ষের যোগসূত্র মৃণাল সেনের ছবি। সেই যোগসূত্র আজ স্মৃতি। তেমনি স্মৃতি হয়ে গেছে একটা সংগঠন—‘The peoples Cinema Society of India’ যে সোসাইটির লক্ষ্য ছিল—“at making low budget films in 16 mm, super 8 mm format and opening up new channels of exhibition in 16 mm through trade unions, village panchayats, student and youth organisations, group theatres, film societies, writers and artists association to break the monopoly racket of big money in production distribution and release.”
এই দুটো খবরের মধ্য থেকে একটা সূত্র উঁকি দেয়। আন্ডারগ্রাউন্ড সিনেমার যে দুই ধারার কথা আলোচনা করা হলো তার সঙ্গে ভারতবর্ষের মেইনস্ট্রিম ছবিকরিয়েদের একটা অস্পষ্ট যোগসূত্র ছিল। সেই যোগসূত্র আজ অতীত। বর্তমানের ছবিকরিয়েরা সেই ছিঁড়ে যাওয়া যোগসূত্রকে আবার নতুন করে উজ্জীবিত করতে পারেন। এখনও ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্যে এই ধরনের স্বাধীন ছবি, বিকল্প ফরম্যাটের ছবির নির্মাণ ঘটে চলে। মেকাস, ব্রাকেজ তাদের কাছে পরিচিত না হতে পারেন। কিন্তু তারাও কোনো আত্মসমর্পণ করেন না, আমাদের মতো বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাষ্ট্রযন্ত্রের পীড়নের তোয়াক্কা না রেখেই চলেন। সে সব ছবিতে নির্মিতি বোধের সৌকর্য না থাকতে পারে কিন্তু সে ছবিগুলো তরল, স্যাঁতসেঁতে গতানুগতিক নয়। সেই ছবির ময়দানের ব্রাত্যজনেরা হারিয়ে যাওয়া যোগসূত্রটা খুঁজে নিতে পারেন। নিশ্চয়ই পারবেন একদিন।
সূত্র :
Index of Censorship: Alfonso Gumucio Dagron.
The underground, Myth and Reality: Louis Marcorelles New Direction in Contemporary film making.
The Low down on super 8 education: Leny Lipton.
Super 8 Delayed, Super 8 Denied: Soumen Guha.
গুপ্ত বিস্ফোরণ, বব কাবিং, অনুবাদ অমলকান্তি ভট্টাচার্য।
মার্কিনি চলচ্চিত্র নব্যধারা, অনুবাদ পবিত্রবল্লভ
দ্য ব্যাটল অফ চিলি, দীপেন্দু চক্রবর্তী।
Screen, June 19, 1981, Indian Super 8 Film Festival ’83, (organised by Jadavpur University Film Society Chitra Chetana.)
প্রথম প্রকাশ : ‘সত্তর দশক’, ২৫ বর্ষ, ১৯৯৫।
প্রচ্ছদ চিত্রে : প্যাট্রিশিও গুজম্যান ও জর্জ মুলার। প্রচ্ছদ সৌজন্য : kinocaviar.com